কলিকাতার ইতিহাস/তৃতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়।

রাজধানী।

 “কলিকাতা” নামের ব্যুৎপত্তিসম্বন্ধে নানা জনের নানা মত। এই নামের উৎপত্তি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন লেখক ভিন্ন ভিন্ন প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন। কাহারও কাহার ও মতে “কাল কেটে” [] হইতে এই নামটি উৎপন্ন “কলা কোর্ট” কথার অর্থ কালীদেবীর মন্দির। গঙ্গার আদি প্রবাহ অথাৎ আদি গঙ্গা(বা টলির নালা) নামক নদীর তীরে কালীঘাটে কালীদেবীর একটা বিখ্যাত মন্দির আছে। অতি প্রাচীন কাল হইতে এই স্থানটা ভারতবর্ষের মধ্যে একটি প্রধান তীর্থ বলিয়া পরিগণিত। এই সমস্ত কথা বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই মতটিই সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য বলিয়া বোধ হয়। জনৈক ওলন্দাজ পর্য্যটক বলেন, কলিকাতা নামটি “গোলগথা” শব্দ হইতে উৎপন্ন। বহুকাল হইতে একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, এক সময়ে বর্ষাকালে এক প্রকার রোগ উৎপন্ন হইয়া ইউরোপীয় অধিবাসীদিগের এক চতুর্থাংশ বিনষ্ট করে। সেই সময়ে নাবিকগণ কুসংস্কারবশতঃ কলিকাতাকে “গোল গথা” অর্থাৎ খর্পর-ভূমি বলিয়া জ্ঞান করিত। স্বর্গীয় রাজা স্যার রাধাকান্তদেব বাহাদুর কে, সি, এস, আই মহোদয়ের মতে কলি ক তার আদি নাম “কিলকিলা” ছিল। গ্রোস সাহেব বলেন, “ভাগীরথী নদার উপরিস্থ প্রথম নগর কলিকাতা। কলিকাতা মোটা কাপড়, শস্য, তৈল এবং দেশের অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যের উত্তম বাজার।” মিষ্টার এ, কে, রায় তাঁহার কলিকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” নামক গ্রন্থ লিঃখয়াছেন —“বর্ণিত আছে যে, কিলকিল প্রদেশ আয়তনে ২ ১যোজন! (অর্থাৎ ১৬০ বর্গমাইল); উহার পশ্চিমে সরস্বতী, পূর্ব্বে যমুনা; পশ্চাল্লিখিত গ্রাম ও নগরগুলি উহার অন্তভুক্ত যথা—হুগলী, বাঁশবেড়িয়া, খড়দহ, শিয়ালদহ, ইত্যাদি ইত্যদি। “আকবরের রাজত্বকালে আবুল ফজল কৃত আইন-ই-আকবরি নামক গ্রন্থে প্রকাশিত রাজা তোডরমল্লের জমা-বন্দি কাগজে মহাল কলিকাতার নাম দৃষ্ট হয়। নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে আর একটি গল্প এইরূপ:জনৈক ইংরেজ এই স্থানে জাহাজ হইতে প্রথমে অবতীর্ণ হইয়াই দেখিতে পান যে, একজন ঘেসে ঘাসের বোঝা মাথায় লইয়া যাইতেছে। ইংরেজ তাহাকে ইংরাজীতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “What place in this?” অর্থাৎ এস্থানের নাম কি? ঘেসেড়া মনে করিল, সাহেব বুঝি তাহার মস্তকস্থিত ঘাসের কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন। এই ভাবিয়া সে হিন্দিতে উত্তর করিল,—“কাল কাটা” অর্থাৎ এ ঘাস আমি গত কল্য কাটিয়াছি সাহেব এ দেশে সবেমাত্র পদার্পণ করিয়াছেন; কাজেই তখন তিনি ঘেসেড়ার হিন্দি কথার মর্ম বুঝিতে না পারিয়া মনে করিলেন, উহাই বুঝি তবে স্থানের নাম হইবে। এই ভাবিয়া তিনি লিখিয়া লইলেন‘Calcutta’ এবং তদবধি ইহা ঐ নামেই পরিচিত হইল। আবার কেহ কেহ অনুমান করেন, কলিকাতা নামটি খাল-কাটা” (অর্থাৎ মার্হাট্টা-খাত) হইতে উৎপন্ন, কারণ তৎকালে উহাই এই স্থানের একরূপ সীমা ছিল। ইহাও একান্ত অসম্ভব নয় যে, মার্হাট্টাখাতটি খনন করা হইলে পর গোবিন্দপুর, কলিকাতা ও সূতানুটী এই তিনখানি গ্রাম একমাত্র কলিকাতা নামে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল।

 কলিকাতা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে যে সকল ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছে, সেগুলি আমরা যতদূর অবধারণ করিতে পারিয়াছি, তাহা একে একে এ স্থানে উল্লেখ করিলাম। অনুসন্ধিৎসুগণের নিকট ইহা কৌতুকজনক হইলেও হইতে পারে। পরন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞানলাভের যখন কোনও উপায় নাই, তখন কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নয়। কখনও বা আশার সহিত কখনও বা সভয়ে, এরূপ কথিত হইয়া থাকে যে, কালে কলিকাতা বৃটিশ ভারত-সাম্রাজ্যের রাজধানী থাকিবে না। গঙ্গাপ্রবাহের গতিপরিবর্তনে এবং ঐ নদীতে ক্রমাগত চড়া পড়িতে থাকায় কলিকাতার অনেক গৌরব ও প্রয়োজনীয়তা কমিয়া যাইবে। মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধিতে গৌড়ের ন্যায় ইহারও অধিবাসিবর্গের দশমাংশের বিনাশ সাধন করিবে। পরন্তু সার্দ্ধৈশতাব্দীর ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা এক প্রকার অসম্ভব! দীর্ঘকালগত নানাপ্রকার জনপ্রবাদ ও ভাবসংযোগের কথা ছাড়িয়া দিলেও, নগরের যে সকল আভ্যন্তরিক উন্নতি সাধিত হইয়াছে, তাহাই অতীতের সহিত বিচ্ছেদসাধনের পক্ষে প্রায় অনুল্লঙ্ঘনীয় অন্তরায়রূপে দণ্ডায়মান হইবে। এই নগরে বণিকদিগের বিনিয়োজিত মূলধন, বহুদিনের দুর্গ, ডক (জাহাজ মেরামতের স্থান) ও জেটি (জাহাজ বাটা) গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক নির্মিত নানাপ্রকার আপিস ও সরকারী অট্টালিকা, রাজসংস্রব শুন্য সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তিবর্গের বা কোম্পানি সমূহের দ্বারা নির্মিত বহুমূল্য আবাসবাটী ও কার্যালয়সকল, মিউনিসিপাল-সমাজ কর্ত্তৃক সংসাধিত অট্টালিকাদির পরিবর্তন, সেনেট গৃহসহিত বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংসৃষ্ট বহুসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর বিদ্যামন্দির, রেলওয়ে কোম্পানিসমুহ ও তাহাদের সুবিস্তৃত সুদর্শন অন্তিম ষ্টেশন ও প্রধান কার্যালয় সকল এবং মফঃস্বল-ভ্রমণ, কার্য্যবণ্টন ও তদাকার অন্যান্য বিষয়ের সরকারী ব্যবস্থার প্রণালী এই সমস্ত বস্তু মহাপ্রলয় ব্যতিরেকে বিলুপ্ত হইবার নহে, অথবা কোনও খামখেয়ালী শাসনকর্ত্তার খেয়ালমাত্রে অন্য ভূমিতে স্থানান্তরিত হইবার নহে। কলিকাতা বহুদিন হইতে এতদ্দেশে ইংরেজদিগের রাজধানী হইয়াছে, অন্য কারণ না থাকিলেও কেবল এই একমাত্র কারণে কলিকাতা বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী থাকিবে।

 কলিকাতা বাঙ্গালার ষষ্ঠ রাজধানী কথিত হইয়াছে। গৌড় নগর সর্বপ্রথম ও অতি প্রাচীন রাজধানী বলিয়া; উল্লিখিত। উহা মালদহ জেলায় গঙ্গার তীরেই অবস্থিত ছিল, কিন্তু গঙ্গার সে প্রবাহ এক্ষণে গৌড় পরিত্যাগ করিয়া তাহা হইতে বহুদূর দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। উহার অক্ষান্তর ২০°৫২‘উত্তর এবং দ্রাঘিমান্তর ৮৮°১০'পূর্ব। নগর ও তাহার উপনগরের আয়তন ২০ হইতে ৩০ বর্গ মাইল অনুমিত হইয়া থাকে। এই নগরের উৎপত্তি বিবরণ অজ্ঞান তিমিরাচ্ছন্ন এক্ষণে উহার অনুমান করা ভিন্ন গত্যন্তর নাই; পরন্তু একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়া থাকেন যে, খৃষ্টের জন্মের ১০০ বা ৮০০ বৎসর পূর্বে ইহার অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল। পাদরী লঙ সাহেব বলেন যে, এই নগর ২০০ বৎসর সমৃদ্ধিশালী ছিল। টমাস টুইনিঙ নামক একজন লেখক বলেন —“সমস্ত ভারতবর্ষেই অতি পুরাকালের অকাট্য নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান আছে, কিন্তু গৌড়ের নিদর্শনগুলি যেরূপ জাজ্বল্যমান বোধ হয়, আর কোন স্থানেরই নিদর্শন সেরূপ জাজ্বল্যমান নহে!” এই নগরে দশলক্ষাধিক লোকের বাস ছিল এবং কি আয়তন, কি অট্টালিকা, কি ঐশ্বর্য্যাড়ম্বর, সকল বিষয়েই ইহা বর্তমান কলিকাতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল। এই নগর সম্বন্ধে যে সকল অত্যদ্ভুত কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, তন্মধ্যে এ*টীর নিদর্শন প্রদর্শনার্থ কথিত হইয়া থাকে যে, “ইহার অধিবাসীদিগকে পান যোগাইবার নিমিত্ত প্রতিদিন ত্রিশ হাজার পাণের দোকান খোলা হইত।” এই নগর লক্ষ্মণাবতী নামেও পরিচিত ছিল। আবুল ফজল কৃত এই নগরের বর্ণনার কিয়দংশ এস্থলে উদ্ধত হইলঃ—

 “জেনতাবাদ অতি প্রাচীন নগর। উহা এক সময়ে বঙ্গের রাজধানী ছিল। পূর্বে ইহা লক্ষ্মণাবতী নামে কখনও বা গৌড় নামে, অভিহিত হইত। মৃত সম্রাট হুমায়ুন ইহার বর্তমান নাম জেনতাবাদ প্রদান করেন। ......প্রাচীন গৌড়নগর যে সকল প্রদেশের রাজধানী ছিল, সেই সকল প্রদেশে গৌড়ীয় ভাষা কথিত হইত; উহাকে সাধারণতঃ বাঙ্গালা ভাষা বলে। কয়েকটি সীমান্ত প্রদেশ ভিন্ন বঙ্গের অন্যান্য সকল প্রদেশেই অদ্যাপি ঐ ভাষা প্রচলিত। ......যৎকালে মহম্মদ বখতিয়ার খিলিজি ১২০৩-০৪ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গালা জয় করেন, তৎকালে তিনি সেই প্রাচীন গৌড়নগরকেই আপনার রাজধানী করিয়াছিনে। ......১৫৩৫ অব্দে যৎকালে সম্রাট হুমায়ুন, সের খাঁ(যিনি হুমায়ুনকে পরে হিন্দুস্থান হইতে দূরীভূত করিয়াছিলেন) নামক পাঠানের পশ্চাদনুসরণ করেন, সে সময়ে তিনি বঙ্গের তদানীন্তন রাজধানী গৌড় অধিকার করেন। ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে গৌড়ের নাম ক্কচিৎ দৃষ্ট হয়।”

 এই নগরের অতীত গৌরবের একটা মোটামুটি ধারণা পাঠক দিগের হৃদয়ে জন্মাইয়া দিবার নিমত্ত জনৈক সেনানায়ক কর্তৃক লিখিত —Sketches of India for fireside Travellers নামক পুস্তকের একস্থান হইতে কিয়দংশ এস্থলে উদ্ধত হইতেছে:—

 তুমি গৌড়নগরের ধ্বংসাবশেষের উপর পদার্পণ করিয়া বিচরণ করিতেছ। এই মৃত্তিকা এক্ষণে চূর্ণীভূত অথবা তোমার পদভরে চুর্ণায়মান ইষ্টকসমূহে গঠিত; ঐ সমস্ত ইষ্টক যুগযুগান্তর পূর্বে মানবহস্তদ্বারাই নির্মিত হইয়াছিল। যে নগরের স্মৃতিচিহ্ন, তুমি অন্বেষণ করিতেছ, সেই নগরের দেবমন্দির প্রাসাদ ও অট্টালিকাসমুহ এই স্থানে ধূলিসাৎ হইয়া রহিয়াছে। তুমি কি এক্ষণে জেরুজালেম নগরে সলমনের সেই সুবিখ্যাত মন্দিরের একখানিও ইট খুজিয়া বাহির করিতে পার? মেরুজালেমে যে দ্বিতীয় মন্দির আমার শক্তি ও গৌরবের দিনের ৮০০ বৎসর পরে ভূমিসাৎ হইয়াছে, তাহার একখানি পাথরের উপর আর একখানি পাথর কি এখন আছে? তুমি কি অম্বেষণ করিতেছ? বাবিল, টায়ার ও সাইডন আমার ভগিনী ছিল। মিসর ও তাহার দেবমূর্তি সকল মামাকে চিনিত; আমার কাল হইতে সাম্রাজ্যের পর সম্রাজ্যের উখান ও পতন ঘটিয়াছে; কার্থেজ রোম ও বিজ্যানিশিয়ম ভূমিসাৎ হইয়াছে। হেজিকায়ার সময়ে মহাপ্রভুর ভবিষ্যদ্বক্তা ইসায়া যেরূপ অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ নগর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী কহিয়াছিলেন, আমার সম্বন্ধে এবং আমার পর আমার বিজেতাদিগের সম্বন্ধেও তদ্রুপ হইয়াছে। আমার পুত্রগণ শৌর্যবীর্যে প্রখ্যাত ছিল, আমার দুর্গসমুহ সমুচ্চ ছিল, আমার প্রাচীরগুলি বৃভিরক্ষিত ছিল, আমার ধনাগার পূর্ণ ছিল, আমার তনয়ারা সুন্দরী ছিল; আমার ভোজোৎসবসমূহে নৃত্যগীতের প্রাচুর্য ছিল; আমি গর্ব্বিত ও উন্নতশীর্ষ ছিলাম, কিন্তু অধুনা ধূলিসাৎ হইয়াছি।”

 ডাক্তার বুকানন হামিল্টন বলেন, “সম্রাট শাহজহাঁর অন্যতম পুত্র শাহসুজা ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে গৌড় পরিত্যাগ করিয়া রাজমহল নগর বঙ্গের রাজধানী বলিয়া নির্ধারণ করেন। উক্ত লেখকের মতে তদবধি গৌড়ের ধ্বংসের সূত্রপাত হয়। তাহার বিবেচনায় সেই সময়ে নগরটা অবিলম্বে ধ্বংসমুখে পতিত হইল,কোনও প্রকার বিপুল বা অসামান্য বিপৎপাত জন্য সে সেরূপ হইল তাহা নহে, পরন্তু রাজধানীর স্থানান্তরীকরণই তাহার একমাত্র কারণ।”

 রাজমহল আর একটি দৃষ্টান্ত। টুইনিঙ সাহেব লিখিয়াছেন —“হুগলী ও নবদ্বীপের ন্যায় রাজমহলও ভারতবর্ষের রাজনগরসমুহের অসামান্য অস্থায়িত্বের একটি সমুজ্জ্বল নিদর্শন; অথবা এ কথাও বলা যাইতে পারে যে, এতগুলি নগর বা গ্রামের রাজধানী, পদে উন্নতি ও পরে পুনরায় তাহাদের পুর্ব্ব নিকৃষ্ট বা নগণ্য অবস্থায় অবনতি;—যে অবস্থায় তাহাদের মনোহরপুষ্পোদ্যান ও ফলবৃক্ষসমুহ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয় এবং তাহাদের অত্যভুত ঐশ্বর্যাড়ম্বর কেবল তাহাদের ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ দেখিয়াই নির্ণয় করিতে হয়, এতদুভয়ের মধ্যে যে বহুসংখ্যক বৎসর অবশ্যই অতীত হইয়া থাকিবে, রাজমহল তাহারই অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ ......।” অন্যত্র তিনি বলিয়াছেন —“রাজমহল যে এক সময়ে একটি বিশাল নগর ছিল, বঙ্গের রাজধানী ছিল, তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু কতদিন উহার গৌরব-রবি সমুজ্জ্বল ছিল, তাহ। এই সুদূরবর্ত্তী কালরূপ তিমিরে সমাচ্ছন্ন। যে স্থলে কোনও জাতির ইতিহাস বিজেতার তরবারির অনুসরণ করে, অথবা তাহা বশ্যতারূপ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হস্তদ্বার। লিখিত হয়, সেস্থলে সত্যের আশা করা বিড়ম্বনামাত্র।” উক্ত লেখক আরও বলিয়াছেন -“উহা গঙ্গার পশ্চিম তীরে ২৫°২'২৫” উত্তর অক্ষান্তরে এবং ৮৭°৫২'৫১” পূর্ব দ্রাঘিমাস্তরে অবস্থিত। উহা এক্ষণে কতকগুলি মৃন্ময় কুটীরের সমষ্টিমাত্র, তাহারই মধ্যে মধ্যে অত্যল্পসংখ্যক সঙ্গতিপয় মুসলমানের কয়েকটা সৌষ্ঠবসম্পন্ন ভদ্রজনোচিত বাটী। প্রাচীন মহম্মদীয় নগরের ধ্বংসাবশেষ অধুনা নিবিড় জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন এবং বর্তমান নগরের পশ্চিমে প্রায় ৪ মাইল বিস্তৃত।” আর এক স্থলে তিনি লিখিয়াছেন: —“রাজমহলের অবস্থানের কথা বিবেচনা করিয়া দেখিলে উহা দুই কারণে রাজধানীরূপে মনোনীত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় প্রথমতঃ উহা বাঙ্গালা ও বিহারের মধ্যস্থলে, এবং দ্বিতীয়ত, ঐ স্থান হইতে গঙ্গানদী ও তেলিয়াগড়ি গিরিসঙ্কট উভয়ের উপরই সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা সম্ভব; ঐ তেলিয়াগড়ি গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়া এক্ষণে রেলগাড়ী চলিতেছে। মুসলমানেরা ঐ স্থানকে আকবরনগরও বলিয়া থাকে। উক্তবিধ নামকরণ সম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প প্রচলিত আছে সুপ্রসিদ্ধ রাজপুত সেনাপতি উড়িষ্যাবিজয়ের পর প্রত্যাগত হইয়া রাজমহলে নিজের জন্য একটি প্রাসাদ ও তদ্ভিন্ন একটি হিন্দু দেবমন্দির নির্মাণ করিতে আরম্ভ করেন। বিহারের শাসনকর্তা ফতেজঙ্গ খাঁ। রাজপুতদিগের আগমনের পূর্ব্বে রাজমহলে বাস করিতেন। তিনি সম্রাটকে লিখিয়া পাঠাইলেন যে, মানসিং পুত্তল পুজার নিমিত্ত একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া নগরকে অপবিত্র করিতেছেন। এবং স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, তিনি বিদ্রোহী হইবার অভিপ্রায় করিয়াছেন। মানসিংহ এই পত্রের কথা শুনিয়া নগরের নাম রাজমহলের পরিবর্তে আকবরনগর রাখিলেন এবং দেবমন্দিরটিকে জুম্মা মসজিদে পরিবর্তন করিলেন।

 পাদরী লঙ সাহেব বলেন, শত রাজার নগর:রাজমহল গঙ্গা নদীর ‘ব’ দ্বীপের অগ্রদেশে অতি সুবিধাজনক ভাবে অবস্থিত.........।” ঢাকা নগররও উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ইহার যশঃসৌরভ রোমীয়কাল হইতে দিগদিগন্তে ব্যাপ্ত হইয়াছিল। ওয়াটার হ্যামিল্টন সাহেব তাঁহার গেজেটিয়ারে বলিয়াছেন:—“১৬০৮ (?)[] খ্রীষ্টাব্দে বাঙ্গালার তদানীন্তন সুবাদার ইসলাম খাঁ রাজধানী রাজমহল হইতে উঠাইয়া; যা ঢাকানগরে লইয়া যান, এবং তদানীন্তন সম্রাটের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শনস্বরূপ উহার নাম পরিবর্তিত করিয়া জাহাঙ্গির নগর রাখেন ......। কথিত আছে যে, সুবাদার সায়েস্তা খার দ্বিতীয়বারের শাসনকালে ঢাকায় চাউল এরূপ স্বল্পমূল্য ছিল যে, বাজারে টাকায় ৮ মণ করিয়া চাউল বিক্রীত হইয়াছিল। এই ব্যাপার স্মরণীয় করিবার নিমিত্ত তিনি ১৬৮৯ অব্দে যৎকালে ঢাকা পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইলেন, সেই সময়ে তাঁহার আদেশক্রমে পশ্চিমদিকের তোরণ নির্মিত হই তাহাতে এইরূপ একটী ক্ষোদিত লিপি সংস্থাপিত হয় যে, উত্তরকালীয় কোনও শাসনকর্তা যত দিন না তণ্ডুলের মূল্য হ্রাস করিয়া তাহা এইরূপ স্বল্পমূল্য করিতে পারিবেন, ততদিন তিনি এ তোরণ উন্মুক্ত করিতে পারিবেন না। এই নিষেধাজ্ঞার জন্য উক্ত তোরণ ১৭৩৯ অব্দে সরফরাজ খাঁর শাসনকাল পর্যন্ত বদ্ধ ছিল। বর্তমান সময়ে ঢাকা পুর্ববঙ্গের রাজধানী এবং সমস্ত বাঙ্গালার মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম নগর বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। নদীয়া পাঁচ শতাব্দীকাল “বঙ্গের অক্সফোর্ড” (অর্থাৎ বিদ্যালোচনার প্রধান স্থান ছিল।) টি টুইনিঙ, সাহেব স্বপ্রণীত ভারতভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থে লিখিয়াছেন:—"......সম্রাট আকবর খৃষ্টীয় ঘোড়শ শতাব্দীতে রাজত্ব করিয়াছিলেন; তাহার ৪,০০০ বৎসর পূর্ব্ব হইতে অতি প্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ নগর নদীয়া বাঙ্গালার রাজধানী ছিল। ......সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ইউরোপীয়েরা অন্যান্য কয়েকটা স্থানের ন্যায় নদীয়াতেও তামাক গাছ প্রথম আমদানী করেন।”

 এই স্থানে সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণবধর্মপ্রচারক চৈতন্য জন্মগ্রহণ ও ধর্ম্মপ্রচার করেন। বৈষ্ণবদিগের নিকট এই স্থান সাতিশয় পবিত্র।

 মুকসদাবাদ বা মুর্শিদাবাদ মুর্শিদকুলিখাঁর বাসস্থান ছিল। তিনি এই স্থানে রাজধানী উঠাইয়া আনেন এবং ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে নিজের নামানুসারে নগরের নামকরণ করেন। তাহার উত্তরাধিকারীদিগের অধীনেও ১৭৭২ অব্দ পর্যন্ত ইহা রাজধানী ছিল। উক্ত বৎসর ভারতবর্ষের প্রথম গবর্নর জেনারেল ওয়ারেণ হেষ্টিংস কলিকাতাকেই রাজকার্যপরিচালনের প্রধান স্থান করেন। কলিকাতার অতি সুন্দর মসজিদ, প্রাসাদ ও সরকারী স্মৃতিমন্দিরসমূহের মধ্যে অনেক গুলি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্তোলিত ইষ্টক ও প্রস্তর দ্বারা নির্মিত হইয়াছিল। বস্তুতঃ পাণ্ডুয়া, রাজমহল ও টাণ্ডার সরকারী অট্টালিকাসমূহের অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত গৌড়নগরের লুষ্ঠিত উপাদানসমূহে বিরচিত হইয়াছিল। কথিত আছে যে, মুর্শিদাবাদের গোরাবাজারস্থিত প্রধান বণিজাধ্যক্ষের আবাসবাটী গৌড়ের ইষ্টক দ্বারা নির্মিত হইয়াছিল। বর্তমান কলিকাতা ১৭৭২-৭৭ হইতে বঙ্গের সর্বপ্রধান নগর এবং বৃটিশ ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানীরূপে পরিগণিত হইয়া আসিতেছে।

  1. কলিকাতা নামটী অতি প্রাচীনকাল হইতে সুপরিচিত। প্রাচীন হিন্দুরা ইহাকে “কালীক্ষেত্র” বলিতেন। পুরাণে উক্ত আছে, সতীর (অর্থাৎ কালীর) ছিন্ন অঙ্গের এক অংশ উহারই চতুঃসীমার মধ্যে কোনও স্থানে পতিত হইয়াছিল; সেই জন্যই এই স্থানের নাম ‘কালীক্ষেত্র” হয়। কলিকাতা “কালীক্ষেত্র” শব্দের অপভ্রংশ মাত্র।—ইণ্ডিয়ান এম্পায়ার ১৮৮৯।
  2. টুইলিঙ সাহেব বলেন যে, ১৬৩৯ অব্দে শাহ সুজা গৌড় হইতে রাজমহল নগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।