কলির বৌ ঘরভাঙ্গনী/তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক।

জমিদার নীলাম্বর মুন্সির বাটির বাহির আঙ্গিনা

মাধব উপবিষ্ট।


(পান হাস্তে নীলাম্বর বাবু আসীন)

 নীল। ভাল মাধব। তোমাকে আজ এত বেজার বোধ হচ্ছে কেন? মুখখানি শুকিয়ে যেন একেবারে আমচুর হয়েছে। বাড়িতে কোন ঝগড়া টগড়া হয়েছে না কি!

 মাধব। (কান্দা ২ হইয়া) ঠাকুর দাদা কি বোল‍্বো বাড়িতে সুখ না থাকিলে কিছুই ভাল লাগে না!

 নীল। কেন বাড়িতে অসুখ কিসের?

 মাধব। ঠাকুর দাদা! আপনি হচ্ছেন গুরুলোক, জার আমি হচ্চি বালক, আমি আপনার কাছে কিছই মিথ্যা বোল্‌ব না, যে অবধি আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে, আর দাদা এই সর্ব্বনাশি ছারমুখিকে বিয়ে করেছেন, সেই অবধি আমার সময় মতন খাওয়াও হয় না, খাওয়া দূরে যাক্‌ মুখে ভাল দুটো কথাও শুন‍্লাম না, ঠাকুর দাদা আপনি হচ্চেন গুরুলোক আপনিই এর্ বিচার করুন।

 নীল। কেন বৌ বড় রাগী না কি?

 মাধব। আজ্ঞে সে কথা আবার বলেন! আপনি বুঝি সেদিনকার কথা শুনেন নাই, অনেক দিনের কথা নয় —আচ্ছা আগে আজিকার কথা বলি, পরে সেদিন কার কথা বলবো আমি আজ প্রাতঃকালে বৌর কাছে চারিটা মুড়ি চাচ্ছিলাম—পরে তিনি আমাকে কতটী সুটা মোল্কা দিলেন, আমি মুড়ির কথা জিজ্ঞাসা কল্লেম; তাতে তিনি উত্তর কোর‍্লেন যে তোমার জন্ম মুড়ি ভাজা হয় নাই। আমি আবার বেহায়ার মত বোল্লাম আচ্ছা দাদা কাল যে মিরপুরের হাট হতে খাজুরে গুড় এনেছেন্ তা হতে একটু গুড় দিন; আমি এই কথা বলিবামাত্র বৌ নাকটা একটু কুঞ্চিত করে—একেই ত যে মুখ, তার মধ্যে আবার মুখটা বেঁকা কোরে ফেকার মেরে চলে গেল, তখন মুখের দিকে চেলে বোধ হয় ১৪ বছরের আয়ু কমে। আমি আবার একটা কথা বল্লেম যে শোন বৌ তুমি পরের ঝি, উড়ে এসে পুড়ে খাচ্ছ, আমাদের সোনার সংসার মাটি কল্লে এই কথা বলবামাত্রই তিনি আমাকে চুলগুলি আউলাইয়া উগ্রচণ্ডা হয়ে ঝারু নিয়ে মারতে এলেন। আমি মানের ভয়ে এক পায় দুপায় আপনার কাছে নালিশ কোর‍্তে এসেছি। দোহাই ঠাকুর দাদা আপনি এর বিচার কোরবেন।

 নিলেম্বর। আরে আমার তিনকাল গেছে এককাল আছে, উচিত বিচার যা হয় করে দিব। এখন আমাকে কিছু দে।

 মাধব। আজ্ঞা আমার কি আছে কি দিব চিরকাল আপনার টা খেয়েই মানুষ হয়েছি।

 নীল। আচ্ছা সে দিন কি হয়েছিল বল‍্তো।

 মাধব। আইগা আমার সব কথা মনে নাই মধ্যে২ একটু২ মনে আছে।

 নীল। আচ্ছা যা মনে আছে তাই বল।

 মাধব। আজ্ঞে সেদিনকার কথা বোলবো কি, গত বৃহস্পতিবার যে জামাই ষষ্টি গিয়াছে সেই দিন দাদাতো আপন স্বশুর বাড়ি গেলেন আমি আর কোথায় যাব, বৌকে বোল্লাম যে শোন বৌ আজি একটা তেহারের দিন, এসো এক পাতিল দধি নিয়া দুই জনে মাখিয়া চুকিয়া খাই; আমি এই কথা বলামাত্র বৌ এ কটী বচন পড়ে যে, নির্গুণ মানুষের বচন মিঠা, নিত্য খায় চিতৈ পিঠা। আমি শেষে বল্লেম যে, এই শ্লোকের অর্থ কি? বৌ এমন একটা অশ্লীল ভাষা বল্লে যে, তা শুনিলে নিরাগীর রাগ জন্মে, দাদা বাড়ি আসিলে পর আমি দাদার নিকট বল্লেম, দাদা হুঁ হাঁ কিছুই বল্লেন না, তাতেই আমি দাদার মন বুঝলাম। পর দিন দাদা ভাত খেয়ে তাঁহার খাটের উপর যাইয়া শয়ন করিলে পর, বৌ তাঁকে একটি পান আর এক ছিলুম তামাক দিয়া বাতাস করিতেছে এমন সময় দাদা বৌর নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন; পরে বৌ আমার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া দাদাকে প্রবোধ দিলেন, পরে আরো কতকগুলি কথা আমার নামে দাদার নিকটে বল্লেন, দাদা কোন কথারই উত্তর দিচ্ছেন না, সমুদয় কথায়ই হয় হয় কচ্চেন কিন্তু দাদা বৌর কথা বেদস্বরূপ মানিলেন, আমি শেচে দাঁড়াইয়া সমুদয় কথাই শুনিতে পাইলাম।

 নীল। তবে ত দেখি বৌ বড় গিপ্তাই, দেখতে শুন্তে ত তত নয়, লাজ লজ্জায় একেবারে যেন দ্রুপত্নি।

 মাধব। আজ্ঞা নিচুবা ডেঙ্গ কাঁটা, খাওনের যম, আর লোকে যে বলে লাজে বৌ ভাত খায় না চালিতা হেন গ্রাস, ওর যে তাই হচ্ছে।

 নীল। ভাল এহাতে শুভঙ্কর কিছু বল্লে না?

 মাধব। তা হলে আর এমন হবে কেন?

 নীল। তোমাদের পিতার সম্পত্তি কি আছে।

 মাধব। আজ্ঞা একটি আবাল আর একটী বকুন বাছুর, আর দাদাকে যে বিবাহ করাইয়াছেন।

 নীল। (হাস্য করিয়া) সেই বিবাহের সরিক কি তুই রে?

 মাধব। আইগা সে কথা বলি না, দাদাকে যে টাকা ব্যয় করে বিবাহ করায়েছেন, সেই টাকার সরিকের কথা বল‍্ছি।

 নীল। আচ্ছা, আমি এসব কথা শুভঙ্করকে বলব, দেখি সে কি কয় পরে তোমাকে জানাইব।

 মাধব। যে আজ্ঞা তবে আমি এখন যাই, নমস্কার ঠাকুরদাদা। ভাল করে বিচার কর্ব্বেন।
[ মাধবের প্রস্থান।

 দয়াল। মাধব তুমি ও বড় নির্ব্বোধ, বাড়িতে সাচা মিচি একটু ঝগড়া করেছ তা নিয়ে আবার আপন মণিবের কাছে নালিশ করিতে এসেছ; এটাকি তোমার ভাল হইয়াছে লোকে তোমাকে, নয় শুভঙ্করকেই মন্দ বলবে, সে তোমাকে পাবেনা শুভঙ্কর শুভ তোমার সহোদর ভাই, ঝগড়া কোন বাড়িতে না হইয়া থাকে।

 মাধব। ভাই তুমি কথা খেল্ কল্লে না, যখন দাদা আমায় ছারা হইয়া বৌর পক্ষ অবলম্বন করিয়ে আমাকে বাড়ি হতে খেদালে তখন দাদা যে আমার, তা তোমরা কি করে বল, সে কথা তোমরা বিবেচনা কর না?

 দয়াল। ভাই যতই বল না কেন, আমার বিবেচনা অনুসারে এটা ভাল হয় নাই। আচ্ছা তুমি যে কর্ত্তার কাছে নালীশ কল্লে, তা তোমাকে এরূপ কর্ত্তে কে দেখেছে।

 মা। কেন তার সাক্ষী নাই ওপাড়ার নয়াখুড়ি, জেঠিমা, ঠাইন্‌ পিশি, ইঁ হারাইত দেখেছেন।

 দয়াল। তারা কিরে তোর কর্ত্তার কাছে সাক্ষী দিতে আস‍্বে?

 মা। (ত্যক্ত হইয়া) যা ভাই তোর সাথে আমি তর্ক করি না। তুই কিছু বুঝিন না।

[ এই বলিয়া মাধবের প্রস্থান।

(খড়ম পায় পাখা হস্তে গুণ২ম্বরে গান করিতে২ শুভঙ্করের প্রবেশ)

 নীল। ওকে? শুভঙ্কর না কি? এসোতো এদিক, একটি কথা শুনে যাও।

 শুভ। ঠাইন মামা! আজি আপনে যে আমাকে এত লঘু স্বরে ডাকছেন ইহার কারণ কি?

 নীল। (হাস্য করিয়া) শুভঙ্কর তুমি একটী মজার মানুষ, পুরুষ কিরে কখন ঠাইন মামা হয়ে থাকে।

 শুভ। তবে এটা আমার চুক হয়েছে মাপ করুন, দোহাই আপনার।

 নীল। আরে শালা পাটনারে মেড়া গাছের গোড়া কাটিয়া মাথার জল ঢালিলে কি হইয়া থাকে।

 শুভ। ঠাকুরদাদা আপনি ত সেই গাছ না!

 নীল। শুভঙ্কর! তুমি আর কাটা ঘায় নেমুর রস দিও না, আমার শরীর ভারি ত্যক্ত আছে।

 শুভ। তবে আজ্ঞা আমাকে কি জন্যে ডাকছেন তা বলুন আমি যাই।

 নীল। ডাকছি যে, মাধব আমার কাছে এক কথার নালিশ বন্দ হয়েছে! তোমার স্ত্রী নাকি তাকে বড় ছিদ্দত করে; এটা কি সে বড় ভাল করে এহাতে লোকে কি বলে?

 শুভ। ঠাকুর দাদা! আপনি কখন কি দেখেছেন যে বিনা বাতাসে গাঙ্গ লড়ে আর এক কাঠি কখন বাজে? যবে এ বিষয় যখন আপনার নিকট মালিশ করেছে, তখন আমি বিশেষ করিয়া আপনার নিকট বল‍্তে পারি আপনি অনুমতি কল্লেই হয়।

 নীল। আচ্ছা বল দেখি শুনি?

 শুভ। কালি প্রাতঃকালে আমি গাই দোয়াইতেছিলাম এমন সময় মাধব গণ্ডা দুই কাঁচা মরিচ কাসন্ধ নিয়ে পাকের ঘরে পান্তাভাত খাইতে গিয়াছে তাতে বৌ বল্লে যে মরিচ ত অল্পই আনিয়াছ, তাতে মাধব উত্তর করে যে আপুচি কৌপ্টা মুচি এই কথা বলামাত্র বৌ তাকে একটি ঠোকর মাল্লে, এমন সময় আমি সম্মুখে পড়িলে উভয়েই ক্ষান্ত পাইল এহাতে ঠাকুর দাদা যাহার দোষ তাহা আপনি বিচার করুন।

 নী। তোমার সম্মুখে সে ঠোকর মাল্লে তুমি কিছু বল্লে না?

 শু। আজ্ঞা আমিই তার ডরে চোর।

 নীঃ। তুমি যখন তার স্বামী হইয়া তার ডরে চোর, তখন সেত দেবরই ওকে ত বলতেই পারে। এহাতে বুঝা যায় যে বৌর সম্পূর্ণ দোষ; যা হউক বৌকে আমি ৴৹ জরিমানা কল্লম।

জরিমানা দিয়া শুভঙ্করের বাটীতে গমন।

শুভঙ্করের বাটী।

 শুভঃ। দেখ বৌ মাধবকে আর আমার বাটীতে জায়গা দিবে না, আমরটা খেয়ে আমার নামেই জমিদারের নিকট নালিশ করেছে।

 মেঘ। (আহ্লাদে আটখানা হয়ে) দেখুন এত দিনে পথে আসেন কি না, আমি এতকাল আপনাকে বলেছি আপনে শুনেও শুনেন নাই গরিবের কথা বাশি হলে ফলে।

 কিঞ্চিৎ পরে মাধবের বাটীতে গমন।)

 মেঃ। ছোটঠাকুরপো! তুমি পিছা শলা না খাইতে সকালে বাড়ী হতে বেরো, তিন বেলা তিন পাথর পানারা খেয়ে২ শরীর দিয়া যেন লুন্দি পড়েছে। যার কাছে নালিশ করিয়াছ তার কাছে যাও, সেই তোমাকে খেতে, দিবে।

 মাঃ। তোমার বাপের বাড়ি নাকি?

 মেঃ। কি? বাপ তুল্লি!

(এই বলিরা পিছা লইয়া মারিতে যায়।)

 পিছা খাইয়া মাধবের জমীদারের নিকট গমন।

 মাঃ। ঠাকুর দাদা শেষ কালে কি বৌর হাতে পিছার বাড়ি লেখা ছিল? যাহউক ভালই হয়েছে আমি বেহায়া দেখে আজো এই বাড়ীতে আছি। তাবৎ দিন ঘশি গোবর টোকাইরা এক মুট ভাত খাইয়াছি। লোকে ডাকের কথায়ই বলে যে পুরুষের মানে রাজা হয় আর স্ত্রীরবানে জাতি যায়। তবে ঠাকুর দাদা আমি এখন বাই।

 নিঃ। কোথায় যাইতে মনস্ত করিয়াছ?

 মাঃ। অজ্ঞা মিছারাম দাসের আক্রায় ভেক নিব। এই বলিয়া মাধব বোগল তলায় কাপড় লইয়া ভেক লইতে গমন। এবং যাইতে২ গান।

তাল এক তালা।

 ভেকনিব আর রবনা ঘরে, জালা সৈতে পারি মমান্তরে

 ভ্রাতা আমার ভালবাসি, বল‍্ত সদা মিষ্টভাষী তাতে পরের ঝি উড়ে আসি, দিল ভেয়ের মনে গরল ভরে।

 এখন হয়েছে বৌর আহ্লাদের প্রাদুর্ভাব, ভেয়ের মনে লেগেছে সেভাব, ঘরের সুখের হয়েছে অভাব, বের হব ডোর কপনী পরে!

সমাপ্ত।