কাদম্বরী (তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ১৮৯২)/কথারম্ভ-১৩
চন্দ্রাপীড় নয়ননিমীলন পূর্ব্বক মহাশ্বেতার কথা শুনিতেছিলেন; কথা সমাপ্ত হইলে কহিলেন, ভগবতি! এ জন্মে কাদম্বরীসমাগম ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। জন্মান্তরে যাহাতে সেই প্রফুল্ল মুখারবিন্দ দেখিতে পাই এরূপ যত্ন করিও। বলিতে বলিতে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। যেমন শিলাতল হইতে ভূতলে পড়িতেছিলেন, অমনি তরলিকা মহাশ্বেতাকে ছাড়িয়া শশব্যস্তে হস্ত বাড়াইয়া ধরিল এবং কাতর স্বরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! দেখ দেখ কি সর্ব্বনাশ উপস্থিত! চন্দ্রাপীড় চৈতন্যশূন্য হইয়াছেন। মৃত দেহের ন্যায় গ্রীবা ভগ্ন হইয়া পড়িতেছে। নেত্র নিমীলিত হইয়াছে। নিশ্বাস বহিতেছে না। জীবনের কোন লক্ষণ নাই। একি দুর্দ্দৈব!—একি সর্ব্বনাশ!—হা দেব, কাদম্বরীপ্রাণবল্লভ! কাদম্বরীর কি দশা ঘটিল। এই বলিয়া তরলিকা মুক্ত কণ্ঠে রোদন করিয়া উঠিল। মহাশ্বেতা সসম্ভ্রমে চন্দ্রাপীড়ের প্রতি চক্ষু নিক্ষেপ করিলেন এবং সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া হতবুদ্ধি ও চিত্রিতের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন। আঃ—পাপীয়সি, দুষ্টতাপসি! কি করিলি, জগতের চন্দ্র হরণ করিলি, মহারাজ তারাপীড়ের সর্ব্বস্ব অপহৃত হইল, মহিষী বিলাসবতীর সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল, পৃথিবী অনাথা হইল। হায় এত দিনের পর উজ্জয়িনী শূন্য হইল! এক্ষণে প্রজারা কাহার মুখ নিরীক্ষণ করিবে, আমরা কাহার শরণাপন্ন হইব? এ কি বিনা মেঘে বজ্রাঘাত? চন্দ্রাপীড় কোথায়? মহারাজ এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে আমরা কি উত্তর দিব। পরিচারকেরা হা হতোঽস্মি! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে এই রূপে বিলাপ করিয়া উঠিল। ইন্দ্রায়ুধ চন্দ্রাপীড়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। তাহার নয়নযুগল হইতে অজস্র অশ্রুবারি বিনির্গত হইতে লাগিল।
এ দিকে পত্রলেখার মুখে চন্দ্রাপীড়ের আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া কাদম্বরীর আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। প্রাণেশ্বরের সমাগমে এরূপ সমুৎসুক হইলেন যে, তাঁহার আগমন পর্য্যন্ত প্রতীক্ষা করিতে পারিলেন না। প্রিয়তমের প্রত্যুদ্গমন করিবার মানসে উজ্জ্বল বেশ ধারণ করিলেন। মণিময় অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া গাত্রে অঙ্গরাগ লেপন পূর্ব্বক কণ্ঠে কুসুমমালা পরিলেন। সুসজ্জিত হইয়া কতিপয় পরিজনের সহিত বাটীর বহির্গত হইলেন। যাইতে যাইতে মদলেখাকে জিজ্ঞাসিলেন, মদলেখে! পত্রলেখার কথা কি সত্য, চন্দ্রাপীড় কি আসিয়াছেন? আমার ত বিশ্বাস হয় না। তাঁহার তৎকালীন নির্দ্দয় আচরণ স্মরণ করিলে তাঁহার আর কোন কথায় শ্রদ্ধা হয় না। আমার হৃদয় কম্পিত হইতেছে। পাছে তাঁহার আগমন বিষয়ে হতাশ হইয়া বিষণ্ণ চিত্তে ফিরিয়া আসিতে হয়। বলিতে বলিতে দক্ষিণ চক্ষু স্পন্দ হইল। ভাবিলেন এ আবার কি! বিধাতা কি এখনও পরিতৃপ্ত হন নাই? আবারও দুঃখে নিক্ষিপ্ত করিবেন? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে মহাশ্বেতার আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সকলেই বিষণ্ণ সকলের মুখেই দুঃখের চিহ্ন প্রকাশ পাইতেছে। অনন্তর ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া পুষ্পশূন্য উদ্যানের ন্যায়, পল্লবশূন্য তরুর ন্যায়, বারিশূন্য সরোবরের ন্যায়, প্রাণশূন্য চন্দ্রাপীড়ের দেহ পতিত রহিয়াছে, দেখিতে পাইলেন। দেখিবামাত্র মূর্চ্ছাপন্ন হইয়া ভূতলে পড়িলেন, অমনি মদলেখা ধরিল। পত্রলেখা অচেতন হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতে লাগিল। কাদম্বরী অনেক ক্ষণের পর চেতন হইয়া সস্পৃহ লোচনে চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র দেখিলেন এবং ছিন্নমূলা লতার ন্যায় ভূতলে পতিত হইয়া শিরে করাঘাত করিতে লাগিলেন।
মদলেখা কাদম্বরীর চরণে পতিত হইয়া আর্ত্তস্বরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আহা তোমা বই মদিরা ও চিত্ররথের কেহ নাই! তোমার হৃদয় বিদীর্ণ হইল, বোধ হইতেছে। প্রসন্ন হও, ধৈর্য্য, অবলম্বন কর। মদলেখার কথায় হাস্য করিয়া কহিলেন, অয়ি উন্মত্তে! ভয় কি? আমার হৃদয় পাষাণে নির্ম্মিত তাহা কি তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই? ইহা বজ্র অপেক্ষাও কঠিন তাহা কি তুমি জানিতে পার নাই? যখন এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখিবামাত্র বিদীর্ণ হয় নাই, তখন আর বিদীর্ণ হইবার আশঙ্কা কি? হা এখনও জীবিত আছি! মরিবার এমন সময় আর কবে পাইব? সমুদায় দুঃখ ও সকল সন্তাপ শান্তি হইবার শুভ দিন উপস্থিত হইয়াছে। আহা আমার কি সৌভাগ্য! মরিবার সময় প্রাণেশ্বরের মুখকমল দেখিতে পাইলাম। জীবিতেশ্বরকে পুনর্ব্বার দেখিতে পাইব, এরূপ প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু বিধাতা অনুকূল হইয়া তাহাও ঘটাইয়া দিলেন। তবে আর বিলম্ব কেন? জীবিত ব্যক্তিরাই পিতা, মাতা, বন্ধু, বান্ধব, পরিজন ও সখীগণের অপেক্ষা করে। এখন আর তাঁহাদিগের অনুরোধ কি? এত দিনে সকল ক্লেশ দূর হইল, সকল যাতনা শান্তি হইল, সকল সন্তাপ নির্ব্বাণ হইল। যাহার নিমিত্ত লজ্জা, ধৈর্য্য, কুলমর্য্যাদা পরিত্যাগ করিয়াছি; বিনয়ে জলাঞ্জলি দিয়াছি; গুরুজনের অপেক্ষা পরিহার করিয়াছি; সখীদিগকে যৎপরোনাস্তি যাতনা দিয়াছি; প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়াছি; সে জীবন-সর্ব্বস্ব প্রাণেশ্বর প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন, আমি এখনও জীবিত আছি! সখি! তুমি আবার সেই ঘৃণাকর, লজ্জাকর প্রাণ রাখিতে অনুরোধ করিতেছ! এ সময় সুখে মরিবার সময়, তুমি বাধা দিও না।
যদি আমার প্রতি প্রিয়সখীর স্নেহ থাকে ও আমার প্রিয়কার্য্য করিতে ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে শোকে পিতা মাতার যাহাতে দেহ অবসান না হয়, বাসভবন শূন্য দেখিয়া সখীজন ও পরিজনেরা যাহাতে দিগ্দিগন্তে প্রস্থান না করে, এরূপ করিও। অঙ্গনমধ্যবর্ত্তী সহকারপোতকের সহিত তৎপার্শ্ববর্ত্তিনী মাধবীলতার বিবাহ দিও। সাবধান, যেন মদারোপিত অশোকতরুর বাল পল্লব কেহ খণ্ডন না করে। শয়নের শিরোভাগে কামদেবের যে চিত্রপট আছে, তাহা গতমাত্র পাটিত করিও। কালিন্দী শারিকা ও পরিহাস শুককে বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া দিও। আমার প্রীতিপাত্র হরিণটীকে কোন তপোবনে রাখিয়া আসিও। নকুলীকে আপন অঙ্কে সর্ব্বদা রাখিও। ক্রীড়াপর্ব্বতে যে জীবঞ্জীবকমিথুন এবং আমার পাদসহচরী যে হংসশাবক আছে, তাহারা যাহাতে বিপন্ন না হয়, এরূপ তত্ত্বাবধান করিও। বনমানুষী কখন গৃহে বাস করে না, অতএব তাহাকে বনে ছাড়িয়া দিও। কোন তপস্বীকে ক্রীড়াপর্ব্বত প্রদান করিও। আমার এই অঙ্গের ভূষণ গ্রহণ কর, ইহা কোন দীন ব্রাহ্মণকে সমর্পণ করিও। বীণা ও অন্য সামগ্রী যাহা তোমার রুচি হয় আপনি রাখিও। আমি এক্ষণে বিদায় হইলাম, আইস, একবার জন্মের শোধ আলিঙ্গন ও কণ্ঠগ্রহণ করিয়া শরীর শীতল করি। চন্দ্রকিরণে, চন্দনরসে, শীতল জলে, সুশীতল শিলাতলে, কমলিনীপত্রে, কুমুদ কুবলয় ও শৈবালের শয্যায় আমার গাত্র দগ্ধ ও জর্জ্জরিত হইয়াছে। এক্ষণে প্রাণেশ্বরের কণ্ঠ গ্রহণ পূর্ব্বক উজ্জ্বলিত চিতানলে শরীর নির্ব্বাপিত করি। মদলেখাকে এই কথা বলিয়া মহাশ্বেতার কণ্ঠ ধারণ পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়সখি! তুমি আশারূপ মৃগতৃষ্ণিকায় মোহিত হইয়া ক্ষণে ক্ষণে মরণাধিক যন্ত্রণা অনুভব করিয়া সুখে জীবন ধারণ করিতেছ। এই অভাগিনীর আবার সে আশাও নাই। এক্ষণে জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা, যেন জন্মান্তরে প্রিয়সখীর দেখা পাই। এই বলিয়া চন্দ্রাপীড়ের চরণদ্বয় অঙ্কে ধারণ করিলেন। স্পর্শমাত্রে চন্দ্রাপীড়ের দেহ হইতে উজ্জ্বল জ্যোতিঃ উদ্গত হইল। জ্যোতির উজ্জ্বল আলোকে ক্ষণকাল সেই প্রদেশ কৌমুদীময় বোধ হইল।
অনন্তর অন্তরীক্ষে এই বাণী বিনির্গত হইল, “বৎসে মহাশ্বেতে! আমার কথার আশ্বাসে তুমি জীবন ধারণ করিতেছ। অবশ্য প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ হইবে, সন্দেহ করিও না। পুণ্ডরীকের শরীর আমার তেজঃস্পর্শে অবিনাশি ও অবিকৃত হইয়া মদীয় লোকে আছে। চন্দ্রাপীড়ের এই শরীরও মত্তেজোময় অবিনাশি। বিশেষতঃ কাদম্বরীর করস্পর্শ হওয়াতে ইহার আর ক্ষয় নাই। শাপদোষে এই দেহ জীবনশূন্য হইয়াছে, যোগিশরীরের ন্যায় পুনর্ব্বার জীবাত্মা সংযুক্ত হইবে। তোমাদের প্রত্যয়ের নিমিত্ত ইহা এই স্থানেই থাকিল, অগ্নিসংস্কার বা পরিত্যাগ করিও না। যত দিন পুনর্জীবিত না হয়, প্রযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করিও।”
আকাশবাণী শ্রবণান্তর সকলে বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়া চিত্রিতের ন্যায় নিমেষশূন্য লোচনে গগনে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। চন্দ্রাপীড়ের শরীরোদ্ভূতজ্যোতিঃস্পর্শে পত্রলেখার মূর্চ্ছাপনয় ও চৈতন্যোদয় হইল। তখন সে উন্মত্তের ন্যায় সহসা গাত্রোত্থান করিয়া, ইন্দ্রায়ুধের নিকটে অতি বেগে গমন করিয়া কহিল, রাজকুমার প্রস্থান করিলেন, তোমার আর একাকী থাকা উচিত নয়। এই বলিয়া রক্ষকের হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক বল্গা গ্রহণ করিয়া তাহার সহিত অচ্ছোদসরোবরে ঝম্প প্রদান করিল। ক্ষণকালের মধ্যে জলে নিমগ্ন হইয়া গেল। অনন্তর জটাধারী এক তাপসকুমার সহসা জলমধ্য হইতে সমুত্থিত হইলেন। তাঁহার মস্তকে শৈবাল লাগাতে ও গাত্র হইতে বিন্দু বিন্দু বারি পতিত হওয়াতে প্রথমে বোধ হইল যেন, জলমানুষ। মহাশ্বেতা সেই তাপসকুমারকে পরিচিতপূর্ব্ব ও দৃষ্টপূর্ব্ব বোধ করিয়া এক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন। তিনিও নিকটে আসিয়া মৃদু স্বরে কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! আমাকে চিনিতে পার? মহাশ্বেতা শোক, বিস্ময় ও আনন্দের মধ্যবর্ত্তিনী হইয়া, সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। গদ্গদ বচনে কহিলেন, ভগবন্ কপিঞ্জল! এই হতভাগিনীকে সেইরূপ বিষম সঙ্কটে রাখিয়া আপনি কোথায় গিয়াছিলেন? এত কাল কোথায় ছিলেন? আপনার প্রিয় সখাকে কোথায় রাখিয়া আসিতেছেন?
মহাশ্বেতা এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে কাদম্বরী, কাদম্বরীর পরিজন ও চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গিগণ সকলে, বিস্ময়াপন্ন হইয়া তাপসকুমারের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। তিনি প্রতিবচন প্রদান করিতে আরম্ভ করিয়া কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। তুমি সেইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছিলে, তোমাকে একাকিনী রাখিয়া, “রে দুরাত্মন্! বন্ধুকে লইয়া কোথায় যাইতেছিস্” এই কথা বলিতে বলিতে অপহরণকারী সেই পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। তিনি আমার কথায় কিছুই উত্তর না দিয়া স্বর্গমার্গে উপস্থিত হইলেন। বৈমানিকেরা বিস্ময়োৎফুল্ল নয়নে দেখিতে লাগিল। দিব্যাঙ্গনারা ভয়ে পথ ছাড়িয়া দিল। আমি ক্রমাগত পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। তিনি চন্দ্রলোকে উপস্থিত হইলেন। তথায় মহোদয়নাম্নী সভার মধ্যে চন্দ্রকান্তমণিনির্ম্মিত পর্য্যঙ্কে প্রিয় সখার শরীর সংস্থাপিত করিয়া কহিলেন, কপিঞ্জল! আমি চন্দ্রমা, জগতের হিতের নিমিত্ত গগনমণ্ডলে উদিত হইয়া স্বকার্য্য সম্পাদন করিতেছিলাম। তোমার এই প্রিয় বয়স্য বিরহবেদনায় প্রাণত্যাগ করিবার সময় বিনাপরাধে আমাকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “রে দুরাত্মন্! যেহেতু তুই কর দ্বারা সন্তাপিত করিয়া বল্লভার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত এই ব্যক্তির প্রাণ বিনাশ করিলি, এই অপরাধে তোকে ভূতলে বারংবার জন্ম গ্রহণ করিতে হইবেক এবং আমার ন্যায় অনুরাগপরবশ হইয়া প্রিয়বিয়োগে দুঃসহ যন্ত্রণা অনুভব করিতে হইবেক।” বিনাপরাধে শাপ দেওয়াতে আমি ক্রোধান্ধ হইলাম, এবং বৈরনির্য্যাতনের নিমিত্ত এই বলিয়া প্রতিশাপ প্রদান করিলাম, “রে মূঢ়! তুই এবার যেরূপ যাতনা ভোগ করিলি, বারংবার তোকে এইরূপ যাতনা ভোগ করিতে হইবেক।” ক্রোধ শান্তি হইলে ধ্যান করিয়া দেখিলাম, আমার কিরণ হইতে অপ্সরাদিগের যে কুল উৎপন্ন হয়, সেই কুলে গৌরীনাম্নী গন্ধর্ব্বকুমারী জন্ম গ্রহণ করেন; তাঁহার দুহিতা মহাশ্বেতা এই মুনিকুমারকে পতি রূপে বরণ করিয়াছে। তখন সাতিশয় অনুতাপ হইল। কিন্তু শাপ দিয়াছি আর উপায় কি? এক্ষণে উভয়ের পাপে উভয়কেই মর্ত্ত্যলোকে দুই বার জন্ম গ্রহণ করিতে হইবেক, সন্দেহ নাই। যাবৎ পাপের অবসান না হয়, তাবৎ তোমার বন্ধুর মৃত দেহ এই স্থানে থাকিবেক। আমার সুধাময় করস্পর্শে ইহা বিকৃত হইবেক না। শাপাবসানে এই শরীরেই পুনর্ব্বার প্রাণসঞ্চার হইবেক, এই নিমিত্ত ইহা এখানে আনিয়াছি। মহাশ্বেতাকেও আশ্বাস প্রদান করিয়া আসিয়াছি। তুমি এখানে মহর্ষি শ্বেতকেতুর নিকটে গিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিশেষ করিয়া তাঁহার সমক্ষে বর্ণন কর। তিনি মহাপ্রভাব, অবশ্য কোন প্রতিকার করিতে পারিবেন।
চন্দ্রমার আদেশানুসারে আমি দেবমার্গ গিয়া শ্বেতকেতুর নিকট যাইতেছিলাম। পথিমধ্যে অতি কোপনস্বভাব এক বিমানচারীর উল্লঙ্ঘন করাতে তিনি ভ্রূকুটীভঙ্গী দ্বারা রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক আমার প্রতি নেত্রপাত করিলেন। তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, রোষানলে আমাকে দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন! অনন্তর “দুরাত্মন্! তুই মিথ্যা তপোবলে গর্ব্বিত হইয়াছিস, তুরঙ্গমের ন্যায় লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক আমায় উল্লঙ্ঘন করিলি। অতএব তুরঙ্গম হইয়া ভূতলে জন্মগ্রহণ কর!” তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক এই বলিয়া শাপ প্রদান করিলেন। আমি বাষ্পাকুল নয়নে কৃতাঞ্জলিপুটে নানা অনুনয় করিয়া কহিলাম, ভগবন্! বয়স্যের বিরহ শোকে অন্ধ হইয়া এই দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি, অবজ্ঞা প্রযুক্ত করি নাই। এক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। প্রসন্ন হইয়া, শাপ সংহার করুন। তিনি কহিলেন, আমার শাপ অন্যথা হইবার নহে। তুমি ভূতলে তুরঙ্গম রূপে অবতীর্ণ হইয়া যাহার বাহন হইবে, তাহার মরণান্তে স্নান করিয়া আপনার স্বরূপ প্রাপ্ত হইবে। আমি বিনয় পূর্ব্বক পুনর্ব্বার কহিলাম, ভগবন্! শাপদোষে চন্দ্রমা মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিবেন। আমি যেন তাঁহারই বাহন হই। তিনি ধ্যান প্রভাবে সমুদায় অবগত হইয়া কহিলেন, “হাঁ, উজ্জয়িনী নগরে তারাপীড় রাজা অপত্যপ্রাপ্তির আশয়ে ধর্ম্ম কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছেন। চন্দ্রমা তাঁহারই অপত্য হইয়া ভূতলে অবতীর্ণ হইবেন। তোমার প্রিয় বয়স্য পুণ্ডরীক ঋষিও রাজমন্ত্রী শুকনাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন। তুমিও রাজকুমার রূপে অবতীর্ণ চন্দ্রের বাহন হইবে।” তাঁহার কথার অবসানে আমি সমুদ্রের প্রবাহে নিপতিত হইলাম ও তুরঙ্গরূপ ধারণ করিয়া তীরে উঠিলাম। তুরঙ্গম হইলাম বটে, কিন্তু আমার জন্মান্তরীণ সংস্কার বিনষ্ট হইল না। আমিই চন্দ্রাপীড়কে কিন্নরমিথুনের অনুগামী করিয়া এই স্থানে আনিয়াছিলাম। চন্দ্রাপীড় চন্দ্রের অবতার। যিনি জন্মান্তরীণ অনুরাগের পরতন্ত্র হইয়া তোমার প্রণয়াভিলাষে এই প্রদেশে আসিয়াছিলেন ও তোমার শাপে বিনষ্ট হইয়াছেন, তিনি আমার প্রিয় বয়স্য পুণ্ডরীকের অবতার।
মহাশ্বেতা কপিঞ্জলের কথা শুনিয়া, হা দেব! জন্মান্তরেও তুমি আমার প্রণয়ানুরাগ বিস্মৃত হইতে পার নাই। আমারই অন্বেষণ করিতে করিতে এই স্থানে আগমন করিয়াছিলে; আমি নৃশংসা রাক্ষসী বারংবার তোমার বিনাশের হেতুভূত হইলাম। দগ্ধবিধি আমাকে আপন প্রয়োজন সম্পাদনের সাধন করিবে বলিয়াই কি এত দীর্ঘ পরমায়ু প্রদান পূর্ব্বক আমার নির্ম্মাণ করিয়াছিল! কপিঞ্জল প্রবোধবাক্যে কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! শাপদোষে সেই সেই ঘটনা হইয়াছে, তোমার দোষ কি? এক্ষণে যাহাতে পরিণামে শ্রেয়ঃ হয়, তাহার চেষ্টা পাও। যে ব্রত অঙ্গীকার করিয়াছ, তাহাতেই একান্ত অনুরক্ত হও। তপস্যার অসাধ্য কিছুই নাই। পার্ব্বতী যেরূপ তপস্যার প্রভাবে পশুপতির প্রণয়িনী হইয়াছেন, তুমিও সেইরূপ পুণ্ডরীকের সহধর্ম্মিণী হইবে, সন্দেহ করিও না। কপিঞ্জলের সান্ত্ত্বনাবাক্যে মহাশ্বেতা ক্ষান্ত হইলেন। কাদম্বরী বিষণ্ণ বদনে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্! পত্রলেখাও ইন্দ্রায়ুধের সহিত জলপ্রবেশ করিয়াছিল। শাপগ্রস্ত ইন্দ্রায়ুধরূপ পরিত্যাগ করিয়া আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু পত্রলেখা কোথায় গেল, শুনিতে অতিশয় কৌতুক জন্মিয়াছে, অনুগ্রহ করিয়া ব্যক্ত করুন। কপিঞ্জল কহিলেন, জলপ্রবেশানন্তর যে যে ঘটনা হইয়াছে তাহা আমি অবগত নহি। চন্দ্রের অবতার চন্দ্রাপীড় ও পুণ্ডরীকের অবতার বৈশম্পায়ন কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং পত্রলেখা কোথা গিয়াছে, জানিবার নিমিত্ত কালত্রয়দর্শী ভগবান্ শ্বেতকেতুর নিকট গমন করি। এই বলিয়া কপিঞ্জল গগনমার্গে উঠিলেন।
তিনি প্রস্থান করিলে রাজপরিজনেরা বিস্ময়ে শোক সন্তাপ বিস্মৃত হইল। চন্দ্রাপীড়ের ও বৈশম্পায়নের পুনরুজ্জীবন পর্য্যন্ত এই স্থানে থাকিতে হইবেক স্থির করিয়া বাসস্থান নিরূপণ করিল ও তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিল। কাদম্বরী মহাশ্বেতাকে কহিলেন, প্রিয়সখি! বিধাতা এই হতভাগিনীদিগকে দুঃখের সমান অংশভাগিনী করিয়া পরস্পর দৃঢ়তর সখ্যবন্ধন করিয়া দিলেন। আজি তোমাকে প্রিয়সখী বলিয়া সম্বোধন করিতে লজ্জা বোধ হইতেছে না। ফলতঃ এত দিনের পর আজি আমি তোমার যথার্থ প্রিয়সখী হইলাম। এক্ষণে কর্ত্তব্য কি উপদেশ দাও। কি করিলে শ্রেয়ঃ হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। মহাশ্বেতা উত্তর করিলেন, প্রিয়সখি! কি উপদেশ দিব! আশাকে কেহ অতিক্রম করিতে পারে না। আশা লোকদিগকে যে পথে লইয়া যায়, লোকেরা সেই পথে যায়। আমি কেবল কথামাত্রের আশ্বাসে প্রাণত্যাগ করিতে পারি নাই। তুমি ত কপিঞ্জলের মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত বিশেষ রূপে অবগত হইলে। যাবৎ চন্দ্রাপীড়ের শরীর অবিকৃত থাকে, তাবৎ ইহার রক্ষণাবেক্ষণ কর। শুভ ফল প্রাপ্তির আশয়ে লোকে অপ্রত্যক্ষ দেবতার কাষ্ঠময়, মৃন্ময়, প্রস্তরময় প্রতিমাও পূজা করিয়া থাকে। তুমি ত প্রত্যক্ষ দেবতা চন্দ্রমার সাক্ষাৎ মূর্ত্তি লাভ করিয়াছ। তোমার ভাগ্যের পরিসীমা নাই এক্ষণে যত্ন পূর্ব্বক রক্ষা ও ভক্তিভাবে পরিচর্য্যা কর।
মদলেখা ও তরলিকা ধরাধরি করিয়া শীত, বাত, আতপ ও বৃষ্টির জল না লাগে এমন স্থানে, এক শিলার উপরে চন্দ্রাপীড়ের মৃত দেহ আনিয়া রাখিল। যিনি নানা বেশভূষায় ভূষিত হইয়া হর্ষোৎফুল্ল লোচনে প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে এক্ষণে দীন বেশে ও দুঃখিত চিত্তে তপস্বিনীর আকার অঙ্গীকার করিতে হইল! বিকসিত কুসুম, সুগন্ধি চন্দন, সুরভি ধূপ, যাহা উপভোগের প্রধান সামগ্রী ছিল, তাহা এক্ষণে দেবার্চ্চনায় নিযুক্ত হইল। এক্ষণে নির্ঝরবারি দর্পণ, গিরিগুহা গৃহ, লতা সখী, বৃক্ষগণ রক্ষক, তরুশাখা চন্দ্রাতপ ও কেকারব তন্ত্রীঝঙ্কার হইল। দূর হইতে আগমন করাতে ও সহসা সেই দুঃসহ শোকানলে পতিত হওয়াতে কাদম্বরীর কণ্ঠ শুষ্ক হইয়াছিল; তথাপি পান ভোজন কিছুই করিলেন না। সরোবরে স্নান করিয়া পবিত্র দুকূল পরিধান করিলেন এবং প্রিয়তমের পাদদ্বয় অঙ্কে ধারণ করিয়া দিবস অতিবাহিত করিলেন। রজনী সমাগত হইল। একে বর্ষাকাল, তাহাতে অন্ধকারাবৃত রজনী। চতুর্দ্দিকে মেঘ, মূষলধারে বৃষ্টি, ক্ষণে ক্ষণে বজ্রের নির্ঘাত ও মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের দুঃসহ আলোক। খদ্যোতমালা অন্ধকারাচ্ছন্ন তরুমণ্ডলীকে আবৃত করিয়া আরও ভয়ঙ্কর করিল। গিরিনির্ঝরের পতনশব্দ, ভেকের কোলাহল ও ময়ূরের কেকারবে বন আকুল হইল। কিছুই দেখা যায় না। কিছুই কর্ণগোচর হয় না। কি ভয়ানক সময়! এ সময়ে জনপদবাসী সাহসী পুরুষের মনেও ভয়সঞ্চার হয়; কিন্ত কাদম্বরী সেই অরণ্যে প্রিয়তমের মৃতদেহ সম্মুখে রাখিয়া সেই ভয়ঙ্করী বর্ষাবিভাবরী যাপিত করিলেন।
প্রভাতে অরুণ উদিত হইলে প্রিয়তমের শরীরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিছুমাত্র বিশ্রী হয় নাই; বরং অধিক উজ্জ্বল বোধ হইতেছে। তখন আহ্লাদিত চিত্তে মদলেখাকে কহিলেন, মদলেখে! দেখ, দেখ! প্রাণেশ্বরের শরীর যেন সজীব বোধ হইতেছে। মদলেখা নিমেষশূন্য নয়নে অনেক ক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! জীবনবিরহে এই দেহ কেবল চেষ্টাশূন্য; নতুবা সেই রূপ, সেই লাবণ্য, কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই। কপিঞ্জল যে শাপবিবরণ বর্ণন করিয়া গেলেন এবং আকাশবাণী দ্বারা যাহা ব্যক্ত হইয়াছে, তাহা সত্য, সংশয় নাই। কাদম্বরী আনন্দিত মনে মহাশ্বেতাকে, তদনন্তর চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গিগণকে সেই শরীর দেখাইলেন। সঙ্গিগণ বিস্ময়বিকসিত নয়নে যুবরাজের শরীরশোভা দেখিতে লাগিল। কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, দেবি! মৃত দেহ অবিকৃত থাকে, ইহা আমরা কখন দেখি নাই, শ্রবণও করি নাই। ইহা অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার সন্দেহ নাই। এক্ষণে আপনার প্রভাববলে ও তপস্যার ফলে যুবরাজ পুনর্জীবিত হইলে সকলে চরিতার্থ হই। পর দিনও সেইরূপ উজ্জ্বল শরীরসৌষ্ঠব দেখিয়া আকাশবাণীর কোন অংশে আর সংশয় রহিল না। তখন কাদম্বরী কহিলেন, মদলেখে! আশার শেষ পর্য্যন্ত এই স্থানে অবস্থিতি করিতে হইবেক। অতএব তুমি বাটী যাও ও এই বিস্ময়াবহ ব্যাপার পিতা মাতার কর্ণগোচর কর। তাঁহারা যাহাতে বিরূপ না ভাবেন, দুঃখিত না হন এবং এখানে না আইসেন, এরূপ করিও। এখানে আসিলে তাঁহাদিগকে দেখিয়া শোকাবেগ ধারণ করিতে পারিব না। সেই বিষম সময়ে অমঙ্গলভয়ে আমার নেত্রযুগল হইতে অশ্রুজল বহির্গত হয় নাই। এক্ষণে জীবিতনাথের পুনঃপ্রাপ্তিবিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধচিত্ত হইয়াও কেন বৃথা রোদন দ্বারা প্রিয়তমের অমঙ্গল ঘটাইব? এই বলিয়া মদলেখাকে বিদায় করিলেন।
মদলেখা গন্ধর্ব্বনগর হইতে প্রত্যাগত হইয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! তোমার অভীষ্টসিদ্ধি হইয়াছে। মহারাজ ও মহিষী আদ্যোপান্ত সমুদায় শ্রবণ করিয়া সস্নেহে কহিলেন, “বৎসে কাদম্বরি! চন্দ্রসমীপবর্ত্তিনী রোহিণীর ন্যায় তোমাকে জামাতার পার্শ্ববর্ত্তিনী দেখিব ইহা মনে প্রত্যাশা ছিল না। স্বাভিলষিত ভর্ত্তাকে স্বয়ং বরণ করিয়াছ, তিনি আবার চন্দ্রমার অবতার শুনিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলাম। শাপাবসানে জামাতা জীবিত হইলে, তাঁহার সহচারিণী তোমাকে দেখিয়া জীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিব। এক্ষণে আকাশবাণীর অনুসারে ধর্ম্ম কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। যাহাতে পরিণামে শ্রেয়ঃ হয় তাহার উপায় দেখ।” মদলেখার মুখে পিতা মাতার স্নেহ সংবলিত মধুর বাক্য শুনিয়া কাদম্বরীর উদ্বেগ দূর হইল।
ক্রমে বর্ষাকাল গত ও শরৎকাল আগত হইল। মেঘের অপগমে দিঙ্মণ্ডল যেন প্রসারিত হইল। মার্তণ্ড প্রচণ্ড কিরণদ্বারা পঙ্কময় পথ শুষ্ক করিয়া দিলেন। নদ, নদী, সরোবর ও পুষ্করিণীর কলুষিত সলিল নির্ম্মল হইল। মরালকুল নদীর সিকতাময় পুলিনে সুমধুর কলরব করিয়া কেলি করিতে লাগিল। গ্রামসীমায় পিঙ্গল কলমঞ্জরী ফলভরে অবনত হইল। শুকসারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণ ধান্যশীষ মুখে করিয়া শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গগনের উপরিভাগে অপূর্ব্ব শোভা বিস্তার করিল। কাশকুসুম বিকসিত হইল। ইন্দীবর, কহ্লার শেফালিকা প্রভৃতি নানা কুসুমের গন্ধযুক্ত বিশদবারিশীকরসম্পৃক্ত সমীরণ মন্দ মন্দ সঞ্চারিত হইয়া জীবগণের মনে আহ্লাদ জন্মিয়া দিল। সকল অপেক্ষা শশধরের প্রভা ও কমলবনের শোভা উজ্জ্বল হইল। এই কাল কি রমণীয়! লোকের গতায়াতের কোন ক্লেশ থাকে না। যে দিকে নেত্রপাত করা যায়, ধান্যমঞ্জরীর শোভা নয়ন ও মনকে পরিতৃপ্ত করে। জল দেখিলে আহ্লাদ জন্মে! চন্দ্রোদয়ে রজনীর সাতিশয় শোভা হয়। নভোমণ্ডল সর্ব্বদা নির্ম্মল থাকে। ভীষণ বর্ষাকালের অপগমে শরৎকালের মনোহর শোভা দেখিয়া কাদম্বরীর দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তও অনেক সুস্থ হইল।
একদা মেঘনাদ আসিয়া কহিল, দেবি! যুবরাজের বিলম্ব হওয়াতে মহারাজ, মহিষী ও মন্ত্রী অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া অনেক দূত পাঠাইয়াছেন। আমরা তাহাদিগকে সমুদায় বৃত্তান্ত শ্রবণ করাইয়া বাটী যাইতে অনুরোধ করাতে কহিল, আমরা এক বার যুবরাজের অবিকৃত আকৃতি দেখিতে অভিলাষ করি। এতদূর আসিয়া যদি তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে দেখিয়া না যাই, মহারাজ কি বলিবেন, মহিষীকে কি বলিয়া বুঝাইব? এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন। উপস্থিত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলে শ্বশুরকুলে শোক তাপের পরিসীমা থাকিবে না। এই চিন্তা করিয়া কাদম্বরী অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলেন। বাস্পালকু [sic: বাস্পাকুল] লোচনে গদ্গদ বচনে কহিলেন, হাঁ, তাহারা অযুক্ত কথা কহে নাই। যে অদ্ভুত, অলৌকিক ব্যাপার উপস্থিত, ইহা স্বচক্ষে দেখিলেও প্রত্যয় হয় না। না দেখিয়া মহারাজের নিকটে গিয়া তাহারা কি বলিবে? কি বলিয়াই বা মহিষীকে বুঝাইবে? যাঁহাকে ক্ষণমাত্র অবলোকন করিলে আর বিস্মৃত হইতে পারা যায় না, ভৃত্যেরা তাঁহার চিরকালীন স্নেহ কি রূপে বিস্মৃত হইবে? শীঘ্র তাহাদিগকে আনয়ন কর। যুবরাজের অবিকৃত শরীরশোভা দেখিয়া তাহাদিগের আগমনশ্রম সফল হউক। অনন্তর দূতগণ আশ্রমে প্রবেশিয়া কাদম্বরীকে প্রণাম করিল। সজল নয়নে রাজকুমারের অঙ্গসৌষ্ঠব দেখিতে লাগিল। কাদম্বরী কহিলেন, তোমরা স্নেহসুলভ শোকাবেগ পরিত্যাগ কর। নিরবধি দুঃখকেই দুঃখ বলিয়া গণনা করা উচিত; কিন্তু ইহা সেরূপ নয়, ইহাতে পরিণামে মঙ্গলের প্রত্যাশা আছে। এই বিস্ময়কর ব্যাপারে শোকের অবসর নাই। এরূপ ঘটনা কেহ কখন দেখে নাই, শ্রবণও করে নাই। প্রাণবায়ু প্রয়াণ করিলে শরীর অবিকৃত থাকে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয়। এক্ষণে তোমরা প্রতিগমন কর। এবং উৎকণ্ঠিতচেতা মহারাজকে এইমাত্র বলিও যে, আমরা অচ্ছোদসরোবরে যুবরাজকে দেখিয়া আসিতেছি। উপস্থিত ঘটনা প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই। প্রকাশ করিলে মহারাজের কখন বিশ্বাস হইবে না, প্রত্যুত শোকে তাঁহার প্রাণ বিগমের সম্ভাবনা।
দূতেরা কহিল, দেবি! হয় আমরা না যাই, অথবা গিয়া না বলি, ইহা হইলে এই ব্যাপার অপ্রকাশিত থাকিতে পারে; কিন্তু দুই অসম্ভব। বৈশম্পায়নের অন্বেষণ করিতে আসিয়া যুবরাজের বিলম্ব হওয়াতে মহারাজ অতিশয় ব্যাকুল হইয়া আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন। আমরা না যাইলে বিষম অনর্থ ঘটিবার সম্ভাবনা। গিয়া তনয়বার্ত্তাশ্রবণলালস মহারাজ, মহিষী ও শুকনাসের উৎকণ্ঠিত বদন অবলোকন করিলে নির্ব্বিকার চিত্তে স্থির হইয়া থাকিতে পারিব, ইহাও অসম্ভব। কাদম্বরী কহিলেন, হাঁ অলীক কথায় প্রভুকে প্রতারণা করাও পরিচিত ব্যক্তির উচিত নয়, তাহা বুঝিয়াছি। কিন্তু গুরুজনের মনঃপীড়া পরিহারের আশয়ে ঐরূপ বলিয়াছিলাম। যাহা হউক মেঘনাদ! দূতদিগের সমভিব্যাহারে এরূপ একটী বিশ্বস্ত লোক পাঠাইয়া দেও, যে সমুদায় ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং বিশেষরূপে সমুদায় বিবরণ বলিতে পারিবে। মেঘনাদ কহিল, দেবি! আমরা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, যত দিন যুবরাজ পুনর্জ্জীবিত না হইবেন তাবৎ বন্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া বনে বাস করিব; কদাচ পরিত্যাগ করিয়া যাইব না। সেই ভৃত্যেই ভৃত্য, যে সম্পৎকালের ন্যায় বিপৎকালেও প্রভুর সহবাসী হয়। কিন্তু আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করাও আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম। এই বলিয়া ত্বরিতকনামা এক বিশ্বস্ত সেবককে ডাকাইয়া দূতগণের সমভিব্যাহারে রাজধানী পাঠাইয়া দিল।
এ দিকে মহিষী বহুদিবস চন্দ্রাপীড়ের সংবাদ না পাইয়া অতিশয় উদ্বিগ্ন ছিলেন। একদা উপযাচিতক করিতে দেবমন্দিরে সমাগত হইয়াছেন এমন সময়ে, পরিজনেরা আসিয়া কহিল, দেবি! দেবতারা বুঝি এতদিনে প্রসন্ন হইলেন; যুবরাজের সংবাদ আসিয়াছে। পরিজনের মুখে এই কথা শুনিয়া মহিষীর নয়ন আনন্দবাস্পে পরিপ্লুত হইল। শাবকভ্রষ্ট হরিণীর ন্যায় চতুর্দ্দিকে চঞ্চল চক্ষু নিক্ষেপ করিয়া গদ্গদ বচনে কহিলেন, কই কে আসিয়াছে? এরূপ শুভ সংবাদ কে শুনাইল? বৎস চন্দ্রাপীড় ত কুশলে আছেন? মনের ঔৎসুক্য প্রযুক্ত এই কথা বারংবার বলিতে বলিতে স্বয়ং বার্ত্তাবহদিগের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন। সজল নয়নে কহিলেন, বৎস! শীঘ্র চন্দ্রাপীড়ের কুশল সংবাদ বল। আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে। চন্দ্রাপীড়কে তোমরা কোথায় দেখিলে? তিনি কেমন আছেন শীঘ্র বল। তাহারা মহিষীর কাতরতা দেখিয়া অত্যন্ত শোকাকুল হইল এবং প্রণামব্যপদেশে নেত্রজল মোচন করিয়া কহিল, আমরা আচ্ছোদসরোবরতীরে যুবরাজকে দেখিয়াছি। অন্যান্য সংবাদ এই ত্বরিতক নিবেদন করিতেছে, শ্রবণ করুন।
মহিষী তাহাদিগের বিষণ্ণ আকার দেখিয়াই অমঙ্গল সম্ভাবনা করিতেছিলেন, তাহাতে আবার, ত্বরিতক আর আর সংবাদ নিবেদন করিতেছে, এই কথা শুনিয়া বিষণ্ণ হইয়া ভূতলে পড়িলেন। শিরে করাঘাত পূর্ব্বক হা হতাস্মি বলিয়া বিলাপ করিয়া কহিলেন, ত্বরিতক আর কি বলিবে? তোমাদিগের বিষণ্ণ বদন, কাতর বচন ও হর্ষশূন্য আগমনেই সকল ব্যক্ত হইয়াছে। হা বৎস! জগদেকচন্দ্র! চন্দ্রানন! তোমার কি ঘটিয়াছে? কেন তুমি বাটী আসিলে না? শীঘ্র আসিব বলিয়া গেলে কই তোমার সে কথা কোথায় রহিল? কখন আমার নিকট মিথ্যা বল নাই এবারে কেন প্রতারণা করিলে? তোমার যাত্রার সময় আমার অন্তঃকরণে শঙ্কা হইয়াছিল, বুঝি সেই শঙ্কা সত্য হইল। তোমার সেই প্রফুল্ল মুখ আর দেখিতে পাইব না! তুমি কি এক বারে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছ? বস এক বার আসিয়া আমার অঙ্কের ভূষণ হও এবং মধুর স্বরে মা বলিয়া ডাকিয়া কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ কর। এই হতভাগিনীকে মা বলিয়া সম্বোধন করে, এমন আর নাই। তুমি কখন আমার কথা উল্লঙ্ঘন কর নাই, এক্ষণে আমার কথা শুনিতেছ না কেন? কি জন্য উত্তর দিতেছ না? তুমি এমন বিবেচনা করিও না যে, বিলাসবতী চন্দ্রাপীড়ের অস্তগমনেও জীবন ধারণ করিবে। ত্বরিতকের মুখে তোমার সংবাদ শুনিতে ভয় হইতেছে। উহা যেন শুনিতে না হয়। এই বলিয়া মহিষী মোহ প্রাপ্ত হইলেন।
বিলাসবতী দেবমন্দিরে মোহ প্রাপ্ত হইয়া পড়িয়া আছেন, শুনিয়া মহারাজ অতিশয় চঞ্চল ও ব্যাকুল হইলেন। শুকনাসের সহিত তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, কেহ কদলীদল দ্বারা বীজন, কেহ জলসেচন, কেহ বা শীতল পাণিতল দ্বারা মহিষীর গাত্রস্পর্শ করিতেছে। ক্রমে মহিষীর চৈতন্যোদয় হইল এবং মুক্ত কণ্ঠে হা হতাস্মি বলিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজা প্রবোধবাক্যে কহিলেন, দেবি! যদি চন্দ্রাপীড়ের অত্যহিত ঘটিয়া থাকে, রোদন দ্বারা তাহার কি প্রতিকার হইবে? বিশেষতঃ সমুদায় বৃত্তান্ত শ্রবণ করা হয় নাই। অগ্রে বিশেষ রূপে সমুদায় শ্রবণ করা যাউক, পরে যাহা কর্ত্তব্য, করা যাইবেক। এই বলিয়া ত্বরিতককে ডাকাইলেন। জিজ্ঞাসিলেন, ত্বরিতক! চন্দ্রাপীড় কোথায় কিরূপ আছেন? বাটী আসিবার নিমিত্ত পত্র লিখিয়াছিলাম, আসিলেন না কেন? কি উত্তর দিয়াছেন? ত্বরিতক, যুবরাজের বাটী হইতে গমন অবধি হৃদয়বিদারণ পর্য্যন্ত সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিল। রাজা আর শুনিতে না পারিয়া আর্ত্তস্বরে বারণ করিয়া কহিলেন, ক্ষান্ত হও — ক্ষান্ত হও! আর বলিতে হইবে না। যাহা শুনিবার শুনিলাম। হা বৎস! হৃদয়বিদারণের ক্লেশ তুমিই অনুভব করিলে। বন্ধুর প্রতি যেরূপ প্রণয় প্রকাশ করিতে হয়, তাহার দৃষ্টান্ত পথে দণ্ডায়মান হইয়া পৃথিবীর প্রশংসাপাত্র হইলে। স্নেহ প্রকাশের নবীন পথ উদ্ভাবিত করিলে। তুমিই সার্থকজন্মা মহাপুরুষ। আমরা পাপিষ্ঠ, নির্দ্দয়, নরাধম। যেন কৌতুকাবহ উপন্যাসের ন্যায় এই দুর্ব্বিষহ দারুণ বৃত্তান্ত অবলীলাক্রমে শুনিলাম, কই কিছুই হইল না। অরে ভীরু প্রাণ! ব্যাকুল হইতেছিস্ কেন? যদি স্বয়ং বহির্গত না হইস্ এবার বলপূর্ব্বক তোকে বহির্গত করিব। দেবি! প্রস্তুত হও, এ সময় কালক্ষেপের সময় নয়। চন্দ্রাপীড় একাকী যাইতেছেন, শীঘ্র তাঁহার সঙ্গী হইতে হইবে। আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। আঃ হতভাগ্য শুকনাস! এখনও বিলম্ব করিতেছ? প্রাণপরিত্যাগের এরূপ সময় আর কবে পাইবে? এই বেলা চিতা প্রস্তুত কর। প্রজ্জ্বলিত অনলশিখা আলিঙ্গন করিয়া তাপিত অঙ্গ শীতল করা যাউক। ত্বরিতক সভয়ে বিনীত বচনে নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি যেরূপ সম্ভাবনা ও শঙ্কা করিতেছেন সেরূপ নয়। যুবরাজের শরীর প্রাণবিযুক্ত হইয়াছে; কিন্তু অনির্ব্বচনীয় ঘটনাবশতঃ অবিকৃত আছে। এই বলিয়া আকাশবাণীর সমুদায় বিবরণ, ইন্দ্রায়ুধের কপিঞ্জলরূপ ধারণ ও শাপবৃত্তান্ত অবিকল বর্ণন করিল। উহা শ্রবণ করিয়া রাজার শোক বিস্ময়রসে পরিণত হইল। তখন বিস্মিত নয়নে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।
স্বয়ং শোকার্ণবে নিমগ্ন হইয়াও শুকনাস ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক সাক্ষাৎ জ্ঞানরাশির ন্যায় রাজাকে বুঝাইতে লাগিলেন। কহিলেন, মহারাজ! বিচিত্র এই সংসারে প্রকৃতির পরিণাম, জগদীশ্বরের ইচ্ছা, শুভাশুভ কর্ম্মের পরিপাক অথবা স্বভাববশতঃ নানাপ্রকার কার্য্যের উৎপত্তি হয় ও নানাবিধ ঘটনা উপস্থিত হইয়া থাকে। শাস্ত্রকারেরা এরূপ অনেক ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন, যাহা যুক্তি ও তর্কশক্তিতে আপাততঃ অলীক রূপে প্রতীয়মান হয়; কিন্তু বস্তুতঃ তাহা মিথ্যা নহে। ভুজঙ্গদষ্ট ও বিষবেগে অভিভূত ব্যক্তি মন্ত্রপ্রভাবে জাগরিত ও বিষমুক্ত হয়। যোগপ্রভাবে যোগীরা সকল ভূমণ্ডল করতলস্থিত বস্তুর ন্যায় দেখিতে পান। ধ্যানপ্রভাবে লোক অনেক কাল জীবিত থাকে। ইহার প্রমাণ আগম, রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি সমুদায় পুরাণে অনেকপ্রকার শাপবৃত্তান্তও বর্ণিত আছে। নহুষ রাজর্ষি অগস্ত্য ঋষির শাপে অজগর হইয়াছিলেন। বশিষ্ঠমুনির পুত্রের শাপে সৌদাস রাক্ষস হয়েন। শুক্রাচার্য্যের শাপে যযাতির যৌবনাবস্থায় জরা উপস্থিত হয়। পিতৃশাপে ত্রিশঙ্কু চণ্ডালকুলে জন্মপরিগ্রহ করেন। অধিক কি, জন্মমরণরহিত ভগবান্ নারায়ণও কখন জমদগ্নির আত্মজ, কখন বা রঘুবংশে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কখন বা মানবের ঔরসে জন্মপরিগ্রহ করিয়া লীলা প্রচার করিয়া থাকেন। অতএব মনুষ্যলোকে দেবতাদিগের উৎপত্তি অলীক বা অসম্ভব নয়। আপনি পূর্ব্বকালীন নৃপগণ অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহেন। চন্দ্রমাও চক্রপাণি অপেক্ষা সমধিক ক্ষমতাবান্ নহেন। তিনি শাপদোষে মহারাজের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন, ইহা নিতান্ত আশ্চর্য্য নয়। বিশেষতঃ স্বপ্নবৃত্তান্ত বিবেচনা করিয়া দেখিলে আর কিছুই সন্দেহ থাকে না। মহিষীর গর্ভে পূর্ণ শশধর প্রবেশ করিতেছে আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন। আমিও স্বপ্নে পুণ্ডরীক দেখিয়াছিলাম। অমৃতদীধিতির অমৃতের প্রভাব ভিন্ন বিনষ্ট দেহের অবিকার কিরূপে সম্ভবে? এক্ষণে ধৈর্য্য অবলম্বন করুন। শাপও পরিণামে আমাদিগের বর হইবে। আমাদের সৌভাগ্যের পরিসীমা নাই। শাপাবসানে বধূসমেত চন্দ্রাপীড়রূপধারী ভগবান্ চন্দ্রমার মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন সার্থক হইবে। এ সময় অভ্যুদয়ের সময় শোকতাপের সময় নয় এক্ষণে পুণ্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান করুন, শীঘ্র শ্রেয়ঃ হইবে। কর্ম্মের অসাধ্য কিছুই নাই।
শুকনাস এত বুঝাইলেন, কিন্তু রাজার শোকাচ্ছন্ন মনে প্রবোধের উদয় হইল না। তিনি কহিলেন, শুকনাস! তুমি যাহা বলিলে যুক্তিসিদ্ধ বটে, আমার মন প্রবোধ মানিতেছে না। আমিই যখন ধৈর্য্য অবলম্বন করিতে সমর্থ নহি, মহিষী স্ত্রীলোক হইয়া কি রূপে শোকাবেগ পরিত্যাগ করিবেন। চল, আমরা তথায় যাই, স্বচক্ষে চন্দ্রাপীড়ের অবিকৃত অঙ্গশোভা অবলোকন করি। তাহা হইলে শোকের কিছু শৈথিল্য হইতে পারে। মহিষী কহিলেন, তবে আর বিলম্ব করা নয়। শীঘ্র যাইবার উদ্যোগ করা যাউক। এমন সময়ে এক জন বৃদ্ধ আসিয়া কহিল, দেবি! চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়নের নিকট হইতে লোক আসিয়াছে, সংবাদ কি জানিবার নিমিত্ত মনোরমা এই মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে দণ্ডায়মান আছেন। মনোরমার আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া নরপতি অতিশয় শোকাকুল হইলেন। বাস্পাকুল নয়নে কহিলেন, দেবি! তুমি স্বয়ং গিয়া সমুদায় বৃত্তান্ত তাঁহার কর্ণগোচর কর এবং প্রবোধবাক্যে বুঝাইয়া কহ যে, তিনি আমাদিগের সমভিব্যাহারে তথায় যাইবেন। গমনের সমুদায় আয়োজন হইল। রাজা, মহিষী, মন্ত্রী, মন্ত্রিপত্নী, সকলে চলিলেন। নগরবাসী লোকেরা কেহ বা নরপতির প্রতি অনুরাগবশতঃ কেহ বা চন্দ্রাপীড়ের প্রতি স্নেহযুক্ত, কেহ বা আশ্চর্য্য দেখিবার নিমিত্ত সুসজ্জ হইয়া অনুগমন করিতে প্রস্তুত হইল। রাজা তাহাদিগকে নানাপ্রকার বুঝাইয়া ক্ষান্ত করিলেন। কেবল পরিচারকেরা সঙ্গে চলিল।
কিয়ৎদিন পরে অচ্ছোদ সরোবরের তীরে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার নিকট অগ্রে সংবাদ পাঠাইয়া পরে আপনারা আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। গুরুজনের আগমনে লজ্জিত হইয়া মহাশ্বেতা মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশিলেন। কাদম্বরী শোকে বিহ্বল হইয়া মূর্চ্ছাপন্ন হইলেন। নব কিসলয়ের ন্যায় কোমল শয্যায় শয়ন করিয়াও পূর্ব্বে যাঁহার নিদ্রা হইত না, তিনি এক্ষণে এক প্রস্তরের উপর পতিত হইয়া মহানিদ্রায় অভিভূত হইয়াছেন দেখিয়া, মহিষীর শোকের আর পরিসীমা রহিল না। বারংবার আলিঙ্গন, মুখচুম্বন ও মস্তক আঘ্রাণ করিয়া, হা হতাস্মি বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, দেবি! জন্মান্তরীণ পুণ্যফলে চন্দ্রাপীড়কে পুত্ত্ররূপে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম বটে; কিন্তু ইনি দেবমূর্ত্তি, এ সময়ে স্পর্শ করা উচিত নয়। পুত্ত্র কলত্রাদির বিরহই যাতনাবহ। আমরা স্বচক্ষে চন্দ্রাপীড়ের আনন্দজনক মুখচন্দ্র দেখিতে পাইলাম, আর দুঃখ সন্তাপ কি? যাঁহার প্রভাবে বৎস পুনর্জীবিত হইবেন, যাঁহার প্রভাবে পরিণামে শ্রেয়ঃ হইবে, এক্ষণে একমাত্র অবলম্বন, তোমার বধূ সেই গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রী শোকে জ্ঞানশূন্যা হইয়াছেন দেখিতেছ না? যাহাতে ইঁহার চৈতন্যোদয় হয় তাহার চেষ্টা পাও! কই! বধূ কোথায়? বলিয়া রাণী সসম্ভ্রমে কাদম্বরীর নিকটে গেলেন এবং ধরিয়া তুলিয়া ক্রোড়ে বসাইলেন। বধূর মুখশশী মহিষী যত বার দেখেন ততই নয়নযুগল হইতে অশ্রুজল নির্গত হয়। তখন বিলাপ করিয়া কহিলেন, আহা! মনে করিয়াছিলাম চন্দ্রাপীড়ের বিবাহ দিয়া পুত্ত্রবধূ লইয়া পরম সুখে কালক্ষেপ করিব, কিন্তু জগদীশ্বরের কি বিড়ম্বনা, পরমপ্রীতিপাত্র সেই বধূর বৈধব্যদশা ও তপস্বিবেশ দেখিতে হইল। হায়! যাহাকে রাজভবনের অধিকারিণী করিব ভাবিয়াছিলাম, তাহাকে বনবাসিনী ও নিতান্ত দুঃখিনী দেখিতে হইল। এই বলিয়া বারংবার বধূর মুখ চুম্বন করিতে লাগিলেন। রাণীর অশ্রুজল ও পাণিতল স্পর্শে কাদম্বরীর চৈতন্যোদয় হইল। তখন নয়ন উন্মীলন পূর্ব্বক লজ্জায় অবনতমুখী হইয়া একে একে গুরুজনদিগকে প্রণাম করিলেন। বৈধব্যদশা শীঘ্র দূর হউক বলিয়া সকলে আশীর্ব্বাদ করিলেন। রাজা মদলেখাকে ডাকিয়া কহিলেন, বৎসে! তুমি বধূর নিকটে গিয়া কহ যে, আমরা কেবল দেখিবার পাত্র আসিয়া দেখিলাম। কিন্তু যেরূপ আচার করিতে হয় এবং এত দিন যেরূপ নিয়মে ছিলেন আমাদিগের আগমনে লজ্জার অনুরোধে যেন তাহার অন্যথা না হয়। বধূ যেন সর্ব্বদা বৎসের নিকটবর্ত্তিনী থাকেন। এই বলিয়া সঙ্গিগণ সমভিব্যাহারে আশ্রমের বহির্গত হইলেন।
আশ্রমের অনতিদূরে এক লতামণ্ডপে বাসস্থান নিরূপণ করিয়া সমুদায় নৃপতিগণকে ডাকাইয়া কহিলেন, ভ্রাতঃ! পূর্ব্বে স্থির করিয়াছিলাম, চন্দ্রাপীড়ের বিবাহ দিয়া তাঁহাকে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া, তৃতীয় আশ্রমে প্রবেশ করিব। এবং জগদীশ্বরের আরাধনায় শেষদশা অতিবাহিত হইবেক। আমার মনোরথ সফল হইল না বটে কিন্তু পুনর্ব্বার সংসারে প্রবেশ করিতে আস্থা নাই। তোমরা সহোদরতুল্য ও পরম সুহৃদ্। নগরে প্রতিগমন করিয়া সুশৃঙ্খল রূপে রাজ্য শাসন ও প্রজা পালন কর। আমি পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার উপায় চিন্তা করি। যাহারা পুত্ত্র কিংবা ভ্রাতার প্রতি সংসারভার সমর্পণ করিয়া চরমে পরমেশ্বরের আরাধনা করিতে পারে তাহারাই ধন্য ও সার্থকজন্মা। এই অকিঞ্চিৎকর মাংসপিণ্ডময় শরীর দ্বারা যৎকিঞ্চিৎ ধর্ম্ম উপার্জ্জন হইলেও পরম লাভ বলিতে হইবেক। ধর্ম্মসঞ্চয় ব্যতিরেকে পরলোকে পরিত্রাণের উপায়ান্তর নাই। তোমরা এক্ষণে বিদায় হও এবং আপন আপন আলয়ে গমন করিয়া সুখে রাজ্যভোগ কর। আমি এই স্থানেই জীবনক্ষেপ করিব, মানস করিয়াছি। এই বলিয়া সকলকে বিদায় করিলেন এবং তদবধি তপস্বিবেশে জগদীশ্বরের আরাধনায় অনুরক্ত হইলেন। তরুমূলে হর্ম্ম্যবুদ্ধি, হরিণশাবকে সুতস্নেহ সংস্থাপন পূর্ব্বক সস্ত্রীক শুকনাস সহিত প্রতি দিন চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র দর্শন করিয়া সুখে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
মহর্ষি জাবালি এই রূপে কথা সমাপ্ত করিয়া হাস্য পূর্ব্বক মুনিকুমারদিগকে কহিলেন, দেখ! আমি অন্যমনস্ক হইয়া তোমাদিগের অভিপ্রেত উপাখ্যান অপেক্ষাও অধিক বলিলাম। যাহা হউক, যে মুনিতনয় মদনবাণে আহত হইয়া আত্মকৃত অবিনয় জন্য মর্ত্ত্যলোকে শুকনাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তদনন্তর মহাশ্বেতার শাপে তির্য্যগ্জাতিতে পতিত হন, তিনি এই। এই কথা বলিয়া অঙ্গুলি দ্বারা আমাকে নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন।
তাঁহার কথাবসানে জন্মান্তরীণ সমুদায় কর্ম্ম আমার স্মৃতিপথারূঢ় এবং পূর্ব্বজন্মশিক্ষিত সমুদায় বিদ্যা আমার জিহ্বাগ্রবর্ত্তিনী হইল। তদবধি মনুষ্যের ন্যায় সুস্পষ্ট কথা কহিতে লাগিলাম। বোধ হইল যেন, এত দিন নিদ্রিত ছিলাম, এক্ষণে জাগরিত হইলাম। কেবল মনুষ্যদেহ হইল না নতুবা চন্দ্রাপীড়ের প্রতি সেইরূপ স্নেহ, মহাশ্বেতার প্রতি সেইরূপ অনুরাগ এবং তাঁহার প্রাপ্তিবিষয়েও সেইরূপ ঔৎসুক্য জন্মিল। পক্ষোদ্ভেদ না হওয়াতে কেবল কায়িক চেষ্টা হইল না। পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মের সমুদায় বৃত্তান্ত স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে পিতা, মাতা, মহারাজ তারাপীড়, মহিষী বিলাসবতী, বয়স্য চন্দ্রাপীড় এবং প্রথম সুহৃদ্ কপিঞ্জল সকলেই এককালে আমার সমুৎসুক চিত্তে পদ প্রাপ্ত হইলেন। তখন আমার অন্তঃকরণ কিরূপ হইল কিছু বলিতে পারি না। অনেক ক্ষণ চিন্তা করিলাম, মনে কত ভাবোদয় হইতে লাগিল। মহর্ষি আমার অবিনয়ের পরিচয় দেওয়াতে তাঁহার নিকট লজ্জিত হইলাম। লজ্জায় অধোবদন হইয়া বিনয়বচনে জিজ্ঞাসিলাম, ভগবন্! আপনার অনুকম্পায় পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত আমার স্মৃতিপথবর্ত্তী হইয়াছে ও সমুদায় সুহৃদ্গণকে মনে পড়িয়াছে। কিন্তু উহা স্মরণ না হওয়াই ভাল ছিল। এক্ষণে বিরহবেদনায় প্রাণ যায়। বিশেষতঃ আমার মরণসংবাদ শুনিয়া যাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছিল, সেই চন্দ্রাপীড়ের অদর্শনে আর প্রাণ ধারণ করিতে পারি না। তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলিয়া দেন। আমি তির্য্যগ্জাতি হইয়াছি, তথাপি তাঁহার সহিত একত্র বাস করিলে আমার কোন ক্লেশ থাকিবে না। মহর্ষি আমার প্রতি নেত্রপাত পূর্ব্বক স্নেহ ও কোপগর্ভ বচনে কহিলেন, দুরাত্মন্! যে পথে পদার্পণ করিয়া তোর এত দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে, আবার সেই পথ অবলম্বন করিবার চেষ্টা পাইতেছিস্? অদ্যাপি পক্ষোদ্ভেদ হয় নাই, অগ্রে গমন করিবার সামর্থ হউক পরে তাহার জন্ম স্থান বলিয়া দিব।
তাত! প্রাণধারণ করিতে পারা না যায় এরূপ বিকার মুনিকুমারের মনে কেন সহসা সঞ্চারিত হইল? পরম পবিত্র দিব্য লোকে জন্মগ্রহণ করিয়া অত্যল্প পরমায়ুঃ কেন হইল? আমাদিগের অতিশয় বিস্ময় জন্মিয়াছে অনুগ্রহ পূর্ব্বক ইহার কারণ নির্দ্দেশ করিলে চরিতার্থ হই। হারীতের এই কথা শুনিয়া মহর্ষি কহিলেন, অপত্যোৎপাদন কালে মাতার যেরূপ মনোবৃত্তি থাকে, সন্তানও সেইরূপ মনোবৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়। পুণ্ডরীকের জন্মকালে লক্ষ্মী রিপুপরতন্ত্র হইয়াছিলেন; সুতরাং পুণ্ডরীক যে, রিপু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন ইহা আশ্চর্য্য নহে। শাস্ত্রকারেরা কহেন, কারণের গুণ কার্য্যে সংক্রামিত হয়। কিন্তু শাপাবসানে ইহার দীর্ঘ পরমায়ু হইবেক। আমি পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, ভগবন্! কিরূপে আমি দীর্ঘ পরমায়ুঃ প্রাপ্ত হই তাহার উপায় বলিয়া দেন। তিনি কহিলেন, ইহার পর ক্রমে ক্রমে সমুদায় জানিতে পারিবে।