কলিকাতার ইতিহাস/পঞ্চম অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়।

কলিকাতার ভূবৃত্তান্ত ও অধিবাসী।

 পূর্বে যাহা বলা হইল, তাহা হইতে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, প্রথম প্রথম যে সকল মহাপুরুষ এদেশের শাসনভার প্রাপ্ত হইতেন, তাঁহারা যে নগরের মিউনিসিপাল ব্যাপারে কেবল নিজের ব্যক্তিগতভাবে যত্ন প্রকাশ করিতেন তাহা নহে, প্রত্যুত তাঁহারাই ইহার সর্ব্বময় কর্তা ছিলেন। যে প্রজাদের স্বার্থ এই মিউনিসিপ্যাল ব্যাপারের সহিত বিশেষ ভাবে বিজড়িত, সেই প্রজাদিগের এ বিষয়ে কোনও হাতই ছিল না। পরন্তু ইংরেজের ন্যায় জ্ঞানালোক প্রাপ্ত ও উদারহৃদয় রাজার পক্ষে চিরদিন প্রকৃতিবর্গকে তাহাদের স্বার্থ-সংসৃষ্ট নগরের পৌর-শাসনকার্যের তত্ত্বাবধানরূপ ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা কখনই সম্ভবপর নয়। সেইজন্যই আমরা দেখিতে পাই যে, মিউনিসিপাল-শাসন মেয়র ও য়্যালডারম্যানদিগের হস্ত হইতে ক্রমে ক্রমে জষ্টিস্ অব দি পীস্ আখ্যাধারী ব্যক্তিগণের হস্তে চলিয়া গিয়াছিল; কিন্তু এই শেষোক্ত ব্যক্তি দিগের প্রধান কার্য্য ছিল-রাস্তাগুলি মেরামত করা ও পরিষ্কার রাখা। এক্ষণে ইহা অবশ্য সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, কলিকাতার দ্রুত ক্রমোন্নতির সহিত নগরের মিউনিসিপাল কার্য্যও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, অথচ জষ্টিসদিগের হতে যে সামান্য ক্ষমতা ও কার্য্যভার অর্পিত হইয়াছিল, তাহাতে কাজের বড়ই অসুবিধা হইতে লাগিল। অবশেষে গবর্ণমেণ্ট প্রজাদিগকে মিউনিসিপাল শাসন-ব্যাপারে অধিকন্তু ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার সুযোগ প্রদান করিলেন। পূর্ম্মেই বলা হইয়াছে, বাঙ্গালার লেফটেন্যাণ্ট গভর্ণর সার রিচার্ড টেম্পলের শাসনক লে প্রজাদিগকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা প্রদত্ত হইল; দেব গবর্নমেই কেবল মিউনিসিপালিটীর কার্যের প্রতি সস্টক দৃষ্টি রাখিয়া তাহার তত্বাবধান করিতে লাগিলেন। অতঃপর স্বত্তশাসনবিষয়ক রাজ- বিধি সময়ে সময়ে সংশোধিত হইয়াছে, এবং সে পক্ষে যেমন মিউনিসিপালির হস্ত হইতে পুলিসের ভার তুলিয়া লওয়া হইয়াছে, অপর পক্ষে তেমনই অন্যান্য ক্ষমতা ও কার্যভার অর্পিত হইয়াছে। লেফটেনাণ্ট গভর্ণর সার আলেকজাণ্ডার ম্যাকেঞ্জির সময়ে উক্ত রাজৰিধির সংশোধনার্থ একটী পাণ্ডুলিপি উপস্থাপিত হইয়াছিল; তাঁহার উত্তরাধিকারী সারজন উডরণের শাসন গবর্ণ- মেণ্টের অনুমোদিত হইয়া আই্নরূপে পরিণত হইয়াছে। আইনটি বিধিবদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় জনসাধরণ নিতান্ত মর্ম্মাহত হইয়াছে, কারণ তাহাদের বিশ্বাস এই যে, উহা দ্বারা স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন- ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করা হইয়াছে। তাহদের প্রতিবাদ, আবেদন প্রভৃতি সমস্তই অরণ্যে রোদন হইয়াছে।

  জব চার্ণক সাহেব ১৬১০ অব্দে ঘোষণাপত্র প্রচার করিয়া সকল জাতিকেই কোম্পানির জমিদারিতে, অর্থাৎ সূতানুটী, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর এই তিনখানি গ্রামে বাস করিবার জন্য আহ্বান করেন। এই নূতন স্থান আসিয়া বাস করিতে তাহাদের প্রবৃত্তি জমাইবার জন্ধ তাহাদিগকে কর.দি অনেক বিষয় হইতে অব্যাহতি ও নানাপ্রকার সুবোগ-সুবিধা প্রদান করিতে চাহেন। অতঃপর পর্তুগীজ, জাৰ্মানী, গ্রীক, ইহুদী, হিন্দু, মুসলমান ও অন্যান্য জাতীয় লোক ক্রমে ক্রমে আসিতে লাগিল। এম, জে, শেঠ দর্শক; ভারতীয় আর্ম্মনীদিগের ইতিহাসে লিখিছেন যে, জব চার্ণক সাহেবের ১৬৯০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা স্থাপনের পূর্বেও আম্মা্নীরা সূতানূটী গ্রামে একটি ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক উপনিবেশ স্থাপন করিয়া- ছিলেন। আম্মানীরা কোন্ সময়ে প্রথম কলিকাতায় আগমন করেন, শেঠ সাহেব তাহার নির্দেশ করেন নাই, কিন্তু তিনি সংপ্রতি একটা ক্ষোদিত গিরি অস্কার করিয়াছেন; ঐ লিপিটা কলি- কাতাস্থ শর্ম্মানীদিগের গোরস্থানে সমাহিত একটী আর্ম্মানী-মহিলার কবরের উপরিস্থ সাধিপ্রস্তুর ক্ষোদিত; উহার ভাষা আম্মানী এবং উহার তারিখ ১৬০০ খৃষ্টাব্দের ১১ই জুলাই। শেঠ সাহেব আপনার পুস্তকের চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করছেন যে, চা্ররণক এই মৃত্তিকায় পদার্পন করিবার বহু পুৰ্বে আর্ম্মানীরা এখানে বাণিজ্য করিতেন এবং সে সময়ে সূতানুটী পণ্য দ্রব্যের একটী প্রধান বাজার বলিয়া বিখ্যাত ছিল। উক্ত লেখক আরও বলেন যে, চার্লক সাহেবের আমন্ত্রণানুসারে পর্তুগীজ এবং আম্মানীর চুঁচুড়া হইতে আগমন করেন। আর্ম্মানীরা এই স্থানে বসবাস করিয়া ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ১"৮৮ অব্দের সনন্দ দ্বারা প্রদত্ত অধিকার সমূহ উপভোগ করিতে থাকেন। ষ্টার্ক সাহেব বলেন-“অনেকে তাঁহার আমন্ত্রণর স্বীকার করিয়াছিলেন এবং উপনিবেশের উত্তর প্রান্তে সমবেত হইয়াছিলেন। আর্ম্মানীঘাট ও আর্ম্মানী ষ্ট্রীট, এই নাম দুটী অদ্যাপি এই ব্যাপারের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। এই স্থানে থাকিয়া তাহারা ইংরেজদিগের যারপর নাই উপকার করিয়া ছিলেন; তাহাদিগকে মধ্যবর্তী করিয়া, তবে ইংরেজেয়া দেশীয় বাজারের লোকের সহিত ক্রয় বিক্রয় করিতে সমর্থ হইতেন।  ইংরেজ নাগরিকের তাবৎ অধিকার উপভোগ করিতেন, এবং তাহাদের মধ্যে ধনাঢ্য ও প্রভাবসম্পন্ন হইয়া মর্যাদাশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন।”

 এই উৎসা শীল উদ্যগী জাতি খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ- ভাঙ্গে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। মোগল-রাজ ভার ঐশ্বর্যা- ড়ম্বরশনে প্রলুব্ধ হইয়া এ দেশের ঐশ্বর্যের অংশভাগী হইবার আশায় কতকগুলি নব নুরাগসম্পন্ন আর্ম্মানী স্বদেশ হইতে এতদ্দেশে আসিয়া উপস্থিত হন যৎকালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ১৬০১ খৃষ্টব্দে ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন, তৎকালে আৰ্মানীদিগের বাণিজ্য খুব বিস্তৃতভাবে চলিতেছিল। ইংরেজরা ১৬১২ অব্দের জানুয়ারী মাসে সম্রাট জাহঙ্গীরের নিকট সনদ প্রাপ্ত হইলে আৰ্মানীরা তাঁহাদের পরম সুহদ ও সহায় হইলেন। পাদরি লঙ সাহেব অর্ম্মাদিগের সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন;— “আর্ম্মনীদিগের মধ্যে কেহ কেহ পারস্য উপসাগর দিয়া ভারত- বর্ষে আসিলেন; আবার কেহ কেহ খোরাসান, কান্দাহার ও কাবুল হইয়া দিল্লীতে উপস্থিত হইলেন। বৈদেশিকদিগের মধ্যে তাহারাই প্রথম বসতি স্থাপন করেন, এবং ক্রমে ক্রমে গুজ- রাট ও সুরাট হইতে বারাণসী ও বিহারে আগমন করেন। ১৬২৫ অব্দে ওলন্দাজের চুচুড়ায় উপনিবেশ স্থাপন করিলে পর আম্মানীরা তথায় বসবাস করতে আরম্ভ করেন। পরে ১৬৯০ অব্দে কলিকাতা স্থাপিত হইলে এবং গভর্ণর চর্ণক তথায় বাস করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিলে অর্ম্মনীর পর্তুগীজদিগের ন্যায় সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠেন; সেই জন্যই ১৭৫৭ অব্দে তারা ক্ষতিপূরণস্বরূপ সাত লক্ষ টাকা প্রাপ্ত হন। তাঁহারাই মধ্য এসিয়ায় বাণিজ্যের পথপ্রদর্শক; উক্ত বাণিজ্যের এখনও অনেক বাকী,ভবিষ্যতে উহার বিস্তর আশা ভরসা আছে।”

 গ্রীকজাতি ১৭৫০ অব্দে বা তৎসমকালে কলিকাতায় আগমন করেন।

 ভারতবর্ষে পর্ত্ত গীজ জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল, এক্ষণে তাহাই দেখা যাউক। হ্যামিল্টন সাহেব বলেন, এক সময়ে পর্তুগীজদিগের ভাষা এরূপ প্রভাবসম্পন্ন হইয়া উঠিয়ছিল যে, ইউরোপীয়দিগের মধ্যে অধিকাংশ লোকই পরস্পরের সহিত সাধারণভাবে কথোপকথনের ক্ষমতা লাভ করিবার নিমিত্ত পর্ত্তুগীজ ভাষা শিক্ষা করিতেন। উহা তৎকালে ভারতবর্ষের lingua frauck[] হইয়া উঠিয়াছিল। ইউরোপীয়দিগের মধ্যে পর্ত্তুগীজরাই সর্ব্বপ্রথমে ভারতবর্ষে আসিবার চেষ্টা করে এবং তাহাতে কৃতকার্য হয়। কলম্বস ভারতবর্ষে আসিবার অভিপ্রায়েই পর্ত্তুগিজ হইতে যাত্রা করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি ভারতের পরিবর্তে আমেরিকায় যাইয়া উপস্থিত হন। তাহার পাঁচ বৎসর পরে, ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে, ভাস্কো ডা গামা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘূরিয়া কালিকিটে আগমন করেন। কিন্তু তাঁহার পূর্ব্বে আর একজন পর্ত্তুগীজ কালিকটে আসিয়াছিলেন। তাহার নাম কভিলহাম। তিনি ১৪৮৭ অব্দে স্থলপথে আসিয়াছিলেন। আরবেরা নবাগতের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা প্রকাশ করিতে লাগিল। দিল্লীর সিংহাসনে তৎকলে লোডিবংশীয় একজন পাঠানসম্রাট প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বাঙ্গালার শাসনকর্তাও পাঠানজাতীয় ছিলেন। দক্ষিণ ভারতবর্ষ কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দক্ষিণাঞ্চলে বিজয়নগরের হিন্দুরাজাই সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ভূপতি ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের একপ্রকার মণ্ডলেশ্বর ছিলেন, এবং তাহার ক্ষমতা তৎকালে দিল্লিশ্বরের ক্ষমতা অপেক্ষাও অধিক ছিল।

 ভাস্কো ডা গামা মালাবার উপকূলে কয়েক মাস থাকিয়া জামোরিন উপাধিধারী কালিকটরাজের নিকট হইতে এক পত্র লইয়া স্বদেশে প্রবৃত্ত হলেন, এবং কলম্বাসের ন্যায় তিনিও মহাসমাদরে ও আড়ম্বরে অত্যথিত হইলেন। পর্ত্তুগীজবাসীরা অদম্য উৎসাহ উদ্দীপিত হইয়া উঠিল। পর্ত্তুগীজেরা তৎকালে কেবল সামান্য বণিক ছিল না; ধন বা খ্যাতি অর্জনের নিমিত অথবা বাহাদুরি দেখাইবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ তাহাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না,পরন্তু তাহারা পৌত্তলিকদিগকে খৃষ্টান করিয়া চতুর্দিকে খৃষ্টধর্ম প্রচারের পবিত্র ব্রতে দীক্ষিত হইয়াছিল। ১৫০৭ খৃষ্টাব্দে ক্যাব্রাল নামক এক ব্যক্তি অক্ষিতাধীন কয়েক খানি জাহাজ সে কজন সহিত প্রেরিত হইল। ইহাদের উপর আদেশ ছিল যে, ইহারা প্রথমে উপদেশ প্রদান করিয়া ধর্ম্ম প্রচারের চেষ্টা করিবে, কিন্তু হতে যদি উদ্দ্যেশ্যসিদ্ধি না হয়, তাহা হইলে তরবারি প্রয়োগ করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। ইতোমধ্যে পর্ত্তুগালের রাজা ১৫০২ অব্দে পোপের নিকট হইতে সে সনদ প্রাপ্ত হইলেন, তদ্দ্বারা পোপ তাঁহাকে সমুদ্রে নৌচালন, দিগ্বিজয় এবং ইথিওপিয়া, আরব, পারস্য ও ভারতবর্ষে বাণিজ্যের সর্ব্বময় প্রভুপদে বরণ করিলেন। এদিকে ক্যাব্রাল নানাপ্রকার ভাগ্যবিপর্যয়ের পর কালিকট ও কোচিনে কুঠি স্থাপন করিলেন। ১৫০২ অব্দে ভাস্কোডা-গামা কয়েকখানি জাহাজ লইয়া পুনর্বার প্রাচ্য ভূখণ্ডে আগমন করেন, এবং যে সকল রাজ্য ও জাতি প্রথম বারে উঁহার প্রতি সৌহৃদ্য ও অনুকূলভাব প্রদর্শন করিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কত গুলির সহিত তিনি যুদ্ধ করেন। অবশেষে ১৫০৫ অব্দে নৌসেনাধ্যক্ষ ফ্রানসিস্কো ডি আলডামা অনেক গুলি রণপোত ও বহুসংখ্যক সৈন্যসহ প্রেরিত হন। তিনি ভারতে প্রথম পর্তুগীজ গভর্ণর ও রাজপ্রতিনিধি বলিয়া পরিচিত।

 তাঁহার পর সুপ্রসিদ্ধ আবুকার্ক ১৫০৯ অব্দে পর্ত্তুগীজদিগের গভর্ণর হন। এই ব্যক্তি প্রকৃত খৃষ্টানের ন্যায় দেশীয়দিগের প্রতি সৌজন্য প্রকাশ ও সদয় ব্যবহার করিয়া তাহাদের এতদূর বিশ্বাস ও অনুরাগভাজন হইয়াছিলেন যে, তাহারা মুসলমানদিগের অপেক্ষা পর্তুগীজদিগের শাসনাধীনে বাস করা শ্রেয়স্কর জ্ঞান করিতে, লাগিল। পাদরি লঙ, সাহেব বলেন, ১৫০০ অব্দে পোর্ত্তুগিজদের গৌড়েশ্বরের অধীনে বেতন-ভাগী বৈদেশিকরূপে বঙ্গদেশে প্রথম উপস্থিত হয়, এবং তৎপরে দেশীয় রাজন্যবর্গের এক প্রকার শরীর-রক্ষা সৈন্যরূপে কার্য্য করিতে থাকে। কিন্তু চিরদিন কাহাও সমান যায় না। স্পেনায়ীরা ক্রমে মাথা তুলিয়া উঠায় পর্তুগীজদিগের পতনের সুত্রপাত হইল। ১৫৩০ অব্দে স্পেনপতি দ্বিতীঃ ফিলিপ পর্ত্তুগালের, রাজমুকুট প্রাপ্ত হলেন এবং তদবধি পর্তুগালের স্বার্থ স্পেনের স্বার্থের অধীন হইয়া পড়িল। ইতোমধ্যে। ওলন্দাজ ও ইংরেজজাতি প্রাচ্য ভূখণ্ডে আসিয়া দর্শন দিলেন। অতঃপঃ ১৬৪০ অব্দ পর্তুগাল স্পেন হইতে বিচ্ছিন্ন হইল বটে, কিন্তু উহা আর পুর্ব্বের ন্যায় মাখা তুলিতে পারে নাই। সার, উইলিয়ম হণ্টার বলেন, ১৫০০ হইতে ১৬০০ অব্দ পর্যন্ত ঠিক এক শতাব্দকাল পর্ত্তুগীজরা প্রাচ্য বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার উপভোগ করিয়াছিল। জাপান ও স্পাইন দ্বীপপুঞ্জ হইতে লোহিত সাগর ও উত্তমাশা অন্তরীপ পর্যন্ত তাহারাই প্রাচ্য ধনরত্নের একমাত্র স্বামী ও বিধাতা ছিল; ওদিকে আবার আফ্রিকায় আটলাণ্টিক মহাসাগরের উপকূলস্থ ও ব্রাজিল দেশস্থ অধিকারগুলি তাহাদের সামুদ্রিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাহাদের অধঃপতনের কারণ সম্বন্ধে সার উইলিয়াস হুণ্টার এইরূপ লিখিয়াছেনঃ-

 “পরন্তু এরূপ সম্রাজ্য রক্ষা করিতে হইলে যাদৃশ রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিগত চরিত্রব থাকা অশ্যক, পর্ত্তুগিজদিগের তাহার কিছুই ছিল না। স্বদেশ মুরগিদের সহিত সংগ্রামে তাহাদের জাতীয় চরিত্র গঠিত হইয়াছিল। তাহারা প্রকৃতপক্ষে পণ্যজীবী বণিক ছিল না; তাহার অবমানান্বেষী বীর ও ধর্মযোদ্ধা ছিল এবং অন্য ধর্মাবলম্বিমাত্রকেই পর্তুগালের ও খৃষ্টে শত্রু জ্ঞান করিত। তাহাদের পূর্ব্বে ভারতীয় ইতিহাস কিরূপ ঘোর ভ্রমান্ধতাপূর্ণ কুসংস্কার ও নিষ্ঠুতায় কলঙ্কিত, তাই যাঁঁহারা তাহাদর তৎকালীন দিগ্বিজয়ের বিবরণ পাঠ না করিয়াছে, তাহারা উপলব্ধি করিতে পারিবেন না। ••••••••• পর্ত্তুগীজেরা কোনও কালই কোম্পানি স্থাপনের চেষ্টা করে নাই, তাহারা তাদের প্রাচ্য বাণিজ্য রাজকীয় অবদান ও একচেটিয়া অধিকারস্বরূপে রক্ষা করিত।” ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিম উপকূলস্থ গোয়া, ডমন ও ডিউ কেবল এই তিনটী স্থান এক্ষণে পর্তুগীজদিগের অধিকারে আছে। আর পর্ত্তুগীজ জাতি হতে উৎপন্ন ফিরিঙ্গি নামক সঙ্কর জাতি ক্যানিং ষ্ট্রীটি বা মুরগীহাটা ও চিনাবাজার অঞ্চলেই বাস করে। ইহাদের অধঃপতনের কথা ভাবিলে মন বিষাদসাগরে নিমগ্ন হয়। ইংরেজরা কলিকাতায় বসতি স্থাপন করলে ইহারা কেরাণীর কাজ করিত, কিন্তু ইহারা আপনাদের কর্ত্তব্যকর্ম্ম এমন জঘন্যভাবে সম্পাদন করিত যে, ডিরেক্টর সভা তাহার যথেষ্ট নিন্দা করিতে বাধ্য হন। ইহারা খানসামা ও গোলাম রূপে নিযুক্ত হইত। ইহাদের মধ্যে অনেকে দস্যুতা ও বোম্বটেগিরি ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছিল। সেই অধঃপতনের দিনে উহারা ভবঘুরে ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইত এবং শান্তিপ্রিয় নিরীহ লোকদিগকে ধরিয়া লইয়া যাইয়া অন্য দেশে বিক্রয় করিত। উহাদের স্ত্রীলোকেরা এক্ষণে সুসভ্যা ইংরেজমহিলাদিগের আয়া হইয়া তাঁহাদের সেবা করিতেছে। লোকে বলে, যেJanala (জানালা) Caste (জাতি), Ormyound (অঙ্গন) প্রভৃতি কথাগুলি পর্ত্তুগীজ ভাষা হইতে উৎপন্ন অথবা তাহাদের দ্বারা প্রবর্ত্তিত।

 বাবু রামকমল সেনের মতে ইংরেজরা ১৬২০ খৃষ্টাব্দে বা তৎসমকালে বাঙ্গালায় প্রথম আগমন করেন। তাঁহারা তাঁহাদের প্রথম বসতিস্থান গোবিন্দপুর ও সূতানুটীতে উপস্থিত হইলে, দেশী লোকেরা তাঁহাদের কথা বুঝিতে পারত না বলিয়া তাঁহাদের নিকট যাইতে সাহস পাইত না, কাজকর্ম্ম অনেকটা অঙ্গভঙ্গিতে ও সঙ্কেত ইশারায় সম্পন্ন হইত। বসাক বা শেঠেরা সে সময়ে বড় বংশ বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন; তাঁহারা নানাপ্রকার খুচরা কাপড়চোপড়ের কারবার করতেন। ইংরেজরা তাঁহাদিগকে একজন দু-বাস (অর্থাৎ দোভাষী) পঠাইয়া দিতে বলেন, কারণ এই শ্রেণীর লোক দ্বারা মান্দ্রাজে বেশ কাজ চলিয়াছিল। বসাকেরা ইংরেজদিগের কথার প্রকৃত মর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া মনে করিলেন, ইংরেজরা বুঝি কাপড় কাচাইবার জন্য ধোপা চাহিতেছেন; তদনুসারে তাহারা কয়েকজন রঞ্জককে পাঠাইয়া দিলেন। ঐ সকল ধোপা সর্বদা ইংরেজদিগের নিকটে থাকিয়া এবং তাঁহাদের কথা শুনিয়া কঁহাদের ভাষা কতক কতক বুঝিতে লাগিল। কথিত আছে যে, এতদ্দেশদিগের মধ্যে থোপারাই প্রথমে কিছু কিছু ইংরেজী শিথিয়াছিল। রতন সরকার নামক একন এদেশীয় ধোপাকে ইংরেজরা প্রথম দোভাষী নিযুক্ত করেন।

 জব চার্নক নতুন উপনিবেশ স্থাপন করিয়া তাহাতে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় লোক অনাইয়া বাস করাইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি কিছুদিন বাঁচিয়া উহা যেমন জাঁঁকিয়া উঠে, তাহা দেখিয়া যাইতে পারেন নাই, কারণ তিনি তাহার অল্প দিন পরেই ১৩১২ অব্দের জানুয়ারি মাসে, মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি যে স্থানে সমাহিত হইয়াছিল, তাহার উপর এটি সুন্দর সমাধিস্তম্ভ নির্মিত হইয়াছে। ঐ সমাধিস্তম্ভটি অদ্যপি পুর্ব্বতন কালেক্টরী কাছারির ঠিক সম্মুখস্থ পুরাতন সেণ্ট জনস ক্যাথিড্রাল নামক গির্জ্জার প্রাঙ্গণে বিদ্যমান আছে। পরন্তু ইহা কলিকাত বাসীদিগের পক্ষে বড়ই নিন্দার কথা যে, ঐ সমস্ত ব্যতীত এই মহানগরীর স্থাপয়িতার আর কোনরূপ স্মৃতি নাই।ষ্টার্ণডেল সাহেব বলে, আমাদের ছোট বড় সকল রকম রস্তাতে অপেক্ষাকৃত অনেক সুপ্রসিদ্ধ লোকের নামও অদ্যপি সংযুক্ত রহিয়াছে, কিন্তু এমন একটি রাস্তা, প্রমোদ্বাদ্ব্যান বা স্মৃতিস্মম্ভ নাই, যাহাতে বঙ্গদেশে বৃটিশশক্তি প্রবেশের পথপ্রদর্শক ও কলিকাতার প্রতিষ্ঠাতা  জে, রেইনি সাহেব বলেন-“ব্রস সাহেবের মতে চার্ণক সকলেরই সবিশেষ সম্মানাস্পদ থাকিয়া কালগ্রাসে পতিত হইয়া ছিলেন; আশার অর্ম্মি বলেন যে, তাঁহার সামরিক অভিজ্ঞ কিছুমাত্র ছিল না বটে, কিন্তু সাহস যথেষ্ট ছিল, এবং নবাব এক সময়ে তাহাকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছিলেন ও কশাঘাত করিয়া ছিলেন বলিয়া ষে গবর্ণমেণ্টের হস্তে তিনি নিজে এই রূপ লাঞ্ছিত ও অবমানিত হইয়াছিলেন, সে গবর্ণমেটকে উপযুক্ত প্রতিষল দির জন্য সর্ব্বদা অধৈর্য্য প্রকাশ করিতেন। এবং যে সার জন গোল্ডসবরো ১৭৯০ কে কমিসারি জেনারেল হইয়া আসিয়াছিলেন, তিনি চার্ণককে অবস্থিতচিত্ত ও শ্রমকাতর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। “

 চার্ণক সাহেবের জীবনের একটা ঘটনা কিঞ্চিৎ বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। ১৬৭৮ সালে একদা চার্ণক সাহেব হুগলি নগরে নদীর ধারে বেড়াইতেছিলেন, এমন সময়ে দেখিতে শইলেন যে, একটা পরমসুন্দরী হিন্দু বিধবা মহাড়ম্বরে বেশভূষা পরিধা করিয়া তাহার বৃদ্ধ পতির চিতায় অনুমৃতা হইবার জন্য শ্মশানাভিমুখে যাইতেছে, কিন্তু বোধ হইল যেন সে নিজে আত্মবিসর্জন করিতে ইচ্ছুক নয়। কোমল হৃদয় চার্ণক তাহার সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হইলেন, এবং কয়েকজনের সাহায্যে তাহাকে উদ্ধার করিয়ানি বাটীতে লইয়া গেলেন। অতঃপর যুবতী তাঁহার পত্নী হইল। তাহার গর্ভে সাহেবের কয়েকটি সন্তানও জন্মিয়াছিল। স্ত্রীলোকটা মৃত্যুমুখে পতিত হইলে, তাহার মৃতদেহ সেণ্ট গির্জার প্রাঙ্গণে সাহেবের পারিবারিক সমাধিস্থানেই গোর দেওয়া হইয়াছিল। কাপ্তেন হ্যামিল্টন বলেন, তাহার স্বামী প্রতি বৎসর তাহার মৃত্যুর দিবস ঐ স্থানে একটি করিয়া মুরগী জবাই করিতেন।”[]

 ১৭৪২ হইতে ১৭৫২ অব্দ পর্যন্ত এই কয়েক বৎসরে নগরে দেয়দিগের বাড়ীর সংখ্যা অতি দ্রুতগতিতে বাড়িয়া উঠিয়াছিল। বাড়ীগুলি কাঁচা পাকা দুই প্রকারই ছিল বটে, কিন্তু তাহাদের অধিকাংশই কাঁচা, এবং সেগুলি ইউরাপীয় সহরের বহির্ভাগে অথচ মার্হ-টা-খাতের অন্তর্ভাগে নির্ম্মিত হইছিল। ইহাই ঐ কয়েক বৎসরের নগরে প্রান উন্নতি। ১৭৫৬ অব্দের মাপে তাহা অপেক্ষা অধিক উন্নতি দেখিতে পাওয়া যায়। অনেকগুলি জঙ্গল পরিষ্কৃত হইয়াছে; বেরিনস পয়েণ্ট হইতে লালবাজার রোড পর্যন্ত সমস্ত সরে ইষ্টকালয়ের চিহ্ন অঙ্কিত, এবং ১০৪২ অব্দের মানচিত্রে যেস্থান জঙ্গলময় ছিল, সেখানে এখন লোকালয়ের চিহ্ন অঙ্কিত। আরও দেখা যায় যে, পুষ্পোদ্যান ও ফলোদ্যান নির্মাণের উপযুক্ত জমিসকল চিহ্নিত এবং জল বহুপরিমাণে বিলুপ্ত হইয়াছে। আবার ১৭৪২ অব্দের মানচিত্রে কেবল ১৬টি বড় বড় রাস্তা দেখিতে পাওয়া যায় কিন্তু ১৭৫৬ অব্দের মান চিত্রে জানান ২৭টা বড় বড় রাস্তা এবং ৫২টি অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তা স্পষ্টরূপে চিহ্নিত হইয়াছে। পরন্তু সর্বপ্রধান উন্নতি হইয়াছে পাকা বাড়ীতে। মোটামুটি গণনায় দেখিতে পাওয়া যায়, যেস্থলে কেবল ২১টা ইষ্টকালয় ছিল (তাহাদের মধ্যে ৫টি মাত্র একটু বড় রকমের), সেস্থলে ১৭৫৬ সালের ম্যাপে অন্যূন ২৬৮টি পাকা বাড়ী দেখান হইয়াছে। কুটীরগুলিও দেখান হইয়াছে বটে, কিন্তু সেগুলি সম্বন্ধে তেমন যত্ন বা সাবধানতা অবলম্বিত হয় নাই, এবং অনেক গুলি পরিত্যক্তও হইয়াছে।

 মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুরও ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণকে ও অন্যান্য জাতীয় লোকদিগকে কলিকাতা বাস করাইবার জন্য বিলক্ষণ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি ঐ সকল লোককে জমি দিতেন, বাড়ী করিয়া দিতেন, এং অন্যান্য অনেক প্রকারে তাহাদের সাহায্য করিতেন। সুদূর উড়িষ্যা হইতে আগত ব্রাহ্মণগণকে তিনি কলিকাতার সমাজে পাকরূপে চালাইয়াছিলেন। সে কালে উড়িয়া ব্রাহ্মণের পাক খাওয়া সামাজিক হিসাবে বড় বিপদের কথা ছিল। এখনও এমন অনেক হিন্দু পবিবার আছেন, যাঁঁহারা উড়িয়া ব্রাহ্মণের হাত খান না। উক্ত মহারাজের ন্যায় তাঁহার বংশধরেরাও উড়িয়াদিগের প্রতি অদ্যাপি বিশেষ অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া থাকেন—তাহাদের অনেককে আপনাদের বাড়ীতে বিনা ভাড়ায় থাকিতে দেন। জনৈক লেখক উড়িয়া বেহারাদের বিষয় বর্ণন করিতে করিতে বলিয়াছেন, উহার অতি প্রাচীনকাল হইতে কলিকাতায় আছে, কারণ সে কালে পাল্কিই প্রধান যান ছিল। ১৭৭৬ অব্দে যে হিসাব করা হইয়াছিল, তাহাতে দেখা যায় উহারা শিবিকা বহন করিয়া প্রতি বৎসর তিন লক্ষ টাকা দেশে লইয়া যাইত। অধুনা এই অতি প্রয়োজনীয় শ্রমজীবি শ্রেণীর লোকেরা ইউরোপীয় ও দেশীয় ধনবানদিগের গৃহে চাকরের কাজে নিযুক্ত হইয়া থাকে। অন্যান্য বিবিধ কাজে উড়িয়ারা দিনমজুরিও করে। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু স্বপ্রণীত বিশ্বকোষ নামক বাঙ্গালা অভিধানে বলিয়াছেন, মহারাজ, নবকৃষ্ণের সময়ে[] কলিকাতায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, তাঁতি, কলু ও অন্যান্য জাতির সর্বশুদ্ধ ৩০০০ ঘর লোকের বাস ছিল।

 আমরা এক্ষণে কলিকাতায় বিভিন্ন অংশের উৎপত্তি ও নামকরণ সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিবার চেষ্টা করিব। জনৈক লেখক বলেন, “সার্কুলার রোডে প্রফুল্লচিত্ত যুবকগণ স্বাস্থ্য-রথে আরোহণ করিয়া, আরামদায়ক সুগন্ধি প্রভাত-সমীরণ সেবন করিত। জনৈক মুসলমানের নাম হইতে ‘আলিপুর” নামটি উৎপন্ন। আলিপুর সেতুর নিকট ‘বিনাশতরু’ নামে অভিহিত দুইটি গাছ ছিল। ঐ বৃক্ষতলে হেষ্টিংস ও ফ্রান্সিস দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরস্পরের প্রতি পিস্তল ছুড়িয়াছিলেন। সার ইলাইজা ইম্পের পার্ক[](প্রমোদ কানন) হইতে পার্ক প্লট নামের উদ্ভব। অপজন সাহেবের ১৭৯৯ সালের কপি, কলিকাতার মানচিত্রে উহা রেরিয়েল গ্রাউণ্ড রোড়, (গোরস্থানের রাস্তা) নামে পরিচিত ছিল। হলওয়েল সাহেব ১৭৫০ অব্দে বলিয়া ছিলেন যে, চৌরঙ্গী রোড কালীঘাট ও ডিহি কলিকাতায় যাইবার রাস্ত; সে সময়ে ঐ স্থানে একটি বাজার বসিত। ১৭৯৪ সালে, উত্তরে ধর্ম্মতলা হইতে দক্ষিণে বৃজিতলা এবং পশ্চিমে সাকুলার রোড হইতে পূর্ব্বে ময়দান পর্যন্ত এই চতুঃসীমার মধ্যে চৌরঙ্গীতে ২৪ টী বাড়ী দেখাইয়াছেন। লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময়ে তিনি চৌরঙ্গীতে অতি নংখ্যক বাড়ীই দেখিয়াছিলেন; তৎকালে কোম্পানীর অধিকারের এক তৃতীয়াংশ জঙ্গলাকীর্ণ ও বন্য পশুর বাসস্থান ছিল।

 ধর্ম্মতলার যেস্থানে এক্ষণে কুক কোম্পানির আস্তাবল (অগশালা) অবস্থিত, ঐ স্থানে পূর্ব্বে একটী বৃহৎ মসজিদ ছিল। মসজিদের জমি ও তৎসন্নিহিত সমস্ত ভূমি ওয়ারেন হেষ্টিংসের জমাদারের জাফর নামক এক ভক্ত মুসলমানের সম্পত্তি ছিল। ঐ মসজদ এক্ষণে নাই, কিন্তু পূর্ব্বে উহা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। যে কারবালা-উৎসব উপলক্ষে সহস্র সহস্র মুসলমান মিলিত হইয়া এক্ষণে সারকুলার রোডে সমবেত হয়, পূর্ব্বে তাহা ঐ মসজিদের নিকট ভূমিতে সমবেত হইত; সুতরাং স্থানটা অতি পবিত্রস্বরূপে বিবেচিত হইত। এই জন্যই এ স্থানের নাম ধর্ম্মতলা হয় এবং উহার নামানুসারে সমস্ত রাস্তাটা ধর্ম্মতলা ষ্ট্রীট নামে খ্যাত হয়।

 গার্ডেন রীচ একটী প্রাচীন স্থান। জেনারেল মার্টিন বলিয়াছেন, ১৭৬০ সালে তথায় ১৫টি বাড়ী ছিল। ‘ সায় উইলিয়াম জোন্স ঐ স্থানে একটী বাঙ্গায় থাকতেন। খিদিরপুরকে ইংরেজীতে 'কিডারপুর' বলে। কর্ণেল কিড নামক একজন সাহেবের নাম হইতে ঐ নামের উৎপত্তি।

 হলওয়েল সাহেবের সময়ে লালবাজার একটা প্রসিদ্ধ বাজার বলিয়া পরিচিত ছিল। বিবি কিণ্ডাসলি বলেন, ১৭৬৮ সালে লালবাজার স্ট্রীট কলিকাতার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট রাস্তা ছিল। তৎ কালে উহা কষ্টম হাউস হইতে বৈঠকখানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

 ১৭৫৭ সালের পূর্ব্বে শোভাবাজার ও পারিয়াঘাটা জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর ঠাকুরগণ ও অন্যান্য প্রাচীন বংশ ঐ সকল স্থান বাসযাগ্য করেন। রাজা নবকৃষ্ণের ষ্ট্রীট নামক রাস্তাটী তিনি নিজ ব্যয়ে নির্মাণ করাইয়া গবর্ণমেণ্টকে অর্পণ করেন। তিনি বেহালা হইতে কুলপি পর্যন্ত ৩২ মাইল দীর্ঘ আর একটী রাস্তাও নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

 টীরেট নামক একজন ফরাসী রাস্তা ও অট্টালিকার সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট অর্থাৎ তত্ত্ববধায়ক ছিলেন। তাঁহারই নামানুসারে ‘টিরেটাবাজার’ নাম হইয়াছে। তিনি ১৭৮৮ সালে বাজার বসান; তৎকালে মাসিক আয় ৩৮০০ টাকা ছিল, এং উহার মূল্য দুই লক্ষ টাকা নির্দ্ধারিত হইয়াছিল। টিরেট সাহেব দেউলিয়া হওয়ায়, তাঁহার বিষয়সম্পত্তি সমস্তই লটারিতে বিক্রীত হইয়া যায়।

 মিশন রো নামক রাস্তাটীর পূর্ব্ব নাম রোপওয়াকু; পরে মিশন চর্চ্চ নামক গির্জার নামানুসারে ঐরূপ নামকরণ হয়। ১৭৫৭ সালের কলিকাতা অবরোধকালে ঐ স্থানে একটী তুমুল যুদ্ধ হইয়াছিল। সেই সময়ে নবাবের সৈন্যরা গির্জ্জাটী ভাঙ্গিয়া ফেলে। পরে ১৭৬৭ অব্দে উহা পুননির্মিত হয় প্রথম প্রোটেষ্টাণ্ট মিশনারি (ধর্ম্মপ্রচারক) কির্ণাণ্ডা ঐ গির্জ্জা নির্মাণ করিয়াছিলেন।

 ওল্ড কোর্ট হাউস(প্রাচীন সভাগৃহ) বা টাউন হলের নামানুসারে ওল্ড-কোর্ট হাউস স্ট্রীটের নামকরণ হইয়াছে। ঐ গৃহটি ১৭২৫-২৭ এই কালমধ্যে কোনও সময়ে বুর্শিয়ার নামক জনৈক বণিক কর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল। উক্ত ব্যক্তি ল সাহেবের পরে ১৭৩৪ অব্দে বোম্বাইয়ের গভর্নর নিযুক্ত হন; গৃহটি প্রথমে এক তল ও চারিটী স্কুল (দাতব্য বিদ্যালয়ের সম্পত্তি ছিল। আবার কেহ কেহ বলেন, ১৭০৭ অব্দে বা তৎসমকালে বুর্শিয়ার সাহেব সাধারণের প্রদত্ত চাঁদার সাহায্যে এই কোর্ট হাউস নির্মাণ করেন, উহার উপরের অংশও চাঁদার টাকায় নির্ম্মিত হয়। ষ্টভোরিনস্ সাহেব ১৭৭০ সালে লিখিয়াছেন;—কোর্ট হাউসের উপরে দুই টী সুন্দর সভাকক্ষ (দরবারগৃহ } আছে। এই দুইটী প্রকোষ্টের একটীতে ফ্রান্সের রাজার এবং পরলোকগতা রাণীর প্রতিমূর্ত্তি সজ্জিত আছে। চিত্রপট দুইটা সজীব মনুষ্যাকারের ন্যায় বৃহদায়তন। ইংরেজেরা যৎকালে চন্দননগর অধিকার করেন, সেই সময়ে ঐ স্থান হতে চিত্রপট দুইটা আনীত হইয়াছিল। ' ১৭৯২ সালে কোর্ট হাউস গবর্মেণ্টের নিকট বিক্রী ও হয়, এবং সেই বংসরেই গবর্ণমেট উহার জীর্ণ অবস্থা দেখিয়া উহা ভূমিসাৎ করিয়া ফেলেন। অর্ম্মি ১৭৫৬ সালে উহার বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন, “গৃহটা একতল হইলেও অতি বিস্তৃতায়তন; উহাতে মেয়রের কাছারি ও দায়রা আদালত বসি।” গৃহটি রূপে প্রাচীন কলিকাতা দাতব্য ভাণ্ডার সম্পত্তি হইয়াছিল, তাহা জানতে পারা যায় নাই।

 বাবু চন্দ্র দাস নামক কলিকাতার একজন কোটিপতি কর্তৃক ‘বাবুঘাট’ নিখিত হইয়াছিল একটা নিম গাছ হইতে নিমতলা ঘাট ষ্ট্রীট নাম হইয়াছে। ক্লাইভ ষ্ট্রীট এক সময় বৃহৎ কারবারের স্থান ছিল। যে স্থানে এক্ষণে ওরিএণ্টাল ব্যাঙ্ক অবস্থিত, ঐ স্থানে লর্ড ক্লাইভের বাড়ী ছিল। বগবাজার (বা বাচবাজার) শ্যাম বাজার, হাটখোলা, জানবাজার, বড়তলা, এই স্থানগুরি নামোল্লেখ ১৭৪৯ সালে দেখিতে পাওয়া যায়। মৎস্যবাজার বা মেচোমাজার বিগত শতাব্দীতে মৎস্যবিক্রয়ের একটা প্রধান স্থান বলিয়া বিখ্যাত ছিল। বড়বাজার কলিকাতার অতি প্রাচীন ইতিবৃত্তে একটী অতি প্রধান বাণিজ্যস্থান বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।

 লোকে বলে, চিৎপুর রোডের পূর্ববর্তী নগরের যে অংশে যে কয়দিগের বাস, তা আধুনিক। দেবী চিত্তেশ্বরীর নামানুসারে চিৎপুর ও তাহা হইতে চিৎপুর বোড় নাম হইয়াছে। চিতোরীর মন্দিয় অদ্যাপি চিৎপুরে বিদ্যমান আছে। প্রাচীনকালে ঐ স্থানে নরবলি হইত। দেশীয় সকল শ্রেণীর লোকেরই দৃঢ় বিশ্বাস যে, চিত্তেশ্বরী জাগ্রত দেবতা; এজন্য অদ্যাপি অনেকে আপন আপন মনস্কামনাসিদ্ধির নিমিত্ত চিত্তেশ্বরীর নিকট নানাপ্রার মানসিক করে ও পূজা দেয়। কলিকাতার মধ্যে এই রাস্তাটীই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং কালীঘাট হইতে মুর্শিদাবাদ পর্যন্তু যে রাস্তা বিস্তৃত হইয়াছে, তাহারই এক অংশ।

 ১৭৪২ অব্দে সিমলা ও মির্জাপুরের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই দুটি স্থান ধানক্ষেত ও পচ পুকুরে আচ্ছন্ন ছিল, এবং তাহা হইতে স্বাস্থ্যের হানিকর বিষম দুর্গন্ধ বাষ্প উত্থিত হইত। সিমসা চোর জুরাগের প্রভৃতি দুবৃর্ত্তগণের আড্ডা বলিয়া বিখ্যাত ছিল। এমন কি, ১৮২৮ অব্দ পর্যন্ত সন্ধ্যার পর কোনও ব্যক্তি অর্থলোভেও সিমলার পথ দিয়া চলিতে, স্বীকৃত হইত না। এক সময়ে এই স্থানে বহু তাঁতির বাস ছিল, এবং সিমলার কাপড় সুশোভন-পরিচ্ছদপ্রিয় ভদ্রসমাজের সবিশেষ আদাদের সামগ্রী ছিল। যেস্থানে এক্ষণে কর্ণওয়ালিস স্কোয়ার ও সারকুলার কেনাল অবস্থিত, তাহা অনেক দিন পশু হত্যার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল; ঐ স্থানে অনেক খুন হইয়া গিয়াছে।

 যেস্থান বৈঠকখানা ষ্ট্রীট নামে খ্যাত ছিল, তাহা এক্ষণে বৌবাজার ও বৈঠকখানা ষ্ট্রীট দ্বারা অবিকৃত। ঐ স্থানে একটা অতি প্রাচীন প্রসিদ্ধ বৃক্ষ ছিল; যে সকল বণিক বাণিজ্যার্থে কলিকাতায় আসিত, তাহারা ঐ বৃক্ষটীকে বৈঠকখানারূপে ব্যবহার করিত, অর্থাৎ ঐ গাছতলায় পণ্য দ্রব্যাদি নামাইয়া বিশ্রামলাভ কবিত; তাহা হইতেই স্থানটার ঐরূপ নামকরণ হইয়াছে। মাণিক নামক মুসলমানপীরের নাম হইতে মাণিকতলা, নাম হইয়াছে। বিবি কাউণ্টেস্ অব লাউডনের নামানুসারে লাউডন স্ত্রী, জষ্টিস্ রসেল সাহেবের নামানুসারে রসেল, ষ্ট্রীট, এবং পর্তুগীজ বণিক জোসেফ ব্যারোটার নামানুসারে ব্যারেটো ষ্ট্রীট নাম হইয়াছে। হলওয়েল সাহেব ১৭৫২ অব্দে যে বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন, তাহাতে ধোপাপাড়া, বেলেপুকুর, ট্যাংরা প্রভৃতির নামোল্লেখ আছে।

 কলিকাতার কোন কোন অংশের নাম স্থানীয় অধিবাসীদিগের বৃত্তিব্যবসাসের নামানুসারে হইয়াছে; যেমন কুম্ভকার হইতে কুমার টুলি, মদ্যবিক্রেতা শৌণ্ডিক হইতে শুণ্ডিপাড়া, কাংস্যকার হইতে কাঁঁসারিপাড়া, সূত্রধর হইতে ছুতারপাড়া, জালজীবী হইতে জেলে পাড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল লোক যে ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি ব্যবহারেরই পরিচালনা করিত তাহা নহে, প্রত্যুত তাহাদের জাতিও ভিন্ন ভিন্ন ছিল, এবং তাহাদের জাতীয় ও সামাজিক আচারব্যবহার তাহাদের বাসস্থানের চতুর্দ্দিকে পরিস্ফুট হইয়া পড়িত। আজকালি কিন্তু সকল বিষয়ই পর পর এমন দ্রুতগতিতে খটিয়া যায় এবং লোকেরা এত অধিকসংখ্যক বিষয়ে ব্যাপৃত থাকে যে, কেহই স্বজাতীয়দিগকে লইয়া সভাসমিতি করিবার কথা ভাবির অবসর পায় না। এই জন্যই কোনও পল্পী বা রাস্তার সহিত অধিবাসীদিগের কোনও রূপ সংস্রংবই দৃষ্ট হয় না।

 সহরের উত্তরাঞ্চলের বাড়ী অতি বিশৃঙ্খলভাবে নির্ম্মিত হইয়াছে; উহাদের নির্মাণে কোনওরূপ শৃঙ্খলা বা পারিপাট্য দৃষ্ট হয় না, কিংবা স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যাহা যাহা আবশ্যক, তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় নাই। ওয়ারেন্ হেষ্টিংস সাহেবই সর্ব্বপ্রথম কার্যতঃ স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাহাদের অনুরাগের পরিচয় প্রদান করেন। রাজকীয় স্থাপত্যশিল্পী উইলিয়াম হজেস সাহেব বলেন-“পরন্তু ইহার(কলিকাতার) সৌন্দর্যের ও ঐশ্বর্যাড়ম্বরের নিমিত্ত ইহা একমাত্র ভূতপুর্ব গভর্ণর জেনালের উদারতা ও সুরুচির নিকট ঋণী; এবং ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে প্রকৃত স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন রূপে পরিচিত হইবার যোগ্য। প্রথম সৌধ হেষ্টিংস সাহেব কর্তৃক নির্ম্মিত হয়। বস্তুতঃ উক্ত গৃহটী উত্তরকালে নির্ম্মিত অনেক অট্টালিকা অপেক্ষা ক্ষুদ্রায়তন হইলেও, উহার রচনাপ্রণালী যে সকলগুলি অপেক্ষা বিশুদ্ধতর, তাহাতে সন্দেহ নাই।” ১৭৮০ অব্দে বিবি কে ওয়ারেন্ হেষ্টিংসের বেলভেডিয়ার ভবনের বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন—“ভবনটী একটী নিখুত রত্ন এবং অগাধ অর্থে যতদূর হইতে পারে, সেইরূপ আড়ম্বরসহকারে উৎকৃষ্ট প্রণালীতে সজ্জিত। ভবনসংলগ্ন চত্বরে বৃক্ষলতাতৃণাদি যে ভাবে সজ্জিত হইয়াছে, তাহাতে সুরুচির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিছুদিন পরে তিনি ‘হেষ্টিংস হাউস্' নামে আর একটী ভবন নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বর্ত্তমান রাজপ্রতিনিধি লর্ড কার্জন বাহাদুর সেই ভবনটি সংপ্রতি ত্রুয় করিয়া অভ্যাস করুদরাজগণের বাসের নিমিত্ত পরিপাটী করিয়া সাজাইয়াছেন: হেষ্টিংস সাহেব তাঁহার প্রিয় জলবিহার স্থল সুকসাগর নামক স্থানে আর একটী ভবনও প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন বারাসাতেও একটা পল্লীভবন ছিল,সেটী গভর্ণর কার্টিয়ারের প্রিয় বাসস্থান; উহা ১৭৬০ অব্দ বা তৎসমকালে নির্ম্মিত হইয়াছিল। দমদমায় লর্ড ক্লাইভেরও একটি বিশ্রামভবন ছিল।

 অনেক স্বনামখ্যাত দেশীয় ভদ্রসন্তানও কলিকাতায় ও তৎসনিহিত স্থানে বাসভবন নির্মাণ করতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। রায় বাঁয়া মহারাজ রাজত বাহাদুর সূতানুটীতে বাস করিনে। মহারাজ নন্দকুমারের পুত্র রায় রয়া মহাঙ্গি গুরুদাস সূতানুটীর মধ্যস্থ চড়কডাঙ্গায় বাড়ী করিয়াছিলেন। গভর্ণর ভ্যান্সিটার্ট সাহেবের বেনিয়ান (মুৎসুদ্দি) ও আব্দুল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান রামচরণ পারিয়াটায় থাকিতেন। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের জোড়াসাঁকোতে বাড়ী ছিল। ওয়ারেন হেষ্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবুও জোড়াসাঁকোয় থাকতেন। হইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর পাথরিয়াঘাটায় থাকিতেন। রিচার্ড বারওয়েল সাহেবের পারস্যশিক্ষক মুন্সি সদরুদ্দীন মেছোবাজারে থাকিতেন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পূর্বপুরুষ রাজা পীতাম্বর মিত্রও মেছোবাজারে থাকিতেন। রামকৃষ্ণ দত্তের পুত্র মদনমোহন দত্ত সূতানুটীর অন্তর্গত নিমতলায় বাস করিতেন। পাটনার কার্শাল রেসিডেণ্টের দেওয়ন বনমালী সরকার এবং তাঁহার নায়েব দেওয়ান দুই জন্মেই কুমারটুলিতে থাকিতেন। কলিকাতায় ইংরেজ জমিদারের দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্রও কুমারটুলিতে থাকিতেন। তিনি চিৎপুর রোডের উপর একটি নবরত্ন মন্দির নির্ম্মান করেন। ঐ মন্দিরের টী চূড়া, এবং তাহায় সর্বোচ্চ চুড়াটী গড়ের মাঠের অক্টার্লোনি মকুমেণ্ট অপেক্ষাও উচ্চতর। প্রধান মন্দির ও সর্বোচ্চ চূড়াটী ১৭৩৭ সালের প্রবল ঝড় ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। সুপ্রসিদ্ধ ধনপতি ও কুঠিয়াল উমিচাঁদ রাজা অপেক্ষাও মহাড়ম্বরে কলিকাতায় বাস করিতেন। তাঁহার ভবন রাজপ্রাসাদের ন্যায় বিবিধ বিভাগে বিভক্ত ছিল। কলিকাতার অধিকাংশ ভাল ভাল বাড়ীই তাঁহার সম্পত্তি ছিল। ১৭৫৭ অব্দে কলিকাতা অবরোধকালে নবাব সিরাজুদ্দৌল্লা উমিচাঁদের বাগানে শিবির সন্নিবেশ করিয়া প্রধান আড় স্থাপন করিয়াছিলেন। ঐ স্থান এক্ষণে হালসি বাগান নামে খ্যত।

 শোভাবাজারে মহারাজ নবকৃষ্ণের দুইটি বাসভবন ছিল; সে দুইটীই সুন্দর রচনাপ্রণালী এবং মনোহর শোভা, সাজসজ্জা ও ঐশ্বর্য্যাড়ম্বরের জন্য, খ্যিাত ছিল। শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যয় মহাশয়ের মতে ঐ দুইটী বাটীই প্রাচ্যদেশবাসীদিগের বিবেচনায় প্রসাদময়ী নগরী আখ্যাধারিনী মহানগরীতে প্রকৃত প্রসাদ-সোধের আদর্শ। চিংপুরে বাঙ্গালার নায়েব দওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁর একটী বাটী ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মহীশুরের টিপুসুলতানের বংশধরেরা টালিগঞ্জে আসিয়া বাস করেন এবং উক্ত শতাব্দীর মধ্যভাগে অযোখার নবাব-বংশ খিদিরপুরের দক্ষিণস্থ মাটিয়াব্রুজে আসিয়া বাস করিলেন। রাজা রামমোহন রায় আমহার্স্ট ষ্ট্রীটে থাকিতেন। দেওয়ান কাশীনাথের বাসভবন বড়বাজারের নিকটর্ত্তী কোনও স্থানে ছিল। সাধুশীল বণিক ও লক্ষপতি বলিয়া বিখ্যত বাবু বৈষ্ণবচরণ শেঠের বাড়ী বড় বাজারে ছিল গৌরী সেনের বাড়ীও বড়বাজরে ছিল। গৌরি সেন মুক্তহস্ত। মহাপুরুষ বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। যে সকল অসমর্থ ঋণশোধে অসমর্থ হইয়া জেলে যাইত, গৌরীসেন তাহাদের ঋণ পরিশোধ করিয়া তাহাদিগকে কারামুক্ত করিতেন। যাহারা কোনও সৎকার্য্যের জন্য ঝগড়া বিপদ করিয়া বিপন্ন হইত এবং বিচারে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইত, তিনি তাহাদের জরিমানার টাকা দিয়া তাহাদিগকে উদ্ধার করিতেন। এই সকল কারণে তাঁহার নাম “লাগে টাকা দেব গৌরী সেন” ইত্যাকার প্রবাদবাক্যে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। বাবু শোভারাম বসাক নামক অতি বনাঢ্য বণিকের বাসভবন বড়বাজারে ছিল।

 বড়বাজারের এবং চোরবাগানের অতি প্রাচীন ধনাঢ্য গোষ্ঠী মল্লিকবংশ, রাজা সুখময় রায়ের পূর্বপুরুষগণ, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষগণ, বাগবাজারের গোকুল মিত্র এবং আরও অনেক প্রসিদ্ধ বংশ—ইহাদের মধ্যে কহ কেহ কলিকাতায় ইংরেজদিগের বসতি স্থাপনের পুর্বে এবং কেহ বা পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতা বসবাস করিতে আরম্ভ করেন।

 পুরাতন ফোর্ট উইনিয়ম দুর্গটি ১৬৯২ অব্দে নির্ম্মিত হইয়াছিল। ইংলণ্ডর প্রাচীনকালের 'ফিউডাল' দুর্গসমুহের ন্যায় উহা নগরর সকলের আশ্রয়স্থল ও স্বরূপ হইয়াছিল; দেশীয়ের বিপদে রক্ষা প্রাপ্ত হওয়ার এবং বাণিজ্যের বিবিধ অধিকার লাভ করায় অতি অল্পকাল মধ্যে সূতানুটী ও গোবিন্দপুরে বাস করিতে আরম্ভ করে। সার জন গোলডসবরো ডিহি কলিকাতার পুরাতন কেল্লার স্থান নির্বাচন কারন; যে যে গোরস্থানে চার্নক ও গোলডসবরো সমাহিত হন, তাহার উত্তরে এবং যে বড়বাজার ইংরেজ উপনিবেশে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করিত, তাহার দক্ষিণে উহা অবস্থিত ছিল। হ্যামিলটন বলেন, কেল্লার মধ্যস্থ গভর্ণরের বাসভবন যেমন দেখিতে সুদৃশ্য ও মনোহর, তেমনই স্থাপত্যশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন ছিল। তদ্ভিন্ন কেল্লার ভিতর পুরাতন জমিদারের কাছারি, সৈন্য দিগের জন্য একটি ভাল হাসপাতাল ও তাহাদের পাকিবার বারিক, এবং কোম্পানীর আনুকূল্যে ও সাধারণের চাঁঁদায় নির্মিত একটা গির্জা ছিল; গির্জাটা সেন র‍্যানের নামানুসারে অভিহিত হইত। বর্ত্তমান ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ পুরাতন কেল্লা হইতে কিয়দ্দুরে হুগলী নদীর নিম্নদিকে লর্ড ক্লাইভ কর্তৃক ১৭৫৭ অব্দে আরব্ধ হয়, এবং ১৭৭৩ অব্দে ইহার নির্ম্মানকার্য সমাপ্ত হয়। ইহাতে ২০,০০,০০০ পাউণ্ড ব্যয় হইয়াছিল। ইহা অষ্টভুজাকার; ইহার মধ্যে পাঁচটী পার্শ্ব বেশ সামঞ্জস্যবিশিষ্ট ও যথানিয়মে নির্মিত, কিন্তু অবশিষ্ট যে তিনটা পা নদীর অভিমুখীন, তাহার নির্ম্মানণপ্রণালী নিয়মানুগত হইয়া ইঞ্জিনিয়ারের ইচ্ছানুসারে নির্ম্মিত হইয়াছে।

 সমগ্র অট্টালিকাটা একটা পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। পরিখাটী শুষ্ক, কিন্তু উহার মধ্যস্থলে একটা খাত আছে; দুইটা কপাটে পোল দ্বারা তাহাতে নদী হইতে জল প্রবেশ করান যাইতে পারে...! কেল্লার ভিতর কেবল নিতান্ত আবশ্যক কতকগুলি গৃহ আছে যেমন সেনাধ্যক্ষের বাসভবন, সৈনিক কর্ম্মচারিগণের ও সৈন্যদিগের বাসস্থান ও অস্ত্রাগার......। প্রত্যেক তোরণের উপরে মেজর সাহেবের বাসের নিমিত্ত এক একটি গৃহ আছে। কয়েকজন প্রধান রাজপুরুষ একত্র মিলিত হইয়া ১৭৫৭ অব্দর জানুয়ারী মাসে কেল্লার ও তন্মধ্যস্থ অট্টালিকা গুলির যে মূল্য নিরূপণ করেন, তাহাতে উহার মুল্য ১,২০,০০০ টাকা অবধারিত হয়। মেজর রালক স্মিথ বলেন, “১৮৪৯ অব্দে ইহার নানা স্থানে ৬১৯টি কামান যুদ্ধার্থ তুলিয়া সাজান ছিল; ইহার ভিতর যে বারুদখানা ছিল, তাহা এত বড় যে, তাহাতে এক একটী ১০০ পাউণ্ডওজনের ৫১০০ ব্যারের বারুল ধরিত, এবং ইহার অস্ত্রাগারে ৪০ হইতে ৫০ হাজার বন্দুক ও তদ্ভিন্ন পিস্তল এবং তরবারি ছিল। ভিন্ন ভিন্ন পরিধির তিন হইতে চারি হাজার লোহার ও পিতলের বড় বড় কামান এবং তদনুরূপ গোলাগুলি বোমা ছিল; 'কেস' ও ‘গ্রপশট’ ব্যতীত কেবল সেই গোলাগুলিতে ২ লক্ষ বার কামান ছাড়া যাইতে পারিত। তৎকালে ইহাতে ১৫,০০০ লোক স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারিত......! ১৮৫৭ সাল হইতে অট্টালিকার ক্রমশঃই উন্নতি হইতেছে।”

 বর্ত্তমান গবর্ণমেণ্ট হাউস। (বড়লাটের বাসভবন) ময়দানের (গড়ের মাঠের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। মার্কুইস অব ওয়েলেসলি ১৭৯১ অব্দে ইহার নির্মাণ কার্য্য আরম্ভ করেন এবং ১৮০৪ অব্দে, তাহা সমাপ্ত হয়। (ইহাতে সর্ব্বসমেত প্রায় ১,৫০,০০ পাউণ্ড ব্যয় হইয়াছিল; জমির জন্য ৮,০০ পাউণ্ড, অট্টালিকার জন্য ১,৩০,০০ পাউণ্ড, এবং প্রথম বার সাজানর জন্য ৫,০০০ পাউণ্ড। জমির পরিমাণ প্রায় ৬ একার—(১৮ বিঘা ৩ কাঠা } হইবে; বরার্ট আতাম কর্তৃক নিম্মিত লর্ড স্কার্সডেলের ডাৰ্বিশিয়ারস্থ কেডলষ্টন হল নামক প্রাসাদের অনুকরণে ইহার নক্সা প্রস্তুত হইয়াছিল। রাজপ্রতিনিধি ও তাঁহার অনুচরবর্গের বাসগৃহ ব্যতীত ইহার ভিতর একটি কাউন্সিল চেম্বার (মন্ত্রিসভাগৃহ) আছে; তথায় উচ্চতম ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন হইয়া থাকে। ইহার নিমিত্ত সময়ে সময়ে ৪ যে সকল চিত্র, প্রর্ত্তিমূর্তি এবং অন্য সাজসজ্জা ও ভূষণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহাতে প্রাসাদের সৌন্দর্য্য বহুপরিমাণে বর্ধিত হইয়াছে, এবং তাহাদের মধ্যে কতকগুলি ঐতিহাসিক মূল্যেও অত্যন্ত অধিক।

 হাইকোর্ট মন্দির গবর্ণমেণ্ট হাউসের পশ্চিমে নদীর নিকটে অবস্থিত। ঐ স্থানে পূর্ব্বে সুপ্রীম কোর্ট ছিল। বর্তমান বাটী ১৮৭২ সালে নির্মিত হয়। বেলজিয়ম দেশান্তর্গত ypres (ঈশ্বর) নগরের টাউন হলের অনুকরণে ইহার নক্সা প্রস্তুত হইয়াছিল।

 হাইকোর্টের পূর্ব ও গবর্ণমেণ্ট হাউসের পশ্চিমে, অর্থাৎ উভয় ভবনের মধ্যস্থলে, টাউনহল দণ্ডায়মান। কলিকাতার অধিবাসীরা প্রায় ৭,০০,০০০ টাকা ব্যয়ে ১৮০৪ সালে ইহা নির্ম্মাণ করেন। এই ভবনে যে সকল অতি মনোহর চিত্রপটাদি শিল্প সামগ্রী আছে, তন্মধ্যে ওয়ারেন হেষ্টিংসের ও রমানাথ ঠাকুরের দুইটী মর্ম্মর প্রস্তররচিত প্রতিমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়।

 এতদ্ভিন্ন আরও অনেক সরকারী অট্টালিকা আছে, যথাষ্ট্যাণ্ডের উপরিস্থ বেঙ্গল ব্যাঙ্ক, সেণ্ট্রাল টেলিগ্রাফ আপিস, জেনারেল পোষ্ট অপিস, রাইটার্স বিল্ডিং নামক বেঙ্গল গবর্ণমেণ্টের দপ্তরখানা ইত্যাদি ইত্যাদি।

'ময়দান (গড়ের মাঠ) যে কেবল কলিকাতার বায়ুকোষ বলিয়া প্রসিদ্ধ তাহা নহে, অধিকন্তু উহার উপর বহু স্মৃতিনিদর্শন বিদ্যমান। সুপ্রসিদ্ধ মহারাণী ভারতেশ্বরী ভিক্টোরিয়া হইতে আরম্ভ করিয়া বহু রাজপ্রতিনিধি, গবর্নর জেনারেল, প্রধান সেনাপতি এবং অন্যান্ত উচ্চপদস্থ বিখ্যাত রাজপুরুষগণের প্রতিমূর্তি এই ময়দানের শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। ঐ সমস্ত প্রতিমূর্ত্তির অধিকাংশই ভাস্করবিদ্যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

  1. সে মিশ্র ভাষায় ইউরোপীয়েরা প্রাচ্য জগতে কথোপকথন করে।
  2. এই প্রথা বিহারর ইতরজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে অদ্যপি প্রচলিত আছে।
  3. মহারাজা নবকৃষ্ণ, লর্ড ক্লাইভ ও ওয়ায়েণ হেষ্টিংসের সময়ে জীবিত ছিলেন।
  4. সার ইলাইজা ইম্পের প্রমোদকানন পশ্চিমে চৌরঙ্গী বোড় হইতে উত্তরে পার্ক ষ্ট্রীট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং যেস্থান এক্ষণে মিডলটন প্লট নামে খ্যাত, ঐস্থানের উপরিস্থ দুই সারি গাছের মধ্য দিয়া তাঁহার বাড়ী হইতে পা দুটি পর্যাপ্ত একটি পথ ছিল; উহার চতুর্দিকে সুন্দর প্রাচীর এবং সমুখে একটা পুষ্করিণী ছিল; এক দল সিপাহী প্রহরী বাড়ী ও বাগানের চতুর্দ্দিকে রাত্রিকালে বুঝিয়া পাহারা দিত এবং সময়ে সময়ে বন্দুক ছুড়িয়া ডাকাতদিগকে ভয় দেখাইত।