কাফ্রি দাসের বৃত্তান্ত/দ্বিতীয় ভাগ
কাফ্রি শিষ্যের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ করণের অল্প দিন পরে আমি অশ্বারোহণ করিয়া তাহার সঙ্গে পুনর্ব্বার কথোপকথন করিতে তাহার প্রভুর গৃহে গেলাম। সেই ঘর আমার বাটীহইতে প্রায় দুই ক্রোশ দূর। আমি যে পর্ব্বতের উপর দিয়া গেলাম, তাহাহইতে চতুর্দ্দিক্স্থ দেশ প্রায় অতুল্য সুন্দর ও ঐশ্বর্য্যযুক্ত দৃষ্ট হইল। তাহা দর্শনে আমার মনে শিক্ষাদায়ক এই২ চিন্তা উৎপন্ন হইল।
প্রচুর তৃণ ভক্ষণকারি মেষ সমূহ সেই পর্ব্বত ব্যাপিয়া চরিতেছিল, ও কোন২ দিগে রাখালগণ আপন২ নিয়মিত স্থানে থাকিয়া নিজ২ পাল রক্ষা করিতেছিল। ইহা আমি আপন পদ ও কর্ম্মের দৃষ্টান্ত স্বরূপ মানিলাম। কেননা সেই পর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী কতক ক্রোশ বিস্তারিত যে প্রদেশ ছিল, তাহাতে থাকিয়া যাহাদের আমি রক্ষা করিতাম ও যাহাদের বিষয়ে মহারাখালের আগমন দিবসে আমার হিসাব দিতে হইবে এমত অনেক লোক বাস করিতেছিল। সম্মুখস্থিত মেষপাল আমার পারমার্থিক পালের দৃষ্টান্তস্বরূপ জানিয়া আমি মনে২ এই প্রার্থনা করিলাম, যে উত্তম রাখাল আপন মেষের জন্যে প্রাণ দিলেন, তিনি আমার হস্তে সমর্পিত এই লোকদের প্রতি বিশ্বস্ত হইতে আমাকে শক্তি দিউন। এবং যাহাদিগকে খ্রীষ্ট আপন রব শুনাইবেন এমত দূরদেশস্থ পালের একজন মেষ স্বরূপ আমার এই যুব কাফ্রি বন্ধু, ইহা চিন্তা করিয়া আমি আহ্লাদিত হইলাম। কেননা “এক পাল ও এক রক্ষক থাকিবে,” ইহা তাবৎ জাতীয় লোকেরা স্বীকার করিবে।
পূর্ব্বাভিমুখে যাত্রা করত পর্ব্বতের বামদিগে সমুদ্রের এক বৃহৎ খালে বিভক্ত অতি সুন্দর ভূমি প্রকাশ হইল। জোয়ারের সময়ে ঐ খাল সমুদ্র জলে পরিপূর্ণ হইয়া দেড় ক্রোশ পরিমিত প্রশস্ত হদের ন্যায় হয়। তাহার চতুর্দিগে যে২ বন ও গ্রাম ও ঘর ও ভজনালয় দেখা যায় তাহা অতি মনোরম্য।
ও পারে অর্থাৎ সমুদ্রেতে কতক ক্রোশ ব্যাপিয়া লঙ্গর করা রণজাহাজের বৃহৎ এক বহর ছিল, এবং তাহার নিকটবর্ত্তি বাণিজ্য জাহাজের আর এক বহর দৃষ্ট হইল। বহরের ঐ দিগে এক মহানগরের বন্দর ও দুর্গ ও গুদী ও নানা প্রশস্ত অট্টালিকা দেখিলাম। ঐ সকল অট্টালিকাদির জানালা ও জাহাজের ধ্বজা সূর্য্য কিরণদ্বারা উজ্জ্বলীকৃত হইয়া অতি সৌন্দর্য্য রূপে দৃশ্য হইল।
ঐ সকল দেখিয়া আমি রাজমন্ত্রিদের সংকল্প ও অনেক দেশীয়দের নাশ ও রণশঙ্কার বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। আহা! যে সময়ে ঈশ্বর পৃথিবীর সীমাপর্য্যন্ত যুদ্ধের শেষ করিয়া শান্তি স্থাপন করিবেন, সে কেমন আনন্দজনক সময় হইবে।
তথাপি শত্রুদের হস্তহইতে আমাদিগের দেশ রক্ষার্থে যে২ রণজাহাজ ও অন্যান্য রক্ষাস্ত্র ঈশ্বর প্রদান করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
দক্ষিণদিগে ও অগ্নিকোণে অসীম সমুদ্রের মহাতরঙ্গ দৃষ্ট হইল। পাইলদ্বারা নানা দিগে গমনকারি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র অনেক জাহাজ সমুদ্রেতে ব্যাপ্ত ছিল। কোন২ জাহাজ অতি দূর দেশে গমন করিতেছিল। অন্য কোন জাহাজ নানা দূর দেশস্থ উৎপন্ন দ্রব্যাদি বোঝাই করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া আসিতেছিল। আর কতক জাহাজ শত্রুর অন্বেষণ করিতে যাইতেছিল, এবং অন্য কতক জাহাজ দুর্জয় সংগ্রামে লব্ধ দ্রব্যাদি লইয়া বন্দরে চলিয়া আসিতেছিল।
যে স্থানে আমি অশ্বারূঢ় হইয়া ভ্রমণ করিতেছিলাম, সে স্থানের নৈর্ঋত কোণে প্রায় পাঁচ ক্রোশ পরিধি পরিমিত এক সুন্দর অর্দ্ধ গোলাকৃতি খাল দৃষ্ট হইল, ঐ খাল শুক্ল ও রক্ত ও ধূম্রবর্ণ মৃত্তিকার উচ্চ পাহাড়ে বেষ্টিত। তাহার ওপারে কতক গুলি উপপর্ব্বত শ্রেণীবদ্ধ ছিল। তাহার শৃঙ্গ সকল অনেকবার মেঘাচ্ছন্ন হইত, কিন্তু সেই সময়ে অতি স্পষ্ট দেখা গেল। এই পর্ব্বতশ্রেণী উত্তর দিগে অন্য শ্রেণীতে যোগ পাইয়া বৃহৎ ও ফলবতী নিম্নভূমির সীমাস্বরূপ হইল। তৎকালে ভূমির শস্য সকল ছেদনোপযুক্ত ছিল, তাহাতে পরমেশ্বর যে আপন কৃপাদ্বারা মনুষ্যসন্তানদের নিমিত্তে প্রচুর আহার প্রস্তুত করেন, ইহা প্রকাশ হইল। “তিনি শস্য প্রস্তুত করেন; তিনি বৎসরকে কল্যাণরূপ মুকুট দিতেছেন, এবং তাঁহার পথহইতে স্নিগ্ধতা নিঃসৃত হইয়া অরণ্যে ও প্রান্তরে পতিত হইলে চতুর্দ্দিগে পর্ব্বতগণ উল্লাসিত হয়, এবং ক্ষেত্র সকল মেষেতে ব্যাপ্ত ও নিম্নভূমি শস্যে আচ্ছন্ন হয়, তাহাতে সকলে জয়ধ্বনি করিয়া গান করে।” ৬৫ গীত।
আমার সম্মুখগামি জাহাজের প্রতি দৃষ্টি করত দায়ূদের এই কথাও আমার মনে পড়িল, যথা “সমুদ্রের মধ্যে জাহাজে গমনাগমনকারি ও জলসমূহের মধ্যে ব্যবসায়কারি লোকেরা গভীর জলে পরমেশ্বরের কর্ম্ম ও আশ্চর্য্যক্রিয়া দেখিতে পায়। তিনি আজ্ঞা দিলে প্রচণ্ড বায়ু উঠে ও তরঙ্গ উঠায়। তাহাতে তাহারা কখন আকাশে উঠে ত কখন গভীর জলে নামে। এই বিপদে তাহাদের প্রাণ গলিত হয়। তাহারা মত্ত মনুষ্যের ন্যায় হেলিয়া দুলিয়া চলিয়া পড়ে ও হতবুদ্ধি হয়। এমত বিপদের সমযে তাহারা পরমেশ্বরের কাছে কাকৃুতি করিলে তিনি তাহাদিগকে কষ্টহইতে আনয়ন করেন, এবং ঝড়কে নির্ব্বাত করিয়া তরঙ্গের শান্তি করেন। তাহাতে তাহারা শান্ত হইয়া পরমানন্দিত হয়। এইরূপে তিনি তাহাদিগকে বাঞ্ছিত স্থলে লইয়া যান। অতএব তাহারা পরমেশ্বরের অনুগ্রহের ও মনুষ্যগণের প্রতি তাঁহার আশ্চর্য্য কর্ম্মের নিমিত্তে তাঁহার প্রশংসা করুক।” ১০৭ গীত।
এ সকল বিষয় চিন্তা করিতে২ আমি পর্ব্বতসীমাতে কোন ভয়ানক ঋজু আড়ূরির ধারে উপস্থিত হইলাম। যে স্থানে অশ্বহইতে নামিয়া তাহাকে এক বন্য বৃক্ষেতে বন্ধন করিলাম। সমুদ্রের ঢেউ আড়ূরির তলে নিত্য২ লাগিয়া সর্ব্বদা অতি তুষ্টিজনক শব্দ করে। ঐ আড়ূরির চূড়ার ও নিম্নস্থিত পাহাড়ের গহ্বরে কতক গুলিন সাগরপক্ষী বাসা করিয়াছিল।
চতুর্দ্দিগে দৃষ্টিগোচর বস্তুসমূহ সম্পূর্ণরূপে শোভান্বিত এবং ধ্যান ও প্রার্থনাদির উপযুক্ত ছিল। সৃজনকর্ত্তা আপন সৃষ্টিতে প্রকাশিত হইয়া তাবৎ প্রাণিকে আপনার সম্মান ও আদর করিতে আজ্ঞা দিলেন। কিন্তু বিশ্বাসি ব্যক্তির প্রতি এই কর্ম্ম বিশেষরূপে তুষ্টিজনক হয়। সে ঈশ্বরের নিয়মপ্রযুক্ত সকল সাংসারিক আশীর্ব্বাদ ও পারমার্থিক সুখাধিকার প্রাপ্ত হয়। তাহার অধিকারপত্র এই; “সকলই তোমাদের, পৌল কি আপল্লো কি কৈফা কি জগৎ কি জীবন কি মরণ কি বর্ত্তমান বিষয় কি ভবিষ্যদ্ বিষয় সকলই তোমাদের, এবং তোমরা খ্রীষ্টের, ও খ্রীষ্ট ঈশ্বরের।” ১ করিন্থীয়দের ৩ অধ্যায়ের ২২,১২৩ পদে।
আমার বামদিকস্থিত অতি সূক্ষ্ম ও শক্ত বালুকাময় এক ক্ষুদ্র খাল ছিল, তাহা চতুর্দ্দিগে প্রস্তরের ও খড়িমাটির আড়ূরির খণ্ডেতে ও ভগ্ন মৃত্তিকাবিশিষ্ট তীরেতে বেষ্টিত। সেখানে কোন মনুষ্যের ঘর বাটী না থাকাতে সে গুপ্তরূপে ধ্যান করিবার উপযুক্ত স্থান বটে।
তথায় এক মহাপ্রস্তরে বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছে এমত কোন লোককে আমি হঠাৎ দেখিতে পাইলাম। যে স্থানে আমি দাঁড়াইয়াছিলাম, সে স্থানহইতে প্রায় দুই শত হাত নীচে ঐ ব্যক্তি ছিল, কিন্তু তাহার বস্ত্রদ্বারা ও শরীরের বর্ণদ্বারা আমি স্থির করিলাম যে সে ঐ কাফ্রি শিষ্য, ও তাহার হস্তস্থিত বহি ধর্ম্মপুস্তক। এমত নির্জন স্থানে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হওনের কোন সম্ভাবনা ছিল না, অতএব হঠাৎ আমি তাহাকে এই রূপে একাকী পাঠ করিতে দেখিয়া অতি আনন্দিত হইলাম। তাহাতে আমি মাছুয়া ও রাখালদ্বারা আড়ূরিতে খোদিত এক অসমান সোপান দিয়া তীরে নামিলাম, কিন্তু কাফ্রি দাস এমত মনঃসংযোগপূর্ব্বক পাঠ করিতেছিল যে আমি তাহার নিকটবর্ত্তী না হইলে সে আমাকে দেখিতে পাইল না। পরে আমি কহিলাম, কে হে, উইলিয়ম?
সে বলিল “হাঁ মহাশয়, আপনাকে দেখিয়া আমি বড় আনন্দিত হইলাম। আমি বোধ করিয়াছিলাম যে ঈশ্বর ও আমা ছাড়া এখানে আর কেহ নাই। মহাশয় এস্থানে কিরূপে আইলেন?”
আমি তোমার প্রভুর গৃহে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছিলাম, কিন্তু চতুর্দ্দিক্স্থ দেশ দর্শনের জন্যে এস্থানে আইলাম। আকাশ নির্ম্মল হইলে আমি সমুদ্র ও জাহাজ দেখিতে এস্থানে অনেক বার আসিয়া থাকি। বহি কি ধর্ম্মপুস্তক?
“হাঁ মহাশয়, এই আমার প্রিয় উত্তম ধর্ম্মপুস্তক।”
হে উইলিয়ম, তুমি যে এইরূপে কাল যাপন করিতেছ, ইহা আহ্লাদের বিষয় এবং উত্তম চিহ্ন বটে।
“আজ্ঞা মহাশয়, ইহা আমার প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহের চিহ্ন, কিন্তু ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আমি কখন উত্তম নহি।”
কি রূপে?
“আমি তাঁহার প্রতি কখন যথেষ্ট কৃতজ্ঞ নহি, ও যথেষ্ট প্রার্থনা করি না; এবং তিনি যে আমাকে এত উত্তম বস্তু দেন তন্নিমিত্তে তাঁহাকে কখন যথেষ্ট রূপে স্মরণেও রাখি না। মহাশয় আমি ভয় করি, আমার মন অতি দুষ্ট। আমি আপনকার ন্যায় হইতে ইচ্ছা করি।”
আমার ন্যায় কেন? তুমি তো আমারই মত ধর্ম্মহীন ও উপায়রহিত পাপী আছ; কেননা ঈশ্বর দয়া ও অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমাকে অগ্নিকুণ্ডহইতে জ্বলন্ত কাষ্ঠের ন্যায় নির্গত না করিলে এবং আপন প্রেম ও অনুগ্রহের বিশেষ পাত্র না করিলে আমিও পাপেতে বিনষ্ট হইতাম। ফলত, তোমায় আমায় কোন প্রভেদ নাই; আমরা উভয়ের ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করণেতে ত্রুটি করিয়াছি। মনুষ্য মাত্রেই পাপ করিয়াছে।
"না মহাশয়, আমি তোমার মত নহি। আমার পাপী আর কাহাকেও জানি না, আমার অন্তঃকরণের ন্যায় আর কোন লোকের অন্তঃকরণ নয়।”
হাঁ, উইলিয়ম। আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতে পারি যে প্রত্যেক চেতনাপ্রাপ্ত মনুষ্য পাপের অত্যন্ত পাপিষ্ঠতা ও পাপি লোকদের মুক্তির নিমিত্তে খ্রীষ্ট যীশুদ্বারা দত্ত মূল্য দর্শন করে, তাহারই মনের ভাব তোমার মনের ভাবের তুল্য। অতএব তুমিও এই গীতের কথাতে স্বীকার করিতে পার, যথা,
আমি দুষ্টাচারিদের ছিলাম প্রধান।
তবু যীশু মোর জন্যে দিলেন স্বপ্রাণ॥
“আজ্ঞা হাঁ, মহাশয়, আমি বিশ্বাস করি যীশু এই অধম কাফ্রি জন্যেও মরিলেন। যদি খ্রীষ্ট এ দুরাচারের কারণ প্রাণ না দিতেন, তবে আমার কি দশা হইত? কিন্তু তিনি সর্ব্বাপেক্ষা দুষ্ট লোকদের নিমিত্তে প্রাণ ত্যাগ করিলেন, অতএব ইহা ধ্যান করিলে কোন২ সময়ে আমার বড় আনন্দ হয়।”
হে উইলিয়ম, তুমি ধর্ম্মপুস্তকের কোন্ স্থান পাঠ করিতেছিলা?
“আমি খ্রীষ্টের সহিত ক্রূশে টাঙ্গান দস্যুর কথোপকথনের বিষয় পড়িতেছিলাম। ঐ দস্যুর প্রার্থনা আমারও উপযুক্ত, “হে প্রভো, আমাকে স্মরণ কর।” হে প্রভো, পাপিষ্ঠ কাফ্রিকে স্মরণ কর, আমার প্রাতঃকালের ও কখন২ রাত্রি কালেরও প্রার্থনা এই। এবং যখন অনেক কথা মনে পড়ে না, তখন আমি সেই প্রার্থনা পুনর্ব্বার করি; ওহে প্রভো, পাপিষ্ঠ কাফ্রিকে স্মরণে রাখ।”
আর প্রভু সেই প্রার্থনা শুনেন ইহাও নিশ্চয় জান কারণ যিনি দস্যুকে ক্ষমা পূর্ব্বক গ্রাহ্য করিলেন, তিনি তোমাকে অগ্রাহ্য করিবেন না। তাঁহার শরণাগত কোন ব্যক্তিকে তিনি কখন দূর করেন না।
“আজ্ঞা মহাশয়, আমি তাহা নিশ্চয় জানি, কিন্তু আমি আপন অন্তঃকরণের অধিক পাপহেতু ভীত ও দুঃখিত আছি। মহাশয়, আপনি এই২ লিম্পিট্[১] মৎস্য দেখুন, তাহারা যেমন শক্তরূপে পাখরে লাগিয়া থাকে, তদ্রূপ পাপ আমার মনে আঁকড়িয়া ধরে।”
হাঁ উইলিয়ম, এমত হইতে পারে বটে, কিন্তু আর এক দৃষ্টান্ত শুন। তুমি খ্রীষ্টের মৃত্যু ও ধর্ম্মেতে প্রত্যয়দ্বারা লিম্পিট্ মৎস্যের ন্যায় তাঁহাতে আসক্ত হও, তাহা হইলে সমুদ্র বা ঝড় তাঁহার প্রেমহইতে তোমাকে পৃথক করিতে পারিবে না।
“সেই তো আমার ইচ্ছা।”
ভাল, উইলিয়ম, এই ক্ষণে বল দেখি, তুমি যে পাপ বিষয়ক কথা কহিলা, তাহা কি তোমার প্রতি ভারস্বরূপ লাগে না; তুমি তাহা ভাল না বাসিয়া বরং তাহাহইতে মুক্তি পাইবার বাঞ্ছা কর কি না?
“হাঁ, অবশ্যই বাঞ্ছা করি, যদ্যপি তাবৎ পৃথিবী আমার হস্তগত হইত, তবে পাপহইতে পৃথক হইবার নিমিত্তে আমি তাহা হৃষ্টচিত্ত হইয়া ছাড়িয়া দিতাম।”
তবে আইস, প্রিয় ভ্রাতা, খ্রীষ্টের নিকটে কুশলে আইস; তাঁহার রক্ত সর্ব্বপ্রকার পাপহইতে পবিত্র করে। তিনি আমাদিগের উদ্ধারের মূল্যস্বরূপ হইলেন। “তিনি আমাদের দুর্ব্বলতা সকল ধারণ করিলেন, ও আমাদের ব্যাধি সকল লইলেন। তিনি আমাদের আজ্ঞালঙ্ঘনের নিমিত্তে ক্ষতবিশিষ্ট ও আমাদের অধর্ম্মের নিমিত্তে চূর্ণ হইলেন, এবং আমাদের মঙ্গলজনক শাস্তি তাঁহার উপরে বর্ত্তিল, এবং তাঁহার ক্ষতদ্বারা আমাদের স্বাস্থ্য হয়। পরমেশ্বর আমাদের সকলের এই অধর্ম্মের ফল তাঁহার উপরে বর্ত্তাইলেন।” যিঃ ৫৩ অঃ। অতএব আইস, নির্ভয়ে পাপিদের ত্রাণকর্ত্তা যীশুর নিকটে আইস।
কাফ্রী কাঁদিতে২ কহিল, “হাঁ মহাশয়, আমি আসিতেছি, কিন্তু অতি ধীরে২ আসিতেছি। মহাশয়, আমি যীশুর নিকটে দৌড়িয়া বরং উড়িয়া আসিতে চাহি। যীশু যে আমার নিকটে এই সুসমাচার প্রচার করিতে আপনাকে প্রেরণ করিয়াছেন, ইহা অতি অনুগ্রহের বিষয়।”
কিন্তু ইহার পূর্ব্বে তুমি এই সকল ধর্ম্মবাক্য শুনিয়াছিলা কি না?
“হাঁ মহাশয়, আমি আপনাকে বাড়ীতে বলিয়াছিলাম আমেরিকা দেশস্থ এক জন ধর্ম্মোপদেশকের কথা শ্রবণাবধি আমি তদ্দ্বারা অনেক সময়ে সান্ত্বনা ভোগ করি।”
ভাল, উইলিয়ম, ঈশ্বর অনুগ্রহ করিয়া তোমার কারণ আপন পুত্ত্রকে মৃত্যুভোগ করিতে দিলেন, আর তিনি তামার মনোরূপ চক্ষু খুলিয়া আপনার এই মহানুগ্রহ বিষয়ক চেতনা তোমার অন্তঃকরণে প্রদান করিয়াছেন, অতএব আমি ভরসা করি তুমি তাঁহার আজ্ঞা পালন করিতে যত্নবান হও, এবং আপন কর্ত্তা ও কর্ত্রীর প্রতি ও সঙ্গিভৃতাবর্গের প্রতি উত্তম আচরণ প্রকাশ করিতে উদ্য্যোগী হও। যে ব্যক্তি অন্তরে খ্রীষ্টীয়ান সে বাহ্যেতেও খ্রীষ্টীয়ান, এবং যাকূব প্রেরিত কহেন, যে জন প্রকৃতরূপে ত্রাণার্থে খ্রীষ্টে প্রত্যয় রাখে, তাহার প্রত্যয় তাহারই ক্রিয়াদ্বারা প্রকাশ পাইবে। হাঁ, উইলিয়ম কেমন, ইহা সত্য কি না?
“হাঁ, মহাশয়, ইহা সত্য বটে, আর আমি তদ্রূপ করিতে বাঞ্ছা করি। আমি বিশ্বাসী হইতে চাহি। যীশুখ্রীষ্ট বিষয়ক সুসমাচার আমার অন্তঃকরণের মধ্যে আসিবার পূর্ব্বে আমি দুষ্ট দাস ছিলাম, ইহাতে আমার খেদ হইতেছে। এখন আমি কর্ত্তার চক্ষুর গোচরে ও অগোচরে সর্ব্বদা সৎকর্ম্ম করিতে ইচ্ছা করি, কারণ ঈশ্বর আমাকে সর্ব্বদা দৃষ্টি করেন। আপন কর্ত্তার প্রতি দোষ করিলে ঈশ্বরের প্রতি দোষ করা হয়, আর তৎপ্রযুক্ত ঈশ্বর আমার উপরে ক্রুদ্ধ হইবেন, ইহা আমি জানি। তদ্ব্যতিরেকে খ্রীষ্ট যাহা বলেন তাহা না করিলে আমি তাঁহাকে কিরূপে প্রেম করিতে পারি? সঙ্গিদাসেরা আমাকে প্রেম না করিলেও আমি তাহাদিগকে প্রেম করি, এবং ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ যেন তাহাদিগের প্রতি হয়, এমত প্রার্থনা করিয়া থাকি। তাহারা যখন মন্দ কথা বলিয়া আমার রাগ জন্মাইতে উদ্যোগ করে, তৎকালে আমার এই বিবেচনা হয়, যদি যীশু খ্রীষ্ট আমার প্রতিনিধি হইয়া আমার পদে দাস্যবৃত্তি করিতেন, তবে তিনি নিন্দিত হইয়া প্রতিনিন্দা করিতেন না; তিনি অল্প কথা কহিয়া অধিক প্রার্থনা করিতেন। এইরূপে আমিও কিছু মাত্র না কহিয়া মনে২ প্রার্থনা করি, হে ঈশ্বর, ইহাদিগকে ক্ষমা করুন।”
এ কাফ্রি খ্রীষ্টীয়ানের সহিত আমার যত বার কথোপকথন হইল, তত বার তাহার মনে জ্ঞানরূপ দীপ্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে, ও ঈশ্বরের অনুগ্রহরূপ কার্য্য তাহার অন্তঃকরণে আরম্ভ হইয়াছে, আমি ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখিতে পাইলাম। যে স্থানে আমরা এই রূপ কথোপকথন করিতেছিলাম, সে স্থানের চতর্দ্দিক্স্থ সুদৃশা বস্তু সকল দর্শন করাতে আমার আন্তরিক আনন্দের বৃদ্ধি হইল। নিকটবর্ত্তি খাল অত্যন্ত সুন্দর ও আকাশ নিম্মর্ল ছিল। আমরা পাড়ের ছায়াতে বসিয়া সূর্য্যের কিরণহইতে রক্ষা পাইলাম। আমাদের মস্তকের উপরে উচ্চ ও বৃহৎ এক বিশেষ পাহাড়ের চূড়া ছিল। সে পাহাড় তুষারের ন্যায় শুক্ল বর্ণ। আমাদের মস্তকোপরে চতুর্দ্দিগে সাগর পক্ষী উড়িতেছিল। আমাদিগের পদের নিকটে সমুদ্রস্থ শৈবাল সকল তরঙ্গদ্বারা প্রস্তরনয় চড়ার উপরে ইতস্তত চালিত হইতেছিল। সম্মুখস্থিত সমুদ্রের উপরে কতক রণ ও বাণিজ্য জাহাজ দৃষ্ট হইল। তীরের নিকটবর্ত্তি নৌকাতে মৎস্যধারিরা আপনাদের ব্যবসায়ে ব্যস্ত ছিল।
তরঙ্গের কল্লোল, ও মস্তকোর্দ্ধগামি পক্ষিদের স্বর, ও কখন২ গমনকারি জাহাজ হইতে তোপের ধ্বনি, ও জলেতে দাঁড় ফেলনের শব্দ, ও নাবিকদের গানধ্বনি, এবং উপরিস্থ মাঠে স্থিত মেষের রব, উক্ত বৈচিত্র্য শব্দ সকল কখন২ মিশ্রিত হইয়া আমাদের কর্ণগোচর হইত। এই সকল মনোহর বস্তু দেখিয়া শুনিয়া আমার মন আনন্দেতে পুলকিত হইল।
আমি অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত কাফ্রি সহিত কথা কহিলাম, কারণ তাহার প্রভু সেই দিবসে তাহাকে কতক ঘণ্টার নিমিত্তে ছুটি দিয়াছিলেন। এই সময়ে আমি বাপ্তিস্মের ধারা ও ইতিকর্ত্তব্যতা বিষয়ক কথা তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম, তাহাতে সে তদনুসারে আচরণ করিতে ব্যগ্র হইল। আর আমার বিবেচনানুসারে সে বাপ্তাইজিত হইবার যোগ্য পাত্র, ইহা বোধ করিয়া আমি পরমাহ্লাদিত হইলাম, যে সে কাফ্রী ‘পূর্ব্বে দূরস্থ হইলেও খ্রীষ্টের রক্তপাতের গুণে এক্ষণে নিকটস্থ হইয়াছে, অতএব সে ভিন্নজাতীয় ও বিদেশীয় আর না হইয়া পবিত্র লোকদের প্রতিবাসী হওয়াতে ঈশ্বরের পরিজন ভুক্ত হইয়াছে।’
আমি তাহাকে কহিলাম, ঈশ্বর অনেক জাতীয়দিগকে আপন অনুগ্রহরূপ শিশিরদ্বারা প্রোক্ষণ করিতে অঙ্গীকার করিয়াছেন।
সে উত্তর করিল, “হাঁ মহাশয়, তিনি আমার মনের পবিত্রতা জন্মাইতে পারেন। তিনি আমাকে প্রক্ষালন করিলে আমি হিম অপেক্ষা শুক্লবর্ণ হইব।”
তাহাতে আমি কহিলাম, ঈশ্বর তোমাকে এ রূপ আশীর্ব্বাদ করিয়া সর্ব্বপ্রকার উত্তম গুণেতে স্থিরীকৃত করুন।
কাফ্রী আপন পিতামাতার বিষয়ে প্রেমবোধক কথা কহিলে আমি অধিক আনন্দিত হইলাম। সে বাল্যাবস্থায় তাহাদের হইতে অপহৃত হইয়াছিল, তথাপি তাহাদিগকে বিস্মৃত না হইয়া ঈশ্বর যেন কোন ক্রমে তাহাদিগকে খ্রীষ্টের নিকটে আনয়ন করেন, এই তাহার একান্ত মনের ইচ্ছা ছিল।
আমি কহিলাম, কি জানি কোন ধর্ম্মপ্রচারক সম্মুখস্থ এক জাহাজে আরোহণ করিয়া তোমার দেশে যদি যান, এবং তদ্দেশস্থ লোকদের নিকটে, বিশেষতঃ তোমার প্রিয় পিতামাতা এ পর্য্যন্ত জীবৎ থাকিলে তাহাদেরও নিকটে পরিত্রাণের মঙ্গল সমাচার প্রচার করিবেন।
এই কথাতে কাফ্রী ভূমিহইতে লম্ফ দিয়া কহিল, “আঃ আমার প্রিয় পিতামাতা। হে আমার প্রিয় দয়াবান ত্রাতা, তুমি পাপিদের জন্যে কি২ করিয়াছ ইহা যদ্যপি তাঁহাদিগকে জানাইয়া তাঁহাদের প্রাণ রক্ষা কর—।”
ইহা বলিয়া সে খেদ প্রযুক্ত আর কথা কহিতে না পারিয়া মৌনী হইয়া রহিল।
তাহাতে আমি কহিলাম, হে বন্ধু, আমি এইক্ষণে তোমার ও তোমার পিতামাতার ত্রাণের জণ্যে প্রার্থনা করি।
“এমত করিলে মহাশয়, অধিক অনুগ্রহ প্রকাশ করিবেন। আপনি এ দেশীয় ও আর২ দেশীয় দরিদ্র কাফ্রিদের নিমিত্তে প্রার্থনা করুন।”
সেই স্থান নূতন ও ভক্তিজনক প্রার্থনালয় ছিল। সমুদ্রতীরস্থ বালুকা আমাদিগের মেজ্যাস্বরূপ ও আকাশ মন্দিরের ছাতস্বরূপ ও পর্ব্বত ও উপপর্ব্বত ও সাগরের তরঙ্গ সকল তাহার প্রাচীর স্বরূপ। সেই স্থানে প্রার্থনা নিত্য করা যাইত না, তথাপি একবার প্রার্থনা হওন হেতু তাহা আমাকর্তৃক সদাকাল পবিত্ররূপে মান্য হইবে। ঈশ্বর সে স্থানে বর্ত্তমান ছিলেন। আমি প্রার্থনা করিলাম। কাফ্রির অন্তঃকরণ চিন্তাতে পরিপূর্ণ হওয়াতে সে রোদন করিতে লাগিল। আমিও তাহার ন্যায় চিন্তিত হইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলাম। ঐ অশ্রুপাত অকপট খ্রীষ্টীয় প্রেমপ্রযুক্ত কি না, ইহা মহাদিবসে প্রকাশ পাইবে।
আমার বাটীতে ফিরিয়া যাওন কাল উপস্থিত হইলে আমি তাহার স্কন্ধে ভার দিয়া আড়ূরির উপরে গে লাম, কারণ অশ্বকে পাহাড়ের উপরে ছাড়িয়া আসিয়াছিলাম। কাফ্রির মুখে নিরহঙ্কার ও কৃতজ্ঞতা দৃষ্ট হইল। বিদায় হইবার সময়ে আমরা পরস্পর হস্ত ধারণ করিলাম, পরে তাহার বাপ্তাইজিত হওনের পূর্ব্বে পুনর্ব্বার তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্তে আমি আর এক দিবস নিরূপণ করিলাম।
কাফ্রী বিদায় লইয়া কহিল “মাহাশয়, পরমেশ্বর আপনার প্রতি আশীর্ব্বাদ করুন।”
তাহাতে আমি প্রত্যুত্তর করিলাম, হে খ্রীষ্টীয় ভাই, তোমাকেও সেই প্রকার এক্ষণে ও সদাক্ষণে আশীর্ব্বাদ করুন! আমেন।
- ↑ সমুদ্রে জাত কোন ক্ষুদ্র মৎস্য বিশেষ