কলিকাতার ইতিহাস/চতুর্থ অধ্যায়

চতুর্থ অধ্যায়।

কলিকাতার ভূবৃত্তান্ত ও অধিবাসী।

 ডাক্তার জেমস্ রানাণ্ড মার্টিন লিখিয়াছেন:

 “দেখা গিয়াছে যে, যে সকল ইউরোপীয় জাতি বিদেশে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছেন, তন্মধ্যে ইংরেজরা সর্বত্রই তাহাদের ঔপনিবেশিক নগরসমুহের স্থাননির্ব্বাচনে যার পর নাই অনবধানতা প্রদর্শন করিয়াছেন।” কাপ্তেন আলেকজাণ্ডার হামিলটন ১৬৮৮ হইতে ১৭৩৩ অব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করিয়া বেড়াইয়াছিলেন। তিনি কলিকাতা সম্বন্ধে বলেন,—“সমগ্র নদীতীরে ইহা অপেক্ষা অধিকতর অস্বাস্থ্যকর স্থানের নির্ব্বাচন হইতে পারিত না।” বস্তুতঃ বাণিজ্যের সুবিধা বিষয়ে ডাক্তার মার্টিন স্বীয় মত স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন —“কিন্তু এস্থলে বাণিজ্যের সুবিধার জন্যই যে এই স্থানটিকে আমাদের রাজধানীরূপে মনোনীত করা হইয়াছে, এ প্রবোধও আমাদের নাই; কারণ আমার বিশ্বাস এই যে, এই স্থান ও সমুদ্রের মধ্যে এমন অনেক স্থান আছে যে, তাহা জাহাজ লাগাইবার পক্ষে অধিকতর উপযোগী, অথচ এমন একটি স্থান নাই, যাহা সমন্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া দেখিলে ইহার ন্যায় অনুপযুক্ত বোধ হয়।” পাদরি লঙ সাহেব বাণিজ্যের হিসাবে কলিকাতায় অবস্থান যার পর নাই সুবিধাজনক বিবেচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়ানে-“এই একটি প্রশ্ন অনেক সময়ে উঠিয়াছে যে, হুগলী নদীর দক্ষিণ পার যখন ফরাসীদিগের, দিনেমারদিগের ও ওলন্দাজদিগের নিকট অধিকতর স্বাস্থ্যকর বলিয়া প্রতিপন্ন হইল, তখন কলিকাতা সেই পারে স্থাপিত হইল না কেন? আমার মতে ইহার প্রধান কারণ এই, বাম পারের জল দক্ষিণ পার অপেক্ষা অধিকতর গভীর ছিল, যে সকল তন্তুবায় কোম্পানিকে কাপড়-চোপড় বিক্রয় করিত, তাহাদের অধিকাংশেরই বাস বাম পারে ছিল, এবং হাবড়ার পারের ন্যায় এ পারে মার্হাট্টাদিগের উৎপাত তত অধিক ছিল না। পাদরি লঙ, সাহেব এ বিষয়টি যে ভাবে দেখিয়াছেন, ওয়ালটার হেমিল্টনও বহুদিন পূর্বে ১৮১৫ অব্দে উহা ঠিক সেই ভাবেই দেখিয়াছিলেন। তিনি বলেন;—“কলিকাতা হইতে দেশের অভ্যন্তরভাগে নানা স্থানে নৌ-চালনের বিলক্ষণ সুবিধা আছে, বিদেশের আমদানি মাল গঙ্গা ও তাহার তোয়দাসমুহ দিয়া হিন্দুস্থানের উত্তরাংশের নানা স্থানে অনায়াসে লইয়া যাওয়া যাইতে পারে, এবং মফঃস্বলের মূল্যবান্ উৎপন্ন দ্রব্যসমুহও পরে কলিকাতায় আনান যাইতে পারে।” কলিকাতা ভাগীরথীর পূর্ব্ব অর্থাৎ বাম তীরে অবস্থিত। ইহার দ্রাঘিমান্তর ৮৮°২৩'৫৯” পূর্ব এবং অক্ষান্তর ২২°৩৪'২” উত্তর। ইহা সমুদ্র হইতে ৮০ মাইল দূরবর্তী। ১৯০১ অব্দে যে লোকসংখ্যা গণনা করা হয়, তাহাতে ইহার অধিবাসি-সংখ্যা ৫,৪২,৬৮৬ স্থির হইয়াছিল; কিন্তু এই সংখ্যার মধো বন্দরের, কেল্লার এবং পরে যে উপনগরাংশ নব-নিউনিসিপাল-বিধি-অনুসারে ইহার সহিত সংযোজিত হইয়াছে, তাহার লোকসংখ্যা করা হয় নাই! এইচ, জে, রেইনি সাহেব কলিকাতার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন—“কলিকাতা নিম্ন, প্রশস্ত?, সমতলভূমি; জোয়ারের জল সর্বোচ্চ যে সীমায় উঠে, তাহা অপেক্ষা ঈষৎ মাত্র উন্নত, এবং গঙ্গানদীর দ্বীপের নিম্নতর অংশের মধ্যে অবস্থিত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ভূতলে ছিদ্র করি। অভ্যন্তরভাগের অবস্থা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত ১৮৩৫-৪০ অব্দে নিয়োজিত কমিটির সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে এইরূপ লিখিত আছে;— পার্বত্য স্রোতস্বতীসমূহের গর্ভে যেরূপ সূক্ষ্ম অঙ্গার পাওয়া যায়, ৩৯২ ফুট নিয়ে সেইরূপ কয়েক খণ্ড অঙ্গা ও কয়েক টুকর। গলিত কাষ্ঠ বালুকা হইতে বাছিয়া তোলা হইয়াছিল, এবং ৪০০ ফুট নিম্ন হইতে একখণ্ড চুর্ণ প্রস্থর উত্তোলিত হইয়াছিল। ৪০০ হইতে ৪৮১ ফুটের মধ্যে, সাগরতট যেরূপ বালুকা পাওয়া যায়, সেই রূপ সূক্ষ্ম বালু। এবং তাহার সহিত সমধিক পরিমাণে মিশ্রিতভাবে, প্রাথমিক শিলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে গঠিত শিঙ্গল (উপলবিশেষ), শিলা-স্ফটিক, ফেসপার (স্ফটিকবৎ খনিজ-বিশেষ), মাইকা (এক প্রকার খনিজ পদার্থ), শ্লেট পাথর ও চূর্ণ প্রস্তর প্রচুর ছিল, আর এই স্তরেই ছিদ্র সমাপ্ত হইয়াছিল। এই স্কুল পরস্পর প্রোথিত-প্রস্তরখণ্ড-রচিত শৈলের গভীরতা নিশ্চিতরূপে অবধারিত হয় নাই, কিন্তু অনেকে অনুমান করেন, ইহা অধোদিকে ৮ ফুট বিস্তৃত; তাহাতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, ইহার সন্নিধানে উচ্চ পর্বত আছে, এবং বোধ হয়, ক্রমে ক্রমে তাহা বসিয়া গিয়াছে। আর ভূপৃষ্ঠের নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গভীরতার যে সকল স্তর দৃষ্ট হয়, তাহাদের প্রকৃতি ও ব্যবস্থার বিষয় পয্যালোচনা করিলে এই অনুমান অমুলক বলিয়া বোধ হয় না! যথা, ভূপৃষ্ঠ হতে ৮০ ফুট নিয়ে এক স্তর পীট(গলিত উদ্ভিজ্জবিশেষ।) আবিষ্কৃত হইয়াছিল, এবং দেখা গিয়াছিল যে, সেই পীটের সহিত মাদ্রাজী শসাররবাজ, শর্করা-তৃণর পত্র প্রভৃতি ছিল। আর ডাক্তার লুকার বলেন, -এই সকল দ্বারা বুঝা যায় যে কলিকাতার ভূপৃষ্ঠের অবস্থা এক্ষণে যেরূপ দৃষ্ট হয়, ইহা সঞ্চয়কলে তাহা হইতে ভিন্ন অন্য এক প্রকার অবস্থা ছিল, এবং নদীমুখের জলও বর্তমান সময়াপেক্ষা অনেকাংশে বিশুদ্ধতর ছিল। ১৫৯ ফুট নিয়ে পীতবর্ণ শিরা-সমতি এক প্রকার অনমনীয় আঠাল কাদা দৃষ্ট হইয়াছিল, এবং ১৯৬ ফুট নিম্নে এক প্রকার লৌহ-মিশ্রিত আঠাল কাদা, পাওয়া গিয়াছিল; ৩৪০ ফুট ও পুনরায় ৩৫০ ফুট নিয়ে একখণ্ড প্রস্তরীভূত অস্থি উত্তোলিত হইয়াছি, সেটা কোনও কুকুরের পায়ের জানুসন্ধির উপরিভাগের অস্থি বলিয়াই অনুমান হইয়াছিল। তদ্ভিন্ন ৩২ ফুট নিম্নে অন্যান্য অস্থিও পাওয়া গিয়াছিল। “

 “আবার অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে, দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা আমরা এক্ষণে যেরূপ দেখিতেছি, তাহা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার ছিল সন্দেহ নাই। কারণ তৎকালে হুগলী নদীর অস্তিত্ব ছিল না, কয়েক শতাব্দী পুর্ব্বে গঙ্গার প্রবাহিত এক্ষণকার ন্যায় পদ্মা দিয়া প্রবাহিত হইত না; নদীয়া নবদ্বীপ: ত্রিবেণী প্রভৃতির নিম্ন দিয়া প্রবাহিত হইয়া সমুদ্রে পতিত হইত; যাকে এক্ষণে টলির নালা বলে, তাহাকেই এদ্দেশীয়রা প্রাচীন গঙ্গার গর্ভ বলিয়া নির্দেশ করে, এবং তাহাকে বুড়ী গঙ্গা আদি গঙ্গা বলে গঙ্গার প্রবাহের এই মহাপরিবর্ত্তন ঠিক কোন সময়ে ঘটিয়াছিল, তাহা সুনিশ্চিতরূপে বলিতে পারা যায় না; পরন্তু এ সম্বন্ধে ডাক্তার বুকানন হামিলটনের অনুমানই সম্ভবপর বলিয়া বোণ হয়, অর্থাৎ গঙ্গার সহিত কুশীনদীর মিলন হইতেই এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে। গঙ্গার স্বর্গ হইতে অবতরণসম্বন্ধে রামায়ণে মহর্ষি বাল্মীকি যে আখ্যায়িকার বর্ণন করিয়াছেন, তাহা সকলেই বিদিত আছেন। গল্পটি এইরূপ ঃ—মহারাজ সগরের ষষ্টি সহস্র পুত্র পিতার নিমিত্ত অশ্বমেধ-যজ্ঞ করিবার সময়ে কপিল মুনির শাপে ভস্মীভূত হন। অনন্তর সগরের প্রপৌত্র ভগীরথ স্তবে তুষ্ট করিয়া গঙ্গাকে মর্ত্যলোকে আননপুর্ব্বক পূর্বপুরুষগণের উদ্ধার সাধন করেন। সেই জন্যই হিন্দুরা গঙ্গাকে পবিত্র জ্ঞান করিয়া তাহার আরাধনা করেন। এই নদীর নিম্নভাগ ভাগীরথী নামে অভিহিত। এতদ্দেশীয়েরা অদ্যাপি তাহাকে ভাগীরথীই বলে, হুগলী বলে না। এ নামটী সম্পূর্ণ আধুনিক এবং হুগলী নগরের নাম হইতে উৎপন্ন, আর তাহাও অধিক দিনের কথা নহে। প্লিনির সময় হইতে বাঙ্গালার সর্বপ্রধান বাণিজ্য স্থান এবং প্রাচীনদিগের নিকট Ganges Regia আখ্যায় অভিহিত সুপ্রসিদ্ধ সাতগাঁ(সপ্তগ্রাম) নামক নগরের ধ্বংসের পর হুগলী নগর প্রাধান্য লাভ করিতে আরম্ভ করিলে এই নদীও ঐ নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করে। পর্ত্তুগীজেরা হুগলীকে Parts plaquous নামে অভিহিত করিত। ১৬৩২ অব্দে উহা রাজকীয় বন্দররূপে পরিণত হয়, আর সম্ভবতঃ ঐ সময় হইতে ভাগীরথী নদীও হুগলী নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করে॥

 কলিকাতার বায়বীয় আর্দ্রতা সাধারণতঃ অত্যন্ত অধিক বলিয়া বিবেচিত হইয়াবথাকে। ব্লানফোর্ড সাহেব অবধারণ করিয়াছেন যে, কলিকাতায় সংবৎসরে এক ইঞ্চির সহস্রতম ভাগে গড় বাষ্প ৭৬১, কিন্তু লণ্ডন নগরে ইহার অর্ধ অপেক্ষাও অল্প, মোটে ৩৭ মাত্র; পক্ষান্তরে, বায়ুতে আর্দ্রতার অনুপ্রবেশ ১০ রিলে, সংবৎসরের গড় পারস্পরিক আর্দ্রতা ৭৬ মাত্র; কিন্তু লণ্ডনে উহা অপেক্ষা অনেক অধিক, ৮৯। ব্ল্যানফোর্ড সাহেব আরও বলেন যে, “বায়ুর তাপশৈত্যের ভাবের পর, এই দুই স্থানে যাহা কিছু স্বাস্থ্যের পরিবর্ত্তন সংঘটিত করে, তাহাদের মধ্যে এই বায়বীয় আর্দ্রতার পার্থক্য সর্ব্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্ববিশিষ্ট কারণ বলিয়া বোধ হয়।”

 ব্ল্যানফোর্ড সাহেবের সুবিস্তৃত হিসাব ও তাকা অনুসারে কলিকাতার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ৬৬০০৪ ইঞ্চি, কিন্তু ইহার ১০০ মাল অপেক্ষা অল্প নিম্নস্থ সাগরদ্বীপে উহা অপেক্ষা অনেক অধিক অর্থাৎ ৮২-২৯ ইঞ্চি।

 বায়ুমান দ্বারা নির্ধারিত হইয়াছে যে, কলিকাতার বায়বীয় চাপের গড় সাগরতলের ১৮ ফুট উর্দ্ধে ২৯৭১৩ ইঞ্চি। কলিকাতাবাসীরা অনেকবার ভীষণ ঝটিকাবর্ত্তের হস্তে বহু দুর্ভোগ ভুগিয়াছে; এই সকল ঝড় বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত হইয়া কলিকাতার বিষম সর্বনাশ সাধন করিয়াছে। এই সমস্ত ঝটিকাবর্ত্ত সাধারণতঃ বৎসরের মধ্যে দুইটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাগত হইয়া থাকে—দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রারম্ভকালে একবার এবং উহার অবসান কালে আর একবার। শেষোক্ত সময়ে যে সকল ঝড় হয়, সেগুলি সাধারণতঃ উপসাগরের উচ্চতর অংশে উৎপন্ন হইয়া থাকে, কিন্তু বায়ুমানযন্ত্রে তাহাদের আগমনের কোনও কারণ নিদর্শন প্রায়ই সূচিত হয় না।

 কলিকাতা “প্রাসাদময়ী নগরী” আখ্যায় অভিহিত হইয়া থাকে। এই আখ্যা ইহা কত দিন হইতে উপভোগ করিয়া আসিতেছে তাহা বলা দুস্কর। কথিত তাছে যে, ইহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হইয়া জবচার্ণক এই স্থানটী মনোনীত করেন। ফোট উইলিয়ম ও এসপ্ল্যানেড এবং তাদের চতুম্পাবর্তী স্থান জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। চাঁদপার ঘাট হইতে খিদিরপুর পর্যন্ত সমস্তটাই কেবল জঙ্গল ছিল। চৌরঙ্গির যে স্থানে অধুনা রম্য সৌধশ্রেণী দণ্ডায়মান, ১৭১৭ অব্দে উহা একটি অতি ক্ষুদ্র পল্লীগ্রাম ছিল; সেখানে ইতস্তঃত বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটা গৃহ এবং তাহাদের চতুর্দিকে একটা জলাশয় ছিল। তৎকালে চৌরঙ্গি নগরের বহির্ভাগ বলিয়া পরিগণিত হইত। তথায় দস্যুতস্করের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব ছিল। রাত্রিকালে ভূত্যেরা ডাকাতের ভয়ে দলবদ্ধ হইয়া গমনা-গমন করিত। কলিকাতার সীমার বহির্ভাগে আশ্বারোহণে গমন করা সে সময়ে বড় বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল। ফরাসী, পর্ত্তুগীজ, মগ, মার্হাট্টা, ইহারা সকলেই বিশিষ্ট ভীতির কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। কথিত আছে যে, ১৭১৭ অব্দে মরো সুন্দর বন হইতে ১৭০০ লোক ধরিয়া লইয়া যায় এবং তাহাদিগকে ২০ হইতে ৭০ টাকা দরে আরাকানে চিরদাসরূপে বিক্রয় করে। এরূপ অনুমান করা হইয়া থাকে যে, বর্তমান আরাকানদিগের তিন চতুর্থ ভাগ সুন্দরবনবাসীদিগের সন্তান। ১৭৭০ অব্দ পর্যন্ত এই রূপ উৎপাত বিদ্যমান ছিল। উক্ত বৎসর, এই সক” মনুষ্যাপহারদিগের হস্ত হইতে কলিকাতার বন্দর রক্ষা করিবার নিমিত্ত শিবপুর রাজকীয় ঔদ্ভিদ উদ্যানের নিকটস্থ মুকুয়া থানা দুর্গের সন্নিধানে নদীর এপার হইতে ওপার পর্যন্ত একটি লৌহ-শৃঙ্খল প্রসারিত করা হয়। মার্হাট্টারা উহার নিকটেই চতুর্দ্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল এবং থানা দুর্গ অধিকার করিল। উক্ত দুর্গ যে স্থানে অবস্থিত ছিল, সেই স্থানে এক্ষণে রাজকীয় ঔদ্ভিদ্‌ উদ্যানের মধ্যস্থ ডাক্তার আণ্ডার্সনের গৃহ দণ্ডায়মান। উত্তরপাড়ায় অদ্যাপি এমন অনেক প্রাচীন লোক আছেন, যাঁহার। তাঁহাদের পিতা, পিতামহ, প্রভৃতির নিকট শুনিয়াছেন যে, মার্হাট্টা বর্গীর দৃষ্টি পরিহার করিবার নিমিত্ত স্ত্রীলোকেরা কলসী মাথায় করিয়া পুষ্করিণীর জলে আত্মগোপন করিত। “বর্গীর হাঙ্গামা” কথাটী এখনও একটী প্রবাদবাক্য হইয়া রহিয়াছে এবং সে কালের সেই ভীষণ দৌরাত্ম্যের কথা স্মৃতিপথে জাগরুক করিয়া রাখিয়াছে। এতদ্দেশে দাসব্যবসায় বহুকাল হইতে প্রচলিত ছিল। কলিকাতা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত দাসব্যবসায়ের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। ওলন্দাজ, ফরাসী, ইংরেজ, পর্ত্তুগীজ, হিন্দু, মুসলমান সকলেই এই প্রথার পক্ষপাতী ছিল। এক্ষণে দাসব্যবসায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকা অপেক্ষা বঙ্গের দাসগণের অবস্থা অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে ভাল ছিল।

 মুসলমান রাজত্বকালে কেবল কলিকাতা কেন, সমস্ত বঙ্গদেশই অতীব অস্বাস্থ্যকর স্থান বলিয়া বিবেচিত হইত। গ্লাডুরিয়া সাহেব স্বপ্রণীত বঙ্গদেশের বিবরণীতে এ সম্বন্ধে মুসলমানদিগের অভিপ্রায় এইরূপ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন:

 “পূর্ব্ব পূর্ব্ব রাজাদিগের রাজত্বকালে জলবায়ুর অপকৃষ্টতানিবন্ধন বঙ্গদেশ মোগল ও অন্যান্য বৈদেশিকগণের স্বাস্থ্যের প্রতিকূল স্বরূপে বিবেচিত হইত; সেই জন্য যে সকল কর্মচারী রাজার বিরাগভাজন হইত, তাহারাই বঙ্গদেশে প্রেরিত হইত। সুতরাং এই উর্বর ভূখণ্ডে চিরবসন্ত বিরাজমান থাকিলেও ইহা অন্ধকারময় কারাগার, খেতভূমি, ব্যাধিনিকেতন ও যমালয় স্বরূপে পরিগণিত হইত। বোধ হয়, য়্যাটকিন্সন সাহেবের কবিতা নগরে, তদনীন্তন অবস্থা সুন্দর রূপে বর্ণন করিতেছে। সেই কবিতায় মর্ম এইরূপ;

 “হে কলিকাতে! তোমার অবস্থা তখন কি ছিল? তোমাকে তখন উদ্বিগ্নহৃদয়ে অতি কষ্টেসৃষ্ট জীবন ধারণ করিতে হইত: তখন তোমার অঙ্গ নিবিড় জঙ্গলে ও অনিষ্টকর জলায় সমাচ্ছন্ন ছিল; তাহাতে অনেক সাহসী উচ্চাভিলাষী লোককেই প্রাণ দিতে হইয়াছে, চতুর্দিকে উচ্চ উচ্চ বৃক্ষসমুহ আলোক রুদ্ধ করিত এবং ইউপাস্ তরুর ন্যায় বিষাক্ত বাষ্প উদগীর্ণ করিত; দিনমান প্রগাঢ় উত্তাপে জ্বলিতে থাকিত এবং তিমিরাচ্ছন্ন রজনা অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও জ্বরসঙ্কুল শয্যা আনয়ন করিত; সায়ংকালে যে সকল পর্যটক সজীব ছিল, প্রভাতে তাহারা জীবনশুন্য হইত।”

 ১৬৯০ খৃষ্টাব্দে কাপ্তেন হ্যামিলটন একটি হাসপাতালের কথা বলিয়াছেন যে, অনেক রোগী তাহাতে প্রবেশ করিয়াছিল বটে কিন্তু অতি অল্প লোকই জীবিত অবস্থায় সেখান হইতে বহির্গত হইয়া আপনাদের চিকিৎসাবিবরণ প্রচার করিয়াছিল। সর্ব্বদা, রৌদ্র, বৃষ্টি, হিম প্রভৃতির প্রভাবাধীনে অবস্থান ও উগ্রবীর্য্য সুর। পান জন্য যে এক প্রকার রোগ উৎপন্ন হয়, তাহাতে এক এক জাহাজের সমস্ত লোকজনের মধ্যে গড়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখে পতিত হইত। তৎকালে মৃত্যু-সংখ্যা যে অত্যন্ত অধিক ছিল, সাহেবদিগের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সাধকগণের (মুর্দ্দফরাসিদিগের) বিপুল অর্থোপার্জনই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বর্ষকালেই তাহাদের উপার্জ্জন অধিক হইত; সে সময়ে কোন কোন বৎসর ইউরোপীয় অধিবাসিবর্গের তিন চতুর্থাংশ কালগ্রাসে পতিত হইত এবং এক চতুর্থাংশ মাত্র বাঁচিয়া থাকিত। তৎকালে উত্তরজীবীরা কোনও প্রকারে প্রাণরক্ষা করিতে পারিয়াছে বলিয়া পরস্পরের মধ্যে আনন্দ প্রকাশ করিবার অভিপ্রায়ে প্রতি বৎসর ১৫ই অক্টোবর তারিখে এক সুবৃহৎ ভোজ্যোৎসবের অনুষ্ঠান করিত। হ্যামিল্টন বলেন, ১৭০০ অব্দে কলিকাতায় ১২০০ ইংরেজ ছিল, কিন্তু পরবর্তী জানুয়ারী মাসে ৪৬০ জনকে গোর দেওয়া হয়। ম্যালেরিয়া ও আমাশয় তৎকালে অত্যন্ত প্রবল ছিল, এবং 'পাকা জ্বর’ নামক এক প্রকার জ্বররোগে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোগীর শমনভবনে গমন করিত। বিবি কিণ্ডলে এ সম্বন্ধে বলিয়াছেন—“এই রোগে কলিকাতার অধিকাংশ রোগীকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যমালয়ে লইয়া যায়—ডাক্তারেরা অনুমান করেন, গলিত অবস্থার চরমে ইহা অবশ্যম্ভাবী।

 কলিকাতা রিভিউ নামক সাময়িক পত্রে জনৈক লেখক লিখিয়াছেন;—“কলিকাতায় যে জ্বরের প্রাবল্য ছিল, তাহাতে বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই। লোকে নিম্নতলে শয়ন করিত; গৃহের ছাদ উন্নত কর হইলেও এবং তাহাতে সিড়ি লাগান হইলেও অতি অল্পসংখ্যক গৃহেরই উপরিতল ছিল। ক্ষৌরকার আখ্যায় অভিহিত ইতর শ্রেণীর ইউরোপীয়দিগের মধ্যে একটা রাগ সাধারণতঃ প্রবল ছিল; উহা এক প্রকার পক্ষাঘাত; সুরাপানজনিত ‘মত্ততা' ও উত্তেজনার পর অঙ্গ স্থলবায়ু লাগানতে ইহা উৎপন্ন হইত। যকৃতের স্ফোটক অতি মারাত্মক হইত; কাউণ্ড লালির বিরুদ্ধে অন্য: দোষারোপের মধ্যে একটি দোষারোপ এই যে, স্ফোটক জন্মিবার পূর্ব্বে তিনি এইরূপ ভাবে চিকিৎসিত হইতেন, যেন যকৃতে স্ফোটক হইছে; কিন্তু তাহা যদি সত্য সত্যই হইত, তাহা হইলে তাহাকে শমনভবনে যাইতে হইত। ঐ কথাটা নিতান্ত অসম্ভব হইলেও, স্ফোটক সম্বন্ধে তাহার মনোভাব কিরূপ ছিল, তাহা ইহা দ্বারা বেশ বুঝা যাইতেছে।

 অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে কয়েক প্রকার জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল, তৎসম্বন্ধে ডাক্তার লিণ্ড লিখিয়াছেন;—

 “ব্যাধিসমূহ প্রধানতঃ অবিরাম বা সবিরাম শ্রেণীর জ্বর; কখন কখন ঐ সকল জ্বর আরম্ভ হয়। ক্রমিক চড়িতে থাকে এবং কয়েক দিন যাবৎ স্পষ্ট বিরামের কোনওরূপ চিহ্ন বুঝিতে পারা যায় না, কিন্তু সাধারণতঃ মধ্যে মধ্যে বিরাম হইয়া থাকে। তাহাদের সহিত প্রায়ই প্রবল কম্পন হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে উর্দ্ধাভিমুখে দুই দিকেই পিত্তনিঃসরণ হইতোকে। ঋতুটি যদি খুব ব্যাধিসঞ্চারপ্রবণ হয়, তাহা হইলে কেহ কেহ উৎকট জ্বরে আক্রান্ত হইয়া অচিরে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়; সমস্ত শরীর সীসবর্ণ চাকুরা চাকুরা দাগে সমাচ্ছন্ন হয়, এবং শবদেহ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ কৃষ্ণবর্ণ হইয়া গলিত হইয়া উঠে। এই সময়ে ভেদও প্রবল হয়। আর এক প্রকার ভেদের সহিত অন্ত্র প্রবাহ থাকে, তাহা হইতে এই গুলিকে পৃথক্ কবির নিমিত্ত ইহাদ কে পৈত্তিক বা দূষিত বলা যাইতে পারে। বঙ্গদেশে এ সমস্ত রোগে ‘ল্যান্সেট '(ছুরিকাস্ত্র) খুব সাবধানে ব্যবহার করা উচিত অনেকে বলেন, বাঙ্গালার সবিরাম জ্বরের উপর চন্দ্রের বা জোয়ার ভাটার আশ্চর্য্য প্রভাব দৃষ্ট হয়। একান্ত সত্যবাদী ও চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রচুর জ্ঞানবিশিষ্ট জনৈক ভদ্রলোক আমাকে বলিয়াছেন যে, বাঙ্গালার জ্বরে কোন্ সময়ে রোগী মারা যাইবে, তা তিনি পূর্বেই সঠিকরূপে বলিয়া দিতে পারিতেন, কারণ সাধারণতঃ ভাটার সময়েই প্রায় তাহা ঘটিত। সে যাহা হউক এটা নিশ্চিত অবধারিত হইয়াছে যে, ১৭৬২ খৃষ্টাব্দে চন্দ্রগ্রহণসময়ে যে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাধি উপস্থিত হইয়া বঙ্গদেশে ৩০,০০০ কৃষ্ণকায় ও ৮০০ ইউরোপীয়ের প্রাণ হরণ করে, সেই ব্যাধির পর যে সকল ইংরেজবণিক ও অন্যান্য লোক 'বার্ক’ (সিঙ্কোনা) খাওয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল, তাহারা ঐ রাগে পুনর্ব্বার আক্রান্ত হইয়াছিল। গ্রহণের দিনে এই জ্বর প্রায় সকল রোগীকে আক্রমণ করিত; সুতরাং গ্রহণের সহিত যে ইহার সম্বন্ধ আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কিছু মাত্র কারণ নাই।”

 কলিকাতায় কলেরা-রোগের প্রথম আবির্ভাবশাল সম্বন্ধে ভাক্তার লিও বলেন;—"১৭৬১ অব্দে যে মহামারীতে বঙ্গদেশে ৩,০০০ কৃষ্ণকায় ও ৮০০ ইউরোপীয় কালগ্রাসে পতিত হয়, সেই রোগে দেখা গিয়াছিল যে, পুনঃ পুনঃ এক প্রকার সাদা আঠাল স্বচ্ছ শ্লেষ্মা বমন এবং তাহার সহিত অবিরত ভেদ, ইহাই অতীব মারাত্মক লক্ষণস্বরূপে বিবেচিত হইত।” কলেরার চিকিৎসা ছিল, বমনকারক, ঔষধ, অহিফেনঘটিত নিদ্রাকারক ঔষধ, আমোনিয়া দ্রব্য, আর জল; উহাতে রোগী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যাইত। মোসিয়র ডেলন ১৯৯৮ অব্দে Indian mordeoli নামক এক প্রকার রোগের কথা লিখিয়া ছেন; উহার সহিত ভেদ বমন থাকে, এবং উহাতে শোকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়; অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে লোহা পুড়াইয়া লাল করিয়া পাদগুলকে ছেকা দেওয়া এবং গোলমরিচের সহিত কাঁজি খাওয়ান সবিশেষ ফলপ্রদ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। কলেরা যৎকালে ব্যাপক আকারে মার্কুইস অব হেষ্টিংসের বিপুল সেনাদলে প্রথম প্রকাশ পায়, সে সময়ে দেশীয় লোকেরাই প্রথম অক্রান্ত হইয়াছিল; ইউরোপীয় রোগীদিগের প্রবল আক্ষেপ (খেঁচুনি) ও দুর্নিবার পিপাসা হইত, কিন্তু ডাক্তারেরা তাহাদিগকে এক বিন্দুও জল খাইতে দিতেন না,অথচ যাহারা গোপনে জল খাইতে পাইত, তাহারা শীঘ্র শীঘ্র সারিয়া উঠিত। ব্র্যণ্ডি ও ডেনম ভিন্ন অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে রোগীকে গরম জলের মধ্যে আকণ্ঠ মগ্ন করিয়া তাহার বহু হইতে রক্ত মোক্ষণ করা হইত,—তবে কথা এই যে, যদি রক্ত বাহির হইত তাহা হইলেই ঐরূপ করা হইত। ডাক্তারের এই রোগের বীজ বায়ুতে থাকে বলিয়া মনে করিতেন, এবং প্রথম প্রথম ইহাকে স্পর্শ সংক্রামক কাজ বলিয়ও বিবেচনা করা হইত; শিবিরানুচরেরা এত শীঘ মারা পড়িয়াছিল যে, মার্কুইস অব হেষ্টিংস গোয়ালিয়রের নিকট স্থায়ী শিবির সন্নিবিষ্ট করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 তৎকালে আমাশয়ের চিকিৎসা কিরূপ হইত, তাহা স্বর্গীয় ডাক্তার গুডিভ সাহেবে। লিখিত 'প্রাচ্য ভূখণ্ডে ইউরোপীয় চিকিৎসার প্রসার' বিষয়ক একটি প্রবন্ধ হইতে জানিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেন—“আমাশয় রোগীর বল রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য এই বিবেচনায় মদ ও সসার মাংসমদ খাদ্য অতীব উপযুক্ত পথ্যরূপে ব্যবহৃত হইত। এই সকল স্থলে রোগীকে ইচ্ছানুসারে পোলাও, কালিয়া মুরগীর কাবাব ও গোলমরিচযুক্ত ‘চিকেনব্রথ’ (কুকুট শিশুর মুস), এবং তাহার সহিত দুই এক গেলাস ঔষধ বা কিঞ্চিৎ ব্র্যাণ্ডি ও জল এবং প্রচুর পাকা ফল খাইতে বলা হইত। দেশীয় চিকিৎসকেরা গরম ও ঠাণ্ডা রোগের নিমিত্ত গরম ও ঠাণ্ডা ঔষধ-মন্ত্র ও কবচ ব্যবহার করিত; আবার ডাক্তার লিণ্ড বলেন যে, পর্ত্তুগীজ ডাক্তারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীকাররূপে রোগীর দেহের সমস্ত ইউরোপীয় শোণিতকে দেশীয় পরিবর্তনের ব্যবস্থা করিত। এই কার্য্য কি প্রকারে সংসাধন করিবার চেষ্টা করিত, শুনিবেন? তাহারা রোগীর শরীরের শিরা ছেদন করিয়া রক্ত বাহির করিয়া ফেলিত এবং যতক্ষণ না তাহাদের বিশ্বাস হইত যে, সমস্ত রক্ত বহির্গত হইয়া গিয়াছে, ততক্ষণ পুনঃ পুনঃ শিরাব্যবচ্ছেদ করতে থাকিত। তৎপরে তাহারা রোগীকে নিরবচ্ছিন্ন এতদ্দেশোৎপন্ন দ্রব্য খাইতে দিত, কারণ তাহারা মনে করি যে, এই উপায়ে রোগীর দেহে পূর্ব্ব শোণিতের পরিবর্তে ভারতীয় শোণিতের সঞ্চার হইবে, এবং তাহা হইলে ঐ রোগী পুর্ব্বে যে সকল রোগ ভোগ করিয়াছে, সে সকল ব্যাধি আর তাহাকে আক্রমণ করিতে পারিবে না। ডাক্তার বেগ বলেন, অবরোগে রক্তমোক্ষণ চিকিৎসাই সচরাচর অবলম্বিত হইত। ১৭৯৩ খৃষ্টাকে ডাক্তার লেস্কার্ট চীনাবাজারের ৩৭ নং বাটীতে স্নানাগার স্থাপন করিয়া প্রত্যেক ব্যক্তির স্নানের মূল্য এক টাকা নির্ধারিত করিয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু ঐ ব্যবসায়ে তাঁহার লাভ হয় নাই। ইংরেজের। যদি খাদ্য, পানীয়, পরিচ্ছদ প্রভৃতি বিষয়ে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উপযোগী জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতেন, তাহা হইলে অনেক রোগের আক্রমণ হইতে যে মুক্ত থাকিতে পারিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইংরেজ-সমাজে দেশাচাররূপ রাক্ষসের প্রভুত্ব যেরূপ বদ্ধমূল, বোধ হয় আর কোনও সমাজে সেরূপ নহে। ইংরেজজাতি আপনাদের দেশাচারের দাস। ইংরেজ-সমাজে দেশাচারের আধিপত্য কিরূপ গভীরভাবে বিস্তৃত, তাহার যথাযথ বর্ণনা করিয়া জনৈক লেখক কোনও সাময়িক পত্রে লিখিয়াছেন;—ইংরেজ ভূমণ্ডলের যেখানেই গিয়াছেন, সেই খানেই তিনি আপনার দেশাচারটিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছেন। তিনি লণ্ডনেও যেরূপ টুপিওয়ালা, কলিকাতাতেও সেইরূপ টুপিওয়ালা। এ বিষয়ে ব্যাটেভিয়ার ওলন্দাজের সহিত তাঁহার সুন্দর সাদৃশ্য আসে, ব্যাটিভিয়ার ওলন্দাজেরা জলার মধ্য দিয়া খাল বা দুর্গন্ধময় পয়ঃপ্রণালী সকল খনন করিয়াছে, কেন না আমষ্টার্ডাম নগরে খাল ও পয়ঃপ্রণালী আছে—তাহার ফল হইল মহামারী জ্বর, সুতরাং দেশীয়দিগের তরবারি অপেক্ষা খালেই জাবাদ্বীপে অধিকসংখ্যক ওলন্দাজের প্রাণসংহার করিয়াছে। আমরা দেখিতে পাই, ১৭৮০ অব্দে কলিকাতর লোকদিগকে এইরূপ সতর্ক করা হইয়াছিল-সম্প্রতি অনেকগুলি আকস্মিক মৃত্যুঘটনা হইয়াছে, অতএব যতদিন গ্রীষ্ম থাকিবে, ততদিন ভদ্রলোকেরা যেন অতিরিক্ত আহার না করেন; কোনও ভারত-বাণিজ্য-রত বড় বড় জাহাজের ডাক্তার খানার সময় আকণ্ঠ গোমাংস ভোজন করিয়া রাস্তায় পড়িয়া মরিয়াছিল; সে দিন তাপমান যন্ত্র ৯৮ দাগে উঠিয়াছিল।

 সে সময়ে ভাল ডাক্তারও পাওয়া যাইত না। আমাশয় রোগের চিকিৎসা-প্রণালী ইতঃপূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। পাদরী লঙ সাহেব বলেন, তখন কলিকাতায় দুইজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁহারা প্রত্যেকে বার্ষিক ২৫ পাউণ্ড (২৫০) টাকা বেতন পাইতেন, তবে অন্যান্য কর্মচারীর ন্যায় তাঁহাদেরও কতকগুলি দ্রব্যে শতকরা দস্তুরি পাওনা ছিল এমন কি ম্যাডিকা নামক মদ্যও বাদ যাইত। না। হ্যামিল্টন সাহেব বলেন;— এই সময় (১৭০৯) ডাক্তারদের বিদ্যাবুদ্ধি তেমন ভাল ছিল না, তাঁহার। তেমন বেতনও পাইতেন না। হাড়ির একটা ভাত টিপিলেই সমস্ত ভাতের অবস্থা বুঝিতে পারা যায়; বোম্বাই প্রদেশের একজন গবর্ণরের সম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, এক সময়ে তিনি ব্যয় লাঘবসাধন দ্বারা তাহার ইংলণ্ডস্থ মাননীয় প্রভুর অনুরাগ আকর্ষণ করিবার অভিলাষী হইয়া দেখিলেন যে, ডাক্তারের বেতন মাসিক ৪২ টাকা; ইহা দেখিয়া তিনি বলিলেন, এ বিষয়ে অবশ্যই কোনও প্রকার ভুল হইয়াছে, অঙ্ক দুইটি উলটপালট হইয়া গিয়াছে’ এই কথা বলিয়াই তিনি কলমের এক খোঁচায় ৪২ টাকার পরিবর্তে ২৪ টাকা লিখিয়া ফেলিলেন।”

 ১৭৮০ অব্দে কলিকাতার কোনও ইংরেজী সাময়িক পত্রে এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর সরস ব্যঙ্গকবিতা প্রকাশিত হইয়াছিল। আমরা এস্থলে তাহার মর্মার্থ উদ্ধৃত করিলাম। ‘ বলা বাহুল্য, অনুবাদে মুলের সৌন্দর্য্য বা রস রক্ষা করা অসাধ্য।

 “যে সকল ডাক্তার কখনও লীডেন বা ফার্ণ্ডাস দেখে নাই, তাহারা যুক্তিবিরুদ্ধ পথে চলে, এবং রক্তহীনতা (নেবা) রোগে রক্ত মোক্ষণ করার। যদি তোমার স্ত্রীর শিরঃপীড়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে সাঙ্গোড্রা[১] সাহেবকে ডাকাইয়া ভোমার পত্নীকে স্পর্শ করিতে দাও; সে শুকর-ধাতক কসাইয়ের মত অবিলম্বে রোগিণীর শরীরে ল্যান্সেট বসাইয়া দিবে। ধসা পচা রোগে শরীর অতি দ্রুত ক্ষয় পাইতে থাকিলেও শোণিতের জলীয়াংশ অধিকতর তেজোহীন করিবার নিমিত্ত সে তোমার শরীর হইতে রক্ত বাহির করিয়া দিবে। কিন্তু ভাই! ব্যাপারটা বেশ করিয়া বুঝিয়। দেখ, একজন বেশ ভাল মিড শিপম্যান (সর্বনিম্নপদস্থ নৌসৈনিক কর্মচারী) সহসা ডাক্তার উপাধি পাইয়া বসিল। কি মজা! সে ব্যক্তি তোমার নাড়ি ধরিল, ঠিক যেন জাহাজের কাছি ধরিয়াছে, আবার অমনি সঙ্গে সঙ্গে ঠিক পোপের মত তোমার রাগ ঠাওর করিয়া ফেলিল! আজ যদি গ্রীকৃদার্শনিক প্লেটো বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে ভারতবর্ষের কোন কোন ডাক্তারকে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার পেটের নাড়ী ছিড়িয়া যাইত; যদি তোমার মাথা খুলি ভাঙ্গিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে উহারা বলিয়া বসিবে, ওটা পিত্তের দোষ, এবং খুব গম্ভীরভাবে ভয়ঙ্কর মুখভঙ্গি করিয়া ও অতি সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ঘোড়ার উপযুক্ত একতাল জোলাপ এবং ক্ষারময় বটিকা দিবে”

 পরন্তু ১৭৮০ অব্দে দেখা যায়, চিকিৎসা ও আইন উভয়ই তত্তৎব্যবসায়ীদিগের পক্ষে সুবর্ণের আকরস্বরূপ হইয়াছিল। তৎকালে ডাক্তারেরা পাল্কী চড়িয়া রোগীদের বাড়ী যাইতেন এবং সাধারণ রোগে প্রত্যেক বারে এক একটা সোণার মোহর দক্ষিণা লইতেন; অসাধারণ স্থলে বা অতিরিক্ত বাবদে দক্ষিণর পরিমাণ অত্যধিক ছিল। ঔষধের মূল্যও অত্যন্ত উচ্চ ছিল। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী পুরাতন কেল্লায় একখানি ডাক্তারী ঔষধের দোকান খুলিয়াছিলেন। কয়েকটা ঔষধের মুল্য এস্থলে দেওয়া গেল এক আউন্স বার্ক ৩ টাকা, একটা বেলেস্তারা (Blistar) ২ দুই টাকা, একটাঔষধের বড় বটিকা ১ এক টাকা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে কাহারও অমূল্য জীবন রক্ষা করিতে হইলে তাহাকে সর্ব- স্বান্ত হইতে হয়, থালা ঘাট বাটী বাধা দিতে হয়। আধুনিক কবিরাজ মহাশয়েরাও ইউরোপীয় প্রণালীর চিকিৎসা ব্যবসায়ী ডাক্তারদিগের ন্যায় প্রত্যেক বার রোগী দেখার দর্শনী লইয়া থাকেন। ইহঁদের ঔষধের মূল্য এরূপ অত্যধিক যে, ইহারা কি প্রণালীতে যে মুল্য নির্ধারণ করেন, তাহা স্থির করিতে বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পায়। পুৰ্বকালে—অবিক দিনের কথা নহে, ৫০ বৎসর পূর্ব্বেও দেশীয় কবিরাজের পরিমিত মত অর্থ লইতেন এবং তাহাও নিতান্ত মমতাশূন্যভাবে লইতেন না। আমাদের সমাজের ইতর ভদ্র সকল শ্রেণীর প্রতিই তুলারূপ দয়ামায়া, স্নেহমমতা ছিল বলিয়া তাহারা যথোচিত সম্মান ও শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র ছিলেন। লোকে তাহাদের বিদ্যাবুদ্ধির ও চিকিৎসা-নৈপুণ্যেরও যথেষ্ট সুখ্যাতি করিত; আজ পর্যন্ত কেহ তাহাদিগকে অতিক্রম করা দূরের কথা, তাহাদের সমকক্ষও হইতে পারেন নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সকল বিষয়েই প্রাচীন প্রথা শীঘ্র শীঘ্র তিরোহিত হইতেছে, এবং সকল দিকেই নব নব প্রথা লোকের উপর চাপিয়া বসিতেছে।

 বলা বাহুল্য যে, স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় যথোচিত ব্যবস্থার অভাব এবং মৃত্তিকাস্থিত নানাপ্রকার দূষিত পদার্থ কলিকাতার মৃত্যুসংখ্যা বহুপরিমাণে বর্ধিত করিয়াছিল। যে পাকা জ্বরের বিষয় পূর্বে লিখিত হইয়াছে, অনেকে অনুমান করিতেন, কলিকাতার মধ্যে সর্ব্বত্র যে ভয়ানক জঙ্গল এবং পচ! পুকুর ও ঝিল বিদ্যমান, তাহাই ঐ জ্বরের প্রধান কারণ। কেবল পশুদের কেন, মনুষ্যদের মৃতদেহও ক্রমাগত কয়েক দিন যাবৎ প্রখর রৌদ্রে রাস্তায় পড়িয়া পচিতে থাকিত। শৃগাল ও অন্যান্য পশু সেই সকল পচা শবদেহ একাদিক্রমে কয়েক দিন পর্যন্ত খাইতে থাকিত। তৎপরে সেই মৃতদেহ নদীতে ফেলিয়া দেওয়া হইত,—সময়ে সময়ে পুষ্করিণীতেও যে নিক্ষেপ করা না হইত, তাহাও নহে।

 সেকালে ব্ল্যাকিয়ার নামক কলিকাতাবাসী একজন সাহেব সমাজে বেশ সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ট্যাঙ্ক স্কোয়ার (বর্তমান নাম ড্যালহাউসি স্কোয়ার) নামক স্থানে বন্য পক্ষী শিকার করি- তেন। ঐ সাহেব বলিয়াছেন, ১৭৯৬ অব্দের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারি মাসে বসন্ত মহামারী উপস্থিত হইয়া অনেক মানুষ ও গবাদি গৃহপালিত পশুর প্রাণসংহার করিছিল। ১৮০২ খৃষ্টাব্দে, মাদ্রা- জের ফিজিশিয়ান জেনারল ডাক্তার জেমস আণ্ডাসন কলিকাতার ইংরেজ উপনিবেশে টিকা দিবার প্রথা প্রবর্তিত করেন। তিনি দুইটি ইউরোপীয় বল ককে গো-বসন্তের বীজে টিকা দিয়া তাহা- দিগকে জাহাজে করিয়া ফোর্ট উইলিয়ামে প্রেরণ করিয়াছিলেন। উইলিয়াম রসেল নামক একজন সাহেবই কলিকাতায় গোবীজে টিকা দিবার প্রণালী প্রথম আরম্ভ করেন এবং গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সিতে ডাক্তার জেনারের আবিষ্কারের সুফলের অধিকতর প্রসারসাধনবিষয়ে তত্ত্বাবধান করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত করেন। এই সময়ে (১৮০২) আর একটী মহোপকার- জনক ব্যবস্থা প্রণীত হয়; পূৰ্বে কতকগুলি ভ্রান্ত হিন্দু বিপথে চালিত হইয়া গঙ্গাসাগরে (সাগরদ্বীপের নিকট সমুদ্রে) সন্তান ভাসাইয়া দিত; গবর্ণমেণ্ট আইন করিয়া এই নিষ্ঠুর প্রথা রহিত করিয়া দিলেন। শাস্ত্র কোনও কালেই এই অমানুষিক নির্দ্দয় প্রথার অনুমোন করে নাই। এই আদেশ যাহাতে লঙ্ঘিত না হয়, তাহা দেখিবার জন্য এই আবশ্যক হইলে বল প্রকাশ করিবার নিমিত্ত একদল সৈন্য তথায় প্রেরিত হইয়াছিল, কিন্তু কেহ কোনও প্রকার বাধা জন্মাইবার চেষ্টা করে নাই।

 কলিকাতার স্বাস্থ্যোন্নতির নিমিত্ত লটারি কমিটি’ যে সকল কার্য্য করিয়াছিলেন, তাহা দ্বারা বিলক্ষণ উপকার হইল। সেকালে লটারির সুব্যবস্থা করিবার জন্য কয়েকজন লটারি-কমিশনার ছিলেন। তাঁহা্রা ১৭৯৪ অব্দে সাধারণের হিতজনক ও দাতব্য- কার্যের নিমিত্ত প্রতি টিকিট ৩২ টাকা দরে ১০,০০০ টিকিট বিক্র য়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। এইরূপ টিকিট বিক্রয়দ্বারা যে অর্থ- লাভ হইল, তাহা দ্বারা কয়েকটি অত্যুৎকৃষ্ট রাস্তা ও গির্জা নির্ম্মিত হইয়াছিল। পাদরী লঙ সাহেব বলেন,—“লটারি সে কালের সাধারণ প্রথা ছিল; মাসিক ১০০০ টাকা ভাড়ায় বড় বড় বাড়ী ৬০০ টাকা দরের সুর্তি টিকিট ধরাইয়া বিক্রয় করা হইত; তদ্ভিন্ন বাগান বাড়ী সকল, এবং নদীর ধারে যেখানে বাস করা উচিত নহে এমন স্থানে অবস্থিত হাবড়ায় একটা বাড়ীও লটারিরা বিক্রীত হয়। হার্ম্মো- নিক হাউসনামক একটা বিখ্যাত হোটেল ১৭৮০ অব্দে লটারিদ্বার। নীলামে ধরান হয়, এবং মাননীয় জষ্টিস্ হাইড, তাহা প্রাপ্ত হন। এণ্টালি (ইটিলি) নামক স্থানে একটা বাগানবাড়ী ১৭৮১ অব্দে ৭৫ টাকা দরের লটারি টিকিট পাইয়া ৬,০০০ টাকায় বিক্রীত হয়। উত্তরকালে লটারি টিকিট বিক্রয় দ্বারা লব্ধ অর্থে কলিকাতায় কয়েকটি সর্বোৎকৃষ্ট রাজপথ নির্মিত হইয়াছিল।[২]

 দমদম, বারাসত, চন্দ্রনগর, কাশিমবাজার, চট্টগ্রাম, শুকসাগর, ও হুগলির নিকট বিরকুল, এই কয়েকটি স্থান তৎকালে সবিশেষ প্রীতিপ্রদ ও স্বাস্থ্যপ্রদ বলিয়া বিবেচিত হইত। ১৭১৯ সালের পূে কলিকাতায় এক প্রকার মিউনিসিপালিটি ছিল। সে যাহা হউক, ইংরেজদিগের বসতি স্থানটিকে মনোরম ও স্বাস্থ্যকর করিবার অভিপ্রায়ে গবর্ণমেণ্ট ১৭৪১ সালে নর্দামাগুলি পুনর্ব্বার জরিপ করিবার আদেশ প্রদান করেন। ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে, ইংরেজ বণিক কোম্পানির এজেণ্টগণ এক আদেশ প্রচার করিয়া তাহাদের জমি- দারীর ভিতর শৃঙ্খলাশূন্য গৃহ নির্মাণ করিতে সকল লোককেই নিষেধ করেন। এরূপ নিষেধাজ্ঞা প্রচার আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল, কারণ অনেক লোকই তাহাদের অনুমতি না লইয়া গৃহ, পুষ্করিণী ও প্রাচীর নির্মাণ করিত। এতাদৃশ অবস্থায় ইংরেজ-শাসনকর্ত্তাদিগের কলিকাতার স্বাস্থ্যোন্নতির প্রয়াস যে কতদূর প্রশংসনীয়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় আধুনিক ভাবসমুহ যে পাশ্চাত্য-দেশ সম্ভুত, তাহাতে সন্দেহ নাই; সুতরাং স্বাস্থ্যবিধানের বর্তমান উপায়াবলী ও যন্ত্রাদিও পাশ্চাত্য জগতের আবিষ্কৃত। কলি- কাতার শ্রীবৃদ্ধিসাধনার্থ ইংরেজরা যে প্রভূত অয়াস স্বীকার ও অর্থ- ব্যয় করিয়াছেন, তাতে ইহার প্রাকৃতিক অবস্থাও দৃশ্য সম্পূর্ণ পরি- বর্তিত হইয়া গিয়াছে। ইংরেজদিগের প্রথম আমলে যে সকল শাসন- কর্তা কলিকাতার উৎকর্ষবিধানকল্পে সুধারাসম্মত প্রণালীমে যত্ন- ক্লেশ স্বীকার করিয়াছেন, তন্মধ্যে মাকুইস অব ওয়েলেসলির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি দেশীয় ও ইউরোপীয় উভয় শ্রেণীর কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে লইয়া একটি কমিটির সংগঠন করেন। সেই কমিটি শ্রীবৃদ্ধিসাধনের প্রণালী নির্দেশ করিয়া যে রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করেন, তদৃষ্টে উক্ত মাকুইস্ মাহাত্ম। এবিষয়ে কিরূপ আন্তরিক যত্ন প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারা যায়। তিনি গবর্ণমেণ্টের ধনাগার উন্মুক্ত করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। পয়ঃপ্রণালীসমুহের সংস্কারসাধনের দিকেই তাহার প্রথম মনোহোগ আকৃষ্ট হয়। এ সম্বন্ধে তাহার নিজ উক্তির ধর্ম উদ্ধৃত করাই সঙ্গত বোধ হইতেছে;—“বর্ষাকালের শেষভাগে কলিকাতার স্বাস্থ্য যে অত্যন্ত বিকৃত হইয়া উঠে, তাহার কারণ- সন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে দেখা যায় যে, নর্দাম ও পয়ঃপ্রণালীসমূহের কদর্য অবস্থা এবং সহরের মধ্যে ও তাহার সন্নিহিত স্থানসমূহে জল জমিয়া থাকাই তাহার প্রধান কারণ।” উক্ত মহানুভব এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন যে, “ভারতবর্ষ শাসন করিতে হইলে, রাজপ্রাসাদে থাকিয়া রাজার ন্যায় মনোভাব লইয়া ঐ কার্য করা উচিত, সামান্য দোকানঘরে থাকিয়া মখমল ও নীলের খুচরা দোকানদারের মনোভাব লইয়া ভারতবর্ষ শাসন করা শোভা পায় না।” গভর্ণর ভ্যানসিটার্ট, লর্ড ক্লাইভ, গভর্ণর ভেরেলেষ্ট, গভর্ণর কাটিয়ার, গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেণ হেষ্টিংস, ইহারাও নগরের পরিচ্ছন্নতা বিধান করিবার ও ইহাকে মুখস্বচ্ছন্দকর ও স্বাস্থ্যকর স্থানে পরিণত করিবার পক্ষে যত্ন চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। সার উইলিয়াম হণ্টার বলেনঃ—“যখন হেষ্টিংস সাহেব শাসনকর্তা হইলেন, তখন আরও কয়েকটি নূতন বিধি প্রণয়ন করিলেন, পুলিসের কর্মচারীদিগকে আরও কিঞ্চিৎ অধিক ক্ষমতা দিলেন, কৃষ্ণ ও শ্বেত সহরকে ৩৫টি ওয়ার্ডে বিভাগে বিভক্ত করিলেন, এবং দেশীয়দিগের আরও কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়া যাইবার সম্মতি ক্রয় করিলেন।”

 প্রথম অবস্থায় মিউনিসিপ্যাল কার্য্য মেয়র এবং নয় জন য়্যালডারম্যান দ্বারা পরিচালিত হইত; তাহারা সকলেই গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক নিয়োজিত হইতেন। কিন্তু পয়ঃপ্রণালীর সহিত তাহাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তৎকালে একটি কমিটী ও স্বয়ং গবর্নমেণ্ট এবং গবর্ণমেণ্টের নিয়োজিত ডাক্তার নগরের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে তত্ত্বাবধান করিতেন। ইতোমধ্যে জষ্টিসগণ আসরে অবতীর্ণ হইলেন। ইহার যাবজ্জীবন কালের নিমিত্ত গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক নিযুক্ত হইতেন। পরলোকগত সার জজ ক্যাম্বেল একটি আইনের পাণ্ডুলিপি উপস্থিত করিয়া মিউনিসিপালিটির সংস্কারসাধনের বিফল চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহার পাণ্ডুলিপির উদ্দেশ্য এইরূপ ছিল:— “মিউনিসিপাল কমিশনারদিগের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ম্যাজিষ্ট্রেটদিগের সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত অল্প মিউনিসিপালকার্য্য ও দায়িত্ব অর্পণ, নির্ব্বাচনপ্রণালী দ্বারা মিউনিসিপাল কমিশনারদিগের নির্বাচন, এবং অন্যান্য প্রকারে মিউনিসিপাল স্বায়ত্তশাসনের প্রসারবর্দ্ধন.” তিনি নিজে বলিয়াছেন, টেক্স বৃদ্ধি করা তাঁহার উদ্দেশ্য নহে, স্বায়ত্তশাসন প্রথার প্রবর্তনই তাঁহার উদ্দেশ্য আর একস্থলে তিনি বলিয়াছেন;—“মিউনিসিপাল-স্বায়ত্তশাসন এদেশে অজ্ঞাত নূতন পদার্থ নহে; উহা এতদ্দেশের স্বভাবসিদ্ধ, কারণ উহা হিন্দুজাতির অতি প্রাচীন নীতি ও অভ্যাস।” তাঁহার উত্তরাধিকারী পরলোকগত সার রিচার্ড টেম্পল ভারত গবর্ণমেণ্টের অনুমোন ক্রমে কলিকাতার করদাতাদিগকে কয়েকজন কমিশনারের নির্বাচনের অধিকার প্রদান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন; কিন্তু ঐ সকল কমিশনারের ক্ষমতা ও অধিকার স্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল কলিকাতায় স্বায়ত্তশাসনুপ্রথা প্রবর্তিত হওয়ার যে সমস্ত সংস্কার সাধিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এইগুলি সবিশেষ উল্লেখযোেগ্য, যথা— নর্দ্দামা ও পয়ঃপ্রণালীসমূহের সংস্কার, রাস্তাগুলিতে গ্যাস ও তাড়িতালোক প্রদান, বস্তিজমির উন্নতিবিধান, ময়লা ও জঞ্জাল আবর্জনার দূরীকরণ, এবং বর্তমান কলের জলের ব্যবস্থা। নগরের মিউনিসিপাল-শাসনের ইতিহাস সবিশেষ কৌতুকাহ। দুর্ভাগ্য- বশতঃ আমাদের এরূপ স্থান নাই যে, আমরা তাহা সবিস্তারে বর্ণন করিতে পারি; সুতরাং সক্ষেপে তাহার উল্লেখ করিয়াই আমাদিগকে সন্তুষ্ট হইতে হইবে। জব চার্ণকের সময়ে ইংরেজ বণিকগণ যৎকালে কলিকাতায় বসতি স্থাপন করিতে আরম্ভ করেন, সেই সময় হইতেই তাঁহারা ইহার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য সবিশেষ উদ্যোগী হন। এই অস্বাস্থ্যকর স্থানকে বসবাসযোগ্য করিবার নিমিত্ত তাঁহারা প্রভূত প্রয়াস পাইয়াছিলেন। জমিসকল পুনঃ পুনঃ জরিপ করিয়া নক্সা ও ম্যাপ প্রস্তুত করা হইতে লাগিল। রাস্তাসকল নির্মিত হইতে লাগিল; জঙ্গল দূরীকৃত হইতে লাগিল, স্থলভাগকে সমতল করিবার উপায় অবলম্বিত হইতে লাগিল; এবং অন্যান্য প্রকারে স্বাস্থ্যসম্পর্কীয় ও গৃহসম্বন্ধীয় সংস্কারসাধনের উপায় সকল স্থিরীকৃত হইয়া কার্য আৰূ হইল। উপনিবেশটিকে মনোজ্ঞ ও স্বাস্থ্যকর করিবার নিমিত্ত তৎকালে ব্যক্তিগত চেষ্টার বিলক্ষণ প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা ছিল। বস্তুতঃ বাণিজ্য ও লোকহিতৈষণাই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ও গৃহসম্পকীয় সংস্কারসাধনের পথপ্রদর্শক হইয়াছিল, এবং গবর্ণমেণ্ট সাক্ষাৎসম্বন্ধে দায়িত্ব ও কর্তৃত্বভার গ্রহণ করিলেও তাহার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ব্যক্তিগত চেষ্টায় এ বিষয়ে অনেক কাজ হইয়াছিল।

 বর্ত্তমান কলিকাতার সূত্রপাত ১৭৫৭ অব্দে। পলাশীর যুদ্ধের পর মিরজাফর বাঙ্গালার মসনদে প্রতিষ্ঠিত হন, এবং সিরাজুদ্দৌলা। ১৭৫৬ ও ১৭৫৭ সালে কলকাতা লুণ্ঠন করায় তত্রত্য বণিকগণের ও অপরাপর অধিবাসীদিগের যে ক্ষতি হইয়াছিল, তাহার পরি- পূরণার্থ সন্ধির নিয়মানুসারে প্রচুর অর্থ প্রদান করেন! তাহাতে ইংরেজরা ৫,০০,০০০ পাউণ্ড, হিন্দু ও মুসলমানগণ ২,০০, ০০ পাউণ্ড, এবং অর্ম্মাণীরা ৭০,০০০ পাউণ্ড ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রাপ্ত হন। এই সম হইতে কলিকাতার ইতিহাস সবিশেষ কৌতুক বহ হইয়া উঠে। তদবধি নগরের শ্রীবৃদ্ধি বেশ সমানভাবে ও অব্যাহতরূপে চলিয়া আসিতেছে। যে জলাময় স্থান এক সময়ে নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ ও বন্যপশুর আবাসস্থল ছিল, তাহাই বর্তমানে বহু রাজপথসঙ্কুস সুন্দর ‘স্থানে পরিণত হইল। পুরাতন কেল্লা পরিত্যক্ত হইল, এবং তাহার স্থানে ‘কষ্টম হাউস’ ও অন্যান্য সরকারী অট্টালিকা নিষ্মিত হইল। ক্লাইভের অভিপ্রায়মত বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নিম্মিত হইল। ইংরেজরা প্রথমে বর্তমান ডালহাউসি স্কোয়ার হইতে টাঁকশাল পর্য্যন্ত নগরের এই মধ্য অংশে বাস করিতেন, তাহারা এক্ষণে তথা হইতে ক্রমে ক্রমে উঠিয়া চৌরঙ্গি ও তনিকটবর্তী স্থানে যাইয়া বাস করিতে লাগিলেন, এবং দেশীয় অধিবাসীরা গোবিন্দপুর ও তৎসন্নিহিত গ্রামসমুহ (যে স্থানে বর্তমান দুর্গ নির্মিত হইয়াছে) হইতে নগরের উত্ত রাংশে উঠিয়া গেলেন।

  1. শাঙ্গোড্রা সুবিখাত 'জিলাব্লান’ নামক উপন্যাসের একটি চরিত্র— জন প্রসিদ্ধ ডাকাররূপে চিত্রিত; রক্তমোক্ষণই তাঁর একমাত্র চিকিৎসা প্রণালী।
  2. সাধারণের হিতকর কার্য্যের নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহের প্রথা ১৭৯৩ অব্দে প্রথম প্রবর্তিত হয়। উক্ত বৎসরের বঙ্গীয় লটারি কমিশনারগণ লটারি দ্বারা যে অর্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা প্রথমে দেশীয়দিগের হাসপাতালের কমিটির হস্তে অৰ্পণ করিতে চাহেন, কিন্তু ঐ কমিটি তাহা গ্রহণ করিতে অসম্মত হওয়ায় পরে সেই অর্থ ঋণ পরিশোধে অসমর্থ (দেউলিয়া) অধমর্ণদিগের উদ্ধারসাধন কল্পে অর্পিত হয়। প্রথমবার প্রতি টিকিট ৩২ টাকা দরে ১০,০০০ টিকিট বিক্রীত হয়। লটারির ব্যয় নির্বাহার্থ শতকরা ২ টাকা এবং লোকহিতকর ও দাতব্য কার্যের নিমিত্ত শতকরা ১০ টাকা কাটিয়া রাখার পর অবশিষ্ট সমস্ত টাকাই পুরস্কার বিতরণে বায়িত হইয়াছিল। ১৮০৫ সালে ১০০০ টাকা করিয়া ৫,০০০ টিকিট বিক্রয় করা হয়। তৎকালে যত টাকা উঠিয়াছিল, তাহার শতকরা ১০ টাকা টাউনহলের নিমিত্ত ও শতকরা ২ টা ব্যয়নিৰ্বা- হার্থ লওয়া হইয়াছিল। ১৮০৬ সালে সাড়ে সাত লক্ষ টাকার লটারি খেলা হইয়াছিল; এবং অনেক দিন পর্যন্ত এইরূপ চলিয়াছিল। লর্ড ওয়েলসলি শহরের উন্নতি সাধনার্থ যে কমিটি স্থাপন করেন, সেই কমিটির অস্তিত্ব যত দিন ছিল, তত দিন লটারি দ্বারা লব্ধ অর্থ সেই কমিটির হস্তে অর্পণ করা হইত। লটারি দ্বারা সংগৃহীত অর্থে ১৮০৫ হইতে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত বহু প্রয়োজনীয় ও কি কার্য্য সাধিত হয়। স্বয়ং গভর্ণর জেনারেল এই সকল লটারি ‘পেট্রন’ (পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। লটারির টাকায় কয়েকটী বড় বড় পুষ্করিণী ও বেলেঘাটা খাল খনন করা হয় এবং টাউনহল ও ইলিয়ট রোড প্রভৃতি কয়েকটা প্রশস্ত রাজপথ নির্মিত হয়। শহরের উন্নতি সাধনকল্পে লটারির লাভ হইতে অন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়াছিল। ১৮১৭ সালে কাউন্সিলের ভাই প্রেসিডেণ্ট (সহ-সভাপতি) সুপ্রসিদ্ধ লটারি কমিটি প্রতিষ্ঠিত করেন। উক্ত কমিটি ভূতপূৰ্ব ১৭টি লটারির উদবৃত্ত সাড়ে চারি লক্ষ টাকা স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এই কমিটি ১৮৩৬ অব্দ পর্যন্ত ২০ বৎসর কাল এক কনসার্ভেন্সি (রাস্তাঘাট প্রভৃতির অক্ষুন্ন অবস্থায় রক্ষাবিধান কার্য) ব্যতীত সহরের আর সমস্ত বিষয়েই তত্ত্বাবধান করিতেন। কনসার্ভেন্সি বিভাগটা পূর্ব্বের ন্যায় ম্যাজিষ্ট্রেটগণের হস্তেই ছিল। ১৮৩৬ সালে লটারি-প্রথা বিলুপ্ত হয়। দেখা যাইতেছে যে, এই কমিটির কল্যাণে রাস্তায় জল দেওয়ায় প্রথা প্রথম প্রবর্ত্তিত হয়। ১৮১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখের কলিকাতা গেজেটে এ সম্বন্ধে এইরূপ লিখিত হইয়াছিল;—
     “ধর্ম্মতলায় কোণ হইতে চৌরঙ্গী থিয়েটার পর্য্যন্ত রাস্তায় জল দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় চৌরঙ্গিবাসীদিগের সুখস্বচ্ছন্দতা বর্দ্ধনের যথেষ্ট সুবিধা হইয়াছে, ইহাতে আমরা সাতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি।”
     “লটারি কমিটি যে সকল শ্রীবৃদ্ধিকর ও লোকহিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিইয়াছিলেন, তাহার সবিস্তার বর্ণনা পাঠকের বিরক্তিকর হইতে পারে। আর এস্থলে কেবল অপেক্ষাকৃত প্রধান কয়েকটির উল্লেখ করিব। সত্য কথা বলিতে হইলে বলিতে হয় যে, লটারি কমিটির যত্নে ও তত্ত্বাবধানে শৃঙ্খলাশূন্য কলিকাতাকে পুনর্গঠিত করিয়া আধুনিক শহরসমুহের ন্যায় সুশৃঙ্খল আকারে পরিণত করিবার কার্য্য কেবল যে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল তাহা নহে, প্রত্যুত ঐ কার্য্য সতেজে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিল যে সুন্দর সুপ্রশস্ত রাজপথ কলিকাতাকে উত্তর দক্ষিণে ভেদ করিয়া বরাবর সরল রেখাক্রমে বিস্তৃত হইয়াছে —কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট, কলেজ ষ্ট্রীট, ওয়েলিংটন ষ্ট্রীট, ওয়েলেসলি ষ্ট্রীট, ও উড ষ্ট্রীট, যাহার এক একটি খণ্ডের নাম মাত্র, সেই সুন্দর রাস্তাটী, এবং সেই রাস্তার পার্শ্বে স্থানে স্থানে অবস্থিত কর্ণওয়ালিস স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার, ওয়েলিংটন স্কোয়ার ও ওয়েলেসলিস্কোয়ার নামক পুষ্করিণী মধ্যস্থ প্রমোদোদ্যানগুলি উক্ত কমিটির কলাণই নির্ম্মিত হইয়াছিল। ফ্রীস্কুল ষ্ট্রীট, কীড স্ট্রীট, হেষ্টীংশ ষ্ট্রীট, ক্রীক রো, ম্যাঙ্গো লেন, বেণ্টিং স্ট্রীট, প্রভৃতি রাস্তাগুলিও কমিটি উন্মুক্ত করিয়া সৱল করেন এবং তাহাদের বিস্তার বর্ধিত করেন। কমিটি বড় বড় রাস্তা ও ছোট পাদচরণপথের নির্মাণ এবং পুষ্করিণীসমুহের খনন ও তৎপার্শ্বে ইষ্টবরেচিত অনুচ্চ স্তম্ভবৃতির নির্মাণ দ্বারা ময়দানের শ্রীবৃদ্ধিসাধন করেন। ষ্ট্রাণ্ডরোডও কমিটি কর্তৃক নির্মিত হয়। কমিটি কলুটোল ষ্ট্রীটর আমহার্টস্ট স্ট্রীট, ও মির্জাপুর স্ট্রীট এই তিনটি বাস্তৱ জরিপ ও স্থান নির্ণয়াদি করিয়া ঠিকঠাক করিয়া দিয়ছিলেন এবং মির্জাপুর ট্যাংক ও সুরতিবাগান ট্যাঙ্ক নামক দুইটী পুষ্করিণী ও শার্টের বাজারের কয়েকটা পুষ্করিণীও খনন করিয়াছিলেন। মুক্তি লা. রি-কমিটি কয়েকটি রাস্তা পাকা কমিয়া বাঁধাইয়া দিয়াছিলেন ও অনেকগুলি রাস্তায় জল দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। রাস্তায় জল দিবার। চাঁদপালের ঘাটে একটা কলও স্থাপিত হইয়াছিল।