কাদম্বরী (তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ১৮৯২)/কথারম্ভ-১২
আপনি বৈশম্পায়নকে স্কন্ধাবার লইয়া আসিবার ভার দিয়া প্রস্থান করিলে তিনি কহিলেন, পুরাণে শুনিয়াছি অচ্ছোদসরোবর অতি পবিত্র তীর্থ। অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়াও লোকে তীর্থ দর্শন করিতে যায়। আমরা সেই তীর্থের নিকটে আসিয়াছি, অতএব একবার না দেখিয়া এখান হইতে যাওয়া উচিত নয়। অচ্ছোদসরোবরে স্নান করিয়া এবং তত্তীরস্থিত ভগবান্ শশাঙ্কশেখরকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া যাত্রা করা যাইবে। এই বলিয়া সেই সরোবর দেখিতে গেলেন। তথায় বিকসিতকুসুম, নির্ম্মল জল, রমণীয় তীরভূমি, শ্রেণীবদ্ধ তরু, কুসুমিত লতাকুঞ্জ দেখিয়া বোধ হইল যেন, বসন্ত সপরিবারে ও সবান্ধবে তথায় বাস করিতেছেন। ফলতঃ তাদৃশ রমণীয় প্রদেশ ভূমণ্ডলে অতি বিরল। বৈশম্পায়ন তথায় ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক এক মনোহর লতামণ্ডপ দেখিলেন। ঐ লতামণ্ডপের অভ্যন্তরে এক শিলা পতিত ছিল। পরমপ্রীতিপাত্র মিত্রকে বহু কালের পর দেখিলে অন্তঃকরণে যেরূপ ভাবোদয় হয়, লতামণ্ডপ দেখিয়া বৈশম্পায়নের মনে সেইরূপ অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হইল। তিনি নিমেষশূন্য নয়নে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। ক্রমে নিতান্ত উন্মনা হইতে লাগিলেন। পরিশেষে ভূতলে উপবিষ্ট হইয়া বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক নানাপ্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন বিস্মৃত বস্তুর স্মরণ করিতেছেন। তাঁহাকে সেইরূপ উন্মনা দেখিয়া আমরা মনে করিলাম, বুঝি রমণীয় লতামণ্ডপ ও মনোহর সরোবর ইঁহার চিত্তকে বিকৃত করিয়া থাকিবেক। যৌবনকাল কি বিষম কাল! এই কালে উত্তীর্ণ হইলে আর লজ্জা, ধৈর্য্য, কিছুই থাকে না। যাহা হউক, অধিক ক্ষণ এখানে আর থাকা হইবে না। শাস্ত্রকারেরা কহেন, বিকারের সামগ্রী শীঘ্র পরিহার করাই বিধেয়। এই স্থির করিয়া কহিলাম, মহাশয়! সরোবর দর্শন হইল এক্ষণে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অবগাহন করুন। বেলা অধিক হইয়াছে। স্কন্ধাবার সুসজ্জ হইয়া আপনার প্রতীক্ষা করিতেছে। আর বিলম্ব করিবেন না।
তিনি আমাদিগের কথায় কিছুই প্রত্যুত্তর দিলেন না, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় অনিমিষ নয়নে সেই লতামণ্ডপ দেখিতে লাগিলেন। পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করাতে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, আমি এখান হইতে যাইব না। তোমরা স্কন্ধাবার লইয়া চলিয়া যাও। তাঁহার এই কথার ভাবার্থ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নানা অনুনয় করিলাম ও কহিলাম, দেব চন্দ্রাপীড় আপনাকে স্কন্ধাবার লইয়া যাইবার ভার দিয়া বাটী গমন করিয়াছেন; অতএব আপনার এখানে বিলম্ব করা অবিধেয়। আপনি বৈরাগ্যের কথা কহিতেছেন কেন? এই জনশূন্য অরণ্যে আপনাকে একাকী পরিত্যাগ করিয়া গেলে যুবরাজ আমাদিগকে কি বলিবেন? আজি আপনার এরূপ চিত্তবিভ্রম দেখিতেছি কেন? যদি আমাদিগের কোন অপরাধ হইয়া থাকে, ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। এক্ষণে স্নান করুন। তিনি কহিলেন, তোমরা কি নিমিত্ত আমাকে এত প্রবোধ দিতেছ। আমি চন্দ্রাপীড়কে না দেখিয়া এক দণ্ড থাকিতে পারি না, ইহা অপেক্ষা আর আমার শীঘ্র গমনের কারণ কি আছে? কিন্তু এই স্থানে আসিয়া ও এই লতামণ্ডপ দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইয়াছে ও ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া আসিতেছে যাইবার আর সামর্থ্য নাই। যদি তোমরা বলপূর্ব্বক লইয়া যাও, বোধ হয় এখান হইতে না যাইতে যাইতেই আমার প্রাণ দেহ হইতে বহির্গত হইবেক। আমাকে লইয়া যাইবার আর আগ্রহ করিও না। তোমরা স্কন্ধাবার সমভিব্যাহারে বাটী গমন কর ও চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া সুখী হও। আমার আর সে মুখারবিন্দ দেখিবার সম্ভাবনা নাই। এরূপ কি পুণ্যকর্ম্ম করিয়াছি যে, চিরকাল সুখে কাল ক্ষেপ করিব!
অকস্মাৎ আপনার এ আবার কি ব্যামোহ উপস্থিত হইল? এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে কহিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি ইহার কারণ কিছু জানি না। তোমাদিগের সঙ্গেই এই প্রদেশে আসিয়াছি। তোমাদিগের সমক্ষেই এই লতামণ্ডপ দর্শন করিতেছি। জানি না, কি নিমিত্ত আমার মন এরূপ চঞ্চল হইল। এই কথা বলিয়া তথা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক যেরূপ লোক অনন্যদৃষ্টি হইয়া নষ্ট বস্তুর অন্বেষণ করে, সেইরূপ লতাগৃহে, তরুতলে, তীরে ও মন্দিরে ভ্রমণ করিয়া যেন, অপহৃত অভীষ্ট সামগ্রীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। আমরা আহার করিতে অনুরোধ করিলে কহিলেন, আমার প্রাণ আপন প্রাণ অপেক্ষাও চন্দ্রাপীড়ের প্রিয়তর। সুতরাং সুহৃদের সন্তোষের নিমিত্ত অবশ্য রক্ষা করিতে হইবেক। এই কথা বলিয়া সরোবরে স্নান করিয়া যৎকিঞ্চিৎ ফলমূল ভক্ষণ করিলেন। এইরূপে তিন দিন অতিবাহিত হইল। আমরা প্রতিদিন নানাপ্রকার বুঝাইতে লাগিলাম। কিছুতেই চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে পারিলেন না। পরিশেষে তাঁহার আগমন ও আনয়ন বিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়া কতিপয় সৈন্য তাঁহার নিকটে রাখিয়া, আমরা স্কন্ধাবার লইয়া আসিতেছি। রাজকুমারের অতিশয় ক্লেশ হইবে বলিয়া পূর্ব্বে এ সংবাদ পাঠান যায় নাই।
অসম্ভবনীয় ও অচিন্তনীয় বৈশম্পায়নবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া চন্দ্রাপীড় বিস্মিত ও উদ্বিগ্নচিত্ত হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, প্রিয়সখার অকস্মাৎ এরূপ বৈরাগ্যের কারণ কি? আমি ত কখন কোন অপরাধ করি নাই। কখন অপ্রিয় কথা কহি নাই। অন্যে অপরাধ করিবে ইহাও সম্ভব নহে। তৃতীয় আশ্রমেরও এ সময় নয়। তিনি অদ্যাপি গৃহস্থাশ্রমে প্রবিষ্ট হন নাই। দেব পিতৃ ঋষি ঋণ হইতে অদ্যাপি মুক্ত হন নাই। এরূপ অবিবেকী নহেন যে, কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া মূর্খের ন্যায় উন্মার্গগামী হইবেন। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে এক পটগৃহে প্রবেশিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। ভাবিলেন যদি বাটীতে না গিয়া এইখান হইতে প্রিয়সুহৃদের অন্বেষণে যাই, তাহা হইলে পিতা, মাতা, শুকনাস ও মনোরমা এই বৃত্তান্ত শুনিয়া ক্ষিপ্তপ্রায় হইবেন। তাঁহাদিগের অনুজ্ঞা লইয়া এবং শুকনাস ও মনোরমাকে প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিয়া বাটী হইতে বন্ধুর অন্বেষণে যাওয়াই কর্ত্তব্য। যাহা হউক, বন্ধু অন্যায় কর্ম্ম করিয়াও আমার পরম উপকার করিলেন, আমার মনোরথ সম্পাদনের বিলক্ষণ সুযোগ হইল। এই অবসরে প্রিয়তমাকে দেখিতে পাইব। এই রূপে প্রিয়সুহৃদের বিরহবেদনাকেও পরিণামে শুভ ও সুখের হেতু জ্ঞান করিয়া দুঃখে নিতান্ত নিমগ্ন হইলেন না। স্বয়ং যাইলেই প্রিয়সুহৃৎকে আনিতে পারিবেন এই বিশ্বাস থাকাতে নিতান্ত কাতরও হইলেন না।
অনন্তর আহারাদি সমাপন করিয়া পটগৃহের বহির্গত হইলেন। দেখিলেন সূর্য্যদেব অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় কিরণ বিস্তার করিতেছেন। গগনে দৃষ্টিপাত করা কাহার সাধ্য। একে নিদাঘকাল, তাহাতে বেলা ঠিক্ দুই প্রহর, চতুর্দ্দিকে মাঠ ধূ ধূ করিতেছে। দিঙ্মণ্ডল যেন জ্বলিতেছে, বোধ হয়। পক্ষিগণ নিস্তব্ধ হইয়া নীড়ে অবস্থিতি করিতেছে। কিছুই শুনা যায় না, কেবল চাতকের কাতর স্বর এক এক বার শ্রবণগোচর হয়। মহিষকুল পঙ্কশেষ পল্বলে পড়িয়া আছে। পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হরিণ ও হরিণীগণ সূর্য্যকিরণে জলভ্রম হওয়াতে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে, কুক্কুরগণ বারংবার জিহ্বা বহির্গত করিতেছে। গ্রীষ্মের প্রভাবে বায়ু উত্তপ্ত হইয়া অনলের ন্যায় গাত্রে লাগিতেছে। গাত্র হইতে অনবরত ঘর্ম্মবারি বিনির্গত হইতেছে। রাজকুমার জলসেচন দ্বারা আপনার বাসগৃহ শীতল করিয়া তথায় বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। গ্রীষ্মকালে দিবসের শেষভাগ অতি রমণীয়। সূর্য্যের উত্তাপ থাকে না। মন্দ মন্দ সন্ধ্যাসমীরণ অমৃতবৃষ্টির ন্যায় শরীরে সুখস্পর্শ বোধ হয়। এই সময় সকলে গৃহের বহির্গত হইয়া সুশীতল সমীরণ সেবন করে, প্রফুল্ল অন্তঃকরণে তরুগণের শ্যামল শোভা দেখিয়া এবং দিঙ্মণ্ডলের শোভা দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হয়। রাজকুমার সন্ধ্যাকালে পটগৃহের বহির্গত হইলেন এবং আকাশমণ্ডলের চমৎকার শোভা দেখিতে লাগিলেন। নিশীথসময়ে চন্দ্রোদয়ে পৃথিবী জ্যোৎস্নাময় হইলে প্রয়াণ-সূচক শঙ্খধ্বনি হইল। স্কন্ধাবারস্থিত সেনাগণ উজ্জয়িনীদর্শনে সাতিশয় উৎসুক ছিল। শঙ্খধ্বনি শুনিবামাত্র অমনি সুসজ্জ হইয়া গমন করিতে আরম্ভ করিল। যামিনী প্রভাত হইবার সময় স্কন্ধাবার উজ্জয়িনীতে আসিয়া পঁহুছিল। বৈশম্পায়নের বৃত্তান্ত নগরে পূর্ব্বেই প্রচারিত হইয়াছিল। পৌরজনেরা রাজকুমারকে দেখিয়া, হতোঽস্মি! বলিয়া রোদন করিতে লাগিল। রাজকুমার ভাবিলেন, পৌরজনেরা যখন এরূপ বিলাপ করিতেছে, না জানি পুত্ত্রশোকে মনোরমা ও শুকনাসের কত দুঃখ ক্লেশ হইয়া থাকিবেক।
ক্রমে রাজবাটীর দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। রাজা বাটীতে নাই, মহিষীর সহিত শুকনাসের ভবনে গিয়াছেন, এই কথা শুনিয়া তথা হইতে মন্ত্রীর ভবনে গমন করিলেন। দেখিলেন, সকলেই বিষণ্ণ। “হা বৎস! নির্ম্মানুষ, ব্যালসঙ্কুল, ভীষণ গহনে কি রূপে আছ! ক্ষুধার সময় কাহার নিকট খাদ্য দ্রব্য প্রার্থনা করিতেছ! তৃষ্ণার সময় কে জলদান করিতেছে! যদি তোমার নির্জ্জন বনে বাস করিবার অভিলাষ ছিল, কেন আমারে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও নাই? বাল্যাবধি কখন তোমার মুখ কুপিত দেখি নাই, অকস্মাৎ ক্রোধোদয় কেন হইল? এরূপ বৈরাগ্যের কারণ কি? তোমার সেই প্রফুল্ল মুখকমল না দেখিয়া আমি আর জীবন ধারণ করিতে সমর্থ নহি।” মনোরমা কাতরস্বরে অন্তঃপুরে এইরূপ নানা প্রকার বিলাপ করিতেছেন, শুনিতে পাইলেন। অনন্তর বিষণ্ণ বদনে মহারাজ ও শুকনাসকে প্রণাম করিয়া আসনে বসিলেন।
রাজা কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! তোমার সহিত বৈশম্পায়নের যে প্রণয় তাহা বিলক্ষণ অবগত আছি। কিন্তু তাঁহার এই অনুচিত কর্ম্ম দেখিয়া আমার অন্তঃকরণ তোমার দোষ সম্ভাবনা করিতেছে। রাজার কথা সমাপ্ত না হইতে শুকনাস কহিলেন, দেব! যদি শশধরে উষ্ণতা, অমৃতে উগ্রতা ও হিমে দাহ্যশক্তি জন্মে, তথাপি নির্দ্দোষস্বভাব চন্দ্রাপীড়ের দোষশঙ্কা হইতে পারে না। একের অপরাধে অন্যকে দোষী জ্ঞান করা অতি অন্যায় কর্ম্ম। মাতৃদ্রোহী, পিতৃঘাতী, কৃতঘ্ন, দুরাচার, দুষ্কর্ম্মান্বিতের দোষে সুশীল চন্দ্রাপীড়ের দোষ সম্ভাবনা করা উচিত নয়। যে পিতা মাতার অপেক্ষা করিল না, রাজাকে গ্রাহ্য করিল না, মিত্রতার অনুরোধ রাখিল না, চন্দ্রাপীড় তাহার কি করিবেন? তাহার কি একবারও ইহা মনে হইল না যে, আমি পিতা মাতার একমাত্র জীবননিবন্ধন, আমাকে না দেখিয়া কি রূপে তাঁহারা জীবন ধারণ করিবেন। এক্ষণে বুঝিলাম কেবল আমাদিগকে দুঃখ দিবার নিমিত্তই সে ভূতলে জন্ম গ্রহণ করিয়ছিল। বলিতে বলিতে শোকে শুকনাসের অধর স্ফুরিত ও গণ্ডস্থল অশ্রু জলে পরিপ্লুত হইল। রাজা তাঁহার সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া কহিলেন, অমাত্য! যেরূপ খদ্যোতের আলোক দ্বারা অনলপ্রকাশ, অনল দ্বারা রবির প্রকাশ, অস্মদ্বিধ ব্যক্তি কর্ত্তৃক তোমার পরিবোধনও সেইরূপ। কিন্তু বর্ষাকালীন জলাশয়ের ন্যায় তোমার মন কলুষিত হইয়াছে। কলুষিত মনে বিবেকশক্তি স্পষ্ট রূপে প্রকাশিত হয় না। সে সময়ে অদূরদর্শীও দীর্ঘদর্শীকে অনায়াসে উপদেশ দিতে পারে। অতএব আমার কথা শুন। এই ভূমণ্ডলে এমন লোক অতি বিরল, যাহার যৌবনকাল নির্ব্বিকার ও নির্দ্দোষে অতিক্রান্ত হয়। যৌবনকাল অতি বিষম কাল। এই কালে উত্তীর্ণ হইলে শৈশবের সহিত গুরুজনের প্রতি স্নেহ বিগলিত হয়। বক্ষঃস্থলের সহিত বাঞ্ছা বিস্তীর্ণ বাহুযুগলের সহিত বুদ্ধি স্থূল হয়। মধ্যভাগের সহিত বিনয় ক্ষীণ হয়। এবং অকারণেই বিকারের আবির্ভাব হয়। বৈশম্পায়নের কোন দোষ নাই, ইহা কালের দোষ। কি জন্য তাহার বৈরাগ্যোদয় হইল, তাহা বিশেষ রূপে না জানিয়া দোষার্পণ করাও বিধেয় নয়। অগ্রে তাহাকে আনয়ন করা যাউক। তাহার মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া যাহা কর্ত্তব্য, পরে করা যাইবেক। শুকনাস কহিলেন, মহারাজ! বাৎসল্য প্রযুক্ত এরূপ কহিতেছেন। নতুবা, যাহার সহিত একত্র বাস, একত্র বিদ্যাভ্যাস ও পরম সৌহার্দ্দে কালযাপন হইয়াছে, পরম প্রীতিপাত্র সেই মিত্রের কথা অগ্রাহ্য করা অপেক্ষা আর কি অধিক অপরাধ হইতে পারে?
চন্দ্রাপীড় নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বিনয় বচনে কহিলেন, তাত! এ সকল আমারই দোষ, সন্দেহ নাই। এক্ষণে অনুমতি করুন, আমি স্বীয় পাপের প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্ত, অচ্ছোদসরোবরে গমন করি এবং বৈশম্পায়নকে নিবৃত্ত করিয়া আনি। অনন্তর পিতা মাতা, শুকনাস ও মনোরমার নিকট বিদায় লইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক বন্ধুর অন্বেষণে চলিলেন। শিপ্রানদীর তীরে সে দিন অবস্থিতি করিয়া রজনী প্রভাত না হইতেই সমভিব্যাহারী লোকদিগকে গমনের আদেশ দিলেন; আপনি অগ্রে অগ্রে চলিলেন। যাইতে যাইতে মনে মনে কত মনোরথ করিতে লাগিলেন। সুহৃদের অজ্ঞাতসারে তথায় উপস্থিত হইয়া সহসা কণ্ঠধারণ পূর্ব্বক কোথায় পলায়ন করিতেছ বলিয়া প্রিয়সখার লজ্জা ভঞ্জন করিয়া দিব। তদনন্তর মহাশ্বেতার আশ্রমে উপস্থিত হইব। তিনি আমাকে দেখিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইবেন, সন্দেহ নাই। মহাশ্বেতার আশ্রমে সৈন্য সামন্ত রাখিয়া হেমকূটে গমন করিব। তথায় প্রিয়তমার প্রফুল্ল মুখকমল দর্শনে নয়নযুগল চরিতার্থ করিব ও মহাসমারোহে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়া জীবন সফল ও আত্মাকে পরিতৃপ্ত করিব। অনন্তর প্রিয়তমার অনুমতি লইয়া মদলেখার সহিত পরিণয় সম্পাদন দ্বারা বন্ধুর সংসারবৈরাগ্য নিবারণ করিয়া দিব। এইরূপ মনোরথ করিতে করিতে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, পথশ্রম ও জাগরণ জন্য ক্লেশকে ক্লেশবোধ না করিয়া দিন যামিনী গমন করিতে লাগিলেন।
পথে বর্ষাকাল উপস্থিত। নীলবর্ণ মেঘমালায় গগনমণ্ডল আচ্ছাদিত হইল। দিনকর আর দৃষ্টিগোচর হয় না। চতুর্দ্দিকে মেঘ, দশ দিক্ অন্ধকার। দিবা রাত্রির কিছুই বিশেষ রহিল না। ঘনঘটার ঘোরতর গভীর গর্জ্জন ও ক্ষণপ্রভার দুঃসহ প্রভা ভয়ানক হইয়া উঠিল। মধ্যে মধ্যে বজ্রাঘাত ও শিলাবৃষ্টি। অনবরত মূষলধারে বৃষ্টি হওয়াতে, নদী সকল বর্দ্ধিত হইয়া উভয় কূল ভগ্ন করিয়া ভীষণ বেগে প্রবাহিত হইল। সরোবর, পুষ্করিণী, নদ, নদী পরিপূর্ণ হইয়া গেল। চতুর্দ্দিক জলময় ও পথ পঙ্কময়। ময়ূর ও ময়ূরীগণ আহ্লাদে পুলকিত হইয়া নৃত্য আরম্ভ করিল। কদম্ব, মালতী, কেতকী, কুটজ প্রভৃতি নানাবিধ তরু ও লতার বিকসিত কুসুম আন্দোলিত করিয়া নবসলিলসিক্ত বসুন্ধরার মৃদগন্ধ বিস্তার পূর্ব্বক ঝাঞ্ঝাবায়ু উৎকলাপ শিখিকুলের শিখাকলাপে আঘাত করিতে লাগিল। কোন দিকে কেকারব, কোন দিকে ভেকরব, গগনে চাতকের কলরব, চতুর্দ্দিকে ঝঞ্ঝাবায়ু ও বৃষ্টিধারার গভীর শব্দ এবং স্থানে স্থানে গিরিনির্ঝরের পতনশব্দ। গগনমণ্ডলে আর চন্দ্রমা দৃষ্টিগোচর হয় না। নক্ষত্রগণ আর দেখিতে পাওয়া যায় না। এইরূপে বর্ষাকাল উপস্থিত হইয়া কালসর্পের ন্যায় চন্দ্রাপীড়ের পথরোধ করিল। ইন্দ্রচাপে তড়িদ্ গুণ সংযোগ করিয়া গভীর গর্জ্জন পূর্ব্বক বারিরূপ শর বৃষ্টি করিতে লাগিল। তড়িৎ যেন তর্জ্জন করিয়া উঠিল। বর্ষাকাল সমাগত দেখিয়া, চন্দ্রাপীড় সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। ভাবিলেন, এ আবার কি উৎপাত; আমি প্রিয় সুহৃৎ ও প্রিয়তমার সমাগমে সমুৎসুক হইয়া, প্রাণপণে ত্বরা করিয়া যাইতেছি। কোথা হইতে জলদকাল দশ দিক্ অন্ধকার করিয়া বৈরনির্যাতনের আশয়ে উপস্থিত হইল? অথবা, বিদ্যুতের আলোকে পথ আলোকময় করিয়া, মেঘরূপ চন্দ্রাতপ দ্বারা রৌদ্র নিবারণ করিয়া, আমার সেবার নিমিত্তই বুঝি, জলদকাল সমাগত হইয়াছে। এই সময় পথ চলিবার সময়। এই স্থির করিয়া গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।
যাইতে যাইতে পথিমধ্যে, মেঘনাদ আসিতেছে দেখিতে পাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, মেঘনাদ! তুমি অচ্ছোদসরোবরে বৈশম্পায়নকে দেখিয়াছ? তিনি তথায় কি নিমিত্ত আছেন, জিজ্ঞাসা করিয়াছ? তোমার জিজ্ঞাসার কি উত্তর দিলেন? তাঁহার কিরূপ অভিপ্রায় বুঝিলে, বাটীতে ফিরিয়া আসিবেন কি না? আমি গন্ধর্ব্বনগরে যাইব শুনিয়া কি বলিলেন? তোমার কি বোধ হয়, আমাদের গমন পর্য্যন্ত তথায় থাকিবেন ত? মেঘনাদ বিনীত বচনে কহিল, “দেব! বৈশম্পায়ন বাটী আসিলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমি অবিলম্বে গন্ধর্ব্বনগরে গমন করিতেছি; তুমি পত্রলেখা ও কেয়ূরকের সহিত অগ্রসর হও,” আপনি এই আদেশ দিয়া আমাকে বিদায় করিলেন। আমি আসিবার সময়, বৈশম্পায়ন বাটী যান নাই, অচ্ছোদসরোবরের তীরে অবস্থিতি করিতেছেন, ইহা কাহারও মুখে শুনি নাই। তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎও হয় নাই। আমি অচ্ছোদসরোবর পর্য্যন্ত যাই নাই। পথিমধ্যে পত্রলেখা ও কেয়ূরক কহিলেন, মেঘনাদ! বর্ষাকাল উপস্থিত! তুমি এই স্থান হইতেই প্রস্থান কর। এই ভীষণকালে একাকী এখানে কদাচ থাকিও না। এই কথা বলিয়া আমাকে বিদায় দিলেন।
রাজকুমার মেঘনাদকেও সঙ্গে করিয়া লইলেন। কিছু দিন পরে অচ্ছোদসরোবরের তীরে উপস্থিত হইলেন। পূর্ব্বে যে স্থানে নির্ম্মল জল, বিকসিত কুসুম, মনোহর তীর ও বিচিত্র লতাকুঞ্জ দেখিয়া প্রীত ও প্রফুল্লচিত্ত হইয়াছিলেন, এক্ষণে বিষণ্ণ চিত্তে তথায় উপস্থিত হইয়া প্রিয়সখার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। সমভিব্যাহারী লোকদিগকে সতর্ক হইয়া অনুসন্ধান করিতে কহিলেন। আপনিও তরুগহন, তীরভূমি ও লতামণ্ডপ তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিলেন। যখন তাঁহার অবস্থানের কোন চিহ্ন পাইলেন না, তখন ভগ্নোৎসাহ চিত্তে চিন্তা করিলেন, পত্রলেখার মুখে আমার আগমন সংবাদ শুনিয়া বন্ধু বুঝি এখান হইতে প্রস্থান করিয়া থাকিবেন। এখানে থাকিলে অবশ্য অবস্থানচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যাইত। বোধ হয়, তিনি নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। এক্ষণে কোথায় যাই কোথায় গেলে বন্ধুর দেখা পাই। যে আশা অবলম্বন করিয়া এত দিন জীবন ধারণ করিয়াছিলাম, তাহার মূলোচ্ছেদ হইল। শরীর অবশ হইতেছে, চরণ আর চলে না। এক বারে ভগ্নোৎসাহ হইয়াছি, অন্তঃকরণ বিষাদসাগরে মগ্ন হইতেছে! সকলই অন্ধকার দেখিতেছি।
আশার কি অপরিসীম মহিমা! চন্দ্রাপীড় সরসীতীরে বন্ধুকে দেখিতে না পাইয়া ভাবিলেন, এক বার মহাশ্বেতার আশ্রম দেখিয়া আসি। বোধ হয়, মহাশ্বেতা সন্ধান বলিতে পারেন। এই স্থির করিয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক তথায় চলিলেন। কতিপয় পরিচারকও সঙ্গে সঙ্গে গেল। আসিবার সময় মনোরথ করিয়াছিলেন মহাশ্বেতা আমার গমনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইবেন এবং আমিও আহ্লাদিত চিত্তে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব। কিন্তু বিধাতার কি চাতুরী! ভবিতব্যতার কি প্রভাব! মনুষ্যেরা কি অন্ধ এবং তাহাদিগের মনোরথ কি অলীক! চন্দ্রাপীড় বন্ধুর বিয়োগে দুঃখিত হইয়া অনুসন্ধানের নিমিত্ত যাঁহার নিকট গমন করিলেন, দূর হইতে দেখিলেন, তিনি শিলাতলে উপবিষ্ট হইয়া অধোমুখে রোদন করিতেছেন। তরলিকা বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিত মনে তাঁহাকে ধরিয়া আছে। মহাশ্বেতার তাদৃশ অবস্থা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইলেন। ভাবিলেন, বুঝি কাদম্বরীর কোন অত্যহিত ঘটিয়া থাকিবেক। নতুবা পত্রলেখার মুখে আমার আগমনবার্ত্তা শুনিয়াছেন, এসময় অবশ্য হৃষ্টচিত্ত থাকিতেন। চন্দ্রাপীড় বৈশম্পায়নের অনুসন্ধান না পাওয়াতে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাহাতে আবার প্রিয়তমার অমঙ্গলচিন্তা মনোমধ্যে প্রবেশ করাতে নিতান্ত কাতর হইলেন। শূন্য হৃদয়ে মহাশ্বেতার নিকটবর্ত্তী হইয়া শিলাতলের এক পার্শ্বে বসিলেন ও তরলিকাকে মহাশ্বেতার শোকের হেতু জিজ্ঞাসিলেন। তরলিকা কিছু বলিতে পারিল না, কেবল দীন নয়নে মহাশ্বেতার মুখ পানে চাহিয়া রহিল।
মহাশ্বেতা বসনাঞ্চলে নেত্রজল মোচন করিয়া কাতর স্বরে কহিলেন, মহাভাগ! যে নিষ্করুণা ও নির্লজ্জা পূর্ব্বে আপনাকে দারুণ শোকবৃত্তান্ত শ্রবণ করাইয়াছিল, সেই পাপীয়সী এক্ষণেও এক অপূর্ব্ব ঘটনা শ্রবণ করাইতে প্রস্তুত আছে। কেয়ূরকের মুখে আপনার উজ্জয়িনীগমনের সংবাদ শুনিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলাম। চিত্ররথের মনোরথ, মদিরার বাঞ্ছা ও আপনার অভীষ্টসিদ্ধি না হওয়াতে সমধিক বৈরাগ্যোদয় হইল এবং কাদম্বরীর স্নেহপাশ ভেদ করিয়া তৎক্ষণাৎ আপন আশ্রমে আগমন করিলাম। একদা আশ্রমে বসিয়া আছি এমন সময়ে, রাজকুমারের সমবয়স্ক ও সদৃশাকৃতি সুকুমার এক ব্রাহ্মণকুমারকে দূর হইতে দেখিলাম। তিনি এরূপ অন্যমনস্ক যে তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন প্রণষ্ট বস্তুর অন্বেষণ করিতে করিতে এইদিকে আসিতেছেন। ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইয়া পরিচিতের ন্যায় আমাকে জ্ঞান করিয়া, নিমেষশূন্য নয়নে অনেক ক্ষণ আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। অনন্তর মৃদু স্বরে বলিলেন, সুন্দরি! এই ভূমণ্ডলে বয়স ও আকৃতির অবিসংবাদী কর্ম্ম করিয়া কেহ নিন্দাস্পদ হয় না। কিন্তু তুমি তাহার বিপরীত কর্ম্ম করিতেছ। তোমার নবীন বয়স, কোমল শরীর ও শিরীষকুসুমের ন্যায় সুকুমার অবয়ব। এ সময় তোমার তপস্যার সময় নয়। মৃণালিনীর তুহিনপাত যেরূপ সাংঘাতিক, তোমার পক্ষে তপস্যার আড়ম্বর সেইরূপ। তোমার মত নবযুবতীরা যদি ইন্দ্রিয়সুখে জলাঞ্জলি দিয়া তপস্যায় অনুরক্ত হয়, তাহা হইলে, মকরকেতুর মোহন শর কি কার্য্যকর হইল? শশধরের উদয়, কোকিলের কলরব, বসন্তকালের সমাগম ও বর্ষা ঋতুর আড়ম্বরের কি ফলোদয় হইল? বিকসিত কমল, কুসুমিত উপবন ও মলয়ানিল কি কর্ম্মে লাগিল?
দেব পুণ্ডরীকের সেই দারুণ ঘটনাবধি আমি সকল বিষয়েই নিরুৎসুক ছিলাম। ব্রাহ্মণকুমারের কথা অগ্নিশিখার ন্যায় আমার গাত্র দাহ করিতে লাগিল। তাহার কথা সমাপ্তি না হইতেই বিরক্ত হইয়া তথা হইতে উঠিয়া গেলাম। দেবতাদিগের অর্চ্চনার নিমিত্ত কুসুম তুলিতে লাগিলাম। তথা হইতে তরলিকাকে ডাকিয়া কহিলাম, ঐ দুর্ব্বৃত্ত ব্রাহ্মণকুমারের অসঙ্গত কথা ও কুৎসিত ভাবভঙ্গী দ্বারা বোধ হইতেছে, উহার অভিপ্রায় ভাল নয়। উহাকে বারণ কর, যেন আর এখানে না আইসে। যদি আইসে ভাল হইবে না। তরলিকা ভয়প্রদর্শন ও তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক বারণ করিয়া কহিল, তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও, পুনর্ব্বার আর আসিও না। সেই হতভাগ্য সে দিন ফিরিয়া গেল বটে, কিন্তু আপন সঙ্কল্প এক বারে পরিত্যাগ করিল না। একদা নিশীথসময়ে চন্দ্রোদয়ে দিগ্বলয় জ্যোৎস্নাময় হইলে তরলিকা শিলাতলে শয়ন করিয়া নিদ্রায় অচেতন হইল। গ্রীষ্মের নিমিত্ত গুহার অভ্যন্তরে নিদ্রা না হওয়াতে আমি বহিঃস্থিত এক শিলাতলে অঙ্গ নিক্ষেপ করিয়া গগনোদিত সুধাংশুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলাম। মন্দ মন্দ সমীরণ গাত্রে সুধাবৃষ্টির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। সেই সময়ে দেব পুণ্ডরীকের বিস্ময়কর ব্যাপার স্মৃতিপথারূঢ় হইল। তাঁহার গুণ স্মরণ হওয়াতে খেদ করিয়া মনে মনে কহিলাম আমি কি হতভাগিনী! আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ বুঝি দেববাক্যও মিথ্যা হইল! কই! প্রিয়তমের সহিত সমাগমের কোন উপায় দেখিতেছি না। কপিঞ্জল সেই গমন করিয়াছেন, অদ্যাপি প্রত্যাগত হইলেন না। এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছি এমন সময়ে দূর হইতে পদসঞ্চারের শব্দ শুনিতে পাইলাম। যে দিকে শব্দ হইতেছিল, সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া জ্যোৎস্নার আলোকে দূর হইতে দেখিলাম, সেই ব্রাহ্মণকুমার উন্মত্তের ন্যায় দুই বাহু প্রসারিত করিয়া দৌড়িয়া আসিতেছে। তাহার সেইরূপ ভয়ঙ্কর আকার দেখিয়া সাতিশয় শঙ্কা জন্মিল। ভাবিলাম, কি পাপ! উন্মত্তটা আসিয়া সহসা যদি গাত্র স্পর্শ করে, তৎক্ষণাৎ এই অপবিত্র কলেবর পরিত্যাগ করিব। এত দিনে প্রাণেশ্বরের পুনর্দ্দর্শন প্রত্যাশার মূলোচ্ছেদ হইল। এত কাল বৃথা কষ্ট ভোগ করিলাম।
এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে নিকটে আসিয়া কহিল, চন্দ্রমুখি! ঐ দেখ কুসুমশরের প্রধান সহায় চন্দ্রমা আমাকে বধ করিতে আসিতেছে। এক্ষণে তোমার শরণাপন্ন হইলাম, যাহাতে রক্ষা পাই কর। তাহার সেই ঘৃণাকর কথা শুনিয়া আমার রোষানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। ক্রোধে কলেবর কাঁপিতে লাগিল। নিশ্বাসবায়ুর সহিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইতে লাগিল। ক্রোধে তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক ভর্ৎসনা করিয়া কহিলাম, রে দুরাত্মন্! এখনও তোর মস্তকে বজ্রাঘাত হইল না, এখনও তোর জিহ্বা ছিন্ন হইয়া পতিত হইল না, এখনও তোর শরীর শত শত খণ্ডে বিভক্ত হইয়া গেল না? বোধ হয় শুভাশুভ কর্ম্মের সাক্ষীভূত পঞ্চ মহাভূত দ্বারা তোর এই অপবিত্র অস্পৃশ্য দেহ নির্ম্মিত হয় নাই। তাহা হইলে, এত ক্ষণে তোর শরীর অনলে ভস্মীভূত, জলে আপ্লাবিত, রসাতলে নীত, বায়ুবেগে শতধা বিভক্ত ও গগনের সহিত মিলিত হইয়া যাইত। মনুষ্যদেহ আশ্রয় করিয়াছিস, কিন্তু তোকে তির্য্যগ্জাতির ন্যায় যথেচ্ছাচারী দেখিতেছি। তোর হিতাহিত জ্ঞান ও কার্য্যাকার্য্যবিবেক কিছুই নাই। তুই একান্ত তির্য্যগ্ধর্ম্মাক্রান্ত। তির্য্যগ্জাতিতেই তোর পতন হওয়া উচিত। অনন্তর সর্ব্বসাক্ষীভূত ভগবান্ চন্দ্রমার প্রতি নেত্রপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলাম, ভগবন্! সর্ব্বসাক্ষিন্! দেব পুণ্ডরীকের দর্শনাবধি যদি অন্য পুরুষের চিন্তা না করিয়া থাকি, যদি কায়মনোবাক্যে তাঁহার প্রতি ভক্তি থাকে, যদি আমার অন্তঃকরণ পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক হয়, তাহা হইলে, আমার বচন সত্য হউক অর্থাৎ তির্য্যগ্জাতিতে এই পাপিষ্ঠের পতন হউক। আমার কথার অবসানে, জানি না, কি মদনজ্বরের প্রভাবে, কি আত্মদুষ্কর্ম্মের দুর্ব্বিপাকবশতঃ, কি আমার পাপের সামর্থ্যে, সেই ব্রাহ্মণকুমার অচেতন হইয়া ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলে পতিত হইল। তাহার সঙ্গিগণ কাতর স্বরে হা হতোঽস্মি! বলিয়া শব্দ করিয়া উঠিল। তাহাদের মুখে শুনিলাম তিনি আপনার মিত্র। এই বলিয়া লজ্জায় অধোমুখী হইয়া মহাশ্বেতা রোদন করিতে লাগিলেন।