কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/সামান্য ক্ষতি

সামান্য ক্ষতি

( দিব্যাবদানমালা)

বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস
 স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হ'তে দূরে গ্রামে নিৰ্জ্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে;
স্নানে চলেছেন শত সখীসনে
 কাশীর মহিষী করুণা।

সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
 জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক’টি আছিল কুটীর
ছেড়ে গেছে লােক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখীর
 কূজন উঠিছে কাননে।

আজি উতরােল উত্তর বায়ে
 উতলা হয়েছে তটিনী।

সােনার আলোেক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে,
লক্ষ মাণিক ঝলকি আঁচলে
 নেচে চলে যেন নটিনী।


কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
 নারীকণ্ঠের কাকলী।
মৃণাল ভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
 আকাশ উঠিল আকুলি।


স্নান সমাপন করিয়া যখন
 কূলে উঠে নারী সকলে-
মহিষী কহিলা “উহু শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জেলেদে আগুন ওলাে সহচরী,
 শীত নিবারিব অনলে।”

সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
 চলিল কুসুম-কাননে।

কৌতুকরসে পাগল পরাণী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি;—
সহসা সবারে ডাক দিয়া রাণী
 কহে সহাস্য আননে;—


“ওলাে তােরা আয়, ওই দেখা যায়
 কুটীর কাহার অদূরে।
ওই ঘরে তােরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব কর পদতল,”
এত বলি রাণী রঙ্গে বিভল
 হাসিয়া উঠিল মধুরে।


কহিল মালতী সকরুণ অতি
 “একি পরিহাস রাণী মা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটীর কোন্ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী
 বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা।”


রাণী কহে রোষে—“দূর করি দাও
 এই দীনদয়াময়ীরে।”-

অতি দুর্দ্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মত
 আগুন লাগাল কুটীরে।


ঘন ঘাের ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
 ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে সে ধূম বিদারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লােল জিহবা প্রসারি
 বহ্নি আকাশ জুড়িল।


পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
 জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জ্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
 বাজিল দীপক রাগিণী।


প্রভাত পাখীর আনন্দগান
 ভয়ের বিলাপে টুটিল;—

৩৬৯
5--24

দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তর বায়ু হইল প্রবল,—
কুটীর হইতে কুটীরে অনল
 উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।


ছােট গ্রামখানি লেহিয়া লইল
 প্রলয়-লােলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমােদক্লান্ত শত সখী সাথে
ফিরে গেল রাণী কুবলয় হাতে
 দীপ্ত অরুণ-বসনা।


তখন সভায় বিচার আসনে
 বসিয়াছিলেন ভূপতি।
গৃহহীন প্রজা দলে দলে আসে,
দ্বিধাকম্পিত গদগদ ভাষে
নিবেদিল দুখ সঙ্কোচে ত্রাসে
 চরণে করিয়া বিনতি।


সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা
 রক্তিমমুখ সরমে।

অকালে পশিলা রাণীর আগার,—
কহিলা, “মহিষ, একি ব্যবহার?
গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার
 বল কোন্ রাজধরমে?”


রুষিয়া কহিলা রাজার মহিলা,
 “গৃহ কহ তা’রে কি বােধে?
গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটীর
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর?
কত ধন যায় রাজমহিষীর
 এক প্রহরের প্রমােদে।”


কহিলেন রাজা উদ্যতরােষ
 রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে,—
“যতদিন তুমি আছ রাজরাণী
দীনের কুটীরে দীনের কি হানি
বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি-
 বুঝব তােমারে নিদয়ে!”


রাজার আদেশে কিঙ্করী আসি
 ভূষণ ফেলিল খুলিয়া।

অরুণবরণ অম্বরখানি
নির্ম্মম করে খুলে দিল টানি,
ভিখারী নারীর চীরবাস আনি
 দিল রাণীদেহে তুলিয়া।


পথে ল'য়ে তা'রে কহিলেন রাজা,
 “মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে;
এক প্রহরের লীলায় তােমার
যে ক’টি কুটীর হ’ল ছারখার
যতদিনে পার সে ক’টি আবার
 গড়ি দিতে হবে তােমারে।


“বৎসর কাল দিলেম সময়
 তা’র পরে ফিরে আসিয়া,
সভায় দাঁড়ায়ে করিয়া প্রণতি
সবার সমুখে জানাবে যুবতী
হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি
 জীর্ণ কুটীর নাশিয়া।”

২৫শে আশ্বিন, ১৩০৬।