কাফ্রি দাসের বৃত্তান্ত/তৃতীয় ভাগ
কাফ্রি দাসের সহিত এরূপ আনন্দজনক কথা হইলে পর আমার মনে যে চেতনা জন্মিল তাহা ব্যক্ত করা ভার।
বাটীতে ফিরিয়া আইলে পর এই বিষয় ভাবিতে২ আমি জ্ঞান করিলাম তাহার বিশ্বাস ও ঈশ্বরের প্রতি মনঃপরিবর্ত্তনের প্রমাণ অতি স্পষ্ট ও সুন্দর রূপে প্রকাশ পাইয়াছে।
ইহাতে স্বচ্ছন্দে দেখা গেল, মনুষ্যেরা অনুগ্রহ পাইয়া বিশ্বাসদ্বারা পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়়; তাহা যে তাহাদের নিজ গুণে এমত নহে, কিন্তু সে ঈশ্বরের দান হয়। এবং কাহারো যেন দর্প না হয়, এই নিমিত্তে তাহা কোন কর্ম্মের ফলেও হয় না। দেখ, যে ব্যক্তি পূর্ব্বে অজ্ঞানতারূপ ঘোর অন্ধকারে আবৃত হইয়া একগুঁইয়া ও অবশ বিপথগামী হইয়াছিল, সেই ব্যক্তি পরামনন পূর্ব্বক এইক্ষণে জ্ঞানি ও নম্র ও বিশ্বাসি খ্রীষ্টীয়ান হইয়াছে। অনুগ্রহরূপ জীবনের কর্ত্তা ও দাতা যে পবিত্র আত্মা তাঁহা বিনা এমত আশ্চর্য্য কর্ম্ম করা কাহার সাধ্য?
এই যুবা আপন প্রভর বাটীতে ও সর্ব্বত্র কিমত আচরণ করে, ইহা জানিতে আমি বিশেষ অনুসন্ধান করিলাম, আর এই বিষয়ে যাহা২ শুনিলাম তাহা তাবৎই সন্তোষজনক হইল। অতএব তাহার আচার ব্যবহার বাপ্তিস্মের উপযুক্ত, ইহাতে সন্দেহ করিতে পারিলাম না। পরে তাহার সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ হইলে আমি তাহাকে ধর্ম্মপুস্তকানুসারে ক্রমিক শিক্ষা দিতে লাগিলাম, তাহাতে তাহার মন ক্রমে২ ধর্ম্ম বিষয়ে বুদ্ধি পাইল। সে আপন ধর্ম্মপুস্তক সঙ্গে করিয়া লইয়া যখন২ কর্ম্মহইতে অবকাশ পাইত, তখন২ তাহা পাঠ করাতে অত্যুত্তমরূপে পড়িতে শিখিল।
দরিদ্র খ্রীষ্টীয়ানদের মধ্যে আমি এরূপ অনেক বার দেখিয়াছি; বাল্যাবস্থায় পাঠ শিক্ষা না করিলেও যে সময়ে পরিত্রাণ বিষয়ক ভাবনা ও ঈশ্বরের বাক্য জানিবার ইচ্ছা মনে উৎপন্ন হয়, সে সময়ে তাহারা পাঠ শিক্ষা করিতে ব্যগ্র হয়, তাহাতে স্বচ্ছন্দে অভ্যাস করত নিজ ও পরের মঙ্গল বাহুল্যরূপে জন্মায়। কাফ্রি দাসের বিষয়েতে ইহা স্পষ্টমতে দৃষ্ট হইল।
ধর্ম্মবিষয়ক কথোপকথন ও শিক্ষা ও প্রার্থনা করণাভিপ্রায়ে আমি তাহার প্রভুর বাটীর নিকটস্থ কোন কুটীরে অনেক কালাবধি প্রতি সপ্তাহে একবার যাইয়া থাকিতাম। ঐ প্রার্থনাদির সময় আমাদের ফলজনক ও মনোরঞ্জক হইত, এবং তৎসভাস্থ লোক সকল যেন কাফ্রির সরল ও অকপট ভাবের সাক্ষীস্বরূপ হয়, তন্নিমিতে আমি তাহাকে সে স্থানে আপনার সহিত লইয়া যাইতে মনস্থ করিলাম। আর তাহা করিলে যাহাদের পারমার্থিক জ্ঞানের বৃদ্ধি বিষয়ে আমি অতিচেষ্টাবান ছিলাম, এমত সভাস্থ লোকেরা প্রার্থনা ও ধন্যবাদ করিতে অধিক উদ্যোগী হইবে, ইহাও ভরসা করিলাম।
ইহা স্থির করিয়া আমি কাফ্রিকে সেই স্থানে একবার লইয়া যাইতে তাহার কর্ত্তার অনুমতি প্রার্থনা করিলাম। ধর্মদ্বারা উইলিয়মের মন যে কি আশ্চর্য্য রূপে পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, ও তাহাতে তাহার আচার ব্যবহারও পূর্ব্বাপেক্ষা উত্তম হইয়াছে, ইহা জাহাজাধ্যক্ষ সুজ্ঞাত হইয়া আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইয়া অনুমতি প্রদান করিলেন।
নিরূপিত দিবসে আমি ঐ কুটীরে গেলাম। সে কুটীর আমার বাটীহইতে প্রায় দুই ক্রোশ অন্তর, আর এই পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগে লিখিত যে পর্ব্বত চূড়াহইতে এমত সুন্দর দর্শন হইল, সেই পর্ব্বতের অধোভাগ দিয়া গেলাম। পর্ব্বতের চূড়া ঢালু থাকা প্রযুক্ত দক্ষিণদিগে তৃণ ভক্ষণকারি মেষ ভিন্ন আর কিছুই দেখা গেল না। কিন্তু কোন২ স্থলে খড়িমাটির শুক্লবর্ণও তৃণের হরিদ্বর্ণদ্বারা পর্ব্বত অতি শোভান্বিত দৃষ্ট হইল।
বামদিগে অর্দ্ধক্রোশ অন্তরে সমুদ্রের জল প্রবেশ করাতে একটা ক্ষুদ্র হ্রদ হইয়াছিল। ঐ হ্রদের এক দিগে মাছুয়া ও মালিমদের কতক গুলিন নৌকা লঙ্গর করা ছিল, আর অন্যদিগে নিকটবর্ত্তি বন ও মাঠের সমীপে গ্রামের ভজনালয় দৃষ্ট হইল। তাহাতে ঘণ্টা সকল বাজান যাইতেছিল, ও তাহাদের মুদু শব্দ জলের উপরে বিস্তারিত হইয়া পর্ব্বতের গহ্বরে প্রবিষ্ট হইলে তাহার প্রতিধ্বনি বার২ শুনা গেল। তত্রস্থ তাবৎ দর্শনই আনন্দজনক ছিল।
আমি গ্রামের মধ্যে অতি সুন্দর স্থানে নির্ম্মিত কতকগুলিন ঘরের নিকট দিয়া গমন করিলাম। সে স্থান শান্তিকচাগের উপযুক্ত বটে। প্রত্যেক ঘর পুষ্পোদ্যানে বেষ্টিত, ও তাহার নিকটে ফল বৃক্ষের বাগান, এবং তন্নিকটস্থ মাঠে কৃষকের গোরু চরিয়া আপন প্রভুর পরিবারের নিমিত্তে দুগ্ধাদি উত্তম২ ভক্ষ্য প্রস্তুত করিতেছিল। এই গ্রামের ভূম্যধিকারিরা সুবিবেচনাপূর্ব্বক ভূমি সকল ভাগ করিয়া দরিদ্র চাষাদিগকে দিয়াছিলেন। স্বাস্থ্যজনক শাক তরকারি ও ঔষধের চারা ও সুগন্ধি ফুল ইত্যাদি বাটীর চতুর্দ্দিগে উৎপন্ন হইতেছিল। অতএব আমি ইহা বিবেচনা করিলাম, দরিদ্র পরিশ্রমিদের ভাগ্য অতি সুখজনক, কারণ তাহারা স্বর্গীয় জ্ঞানজনক পাঠশালাহইতে কৃতজ্ঞতা শিক্ষা প্রাপ্ত হয়। ধনবান লোকদের জন্যে কেবল নয়, কিন্তু দরিদ্রদেরও জন্যে সূর্য্য আলো করে, ও বৃষ্টি পড়ে, ও মৃত্তিকাহইতে শস্যাদি জন্মে ও বৃক্ষ সকল ফুল ও ফল ধরে ও পক্ষিগণ গান করে; তাহাদের অধিক বস্তুর আবশ্যকতা নাই, আর মনে সন্তোষ থাকিলে তাহারা অল্পতর বস্তুতেও তৃপ্ত হয়। বিশেষতঃ সাংসারিক বিষয়েতে দরিদ্র হইয়া যাহারা বিশ্বাসে ধনবান ও স্বর্গের মনোনীত অধিকারী, তাহারাই ধন্য।
আমি যে সুন্দর ও পরিষ্কৃত কুটীর দিয়া গেলাম, তন্নিবাসি কতক লোকদের এরূপ অবস্থা ছিল। তাহাদের শান্তি হউক! তাহারা জীবদ্দশাতে যাত্রিক ও বিদেশীয় লোকস্বরূপ; ও শয়তানের হস্তহইতে মুক্ত হওয়াতে তাহাদের সহিত স্বর্গে সাক্ষাৎ পাইবার আমার ভরসা আছে।
আমি যে কুটীরেতে যাইতেছিলাম, সে এক বনের পার্শ্বে থাকা প্রযুক্ত গ্রীষ্মকালের রৌদ্রহইতে ও শীতকালের ঝড়হইতে রক্ষা পাইত। নিকটবর্ত্তী হইলে পর আমি আপন কাফ্রি বন্ধুকে আমার অপেক্ষায় বৃক্ষের তলে বসিয়া থাকিতে দেখিলাম। তাহার হাতে একখানি ক্ষদ্র বহি ছিল, তাহা আমি পূর্ব্বে তাহাকে দিয়াছিলাম, ও তাহার ধর্ম্ম পুস্তক ভূমিতে পড়িয়া রহিল। সে আমাকে দেখিবামাত্র অতি আনন্দ পূর্ব্বক উঠিয়া কহিল;
“হে মহাশয়, আমি আপনাকে দেখিয়া অতি হৃষ্ট হইলাম, কারণ আমি মনে করিয়াছিলাম, আপনি অতি বিলম্বে আসিতেছেন।”
হে উইলিয়ম, তুমি ভাল আছ; আমি নিজ কএক জন বন্ধুর নিকটে তোমাকে লইয়া যাইতে চাহি, বোধ হয় তাহারা প্রভুরও বন্ধু। আমরা প্রতি বুধবারে একত্র হইয়া আপনাদের অনন্তকালীন সুখ বিষয়ে কথোপকথন করি; আর আমি নিশ্চয় জানি তাহারা তোমাকে অতি আনন্দ পূর্ব্বক গ্রাহ্য করিবে।
“মহাশয়, এমত ধার্ম্মিক লোকদের মধ্যে যাইতে আমি যোগ্য নহি। আমি মহাপাপী। তাহারা উত্তম খ্রীষ্টীয়ান।”
হে উইলিয়ম, তাহাদিগকে যদি জিজ্ঞাসা কর, তবে তাহারা প্রত্যেকে বলিবে যে আমি আর সকল লোক অপেক্ষা মহাপাপী। কেবল অল্পকাল হইল তাহাদের মধ্যে অনেকে প্রকাশরূপে দুষ্কর্ম্ম করিত, ও ঈশ্বরকে না জনিয়া কায়মনোবাক্যে ষীশু খ্রীষ্টের শত্রু ছিল। কিন্তু প্রভুর অনুগ্রহদ্বারা এ দুষ্ট পথে চেতনা পাইলে তাহাদের অন্তঃকরণ দমন হইল, ও তাহারা এক্ষণে তাঁহাকে প্রেম করত তাঁহার আজ্ঞা পালন করে। তুমি যাহাদের সাক্ষাৎ পাইবা, তাহারা তোমার মত পাপী, কিন্তু প্রভুর প্রেমের বিষয়ে কথোপকথন করে, ও তাঁহার প্রশংসা করে; আর আমি নিশ্চয় জানি, তুমিও তাহাদের সহিত একত্র হইয়া যীশুর স্তবস্তুতি গান করিতে ইচ্ছা কর।
“হাঁ, মহাশয়, সে গীত এই অধম কাফ্রির প্রতি উত্তমরূপে খাটিবে।”
ইহা বলিয়া আমরা কুটীরের বাগানের দ্বারে উপস্থিত হইলাম। অনেক লোক বাটীর মধ্যে ও নিকটে দাঁড়াইয়া প্রেম ভাবে তাকাইয়া আমাদিগকে আনন্দপূর্ব্বক গ্রাহ্য করিল। তাহারা জানিয়াছিল কাফ্রী অদ্যকার সভাতে আসিবে, এই কারণ প্রত্যেকের মুখে সন্তোষ প্রকাশিত হইল। পরে আমি তাহার হাত ধরিয়া তাহার বিষয়ে লোকদিগকে কহিলাম, হে আমার বন্ধুগণ, আমি আফ্রীকা দেশীয় এক জন ভ্রাতাকে তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করাইতে আনিলাম। তোমরা প্রভু ষীশু খ্রীষ্টের নামেতে তাহাকে আনন্দে গ্রাহ্য করিও।
তত্রস্থ এক জন নম্রশীল ও ধার্ম্মিক মজুরের অন্তঃকরণ ও জিহ্বা খ্রীষ্টীয় কোমলতাতে সর্ব্বদা পরিপূর্ণ ছিল। সে ব্যক্তি কহিল, “আপনাদের প্রিয় শিক্ষককে দেখিতে আমরা নিত্য আনন্দিত হই; বিশেষতঃ অদ্য, যেহেতুক তিনি এই কাফ্রিকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। তাহার প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহের বিষয় আমরা শুনিয়াছি।” ইহাতে সে কাফ্রির প্রতি ফিরিয়া কহিল, “প্রিয় বন্ধু, তোমার হাতে দেও। এই স্থানে ও সর্ব্বস্থানে ঈশ্বর তোমার সঙ্গে হউন, আর তাঁহার নাম ধন্য হউক, যেহেতুক আমরা দুই জনে অতিশয় পাপিষ্ঠ হইলেও তিনি উভয়কেই আপন দয়া হেতু ডাকিয়াছেন, অতএব আইস আমরা তাঁহাকে প্রেম করিয়া তাঁহার সেবা করি।”
কাফ্রী বাটীতে প্রবেশ করণকালে প্রত্যেক জন তাহাকে আহ্লাদ পূর্ব্বক গ্রাহ্য করিলে পর কোন২ ব্যক্তি তাহাকে অতি কোমল ও উত্তম বাক্য কহিল। সে বলিল, “মহাশয়, এ সকল উত্তম বন্ধুদের প্রতি আমি কি কহিব, তাহা জানি না; এই স্থান পৃথিবীর মধ্যে স্বর্গতুল্য বোধ হইতেছে।”
তাহাতে সে সজল নয়নে কহিল, “হে প্রিয় বন্ধুরা ও যীশু খ্রীষ্টাশ্রিত ভাইরা, ঈশ্বর তোমাদিগকে আশীর্ব্বাদ করুন, ও শেষে স্বর্গেতে গ্রহণ করুন।” এই কথা সমাপ্ত হওনের পূর্ব্বে কেহ২ তাহার ক্রন্দন দেখিয়া আপনারাও কান্দিতে লাগিল।
এই সকল বন্ধুদের সঙ্গে একত্র হওন কালে আমি ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করত প্রার্থনাদ্বারা ঈশ্বরের আরাধনা আরম্ভ করিতাম। এই সময়েও সে রূপ করিলে পর আমি বর্ত্তমান লোকদিগকে কহিলাম, ঈশ্বর অনুগ্রহ পূর্ব্বক কতক কাল হইল এ যুবাকে আমার উপদেশ শুনিতে আনিয়াছেন; এবং আমি ধর্ম্মবিষয়ে তাহাকে সরলমনা ও চিন্তিত দেখিয়া তাহার ইচ্ছানুসারে তাহাকে বাপ্তাইজ করিতে স্থির করিয়াছি। আরও কহিলাম, আমাদের সহিত ধর্ম্ম বিষয় কথোপকথন করণার্থে আমি তাহাকে এই সময়ে এস্থানে আনিলাম; কারণ “পূর্ব্বকালে যাহারা প্রভুকে ভয় করিত, তাহারা যদ্রুপ পরস্পর অনেকবার কথা কহিত, আর তাহাতে এই প্রমাণ হইল তাহারা তাঁহার চিন্তা করিত” (মলাখি ৩;১৬) তদ্রূপ আমরাও পরস্পর শিক্ষা প্রাপণাভিপ্রায়ে একত্র হইয়া খ্রীষ্টীয় লোকদের উচিত কার্য্য ভ্রাতৃরূপে করিতেছি।
পরে আমি কাফ্রির প্রতি ফিরিয়া কহিলাম, ওহে উইলিয়ম, কে তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন?
তাহাতে কাফ্রী কহিল, “দয়াবান্ পিতা ঈশ্বর।”
কে তোমাকে ত্রাণ করিলেন?
“তাঁহার প্রিয় পুত্র ষীশু, তিনি আমার জন্যে মরিলেন।”
কে তোমাকে পবিত্র করেন?
“পবিত্র আত্মা, তিনি পিতাকে ও তাঁহার প্রিয় পুত্ত্র যীশুকে জানিতে আমাকে শিক্ষা দিলেন।”
স্বভাবতঃ তোমার কি দশা ছিল?
“আমি অতি পাপী ছিলাম; পাপ ভিন্ন কিছু জানিতাম না, কিছুও করিতাম না; আমার শরীর অপেক্ষা আমার মন মলীন হইত।”
সে সময়াবধি তোমার মন পরিবর্ত্তন হইয়াছে কি না?
“আমার এমত ভরসা আছে; কিন্তু কখন২ ভয় কার পাছে সে ভরসা মিথ্যা হয়।”
যদি তোমার মন পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে, তবে সে পরিবর্ত্তন কে করিলেন?
“পিতা ঈশ্বর; তাঁহার প্রিয় পুত্র যীশু; ও পবিত্র আত্মা।’
এই পরিবর্ত্তন তোমার মধ্যে কি রূপে হইয়াছিল?
“অতি শিশুকালে ঈশ্বর আমাকে দাস করিয়াছিলেন।”
হে উইলিয়ম, ঈশ্বর তোমাকে দাস করিলেন, তুমি এই কথা কি রূপে বলিতে পার?
“মহাশয় আমার অভিপ্রায় এই, ঈশ্বর আমার মঙ্গলের নিমিত্তে গোরা লোকদিগের নিকটে আমার দাস্যবৃত্তি করা ভাল বুঝিলেন।”
তাহা তোমার মঙ্গলের নিমিত্তে কি রূপে হইল?
“তিনি আমাকে অন্ধকারময় দেশহইতে দীপ্তিময় দেশে আনিলেন।”
দীপ্তিময় দেশ কাহাকে বল? সে কি জামেকা উপদ্বীপ?
“না, তাহা আমার কারারূপ দেশ; কিন্তু দীপ্তিময় দেশ আমেরিকা, কারণ আমি প্রথম বার সে স্থানেই সেই উত্তম উপদেশকের প্রমুখাৎ খ্রীষ্ট বিষয়ক সুসমাচার শুনিয়াছিলাম। এখন যে স্থানে আছি, তাহা অধিক দীপ্তিময় দেশ, কেননা যীশু পাপিদিগকে কি রূপ প্রেম করেন, তাহা মহাশয় ক্রমে২ আমাকে অধিক জানাইতেছেন।”
খ্রীষ্টের রক্ত কি করে?
“খ্রীষ্টের রক্ত তাবৎ পাপহইতে পরিষ্কার করে, আর আমার ভরসা হয় যে আমাকেও পাপহইতে পরিষ্কার করিবে।”
তবে কি তাঁহার রক্তদ্বারা তাবৎ লোক পাপহইতে পরিষ্কৃত হয়?
“না, মহাশয়।”
কোন্ লোকেরা পরিষ্কৃত হইয়া ত্রাণ পায়?
“যাহারা তাঁহাতে বিশ্বাস করে।”
তুমি কি ধর্ম্মপুস্তকহইতে ইহার প্রমাণ দিতে পার?
“হাঁ, মহাশয় পারি, লেখা আছে যে কেহ পুত্ত্রে প্রতি বিশ্বাস করে, তাহার অনন্ত, পরমায়ুঃ হয়; যে পুত্ত্রকে না মানে, সে পরমায়ুর দর্শন পায় না; কিন্তু ঈশ্বরের ক্রোধপাত্র হইয়া থাকে।” যোহন ৩;৩৬।
বিশ্বাস প্রাপ্ত হওয়া কি?
“আমার এমত বোধ হয়, যীশু খ্রীষ্টের বিষয় অধিক ধ্যান করা, ও তাঁহাকে অধিক প্রেম করা, ও তিনি যাহা বলেন তাহা সত্য জ্ঞান করা, ও তাঁহার স্থানে পুনঃ২ প্রার্থনা করা, আর যৎকালীন আপনাকে অতি দুর্ব্বল ও পাপিষ্ঠ বোধ করি, তৎকালীন তিনি আমার নিমিত্তে বলবান ও কৃপাবান, ইহা বিবেচনা করাই বিশ্বাস।”
তুমি যে বিশ্বাসের কথা বলিলা, তোমার কি তদ্রূপ বিশ্বাস আছে?
“মহাশয়, আমি কখন২ বোধ করি আমার কিছু মাত্র বিশ্বাস নাই।”
হে উইলিয়ম, কেন তুমি এমত বোধ কর?
“আমি যখন প্রভু যীশু খ্রীষ্টের বিষয় ভাবিতে চাহি, তখন মন অন্য কোন বিষয়েতে যায়; যে সময়ে তাঁহাকে প্রেম করিতে চাহি, তখন অন্তঃকরণ শীতল হয়; তিনি পাপিদিগকে যাহা২ বলেন তাহা তাবৎই সত্য, ইহা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করিলে মনে করি, তাহা আমার বিষয়ে সত্য নহে; প্রার্থনা করিতে চাহিলে শয়তান আমার অন্তঃকরণে অতি দুষ্ট চিন্তা জন্মায়; আর আমি কখনও খ্রীষ্টের প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ নহি। এই সকল কারণ প্রযুক্ত কোন২ সময়ে ভয় হয় আমার কিছু মাত্র বিশ্বাস নাই।”
কতক লোক কাফ্রির এই কথা অতি মনোযোগ পূর্ব্বক শুনিয়া তাহার দুঃখেতে দুঃখী হইতেছে, ইহা দেখিয়া আমি কহিলাম;
হে উইলিয়ম, তোমার এ বিষয়ে ভয়থাকাতেই বোধহয় আমি প্রমাণ দিতে পারি যে তোমার বিশ্বাস আছে। আমার আর কএক প্রশ্নের উত্তর দেও।
তুমি কি আপনা আপনি অর্থাৎ আপন চিন্তা ও ক্রিয়াদ্বারা আপনাকে মহাপাপী জানিয়া ত্রাণকর্ত্তার আবশ্যকতা বিষয় জ্ঞাত হইলা?
“না, তদ্বিষয় নিজে না ভাবিতে২ চেষ্টাও না করিতে২ সেই জ্ঞান অকস্মাৎ মনে উদয় হইল।”
সুসমাচার প্রচারদ্বারা তোমার অন্তঃকরণ জাগাইতে কে আমেরিকা দেশের সদুপদেশককে পাঠাইলেন?
“ঈশ্বর, তিনি বই আর কে?”
তবে কে তোমার মনে ধর্ম্ম চিন্তা ও ভাবনার কার্য্য আরম্ভ করিলেন?
“দয়াবান ঈশ্বর, আমি তাহা নিজে করিতে পারিতাম না, ইহা নিশ্চয় জানি।”
যীশু খ্রীষ্টদ্বারা যে পরিত্রাণ, সে সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় বিষয়, ইহা ভাবিয়া তুমি কি তাহা অতি বাঞ্ছনীয় জ্ঞান কর?
“হাঁ, তাহা অবশ্য করি”।
তিনি তোমাকে ত্রাণ করিতে পারেন, ইহা কি তুমি বিশ্বাস কর?
“হাঁ, তিনি শেষপর্য্যন্ত ত্রাণ করিতে পারেন।”
তুমি কি বোধ কর তিনি তোমাকেই ত্রাণ করিতে ইচ্ছুক নহেন?
“না, আমি ইহা কহিতে পারি না। তিনি অতি দয়া ও অনুগ্রহ করিয়া কহিয়াছেন; যে কেহ আমার শরণাগত হইবে, আমি তাহাকে কোন ক্রমে দূর করিব না।”
তুমি কি তাঁহার আজ্ঞা পালন করিতে অত্যন্ত ইচ্ছুক ও যত্নবান আছ?
“হাঁ, মহাশয়, আমি তাঁহাকে প্রেম করি, তাহাতে তিনি যাহা কহেন তাহাই করিতে চাহি।”
ঈশ্বর যদি তোমাকে দুঃখের অবস্থায় আনেন, তবে কি তুমি তাঁহার নাম হেতু সেই দুঃখ সহ্য করিতে সম্মত হইবা?
“হাঁ বোধ করি তাঁহার প্রতি প্রেম প্রযুক্ত আমি প্রাণও দান করিতে পারি। তিনি এ দুরাচার পাপির নিমিত্তে মরিলেন, অতএব এমত দায়াবান ও ধর্ম্মত্রাতার জন্যে দুরাচার পাপী মরিবে না কেন?”
ভাল, উইলিয়ম্, আমি তোমাকে সাহস করিয়া কহিতে পারি, তোমার বিশ্বাসই তোমাকে সুস্থ করিয়াছে।
এই কথাতে তৎকালের পরীক্ষার শেষ করিলাম। ঘরের অন্য বন্ধু সকল প্রেমার্দ্র হইয়া অতি মনোযোগপূর্ব্বক এই জিজ্ঞাসোত্তর শুনিল। পরে তাহাদের এক জন মনস্তাপ প্রকাশ করিয়া কহিল।
“মহাশয়, আমি দেখিতেছি, কতক লোক কৃষ্ণবর্ণ ও কতক লোক শুক্লবর্ণ বটে; কিন্তু সত্য খ্রীষ্টীয়ানেরা সকল একবর্ণ। এই কাফ্রী কথা কহিতে২ আমার অন্তঃকরণ তাহার সঙ্গে গেল।” তাহাতে আর সকল লোকেরা প্রত্যেকেই কহিতে লাগিল, “আমারও সেই রূপ।”
কাফ্রুর বৃত্তান্তের বিষয়ে আরো কিছু কথাবার্ত্তা হইলে পর আমি কহিলাম, ঈশ্বরের অনুগ্রহরূপ বাহুল্য ও অনির্ব্বচনীয় দান হেতু তাঁহার ধন্যবাদ করত যীশুর প্রেমের বিষয়ে এইক্ষণে আমরা গান করি, যথা,
চল ভাই স্বর্গ গীত
যীশু নামে সবে গাই। ইত্যাদি।
সেই গায়ক লোকদের স্বর উত্তম হউক অথবা না হউক, তাহাদের অন্তঃকরণের ভক্তি ভাব প্রযুক্ত ঈশ্বরের উদ্দেশে তাহা সুশ্রাব্য গানস্বরূপ হইল, ইহার কোন সন্দেহ নাই।
কাফ্রী আমাদের গানের স্বর উত্তমরূপে জানিত না বটে; তথাপি সে আমাদের সহিত অতি ব্যগ্রতা ও প্রেম পূর্ব্বক গান করিতে লাগিল। ইহাতে জানা গেল, গীতের কথা তাহার মনে অতি সুন্দর রূপ লাগিয়াছে। আমরা যখন পঞ্চম পদের শেষ করিলাম, যথা,
সুদ্ধ দয়া করি তিনি
স্বর্গহৈতে নামিলেন,
তখন কাফ্রী এক প্রকার বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া এ কথা পুনরুক্তি করিয়া কহিল, হাঁ, বটে, সুদ্ধ দয়া করিয়া উইলিয়মকে উদ্ধার করিতে তিনি স্বর্গহইতে নামিলেন।
অনুগ্রহদ্বারা যে পরিত্রাণ হয়, আমি এই বিষয়ে অল্প কথা বলিয়া গীত গাইলে পর বর্ত্তমান ব্যক্তি সকলকে আপনাদের স্বর্গ গমনের নিরূপিত পথে ধাবমান হইতে পরামর্শ দিয়া সভা ভঙ্গ করিলাম। সেই রাত্রির সকল ঘটনা যদ্যপি পৃথিবীতে কোন পুস্তকে লিখিত না হইত, তথাপি স্বর্গের স্মরণরূপ পুস্তকে নিঃসন্দেহে লেখা থাকিত।
তৎপরে আমি কাফ্রির বাপ্তাইজিত হওনের দিবস নিরূপণ করিয়া আপন প্রেমি বন্ধুগণহইতে বিদায় হইলাম।
বাটীতে ফিরিয়া যাওন কালে নির্ম্মল চন্দ্রের প্রতিবিম্ব হ্রদস্থ জলের উপরে পড়িল। ইহার কিছু কাল পূর্ব্বে আমি কতক লোকদের সহিত একত্র হইয়া অনুগ্রাহক ও বিধাতা ঈশ্বরের ধন্যবাদ করিয়াছিলাম; কিন্তু এইক্ষণে জগৎ সৃষ্টির সৌন্দর্য্য ও সান্তনা দেখিয়া বিশ্বেশ্বরের প্রতি নূতন উপঢৌকনরূপ প্রশংসা করিতে হইল। তদ্রূপ দায়ূদ্ও ৮ গীতে গায়; যথা, “তোমার অঙ্গুলিদ্বারা নির্ম্মিত যে আকাশ, ও তোমার স্থাপিত যে চন্দ্র ও তারাগণ, তাহা নিরীক্ষণ করিলে বলি, মনুষ্য কে, যে তুমি তাহাকে স্মরণ কর? এবং মনুষ্যসন্তান বা কে, যে তাহার তত্ত্বাবধারণ কর?”
অল্প দিনের মধ্যে কাফ্রী বাপ্তাইজিত হইল। আর তাহার কতক কাল পরে সে জাহাজে চড়িয়া আপন কর্ত্তার সহিত দেশান্তরে যাত্রা করিল। সেই অবধি আমি তাহার বিষয়ে কোন সংবাদ পাই নাই; অতএব সে এই পর্য্যন্ত যাত্রিকের ন্যায় জগৎ ভ্রমণ করিতেছে, অথবা স্বর্গে যীশুর প্রেম বিষয়ক গীত গায়কদের সভায় প্রবিষ্ট ইইয়াছে, তাহা আমি জানি না। কিন্তু ইহা নিশ্চয় জানি, সে কাফ্রী পরমেশ্বরের প্রশংসার্থ স্তম্ভস্বরূপ। তাহার অন্তঃকরণে ত্রাণকর্ত্তার প্রতিমূর্ত্তি মুদ্রাঙ্কিত হইল, আর অনুগ্রহদ্বারা তাহার মনের পরিবর্ত্তন হইয়াছিল, ইহা তাহার সরল ও অকপট আচার ব্যবহারেতে ও কথোপকথনেতে প্রকাশ পাইত। তজ্জন্যে ঈশ্বরকে গৌরব দি। ইতি।