কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/পুরাতন ভৃত্য

পুরাতন ভৃত্য

ভূতের মতন চেহারা যেমন,
নির্ব্বোধ অতি ঘাের।
যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন
কেষ্টা বেটাই চোর।
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত,
শুনেও শােনে না কানে।
যত পায় বেত না পায় বেতন
তবু না চেতন মানে।
বড় প্রয়ােজন ডাকি প্রাণপণ
চীৎকার করি, “কেষ্টা”
যত করি তাড়া, নাহি পাই সাড়া,
খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে,
বাকি কোথা নাহি জানে।
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে
তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপরে
নিদ্রাটি আছে সাধা।
মহাকলরবে গালি দেই যবে
পাজি হতভাগা গাধা,

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে
দেখে’ জ্বলে যায় পিত্ত।
তবু মায়া তা’র ত্যাগ করা ভার
বড় পুরাতন ভৃত্য!

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষ-মূর্তি
বলে, “আর পারি না কো!
রহিল তােমার এ ঘর দুয়ার
কেষ্টারে ল’য়ে থাকো।
না মানে শাসন, বসন বাসন
অশন আসন যত
কোথায় কি গেলো, শুধু টাকাগুলাে
যেতেছে জলের মত।
গেলে সে বাজার, সারাদিন আর
দেখা পাওয়া তা’র ভার।
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি
ভৃত্য মেলে না আর?”
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে,
আনি তা’র টিকি ধরে,’—
বলি তা’রে “পাজি, বেরাে তুই আজই,
দূর করে’ দিনু তােরে

ধীরে চলে’ যায়, ভাবি, গেল দায়;—
পরদিন উঠে দেখি
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে
বেটা বুদ্ধির চেঁকি।
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনাে দুখ,
অতি অকাতর চিত্ত।
ছাড়ালে না ছাড়ে, কি করিব তা’রে,
মাের পুরাতন ভৃত্য।

সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা
করিয়া দালাল-গিরি
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন
বারেক আসিব ফিরি’।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়,—
বুঝায়ে বলি তা’রে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য;—
নহিলে খরচ বাড়ে।
ল’য়ে রশারশি করি’ কশাকশি
পোঁটলা পুটলি বাঁধি’
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে
গৃহিণী কহিল কাঁদি’,—

“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে
কষ্ট অনেক পাবে”!
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম!
নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়;—হেরিলাম হায়
নামিয়া বর্দ্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত
তামাক সাজিয়া আনে।
স্পর্দ্ধা তাহার হেনমতে আর
কত বা সহিব নিত্য।
যত তা’রে দুষি’ তবু হ’নু খুসি
হেরি পুরাতন ভৃত্য।

নামিনু শ্রীধামে; দক্ষিণে বামে
পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা
করিল কণ্ঠাগত।
জন ছয় সাতে মিলি এক সাথে
পরম বন্ধুভাবে
করিলাম বাসা, মনে হ’ল আশা
আরামে দিবস যাবে।

কোথা ব্রজবালা, কোথা বনমালা,
কোথা বনমালী হরি।
কোথা, হা হন্ত, চির বসন্ত!
আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মত
বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ।
আমি একা ঘরে, ব্যাধি-খরশরে
ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ—
“কেষ্ট আয়রে কাছে;
এতদিনে শেষে আসিয়া বিদেশে
প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তা’র মুখ ভরে’ ওঠে বুক,
সে যেন পরম বিত্ত।
নিশিদিন ধরে’ দাড়ায়ে শিয়রে
মাের পুরাতন ভৃত্য।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল,
শিরে দেয় মাের হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাহি ঘুম,
মুখে নাই তা’র ভাত।

বলে বারবার, “কর্ত্তা, তােমার
কোনাে ভয় নাই, শুন,
যাবে দেশে ফিরে, মা-ঠাকুরাণীরে
দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম,
তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কাল-ব্যাধির
আপনার দেহপরে।
হ’য়ে জ্ঞানহীন কাটিল দুদিন
বন্ধ হইল নাড়ি।
এতবার তা’রে গেনু ছাড়াবারে,
এতদিনে গেল ছাড়ি’!
বহুদিন পরে আপনার ঘরে
ফিরি সারিয়া তীর্থ।
আজ সাথে নেই চিরসাথী সেই
মাের পুরাতন ভৃত্য।

১২ ফাল্গুন, ১৩০১।