কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/পরিশোধ
পরিশােধ
(মহাবস্তৃবদান)
রাজকোষ হ’তে চুরি! ধরে’ আন চোর,
নহিলে, নগরপাল, রক্ষা নাহি তাের,
মুণ্ড রহিবে না দেহে!—রাজার শাসনে
রক্ষিদল পথে পথে ভবনে ভবনে
চোর খুঁজে খুঁজে ফিরে। নগর বাহিরে
ছিল শুয়ে বজ্রসেন বিদীর্ণ মন্দিরে,
বিদেশী বণিক পান্থ তক্ষশিলাবাসী;
অশ্ব বেচিবার তরে এসেছিল কাশী,
দস্যুহস্তে খােয়াইয়া নিঃস্বরিক্ত শেষে
ফিরিয়া চলিতেছিল আপনার দেশে
নিরাশ্বাসে। তাহারে ধরিল চোর বলি’
হস্তে পদে বাঁধি তা'র লােহার শিকলি
লইয়া চলিল বন্দীশালে।
সেইক্ষণে
সুন্দরী-প্রধানা শ্যামা বসি বাতায়নে
প্রহর যাপিতেছিল আলস্যে কৌতুকে
পথের প্রবাহ হেরি’;—নয়নসম্মুখে
স্বপ্নসম লােকযাত্রা। সহসা শিহরি’
কাঁপিয়া কহিল শ্যামা,—“আহা মরি মরি
মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি উন্নতদর্শন
কারে বন্দী করে' আনে চোরের মতন
কঠিন শৃঙ্খলে? শীঘ্র যা’লাে সহচরী
বল্গে নগরপালে মোর নাম করি-
শ্যামা ডাকিতেছে তা'রে; বন্দী সাথে ল'য়ে
একবার আসে যেন এ ক্ষুদ্র আলয়ে
দয়া করি।”-শ্যামার নামের মন্ত্রগুণে
উতলা নগররক্ষী আমন্ত্রণ শুনে
রােমাঞ্চিত; সত্বর পশিল গৃহমাঝে
পিছে বন্দী বজ্রসেন নতশির লাজে
আরক্ত কপােল। কহে রক্ষী হাস্যভরে—
“অতিশয় অসময়ে অভাজনপরে
অযাচিত অনুগ্রহ,—চলেছি সম্প্রতি
রাজকাজে,—সুদর্শনে, দেহ অনুমতি।”
বজ্রসেন তুলি শির সহসা কহিলা-
“একি লীলা, হে সুন্দরী, একি তব লীলা?
পথ হ’তে ঘরে আনি কিসের কৌতুকে
নির্দ্দোষী এ প্রবাসীর অবমানদুখে
করিতেছ অবমান?”-শুনি শ্যামা কহে,
“হায় গাে বিদেশী পান্থ কৌতুক এ নহে।
আমার অঙ্গেতে যত স্বর্ণ অলঙ্কার
সমস্ত সঁপিয়া দিয়া শৃঙ্খল তােমার
নিতে পারি নিজ দেহে; তব অপমানে
মোর অন্তরাত্মা আজি অপমান মানে।”
এত বলি সিক্তপক্ষ্ম দুটি চক্ষু দিয়া
সমস্ত লাঞ্ছনা যেন লইল মুছিয়া
বিদেশীর অঙ্গ হ'তে। কহিল রক্ষীরে
“আমার যা আছে ল’য়ে নির্দ্দোষী বন্দীরে
মুক্ত করে' দিয়ে যাও।”—কহিল প্রহরী,
“তব অনুনয় আজি ঠেলিনু সুন্দরী
এত এ অসাধ্য কাজ। হৃত রাজকোষ,
বিনা কারাে প্রাণপাতে নৃপতির রােষ
শান্তি মানিবে না।” ধরি প্রহরীর হাত
কাতরে কহিল শ্যামা,—“শুধু দুটি রাত
বন্দীরে বাঁচায়ে রেখাে এ মিনতি করি!”
“রাখিব তােমার কথা,”—কহিল প্রহরী।
দ্বিতীয় রাত্রির শেষে খুলি বন্দীশালা
রমণী পশিল কক্ষে, হাতে দীপ জ্বালা',
লােহার শৃঙ্খলে বাঁধা যেথা বজ্রসেন—
মৃত্যুর প্রভাত চেয়ে মৌনী জপিছেন
ইষ্টনাম। রমণীর কটাক্ষ-ইঙ্গিতে
রক্ষী আসি খুলি দিল শৃঙ্খল চকিতে।
বিস্ময়-বিহ্বল নেত্রে বন্দী নিরখিল
সেই শুভ্র সুকোমল কমল-উন্মীল
অপরূপ মুখ। কহিল গদগদ স্বরে-
“বিকারের বিভীষিকারজনীর পরে
করধৃত শুকতারা শুভ্রউষাসম
কে তুমি উদিলে আসি কারাকক্ষে মম-
মুমূর্ষর প্রাণরূপা, মুক্তিরূপা অয়ি
নিষ্ঠুর নগরী মাঝে লক্ষী দয়াময়ী।”-
“আমি দয়াময়ী!” রমণীর উচ্চহাসে
চকিতে উঠিল জাগি নব ভয়ত্রাসে
ভয়ঙ্কর কারাগার। হাসিতে হাসিতে
উন্মত্ত উৎকট হাস্য শােকাশ্রুরাশিতে
শতধা পড়িল ভাঙি। কাঁদিয়া কহিলা-
“এ পুরীর পথমাঝে যত আছে শিলা
কঠিন শ্যামার মত কেহ নাহি আর।”-
এত বলি দৃঢ়বলে ধরি হস্ত তা'র
বজ্রসেনে ল'য়ে গেল কারার বাহিরে।
তখন জাগিছে ঊষা বরুণার তীরে,
পূর্ব্ব বনান্তরে। ঘাটে বাঁধা আছে তরী।
“হে বিদেশী এস এস” কহিল সুন্দরী
দাঁড়ায়ে নৌকার পরে—“হে আমার প্রিয়
শুধু এই কথা মাের স্মরণে রাখিয়াে-
তােমা সাথে এক স্রোতে ভাসিলাম আমি
সকল বন্ধন টুটি’ হে হৃদয়স্বামী
জীবনমরণপ্রভু।”—নৌকা দিল খুলি।
দুই তীরে বনে বনে গাহে পাখীগুলি
আনন্দ-উৎসব গান। প্রেয়সীর মুখ
দুই বাহু দিয়া তুলি ভরি নিজ বুক
বজ্রসেন শুধাইল-“কহ মােরে প্রিয়ে,
আমারে করেছ মুক্ত কি সম্পদ দিয়ে?
সম্পূর্ণ জানিতে চাহি অয়ি বিদেশিনী
এ দীন দরিদ্রজন তব কাছে ঋণী
কত ঋণে?”-আলিঙ্গন ঘনতর করি
“সে কথা এখন নহে” কহিল সুন্দরী।
নৌকা ভেসে চলে' যায় পূর্ণ বায়ুভরে
তূর্ণ স্রোতােবেগে। মধ্য গগনের পরে
উদিল প্রচণ্ড সূর্য্য। গ্রামবধুগণ
গৃহে ফিরে গেছে করি স্নানসমাপন
সিক্তবস্ত্রে, কাংস্যঘটে ল’য়ে গঙ্গাজল।
ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট; কোলাহল
থেমে গেছে দুই তীরে; জনপদ-বাট
পান্থহীন। বটতলে পাষাণের ঘাট,
সেথায় বাঁধিল নৌকা স্নানাহারতরে
কর্ণধার। বনচ্ছায়া স্তব্ধ শব্দহীন;
অলস পতঙ্গ শুধু গুঞ্জে দীর্ঘ দিন,
পক্কশস্যগন্ধহরা মধ্যাহ্নের বায়ে
শ্যামার ঘােমটা যবে ফেলিল খসায়ে
অকস্মাৎ,—পরিপূর্ণ প্রণয়পীড়ায়
ব্যথিত ব্যাকুল বক্ষ-কণ্ঠরুদ্ধপ্রায়
বজ্রসেন কানে কানে কহিল শ্যামারে—
“ক্ষণিক শৃঙ্খলমুক্ত করিয়া আমারে
বাঁধিয়াছ অনন্ত শৃঙ্খলে। কি করিয়া
সাধিলে দুঃসাধ্য ব্রত কহ বিবরিয়া।
মাের লাগি কি করেছ জানি যদি প্রিয়ে
পরিশােধ দিব তাহা এ জীবন দিয়ে
এই মাের পণ।”—বস্ত্র টানি মুখপরি
“সে কথা এখনাে নহে”—কহিল সুন্দরী।
গুটায়ে সােনার পাল সুদূরে নীরবে
দিনের আলােকতরী চলি গেল যবে
অস্তঅচলের ঘাটে,—তীর-উপবনে
লাগিল শ্যামার নৌকা সন্ধ্যার পবনে।
শুক্ল চতুর্থীর চন্দ্র অস্তগত প্রায়,—
নিস্তরঙ্গ শান্ত জলে সুদীর্ঘ রেখায়
ঝিকিমিকি করে ক্ষীণ আলাে; ঝিল্লিম্বনে
তরুমূল-অন্ধকার কাঁপিছে সঘনে
বীণার তন্ত্রীর মত। প্রদীপ নিবায়ে
তরীবাতায়নতলে দক্ষিণের বায়ে
ঘন-নিশ্বসিত মুখে যুবকের কাঁধে
হেলিয়া বসেছে শ্যামা; পড়েছে অবাধে
উন্মুক্ত সুগন্ধ কেশরাশি, সুকোমল
তরঙ্গিত তমােজালে ছেয়ে বক্ষতল
বিদেশীর—সুনিবিড় তন্দ্রাজালসম।
কহিল অস্ফুটকণ্ঠে শ্যামা,—“প্রিয়তম,
তােমা লাগি যা করেছি কঠিন সে কাজ
সুকঠিন—তারাে চেয়ে সুকঠিন আজ
সে কথা তােমারে বলা। সংক্ষেপে সে কব
একবার শুনে মাত্র মন হ’তে তব
সে কাহিনী মুছে ফেলাে।
বালক কিশাের
উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মাের
উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে
তব চুরিঅপবাদ নিজস্কন্ধে ল'য়ে
দিয়েছে আপন প্রাণ। এ জীবনে মম
সর্ব্বাধিক পাপ মাের, ওগাে সর্ব্বোত্তম,
করেছি তােমার লাগি এ মাের গৌরব।—
ক্ষীণ চন্দ্র অস্ত গেল-অরণ্য নীরব
শত শত বিহঙ্গের সুপ্তি বহি শিরে
দাঁড়ায়ে রহিল স্তব্ধ। অতি ধীরে ধীরে
রমণীর কটি হ’তে প্রিয়বাহুডাের
শিথিল পড়িল খসে’; বিচ্ছেদ কঠোর
নিঃশব্দে বসিল দোঁহা মাঝে; বাক্যহীন
বজ্রসেন চেয়ে রহে আড়ষ্ট কঠিন
পাষাণপুত্তলি; মাথা রাখি তা'র পায়ে
ছিন্নলতাসম শ্যামা পড়িল লুটায়ে
আলিঙ্গনচ্যুতা; মসীকৃষ্ণ নদীনীরে
তীরের তিমিরপুঞ্জ ঘনাইল ধীরে।
সহসা যুবার জানু সবলে বাঁধিয়া
বাহুপাশে—আর্ত্তনারী উঠিল কাঁদিয়া
অশ্রুহারা শুষ্ককণ্ঠে—“ক্ষমা কর নাথ,
এ পাপের যাহা দণ্ড সে অভিসম্পাত
হােক বিধাতার হাতে নিদারুণতর-
তােমা লাগি যা করেছি তুমি ক্ষমা কর।”
চরণ কাড়িয়া ল'য়ে চাহি তা’র পানে
বজ্রসেন বলি উঠে—“আমার এ প্রাণে
তােমার কি কাজ ছিল! এ জন্মের লাগি
তাের পাপ-মূল্যে কেনা মহাপাপভাগী
এ জীবন করিলি ধিক্কৃত। কলঙ্কিনী,
ধিক্ এ নিশ্বাস মাের তাের কাছে ঋণী!
ধিক্ এ নিমেষপাত প্রত্যেক নিমেষে!"
এত বলি উঠিল সবলে। নিরুদ্দেশে
নৌকা ছাড়ি চলি গেলা তীরে—অন্ধকারে
বনমাঝে। শুষ্কপত্ররাশি পদভারে
শব্দ করি বনানীরে করিল চকিত
প্রতিক্ষণে; ঘন গুল্মগন্ধ পুঞ্জীকৃত
বায়ুশূন্য বনতলে; তরুকাণ্ডগুলি
চারিদিকে আঁকাবাঁকা নানা শাখা তুলি
অন্ধকারে ধরিয়াছে অসংখ্য আকার
বিকৃত বিরূপ; রুদ্ধ হ’ল চারিধার;
নিস্তব্ধ নিষেধসম প্রসারিল কর
লতাশৃঙ্খলিত বন। শ্রান্তকলেবর
পথিক বসিল ভূমে। কে তা'র পশ্চাতে
দাঁড়াইল উপচ্ছায়াসম! সাথে সাথে
অন্ধকারে পদে পদে তা'রে অনুসরি
আসিয়াছে দীর্ঘ পথ মৌনী অনুচরী
রক্তসিক্ত পদে। দুই মুষ্টি বদ্ধ করে'
গর্জ্জিল পথিক—“তবু ছাড়িবি না মােরে!”
রমণী বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়া পড়িয়া
বন্যার তরঙ্গসম দিল আবরিয়া
আলিঙ্গনে কেশপাশে স্রস্ত বেশবাসে
আঘ্রাণে চুম্বনে স্পর্শে সঘন নিশ্বাসে
সর্ব্ব অঙ্গ তা'র; আর্দ্র গদগদ-বচনা
কণ্ঠরুদ্ধপ্রায়;—“ছাড়িব না ছাড়িব না”
কহে বারম্বার; “তােমা লাগি পাপ নাথ,
তুমি শাস্তি দাও মােরে, কর মর্ম্ম-ঘাত,
শেষ করে দাও মাের দণ্ড পুরস্কার।”-
অরণ্যের গ্রহতারাহীন অন্ধকার
অন্ধভাবে কি যেন করিল অনুভব
বিভীষিকা। লক্ষ লক্ষ তরুমূলসব
মাটির ভিতরে থাকি শিহরিল ত্রাসে।
বারেক ধ্বনিল রুদ্ধ নিষ্পেষিত শ্বাসে
অন্তিম কাকুতি স্বর,—তারি পরক্ষণে
কে পড়িল ভূমিপরে অসাড় পতনে।
বসেন বন হ’তে ফিরিল যখন
প্রথম উষায় ঝলে বিদ্যুৎ বরণ
মন্দির-ত্রিশূল-চূড়া জাহ্নবীর পারে
জনহীন বালুতটে নদী ধারে ধারে
কাটাইল দীর্ঘ দিন ক্ষিপ্তের মতন
উদাসীন। মধ্যাহ্নের জ্বলন্ত তপন
হানিল সর্ব্বাঙ্গে তা’র অগ্নিময়ী কশা।
ঘটকক্ষে গ্রামবধূ হেরি তা'র দশা
কহিল করুণ কণ্ঠে—“কে গাে গৃহছাড়া
এস আমাদের ঘরে!” দিল না সে সাড়া
তৃষায় ফাটিল ছাতি,—তবু স্পর্শিল না
সম্মুখের নদী হ’তে জল এক কণা।
দিনশেষে জ্বরতপ্ত দগ্ধ কলেবরে
ছুটিয়া পশিল গিয়া তরণীর পরে
পতঙ্গ যেমন বেগে অগ্নি দেখে ধায়
উগ্র আগ্রহের ভরে। হেরিল শয্যায়
একটি নূপুর আছে পড়ি। শতবার
রাখিল বক্ষেতে চাপি। ঝঙ্কার তাহার
শতমুখ শরসম লাগিল বর্ষিতে
হৃদয়ের মাঝে। ছিল পড়ি একভিতে
নীলাম্বর বস্ত্রখানি,—রাশীকৃত করি
তারি পরে মুখ রাখি রহিল সে পড়ি-
সুকুমার দেহগন্ধ নিশ্বাসে নিঃশেষে
লইল শােষণ করি অতৃপ্ত আবেশে।
শুক্ল পঞ্চমীর শশী অস্তাচলগামী
সপ্তপর্ণ তরুশিরে পড়িয়াছে নামি’
শাখাঅন্তরালে। দুই বাহু প্রসারিয়া
ডাকিতেছে বজ্রসেন—“এস এস প্রিয়া"-
চাহি অরণ্যের পানে। হেনকালে তীরে
বালুতটে ঘনকৃষ্ণ বনের তিমিরে
কার মূর্ত্তি দেখা দিল উপচ্ছায়াসম-
“এস এস প্রিয়া!” “আসিয়াছি প্রিয়তম!”
চরণে পড়িল শ্যামা—“ক্ষম মোরে ক্ষম!
গেল না ত সুকঠিন এ পরাণ মম
তােমার করুণ করে।” শুধু ক্ষণতরে
বজসেন তাকাইল তা’র মুখপরে,—
ক্ষণতরে আলিঙ্গনলাগি বাহু মেলি,
চমকি উঠিল,—তা’রে দূরে দিল ঠেলি,
গরজিল-“কেন এলি, কেন ফিরে এলি!”
বক্ষ হতে নূপুর লইয়া -দিল ফেলি
জ্বলন্ত অঙ্গারসম-নীলাম্বরখানি
চরণের কাছ হ'তে ফেলে দিল টানি;
শয্যা যেন অগ্নিশয্যা, পদতলে থাকি
লাগিল দহিতে তা'রে; মুদি দুই আঁখি
কহিল ফিরায়ে মুখ—“যাও যাও ফিরে
মােরে ছেড়ে চলে' যাও!” নারী নতশিরে
ক্ষণতরে রহিল নীরবে। পরক্ষণে
ভূতলে রাখিয়া জানু যুবার চরণে
প্রণমিল-তা’র পরে নামি নদীতীরে
আঁধার বনের পথে চলি গেল ধীরে—
নিদ্রাভঙ্গে ক্ষণিকের অপূর্ব্ব স্বপন
নিশার তিমির মাঝে মিলায় যেমন।