কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/ব্রাহ্মণ

ব্রাহ্মণ

(ছান্দোগ্যোপনিষৎ। ৪ প্রপাঠক। ৪ অধ্যায়।)

অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে
অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য্য; আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রমমাঝে ঋষিপুত্রগণ
মস্তকে সমিভার করি’ আহরণ
বনান্তর হ’তে; ফিরায়ে এনেছে ডাকি’
তপােবন-গােষ্ঠ গৃহে স্নিগ্ধশান্ত-আঁখি
শ্রান্ত হােমধেনুগণে; করি’ সমাপন
সন্ধ্যাস্নান, সবে মিলি’ লয়েছে আসন
গুরু গৌতমেরে ঘিরি’ কুটীর-প্রাঙ্গণে
হােমাগ্নি-আলােকে। শূন্যে অনন্ত গগনে
ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি; নক্ষত্রমণ্ডলী
সারি সারি বসিয়াছে স্তব্ধ কুতুহলী
নিঃশব্দ শিষ্যের মত। নিভৃত আশ্রম
উঠিল চকিত হ’য়ে,—মহর্ষি গৌতম

কহিলেন—বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি,
কর অবধান।
হেনকালে অর্ঘ্য বহি’
করপুট ভরি’, পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দি’ ফলফুলদলে
ঋষির চরণ-পদ্ম, নমি’ ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,—
ভগবন, ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছি দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী
সত্যকাম নাম মাের!
শুনি’ স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তা’রে স্নেহশান্ত ভাষে—
কুশল হউক্ সৌম্য! গােত্র কি তােমার?
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।—
বালক কহিলা ধীরে,—
ভগবন্ গােত্র নাহি জানি। জননীরে
শুধায়ে আসিব কল্য কর অনুমতি!
এত কহি’ ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি’ সত্যকাম, ঘন অন্ধকার
বন-বীথি দিয়া,—পদব্রজে হ’য়ে পার
ক্ষীণ স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী, বালুতীরে

সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননী-কুটীরে
করিলা প্রবেশ।
ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা’;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি’ জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি’; হেরি তা’রে বক্ষে টানি’
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণ কুশল। শুধাইল। সত্যকাম—
কহগো জননী মাের পিতার কি নাম,
কি বংশে জনম? গিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে;—গুরু কহিলেন মােরে,—
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।—মাতঃ, কি গােত্র আমার?

শুনি’ কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে
কহিলা জননী,—যৌবনে দারিদ্রদুখে
বহু-পরিচর্য্যা করি’ পেয়েছিনু তােরে,
জন্মেছিস্ ভর্ত্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে,
গােত্র তব নাহি জানি, তাত!
পরদিন
তপােবন-তরুশিরে প্রসন্ন নবীন
জাগিল প্রভাত। যত তাপসবালক,
শিশির-সুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলােক,

ভক্তি-অশ্রু-ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা,—
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্ত জটা,—
শুচিশোভা সৌম্যমূর্ত্তি সমুজ্জ্বলকায়
বসেছে বেষ্টন করি’ বৃদ্ধ বটচ্ছায়
গুরু গৌতমেরে। বিহঙ্গকাকলীগান,
মধুপ-গুঞ্জনগীতি, জলকলতান,
তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর
বিচিত্র তরুণ কণ্ঠে সম্মিলিত সুর
শান্ত সামগীতি।
হেন কালে সত্যকাম
কাছে আসি’ ঋষিপদে করিলা প্রণাম,—
মেলিয়া উদার আঁখি মহিলা নীরবে।
আচার্য্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,—
কি গােত্র তােমার, সৌম্য, প্রিয়-দরশন?
তুলি’ শির কহিলা বালক,—ভগবন্
নাহি জানি কি গােত্র আমার। পুছিলাম
জননীরে;—কহিলেন তিনি,—সত্যকাম,
বহু-পরিচর্য্যা করি’ পেয়েছিনু তােরে,
জন্মেছিস্ ভর্ত্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে—
গােত্র তব নাহি জানি।
শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা,—

মধুচক্রে লােষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মত—সবে বিস্ময়-বিকল,
কেহ বা হাসিল, কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্য্যের হেরি অহঙ্কার।

উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন
বাহু মেলি’,—বালকেরে করি’ আলিঙ্গন
কহিলেন—অব্রাহ্মণ নহ তুমি, তাত!
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।

৭ই ফাল্গুন, ১৩০১।