কাফ্রি দাসের বৃত্তান্ত/প্রথম ভাগ

কাফ্রি দাসের বৃত্তান্ত।

প্রথম ভাগ।

 সমুদ্রের নিকটে আমার কতক বৎসর বাস করণ কালে এক দিবস কোন জাহাজাধ্যক্ষ আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কহিলেন, আমি এই গ্রামের মধ্যে আপন পরিবারের জন্যে ঘর ভাড়া করিয়াছি। জাহাজাধ্যক্ষ আরও কহিলেন, “তিন বৎসরাবধি এক জন কাফ্রি দাস আমার নিকটে নিযুক্ত আছে। সে বালকটি উত্তম; এবং বাপ্তাইজিত[১]হইতে অত্যন্ত বাঞ্ছা করে, অতএব আপনি তাহাকে উপযুক্ত পাত্র বুঝিয়া বাপ্তাইজ করিবেন, ইহা আপনকার নিকটে যাচ্ঞা করিতে আমি তাহার কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি।”

 এই কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সে কি খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের বিষয়ে কিছু জানে?

 জাহাজাধ্যক্ষ উত্তর করিলেন, “হাঁ, অবশ্য জানে। কেননা সে আর২ ভৃত্যবর্গের মধ্যে এই বিষয়ে অনেক কথা কহে, এই প্রযুক্ত তাহারা তাহাকে বিদ্রুপ করিলেও সে তাহা ধৈর্য্যপূর্ব্বক সহ্য করে।”

 আমি কহিলাম, সে কি দাসত্ব পদে ভাল আচরণ করে?

 তিনি কহিলেন, “হাঁ তাহা করে; জাহাজে কিম্বা বাটীতে তাহার তুল্য সৎ ও শিষ্ট দাস কেহ নাই।”

 সে কি চিরকাল এইরূপ ভাল আচরণ করিয়াছে?

 জাহাজাধ্যক্ষ কহিলেন, “না, সে প্রথমে অতি অবাধ্য ও প্রতারক ছিল, কিন্তু গত দুই বৎসরাবধি নূতন লোকের মত হইয়াছে।”

 পরে আমি কহিলাম, ভাল মহাশয়, তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে আমি বড় আনন্দিত হইব, এবং তাহার বিশেষরূপে শিক্ষা ও পরীক্ষা লইলে পর সে বাপ্তাইজিত হইবার উপযুক্ত কি না, তাহা বলিতে পারিব। সে কি পড়িতে পারে?

 জাহাজাধ্যক্ষ কহিলেন, “পারে, আমার এক জন দাসীর মুখে শুনিয়াছি সে অনেক কাল বড় পরিশ্রম করিয়া এইক্ষণে ধর্ম্মপুস্তকের যে কোন অধ্যায় হউক তাহা এক প্রকার পড়িতে পারে। সে স্বদেশীয় অনেক লোক অপেক্ষা ইংরাজী ভাষা ভালরূপে জানে, তথাপি তাহার অনেক কথা অশুদ্ধ হয়। সে যাহা হউক, আমি তাহাকে কোন্‌ সময়ে আপনার নিকটে প্রেরণ করিব?”

 যদি মহাশয়ের ইচ্ছা হয়, তবে কল্য বৈকালে তাহাকে পাঠাইয়া দিবেন।

 “ভাল, সে দুই প্রহর চারি ঘণ্টার সময়ে আপনার নিকটে আসিবে, পরে কি করা কর্ত্তব্য তাহা আপনি জানিতে পারিবেন।”

 পর দিবস নিরূপিত সময়ে সেই কাফ্রি শিষ্য আমার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে দেখিতে যুবা, এবং মখদ্বারা তাহার বদ্ধিমত্ত্ব ও সতর্কতা ও প্রফুল্লচিত্ত প্রকাশ হইল।

 আমি তাহাকে বসিতে বলিয়া কহিলাম, তোমার সাহেব আমাকে বলিয়াছেন, খ্রীষ্টীয় বাপ্তিস্মের বিষয়ে আমার সহিত তোমার কিছু কথা আছে।

 তাহাতে কাফ্রী কহিল, “হাঁ মহাশয়, খ্রীষ্টীয়ান হইতে আমার বড় বাঞ্ছা আছে।”

 কেন তোমার এমন ইচ্ছা হয়?

 “কারণ আমি জানি, যে খ্রীষ্টীয়ানেরা মৃত্যর পরে স্বর্গে যায়।”

 আমি কহিলাম, তোমার এই ইচ্ছা কত দিনাবধি হইয়াছে?

 “দুই বৎসর গত হইল আমেরিকা দেশে এক জন ধর্ম্মোপদেশকের কথা শুনিয়াছিলাম, সেই অবধি আমার এই ইচ্ছা হইল।”

 তুমি কোথায় জন্মিয়াছিলা?

 “আফ্রিকা দেশে। কিন্তু শিশুকালে গোরা লোকেরা আমাকে গোলাম করিয়া দেশান্তরে লইয়া গেল।”

 ইহা কি রূপে হইয়াছিল?

 “এক দিন আমি একাকী সমুদ্রতীরে শঙ্খ কুড়াইতেহিলাম, এমত সময়ে কতকগুলি গোরা নাবিকেরা এক নৌকাহইতে নামিয়া আমাকে ধরিয়া লইয়া গেল। সেই অবধি আমি আপন পিতা মাতাকে আর দেখিতে পাইলাম না।”

 তাহার পর তোমার কি হইল?

 “তাহার পর সেই নাবিকেরা আমাকে জাহাজে করিয়া লইয়া গিয়া জামেকা উপদ্বীপে এক জন সাহেবের নিকটে বিক্রয় করিলে আমি কএক বৎসরপর্যন্ত তাঁহার ঘরে কর্ম্ম করিলাম। পরে প্রায় তিন বৎসর হইল যে জাহাজীয় কাপ্তান আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, তিনি জাহাজে আপন কর্ম্ম করাইবার জন্যে আমাকে ক্রয় করিলেন। তিনি ভাল কর্ত্তা প্রযুক্ত আমাকে দাসত্বহইতে মুক্ত করিলেন। সেই কাল অবধি আমি তাঁহার সহিত বাস করিয়া আসিতেছি।”

 আমেরিকায় যাইবার পূর্ব্বে তোমার নিজ আত্মার বিষয়ে কি রূপ চিন্তা ছিল?

 “সে সময়ে আপন আত্মার বিষয়ে আমার কিছুমাত্র চিন্তা ছিল না। কেননা তখন কেহই আমাকে আত্মার বিষয়ে কোন কথা শিখায় নাই।”

 ভাল, বল দেখি, আমেরিকাতে তোমার আর কি২ ঘটিয়াছিল? তুমি সেখানে কেমন করিয়া গিয়াছিলা?

 “আমার প্রভু আমাকে জাহাজে লইয়া গেলেন। পরে সেখানে এক মাস থাকাতে আমি ঐ ধর্ম্মোপদেশকের কথা শুনিলাম।”

 সেই উপদেশক কি কহিলেন?

 “তিনি আমাকে মহাপাপী কহিলেন।”

 তিনি কি বিশেষ করিয়া তোমাকেই কহিলেন?

 “হাঁ, আমার তদ্রূপ বোধ হইল, আর যত লোক সেখানে তাঁহার কথা শুনিতেছিল তিনি সকলের কাছে আমারই বিষয় কহিলেন।”

 তিনি কি বলিলেন?

 “তিনি আমার অন্তঃকরণের সমূদয় ভাব প্রকাশ করিলেন।”

 তোমার অন্তঃকরণের কি২ ভাব?

 “তিনি আমার পাপ ও অজ্ঞানতা ও অবিশ্বাস জানাইয়া আমাকে কহিলেন, তোমার কোন সুচিন্তা বা সুক্রিয়া কিছুই নাই।”

 তিনি আর কি বলিলেন?

“তিনি এক২ বার আমার মুখের দিগে তাকাইয়া কহিলেন, পাপি ব্যক্তিরা কৃষ্ণবর্ণ বা গৌরবর্ণ হউক, প্রভু যীশু খ্রীষ্ট সকলেরই জন্যে প্রাণ দিয়াছেন। ইহা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, তিনি যে পাপিদের জন্যে এমত কর্ম্ম করিয়াছেন, ইহা অতি উত্তম বটে।”

 তুমি কিসেতে বুঝিলা যে উপদেশক বিশেষ করিয়া তোমাকেই এই কথা কহিলেন?

 “যেহেতুক সেই স্থানে আমার মত মহাপাপী আর কেহ নাই, ইহা আমি জানিলাম; এবং উপদেশক মহাশয়ও অবশ্য তাহা জানিতে পারিয়াছিলেন, কারণ তিনি আমাকে সেখানে দেখিলেন।”

 ভাল, তিনি যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে ঐ রূপ কথা প্রচার করিলে তুমি আপনার বিষয়ে কি বোধ করিলা?

 “মহাশয়, তিনি যখন কহিলেন যে দুষ্ট লোকেরা নরকাগ্নিতে পতিত হইবে, তখন আমার অত্যন্ত ভয় হইল, কেননা আপনাকে অতি দুষ্ট জানিলাম, তাহাতে আমি কাঁদিতে লাগিলাম। পরে তিনি পাপিদের প্রতি খ্রীষ্টের প্রেমের বিষয় কহিলে আমি আরও রোদন করিলাম। তাহাতে খ্রীষ্টকে আমার প্রেম করা কর্ত্তব্য ইহা মনে স্থির করিলাম, কিন্তু কি রূপে করিতে হয়, তাহা না জানিয়া আমি পুনর্ব্বার কাঁদিলাম।”

 সে দেশে থাকিয়া তুমি ঐ উপদেশ ভিন্ন অন্য কোন উপদেশ শুনিয়াছিলা কি না?

 “হাঁ মহাশয়, আমার প্রভু আমাকে ঐ মাসে তিনবার ভজনালয়ে যাইতে দিলেন, তাহাতে প্রত্যেক বারেই খ্রীষ্টকে অধিক প্রেম করিতে ও তাঁহার আজ্ঞানুসারে চলিতে আমার বাঞ্ছা হইল। কিন্তু কখন২ আমার অন্তঃকরণ প্রস্তরের ন্যায় কঠিন বোধ হইত।”

 তদবধি তুমি কি আর কোন উপদেশ শুনিয়াছ?

 “না, আর শুনি নাই, কেবল গত রবিবারে এই স্থানের গির্জাঘরে ধর্ম্মোপদেশ শুনিয়া আমি যীশুর নামে বাপ্তাইজিত হইতে চাহিলাম।”

 আমেরিকা দেশে ঐ সকল উপদেশ শুনিলে পরে তোমার মনে কি২ চিন্তা জন্মিল? আর তোমার মনের কথা কি কাহাকে বলিয়াছিলা?

 “আজ্ঞা না, সে সময়ে ঈশ্বর ব্যতিরেকে আমি আর কাহাকেও বলি নাই। কেননা ঈশ্বর দরিদ্রের প্রার্থনা শুনেন, এই কথা আমি উপদেশকের মুখে শুনিয়া ঈশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করিলাম, তাহাতে তিনি আমার কথা শুনিলেন। আমি খ্রীষ্টের বিষয়ে অনেক বার মনে ভাবিলে তাঁহার মত হইতে আমার ইচ্ছা হয়।”

 তুমি কি পড়িতে পার?

 “অল্প পারি।”

 কে তোমাকে পড়িতে শিখাইল?

 “ঈশ্বর শিখাইলেন।”

 এ কথা কেন বল?

 “ঈশ্বর আমার মনে পাঠ করিতে ইচ্ছা জন্মাইলে পাঠ শিক্ষা করা সহজ হইল। আমার প্রভু আমাকে একখানি ধর্ম্মপুস্তক দিলে পর এক জন নাবিক আমাকে অক্ষর সকল দেখাইয়া দিল। তাহাতে ঈশ্বরের সাহায্যে আমি আপনি পড়িতে শিখিলাম।”

 তুমি ধর্ম্মপুস্তকে কোন২ বিষয় পড়িয়া থাক?

 “প্রভু, যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে নানা প্রকার কথা অর্থাৎ তনি দুষ্ট লোককর্তৃক হত হইয়া প্রাণ ত্যাগ করিয়া পনরুত্থিত হন, পাপিদের প্রতি বিশেষতঃ নীচ কাফ্রী যে আমি আমারই প্রতি তাঁহার এই প্রেমের বিষয়ে পাঠ করি। আমি নীচ কাফ্রী হইলেও খ্রীষ্ট আমাকে প্রেম করেন, ইহা চিন্তা করিয়া কখন২ আমার চক্ষুর জল পড়ে।”

 তুমি ধর্ম্মপুস্তক পাঠ ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহার ধ্যান করিলে লােকেরা তোমাকে কি বলে?

 “কোন২ দুষ্ট লোক যীশু খ্রীষ্টকে প্রেম না করিয়া আমাকে পাগল ও কাফ্রি কুকুর, ও কালো পাষণ্ড বলে, তাহাতে কখন২ আমার রাগ জন্মে। কিন্তু যীশু খ্রীষ্টের অনেক দুর্নাম হইলেও তিনি মেষশাবকের ন্যায় নীরব হইয়া থাকিলেন, তন্নিমিত্তে কোন খ্রীষ্টীয়ান ব্যক্তির রাগ করা উচিত নয়, ইহা মনে করিয়া আমি তাহাদিগকে কিছু কথা বলি না।”

 যুব কাফ্রির এমত নিষ্কপট ও সরল স্বভাব দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের মূল বিষয়ে তাহার কি রূপ জ্ঞান ও বোধ আছে, ইহা জ্ঞাত হইবার জন্যে ১ করিন্থীয়দের প্রতি ১ পত্রের ১৩ অধ্যায়ের ১৩ পদে পৌল প্রেরিতের লিখিত ধর্ম্মসার যথা “এখন প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ও প্রেম এই তিন আছে, কিন্তু ইহাদের মধ্যে প্রেমই শ্রেষ্ঠ,” ইহা স্মরণ করিয়া আমি কাফ্রিকে জিজ্ঞাসা করিলাম; প্রত্যয় কাহাকে বলে? ও তোমারই প্রত্যয় কি? অর্থাৎ খ্রীষ্টের ও তোমার আত্মার বিষযে তুমি কি প্রত্যয় করিতেছ?

 সে কহিল, “প্রভু যীশু খ্রীষ্ট পাপিদের পরিত্রাণার্থে এই জগতে অবতীর্ণ হইলেন। অতএব আমি দরিদ্র ও কাল কাফ্রী ও বড় পাপী হইলেও তিনি আমাকে ত্রাণ করিবেন, এই আমার প্রত্যয়।”

 তোমার প্রত্যাশা কি? অর্থাৎ ঐহিক ও পারত্রিকের বিষয়ে তোমার কি ভরসা আছে?

 “আমি যাবৎ এই জগতে বাস করিব, তাবৎ প্রভ যীশু আমাকে পাপ ও আপদহইতে রক্ষা করিবেন, এবং মৃত্যুর পর তাঁহার সহিত স্বর্গে নিত্য বাস করিলে আমি আর কখনো মরিব না, এই আমার প্রত্যাশা।”

 খ্রীষ্টীয় প্রেমের বিষয়ে তুমি কি বোধ কর? অর্থাৎ সর্ব্বাপেক্ষা তুমি কাহাকে অধিক প্রেম কর?

 “আমি পিতা ঈশ্বরকে প্রেম করি, যেহেতুক তিনি দয়া করিয়া আপন পুত্ত্রকে জগতে পাঠাইলেন। আর যীশু খ্রীষ্টকেও প্রেম করি, কারণ তিনি আমাকে প্রেম করিলেন। এবং কাল কিম্বা গোরা হউক, আমি সকল লোককেই প্রেম করি, কেননা তাহারা ঈশ্বরের সৃষ্ট। বিশেষতঃ আমি খ্রীষ্টীয়ানদিগকে প্রেম করি, কেননা খ্রীষ্ট তাহাদিগকে প্রেম করেন ও তাহারা খ্রীষ্টকে প্রেম করে।

 কাফ্রি শিষ্যের সহিত প্রথম আমার এইরূপে কথোপকথন হইয়াছিল। পরে তাহার ইচ্ছানুসারে তাহাকে মণ্ডলীভক্ত করিবার ভরসাতে আমি আনন্দিত হইলাম। তথাপি তাহার সহিত আরও কথোপকথন করিতে এবং তাহার আচার ও ব্যবহার বিশেষরূপে অনসন্ধান করিতে ইচ্ছুক হইয়া এই অঙ্গীকার করিলাম, যে আমি অল্প দিনের মধ্যে তোমার প্রভুর ঘরে যাইয়া তোমার সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ করিব। ইহা বলিয়া কাফ্রিকে বিদায় করিলাম।

 সে প্রস্থান করিলে পর আমি মনে২ ভাবিলাম, যে ঈশ্বর আপন পুত্ত্রের রক্তদ্বারা পৃথিবীর সর্ব্বদেশীয় ও সর্ব্ববংশীয় ও সর্ব্বরাজ্যীয় ও সর্ব্বভাষাবাদি লোকদের মধ্যে আপনার আশ্রিতগণকে মুক্ত করেন।

 “হে পৃথিবীর রাজ্য সকল, ঈশ্বরের নিকটে গান কর। পরমেশ্বরের প্রশংসা গান কর।”


  1. বাপ্তাইজ। খ্রীষ্টীয়ান লোকদের মধ্যে কেহ২ বলে, এ শব্দের অর্থ কেবল অবগাহন (বা ডুব) আর কেহ২ বলে ইহার অর্থ অবগাহন, কিম্বা জল ছিটান কিম্বা জল সংস্কার কিম্বা য়ান।