কাদম্বরী (তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ১৮৯২)/কথারম্ভ-১০
চন্দ্রাপীড় স্কন্ধাবারে প্রবেশিয়া উজ্জয়িনী হইতে আগত এক বার্ত্তাবহকে দেখিতে পাইলেন। প্রীতিবিস্ফারিত লোচনে পিতা, মাতা, বন্ধু, বান্ধব, প্রজা, পরিজন প্রভৃতি সকলের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসিলেন। সে প্রণতিপূর্ব্বক দুই খানি লিখন তাঁহার হস্তে প্রদান করিল। যুবরাজ পিতৃপ্রেরিত পত্রিকা অগ্রে পাঠ করিয়া তদনন্তর শুকনাসপ্রেরিত পত্রের অর্থ অবগত হইলেন। এই লিখিত ছিল “বহু দিবস হইল তোমরা বাটী হইতে গমন করিয়াছ। অনেক কাল তোমাদিগকে না দেখিয়া আমরা অতিশয় উৎকণ্ঠিতচিত্ত হইয়াছি। পত্রপাঠ মাত্র উজ্জয়িনীতে না পঁহুছিলে, আমাদিগের উদ্বেগ বৃদ্ধি হইতে থাকিবে।” বৈশম্পায়নও যে দুইখানি পত্র পাইয়াছিলেন তাহাতেও এইরূপ লিখিত ছিল। যুবরাজ পত্র পাইয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন কি করি, এক দিকে গুরুজনের আজ্ঞা, আর দিকে প্রণয়প্রবৃত্তি। গন্ধর্ব্বরাজতনয়া কথা দ্বারা অনুরাগ প্রকাশ করেন নাই বটে, কিন্তু ভাবভঙ্গির দ্বারা বিলক্ষণ লক্ষিত হইয়াছে। ফলতঃ তিনি অনুরাগিণী না হইলে আমার অন্তঃকরণ কেন তাঁহার প্রতি এত অনুরক্ত হইবে? যাহা হউক, এক্ষণে পিতার আদেশ অতিক্রম করা হইতে পারে না। এই স্থির করিয়া সমীপস্থিত বলাহকের পুত্ত্র মেঘনাদকে কহিলেন, মেঘনাদ! পত্রলেখাকে সমভিব্যাহারে করিয়া কেয়ূরক এই স্থানে আসিবে। তুমি দুই এক দিন বিলম্ব কর, পত্রলেখা আসিলে তাহাকে সঙ্গে লইয়া বাটী যাইবে এবং কেয়ূরককে কহিবে যে, আমাকে ত্বরায় বাটী যাইতে হইল; এজন্য কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না। এক্ষণে বোধ হইতেছে তাঁহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় না হওয়াই ভাল ছিল। আলাপ পরিচয় হওয়াতে কেবল পরস্পর যাতনা সহ্য করা বই আর কিছুই লাভ দেখিতে পাই না। যাহা হউক, গুরুজনের আজ্ঞার অধীন হইয়া আমার শরীর উজ্জয়িনীতে চলিল, অন্তঃকরণ যে গন্ধর্ব্বনগরে রহিল ইহা বলা বাহুল্যমাত্র। অসজ্জনের নাম উল্লেখ করিবার সময়ে আমাকেও যেন এক এক বার স্মরণ করেন। মেঘনাদকে এই কথা বলিয়া বৈশম্পায়নকে কহিলেন আমি অগ্রসর হইলাম; তুমি রীতি পূর্ব্বক স্কন্ধাবার লইয়া আইস।
রাজকুমার পার্শ্ববর্ত্তী বার্ত্তাবহকে উজ্জয়িনীর বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতে করিতে চলিলেন। কতিপয় অশ্বারোহীও সঙ্গে সঙ্গে চলিল। ক্রমে প্রকাণ্ড পাদপ ও লতামণ্ডলীসমাকীর্ণ নিবিড় অটবীমধ্যে প্রবেশিলেন। কোন স্থানে গজভঙ্গ বৃক্ষশাখা পতিত হওয়াতে পথ বক্র ও দুর্গম হইয়াছে। কোন স্থানে বৃক্ষমণ্ডলীর শাখাসকল পরস্পর সংলগ্ন ও মূলদেশ পরস্পর মিলিত হওয়াতে দুষ্প্রবেশ দুর্গ সংস্থাপিত রহিয়াছে। স্থানে স্থানে এক একটা কূপ, উহার জল বিবর্ণ ও বিস্বাদ। উহার মুখ লতাজালে এরূপ আচ্ছন্ন যে, পথিকেরা জল তুলিবার নিমিত্ত লতা দ্বারা যে রজ্জুরচনা করিয়াছিল কেবল তাহা দ্বারাই অনুমিত হয়। মধ্যে মধ্যে গিরিনদী আছে; কিন্তু জল নাই। তৃষ্ণার্ত্ত পথিকেরা উহার শুষ্ক প্রদেশ খনন করাতে ছোট ছোট কূপ নির্ম্মিত হইয়াছে। এই ভয়ঙ্কর কান্তার অতিক্রম করিতে দিবাবসান হইল। দূর হইতে দেখিলেন সম্মুখে এক রক্তবর্ণ পতাকা সন্ধ্যাসমীরণে উড্ডীন হইতেছে।
রাজকুমার সেইদিক্ লক্ষ্য করিয়া কিঞ্চিৎ দূর গমন করিলেন। দেখিলেন চতুর্দ্দিকে খর্জ্জূরবৃক্ষের বনমধ্যে এক মন্দিরে ভগবতী চণ্ডিকার প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত আছে। রক্তচন্দনলিপ্ত রক্তোৎপল ও বিল্বদল সম্মুখে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। দ্রাবিড়দেশীয় এক ধার্ম্মিক তথায় উপবেশন করিয়া কখন বা যক্ষকন্যার মনে অনুরাগসঞ্চারের নিমিত্ত রুদ্রাক্ষমালা জপ, কখন বা দুর্গার স্তুতিপাঠ করিতেছেন। তিনি জরাজীর্ণ, কালগ্রাসে পতিত হইবার অধিক বিলম্ব নাই, তথাপি ভগবতী পার্ব্বতীর নিকট কখন বা দক্ষিণাপথের অধিরাজ্য কখন বা ভূমণ্ডলের আধিপত্য কামনা করিতেছেন। কখন বা প্রেয়সীবশীকরণতন্ত্রমন্ত্র শিখিতেছেন ও তীর্থদর্শনসমাগতা বৃদ্ধা পরিব্রাজিকাদিগের অঙ্গে বশীকরণচূর্ণ নিক্ষেপ করিতেছেন। কখন বা হস্ত বাজাইয়া মস্তক সঞ্চালন পূর্ব্বক মশকের ন্যায় গুন গুন শব্দে গান করিতেছেন। জগদীশ্বরের কি আশ্চর্য্য কৌশল! তিনি যেরূপ এক স্থানে সমুদায় সৌন্দর্য্যের সমাবেশ করিতে পারেন, সেইরূপ তাঁহার কৌশলের সমুদায় বৈরূপ্যও এক স্থানে সন্নিবিষ্ট হইয়া থাকে। দ্রাবিড়দেশীয় ধার্ম্মিকই তাহার প্রমাণস্বরূপ। তিনি কাণা, খঞ্জ, বধির ও রাত্র্যন্ধ; এরূপ লম্বোদর যে রাক্ষসের ন্যায় রাশি রাশি ভোজন করিয়াও উদর পূর্ণ হয় না। শুষ্কলতারচিত পুষ্পকরণ্ডক ও আঙ্কুশিক লইয়া বনে বনে ভ্রমণ ও বৃক্ষে বৃক্ষে আরোহণ করাতে বানরগণ কুপিত হইয়া তাঁহার নাসা কর্ণ ছিন্ন করিয়াছে এবং ভল্লূকের তীক্ষ্ণ নখে গাত্র ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে। রাজকুমারের লোকজন তথায় উপস্থিত হইবামাত্র তিনি তাহাদের সহিত কলহ আরম্ভ করিলেন।চন্দ্রাপীড় মন্দিরের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গম হইতে অবতীর্ণ হইলেন। ভক্তিভাবে দেবীকে প্রদক্ষিণ করিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। কাদম্বরীর বিরহে তাঁহার অন্তঃকরণ অতিশয় উৎকণ্ঠিত ছিল, দ্রাবিড়দেশীয় ধার্ম্মিকের আমোদজনক ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। তিনি স্বয়ং তাঁহার জন্মভূমি, জাতি, বিদ্যা, পুত্ত্র, বিভব, বিষয় ও প্রব্রজ্যার কারণ সমুদায় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। ধার্ম্মিক আপনার শৌর্য্য, বীর্য্য, ঐশ্বর্য্য, রূপ, গুণ, বুদ্ধিমত্তার এ রূপে পরিচয় দিলেন যে তাহা শুনিয়া কেহ হাস্য নিবারণ করিয়া রাখিতে পারে না। অনন্তর রবি অস্তগত হইলে অগ্নি জ্বালিয়া ও ঘোটকের পর্য্যাণ বৃক্ষশাখায় রাখিয়া সকলে নিদ্রা গেলে রাজকুমার শয়ন করিয়া কেবল গন্ধর্ব্বনগর চিন্তা করিতে লাগিলেন। প্রভাতে চণ্ডিকার উপাসককে যথেষ্ট ধন দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। কতিপয় দিনে উজ্জয়িনীনগরে পঁহুছিলেন। রাজকুমারের আগমনে নগর আনন্দময় হইল। তারাপীড় চন্দ্রাপীড়ের আগমনবার্ত্তা শ্রবণে সাতিশয় আনন্দিত হইয়া সভাস্থ রাজমণ্ডলী সমভিব্যাহারে স্বয়ং প্রত্যুদ্গমন করিলেন। প্রণত পুত্ত্রকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া তাঁহার শরীর শীতল হইল। যুবরাজ তথা হইতে অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া প্রথমতঃ জননীকে, অনন্তর অবরোধকামিনীদিগকে, একে একে প্রণাম করিলেন। পরে অমাত্যের ভবনে গমন করিয়া শুকনাস ও মনোরমার চরণ বন্দনা পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন পশ্চাৎ আসিতেছেন সংবাদ দিয়া তাঁহাদিগকে আহ্লাদিত করিলেন। বাটী আসিয়া জননীর নিকট আহারাদি সমাপন করিয়া, অপরাহ্ণে শ্রীমণ্ডপে আসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। তথায় জীবিতেশ্বরী গন্ধর্ব্বরাজকুমারীর মোহিনী মূর্ত্তি স্মৃতিপথারূঢ় হইল। পত্রলেখা আসিলে প্রিয়তমার সংবাদ পাইব এইমাত্র আশা অবলম্বন করিয়া কথঞ্চিৎ কাল যাপন করিতে লাগিলেন।
কিছু দিন পরে মেঘনাদ ও পত্রলেখা আসিয়া উপস্থিত হইল। যুবরাজ সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া পত্রলেখাকে মহাশ্বেতা ও কাদম্বরীর কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিলেন। পত্রলেখা কহিলেন, সকলেই কুশলে আছেন। প্রিয়তমার সংক্ষেপ সংবাদ শ্রবণে যুবরাজের মন পরিতৃপ্ত হইল না। তিনি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, পত্রলেখে! আমি তথা হইতে আগমন করিলে তুমি তথায় কত দিন ছিলে? গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রী কিরূপ তোমার আদর করিয়াছিলেন? কি কি কথা হইয়াছিল? সমুদায় বিশেষ রূপে বর্ণন কর। পত্রলেখা কহিল, শ্রবণ করুন। আপনি আগমন করিলে আমি তথায় যে কয়েক দিন ছিলাম, গন্ধর্ব্বকুমারীর নব নব প্রসাদ অনুভব করিতাম। আমোদ আহ্লাদে পরম সুখে দিবস অতিবাহিত করিয়াছি। তিনি আমা ব্যতিরেকে এক দণ্ডও থাকিতেন না। যেখানে যাইতেন, আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেন। সর্ব্বদা আমার চক্ষুর উপর তাঁহার নয়নোৎপল ও আমার করে তাঁহার পাণিপল্লব থাকিত। একদা প্রমোদবনবেদিকায় আরোহণ পূর্ব্বক কিছু বলিতে অভিলাষ করিয়া বিষণ্ণ বদনে আমার মুখপানে অনেক ক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। তৎকালে তাঁহার মনে কোন অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হওয়াতে তাঁহার কম্পিত ও রোমাঞ্চিত কলেবর হইতে বিন্দু বিন্দু স্বেদজল নিঃসৃত হইতে লাগিল। কিন্তু কিছুই বলিতে পারিলেন না। আমি তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, দেবি! কি বলিতেছেন বলুন। কিন্তু তাঁহার কথা স্ফূর্ত্তি হইল না; কেবল নয়নযুগল হইতে জলধারা পড়িতে লাগিল। এ কি! অকস্মাৎ এরূপ দুঃখের কারণ কি? এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে বসনাঞ্চলে নেত্রজল মোচন করিয়া বলিলেন, পত্রলেখে! দর্শন অবধি তুমি আমার প্রিয়পাত্র হইয়াছ। আমার হৃদয় কাহাকেও বিশ্বাস করিতে সম্মত নহে; কিন্তু তোমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করিয়াছে। তোমাকে মনের কথা না বলিয়া আর কাহাকে বলিব। প্রিয়সখীকে আত্মদুঃখে দুঃখিত না করিয়া আর কাহাকে আত্মদুঃখে দুঃখিত করিব? কুমার চন্দ্রাপীড় লোকের নিকটে আমাকে নিন্দনীয় করিলেন ও যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিলেন। কুমারীজনের কুসুমসুকুমার অন্তঃকরণ যুবজনেরা বলপূর্ব্বক আক্রমণ করে, কিছুমাত্র দয়া করে না। এক্ষণে গুরুজনের অননুমোদিত পথে পদার্পণ করিয়া কিরূপে নিষ্কলঙ্ক কুলে জলাঞ্জলি প্রদান করি। কুলক্রমাগত লজ্জা ও বিনয়ই বা কিরূপে পরিত্যাগ করি। যাহা হউক, জগদীশ্বরের নিকটে এই প্রার্থনা, জন্মান্তরে যেন তোমাকে প্রিয়সখীরূপে প্রাপ্ত হই। আমি প্রাণত্যাগ দ্বারা কুলের কলঙ্ক নিবারণ করিব, অভিলাষ করিয়াছি।
আমি তাঁহার দুরবগাহ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিতে না পারিয়া বিষণ্ণ বদনে বিজ্ঞাপন করিলাম, দেবি! যুবরাজ কি অপরাধ করিয়াছেন, আপনি তাঁহাকে এত তিরস্কার করিতেছেন কেন? এই কথা শুনিয়া রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, ধূর্ত্ত প্রতিদিন স্বপ্নাবস্থায় আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে কত কুপ্রবৃত্তি দেয়, তাহা ব্যক্ত করা যায় না। কখন সঙ্কেতস্থান নির্দ্দেশ পূর্ব্বক মদনলেখন প্রেরণ করে; কখন বা দূতীমুখে নানা অসৎপ্রবৃত্তি দেয়। আমি ক্রোধান্ধ হইয়া অমনি জাগরিত হই ও চক্ষু উন্মীলন করি, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাই না। কাহাকে তিরস্কার করি, কাহাকেই বা নিষেধ করি কিছুই বুঝিতে পারি না। এই কথা দ্বারা অনায়াসে কাদম্বরীর সংকল্প ব্যক্ত হইল। তখন আমি হাসিতে হাসিতে কহিলাম, দেবি! একজনের অপরাধে অন্যের প্রতি দোষারোপ করা উচিত নয়। আপনি দুরাত্মা কুসুমচাপের চাপল্যে প্রতারিত হইয়াছেন, চন্দ্রাপীড়ের কিছুমাত্র অপরাধ নাই।
কুসুমচাপই হউক, আর যে হউক, তাহার রূপ, গুণ, স্বভাব কি প্রকার বর্ণনা কর তাহা হইলে বুঝিতে পারি কে আমাকে এত যাতনা দিতেছে। তিনি এই কথা কহিলে বলিলাম, সে দুরাত্মা অনঙ্গ, তাহার রূপ কোথায়? সে জ্বালাবতী ও ধূমপটল বিস্তার না করিয়াও সন্তাপপ্রদান ও অশ্রুপাতন করে। ত্রিভুবনে প্রায় এরূপ লোক নাই, যাহাকে তাহার শরের শরব্য হইতে না হয়। কুসুমচাপের যেরূপ স্বরূপ বর্ণনা করিলে, বোধ হয়, আমি তাহার বাণপাতের পথবর্ত্তী হইয়া থাকিব। এক্ষণে কি কর্ত্তব্য উপদেশ দাও। এই কথা শুনিয়া আমি প্রবোধবাক্যে বলিলাম, দেবি! কত শত বিখ্যাত অবলাগণ ইচ্ছা পূর্ব্বক স্বয়ংবরবিধানে প্রবৃত্ত হইয়া আপন অভিলাষ সম্পাদন করিয়া থাকেন, অথচ লোকসমাজে নিন্দনীয় হয়েন না। আপনিও স্বয়ংবরবিধানের আয়োজন করুন ও এক খানি পত্রিকা লিখিয়া দেন। সেই পত্রিকা দেখাইয়া আমি রাজকুমারকে আনিয়া আপনার মনোরথ পূর্ণ করিতেছি। এই কথায় অতিশয় হৃষ্ট হইয়া প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে ক্ষণকাল অনুধ্যান করিয়া কহিলেন, তাহারা অতিশয় সাহসকারিণী, যাহারা স্বয়ংবরে প্রবৃত্ত হয় ও মনোগত কথা প্রিয়তমের নিকট বলিয়া পাঠায়। কুমারীজনের এতাদৃশ প্রাগল্ভ্য ও সাহস কোথা হইতে হইবে? কি কথাই বা বলিয়া পাঠাইব? তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় এ কথা বলা পৌনরুক্ত। আমি তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত, বেশবনিতারাই ইহা কথা দ্বারা ব্যক্ত করিয়া থাকে। তোমা ব্যতিরেকে জীবিত থাকিতে পারি না এ কথা অনুভববিরুদ্ধ ও অবিশ্বাস্য। যদি তুমি না আইস, আমি স্বয়ং তোমার নিকট যাইব, এ কথায় চাপল্য প্রকাশ হয়। প্রাণপরিত্যাগ দ্বারা প্রণয়প্রকাশ করিতেছি, এ কথা আপাততঃ অসম্ভব বোধ হয়। অবশ্য একবার আসিবে, এ কথা বলিলে গর্ব্ব প্রকাশ হয়। তিনি এখানে আসিলেই বা কি হইবে, যখন হিমগৃহে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তিনি কত কথা কহিলেন; আমি তাঁহার সমক্ষে একটি মনের কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। আমার সেই মুখ, সেই অন্তঃকরণ, কিছুই পরিবর্ত্ত হয় নাই। পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ হইলেই যে মনোগত অনুরাগ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে প্রণয়পাশে বদ্ধ করিতে পারিব, তাহারই বা প্রমাণ কি? যাহা হউক, এক্ষণে সখীজনের যাহা কর্ত্তব্য, কর। এই বলিয়া আমাকে পাঠাইয়া দিলেন। ফলতঃ গন্ধর্ব্বরাজকুমারীর সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া তৎকালে তথা হইতে আপনার প্রত্যাগমন করায় নিতান্ত নিঃস্নেহতা প্রকাশ হইয়াছে; এটি যুবরাজের উপযুক্ত কর্ম্ম হয় নাই। এই কথা বলিয়া পত্রলেখা ক্ষান্ত হইল।