কলিকাতার ইতিহাস/নবম অধ্যায়
নবম অধ্যায়।
মুদ্রাযন্ত্র বা সংবাদপত্র।
যে সমস্ত কারণ প্রভাব বিস্তার করিয়া আধুনিক সভ্যতাকে বর্ত্তমান পথে পরিচালিত করিয়াছে, তন্মধ্যে সংবাদপত্র অন্যতম প্রধান কারণ। সংবাদপত্রের প্রভাবের পরিমাণ ও ইহার যথোচিত স্থান নির্ণয় করা একান্ত দুঃসাধ্য। অনেকে বলিয়াছেন, “সংবাদপত্র রাজ্যের চতুর্থ বল।” বোধ হয়, ইহার শক্তি তদপেক্ষাও অধিক। লাটিন ভাষায় একটি প্রবাদ-বাক্য আছে; তাহার অর্থ—‘জনসাধারণের বাণীই ভগবানের বাণী।’ সংবাদপত্র সেই জনসাধারণের বাণী প্রচার করিবার ভার গ্রহণ করিয়া থাকে। সভ্যতার উন্নতির সহিত সংবাদপত্রের ইষ্টানিষ্ট-সাধনশক্তি অতি দ্রুত বেগে বৃদ্ধি ও পুষ্টি লাভ করিতেছে। ইংল্যাণ্ডের মহাবাগ্মী চেদাম যে সমস্ত প্রসিদ্ধ বক্তৃতা দ্বারা অমরত্ব লাভ করিয়াছেন, তাহার এক স্থলে সংবাদপত্রকে বায়ুর ন্যায় সর্ব্ববন্ধনমুক্ত ও অব্যাহত বলিয়া বর্ণন করিয়াছেন। এই সংবাদপত্রের রাজনীতি-সমালোচক আরাম কেদারায় অর্দ্ধশয়ান অবস্থায় আরাম করিতে করিতে রাজা, সেনাপতি, রাজমন্ত্রী, ধর্ম্মযাজক ও জনসাধারণকে স্ব স্ব কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করে না। ইহা চরিত্রহীন ব্যক্তিদিগকে চরিত্র দান করিয়া থাকে।
সংবাদপত্রের প্রকৃতি এইরূপ। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, সিসিরো ও ডিমস্থিনিস যৎকালে বক্তৃতাদ্বারা জগৎকে মুগ্ধ করেন, তৎকালে সংবাদপত্রের শক্তি বিকশিত হয় নাই। আধুনিক বাগ্মিগণকে বক্তৃতা করিতে বা প্রবন্ধ পাঠ করিতে বিস্তর অসুবিধা ভোগ করিতে হয়। কারণ তাঁহারা জানেন যে, যে নবশক্তি সদা আত্মাভিমানে মত্ত ও যাহার নিকট কোন ব্যক্তির, কোন ধর্ম্মের পরিত্রাণ নাই, সেই শক্তি অচিরে তাঁহাদের উক্তি তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিবে এবং সর্ব্বজনসমক্ষে উপস্থিত করিয়া তাহার সমালোচনা করিবে। কথিত আছে যে, “সিজারের মহিষী সর্ব্বপ্রকার নিন্দা ও সন্দেহ হইতে মুক্ত হইবে।” কিন্তু মহাপ্রভাবশালী সংবাদ পত্রের নিকট তাঁহাকেও মস্তক নত করিতে হয়; নচেৎ উহা এক সময়ে সুযোগ পাইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিবে এবং তাঁহার চরিত্রের দোষ উদঘাটন করিতে সঙ্কুচিত হইবে না। বস্তুতঃ ইহা “শিক্ষকগণকেও শিক্ষা দিয়া থাকে”। ইহাই বিস্ময়ের বিষয় যে, চারিশত বৎসর কালের মধ্যে ইহা এতাদৃশ প্রভাবসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে এবং এরূপ অনির্ব্বচনীয় ক্ষমতা পরিচালন করিতে পারিতেছে। উল্লিখিত আছে যে, প্রথম সংবাদপত্র জার্ম্মানি দেশে ১৪৯৮ অব্দে প্রকাশিত হয়।
বস্তুতঃ, অতি প্রাচীনকালে যখন শাসনবিজ্ঞান ও শাসন-নীতি অতি অপক্ক অবস্থায় ছিল, সে সময়ে প্রশংসা ও নিন্দাবাদ সাধারণ্যে প্রচার করায় যে যথেষ্ট সুফল ফলিত, তাহা বেশ বুঝা যায়, কারণ প্রশংসা প্রচার দ্বারা সৎকর্ম্মে উৎসাহ দেওয়া হইত এবং নিন্দা প্রচারে অসৎ কর্ম্মের দমন হইত। অন্যান্য লোকের ক্রিয়াকলাপের সমলোচনা ও অনুমোদন করা, অথবা তাহাতে সম্মতি দেওয়া আমাদের প্রকৃতিসিদ্ধ ধর্ম্ম। লোকে বলে, সত্য ও ন্যায় সমধিক প্রচার দ্বারাই বিলক্ষণ পুষ্টি লাভ করে। সংবাদপত্রের শিক্ষা দিবার শক্তিও বিলক্ষণ আছে, কারণ এ কাল পর্য্যন্ত জ্ঞানবিস্তারের যে সমস্ত উপায় আবিস্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে সংবাদপত্র অতি অল্পকাল মধ্যে বহুলোকের নিকট যেরূপ সত্বর বিস্তার করিতে পারে, আর কোনও উপায় দ্বারাই তেমন হয় না। ইহা জনসাধারণকে ভাব ও চরিত্র দান করে, এবং ইহা দ্বারা বর্ত্তমান সাহিত্যের যে কত দূর উন্নতি সাধিত হইতেছে, তাহা বলিয়া বলিয়া শেষ করা যায় না। জ্ঞান-জনিত সাধুতা বলিয়া যে একটা জিনিষ আহে, তাহা জ্ঞান বিস্তারের এই নবাবিষ্কৃত যন্ত্র দ্বারা বিলক্ষণ উৎকর্ষ লাভ করিষ্যছে। বস্তুতঃ ইহা বহু সংখ্যক লোকের মত গঠিত ও পরিচালিত করে এবং তাহার প্রতিধ্বনিও করিয়া থাকে। তথাকথিত “বাক্শক্তিহীন” লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত প্রজা সংবাদপত্রকেই তাহাদের স্বত্বাধিকারের প্রকৃত ব্যখ্যাকর্ত্তা ও রক্ষক বলিয়া জানে। সুতরাং ইহা যে অল্পকাল মধ্যে মানবসমাজের বিষয় ব্যাপারে এতাদৃশ প্রভাব ও ক্ষমতা লাভ করিবে, তাহাতে আশ্চর্যের বিষয় কি আছে? ইউনিভারসিটী কলেজের ভূতপূর্ব্ব অধ্যাপক হেনরি মর্লি “সংবাদপত্র প্রাচীন ও আধুনিক” এতদ্বিষয়ক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, ইহার বীজ মধ্যযুগে প্রথম রোপিত হয়। খৃষ্টীয় ১৬শ শতাব্দীতে ভেনিস নগরে কর্ত্তৃপক্ষীয়দিগের দ্বারা প্রস্তুত সাধারণের চিত্তাকর্ষক সংবাদসমূহে পূর্ণ একখণ্ড হস্তলিখিত কাগজ কোন প্রকাশ্য স্থানে উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করিবার কথা প্রচলিত ছিল। ঐ প্রথা হইতেই সংবাদপত্রের উদ্ভব হয়। পুর্ব্বোক্ত সংবাদপূর্ণ কাগজ পড়া যাহারা শুনিতে যাইত, তাহাদিগকে এক এক গেজেটা” (এক প্রকার সামান্য মূল্যের মুদ্রা) দিতে হইত; ঐ গেজেটা কথা হইতেই উত্তরকালে “গেজেট” শব্দ উদ্ভূত হইয়াছে। মলি সাহেব স্থির করিয়াছেন যে, ইংল্যাণ্ডে পূর্ব্বে বণিকগণ যে সংবাদপূর্ণ চিঠিপত্র বিদেশে লইয়া যাইতেন, তাহা হইতেই সংবাদপত্রের সৃষ্টি হইয়াছে। খৃষ্টীয় ১৬শ শতাব্দীতে জনসাধারণের চিত্তাকর্ষক বিশেষ বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে সংবাদপূর্ণ কাগজ বাহির করা হইত। ইংল্যাণ্ডে ন্যাথানিয়েল বট্লার এবং ড্যানিয়েল ডিফো “উইক্লি নিউস (Weekly News)” নামে একখানি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন। মুসলমান শাসনকালে দেশীয় রাজগণের ব্যয়ে সংবাদসংবলিত কাগজ রাজকীয় গেজেট রূপে বাহির করা হইত। ঐ সকল কাগজে সত্য ও মিথ্যা ঘটন্যর বিবরণ সত্য বলিয়া প্রকাশ করা হইত, কিন্তু তৎসম্বন্ধে কোনরূপ সমালোচনা বা মন্তব্য প্রকাশিত হইত না। ঐরূপ কাগজের নাম ছিল “আকবর”! তাদৃশ গভর্ণমেণ্টের অধীন লেখকগণের অবস্থা বিবেচনা করিয়া দেখিলে ইহা স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, ইংরেজী সংবাদপত্রের সহিত ঐ সকল আকবরের তুলনাই হইতে পারে না।
ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের ইতিবৃত্ত অতি বিচিত্র। প্রায় দুরতিক্রম্য সুবিধাসমূহের মধ্যে ইহার উদ্ভব হয়, এবং তাহার পর পদে পদে ইহাতে নানারূপ সঙ্কটে পড়িতে হয়। তখন অবস্থা এরূপ ছিল যে, কর্ত্তৃপক্ষীয়েরা ভারতে স্বাধীন মুদ্রাযন্ত্রের আবির্ভাবকে অত্যন্ত ভয় করিতেন। ফরাসীরা তখনও বিলক্ষণ প্রভাবশালী ছিল এবং দারুণ উদ্বেগের কারণ হইয়া পড়িয়াছিল। তদ্ভিন্ন কতকগুলি ইংরেজ, বিশেষতঃ খৃষ্টিয়ান পাদরিরা, দেশীয়দিগের আচার ব্যবহার, রীতি নাতি, ধর্ম্মানুষ্ঠান প্রভৃতির তারস্বরে নিন্দা করিতেছিল। ঈদৃশ অবস্থায় ইংরেজ কর্ত্তৃপক্ষীয়ের এই নব শক্তির অভ্যুদয়ের যে দারুণ ঈর্ষার চক্ষে দেখিবেন, তাহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি আছে? তৎকালে এতদ্দেশের ইংরেজ গভর্ণমেণ্ট বিলাতের এক বিশেষ সভার প্রত্যক্ষ অধীন ছিল, এবং সেই প্রভুরা এতদ্দেশীয় মুদ্রাযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা প্রদান করিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। সার্ জন্ ম্যালকম সাহেবের ভারত ইতিহাসের পরিশিষ্টে তাঁহার যে বক্তৃতা মুদ্রিত হইয়াচ্ছে, তাহাতেই এই প্রণালীর সর্ব্বোৎকৃষ্ট সমর্থন দৃষ্ট হয়। ঐ সমর্থনে অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যা। এতৎপ্রসঙ্গে উইলিয়ম ডিগবি সাহেব লর্ড হেষ্টিংসকে ভারতীয় ইংরেজী সংবাদপত্রসমূহকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করিবার সুযোগ প্রদানের নিমিত্ত প্রশংসা করিয়াছেন। পরন্তু এ বিষয়ে সার চার্লস মেটকাফই (পরে লর্ড মেটকাফ) সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মান ও প্রশংসা পাইবার যোগ্য। লর্ড উইলিয়ম্ বেণ্টিঙ্ক ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রকে স্বাধীনতা প্রদান করিতে ইতস্ততঃ করিয়াছিলেন। তিনি পদত্যাগ করিয়া গমন করিলে সার্ চার্লস্ মেটকাফ কিছুদিন তাঁহার পক্ষে আন্তরিকভাবে কার্য্য করেন এবং সেই সুযোগে সেই সংস্কার সাধন করিয়া ভারতবাসিগণের আশীর্ব্বাদভাজন হন: এই কার্য্য তিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া নিজ দায়িত্বে সংসাধন করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে মেকলে সাহেব তাঁহাকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।
১৮৩৫ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্র স্বাধীনতা লাভ করে। সার চার্লস্ মেটকাফ প্রকৃতই “ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাদাতা” নামে অভিহিত হইয়াছেন, যে মনোভাব ও প্রবৃত্তির উত্তেজনায় তিনি এই কার্য্যে ব্রতী হন, তাহা তাঁহার নিজ উক্তিতেই প্রকাশমান। তাঁহাকে যে অভিনন্দনপত্র প্রদত্ত হয়, তদুত্তরে তিনি বলেন, “জ্ঞান বিস্তারের ফলে পরিণামে ভারতে আমাদের রাজত্বের বিলোপ হইবে, ইহাই যদি উহাদের একমাত্র যুক্তি হয়, তাহা হইলে আমি এ বিষয়ে উহাদের সহিত তর্ক করিতে চাহি না, পরন্তু এই মাত্র বলিব যে, ফলে যাহাই হউক না কেন, জ্ঞান বিস্তার করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। ভারতের অধিবাসীদিগকে অজ্ঞানান্ধ করে সমাচ্ছন্ন রাখিয়াই যদি ইহাকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অংশীভূত করিয়া রাখিতে হয়, তাহা হইলে আমাদের রাজত্ব এদেশের পক্ষে অমঙ্গলের কারণ হলে, সুতরাং তাহার বিলাপ হওয়াই উচিত। * * * * আমরা যে কেবল দেশের রাজস্ব সংগ্রহ করিবার ও তদ্দ্বারা এই দেশ অধিকারে রাখিবার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করিবার নিমিত্ত এবং অনটন পড়িলে ঋণ করিয়া তাহা পূরণ করিবার নিমিত্ত এখানে আছি, ইহা কখনই হইতে পারে না। নিঃসন্দেহই ইহা অপেক্ষা বহু মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত আমরা এখানে আছি। তন্মধ্যে একটী প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, আমরা দেশের সর্ব্বত্র ইউরোপের মার্জিত জ্ঞান, সভ্যতা ও শিল্পবিজ্ঞান বিস্তার করিব এবং তদ্দ্বারা জনসাধারণের অবস্থার উৎকর্ষ বিধান করিব। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপায়।”
কলিকাতাবাসীরা এই মহোপকারের স্মরণার্থ ভাগীরথীর তীরে একটা সুন্দর অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া তাহার নাম “মেটকাফ্ হল” রাখেন। যে উদ্দেশ্যে এই অট্টালিকা নির্মিত হয়, তৎসম্বন্ধে এইরূপ লিখিত আছে, “ইহাতে একটি সাধারণ পুস্তকালয় থাকিবে এবং নানাপ্রকারে জ্ঞানবিস্তার কল্পে ইহার ব্যবহার হইবে। ইহাতে এইরূপ একটী ক্ষোদিত লিপি থাকিবে যে, স্যার চার্লস মেটকাফ্ ১৮৩৫ অব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রকে স্বাধীনতা প্রদান করেন; তদ্ভিন্ন উক্ত স্বাধীনতাদাতার অর্দ্ধ-প্রতিমূর্ত্তিও অট্টালিকা মধ্যে স্থাপিত হইবে।”
ইহার পর ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা দুইবার অস্থায়িভাবে হরণ করা হয়। একবার ১৮৫৭ অব্দে সিপাহীবিদ্রোহরূপ শোচনীয় ঘটনার সময়, এবং দ্বিতীয়বার ১৮৭৮ অব্দে লর্ড লিটনের শাসনকালে। পরন্তু এই দ্বিতীয়বারে কেবল দেশীয় ভাষায় প্রচলিত সংবাদপত্রসমূহের স্বাধীনতাই সঙ্কুচিত করা হইয়াছিল। পরে লর্ড রিপন মহোদয় ১৮৭৮ অব্দে এই বিষম পক্ষপাতমূলক অহিতকর আইন রদ করিয়া দেন।
১৭৬৮ অব্দে বোল্টস্ নামক একজন সাহেব কাউন্সিল হাউসে এবং অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানে এই মর্ম্মে একটি বিজ্ঞাপন দেন যে, “যাহাতে প্রত্যেক লোকের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, এরূপ অতি প্রয়োজনীয় অনেকগুলি কাগজ পত্র তাঁহার হাতে আছে, কোনও ব্যক্তি পাঠ করিতে ইচ্ছা করিলে তিনি সন্তুষ্টচিতে তাহা পাঠ করিতে দিবেন, আর মুদ্রণকার্য্যে অভিজ্ঞ কোন এক বা একাধিক ব্যক্তি মুদ্রাযন্ত্র চালাইতে চাহিলে তিনি সে বিষয়েও সকল প্রকার সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছেন, এবং তদ্ব্যতীত মুদ্রাযন্ত্রের আবশ্যক অক্ষর ও অন্যান্য সরঞ্জামও তিনি প্রদান করিবেন।” কলিকাতায় মুদ্রাযন্ত্রের অভাব সম্বন্ধে তিনি প্রায়ই অনুযোগ করিতেন। বষ্টিড্ সাহেব এই সমস্ত কথা লিপিবদ্ধ করিবার সময় বলিয়াছেন, “বোল্টস্ সাহেব প্রকাশ্যে এই অনুযোগ প্রকাশ করিলেও তাহার পর একাদশ বৎসরেরও অধিক কাল ঐ অভাব অপূর্ণ অবস্থাতেই থাকিয়া যায়, কারণ মুদ্রিত আকারে সাধারণ সংবাদ প্রকাশ এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম্ম ও ইউরোপীয় অধিবাসীদিগের সামাজিক অভাবসমূহ প্রচার করিবার প্রধান উপায় মুদ্রাযন্ত্র। এই মুদ্রাযন্ত্র এশিয়ার সর্ব্বপ্রধাননগর (কলিকাতা) ১৭৮০ অব্দের পুর্বে প্রাপ্ত হয় নাই।” কলিকাতায় প্রচলিত প্রথম সংবাদপত্রের নাম “বেঙ্গল গেজেট” উহা ১৭৮০ অব্দের ২০শে জানুয়ারি শনিবার (অর্থাৎ ইংল্যাণ্ডের সুপ্রসিদ্ধ সংবাদপত্র “টাইমস্” প্রকাশিত হইবার আট বৎসর পূর্বে প্রথম প্রকাশিত হয়।) ইহা প্রচারিত হইবার বিজ্ঞাপনে এইরূপ লিখিত ছিল; “রাজনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্র, সকলেরই নিকট উন্মুক্ত,কিন্তু কাহারও প্রভাব-পরিচালিত নহে।” দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থে ৮ ইঞ্চি এইরূপ দুই খণ্ড কাগজে ইহার অবয়ব গঠিত হইত; তাহার প্রত্যেক পৃষ্ঠা তিন কলাম (স্তম্ভ) করিয়া মুদ্রিত “ম্যাটার” থাকিত, তাহার অবকাশেই বিজ্ঞাপনে নিয়োজিত হইত। এতৎসম্বন্ধে এইরূপ লিখিত আছে;—“এই ক্ষুদ্র কাগজের অধিকাংশ স্থান কলিকাতার ও মফঃস্বলের পত্র-লেখকগণের পত্রে পূর্ণ হইত, তদ্ভিন্ন সময়ে সময়ে ইউরোপ হইতে যে নূতন সংবাদ আসিত তাহাও উদ্ধৃত হইত। ইহার কাগজ এবং ছাপা অতি কদর্য ছিল।” জেমস অগষ্টস হিকি নামক একজন সাহেব ইহার স্বত্বাধিকারী ছিলেন। বষ্টিড সাহেবের লিখিত বিবরণ পাঠ করিলে স্পষ্ট প্রতীতি হয় যে, উক্ত সংবাদপত্র প্রকাশ করিবার পুর্বে হিকি সাহেবকে বহু ক্লেশ ভোগ করিতে হইয়াছিল। জীবনসংগ্রামে তাঁহাকে নানাপ্রকার ভাগ্যবিপর্যয় অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। বষ্টিড, সাহেব আরও বলেন, “প্রথমে যে সকল লেখকের নামের তালিকা বাহির হয়, তাহাদিগকে ধন্যবাদ দিবার সময় স্বত্বাধিকার প্রকাশ করিয়াছেন যে, সংবাদ,পত্ররূপে হিতকর অনুষ্ঠানটিকে তিনি যদি সৌভাগ্যক্রমে সৌষ্ঠবসম্পন্ন করিয়া তুলিতে পারেন, তাহা হইলেই আপনাকে যথেষ্ট পুরস্কৃত জ্ঞান করিবেন, যে হেতু উহা অল্পকাল মধ্যে একটি অমোঘ পিত্তঘ্ন ঔষধরূপে পরিণত হইবে, কারণ তিনি আশা করেন যে, তাঁহার গ্রাহকেরা টিংচার অভ্ বার্ক, ক্যাষ্টর অয়েল বা কলম্বা রুট্ অপেক্ষা উহা হইতে অধিকতর প্রকৃত উপকার লাভ করিবেন।” এই নবজাত সংবাদপত্রের জীবনের প্রথম কয়েক মাস বেশ সুখশান্তিতে কাটিয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। ইহা সাধারণতঃ নীরস ও অনেকটা ইতর প্রকৃতির হইলেও মোটের উপর নিরীহভাবেই চলিয়াছিল। প্রধানতঃ প্রধান বাণিজ্যব্যবসায়ী জনগণ হইতে এবং বেসরকারী ইউরোপীয় সমাজ হইতে ইহার নিমিত্ত গ্রাহক সংগ্রহ করা হইত। ইহার সমালোচনা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ ইউরোপীয় ও ভারতীয়দিগের প্রতিকূলে তুল্যরূপেই চালিত হইত। ওয়ারেন হেষ্টিংস ও স্যার ইলাইজা ইম্পের প্রতি আক্রমণের নিমিত্ত এই সংবাদপত্র বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছে ফ্রান্সিস সম্বন্ধে বষ্টিড্ বলেন,—“এমন কথা বলা যায় না যে, তাহার চরিত্র আচরণ সকল সময়েই এতদূর নিষ্কলঙ্ক ছিল যে, নীতিপ্রিয় হিকি তাহার সমালোচনা করিবার সুযোগ কখনই প্রাপ্ত হন নাই; নিরপেক্ষভাবে চলিতে হইলে যে সকল স্থলে প্রকাশ্য মন্তব্য প্রকাশ করাই সঙ্গত, সে সকল স্থলে হয়ত কোন কথাই বলা হয় নাই, অথবা তাহার অনুকূলেই বল হইয়াছে সমাজের সরকারী নেতাদিগের মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সিসই কোমল ব্যবহার প্রাপ্ত হইয়াছেন।”
আর এক স্থলে লিখিত আছে,—“সরকারী কার্য্যে বা সামাজিক হিসাবে যাঁহারা প্রসিদ্ধ, তাঁহাদের অনেককেই যেরূপ ভাবে ও যে ভাষায় আক্রমণ করা হইত, তাহাতে বিদ্বেষপূর্ণ শত্রুতার ভাবই প্রকাশ পাইত; আবার তাঁদের মধ্যে যাঁহারা সর্বপ্রধান, তাঁহাদিগকে সাধারণের নিকট নিতান্ত ঘৃণা ও অবজ্ঞার পাত্র করিয়া তোলা হইত।”
হিকির সমালোচনার রীতি-প্রণালী সম্বন্ধে এইরূপ লিখিত আছে;—“বেঙ্গল গেজেট যাহাদিগকে সাধারণের নিকট বিদ্রূপপাত্র করিতে ইচ্ছা করিত, তাহাদিগকে করাঘাত করিবার উহার এই একটী প্রিয় প্রথা ছিল যে, উহা একটি নাটক বা প্রহসনের অভিনয়ের বা কনসার্টের বিজ্ঞাপন ঘোষণা করিত। (কারণ ঐগুলিই তৎকালে প্রচলিত আমোদ ছিল।) এবং সেই সঙ্গে উহার লক্ষ্যীভূত ব্যক্তিবর্গের এক এক জনকে অতি সামান্য ও সূক্ষ্ম আবরণে আবৃত করিয়া কে কোন্ অংশের বা চরিত্রের অভিনয় করিবে, তাহা নির্দ্দেশ করিয়া দিত।”
পাদরি উড সাহেব বলেন;—“উহার লেখা ক্রমশঃ এরূপ জঘন্য হইয়া উঠিল যে, ১৭৮০ অব্দের ১৪ই নবেম্বর গভর্ণমেণ্ট এক আদেশ প্রচার করিয়া জেনারেল পোষ্ট অফিস হইতে উহার প্রচলন রহিত করিয়া দিলেন, কারণ কিছুদিন হইতে উহাতে এমন কতকগুলি কার্য্য প্যারাগ্রাফ বাহির হইতেছিল যে, তাহাতে ব্যক্তিগত চরিত্রের নিন্দাগ্লানি বিদ্যমান এবং তাহার লেখার ফলে উপনিবেশের শান্তিভঙ্গ হইবার সম্ভাবনা। হিকি তাঁহার কাগজ বিলি করিবার নিমিত্ত ২০ জন হরকরা নিযুক্ত করিলেন ও বলিলেন যে, যদিও তাঁহাকে হোমারের ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাথা রচনা করিয়া কলিকাতার রাস্তায় রাস্তায় বিক্রয় করিয়া বেড়াইতে হয়, তথাপি তিনি গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধাচরণ করিতে ক্ষান্ত হইবেন না। এইরূপে দীর্ঘকাল বিবাদ করিবার পর তাহাকে কারাগারে জীবন অতিবাহিত করিতে হয়।”
“ওরিজিনাল ইনকোয়ারি” নামক গ্রন্থের লেখক ভারতের স্বাধীন-মুদ্রান্ত্রের বর্ণন প্রসঙ্গে হিকির বেঙ্গল গেজেট সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের বিবরণ প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলেন“স্থানীয় গভর্ণমেণ্টগুলি ১৭৯৩ অব্দের আইনের বিধানানুসারে নির্বাসন দানের ক্ষমতাপন্ন হওয়ার সময় হইতে ভারতে স্বাধীন মুদ্রাযন্ত্রের অস্তিত্ব মুহূর্তের জন্যও ছিল না বটে, তথাপি কলিকাতার সেন্সরের পদ সৃষ্ট হইবার পুর্বে এবং উহা উঠিয়া যাইবার পরে কোন কোন সংবাদপত্র-সম্পাদক সময়ে সময়ে নিজ দায়িত্বে রাজকীয় কার্য্যাবলার ও সরকারী কর্মচারীদিগের সম্বন্ধে প্রকৃত ব্যাপার ও আপনাদের মতামত প্রকাশ করিতে সাহসী হইয়াছেন এবং তাহার ফলে অনেক সময় আপনাদের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছেন। এইরূপ কথার প্রচার দ্বারা কখনও যে কোন বিশেষ বা স্থানীয় ভাবের কোনও অনিষ্ট রটিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র প্রমাণ পাওয়া যায় না, অথবা তাহা বিশ্বাস করিবার বিন্দুমাত্রও হেতু দৃষ্ট হয় না। পরস্পর বিসংবাদী বিধি ব্যবস্থা দ্বারা যে গুরুতর বিশৃঙ্খলাসমূহ উৎপন্ন হইয়াছিল, তৎসম্বন্ধে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, এবং তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ ১৭৮০ অব্দের উল্লেখ করা যাইতে পারে; কিন্তু হিকির বেঙ্গল গেজেটের প্রচার দ্বারা যে গুরুতর অনিষ্ট ঘটিয়াছিল বলিয়া সারজন ম্যালকম্ অনুমান করিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে তিনি একটিও দৃষ্টান্ত দিতে পারেন নাই। পক্ষান্তরে ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, উক্ত সংবাদপত্রের ফাইল পরীক্ষা করিলে তৎকালে জনসাধারণের মধ্যে যে সকল বিষয়ের আলোচনা হইত, তাহাদের ভাব ও প্রকৃতি এবং যাহারা উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাহাদের চরিত্রের অনেক তথ্যই অবগত হওয়া যায়; আর ঐরূপ সংবাদপত্র পাঠ ভিন্ন তদানীন্তন কালের অবস্থার প্রকৃত জ্ঞান লাভের অন্য উপায়ও নাই।”
বর্ত্তমান সময়ের অবস্থার সহিত তুলনা করিয়া বিচার করিয়া দেখিলে,তদানীন্তন কালের ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাসঙ্কোচক বিধি ব্যবস্থাগুলি নিতান্ত কঠোর বলিয়াই প্রতীয়মান হয়। ভারত গভর্ণমণ্টের চরিত্র ও কার্যসম্বন্ধীয় সকল বিষয়ের আলোচনাই নিষিদ্ধ ছিল। এই নিয়মের লঙ্ঘনকারী দেশীয় হইলে তাহার প্রতি অর্থ ও কারাদণ্ডের এবং বিলাতজাত ইংরেজ হইলে তাহার প্রতি নির্বাসন দণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। তদানীন্তন কালের অবস্থানুসারে এই সমস্ত নিষেধবিধির আবশ্যকতা হইয়াছিল, অথবা তৎকালীন কর্তৃপক্ষীয়দিগের যথেচ্ছাচারিতা হইতে উহাদের উদ্ভব হইয়াছিল, একথা এখন নিশ্চয় করিয়া বলা সহজ নয়। পরন্তু ইহাই কৌতুহলের বিষয় যে, দেশীয়দিগের অপেক্ষা ইংরেজদিগের প্রতিই অধিক দণ্ডের প্রয়োগ হইত। তৎকালে মুদ্রাযন্ত্রের পরিচালন ভার প্রায়শঃ ইংরেজদিগের হস্তেই ছিল। কিন্তু কতিপয় বর্ষ পরে, সম্ভবত ১৮১৬ অব্দ হইতে, এতদ্দেশীয়ের সংবাদপত্রপ্রচার ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন।
সুপ্রসিদ্ধ জেমস্ সিল্ক বকিংহাম কর্তৃক সম্পাদিত “কলিকাতা জাল” নামক সংবাদ পত্র লইয়া জন আডাম সাহেবের বিস্তর বিবাদ বিসংবাদ চলিয়াছিল। মাননীয় জন আডাম কিছুদিনের জন্য গভর্নর হন। সম্পাদক অতি উদ্ধত ও বিদ্বিষ্টময় ভাবে গভর্ণরের ব্যক্তিগত চরিত্র আক্রমণ করি যা দোষের কার্য্য করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। পরন্তু সেই সঙ্গে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, তাহার প্রতি যে নির্বাসনদণ্ডের প্রয়োগ করা হইয়াছিল এবং তাঁহাকে যেরূপ কষ্ট দেওয়া হইয়াছিল, তাহা ন্যায়সঙ্গত হয় নাই।
লর্ড হেষ্টিংসের শাসনকালে একমাত্র ইংরেজরাই সংবাদপত্র পরিচালন করিতেন এবং তাঁহার নিকট বিলক্ষণ উৎসাহ ও অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইতেন। মাদ্রাজের অধিবাসীরা উক্ত মহাত্মাকে যে অভিনন্দনপত্র প্রদান করেন, তদুত্তরে তিনি বলেন,—“আমি মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা-সঙ্কোচক বিধিসমুহ, অপনীত করিয়াছি এবং ভারতীয় ইংরেজগণকে মতামত প্রচারের স্বাধীনতা প্রদান করিয়াছি, কারণ আমার বিবেচনায় উহা ইংরেজজাতির প্রতিসিদ্ধ অধিকার।” আর এক স্থলে উক্ত মহাত্মা বলেন, “নিজের সাধুতার জ্ঞান থাকিলে, সাধারণের সমালোচনা দ্বারা কর্তৃপক্ষীয়দিগের আত্মশক্তির কিছুই হ্রাস হয় না; প্রত্যুত,তদ্বারা তাঁহাদের শক্তি প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।” সুখের বিষয় এই যে, সে সময়েও কর্তৃপক্ষীয়েরা প্রকাশ্য সমালোচনার শক্তি ও উপকারিতা অনুভব করিতেন। তবে ইহা অবশ্য স্বীকার্য্য যে, তদনীন্তনকালে উচ্চপদস্থ ক্ষমতাপন্ন রাজপুরুষদিগের ক্রিয়াকলাপ প্রকাশ্যে সমালোচনা করা অতি গুরুতর ব্যাপার ছিল, এবং গভর্ণমেণ্ট যে সময়ে সময়ে সংবাদপত্র সংক্রান্ত অভিযোগ উপস্থিত করিতেন, তাহারও দৃষ্টান্তের অভাব নাই। পরন্তু ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্র পরে যে ক্ষমতা লাভ করে, তাহা যে উত্তরোত্তর পরিপুষ্ট ও বর্দ্ধিত হইয়া আসিতেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। উদারহৃদয় গভর্ণর জেনারেল লর্ড ক্যানিং মুদ্রাযন্ত্রের মহিমা বেশ বুঝিতেন; এমন কি সিপাহী-বিদ্রোহের সেই নিদারুণ সঙ্কটকালেও তিনি তাহা বিস্মৃত হন নাই। উক্ত মহাত্মা বলিয়াছিলেন,—“মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা দ্বারা যে ইষ্ট সাধিত হয়, তাহা এরূপ সুস্পষ্ট ও সর্ব্বজনস্বীকৃত যে, উহার অপব্যবহার দ্বারা যে অনিষ্ট উৎপন্ন হয় তদপেক্ষা ইষ্টের গুরুত্ব অধিক—অনিষ্ট ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ইষ্ট চিরস্থায়ী।’’
ক্রমে আরও কয়েকখানি সংবাদপত্র নগরে আবির্ভূত হইয়াছিল; “মনিটরিয়াল গেজেট” নামে একখানি সংবাদপত্র ছিল; পাদরি লঙ সাহেব বলেন,[১] ১৭৮০ অব্দে কিয়ার্ণাণ্ডার সাহেবের একটী মুদ্রাযন্ত্র ছিল। বর্ত্তমান প্রধান প্রধান ইংরেজী সংবাদপত্রগুলির পূর্ব্ব বৃত্তান্ত জানিতে পাঠকগণের কৌতুহল হইতে পারে; এজন্য পশ্চাতে তাহা প্রকাশ করা গেল;—
জন্ বুল—ইহাই উত্তরকালে “ইংলিশম্যান্’ রূপে আবির্ভূত হয়। বকিংহাম সম্পাদিত “কলিকাতা জর্ণাল” নামক সংবাদপত্রের প্রভাব খর্ব্ব করিবার উদ্দেশে ১৮২১ অব্দে ইহা প্রকাশিত হয়। বাকিংহাম সাহেব ১৮১৮ অব্দে “কলিকাতা জর্ণাল” প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। এই সংবাদপত্রের পরিচালনার্থ প্রথমে ৩০,০০০ টাকা মূলধন নিয়োগ করা হয়, কিন্তু পরে ক্রমে ক্রমে মূলধন যোগ করিতে করিতে কারবারটির মূল্য পরিণামে চারি লক্ষ টাকায় দাঁড়ায়, এবং উহাতে বৎসরে ৬০ হইতে ৮০ হাজার টাকা লাভ হইত। প্রথম পাঁচ বৎসরে ইহা বিলক্ষণ ক্ষমতাশালী হইয়া উঠে। সকল শ্রেণীর লোকেই ইহার গ্রাহক মধ্যে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তাহার পর ইহা কর্তৃপক্ষীয়দিগের বিরাগভাজন হইয়া পড়ে, এবং সম্পাদকের নামে কয়েকটি মানহানির মোকদ্দমা উপস্থিত করা হয়। বকিংহাম সাহেবের মতে, তৎকালে কলিকাতায় আর ছয়খানি সংবাদপত্র ছিল। তন্মধ্যে “এশিয়াটিক মিরর” পাদরি জন্ ব্রাইসের সম্পাদকত্বে প্রকাশিত হয়। বর্ণিত আছে যে, মাননীয় আডামস্ সাহেবের সহিত তাঁহার ভয়ানক বাগযুদ্ধ ঘটে, তাহাতে ইউরোপীয় সমাজ একেবারে চটিয়া যায় এবং তাঁহার কাগজ ক্রমশঃ অবনতি পাইতে থাকে। এক্ষণে একমাত্র কলিকাতা জর্ণালই নিজ বিরাগভাজন কর্ম্মচারীদিগের প্রতিকুল সমালোচনা করিতে লাগিল। এই সময়ে “জন্বুল” পত্র উহার প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে অবতীর্ণ হইল। সৈনিক ও অসৈনিক রাজপুরুষেরাই ইহার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও উন্নতিসাধক হইলেন। সুতরাং ইহা অচিরকাল মধ্যে প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন হইয়া উঠিল। অতঃপর কলিকাতা জর্ণালের সম্পাদক জন্বুল সম্পাদকের নামে মানহানির এক নালিশ উপস্থিত করেন। বোধ হয়, সে সময়ের ইংরেজী সংবাদপত্রগুলির প্রকৃতি ও অবস্থার সহিত বর্তমান সময়ের বাঙ্গালা সংবাদপত্রসমূহের পরস্পরের সহিত বাগযুদ্ধের তুলনা করিলে নিতান্ত অসঙ্গত হয় না।
ইংলিশম্যান-যে রাজনৈতিক ভাব লইয়া “ইণ্ডিয়ান ডেলি নিউস” জন্ম গ্রহণ করে, তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব লইয়া ইহা আবির্ভূত হয়। ১৮২১ অব্দে, অর্থাৎ যে বৎসর ইংলণ্ডেশ্বর চতুর্থ জজের সৃহিত তদীয় হতভাগা মহিষীর বিবাদ চরম সীমায় উপস্থিত হয়, সেই বৎসর “জনবুল” রাজার পক্ষসমর্থনকারী এবং ব্যক্তিগত কুৎসাবাদের নিন্দাকারিরূপে জন্মগ্রহণ করে। ব্যক্তিগত কুৎসাই এ পর্যন্ত কলিকাতার সংবাদপত্রসমূহের প্রধান অবলম্বন ছিল, কিন্তু জনবুল এক নূতন পথে চলিতে লাগিল। থিওডর হুকের পত্রের নামের অনুকরণে এই নাম রাখা হইয়াছিল, তাহা স্পষ্টই প্রতীত হয়। ইহ, অচিরকাল মধ্যে বহু উচ্চপদস্থ সিভিলিয়ামের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করিল এবং কিছুদিনের মধ্যে সরকারী মুখপত্রস্বরূপ হইয়া পড়িল। পরন্তু সর্বপ্রকার সংস্কারের দৃঢ় বিরোধী হওয়ায় অল্পকাল মধ্যে ইহার গ্রাহক-সংখ্যা অনেক কমিয়া গেল। অবশেষে যখন জে, এচ, ষ্টকেলার সাহেব ১৮৩৩ অব্দে নামমাত্র মূল্যে ইহা ক্রয় করেন, তখন ইহার মুমুর্ষিদশা। ষ্টকেলার সাহেবই ইহার নাম “ইংলিশম্যান” রাখেন ও ইহাকে নবজীবন প্রদান করেন। তৎকালে সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক থ্যাকারের পিতৃব্য চার্লস্ থ্যাকারে ইহার অন্যতম বেতনভোগী লেখক কর্ম্মচারী ছিলেন। তিনি সময়ে সময়ে এরূপ লিপিচাতুর্য প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন যে, দ্বারা স্পষ্টই প্রতীত হয়, থ্যাকারে পরিবারের মধ্যে উক্ত ঔপন্যাসিকই যে একমাত্র সাহিত্যরথী ছিলেন, এরূপ নহে। এই ইংলিশম্যান মুদ্রাযন্ত্রেই সুপ্রসিদ্ধ মেকলে তাহার ক্লাইভ ও হেষ্টিংস সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলি প্রথম মুদ্রিত করেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর জে, ওবি, সাণ্ডার্স ইংলিশম্যানের স্বত্ব ক্রয় করিয়া লন। তাঁহারই পুত্র ইহার বর্তমান প্রধান স্বত্বাধিকারী॥
ষ্টেটম্যান এণ্ড ফ্রেণ্ড অভ ইণ্ডিয়া—ইহা প্রথমতঃ “ফ্রেণ্ড অভ ইণ্ডিয়া” নামে মাসিক পত্রের আকারে ১৮১৮ অব্দের এপ্রেল মাসে আবির্ভূত হয়। ডাক্তার মার্শম্যান উহার উক্তরূপে নামকরণ করেন, এবং মিশনারিদিগের প্রভাবেই ইহার জন্ম হয়। ভারতবর্ষের উন্নতি ও সংস্কার সংক্রান্ত নানা বিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ, লর্ড হেষ্টিংসের প্রভাবে দেশ মধ্যে যে সমস্ত নানাবিধ সভাসমিতি উৎপন্ন হইতেছিল, তাহাদের রিপোর্ট, এবং অন্যান্য দেশের বাইবেল, মিশনারি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সমাজসমূহের কার্যালীর উল্লেখ ও সমালোচনা প্রকাশ করাই ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ডাক্তার মার্শম্যান ১৮২০ অব্দের জুন মাসে ইহার এক ত্রৈমাসিক সংস্করণ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। দেশের হিতাহিত সম্পর্কীয় বহু বিষয়ের আলোচনার জন্য ইহার কলেবর অত্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ইহার নিয়মিত প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটিতে থাকে। সেই জন্যই তিনি ভারতসংক্রান্ত বিষয়সমুহের প্রবন্ধ এবং ভারতের ইষ্টানিষ্টের সহিত সম্পর্ক থাকিতে পারে এরূপ যে কোন গ্রন্থ ইউরোপে বা ভারতে প্রচারিত হউক, তাহার সমালোচনা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত একখানি ত্রৈমাসিক পত্রের সৃষ্টি করেন। প্রথম প্রথম কিছুকাল ইহা সতীদাহ প্রথা নিবারনের পক্ষাবলম্বন করে,এবং মাননীয় আড়াম সাহেব ইহার ঐ সমস্ত মর্ম্মভেদী প্রবন্ধ একটা বিশেষ নিয়ম লঙ্ঘন করিতেহে বলিয়া কাউন্সিলে আবেদন করিতে বাধ্য হন, কারণ উক্ত নিয়মানুসারে ঐ সময়ে, যেরূপ আলোচনায় দেশীয়দিগের মনে তাহাদের ধর্মবিশ্বাসে বা ধর্ম্মকর্ম্মে হস্তক্ষেপ হইবে বলিয়া আশঙ্কা জম্মিতে পারে, এরূপ আলোচনা করা নিষিদ্ধ ছিল। আডাম সাহেব ঐ আবেদন করিয়া প্রার্থনা করেন যে, সংবাদপত্র সম্পাদক কে যেন ভবিষ্যতে ঐরূপ আলোচনা হইতে বিরত থাকিতে আদেশ করা হয়। কিন্তু লর্ড হেষ্টিংস ঐ সমস্ত প্রবন্ধ বিশেষ অপত্তিজনক বিবেচনা না করায় তিনি আভাম সাহেবের কথায় কর্ণপাত করিলেন না। অধিকন্তু তিনি ডাক্তার মার্শম্যানকে আশ্বাস দিয়া বলিলেন যে, আমার নিজের কথা বলিতে হইলে, সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণরূপে উঠিয়া যায়, ইহাই আমার একান্ত অভিপ্রায়। পুর্ব্বেই বলা হইয়াছে, মুদাযন্ত্র তৎকালে দৃঢ়রূপে শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। লর্ড হেষ্টিংস ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রকে সর্ব্বদা উৎসাহ দিতেন, কিন্তু ইংল্যাণ্ডের কর্তৃপক্ষীয়েরা এবং তাঁহার নিজ কাউন্সিলের সদস্যগণ তাহাকে নানাপ্রকার বাধা দিতেন, তিনি ভারতবর্ষে আসিবার সময় মুদ্রাযন্ত্র সম্বন্ধে অতি উদার মত লইয়া আসিয়াছিলেন। ভারত ইতিহাসের পাঠকগণ বিজিত আছেন যে ১৭৯৯ অব্দে যৎকালে টিপু সুলতানের সহিত যুদ্ধ চলিতেছিল,সেই সময়ে মুদ্রিতব্য বিষয়ের পাণ্ডুলিপি পরীক্ষার কঠোর নিয়মাবলী প্রবর্তিত হয়, অর্থাৎ সেন্সর প্রথার সৃষ্টি হয়। নিয়ম হন যে, “প্রত্যেক প্রিণ্টারকে নিজ কাগজের প্রত্যেক সংখ্যায় আপনার নাম সন্নিবিষ্ট করিতে হইবে এবং তাহা প্রকাশ করিবার পুর্বে তাহার একখণ্ড অনুলিপি গভর্ণমেণ্টের সেক্রেটারীর পরিদর্শনার্থ প্রেরণ করিতে হইবে, অন্যথা তাঁহাকে ইংল্যাণ্ডে প্রতিগমন রূপ দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে।” সেন্সর (পাণ্ডুলিপিরীক্ষক) যে প্রবন্ধটি গভর্ণমেণ্টের বা সমাজের ক্ষতিকর হইতে পারে বলিয়া মনে করিতেন, তাহা তিনি কলমের আঁচড়ে কাটিয়া দিতেন। এই হেতু তৎকালে সংবাদপত্রসমুহ প্রায়ই দুই একটি কলমে কেবল তারকাচিহ্নের (*) শোভা লইয়া প্রকাশিত ইইত। লর্ড হেষ্টিংস তাহার কাউন্সিলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৮১৮ অব্দের ১৯শে আগষ্ট তারিখে কোনরূপ হেতুবাদ প্রদর্শন না করিয়া উক্ত প্রকার পাণ্ডুলিপিপরীক্ষার প্রথা রহিত করিয়া দেন। সম্পাদকদিগের নিমিত্ত তিনি কতক গুলি নিয়মও বিধিবদ্ধ করেন। ভারতবর্ষ সংক্রান্ত ইংল্যাণ্ডীয় কর্তৃপক্ষগণের বিধিব্যবস্থা ও অন্যান্য কার্যের প্রতিকূল মন্তব্য, স্থানীয় শাসনকর্তাদিগের রাজনৈতিক কার্বের আলোচনা, এবং কাউন্সিলের সদস্য, সুপ্রীম কোটের জজ, যা লড বিশপের সরকারী কার্যের বিরুদ্ধ সমালোচনা প্রকাশ করা তাঁহাদের পক্ষে নিষিদ্ধ হইল। তদ্ভিন্ন, দেশীয় প্রজাবর্গের মনে তাহাদের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্ম্মেকর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিবার সঙ্কল্প হইয়াছে এইরূপ আশঙ্কা বা সন্দেহ জন্মিতে পারে এরূপ ভাবের আলোচনা করা, অথবা ইংরেজী ও অন্যান্য সংবাদপত্র হইতে ঐ শ্রেণীর প্রবন্ধ সঙ্কলন করিয়া পুনঃ প্রকাশ করা, এবং যাহাতে সমাজমধ্যে বিবাদ বিসংবাদ ও অনৈক্য জন্মিতে পারে, এরূপ ভাবের ব্যক্তিগত কুৎসা বা চরিত্র সমালোচনা প্রচার করাও নিষিদ্ধ হইল। আরও বিধান হইল যে, কেহ এই সমস্ত নিয়ম সজ্জন করিলে গভর্ণমেণ্ট তাহার নামে সুপ্রীম কোর্টে মোকদ্দমা উপস্থিত করিতে পারিবেন, অথবা অপরাধীর লাইসেন্স (অনুমতিপত্র) রহিত করিয়া তাঁহাকে ইউরোপে ফিরিয়া যাইবার আদেশ করিতে পারিবেন। ফলতঃ এই সমস্ত নিয়ম এরূপ কঠোর হইয়াছিল যে, সেগুলি যথাযথভাবে প্রয়োগ করিলে সর্ব্বপ্রকার স্বাধীন সমালোচনাই একেবারে অন্তর্হিত হইত। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিরা সাধারণতঃ মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিতে একান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন, এবং ঐ সকল নিয়ম জারি হইবার পরও তাঁহারা একবার একটি ফৌজদারি মোকদ্দমা অনুমোন করিতে অস্বীকৃত হন। লর্ড হেষ্টিংসও আপনার শাসনকালকে সংবাদপত্র-সম্পাদকের নির্বাসনরূপ কলঙ্কে কলঙ্কিত করিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। এই সমস্ত কারণে নিয়মগুলি শীঘ্রই মৃতপ্রায় অকার্যকর এবং মুদ্রাযন্ত্র কার্যতঃ স্বাধীন হইয়া পড়িল।
১৮৩৫ অব্দে “ফ্রেণ্ড অভ ইণ্ডিয়া” পত্রের সাপ্তাহিক সংস্করণ প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয়। মার্শম্যান্, ম্যাক্ ও লীচম্যান এই তিন জন উদার ব্যক্তি ইহার সম্পাদন ভার গ্রহণ করেন। এতৎসম্বন্ধে লিখিত আছে; “স্থির হয় যে, রাজনীতি অপেক্ষা এই পত্রিকা ধর্ম্মের ভাবে অধিক পরিচালিত হইবে, এবং ইহাকে ভারতের নৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক সর্ব্ববিধ মঙ্গলসাধক বিষসমূহের আলোচনার যন্ত্রস্বরূপ করা হইবে। যৎকালে লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক এইরূপ বিষয়সমূহের আলোচনাগুলিকে অতীব উদারভাবে উৎসাহ প্রদান করিতেছিলেন, সেই অনুকূল সময়ে ইহার জন্ম হয়। ইহার প্রথম কয়েক সংখ্যা তাঁর শাসনকাল সমাপ্ত হইবার পূর্বেই প্রকাশিত হয় তিনি যেভাবে ইহা পরিচালিত হইতেছিল, তদ্বিষয়ে আপনার সন্তোষ জ্ঞাপন করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। যাহা নিরবচ্ছিন্ন ধর্ম্মবিষয়ক নহে, অথচ সকল বিষয়েই আলোচনা ধর্মের ভাবে করিতে প্রস্তুত, এরূপ একখানি কাগজের আবির্ভাবে সর্বশ্রেণীর মিশনারীরা আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন এবং সর্বান্তঃকরণে ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তথাপি দেখা গেল, প্রথম বৎসরের অন্তে ইহার গ্রাহকসংখ্যা দুইশতের অধিক নহে।”
১৮৭৪ অব্দে(কেহ কেহ বলেন ১৮৭৫ শব্দে) রবার্ট নাইট সাহেব ৩০,০০০ টাকা মাত্র মূল্যে এই কাগজের লাভালাভের স্বত্ব ক্রয় করেন। “ইণ্ডিয়ান ষ্টেটসম্যান” এই নামে ইহার দৈনিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কয়েকমাস পরে “ফ্রণ্ড অফ ইণ্ডিয়া” ইহার সহিত মিলিত হয়। ইহার বর্তমান সাপ্তাহিক সংস্করণ “ফ্রেণ্ড অভ ইণ্ডিয়া এ ষ্টেটসম্যান”নামে প্রকাশিত হইয়া থাকে। সুবিখ্যাত সংবাদপত্র সম্পাদক রবার্ট নাইটের জীবনচরিতের আলোচনা যেমন কৌতুকাবহ, তেমনই শিক্ষাপ্রদ। তিনি এতদ্দেশীয়দিগের পক্ষাবলম্বী বলিয়াই পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ বোম্বাই গভর্ণমেণ্টের একজন কর্মচারী ছিলেন, এবং বোধ হয়, পরে ভারত গভর্ণমেণ্টের আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারী হইয়াছিলেন[২] পরন্তু সবিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন লেখক বলিয়াই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। ষ্টেটসম্যানের সহিত সংস্রবে আসিবার পূর্বে তিনি"ইণ্ডিয়ান একনমিষ্ট” নামক কলিকাতায় আর একখানি পত্র সম্পাদন করেন। ঐ সময়ে বাঙ্গালা গভর্নমেণ্ট তাহার নামে একটি মানহানির মোকদ্দমা উপস্থিত করেন। উহা আপোষে মিটিয়া যায়, এবং নাইট সাহেব নগদ ২০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া ইণ্ডিয়ান একনমিষ্ট পত্রের লাভালাভের স্বত্ব গভর্ণমেণ্টের নিকট বিক্রয় করেন। হায় সমসাময়িক ইংরেজ লেখকগণের মধ্যে সংবাদপত্র সম্পাদন পটুতায় তাঁহা অপেক্ষা কেহ শ্রেষ্ঠ ছিলেন কি না সন্দেহ। অর্থনাতিঘটিত বিষয়সমূহের আলোচনায় তিনি সবিশেষ দক্ষ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু লিখিতেন, তাহাতেই তাঁহার স্বাধীনচিত্ততা, উদার সহানুভূতি ও লিপিকৌশলের সৌন্দর্য প্রকাশ পাইত এবং তজ্জন্য তাহার কাগজখানি দেশমধ্যে বিলক্ষণ ক্ষমতাশালী ও দেশীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রিয়পাত্র হইয়া পড়ে। তিনি প্রকৃতই ভারতের হিতৈষী মিত্র ছিলেন। ভারতবাসীরা তৎকৃত উপকারসমূহ কখনই বিস্মৃত হইতে পারিবে না। আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে এই সংবাদপত্র বানিকে নানারূপ ভাগ্যবিপর্যয় অতিক্রম করিতে হইয়াছিল; কিন্তু তিনি মৃত্যুকালে ইহাকে বিলক্ষণ লাভজনক কারবার করি আপনার উত্তরাধিকারীদিগকে দিয়া গিয়াছেন। অধুনা ইহা ভারতের মধ্যে একখানি সমধিক প্রচার ও প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন সংবাদপত্র।
ইণ্ডিয়ান ডেলি নিউস্—জেম্স্ উইল্সন্ সাহেবের সম্পাদকত্বকালে ইহা বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ও ক্ষমতাশালী হইয়া উঠে। ১৮৬৪ অব্দের ১৮ই আগষ্ট ডেলিনিউস পুরাতন “বেঙ্গল হরকরা” পত্রের সহিত মিলিত হয়। এই পত্রখানি ১৭৯৫ অব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কাপ্তেন ফেনুইক্ যৎকালে ইণ্ডিয়ান ডেলি নিউস্ পত্রের প্রধান সম্পাদক ছিলেন, তৎকালে জেমস্ উইল্সন্ সময়ে সময়ে সহকারি-সম্পাদকরূপে কার্য্য করিতেন। উইল্সনের সহিত পার্কার নামক একজন সাহেবও ইহার স্বত্বাধিকারী হন। কিন্তু পরে উইল্সন্ই ইহার একমাত্র স্বত্বাধিকারী হন। প্রথমে ইহার নিজের মুদ্রাযন্ত্র ছিল না। তৎকালে ইহা বেঙ্গল প্রিণ্টিং কোম্পানির যন্ত্রে মুদ্রিত হইত। কিন্তু ক্রমে কাগজের উন্নতি হইলে, ইহার নিজেরই একটি মুদ্রাযন্ত্র হয়। জেমস্ উইল্সন্ যৎকালে এদেশ পরিত্যাগ করেন, সেই সময়ে তিনি একটি লিমিটেড কোম্পানির নিকট কারবারটি বিক্রয় করিয়া যান। ইহার বর্ত্তমান সম্পাদকের নাম জে, সি, উইল্সন্ এবং ইহার অন্যান্য কার্য্যপরিচালনভার অধুনা একটি লিমিটেড কোম্পানির হস্তে ন্যস্ত।
শিক্ষিত ভারতবাসীরাও অনেকগুলি প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ইংরেজী সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। উহাদের মধ্যে সর্ব্বোৎকৃষ্টগুলি ইউরোপীয়দিগের পরিচালিত পত্র অপেক্ষা কেন ক্রমেই নিকৃষ্ট নহে। শ্রীনাথ ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষেত্রচন্দ্র ঘোষ, হরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ,রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, কাশীপ্রসাদ ঘোষ, রেভারেণ্ড লালবিহারী দে প্রভৃতি বাঙ্গালীরা সংবাদপত্রে খিলিতেন, এবং তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ, সংবাদপত্র-সম্পাদকব্যবসায় অবম্বন করিয়াছিলেন। কাশীপ্রসাদ ঘোষ “হিন্দু ইণ্টেলিজেন্সার” নামক পত্রের সম্পাদক বলিয়া খ্যাত ছিলেন। উহা ১৮৪০ অব্দে বা তৎসমকালে প্রচারিত হয়। কথিত আছে যে, দেশীয়দিগের পরিচালিত ইংরেজী সংবাদপত্রসমূহের মধ্যে উহাই বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। কাশীপ্রসাদ গদ্য ও পদ্য উঞ্চয় প্রকাশ চনাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি কাপ্তেন ডি, এল, রিচার্ডসনের একজন প্রসিদ্ধ ও প্রিয় ছাত্র ছিলেন। রামবাগানের দত্তবংশীয় ঈশানচন্দ্র দত্ত “হিন্দু পাইওনিয়ার” পত্রের সম্পাদক ছিলেন। পরন্তু সে সময়ের দেশীয়পরিচালিত ইংরেজী সংবাদপত্রসমূহের মধ্যে উক্ত হিন্দু পাইওনিয়র প্রধান।
হিন্দু প্রেট্রিয়ট-~-পত্রই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রতিষ্ঠালাভে সমর্থ হইয়াছিল। ইহার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে রামগোপাল সান্ন্যাল কত কৃষ্ণদাস পালের জীবনচরিতে লিখিত আছে যে, শ্রীনাথ ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও ক্ষেত্রচন্দ্র ঘোষ ইহার প্রথম সম্পাদক ছিলেন। বড়বাজারনিবাসী মধুসূদন রায় নামক এক ব্যক্তি এইরূপ একখানি পত্র প্রকাশের কল্পনা করেন। কালাকার স্ক্রীটে তাঁহার এক মুদ্রাযন্ত্র ছিল। সেই যন্ত্রেই হিন্দু পেট্রয়টের প্রথম সংখ্যা ১৮৫৩ অব্দে মুদ্রিত হয়। ক্রাইন্ সাহেব “রেইস এণ্ড রাইয়ত” পত্রের সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনবৃত্তান্তে হিন্দু পেট্রয়টের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন—“যে সকল সাময়িক পত্র একটি জাতির সাহিত্যিক ভাবের উন্মেষণ ঘোষণা করে, তন্মধ্যে একখানির নাম ‘বেঙ্গল রেকর্ডার', এবং তাহার চিতাভস্ম হইতে হিন্দু পেট্রিয়টের জন্ম হয়। ইহার স্বত্বাধিকারী এটিকে লোকসানের কারবার দেখিয়া ১৮৫৪ অব্দে অতি নামমাত্র মুল্যে মুদ্রাযন্ত্র ও কাগজের স্বত্ব বিক্রয় করিতে প্রস্তুত হন। তৎকালে হরীশ্চন্দ্র ইহার একজন প্রধান লেখক ছিলেন। তিনি দেখিলেন, তাঁর চিরপোষিত আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করার সুযোগ উপস্থিত, সুতরাং তিনি ইহার ক্রেতা হইলেন। কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপর অতি গোপনে সমাহিত হই, কারণ তঁহার প্রভু মিলিটারি অডিটর জেনারেল আপনার অধস্তন কর্মচারীকে সংবাদপত্রের স্বাধিকারী ও সম্পাদক হইতে দিবেন এরূপ সম্ভাবনা অতি অল্পই ছিল। সুতরাং কার্য্যটা বেনামিতে হইল, এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে সম্পাদক খাড়া করা হইল। কিন্তু কাগজ সম্পাদন ও পরিচালনের সমস্ত ভার হরাশের উপর পড়িল। ইহার জন্য তাঁহাকে অনেক দিন কঠোর (ক্লশ ভোগ করিতে হইয়াছিল; এমন কি, এক সময়ে এই দরিদ্র কেরানীকে ইহার ব্যয় সঙ্কুলনাথ আপনার সামান্য বেতন হইতে মাসিক প্রায় ৭০০ টাকা করিয়া ব্যয় করিতে হইত। তিনি বীরোচিত সাহসের সহিত অটলভাবে এই ক্লেশ সহ্য করেন, এবং অবশেষে তাঁহার কাগজের উন্নতির সহিত আয়েরও সচ্ছলতা ঘটে; পর তাহার অকালমৃত্যুতে তাহার পরিজনবর্গকে একটি সুন্দর সাহিত্যিক সম্পত্তির লাভভোগে বঞ্চিত হইতে হয়। অতঃপর মহাভারতের বাঙ্গালী অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ কাগজখানি ক্রয় করিয়া লন এবং অতি সামান্য অর্থ দিয়। বেনামদারের দাবি মিটাইয়া দেন।” রামগোপাল সন্ন্যাল নিয়াছেন, মানুভব ফালী: প্রসন্ন সিংহ ৫০০০ টাকায় কাগজের স্বত্ব ক্রয়াকরিয়া পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হস্তে উহার পরিচালনের ভার অর্পণ করেন। এই সময়ে কৃষ্ণদাস পাল, কৈলাসচন্দ্র বসু এবং নবীনকৃষ্ণ বসু ইহার সম্পাদনভার গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইলে উক্ত প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত তাহাদের হস্তে ইহার পরিচালনভার প্রদান করেন। অবশেষে কৃষ্ণদাস পালই ইহার একমাত্র সম্পাদক হন। ১৭৬২, অকে হিন্দু সমাজের কতিপয় প্রধান ব্যক্তির অনুরোবে, কালীপ্রসন্ন সিংহ এই কাগজের পরিচালনভার মহারাজ রমানাথ ঠাকুর, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মহারাজ বাহাদুর স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এ কযেকজন ট্রষ্টির হস্তে অর্পণ করেন। এই ট্রষ্ট সংক্রান্ত দলিল ১৮৮২ অব্দে লিখিত পঠিত হয়। এই সময়ে পেটুরিয়টের অতি সামান্য আয় ছিল; তৎকালে ইহার গ্রাহক-সংখ্য আড়াই শতের অধিক ছিল না। ১৮৬৩ অব্দে ইহার সাফল্যলাভ বিষয়ে সন্দেহ অনেক পরিমাণে অপনীত হইল। এত দিন পেট্রিয়ট প্রতি বৃহস্পতিবার প্রাতঃকালে বাহির হইত, কিন্তু এখন হইতে সোমবারে প্রকাশিত হইতে লাগিল। কৃষ্ণদাসের সময়ে ইহা সপ্তাহিক ছিল, কিন্তু এক্ষণে দৈনিক হইয়াছে। কৃষ্ণ দাস পালের রচনার রীতিপদ্ধতি প্রভৃতি সম্বন্ধে এন, এন, ঘোষ মহোদয় লিখিয়াছেন যে, হিন্দু পেট্রিয়টে তাঁহার লেখা সুমার্জিত বুদ্ধি মতের উদারতা এবং তর্কশক্তির বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যাই, কিন্তু তাহাতে উচ্চ অঙ্গের লিপিকুশলতা অতি কদাচিৎ প্রকাশ পাইতে।” কুষ্ণদাস পাল বেশ সামাজিও লোক ছিলেন এবং তাঁর একটি অসাধারণ গুণ ছিল; তিনি শাসনকর্ত্তাদিগের ও তাহার স্বদেশীদিগের এই উভয় শ্রেণীরই শ্রদ্ধা-বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারিতেন। তিনি দেশীয় সমাজের অনেকেরই প্রতিনিধিস্বরূপ ছিলেন। তিনি পেট্রিয়টে আপনার স্বাভাবিক মাধুর্য্য ও ধরতা অনুপ্রবিষ্ট করিয়াছিলেন। তাঁহার মন প্রকৃত কার্য্যপ্রবণ ছিল। তাহার মনের ছায়া তাহার লেখায় সুপরিস্ফুট হইত। তিনি স্বাধীনভাবে সকল বিষয়ের সমালোচনা করিতেন। তাঁহাকে বিশ্বাস করিয়া কোন কথা বলিলে, সে গুপ্ত কথা তিনি কখনই ব্যক্ত করিতেন না, এবং কখনও কাহাকেও ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করিয়া কটুক্তি বর্ষণ করেন নাই। তাঁহার এই এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল যে, তিনি অতি সহজে প্রকৃত ব্যাপার আয়ত্ত করিয়া ফেলিতে পারিতেন, কিন্তু নিজ মনোভাব কর্তৃক পরিচালিত হইয়া তিনি কখনও বাগাড়ম্বর প্রকাশ করিতেন না।
ইণ্ডিয়া মিরর-সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার ৺মনোমোহন ঘোষের দেশহিতৈষিতায় ও ৺দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থসাহায্যে ১৮৬১ অব্দে পাক্ষিকপ রূপে ইহার আবির্ভাব হয়। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ সেনও ইহাতে লিখিতেন। কিছুদিন পরে মনোমোহন সে ব্যারিষ্টার হইবার নিমিত্ত ইংলণ্ডে গমন করিলে ইহার পরিচালনভার নরেন্দ্রনাথের হস্তে পতিত হয়। তাহার সুদক্ষ সম্পাদনে ইহা সাপ্তাহিক আকার ধারণ করে। অতঃপর সুপ্রসিদ্ধ বক্ত। ও ব্রাহ্মনে কেশবচন্দ্র সেন ইহাকে দৈনিক করিবার কল্পনা করেন। অবশেষে অন্যতম বিখ্যাত ব্রাহ্মনেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে সম্পাদক ও বর্তমান সম্পাদকের পিতৃব্যপুত্র কৃষ্ণবিহারী সেনকে সহসম্পাদক করিয়া কেশবচন্দ্র সেন ১৮৭৮ অব্দে আপনার সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করেন। কয়েক বৎসর যাবৎ সমগ্র ভারতবর্ষে ইহাই একমাত্র দেশীয় পরচালিত ইংরেজী দৈনিক সংবাদপত্র ছিল। ১৮৭৯ অব্দে নরেন্দ্র নাথ সেন ইহার একমাত্র স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক হন তৎপুর্ব্বে ইহা কয়েকজনের মিলিত সম্পত্তি ছিল। কয়েক বৎসর ইহার একটী বিশেষ রবিবারে সংস্করণ বাহির হইয়াছিল; তাহাতে কেবল ধর্ম্মবিষয়ের আলোচনা হইত রবিবারের কাগজখানি কৃষ্ণবিহারী সেন সম্পাদন করিতেন।
অমৃতবাজার-পত্রিকা-ইহার জন্মস্থান যশোহর জেলা। প্রার ৩৫|৩৬ বৎসর হইল, শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার ঘোষ ও তদীয় ভ্রাতৃগণের যত্নে ইহার জন্ম হয়। তাঁহাদের জননীর পবিত্র স্মৃতিরক্ষা তাঁহারই নামের অনুকরণে ইহার নামকরণ হয়। ইহা প্রথমে বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইত; তৎপরে বাঙ্গালা ও ইংরেজী উভয় ভাষাতেই লিখিত হইত। শিশিরকুমার ঘোষ কৃত “ইণ্ডিয়ান স্কেচেস্” নামক পুস্তকের ভূমিকায় লিখিত আছে যে, “লড লিটনের মুদ্রাযন্ত্রের মুখরোধক আইনের যখন প্রথম সূচনা হইল ও স্পষ্ট বুঝা গেল যে, দেশীয় ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রসমূহ অল্পাধিক পরিমাণে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইবে, সেই সময়ে যোষ ভ্রাতারা স্থির করিলেন যে, অতঃপর তাঁহাদের অমৃতবাজার পত্রিকা একমাত্র ইংরেজী ভাষায় লিখিত ও প্রচারিত হইবে।” নানাপ্রকার ভাগ্যবিপর্যয়ের পর ইহা এক্ষণে প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ও ক্ষমতাশালী সংবাদপত্র হইয়া উঠিয়াছে। জীবনসংগ্রামের সেই প্রথম অবস্থায় ইহার স্বত্বাধিকারীরা মাননীয় রাজা দিগম্বর মিত্র বাহাদুর, মহারাজ কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি মহাত্মাদিগের নিকট যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য লাভ করিয়াছিলেন। ১৮৮৯ বা ১৮৯০ অব্দে রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের পরামর্শে কাগজখানিকে দৈনিকরূপে প্রকাশ করার কথা স্থির হয় এবং তাহা কার্যেও পরিণত হয়। তৎকালে রাজা বাহাদুর নিজ ক্ষতি স্বীকার করিয়াও নানাপ্রকার যে সাহায্য করিয়াছিলেন, তাহা বিলক্ষণ সময়োপযোগী হইয়াছিল।
বেঙ্গলি-অধুনা ইহা দৈনিকরূপে প্রকাশিত হইয়া থাকে। ইহার বর্তমান সম্পাদক সুপ্রসিদ্ধ বাগ্মী শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশীয়-পরিচালিত ইংরেজী সংবাদপত্রসমূহের মধ্যে রুহ। সবিশেষ প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ও প্রভাবশালী। কলিকাতা সিমলার ঘোষ বংশীয় প্রশিদ লেখক ও পণ্ডিত ৺গিরিশচন্দ্র ঘোষের সম্পাদকত্বে ইহার জন্ম। ১৮৬১ অব্দে বেঙ্গলির প্রথম সংখ্যা মুদ্রিত হয়। তৎকালে ইহা সাপ্তাহিক ছিল এবং প্রতি শানবারে প্রকাশিত হইত। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তৎকালে গভর্ণমেণ্টের অধীনে মিলিটারি পে-একজামিনারের আফিসে চাকরি করিতেন। ১৮৬৯ অব্দ পর্যন্ত তিনিই বেঙ্গলীর সম্পাদক ছিলেন। উক্ত অব্দে তার মৃত্যু হইলে তাহার সহযোণী ৺বেচারাম চট্টোপাধ্যায় ইহার সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করেন, এবং ৺রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত চন্দনাথ বসু প্রমুথ পণ্ডিতগণ ইহাতে যোগদান করেন। ১৮৮৮ অব্দে বা তৎসমকালে ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঙ্গলির স্বত্ব ও তৎসংক্রান্ত সমস্ত জিনিষপত্র ক্রয় করিয়া লন। এই ব্যাপার লইয়া কিছু গোলযোগ উপস্থিত হয়, কিন্তু রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের জ্যেষ্ঠ সহোদর ও মহারাজকুমার নীলকৃষ্ণ বাহাদুরের মধ্যস্থতায় তাহার সুন্দর মীমাংসা হইয়া যায়। ১৯০০ অব্দে বা তৎসমকালে কবিরাজ শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ সেন ও রাজা বাহাদুরের ঐকান্তিক আগ্রহে ও সহকারিতায় বেঙ্গলি দৈনিক রূপে প্রকাশিত ইতে আরম্ভ হয়।
ইণ্ডিয়ান নেশন—দেশীয় পরিচালিত ইংরেজী সপ্তাহিক পত্রে সংখ্যা এত অধিক যে, তাহাদের প্রত্যেকটির কথা সংক্ষেপে বলিলেও তাহা নিতান্ত বিরক্তির কারণ হইয়া উঠিবে। এজন্য এস্থলে কেবল “ইণ্ডিয়ান নেশন” পত্রের উল্লেখ করিয়া ক্ষান্ত হই। লর্ড রিপণের শাসনকালে যখন ইলবার্ট বিল লইয়া তুমূল আন্দোলন ও বাগ্বিতণ্ডা চলিতেছিল, সেই ঘোর দুর্দিনে ১৮৮২ অব্দে ইহার জন্ম হয়। অগাধ পণ্ডিত ও চিন্তাশীল লেখক এবং মেট্রপলিটান ইনষ্টিটিউশন নামক কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ বারিষ্টার প্রবর শ্রীযুক্ত এন, এন, ঘোষ ইহার সম্পাদক।
আমরা এক্ষণে দেশীয় ভাষায় লিখিত সংবাদপত্রের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি। শ্রীযুক্ত এন, এন, ঘোষ মহোদয় স্বরচিত মহারাজ নবকৃষ্ণের জীবনচরিতে এক স্থলে বলিয়াছেন, “ইংলণ্ডের সহিত ভারতবর্ষের সংযোগ ভগবানের বিধানক্রমে হইয়াছে।” এই উক্তি যে অত্যন্ত সারবান, তাহাতে সন্দেহ নাই। বাঙ্গালা সংবাদপত্রের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইবার প্রাক্কালে আমরা এই উক্তির প্রতিধ্বনি না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। দেশীয় ভাষাসমূহের পুষ্টিসাধনের নিমিত্ত ইংরেজ রাজপুরুষ ও মিশনারিগণ যে কতদূর যত্ন চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। এই উদ্দেশ্য সাধন করিবার অভিপ্রায়ে ইংরেজ মিশনারিরা প্রথমে নিজেরাই প্রভূত শ্রম স্বীকার করিয়া দেশীয় ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন, এবং তৎপরে উন্নতিসাধনের দিকে মনোনিবেশ করেন। “জাতীয় শিক্ষা” কথাটীর অর্থ “জনসাধারণকে তাহাদের মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান।” ডাক্তার ক্যারি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও ডফ, প্রমুখ মিশনারিগণ, লর্ড হেষ্টিংস, ওয়েলেসলি, হার্ডিঞ্জ, সার চার্লস্ ট্রোভলিয়ান ও হলিডে প্রভৃতি উচ্চপদস্থ রাজপুরুষগণ, এবং ডেভিড, হেয়ার প্রভৃতি বেসরকারী ইংরেজ মহাপুরুষগণ সদাশয় প্রণোদিত হইয়া দেশীয় ভাষার পরিপুষ্টি ও উৎকর্ষসাধনকল্পে বিস্তর সহায়তা করিয়াছেন। বাঙ্গালা ভাষার ভবিষ্যৎ যে বিলক্ষণ আশাপূর্ণ তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রায় ৫ বৎসর গত হইল, জনৈক লেখক কোন সাময়িক পত্রে বাঙ্গালা ভাষা সম্বন্ধে লিখিয়াছেন - “ড্যাণ্টির পূর্বে ইটালীয় ভাষা যেরূপ অপরিপক্ক ছিল, পঞ্চাশৎ বর্ষ পূর্বে বাঙ্গালা ভাষাও তদ্রুপ অপক্ক ছিল। ড্যাণ্টি আবির্ভূত হই- লেন এবং সেই একজন লোক একখানি মাত্র গ্রন্থ ‘ডিভাইন কমেডি রচনা দ্বারা প্রতিপন্ন করিলেন যে, তাঁহার দেশীয় ভাষা অতি উচ্চ ও জটিল ভাব প্রকাশে সমর্থ। বঙ্গদেশেও কি আমরা সেইরূপ আশা করিতে পারি না? বাঙ্গালা ভাষার দ্রুত ও অশ্রুতপূর্ব উন্ন- তির কথা বিবেচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, পূর্বোক্ত লেখকের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটা সফল হইয়াছে।
রাজা রামমোহন রায় কলিকাতার ব্রাহ্মসমাজের স্থাপয়িতা। এই ব্রাহ্মসমাজের আম্মেলনে কেবল যে বাঙ্গালা সংবাদপত্রেরই পুষ্টি ও উন্নতি হইয়াছে, তাহা নহে, প্রত্যুত তাহা হইতে বাঙ্গালা ভাষা এবং সাহিত্যও বিলক্ষণ সমুতা লাভ করিয়াছে। প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম সাহিত্য সেবীদিগের মধ্যে কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, চিরঞ্জীব শৰ্মা, গৌরগোবিন্দ রায়, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য। তদানীন্তনকালের ব্রাহ্মদিগের লেখনী দেশের প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে পরিচালিত হইত, কারণ তাহারা মনে করি- তেন, এই ধর্ম্ম কুসংস্কারময় এবং ইহা কোনরুপ ধ্রুব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। আদিম বৈদান্তিক নীতির পূনঃ স্থাপনের হলে একটি নূতন ধর্মমত সৃষ্ট হইল। বলা বাহুল্য, এই নব ধর্মমতের অনেক ভাই ইউরোপীয় ধর্ম্মশাস্ত্র হইতে ও নানা- প্রকার ইউরোপীয় রাজনীতিক্ষেত্র হইতে গৃহীত হইয়াছিল। বিবেকই মনুষ্যের কার্যের নিয়্নতা, স্বাধীনতা, সাম্য, ও ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি কল্পিত নীতি, দেশের সর্বনাশাধক প্রকৃত ও অত্যা- চারের বিরুদ্ধে অভিযান, পুরোহিত শ্রেণীর (ব্রাহ্মণজাতির) ধ্বংসসাধন, জাতিভেদ-প্রণালীর সম্পূর্ণ বিলোপ, হিন্দু রমণী- গণকে তাঁহাদের তথাকথিত দুর্দশা ও হীনাবস্থা হইতে উদ্ধার করিয়া পুরুষদিগের ন্যায় একই প্রকার অধিকার প্রদানপূর্বক পুরুষদিগের সহিত একাশনে সংস্থাপন প্রভৃতি বিষয় প্রকাশ্যে প্রচারিত হইতে লাগিল। এই সকল ভদ্রলোক দেবপ্রতিমার বিনাত বিষয়ে যেরূপ আগ্রহ প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহাও নিতান্ত বিস্ময়া- বহ। ইহা সমাজ, পৈতৃক ধর্ম্ম ও আত্মীয় স্বজন পরিত্যাগ করিয়া দূরে অপসৃত হইয়াছেন, এবং ইহাদের মতে যাহা যাহা গুরুতর অনিষ্টের কারণ, সমাজের ক্ষতিকর ও উন্নতির প্রতিরোধক, সেগুলির মূলোচ্ছেদ করিবার অভিপ্রায়ে আপনাদের সাংসারিক উন্নতির সর্বপ্রকার চেষ্টায় জলাঞ্জলি দিয়াছেন। কোন কোন ইংরেজ ও ফরাসী লেখকের সর্বনাশকর রীতি-প্রণালী এ দেশের সর্বপ্রকার অনিষ্টের একমাত্র প্রতীকার বলিয়া ইহারা যেরূপ সমা- দর ও সাহসের সহিত গ্রহণ করিয়াছেন, বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে আর কখনও তাহা খটে নাই। এক শ্রেণীর ইউরোপীয় দার্শনিক লেখকগণের মনোমুগ্ধকরী ও ওজস্বিনী ভাষা ইহাদিগকে এতদূর অভিভূত ও জ্ঞানশুন্য করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা হিন্দুজাতির বিশেষ ভাব ও প্রকৃতি এবং পূর্ব গৌরবাদির কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া সমাজের গঠন ও সামাজিক অন্যান্য বিষয় জ্যামিতির অনু- শীলণীর প্রতিজ্ঞার স্যার বিচার করিয়া থাকেন। ফরাসী দার্শনিক মাল্ব্রনশের ন্যায় ইহারা কল্পনার প্রয়োগ করিয়া কল্পনার নিন্দা এইরূপে গোঁড়ামির সহায়তায় ইহার। সমাজের প্রাচীন নিয়মাবলী ও গঠন ভয়ানকভাবে বিপর্যস্ত করিয়া তুলেন।
রাজা রামমোহন রায়ই বর্তমান বাঙ্গালা গদ্যের জনক বলা যাইতে পারে। তাছার গদ্য রচনা বেশ সরল ছিল। হিন্দু দর্শন- শাস্ত্রের জটিল বিষয়গুলি বাঙ্গালা সরল গদ্যে প্রকাশ করিয়া তিনি যেরূপ কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার পূর্বে আর কেহই তেমন পারেন নাই। রামমোহন রায় ১৮২১ অব্দে “ব্রাহ্মণ- পত্রিকা” নামে একখানি কাগজ বাহির করিতে আরম্ভ করেন। কাগজখানি অতি অল্প কাল জীবিত ছিল। কথিত আছে যে, উহার লেখা অতি তেজস্বী ছিল। উহার আক্রমণ প্রধান মিশনারি- দিগের বিরুদ্ধেই চালিত হইত। সমাচারচন্দ্রিকার প্রভাব খর্ব্ব করার নিমিত্ত সংবাদ-কৌমুদী নামে, একখানি সংবাদপত্র প্রচা- রিতরন রামমোহন রায় এবং পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ তার সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গদূত নামে আরও একখানি কাগজ ছিল, আর মার্টিন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সহিত মিলিত হই। রামমোহন রায় উহা চালাইতেন। রামমোহন সংস্কৃত, পারসী ও আরবী ভাষা আয়ত্ত করিছিলেন; তদ্ভিন্ন বঙ্গপুরে কলেক্টরে অফসে চাকরি করার সময় তিনি এরূপ অধ্যবসায় ও যত্নের সহিত ইংরেজী শিখিতে প্রবৃত্ত হন যে, কয়েক বৎসরের মধ্যেই তিনি মনোবিজ্ঞান ও ঈশ্বরতত্ত্ববিষয়ক দুরূহ গ্রন্থ সকলও বুঝিতে সমর্থ হন। তিনি ভারতের নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়াছিলেন; তদ্ভিন্ন তিনি ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ড দর্শনে গমন করিয়াছিলেন এবং বহু বড় লোক ও পাশ্চাত্য পণ্ডিতের সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন। তিনি নানাদিকে যেরূপ ক্রিয়াশীলতা প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং স্বজাতির মধ্যে সভ্যতা ও জ্ঞানবিস্তারের নিমিত্ত যেরূপ উদারভাবে যত্ন চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহাতেই তিনি সংস্কারক, রাজনীতিবেত্তা ও ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তক বলিয়া বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছেন। তিনি হুগলি জেলার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইংল্যাণ্ডের অন্তঃপাতী বৃষ্টল নগরে ১৮৩৩ অব্দে কালগ্রাসে পতিত হন।
৺অক্ষয়কুমার দত্ত, ৺ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু, সহচর ও সহযোগী ছিলেন।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা—অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদকত্বে ইহা প্রথমে পাক্ষিক ও পরে মাসিক রূপে প্রকাশিত হয়। তাহার সম্পাদকত্বকালে ইহার লেখা এরূপ চিত্তাকর্ষক ছিল যে, লোকে অতি আগ্রহের সহিত ইহার প্রচারের প্রতীক্ষা করিত। যুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত লিখিয়াছেন;—'ইউরোপীয় বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ, নৈতিক উপদেশাবলী, বিভিন্ন জাতি ও শাখা জাতির এবং চেতন অচেতন জগতের বিবরণ, এবং যাহাতে বুদ্ধিমান বাঙ্গালীর মনে জ্ঞানালোক প্রবেশ করিতে ও মন হইতে অজ্ঞানান্ধকার ও কুসংস্কার দূরীভূত হইতে পারে, তৎসমস্তই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় স্থান পাইত।” এই পত্রিকা অদ্যাপি জীবিত আছে। ৺ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহার বর্তমান সম্পাদক। সাহিত্যক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্ত অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। তিনি বাঙ্গালায় অনেক নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার প্রচলিত করি গিয়াছেন। তিনি সাতিশয় কোমলস্বভাব, দয়া, অমায়িক, অধ্যয়নরত ও শান্তিপ্রিয় ছিলেন। তিনি নীরবে দেশের উন্নতির কার্য করিয়া যাইতেন। তিনি ১৮২০ খৃষ্টাবে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে কালগ্রাসে পতিত হন। বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি যে সকল গ্রন্থ লিখিয়াছেন, সেগুলি কেবল কলিকাতার কেন, বঙ্গদেশের সর্বত্রই অল্পবয়স্ক ছাত্রদিগের পাঠ্যপুস্তকরূপে মহাসমাদরে গৃহীত হইয়াছে।
কি ইংরেজী কি বাঙ্গালা, উভয় প্রকার সংবাদপত্র পরিচালনক্ষেত্রেই ৺ কেশবচন্দ্র সেন যেরূপ শ্রম স্বীকার করিয়া গিয়াছেন, তাহা অতীব মহনীয়। ইণ্ডিয়া মিরর পত্রের সম্পাদনে তিনি কিরূপ সহকারিতা করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। রবিবারের মিরর তাঁহারই যত্নে প্রকাশিত হয়। ঐ কাগজে প্রথম প্রথম কেবল তত্ত্ব ও মানবের কতই আলোচিত হইত। তিনি বাঙ্গালায় “সুলভ সমাচার” নামে এক পয়সা মূল্যের একখানি কাগজ বাহির করেন; সুত্রাং যাইতে পারে যে, তিনিই বঙ্গদেশে সুলভ সংবাদ পত্রের প্রকৃত জন্মদাতা। উহা “নববিধান” হইতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যও গ্রহণ করে। বাঙ্গালা সাহিত্যের পরিপুষ্টি ও উন্নতিকল্পে উহার যত্নচেষ্টা সবিশেষ প্রশংসার যোগ্য, সন্দেহ নাই। সংসারে কি হইতেছে না হইতেছে এ তত্ত্বের সংবাদ যাহারা রাখেন, তাহারা অবশ্যই লক্ষ্য নির থাকিবেন যে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি সাধনকল্পে আড়ম্বরবিহীন ব্রহ্মেরা অকাতরে পরিশ্রম করিয়াছেন। বোধ হয়, কেশবচন্দ্র সেন হইতেই বাঙ্গালায় বক্তৃতাপ্রচারের সৃষ্টি। সময়ে সময়ে লেখা যাইত যে, বীড স্কোয়ার নামক উদ্যানের এক পার্শ্ব প্রচারকে্রা বাইবেল প্রচার করিতেছেন এবং তাহারই অদূরে কেশবচন্দ্র নানাজাতীয় জনমণ্ডলীর মধ্যস্থলে আপনার একেশ্বরবাগ প্রচার করিতেছেন বাঙ্গালায় চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা করিবার পথ তিনিই প্রদর্শন করেন। অক্লান্ত শ্রমশীল কেশবচন্দ্রের নিকট স্ত্রীশিক্ষাও যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করিয়াছিল। নগরের যে অংশে দেশীয়দিগের বাস, সেই অংশে (অর্থাৎ উত্তরাংশে) ‘য়্যালবার্ট হল’ নামে সাধারণ-মন্দির আছে, প্রধানতঃ কেশবচত্রের যত্নেই তাহা নির্মিত হয়; লোকে তথায় সভা করিয়া রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মবিষয়ক ও অন্য প্রসঙ্গের অবাধে আলোচনা করিতে পারে। দেশীয় থিয়েটার এবং ব্যায়াম ও অন্যান্য ক্রীড়াকৌতুকে তিনি একজন বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক ও সংস্কারসাধক ছিলেন। ইণ্ডিয়া ক্লাব ঠাহারই দ্বারা স্থাপিত হয়। তাঁহার সুবিখ্যাত জামাতা কুচবিহারাধিপতিই উহার বর্তমান পেট্রন'। ১৮৮২ অব্দে উহা প্রথম স্থাপিত হয়। ইংরেজ ও ভারতবাসীদিগের মধ্যে সামাজিক, ভাবের পরিবর্ধনই উহার প্রধান উদ্দেশ্য। কেশবচন্ত্রের ক্রিয়াশীলতা বহুমুখীন। তিনি কলুটোলার সেনবংশের প্যারীচরণ সেনের মধ্যমপুত্র। ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর তাঁহার জন্ম হয়। প্রথম বয়সে তিনি নাটকাভিনয়াদি থিয়েটারে আমোদ প্রমোদের অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি এইরূপ আমোদে অন্যূন ১০,০০০ টাকা ব্যয় করিয়া ফেলেন। তিনি হিন্দু মেট্রপলিটান কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। কথিত আছে যে, পৈতৃক ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া ব্রাহ্ম হইবার পূর্বে তিনি আপনাকে জীবনের মহাব্রত উদযাপনের উপযোগী করিবার অভিপ্রায়ে যেন ভগবৎ-প্রণোদিত হইয়া কয়েক বৎসর অতি আগ্রহের সহিত বাইবেল এবং ইংরেজী ধর্ম্ম এত্ব ও দর্শনশাস্ত্রসম্পকীয় বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রথমে কিছু দিন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু- রের প্রতিষ্ঠিত আদি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করুন; কিন্তু কেশবের স্বাধীনতাপ্রিয় ক্ষমতাশালী হৃদয়কে বশীভূত করা দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল। কেশবচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া একটি স্বতন্ত্র সমাজ স্থাপন করিলেন এবং অল্পকাল মধ্যে নিজ মহৎ চরিত্র ও গুণের অনুরূপ পদ লাভ করিলেন। আমরা তাহার জীবনের কার্য্যাবলীর সূক্ষ্ম বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইতে ইচ্ছা করি না। তাহার শিষ্য ও সহযোগী সুযোগ্য শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র মজুম- দার মহাশয় তাঁহার যে জীবনচরিত প্রণয়ন পরিয়াছেন, তাহা হইতে তাহার জীবনের অনেক কথাই জানিতে পারা যায়। ভারত- রাজরাজেশ্বরী স্বর্গীয়া ভিক্টোরিয়া ভারতবাসীদিগের মধ্যে একমাত্র কেশবচন্দ্রের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া আনন্দলাভ করিয়া ছিলেন। কেশব ও তাঁহার পরিজনবর্গ এবং ইংল্যাণ্ডের রাজ- পরিবারবর্গের মধ্যে সর্বদাই চিঠিপত্রের আদান প্রদান চলিত। রামমোহন রায় এই নবধর্ম্মের প্রতিষ্ঠাতা বটে, কিন্তু কেশবই ইহার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক। তাঁহারই যত্নচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ এতাদৃশ শ্রদ্ধেয় হইয়াছে। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে কেশবচন্দ্র কালগ্রাসে পতিত হন।
মিশনারিরা যে এ দেশের অনেক উপকার করিয়াছেন, তাহা ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। শ্রীরামপুরের মিশনারিরাই বাঙ্গালা সংবাদপত্রের উন্নতির পথপ্রদর্শক। প্রথম বাঙ্গালা সংবাদপত্র “সমাচার-দর্পণ” তাহাদেরই এরা ১৮১৮ অব্দে প্রকাশিত হয়। কেবল তাহাই নহে, বাঙ্গালা ভাষায় ছাপিষার অক্ষর এবং মুদ্রাযন্ত্রও তাঁহারাই প্রথমে প্রবর্তিত করেন। ভোরে লালবিহারী দে লিখিয়াছেন-“ওয়ার্ড সাহেব কর্তৃক ইংল্যাণ্ড হইতে আনীত মুদ্রা- যন্ত্র স্থাপিত হইল। পঞ্চানন নামক একজন বাঙ্গালী কর্মকারের সহায়তায় এক ফাউণ্ট বাঙ্গালা অক্ষর ঢালা হইল। এই পঞ্চানন ডাক্তার উইলকিন্স সাহেবের নিকট “পঞ্চ” কাটিতে শাখিয়াছিল। ১৮০০ অব্দের ১৮ই মার্চ বাঙ্গালার ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দিন; ঐ দিন ক্যারি সাহেব ‘মথি লিখিত সুসমাচার’ নামক ধর্ম্মপুস্তকের প্রথম পৃষ্ঠা মুদ্রিত করেন। উহার শেষ পৃষ্ঠা ১৮০১ অব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি মুদ্রিত হয়। সমগ্র ‘নিউটেষ্টামেণ্ট ঐখানেই মুদ্রিত হইয়াছিল। অতঃপর খৃষ্টধর্ম্মসম্বন্ধীয় পুস্থিক সকল ঘন ঘন ছাপা হইতে লাগিল। এই মিশনের ব্যনির্বাহার্থ মার্শম্যান সাহেব ও তদীয় পত্নীর অধীনে একটি বোর্ডিং স্কুল স্থাপন করা হইল।” ইংরেজ গভর্ণমেণ্ট মিশনারিদিগকে কলি- কাতায় বাস করিতে না দেওয়ায় মার্শম্যান, ওয়ার্ড, গ্র্যাণ্ট ও ব্রা- সন্ শ্রীরামপুরে বাস করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহাদের কলিকাতায় বাসের অনুমতি লাভের নিমিত্ত ক্যারি সাহেব প্রাণপণে চেষ্ট করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন ফলোদয় হয় নাই। দিনে- মারেরা তাহাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেন। একটি যথোপযুক্ত গৃহ ক্রয় কষিয়া মিশনারিরা তাহাতে বাস করিতে লাগিলেন, এবং কিছুদিন পরে কারি সাহেবও আসিয়া তাহাদের সহিত বোগ দিলেন। ইউরোপীয়দিগের মধ্যে ডাক্তার ক্যারিই প্রথমে বাঙ্গালা শিক্ষা করেন এবং ঐ ভাষায় একটা বক্তৃতা করেন। ইহাতে তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল হাৰ যথেষ্ট প্রশংসা করিয়াছিলেন। সমাচার-দর্পণ আবির্ভূত হইবার কয়েক মাস পুর্বে মার্শম্যান ও তদীয় বন্ধুগণ “দিগদর্শন” নামে একখানি মাসিক পত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন। আবার দর্পণের আবির্ভাবের কয়েকদিন পরে কৃষ্ণমোহন দলের সম্পাদকত্বে “সংবাদতিমিরনাশক” নামে এক খানি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। হিন্দু- ধর্ম্মনীতির পৃষ্ঠ- পোষকতা করা ও হিন্দুদিগের স্বার্থরক্ষা করাই এই সাপ্তাহিক পত্র- প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল। বিস্ময়ের বিষয় এই যে,৺ দ্বারকানাথ ঠাকুর ইহার গ্রাহক শ্রেণীমধ্যে পরিগণিত ছিলেন।
লর্ড হেস্টিংসের কৃপায় ডাক্তার মার্শম্যান্য প্রচলিত মাশুলের এক-চতুর্থাংশ মাত্র প্রদান করিয়া ডাকযোগে “দর্পণ” প্রেরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নামক জনৈক ব্রাহ্মণ কর্তৃক ১৮১৬ অব্দে “বাঙ্গালা গেজেট” সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়। বোধ হয়, উহাই প্রথম বাঙ্গালা সংবাদপত্র। রেলি সাহেবের মতে, ছাপিবারর জন্য বাঙ্গালা অক্ষরের ব্যবহায় ১৭৭৮ অব্দে প্রবর্তিত হয়, এবং বাঙ্গালা ভাষার প্রথম পুস্তক-একখামি ব্যাকরণ সুগলিতে মুদ্রিত হয়। ঐ ব্যাকরণমি এ, বি, হ্যালহেঙ, নামক একজন প্রসিদ্ধ প্রাচ্য-ভাষাৰিৎ পণ্ডিত কর্তৃক লিখিত হইয়াছিল। ওয়ারেন হেষ্টিংস হ্যালহেডের মুরুব্বি ছিলেন। বীর সেনাদলের অন্যতম লেফটেনাণ্ট চার্লস্ উইকিন্স কর্তৃক বাঙ্গালা ছাপিবার অক্ষর প্রথমে প্রস্তুত হয়, এবং তাঁহার নিকট পঞ্চানন এই বিদ্যা শিক্ষা করেন। এই দেশীয় কর্মকার প্রত্যেক অক্ষরের মূল্য ১।০ লইত। খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত দেশীয়দিগের মধ্যে ৺ রেভারেণ্ড ডাক্তাব কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মাতৃভাষার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করিয়াছেন। তিনি ইংরেজী ও দেশীয় ভাষায় বহু সংবাদপত্র সম্পাদন ও পরিচালন করিয়াছিলেন। প্রায় ছাত্রাবস্থাতেই তিনি “একোয়ারার” নামে একখানি কাগজ বাহির করেন; তদ্ভিন্ন তিনি ডিরোজিও সাহেবের উপদেশে ও পরিচালনে প্রচারিত ‘পার্থিবন পত্রেও প্রবন্ধ লিখিতেন, কিন্তু এ পত্র ডাক্তার উইলসনের আদেশে রহিত হইয়া যায়। এতদ্ব্যতীত তিনি “ইভ্যাঞ্জেলিষ্ট” নামে আর একখানি পত্রও সম্পাদন করিতেন বাঙ্গালা ও সস্কৃত গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ' (১৮৬১-৬২ অব্দে প্রকাশিত), এবং তাঁহার স্বকৃত টীকাসংবলিত রঘুবংশ, কুমার-সন্তব, ‘ভট্টি-কাব্য ও ঋবেদ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮৪৬ অব্দে বাঙ্গালা গভর্ণমেণ্টের অনুগ্রহে তিনি বিদ্যাকল্পদ্রুম’ প্রকাশ করেন এবং ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেলের নামে তাহা উৎসর্গ করেন। তিনি ইংরেজী সংস্কৃত, লাটিন, গ্রীক, ফরাসী ও বাঙ্গালা ভাষায় সুপণ্ডিত বুলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার অহমিকপূন্যতা, সৎস্বভাব, বিনয় ও সাধু চরিত্রের জন্য সকলেই তাহাকে যথোচিত ভক্তিশ্রদ্ধা করি। তাঁহার অসাধারণ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের নিমিত্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যা- লয় হইতে ১৮৭৬ অব্দে তিনি ডি, এল উপাধি লাভ করেন। তিনি একজন প্রকৃত স্বদেশহিতৈষী ছিলেন, এবং বহু দেশহিতকর অনুষ্ঠানের সহিত তাহার সংস্রব ছিল। ১৮১০ অব্দে কলিকাতা নগরে তাহার জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সে কালের মিশনারিরা যে উদ্দেশ্যেই হিন্দু ও মুসলমানদিগের ভাষা ও সাহিত্য অনুসন্ধান ও শিক্ষা করিয়া থাকুন না কেন, সাহিত্য ক্ষেত্রে তাহাদের দ্বারা যে স্থায়ী রকমের কাজ হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এতৎসম্পর্কে ওয়ারেন হেষ্টিংস-প্রমুখ গভর্ণরগণও অনেক কাজ করিয়াছেন। হেষ্টিংসের বিশিষ্ট অনুগ্রহে ডাক্তার উইলকিন্স ভগবদগীতার ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন, এবং সার উইলিয়াম জোন্স, কোলব্রুক, গ্লাডউইন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ভাষাতৰিৎ ও পণ্ডিতগণ অনুসন্ধিৎসু ইউরোপীয়দিগের উপ- কারার্থ প্রাচ্য ভাষার গ্রন্থসমূহের প্রচারে নানাপ্রকারে সহায়তা করিয়াছিলেন। প্রাচ্য ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে ইউরোপীয় বাণিজ্য ব্যবসায়ীদিগের যত্ন চেষ্টায় প্রত্নতত্ত্ববিৎ ও ভাষাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণের নিমিত্ত বহু জটিল প্রশ্ন মীমাংসিত হইয়াছে। তাহাতে প্রাচীন জগতের বহু অদ্ভুত তত্ত্ব প্রকাশিত হইয়াছে। উহার সাহিত্যিক গুরুত্ব সম্বন্ধে জনৈক লেখক এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, “এই ঘটনা একমাত্র গ্রীক সাহিত্যের পুনরভ্যুদয় অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অল্পগুরুত্ববিশিষ্ট, কিন্তু ধর্মবিষয়ক ও দার্শনিক হিসাবে বিবেচনা করিয়া দেখিলে, বোধ হয়, তদপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রসূ......” উক্ত লেখক আর এক স্থলে বলিয়াছেন, ইহা “ভূতলস্থ অন্ধকারময় গহ্বরে দীপ লইয়া যাইয়া তাহার আলোক সাহায্যে পৃথিবীর নানা প্রকার আঙ্গিক পরিবর্তনের অনুসন্ধান এবং প্রকৃতির ধ্বংসপ্রাপ্ত জগতের ধ্বংসাবশেষসমুহের আবিষ্কার করিয়াছে;.....।” তদ্ভিন্ন ইহা “ভাষার গভীরতম প্রদেশসমূহের প্রকাশ করিয়াছে, বিভিন্ন খাতির নানা দেশে উপনিবেশ সংস্থাপনার্থ প্রস্থান ও সামাজ্যের পরিবর্তনসমূহ আবিষ্কার করিয়াছে, এবং মানবজাতির কোন কোন অংশের লুপ্তচিহ্নের পুনরুদ্ধার করিয়াছে।”
হিন্দুরা বিদ্যানুরাগের নিমিত্ত চিরপ্রসিদ্ধ। হিন্দুরা বিদ্যাকে যেরূপ আদর ও মূল্যবান্ জ্ঞান করেন, বোধ হয় ভূমণ্ডলের আর কোন জাতিই সেরূপ করেন না। ইহাদের বিদ্যানুরাগ কিরূপ মহনীয় এবং এ বিষয়ে ইহারা কিরূপ মহত্ত্ব প্রদর্শন করিয়া থাকেন, তাহা পশ্চাল্লিখিত আখ্যায়িকা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে;—
এক সময়ে মহাৰাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর পণ্ডিত জগন্নাথ তর্ক- পঞ্চাননকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা আয়ের একটা জমিদারী দান করিতে চাহেন। তৎকালে উক্ত পণ্ডিত মহাশয় এই বলিয়া তাহা গ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হন যে, অর্থলাভ অনর্থের মূল ও তাহাতে ধর্ম্মপ্রবৃত্তি বিনাশ পায়, এবং তাহার বংশধরেরা ধনবান্ হইলে বিদ্যালোচনা পরিত্যাগ করিয়া বিলাসব্যসনে মত্ত হইবে। কি আর্য বিদ্যানুরাগ! কি মহনীয় নির্লোভত্ব! আর একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। নবদ্বীপাধিপতি রাজা ঈশ্বরচন্দ্র যৎকালে পণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইয়া তাহার সাংসারিক অবস্থা ও অভাব আকাক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করেন, তৎকালে তর্ক- সিদ্ধান্ত মহাশয় রাজাকে যে উত্তর প্রদান করিয়াছিলেন, তাহাতে অতি উচ্চ মহানুভবত্ব ও আত্মগৌরবের ভাব সুপরিব্যক্ত। সুপ্র- সিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত ডাইওজেনিজ মহাবীর আলেকজাণ্ডার দি গ্রেটের প্রশ্নের যে উত্তর দিয়াছিলেন, তাহাতেও ঐরূপ ভাব ব্যক্ত হইয়াছিল।
এ বিষয়ে রেভারেণ্ড ওয়ার্ড বলেন;—“প্রাচীন কালের হিন্দুগণ যে অগাধ জ্ঞান গৌরবে ভূষিত ছিলেন, এ কথা কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। তাহারা যে প্রকার বহু বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে প্রতিপন্ন হয় যে, প্রায় সকল বিজ্ঞানই তাহাদের মধ্যে আলোচিত হইয়াছিল এবং যে ভাবে তাহারা এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রতি- পন্ন হয় যে, হিন্দু পণ্ডিতগণ বিদ্যাবিষয়ে প্রাচীন অন্য কোন জাতি অপেক্ষা নিকৃষ্ট ছিলেন না। তাঁহাদের দর্শন ও স্মৃতিগ্রন্থসমুহ যতই অধ্যায়ন করা যায়, ততই পাঠক ঐ সকল স্থ র জ্ঞ র গভীরতা উপলব্ধি করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হন।
কলিকাতার মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর পণ্ডিতকে অকা- তরে অর্থদান এবং তাহাজের চতুষ্পাঠী সংস্থাপনে আনুকূল্য করি তেন, তাহারই একান্ত যত্নে হাতীবাগান[৩] বাঙ্গালার মধ্যে সংস্কৃত বিদ্যার অন্যতম কেন্দ্রস্থান বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়া উঠে। তিনিই পণ্ডিতদিগের দাবির কথা রাজপুরুষদিগের গোচরে আনয়ন করেন এবং তাঁহাদিগকে উপাধি বৃত্তি ও অন্যান্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করাইয়া দেন। পণ্ডিতদিগের অবস্থার উন্নতিসাধনার্থ তাহার যত্ন চেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ধাহা লিখিয়াছেন, তাহার মর্মার্থ নিম্নে উদ্ভুত হইল;—
“বিদ্যার প্রগাঢ় উৎসাহদাতা বলিয়া চতুষ্পর্শ্ববর্তী স্থানের সমস্ত পণ্ডিত তাহার প্রাসাদে সমবেত হইতেন; তদ্ভিন্ন ভারতের দূর্ববর্তী স্থান হইতে যে সকল পণ্ডিত কার্যবশত কলিকাতায় আসিতেন, ভঁহারাও তথায় আসিয়া আশ্রয় লইতেন। এতদ্দেশপ্রচলিত একটি বহু প্রাচীন ও অতি মহনীয় রীতি অনুসারে ধনবান্ লোকের পণ্ডিত দলে পরিবৃত থাকে, এবং ঐ সকল পণ্ডিত তাহাদিগকে সকল বিষয়ে আপনাদের মতামত জ্ঞাপন করেন এবং তর্কশাস্ত্রে ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে বিচার করেন। নবকৃষ্ণের সভা যে বহু বিখ্যাত পণ্ডিতে অলঙ্কৃত ছিল, তাহা জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন এবং বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের নাম দেখিয়াই বুঝা যায়। তাঁহার সভায় বিষয়ের বিচার হইত এবং বিচারক পপণ্ডিতগণকে যথোপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করিয়া উৎসাহ দেওয়া হইত। তাঁহার অগাধ ধন ও প্রভূত ক্ষমতা সহায়তায় তিনি বহু দুষ্প্রাপ্য পারসী ও সংস্কৃত হস্তলিখিত গ্রন্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”
৺ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “সমাচার চন্দ্রিকা” হিন্দু ধর্ম্মের পক্ষাবলম্বী বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। ১৮২১ অব্দে ইহা প্রথম প্রকাশিত হয়। ইহা ধর্ম্মসভার মুখপত্র ছিল। ভবানীচরণ এই সভারও সম্পাদক ছিলেন, এবং ৺রাজা গোমোহন দেব বাহাদুর উহার স্থাপনকর্তা ও সভাপতি ছিলেন। সত্য কথা বলিতে কি, হিন্দুধর্ম্মের স্বার্থসংরক্ষণার্থ হিন্দুদিগের উহাই সর্বপ্রথম সাধারণ অনুষ্ঠান। জে, সি, মার্শম্যান ভবানীচরণ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, পণ্ডিত আখ্যাধারী না হইলেও তিনি সাতিশয় বুদ্ধিমান ও বিলক্ষণ বিধান এবং অতীশয় উৎসাহশীল ও কার্যকুশল ব্রাহ্মণ ছিলেন বলিয়া স্বদেশীয়দিগের মধ্যে বিলক্ষণ প্রভুত্ব সংস্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। চন্দ্রিকার সুদক্ষ সম্পাদকের জীবিতকালে ইহা দেশের প্রচলিত কুসংস্কারের প্রবল রক্ষক বলিয়া বিবেচিত হইত। ভবানীচরণ যে সকল মত প্রকাশ করতেন, লোকে তাহা পরম সমাদরে গ্রহণ করিত। পরন্তু এই সমাজই ইহার উন্নতির এক মাত্র কারণ নহে, প্রত্যুত তাঁঁহার রচনার বিশুদ্ধতা ও প্রাঞ্জল ভাষাও তৎপক্ষে বিলক্ষণ সহায় কয়িছিল। কয়েক ২সর মাত্র হইল চন্দ্রিকার জীবনের অবসান হইয়াছে।
তদানীন্তন কালের আর একখানি বিখ্যাত সংবাদপত্রের নাম “সংবাদ-প্রভাকর।” সুকবি ৺ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদকত্বে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ইহা প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয়। প্রথমে ইহা সপ্তাহে তিন দিন বাহির হইত, পরে ১৮৩৭ অব্দে দৈনিক আকার ধারণ করে। ৺রায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাহাদুর, ৺দীনবন্ধু মিত্র, শ্রীযুক্ত মনোমোহন বসু প্রভৃতি খ্যাত্যাপন্ন লেখকগণ ঈশ্বরচন্দ্রের নিকট শিক্ষানবিসি করিয়া হাত পাকাইয়াছিলেন। তৎকালে সমাজের উপর তাঁহার অপরিসীম প্রভাব ছিল। কিন্তু জীবনের শেষদশায় তিনি দারুণ দুরবস্থায় পতিত হন এবং ৺মহারাজ কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের আশ্রয়ে তাঁহার খড়গহস্থ বাগানবাটীতে বাস করেন। তথায় ঈশ্বরচন্দ্রের কুঞ্জ নামক একটী কুঞ্জ অদ্যাপি তাঁহার নাম ঘোষণা করিতেছে। শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত লিখিয়াছেন;—“তাঁহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতাগুলিই তাঁহার যশের মূল ভিত্তি, ঐ সকল কবিতা রস-মাধুর্যে পরিপূর্ণ এবং জনসাধারণের অতি আদরের সামগ্রী। জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাবলী, বিশেষত হিন্দুর জীবনের সর্বাবস্থার ঘটনাবলীই, তাহার রচনার বিষয়। শরতের দুর্গোৎসবকালীন বা শীতের আমনী উৎসবকালীন হিন্দু গৃহস্থের হর্ষবিবাদ, হিন্দুচরিত্রের দোষগুণ, তাহাদের আশা, আকাঙখা ও অনুরাগ, তাঁহাদের মাৎসর্য্য ও বিবাদ বিসংবাদ, নব্য বাঙ্গালীদিগের নানাপ্রকার দোষ এবং তাহাদের অভিমান ও আকাঙ্ক্ষা এই সমস্ত বিষয় এবং এতাদৃশ অন্য বিষয় তিনি যেরূপ নিপুণতার সহিত অখাযথভাবে পুঙ্খাপুঙ্খরূপে বর্ণন করিয়াছেন, তাহা নিতান্ত বিস্ময়াবহ। কবিতাগুলি পাঠ করিলে পাঠকের মনে হয় যেন, তিনি গ্রন্থকারের চিত্রিত দৃশ্যাবলী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিতেছেন এবং কল্পিত অভিনেতা ও বক্তাদের মধ্যে বাস ও বিচরণ করিতেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র ব্যঙ্গ রসের অবতারস্বরূপ। তাঁহার স্বাভাবিক সরল কবিতার প্রত্যেক ছত্রে অতি উচ্চশ্রেণীর রসমাধুর্য্য দেদীপ্যমান। পরন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় করুণরসাদি কবিজনোচিত উচ্চশ্রেণীর গুণপনার একান্ত অভার দৃষ্ট হয়।
তদানীন্তন কালের আর একখানি প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন সংবাদপত্রের নাম “সংবাদ-ভাস্কর”। প্রখিতনামা পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য ইহার সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাধারণত ‘গুড়গুড়ে ভভট্টাচার্য্য এই বিকৃত নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি “রসরাজ” নামে আর একখানি কাগজও বাহির করিয়াছিলেন। তৎকালীন হিন্দুসমাজ ঈশ্বরচন্দ্র ও গৌরীশঙ্করের সরস লিপিযুদ্ধে যার পর নাই আনন্দানুভব করিত। কথিত আছে যে, তাঁহারা এই ব্যাপারে নিরতিশয় অশ্লীলতা, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও কুরুচির পরিচয় দিতেন; পরন্তু বর্তমান সময়ের কোন কোন বাঙ্গালা সংবাদ পত্রে পরস্পরের প্রতি কটুক্তি বর্ষণের সহিত তুলনা করিলে, তাহাদের সে লেখাও সংযমের অভাব বলিয়াই বোধ হয়। সিপাহী-বিদ্রোহের সময় মহারাজ কমলকৃষ্ণ বাহাদুর সংবাদ ভারে নিয়মিতরূপে প্রবন্ধ লিথিতেন। এই অধ্যায়ের শেষাংশে সংবাদপত্রের ও সাময়িক পত্রের এক তালিকা দেওয়া হই। তালিকা যে সম্পূর্ণ হইয়াছে, একটিও ছাড় হয় নাই এমন কথা বলিতে পারা যায় না।
সোম প্রকাশ-বাঙ্গালা কাগজের মধ্যে পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ-সম্পাদিত “সোমপ্রকাশ” সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি অতি সুন্দর বাঙ্গালা লেখক ছিলেন,—তাঁহার লেখার তেজ ফুটিয়া বাহির হইত। ৺পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরপ্রমুখ সুবিচারকেরা তাঁহার লেখার যথেষ্ট সুখ্যাতি করিয়াছেন। বলিতে গেলে, তিনি যেন প্রাচীন ও বর্ত্তমান সংবাদপত্র-সম্পাদন-প্রণালীর সন্ধিস্থলে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। তৎকালে সোমপ্রকাশের ন্যায় প্রভাবশালী কাগজ আর ছিল না। দ্বারকানাথ সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ও স্বাধীনপ্রকৃতির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ২৪ পরগণার অত: পাতী চিঙড়ি পোতা গ্রামে তাঁহার জন্ম হয়। দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র সম্বন্ধীয় আইন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোমপ্রকাশের প্রকাশ তিরোহিত হইয়া যায়। কিছুদিন পরে পূর্ব্ব সম্পাদকের অধীনে ইহা পুনরাবির্ভূত হয়, কিন্তু এখন ইহার জ্যোতিঃঃ বিলুপ্ত।
এডুকেশন গেজেট-৺ভুদেব মুখোপাধ্যায় এই সাপ্তাহিক পখানি অতীব দক্ষতা ও বিজ্ঞতার সহিত সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন। গভর্ণমেণ্ট ইহাতে অর্থসাহায্য করিতেন। এই কাগজখানি অদ্যপি জীবিত আছে।
মাসিক পত্রসমূহের মধ্যে ১৮৫১ অব্দে প্রথম প্রকাশিত ও ৺রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত “বিবিধার্থ সংগ্রহ” পত্রের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই সচিত্র পত্রখানি বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইত এবং ইহাতে প্রধানতঃ শিল্প-বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ক প্রসঙ্গে আলোচনা হইত। শেষ দশায় ইহা ৺কালীপ্রসন্ন সিংহের হস্তে আসিয়া পড়ে। তিনি পূর্ব্ব নামের পরিবর্তন করিয়া ইহার নাম “রহস্য সংগ্রহ” রাখেন।
বঙ্গদর্শন-৺বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত এই মাসিক পত্রখানিও সাতিশয় খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল। ইহার প্রথম অবস্থায় যে সকল বাঙ্গালী লেখক ইহাতে লিখিতেন, তাঁঁহাদের মধ্যে অনেকেই উত্তরকালে খ্যাতিমান্ হইয়াছেন। বঙ্কিম চন্দ্রের অসাধারণ সৃজন ক্ষমতা এবং রচনাশক্তি ছিল। বলিতে গেলে, তিনি বর্ত্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যকে এক অভিনব পথে পরিচালিত করিয়াছেন। বিদ্রূপবাণবর্ষণ দ্বারা হৃদয়ের মর্মগ্রন্থি ছিন্ন করিবার তাহার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তাঁহার রচনায় তাঁহার অসামান্য বিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণশক্তি এবং সরস রসিকতা প্রকাশ পাইত। চরিত্রচিত্রণে তিনি যে অদ্ভুত নৈপুণ্য প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, বস্তুতঃ তাহার তুলনা নাই।
বঙ্গবাসী—সুলত বাঙ্গালা সংবাদপত্র প্রচার বিষয়ে “বঙ্গবাসী”র প্রতিষ্ঠাতারাই সবিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন ও সাফল্য লাভ কয়িয়াছেন। লর্ড রিপণের শাসনকালে কতকগুলি স্বাধীনচিত্ত দেশহিতৈষী মহাত্মার যত্নে এই পত্র প্রথম প্রকাশিত হয়। ঐ সকল মহাত্মার মধ্যে শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ রায় এবং ইহার বর্তমান সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। জন্মবধি ইহার প্রবন্ধাবলী পাঠকদিগের চিত্তাকর্ষণ করিতে লাগিল, এবং ইহা সত্বরেই প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ও ক্ষমতাশালী হইয়া উঠিল। এ পর্যন্ত কোন সংবাদপত্রের ভাগ্যে যাহা ঘটে নাই, ইহার ভাগ্যে তাহাই ঘটিল,—বাঙ্গালা সংবাদপত্রের ইতিহাসে যাহা হয় নাই, ইহই তাহার হইল,—বঙ্গবাসী ১৫ হইতে ২০ হাজার নিয়মিত গ্রাহক সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইল। এই অসাধারণ সমৃদ্ধির প্রধান কারণ যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর সুদক্ষতা। তাহার সুদক্ষ পরিচালনগুণে কেবল যে কাগজখানি অশ্রুতপূর্ব ও অতুলনীয় মর্যাদা ও সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছিল তাহা নহে, প্রত্যুত শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার, শ্রীযুক্ত চন্দ্রনাথ বসু, শ্রীযুক্ত ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি সুলেখকগণ ইহার সহিত একমতাবলম্বী হইয়া বঙ্গবাসীর উন্নতির জন্য কায়মনোবাক্যে চেষ্টা করিয়াছিলেন। হিন্দুধর্ম্মের পক্ষাব স্বম হেতু বহুসংখ্যক শিক্ষিত লোক ইহার সহিত যোগদান করেন। এই সময়ে সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত শশধর তর্কচূড়ামণি এমন ভাবে হিন্দুধর্মের প্রচার ও ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন যে, তাঁহার ভক্তগণ তাঁঁহাকে বৈজ্ঞানিক আখ্যা প্রদান করিলেন, এই সেই সমস্ত ব্যাখ্যা বঙ্গবাসীতে প্রকাশিত হইতে লাগিল। শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ওরফে কৃষ্ণনন্দ স্বামীও কিছু দিন ইহাতে লিখিয়াছিলেন। এইরূপে দিন দিন বঙ্গবাসীর প্রসার বৃদ্ধি হইতে লাগিল। বাঙ্গালায় যাহা কখনও হয় নাই, তাহাই হইল,—সুদূর পল্লীগ্রামবাসীরা, অশিক্ষিত দোকানদারেরা এমন কি মফঃস্বলে ফেরিওয়ালারা পর্যন্ত বঙ্গবাসী পাঠ করিতে বা উহার পাঠ শ্রবণ করিতে লাগিল। হিন্দুধর্ম্মের বর্ত্তমান ভাব এই অভিনব প্রণালীর প্রচারে যেন নববলে বলীয়ান্ হইয়া উঠিল। এই সময়ে বঙ্গবাসী “ইণ্ডিয়ান ন্যাশন্যাল কংগ্রেস্” নামক সভার কোন কোন কার্য্য ও প্রণালীর দোষোদঘাটন করিয়া এবং উহার অমিতব্যয়িতার উল্লেখ করিয়া উহার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ প্রকাশ করিতে লাগিল। ইহাতে অপর পক্ষীয়েরা বঙ্গবাসীর প্রতি বিরূপ হইলেন এবং এমন একখানি কাগজের অভাব অনুভব করিতে লাগিলেন যাহা রাজনৈতিক বিষয়ে বঙ্গবাসীর বিপরীত মতাবলম্বী হইবে।
হিতবাদী-ঐরূপ একখানি সংবাদপত্র প্রকাশ করিবার উদ্দেশ্যে একটি জয়েণ্ট ষ্টক কোম্পানির সৃষ্টি হইল, এবং তাঁহাদের যত্নে “হিতবাদী” প্রচারিত হইল: সুপ্রসিদ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য ইহার সম্পাদক হইলেন। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ খ্যাতনামা লেখকগণ ইহার নিয়মিত লেখক ও পৃষ্ঠপোষক হইলেন। কিন্তু এই কারবার লাভবান না হওয়ায় কিছু দিন পরে ইহা পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদকে বিক্রয় করা হয়। তিনিই ইহার বর্তমান সম্পাদক। তাঁহার সুদক্ষ পরিচালনগুণে হিতবাদী ৩০ ইইতে ৪০ সহস্র গ্রাহক সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে। পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন নানাবিষয়ে সুপণ্ডিত। তিনি কেবল বাঙ্গালা গদ্য রচনাতেই সুদক্ষ নহেন, পদ্য রচনাতেও সুনিপুণ। তিনি কেবল সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত নহেন, ইংরাজীতেও সুশিক্ষিত।
সঞ্জীবনী-একখানি বাঙ্গালা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত উন্নতশ্রেণীর ব্রাহ্মদিগের যত্নে ইহার জন্ম। সিটি কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ শ্রী যুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র ইহার বর্ত্তমান সম্পাদক। ব্রাহ্মদিগের স্বার্থসংরক্ষণ ইহার উদ্দেশ্য হইলেও, যাহাতে সর্বশ্রেণীর লোকের হিতসাধন হইতে পারে, এরূপ বহু বিষয় অপক্ষপাতে ও যুক্তি সঙ্গত ভাবে ইহাতে আলোচিত হইয়া থাকে। অতি উদার নীতিতে এবং অত্যন্ত সুবুদ্ধিসহকারে ইহা পরিচালিত হইয়া থাকে।
এতদ্ব্যতীত আরও অনেকগুলি সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্র আছে। এস্থলে সে সকলের উল্লেখ করা হইল না। দুঃখের বিষয় এই যে, স্থানাভাববশতঃ “ভারতী” “নব্যভারত” প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর পত্রগুলির নামোল্লেখ পর্য্যন্ত করিতে পারিলাম না। এই কাগজগুলি অতিশয় দক্ষতা ও যোগ্যতার সহিত পরিচালিত হইয়া থাকে।
ধর্ম্ম, শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি মানব-জ্ঞানক্ষেত্রের তাবৎ বিষয়ে হিন্দুজাতি যে মানসিক ক্রিয়াশীলতার পরিচয় দিয়াছেন, একটি অধ্যায়ে তাহার সবিস্তার আলোচনা করা দুঃসাধ্য। ৺রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ১৮২২ খৃষ্টাব্দে তাঁহার সুবিখ্যাত সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুমের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। উহা পরে ক্রমান্বয়ে আট খণ্ডে সমাপ্ত হইয়াছে। ঐরূপ অভিধান এদেশে পূরর্ব্বে আর কখনও প্রকাশিত হয় নাই। উহার সম্পাদনে অপরিসীম পাণ্ডিত্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম ও সুবিস্তর গবেষণার প্রয়োজন হইয়াছিল। উহাতে অর্থব্যয়ও যে প্রভূত হইয়াছিল তাহা বলাই বাহুল্য, কারণ মুদ্রণকৌশল তাহার অল্প দিন পুর্ব্বেই এদেশে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। ৺রামকমল সেন ডাক্তার ক্যারি সহায়তায় ১৮৩০ অব্দে শ্রীরামপুরে তাঁহার ইংরেজী বাঙ্গালা অভিধান প্রকাশ করেন। টড্, সম্পাদিত “জনসনস্ ডিক্সনারি” নামক অভিধানের অনুকরণে ইহা সঙ্কলিত এবং ১৮৩৪ অব্দে ইহার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম ক্যাভেণ্ডিস বেণ্টিঙ্ক বাহাদুরের নামে ইহা উৎসর্গীকৃত হয়। ইহার প্রচারের পূর্ব্বে আরও অনেক অভিধান গভর্ণমেণ্টের উৎসাহে ও সাহায্যে ভারতবর্ষে প্রকাশিত হইয়াছিল।[৪]
রামগোপাল ঘোষ সংবাদপত্র-ক্ষেত্রে কি কাজ করিয়াছেন, আমরা এক্ষণে তাহাই সংক্ষেপে উল্লেখ করিব। “জ্ঞানান্বেষণ” পত্রে তিনি “সিভিস্” (Civis) নামে স্বাক্ষর করিয়া বাণিজ্যশুল্ক সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখিতেন। তিনি নিজেও “স্পেক্টটর” নামে একখানি কাগজ বাহির করিয়াছিলেন। যে সকল মহাত্মা জর্জ টমসনের সহযোগে বৃটিশ ইণ্ডিয়ান্ সোসাইটী (পরে বৃটিশ ইণ্ডিয়া যাসোসিয়েশন) সংস্থাপন করেন, রামগোপাল তাঁহাদের অন্যতম ছিলেন। এই সভার আদি নাম ছিল “ল্যাণ্ড হোল্ডার্স য়্যায়োসিয়েশন” অর্থাৎ জমিদার-সভা। বঙ্গবাসীদিগের হিতকর বহু কার্য্যানুষ্ঠানেই তিনি মহানুভব ডেভিড হেয়ার ডি, বেথুন এবং ডাক্তার মোয়াটের সহযোগী ছিলেন। রামগোপাল এবং আর কয়েকজন মহানুষ ব্যক্তি দ্বারকানাথ ঠাকুর যাহাতে চারিজন ছাত্রকে বিভিন্ন ব্যবসায়ের উপযোগিনী শিক্ষা লাভ করিতে ইংল্যাণ্ডে প্রেরণ করেন, তদ্বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করেন। সর্ব্বোপরি তাহার প্রধান গুণ, সুন্দর ইংরেজী বক্তৃতা। তাঁহার ন্যায় বাগ্মী বাঙ্গালীদের মধ্যে ইতঃপূর্বে আর জন্মগ্রহণ করেন নাই। গভর্ণমেণ্ট কলিকাতায় গঙ্গাতীরে হিন্দুদিগের শবদাহ প্রথা রহিত করিতে উদ্যত হইলে, রামগোপাল জষ্টিস অভ দি পীস গণের সভায় হিন্দুদিগের পক্ষ সমর্থন করিয়া ওজস্বিনী ভাষায় যে সারগর্ভ বক্তৃতা করেন, তজ্জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। সেই বক্তৃতার ফলে গভর্ণমেণ্ট স্বীয় সঙ্কল্প পরিহার করতে বাধ্য হন। তাঁহার জীবনচরিত-লেখক বলেন,—“লেখকরূপেই কি, আর বক্তারূপেই বা কি বিশুদ্ধ ও সুপ্রণালীসম্মত ইংরেজী ভাষা প্রয়োগে তাঁহার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তিনি যে কোন বিষয়ের আলোচনা বা পক্ষসমর্থন করিতেন, তাহাতে মন প্রাণ ঢালিয়া দিয়া এমনই বিভোর হইয়া প্রবৃত্ত হইতেন যে, ইংরেজী ভাব ও ভাষা তাঁর পক্ষে বৈদেশিক অথবা তিনি ইংরেজপরিবারের মধ্যে লালিত পালিত হন নাই, ইহণ বিশ্বাস করা দুঃসাধ্য হইত। কলিকাতায় সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার কক্রেন সাহেব এক সময়ে বলিয়াছিলেন যে, স্বদেশীয়দিগের হিতকর সর্ববিষয়ের সমর্থনে রামগোপাল যেরূপ বাগ্মিতা ও আগ্রহ প্রকাশ করিতেন, অন্য কাহাকেও তদ্রুপ করিতে তিনি কখনও শুনেন নাই” রামগোপাল জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। তাঁহার পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র। তিনি ১৮১৫ অব্দের অক্টোবর মাসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৬৮ অব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি কালগ্রাসে পতিত হন। যাহারা এ দেশে জয়েণ্ট স্টক কোম্পানির প্রথম সৃষ্টি করেন, রামগোপাল তাহাদের মধ্যে একজন ছিলেন। বাঙ্গালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম বেঙ্গল চেকার অভ, কমার্স নামক সভার অন্যতম সদস্য নিযুক্ত হন(১৮৫০)। রামগোপালের আচার ব্যবহারগুলি প্রকৃত হিন্দুজনানুমোদিত ছিল না; এজন্য তাঁহার মাতার শ্রাদ্ধের সময় তাহাকে মহা সঙ্কটে পড়িতে হয়। সে সময়ে তিনি মহারাজ কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের কৃপায় সে সঙ্কট হইতে উদ্ধার প্রাপ্ত হন। বলা বাহুল্য, উক্ত মহারাজ রামগোপালের গুণের সবিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। রামগোপাল মৃত্যুকালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০,০০০ ডিষ্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল, সোসাইট নামক সভায় ২০,০০০ এবং তাঁহার যে সকল বন্ধুবান্ধব তাঁহার নিকট ঋণী ছিলেন, তাহাদিগকে ৪০,০০০ টাকা দান করিয়া যান।
প্রেসিডেন্সি কলেজের অন্যতম অধ্যাপক ‘প্যারীচরণ সরকার বহুদশী শিক্ষাতত্ত্বজ্ঞ ও লোকহিতৈষী বলিয়া সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতীয় শিক্ষকগণের শিরোমণি”ও “প্রাচ্য ভূখণ্ডের আর্ণল্ড” আখ্যায় অভিহিত হইতেন। তিনি “হিতসাধক” নামে একখানি বাঙ্গালা কাগজ এবং পরে ১৮৬৫ বা ১৮৬৬ অব্দে “ওয়েল-উইশার” (হিতৈষী) নামে একখানি ইংরেজী পত্র প্রকাশ করেন। বঙ্গদেশের মাদক-নিবারণবিষয়ক অনুষ্ঠানের সহিত তাঁহার সংস্রব ছিল। এই সূত্রে একটী মাদক-নিবারণী-সভা স্থাপিত হয়। প্রথমতঃ মহারাজ কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ও তৎপরে মহারাজ কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুর উহার সভাপতি হন, এবং সেই সময়ে কেশবচন্দ্র সেনও উহাতে যোগদান করেন। প্যারীচরণের হস্তে কিছুদিন “এডুকেশন গেজেট" পুরো ভার ছিল। তিনি ছাত্রবর্গের, বিশেষত দরিদ্র ছাত্রগণের পরম সহায় ও অভিভাবক বলিয়া খ্যাত ছিলেন। তৎপ্রণীত ফার্ষ্ট বুক্ অভ্ রিডিঙ্, সেকেণ্ড বুকু অভ্ রিডিঙ্ প্রভৃতি ইংরেজী শিক্ষার প্রথম পুস্তকগুলি অদ্যাপি সমাদৃত ও নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অধুনা স্যর রোপার লেখব্রিজ সাহেব ঐ সকল পুস্তক প্রকাশ করিয়া থাকেন, কারণ তিনি উহাদের প্রচারস্বত্ব ক্রয় করিয়া লইয়াছেন। প্যারীচরণ ১৮২৩ অব্দের ২৩শে জানুয়ারি কলিকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৭৫ অব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর মৃত্যুমুখে পতিত হন।
৺প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী কিছু দিন কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বোধ হয়, দেশীয়দিগের মধ্যে তিনিই প্রথম বাঙ্গালা ভাষায় পাটীগণিত ও বীজগণিত বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তৎকালে এই কার্য্য যে নিতান্ত দুঃসাধ্য ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই; কারণ তত্ত্বদ্বিষয়োপযোগী অনেক নূতন নূতন শব্দই প্রস্তুত করিয়া লইতে হইয়াছিল। বহুদর্শী শিক্ষাতত্ত্বজ্ঞ বলিয়া তিনি সুপরিচিত ছিলেন। বহু বিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়া এবং অনেক ছাত্রকে অর্থ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু দান করিয়া তিনি দেশমধ্যে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের সহায়তা করিয়াছিলেন। ১৮৮৬ অব্দের নভেম্বর মাসে তাঁহার মৃত্যু হয়। ৺কিশোরীচাদ মিত্র স্বসময়ের সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্র একজন উৎকৃষ্ট ইংরেজীলেখক বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ৺দ্বারকানাথ ঠাকুরের একজন প্রকৃত সুহৃদ ছিলেন এবং তাহার জীবনচরিত প্রণয়ন করেন। ৺প্যারীচাদ মিত্র ১৮১৪ অব্দে কলিকাতা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙ্গালা সংবাদপত্র ক্ষেত্রে ও সাধারণতঃ বাঙ্গালা সাহিত্যক্ষত্রে তিনি যে কাজ করিয়াছেন, তাহার ফল নিতান্ত অস্থায়ী রকমের নহে। রেভারেণ্ড জে, লঙ তাঁহাকে “বাঙ্গালার ডিকেন্স”আখ্যা প্রদান করিয়াছিলেন। ইংরেজী ও বাঙ্গালা ভাষায় তাঁহার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল” “জমিদার ও রাইয়ত” শীর্ষক হার যে প্রবন্ধ কলিকাতা রিভিউ পত্রে প্রকাশিত হয়, লর্ড আলবিমাল তাহা পার্লামেণ্টের লর্ড সভার গোচরে আনয়ন করেন। সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মবিষয়ে তিনি বহু প্রসিদ্ধ প্রবন্ধ লিখিয়া গিয়াছেন। “আলালের ঘরের দুলাল” প্রভৃতি বিদ্রুপাত্মক গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায়, বোধ হয়, তিনিই প্রথম সুচনা করেন। তাহার জীবনচরিত-লেখক বলেন, তাঁহার একখানি পুস্তকও আকারে বড় নয় বটে, কিন্তু সকলগুলিই সুস্পষ্ট ও সরল ভাষায়,—যে ভাষায় আমরা সচরাচর কথা কহি, সেই ভাষায় লিখিত, এবং সকলগুলিই মৌলিকতাগুণের নিমিত্ত সবিশেষ প্রশংসনীয়। নিকষ্ট শ্রেণীর গ্রন্থসমুহ যেরূপ হলাহলরাশি, প্রচণ্ড ক্রোধ ও দারুণ বিদ্বেষের ভাবে পরিপুর্ণ, তাঁহার বিদ্রুপাত্মক পুস্তকে তাহার কোন চিহ্নই ধৃষ্ট হয় না। তিনি “মাসিক পত্রিকা” নামে একখানি বাঙ্গালা কাগজ বাহির করেন। ইহা যে প্রতিমাসে প্রকাশিত হইত, তাহা ইহার নাম দ্বারাই বুঝা যায়। তারাচাদ চক্রবর্তীর সহিত একযোগে তিনি বাঙ্গালা “স্পেক্টার” প্রকাশ করেন। জর্জ টমসন সাহেবের সভাপতিত্বে বৃটিশ ইণ্ডিয়ান সোসাইটী স্থাপিত হইলে প্যারীচাঁদ উহার সম্পাদক হন।
বাঙ্গালা সাহিত্য-ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকোবাসী সুপ্রসিদ্ধ ৺ কালীপ্রসন্ন সিংহ যে কাজ করিয়াছেন, তাহার যথোচিত প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। তাহারই যত্নে এবং তাহারই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানাধীনে সুপ্রসিদ্ধ মহাকাব্য মহাভারত বাঙ্গালা গদ্যে অনুদিত হয়। মহাভারতের আরও কয়েকখানি বাঙ্গালা অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে বটে, কিন্তু মুলের প্রকৃতভাব বাস্তু এবং ভাষার বিশুদ্ধতা ও উচ্চতায় তাঁহাদের একখানিও কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদের সহিত তুলনীয় নহে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত ইহার যথোচিত অনুবাদ ও বিশুদ্ধতার তত্ত্বাবধান করিয়াছিলেন। উদারহৃদয় মহাত্মা বাঙ্গালা ভাষার যে অপরিমেয় মহোপকার সংসাধন করিয়াছেন, তাহা কখনও বিস্মৃত হইবার নহে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বাঙ্গালাভাষা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের নিকট অদ্যাপি অপরিজ্ঞাত; নচেৎ তিনি যে এতদিন তাঁহার পরিশ্রমের অনুরূপ পুরস্কার লাভ করিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তদানীন্তনকালে বাঙ্গালা ভাষার সে যে পরিমাণ স্বদেশানুরাগ ও স্বার্থ-তারে প্রয়োজন হইত, তা। অতি অল্প লোকেই প্রদর্শন করিতে পারিতেন। এরূপ স্থলে তিনি ও তার স্বদেশীয়গণের আন্তরিক কৃতজ্ঞতার পাত্র, তাহা কে অস্বীকার করিবে। তিনি বহু গুণী ব্যক্তির সহায় ও সুহৃদ ছিলেন। ঐ সকল গুণী ব্যক্তি পরে সংসার-ক্ষেত্রে বিভিন্ন পথে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। বাঙ্গালা নাট্যশালার শ্রীবৃদ্ধিসাধনে তিনি বিস্তর সায়তা করিয়াছেন। তাঁহার হাস্যরসাত্মক ও বিদ্রুপা ত্মক সামাজিক না “হুতুম প্যাঁচা” গ্রন্থে তিনি তদানীন্তন সমাজের ভাল মন্দ সকল ভাবই বিশদরূপে যথাযথভাবে অতি নিপুণতার সহিত চিত্রিত করিয়াছেন। ঐ শ্রেণীর গ্রন্থের মধ্যে উহাই সর্বোৎকষ্ট, —উহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পুস্তক এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই। হয় তো এমন দিন আসিলেও আসিতে পারে, যখন লোকে হুতুম প্যাঁচা পড়িবে না, কিন্তু এমন দিন কখনই আসিবে না, যখন হুতুম প্যাঁচা পড়িয়া লোকে আনন্দ ও উপকার লাভ না করিবে। কালীপ্রসন্ন দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের বংশধর ও জয়কৃষ্ণ সিংহের পৌত্র। এই জয়কৃষ্ণ প্রাচীন হিন্দু কলেজের সংস্থাপন ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন। কালীপ্রসন্ন ব্যবসায়ে জমিদার ও জাতিতে কাষ ছিলেন। তাঁহার বংশধরের। অদ্যাপি জীবিত আছেন।
৺মধুসূদন দত্ত বাঙ্গালা গদ্য-ক্ষেত্রে তে কাজ করিয়া গিয়াছেন, সত্য সত্যই তাহার তুলনা নাই। শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত লিখিয়াছেন;—“মেঘনাদ বধ” অতি উচ্চশ্রেণীর বীররসাত্মক কাব্য; সমস্ত বাঙ্গালা সাহিত্যরাজ্য তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিলেও ইহার তুল্য উচ্চতাবিশিষ্ট রচনা আর দেখিতে পাওয়া যাবে না।যাঁহারা উচ্চভাব অনুভব হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ, তাঁহারা মেঘনাদ বধ পাঠ করিলে যেরূপ ভক্তিবিমিশ্র ভয়ের ভাবে বিভোর হইবেন, বঙ্গীয় অন্য কোন কবির কাব্য পাঠে সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই; অপিচ তাঁহারা মধুসূদনকে অতি উচ্চশ্রেণীর প্রতিভাসম্পন্ন কবি বলিয়া স্বীকার করিবেন, এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকবি ব্যাস, বাল্মীকি বা কালিদাস, অথবা হোমার, ড্যাণ্টি বা সেক্সপিয়রের অব্যবহিত নিম্নাসনে স্থান দিবেন। যশোহর জেলায় ১২২৮ অকে মধুসূদনের জন্ম হয়। ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম কালে তিনি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং অধ্যয়ন সমাপ্ত করার পর কিছুদিন মাদ্রাজে যাইয়া অবস্থিতি করেন। অনন্তর তিনি বাঙ্গালায় প্রত্যাগমন করিয়া তিনখানি নাটক, দুইখানি প্রহসন, এবং বাঙ্গালস ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিনখানি ও মিত্রাক্ষরচ্ছলে একখানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ইতঃপূর্ব্বে অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাঙ্গালা কবিতা আর কেহ রচনা করেন নাই। অতঃপর তিনি ইংল্যাণ্ডে গমন করেন এবং প্রাতঃস্মরণীয় উদারচরিত দাতা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহায্যে ব্যারিষ্টার হইয়া স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হন। ১৮৭৫ অব্দে মধুসূনের মৃত্যু হয়। বস্তুয় তাঁহার গ্রন্থাবলী পাঠ করিলে, সেগুলি বৃষ্টিয়ানের রচিত, বিশ্বাস করিতে কোন মতেই প্রবৃত্তি হয় না।
শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দলের মতে মধুসূদনের নিয়েই সুপ্রসিদ্ধ কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন। তাঁহার কবিতা উচ্চশ্রেণীর মধুর কল্পনা, সৌন্দর্য্যের অতি উৎকৃষ্ট ভাব, বিশুদ্ধ চিন্তা ও ভাবগাম্ভীর্য্যে পরিপূর্ণ। তাহার ছোট ছোট কবিতাগুলিতেও উন্নত ও গভীর ভাব প্রকটিত। হেমচন্দ্র অনেকগুলি পদ্যগ্রন্থ লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি কলিকাতা হাইকোটের সবকারী উকিল ছিলেন। ১৮০৮ অব্দে তাঁহার জন্ম এবং ১৯০২ অব্দে তাহার মৃত্যু হয়। শী শ্রীযুক্ত নবীনচন্দ্র সেনের কবিতাতেও উচ্চশ্রেণীর কল্পনা ও ভাবমাধ্যুর্য্য প্রকটিত। উহার সৌন্দর্য্য যেন নিত্য নতুন। বাঙ্গালা কবিতা রচনায় আরও অনেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, তন্মধ্যে ৺মদনমোহন তর্কালঙ্কার ৺রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যুক্ত মনোমোহন বসু, এবং নারী কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, কামিনী সেন, মানকুমারী প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুর, মনোমোহন বস, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, বিহারিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং রাজকৃষ্ণ রায়ও বাঙ্গালা সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষতঃ উহার নাটক বিভাগে, সুলেখক বলিয়া খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন: দীনবন্ধুর লেখায় স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তিনি লোকের চরিত্র অবিকল চিত্রিত করিয়া সমাজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা পাইয়াছেন। তাঁহার নাটকীয় চরিত্র: গুলি তাহাদের নীচতা ও দুশ্চরিত্রতা প্রদর্শনস্থলেও এমন নিপুণতার সহিত হুবহু চিত্রিত হইয়াছে যে, তজ্জন্য গ্রন্থকারকে শতমুখে প্রশংসা করিতে হয়। শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসুর রচনায়ও ঐ গুণ দৃষ্ট হয়। তাঁহার বিদ্রুপাত্মক মর্মভেদী সামাজিক নক্সাগুলি তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় করিয়া তুলিয়াছে!
রামবাগানের দত্তবংশীয়েরা পুরুষানুক্রমে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া আসিতেছেন। এতদ্বংশীয়দিগের মধ্যে যাঁহারা বাঙ্গালীর মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, তন্মধ্যে নীলমণি দত্ত, রসময় দত্ত, রায় শশিচন্দ্র দত্ত বাহাদুর, গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত, ঈশানচন্দ্র দত্ত, যোগেশচন্দ্র দত্ত, কুমারী তরুবালা দত্ত, ও, সি, দত্ত এবং রমেশচন্দ্র দত্ত এই কয়েকজনের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এক পরিবারে এতগুলি লেখকের উদ্ভব নিতান্ত বিস্ময়জনক নহে কি? ৺নীলমণি দত্তকে এই বংশের একরূপ প্রতিষ্ঠাতা বলিতে পার। যায়। বাঙ্গালীদের মধ্যে এই নীলমণিই প্রথম ইংরেজী শিক্ষা করেন। তিনি মহারাজ নবকৃষ্ণ যাহাদুরের একজন সুস্থ ও সহচর ছিলেন। রসময় দত্ত কলিকাতা ছোট আদালতের প্রথম দেশীয় জজ হন। রায় শশিচন্দ্র দত্ত বাহাদুর বিবিধ বিষয়ে যে সকল গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, তাহাতেই তাহার বহুমুখীন বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় সুপরিস্ফুট। শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত সাহিত্য-ক্ষেত্রে যে অসামান্য শ্রম স্বীকার করিয়াছেন, তজ্জন্য তিনি তাঁহার স্বদেশীয়গণের অশেষ কৃতজ্ঞতার ভাজন, সন্দেহ নাই। তাঁহার মহনীয় উপন্যাসগুলি বঙ্গবাসীদিগের পরম সময়ের সামগ্রী। তিনি ঋগবেদের সটীক সংস্করণ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা ইউরোপের বিদ্বৎসমাজে সমুচিত প্রশংসালাভ করিয়াছে। তাঁহার ঐতিহাসিক গ্রন্থনিচয় তাঁহাকে সুলেখক বলিয়া ঘোষণা করিতেছে। ফলতঃ তিনি একা ধারে ঐতিহাসিক, ঔপন্যাসিক কবি, পণ্ডিত ও সুলেখক।
৺সার রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩৪ বৎসরকাল উক্ত বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। সেকালে হিন্দু সমাজ ইংরেজী শিক্ষাকে ঈর্ষা ও আশঙ্কার চক্ষে দেখিত, কিন্তু উক্ত বাজা বাহাদুর উহার পক্ষাবলম্বন করেন এবং কলেজটাকে সুফলপ্রসু করিয়া তুলেন। তিনি গভর্ণমেণ্ট-সংস্কৃত কলেজের নিয়মিত পরিদর্শক ও কিছুকাল উহার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি অনেক সময়ে উহার বার্ষিক পরীক্ষাও গ্রহণ করিতেন। তিনি উদারনীতির পক্ষাবলম্বী ছিলেন ও স্ত্রীশিক্ষার মূল্য বুঝিতেন। মাননীয় বেথুন সাহেব বলিয়াছেন,—“আধুনিক কালে ভারতবাসীদিগের মধ্যে তিনিই প্রথমে স্বদেশীদিগকে বুঝাইয়া দেন যে, স্ত্রীলোকদিগকে অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন রাখা নিতান্তনির্ব্বুদ্ধিতা ও দোষের কার্য্য।” বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা পারিতোষিকগ্রহণার্থ তাঁহার ভবনে সমবেত হইত। তিনি স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে কয়েকখানি পুস্তিকা প্রচার করিয়াছিলেন, এবং ঐ সকল পুস্তিকায় যেরূপ উপদেশ দিয়াছিলেন, নিজেও যে কার্যতঃ তদনুরূপ অনুষ্ঠান করিতেন, তাহা তাঁহার স্বকীয় পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগের শিক্ষালাভের ব্যবস্থা দ্বারা বেশ বুঝা যায়। তখনকার অধিকাংশ লোকই কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটির প্রতি সভয়ে দৃষ্টিপাত করিত, কারণ তাহারা মনে করি যে, উক্ত সোসাইটির প্রচারিত গ্রন্থপাঠের ফলে এতদ্দেশীয়দিগের হিন্দুধর্ম্মবিশ্বাসের মুলোচ্ছেদ ঘটিবে; কিন্তু রাধাকান্তের মনে এরূপ অমুক আশঙ্কা স্থান পাইত না। তিনি উক্ত সোসাইটীর একজন উদ্যমশীল সদস্য ছিলেন এবং নিজেও কয়েকখানি বাঙ্গালা স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখিয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন।
উক্ত রাজার ক্রিয়াশীলতা নানাদিকে প্রকাশ পাইত। তিনি বৃটিশ ইণ্ডিয়ান য়্যাসোসিয়েশন নামক সভার প্রথম আজীবন সভাপতি ছিলেন এবং উহাকে এমনভাবে পরিচালিত করিতেন যে, তাহাতে তাহার বিজ্ঞতা ও রাজভক্তির সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাইত। তিনি কিছুকাল কৃষি ও উদ্যান-সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি অনেক কাগজে কৃষিবিষক প্রবন্ধ লিখিতেন। তিনি উদ্যানতত্ত্বঘটিত একখানি পারসী গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ প্রস্তুত করেন। বিলাতের রয়াল সোসাইটীর উপদেশে ও অনুরোধে ঐ অনুবাদ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। “শব্দকল্পদ্রুম” নামক সুবৃহৎ সংস্কৃত অভিধানের প্রচারই তাঁহার জীবনের মহত্তম কার্য্য। এই কার্য্যসাধনে বহু পরিশ্রম এবং চত্বাবিংশৎ বর্ষাধিক সময় ও প্রভূত অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হইয়াছিল। এই গ্রন্থ মুদ্রিত করিবার নিমিত্ত রাজাকে একটি মুদাযন্ত্র স্থাপন করিতে এবং বিশেষ প্রকারের অক্ষর প্রস্তুত করাইভে হইয়াছিল। এই কার্য্য দ্বারা তিনি বিশ্বব্যাপী যশ লাভ করেন। বিলাতের “রয়াল এসিয়াটিক সোসাইটী” প্যারী নগরের “এসিয়াটিক সোসাইটী’ কোপেন হাগেন নগরের “রয়াল সোসাইটী” জার্ম্মাণির “ওরিএণ্টাল সোসাইটী” আমেরিকার “ওরিএণ্টাল সোসাইটী,” সেণ্টপিটার্সবর্গ নগরের “ইম্পিরিয়াল য়্যাকাডেমি,” বার্লিন নগরের “রয়াল য়্যাকাডেমি” প্রভৃতি বিদ্বৎসমাজ তাঁহাকে স্ব স্ব সভার অবৈতনিক সদস্যরূপে গ্রহণ করিয়া নিয়োগপত্র প্রেরণ করেন। রুষিয়ার সম্রাট্ ও ডেন্মার্কের রাজা তাঁহাকে পদক পাঠাইয়া দেন। ইংল্যাণ্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়া তাঁহাকে নাইট শ্রেণীভুক্ত করিয়া ‘সার’ উপাধি প্রদান এবং উপঢৌকনস্বরূপ একটি সুন্দর স্বর্ণপদক প্রেরণ করেন। “রাজা বাহাদুর” উপাধি তিনি পূর্বেই পাইয়াছিলেন। রাধাকান্ত দেব বহু বৎসর যাবৎ জষ্টিস্ অভ্ পিস্ ও কলিকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট রূপেও কার্য করিয়াছিলেন।
রাধাকান্ত দেবের অনেক গুণ ছিল। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য ভাষায় সুপণ্ডিত, উদারনৈতিক, উন্নতিশীল এবং শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজের প্রসার সাধনে কার্যতঃ সাহায্যকারী ছিলেন। এই সকল গুণ থাকায় তিনি স্বকীয় কার্য্য ও দৃষ্টান্ত দ্বারা তাঁহার স্বদেশীয়দিগের জীবন ও চিন্তাস্রোতের গতি অনেকটা ফিরাইতে পারিয়ছিলেন। তাঁহার সমুদয় সহানুভূতি ও সুমার্জিত আচারব্যবহারের জন্য তিনি সকল শ্রেণীর লোকেরই সমাদর এবং ভক্তিশ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিলেন। সার লরেন্স পীল দীর্ঘকাল তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিয়া এবং তাঁহার আচারব্যবহার লক্ষ্য করিয়া বলিয়হিলেন, “রাধাকান্ত ভদ্রতার পূর্ণ আদর্শ এবং সে আদর্শ সর্বদা আমাদের অনুকরণীয়।”
বাঙ্গালা ভাষা, সাহিত্যের পরিপুষ্টি ও শ্রীবৃদ্ধিসাধন বিষয়ে যাত্রা, থিয়েটার ও ঐ শ্রেণীর অন্যান্য আমোদজনক ব্যাপার যে বিস্তর সহায়তা করিয়াছে, সে কথা এখনও বলা হয় নাই। উহাদের ধারা ভারতবাসীদিগের রুচি ও আচার ব্যবহার বহুপরিমাণে পরিমার্জিত ও পরিপুষ্ট হইয়াছে! উহারা বৈষ্ণব ধর্ম্মের সারতত্ত্ব, রামায়ণ মহাভাতাদি উৎকৃষ্ট ধর্ম্মগ্রন্থসমূহের উপদিষ্ট মানবের কর্ত্তব্যনীতি এবং হিন্দু দর্শনশাস্ত্রের গভীর নাতিসমূহ জনসাধারণের মনে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত করিয়া দিয়াছে। এমন কি, স্ত্রীলোকেরা এবং সুকুমারবয়স্ক বালক বালিকারাও উহা হইতে মহোপকার লাভ করিয়াছে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের এবং থিয়েটার সম্প্রদায়ের যত্ন চেষ্টায় আধুনিক বাঙ্গাল গানের এবং সকল গানের রাগ রাগিণী ও সুরের অনেক উন্নতি সাধিত হই। যাত্রার গানে এখন আর লোকের মন উঠে না, কাজেই সেগুলি বিদায় প্রাপ্ত হইয়াছে এবং মার্জিত ব্রাহ্মসঙ্গীত ও হালকা সুরের থিয়েটারের গান তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। ব্রাহ্ম সমাজের এবং থিয়েটারের চেষ্টায় বাঙ্গালা গানের যে এইরূপ রূপান্তর ঘটিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
এক সময়ে হিন্দুস্থানী ও মুসলমানী সঙ্গীতের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব ছিল। ভদ্র ও সৌখীন সমাজে ঐ সকল গানেরই সমাদর ছিল। ঐ সকল গান অতি উচ্চ অঙ্গের রাগ রাগিণীতে গীত হইত এবং সাধারণতঃ কালোয়াতী গান নামে পরিচিত ছিল। ব্রহ্মসঙ্গীত ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণীর গানের ভন বড় একটা আদর ছিল না। টপ্পা, গজেল প্রভৃতি সুমধুর সঙ্গীতগুলি মহারাজ রাজকৃষ্ণ বাহাদুরের অতি আদরের বন্ধু ছিল। তিনিই ঐ গুলিকে জনসাধারণের আদরণীয় করিয়া তুলেন। “রেইস্ এণ্ড রাইয়ত” পন্ত্রের সম্পাদক ৺শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় উক্ত মহারাজের সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহার মর্মার্থ এইরূপ;—
“সঙ্গীতের প্রতি রাজকৃষ্ণের অসীম অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে একজন বিখ্যাত গায়ক ও বাদ্যযন্ধু-বাদক ছিলেন।......গীতবাদ্যনিপুণ বহু ব্যক্তি রাজকৃষ্ণের নিকট প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করিবার আশায় সুদূর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দাক্ষিণাত্য হইতে আগমন করিত। তাহার এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ছিল বলিয়া তিনি এই বিদ্যার সুন্দর বিচার করিতে পারিতেন। সঙ্গীত বিদ্যাবিশারদ ফকির এবং সন্ন্যাসীরা অর্থস্পৃহাশূণ্য হইলেও কেবল সংসারের নীরসতা হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়া কিয়ৎকাল বিশুদ্ধ শান্তিসুখে অতিবাহিত করিবার নিমিত রাজকৃষ্ণের নিকট গমন করিতেন।”
কবি, পাঁচালি, কথকতা, আখড়াই প্রভৃতিও আমোদজনক ব্যাপার বলিয়া হিন্দুসমাজে প্রচলিত ছিল। এই সকল ব্যাপারের উন্নতিকল্পে ৺মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর যে আয়াস স্বীকার ও যত্ন চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন, তাহার উয়েখ না কষিয়া থাকা যায় না। এ সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত এন্, এন্, ধোষ লিখিয়াছেন;—
“সুকুমার শিল্পের প্রতি, বিশেষতঃ সঙ্গীত বিদ্যার প্রতি তিনি যে অনুরাগ প্রদর্শন করিতেন, তাহা সর্ব্বপ্রকারে তাঁহারই যোগ্য। সুবিখ্যাত গীত-রচক হরু ঠাকুর ও নিতাই দাস তাঁহার আশ্রিত মধ্যে পরিগণিত ছিল। যে বাই-নাচকে ইংরেজরা আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ আমোদ বলিয়া মনে করেন, সেই নাচ নবকৃষ্ণ কলিকাতার সমাজে প্রবর্তিত করেন এবং তাহাকে সর্বসাধারণের আরের বস্তু করিয়া তুলেন। কবির গান তদানীন্তন হিন্দু সমাজের প্রধান আমোদের বিষয় ছিল। উহাতে তৎকাল-রচিত কবিতা দ্বারা বাগযুদ্ধ করিবার অদ্ভুত শক্তি প্রকাশ পাইত। দুই সম্প্রদায় আসরে অবতীর্ণ হইয়া “কবির লড়াই” করিতে প্রবৃত্ত হইত। এক পক্ষ তৎক্ষণাৎ গীত রচনা করিয়া ও শ্রোতৃমণ্ডলীর সম্মুখে গাহিয়া চাপান দিত; অপর পক্ষ সেই অবসরে তাহার উত্তর-সূচক গীত বচনা করিয়া লইত এবং প্রথম পক্ষ নিবৃত্ত হইলে শ্রোতৃমণ্ডলীর সমুখে তাহা গাহিত। শ্রোতারা এই অদ্ভুত শক্তি দেখিয়া বিস্ময়বিহ্বল হইয়া উচ্চৈঃস্বরে আনন্দ ও প্রশংসা-ধ্বনি করিতে থাকিত। এইরুপে বহুক্ষণ গীতযুদ্ধ চলিত এবং অবশেষে শ্রোতারা জয়পয়াজয়ের বিচার করিয়া দিতেন। হরু ঠাকুরের পূর্ণ নাম হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী। কবিদিগের মধ্যে তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন বলিয়া 'ঠাকুর’ আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। নষকৃষ্ণের ভবনেই এইরূপ আমোদের প্রথম সৃষ্টি হয়,—প্রথম “কবির লড়াই” হয়। হরু ঠাকুর নবকৃষ্ণের এরূপ অনুরক্ত ছিলেন যে, নবকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তিনি ঐ ব্যবসায় ছাড়িয়া দেন। আখড়াই নামে আর এক প্রকার সঙ্গীতামোদ প্রচলিত ছিল। উক্ত মহারাজ তাহারও একজন প্রসিদ্ধ উৎসাহদাতা ছিলেন। আখড়াই বিষয়ের ওস্তাদ কুলুইচন্দ্র সেন তাঁহার নিকট অনেক উৎসাহ পাইয়াছিলেন। কুলুইচন্দ্রের দূর সর্স্পীয় ভ্রাতা রামনিধি গুপ্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি করেন। এই রামনিধি সাধারণতঃ নিধু বাবু নামে পরিচিত। এইরূপে সঙ্গীত-বিদ্যার উপাসক বলিয়া তাঁহার যশঃ চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইতে সুপ্রসিদ্ধ গীতবাদ্যের ওস্তাদগণ তাঁহার নিকট আগমন করিতে, কিন্তু কাহাকেও নিরাশ হইয়া যাইতে হইত না।”
সঙ্গীতবিদ্যাবিষয়ে শ্রীযুক্ত রাজা সার সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর যে মহৎ কার্য করিয়াছেন, এস্থলে তাহার উল্লেখ না করিয়া এ প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করিতে পারা যায় না। লুপ্তপ্রাপ্ত ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের পুনরুদ্ধার ও ঐ বিদ্যার শ্রীবৃদ্ধিসাধনকল্পে উক্ত রাজা পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ের ত্রুটি করেন নাই, এমন কি আপনার সমস্ত জীবনই নিয়োগ করিয়াছেন। আধুনিক কোন ভারতবাসীই এ বিষয়ে তাহার সহিত তুলনীয় হইতে পারেন না। এই উচ্চ কলা ইদানীং এক প্রকার ইতরশ্রেণীর লোকের হস্তেই পতিত হইয়াছিল। উক্ত রাজা ইহাকে সেই দুরবস্থা হইতে উদ্ধার করিয়া ভদ্রসমাজে যথোপযুক্ত আসনে স্থাপন করিয়াছেন। উচ্চ অঙ্গের সঙ্গীতকলার আলোচনায় তিনি আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন, এবং এ বিষয়ে অনেকগুলি পুস্তক-পুস্তিকাও প্রকাশ করিয়াছেন।
১৮১৮ হইতে ১৮৫৫ অব্দ পর্য্যন্ত যে সমস্ত বাঙ্গালা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হইয়াছিল, পশ্চাৎ তাহার একটী তালিকা প্রদত্ত হইল। তালিকাটী রেভারেণ্ড জে, লঙ্ ১৮৫৫ অব্দে প্রস্তুত করিয়া গভর্ণমেণ্টের নিকট অর্পণ করেন।
পত্রের নাম। | কখন প্রথম প্রকাশিত হয়। |
কত দিন জীবীত ছিল। |
সম্পাদকের নাম। | মাসিক মূল্য। |
বেঙ্গলা-গেজেট | ১৮১৬ | ১ বৎসর | গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য | ১৲ |
সমাচার-দর্পণ | ১৮১৮ | ২১ " | জে, মার্শম্যান, শ্রীরামপুর | ১৲ |
সংবাদ-কৌমুদী | ১৮১৯ | ৩৩ " | তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানী- চরণ বন্দ্য | ১৲ |
সমাচার-চন্দ্রিকা | ১৮২২ | ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৲ | |
সংবাদ তিমিরনাশক | ১০ " | কৃষ্ণমোহন দাস | ||
বঙ্গদূত | ১৬ " | নীলরতন হালদার | ||
সংবাদ-প্রভাকর | ১৮৩০ | ২৫ " | ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত | ১৲ |
সংবাদ-সুধাকর | ৩ " | প্রেমচাঁদ রায় | ||
অনুবাদিকা | ২ " | |||
জ্ঞানান্বেষণ | ১৮৩১ | ১৩ " | দক্ষিণারঞ্জন মুখো, ও রসিক মল্লিক | |
সুখাকর | ১ " | পি, রায় | ||
সংবাদ-রত্নাকর | ১ " | ব্রজমোহন সিংহ | ||
সমাচার-শুভরাজেন্দ্র | দুর্লভচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | |||
শাস্ত্রপ্রকাশ | ১ বৎসর | লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার | ||
বিজ্ঞান সেবাধীশ | গঙ্গাচরণ সেন | |||
জ্ঞান-সিন্ধু তরঙ্গ | রসিককৃষ্ণ মল্লিক | |||
জ্ঞানোদয় | রামচন্দ্র মিত্র | |||
পাশাবলী | রামচন্দ্র মিত্র | |||
সংবাদ-রত্নাবলী | ১৮৩২ | মহেশচন্দ্র পাল | ||
সংবাদ-সারসংগ্রহ | বেণীমাধব দে | |||
সংবাদ-পূর্ণচন্দ্রোদয় | ১৮৩৫ | ২ বৎসর | হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৲ |
সংবাদ-সুধাসিন্ধু | ১৮৩৭ | ১,, | কালীশঙ্কর দত্ত | ৷৷৹ |
সংবাদ-দিবাকর | ১৮৩৭ | ৬ মাস | গঙ্গানারায়ণ বসু | ৷৷৹ |
সংবাদ-গুণাকর | ১৮৩৭ | ৬,, | গিরিশচন্দ্র বসু | ৷৷৹ |
সংবাদ-সৌদামিনী | ২ বৎসর | কালাচাঁদ দত্ত | ||
সংবাদ-মৃত্যুঞ্জয় | পার্ব্বতীচরণ দাস | |||
সংবাদ-ভাস্কর | শ্রীনাথ রায় | ১৲ | ||
রসরাজ | ১৮৩৮ | ১৭ বৎসর | গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য | ৷৷৹ |
সংবাদ অরুণোদয় | জগন্নারায়ণ মুখোপাধ্যায় | |||
সুজন রঞ্জন | হেরম্বচরণ মুখোপাধ্যায় | |||
বেঙ্গলা গভর্ণমেণ্ট গেজেট | ১৮৩৯ | ১৭ বৎসর | জে মার্শম্যান | ৷৷৹ |
মুর্শিদাবাদ পত্রিকা | ১৮৪০ | ১ “ | গুরুদয়াল চৌধুরী | |
জ্ঞানদীপিকা | ১ “ | ভবানী চট্টোপাধ্যায় | ||
ভারত-বন্ধু | শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় | |||
বঙ্গদূত | ১ “ | নীলকমল দাস | ||
বাদেন দর্শন | অক্ষয়কুমার দত্ত ও প্রসন্নচন্দ্র ঘোষ | |||
বেঙ্গলা স্পেক্টেটর | ২ “ | রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি | ||
অয়নবাদদর্শন | ১৮৪৩ | ১ “ | শ্রীনারায়ণ রায়, বারাকপুর | ১৲ |
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা | ১৮৪৩ | ১২ “ | অক্ষয়কুমার দত্ত | ৷৷৹ |
সংবাদ-রাজরাণী | ১৮৪৪ | ৬ মাস | গঙ্গানারায়ণ বসু | |
সর্ব্বরসরঞ্জিনী | ||||
জগদ্বন্ধু পত্রিকা | ১৮৪৬ | ২ বৎসর | সীতানাথ ঘোষ প্রভৃতি | |
সত্যার্ণব | ১৮৫৫ | ৫ “ | রেভারেণ্ড ডবলিউ স্মিথ্ | ৴১০ |
পাষণ্ডপীড়ন | ১ “ | ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত | ||
সমাচার-জ্ঞানদর্পণ | ৩ “ | উমাকান্ত চট্টোপাধ্যায় | ||
জগদ্দীপক ভাস্কর | মৌলবী রজরালি | ৷৹ | ||
নিত্যধর্ম্মরঞ্জিকা | নন্দকুমার কবিরত্ন | ৷৷৹ | ||
ভৈরব দ্বন্দ্ব | ||||
দুর্জ্জন-দমন মহানবমী | মথুরানাথ গুহ | |||
কাব্যরত্নাকর | ১৮৪৭ | ১ “ | উমাকান্ত ভট্টাচার্য্য | |
জ্ঞানাঞ্জন | ১ “ | চৈতন্যচরণ অধিকারী | ||
হিন্দুধর্ম্ম-চন্দ্রোদয় | ১ “ | হরিনারায়ণ গোস্বামী | ||
রঙ্গপুর-বার্ত্তাবহ | গুরুচরণ রায় | ৷৹ | ||
জ্ঞানসঞ্চারিণী | ২ “ | গঙ্গানারায়ণ বসু | ৷৹ | |
সাধুরঞ্জন | ১৮৪৭ | ২ “ | ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত | ৷৹ |
দিগ্বিজয় | দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায় | |||
সুজনবন্ধু | নবীনচন্দ্র রায় | |||
বন্ধু হিন্দু | উমাচরণ ভদ্র | |||
আক্কেল গুড়ুম | ১৮৪৭ | ৪ মাস | ব্রজনাথ বসু | |
মনোরঞ্জন | ১৮৪৭ | গোপালচন্দ্র দে | ||
কনোটভ | ১৮৪৮ | ১ বৎসর | মহেশচন্দ্র ঘোষ | |
জ্ঞানচন্দ্রোদয় | ১৮৪৮ | ২ মাস | রাধানাথ বসু | |
জ্ঞানরত্নাকর | ১৮৪৮ | ১ বৎসর | তারিণীচরণ রায় | |
ভৃঙ্গদূত | ১৮৪৮ | ১ “ | আনন্দচন্দ্র শর্ম্মা | |
সংবাদ অরুণোদয় | ১৮৪৮ | ১ “ | পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায় | |
সংবাদ-দিনমণি | ১৮৪৮ | ৬ মাস | গোপালচন্দ্র রায় | |
সংবাদ-রত্নবর্ষণ | ১৮৪৮ | মাধবচন্দ্র ঘোষ | ||
সংবাদ রোসৌন্দজার | ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় | ৷৷৹ | ||
বারাণসী-চন্দ্রোদয় | ২ বৎসর | উমাকান্ত ভট্টাচার্য্য | ||
মুক্তাবলী | কালীকান্ত ভট্টাচার্য্য | |||
রসমুদ্গর | ১৮৪৯ | গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় | ||
রসসাগর | ১৮৪৯ | ৫ বৎসর | রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় | |
রসরত্নাকর | যদুনাথ পাল | |||
সুজনরঞ্জন | গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত | |||
মহাজন-দর্পণ | জয়কালী বসু | |||
কৌস্তভ-কিরণ | রাজনারায়ণ মিত্র | |||
জ্ঞানপ্রদায়িনী | বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৲ | ||
সত্যধর্ম্মপ্রকাশিকা | গোবিন্দচন্দ্র দে | |||
সর্ব্বশুভঙ্করী | ১৮৪৯ | ৫ “ | মতিলাল চট্টোপাধ্যায় | ১৲ |
সত্যপ্রদীপ | ১ “ | এম্, টাউন্, সেণ্ড্ | ৷৷৹ | |
সংবাদবর্দ্ধমান | কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় | ৷৷৹ | ||
বর্দ্ধমান-চন্দ্রোদয় | রামরত্ন চট্টোপাধ্যায় | |||
সংবাদ-সুধাংশু | ১৮৫২ | ১ “ | রেভারেণ্ড কে, এম, বন্দ্যোপাধ্যায় | ৷৹ |
উপদেশক | ৯ “ | রেভারেণ্ড জে, ওয়েঞ্জার | ৵৹ | |
সঞ্চারিণী | ২ “ | শ্যামাচরণ বসু | ||
সংবাদ-নিশাকর | নীলকমল দাস | |||
ধর্ম্মাধর্ম্মপ্রকাশিকা | ||||
ভক্তিসূচক | রামনিধি দাস | |||
দূরবীক্ষণিকা | ||||
জ্ঞানোদয় | চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় | ৷৹ | ||
জ্ঞানদর্শন | শ্রীপতি মুখোপাধ্যায় | |||
কাশীবার্ত্তাপ্রকাশিকা | কাশীদাস মিত্র | ৷৷৹ | ||
মেদিনীপুর ও হিজিলি গার্জ্জিয়ান | ১৮৫২ | ২ বৎসর | এইচ্,ভি, বেলি | |
বিবিধার্থ সংগ্রহ | ১৮৫২ | ৪ “ | রাজেন্দ্রলাল মিত্র | ৶৹ |
জানারুণোদয় | কেশবচন্দ্র কর্ম্মকার | ৷৹ | ||
সুলভ পত্রিকা | ১৮৫৩ | তারানাথ দত্ত | ৵৹ | |
সুধাবর্দ্ধন | ১৮৫৪ | ১৲ | ||
বঙ্গ বার্ত্তাবহ | ১৮৫৪ | ৷৹ | ||
সর্ব্বশুভকরী | ১৮৫৪ | ৷৹ |
- ↑ বষ্টিড সাহেব সে কালের সংবাদপত্রের এইরূপ একটী তালিকা দিয়া ছেন:—ইণ্ডিয়ান্ গেজেট (নবেম্বর ১৭৮০); কলিকাতা গেজেট এণ্ড ওরিএণ্টাল এডভার্টাইজার (সম্পাদক ফ্রান্সিস গ্লাড উইন্ (ফেব্রুয়ারি ১৭৮৪); বেঙ্গল জর্ণাল (ফেব্রুয়ারি ১৭৮৫); ওরিএণ্টাল ম্যাগেজিন্ (৬ই এপ্রেল ১৭৮৫), কলিকাতা ক্রনিকল (জানুয়ারি ১৭৮৬)।
- ↑ রবার্ট মাইটের বোম্বাই জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইরূপ:—তিনি বোম্বাই টাইমস্ পত্রের এক জন সাময়িক লেখক ছিলেন। ডাক্তার সুইষ্ট অবসর গ্রহণ করিলে তিনিই উহার সম্পাদক হন। ১৮৫৮ হইতে ১৮৬৪ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ৭ বৎসরকাল তিনি ঐ কার্য্যে নিযুক্ত থাকেন এবং প্রভূত পরিশ্রম করিয়া কাগজখানিকে লোকপ্রিয় করিয়া তুলেন। দেশীয় স্বত্বাধিকারীরা এবং অপরাপর যাহাদের হাতে অংশ ছিল, সকলেই ১৮৩০ অব্দে উহার সহিত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিয়া সম্পাদকের নিকট উহা বিক্রয় করেন। তাহার সম্পকিত্বকালে বোম্বাই টাইমস্ স্থায় নামের পরিপন করিয়া “টাইমস্ অভ ইণ্ডিয়া” এই নাম ধারণ করে। উহার সম্পাদকত্বের শেষভাগে আমেরিকার যুদ্ধজন্য তুলার বাজারে দুর্ভিক্ষ ঘটায় বোম্বাই অস্মবগব কতিদ্ভুত সমৃদ্ধি ঘটে। কোটি কোটি টাকা সাগরে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। এই সমৃর্দ্ধিপ্রহাহের সর্ব্বোচ্চ তরঙ্গের সময় নাইট সসাগেব! অবসর গ্রহণ করেন, এবং তাহার ভারতীয় বন্ধুগণ তৎকৃত মহোপকারসমুহ স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তাহাকে এককালীন ৭৫,০০০ টাকা প্রদান করেন।
- ↑ হাতীবাগান-কলিকাতার উত্তরপূর্বাঞ্চলস্থ একটা পল্লীর নাম। বহু সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের বাসস্থান বলিয়া ইহা প্রসিদ্ধ।
- ↑ ঐরূপে প্রকাশিত অভিধানের নাম;—
১। গিলাক্রাইষ্টের হিন্দি ইংরেজী ও ইংরেজী হিন্দি অভিধান, ২য় খণ্ড। ২। ফর্স্টারের বাঙ্গালা ইংরেজী অভিধান, ২য় ৩। হণ্টারের হিন্দি ইংরজে অভিধান। ৪। গ্যাটনের হিন্দি, পারসী ও ইংরেজী অভিধান। ৫। উইলসনের সংস্কৃত ইংরেজী অভিধান। ৬। ক্যারির বাঙ্গালা ইংরেজী অভিধান। ৭। হকের ব্রহ্ম ইংরেজী অভিধান। ৮। মলেনওয়ার্থের মহারাট্টা ইংরেজী অভিধান।