কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/বিদায়-অভিশাপ

বিদায়-অভিশাপ

বিদায়-অভিশাপ

[দেবগণ কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া বৃহস্পতিপুত্র কচ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের নিকট হইতে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখিবার নিমিত্ত তৎসমীপে গমন করেন। সেখানে সহস্র বৎসর অতিবাহন করিয়া এবং নৃত্যগীতবাদ্য দ্বারা শুক্রদুহিতা দেবযানীর মনোরঞ্জনপূর্ব্বক সিদ্ধকাম হইয়া কচ দেবলোকে প্রত্যাগমন করেন। দেবযানীর নিকট হইতে বিদায়কালীন ব্যাপার পরে বিবৃত হইল।]

কচ ও দেবযানী

কচ


দেহ আজ্ঞা, দেবযানী, দেবলোকে দাস
করিবে প্রয়াণ। আজি গুরুগৃহবাস
সমাপ্ত আমার। আশীর্ব্বাদ কর মোরে
যে বিদ্যা শিখিনু তাহা চিরদিন ধরে'
অন্তরে জাজ্জ্বল্য থাকে উজ্জ্বল রতন,
সুমেরুশিখরশিরে সূর্য্যের মতন,
অক্ষয় কিরণ।

দেবযানী


   মনােরথ পূরিয়াছে,
পেয়েছ দুর্লভ বিদ্যা আচার্য্যের কাছে,
সহস্রবর্ষের তব দুঃসাধ্য সাধনা
সিদ্ধ আজি; আর কিছু নাহি কি কামনা
ভেবে দেখ মনে মনে!

কচ


    আর কিছু নাহি।

দেবযানী


কিছু নাই? তবু আরবার দেখ চাহি
অবগাহি হৃদয়ের সীমান্ত অবধি
করহ সন্ধান; অন্তরের প্রান্তে যদি
কোনাে বাঞ্ছা থাকে, কুশের অঙ্কুরসম
ক্ষুদ্র দৃষ্টি-অগােচর, তবু তীক্ষ্ণতম।

কচ


আজি পূর্ণ কৃতার্থ জীবন। কোনাে ঠাই
মাের মাঝে কোনাে দৈন্য কোনাে শূন্য নাই
সুলক্ষণে!

দেবযানী


  তুমি সুখী ত্রিজগৎ মাঝে।
যাও তবে ইন্দ্রলােকে আপনার কাজে

উচ্চশিরে গৌরব বহিয়া। স্বর্গপুরে
উঠিবে আনন্দধ্বনি, মনােহর সুরে
বাজিবে মঙ্গল-শঙ্খ, সুরাঙ্গনাগণ
করিবে তােমার শিরে পুষ্প বরিষণ
সদ্যছিন্ন নন্দনের মন্দার-মঞ্জরী।
স্বর্গপথে কলকণ্ঠে অপ্সরী কিন্নরী
দিবে হুলুধ্বনি। আহা, বিপ্র, বহুক্লেশে
কেটেছে তােমার দিন বিজনে বিদেশে
সুকঠোর অধ্যয়নে। নাহি ছিল কেহ
স্মরণ করায়ে দিতে সুখময় গেহ,
নিবারিতে প্রবাস-বেদনা। অতিথিরে
যথাসাধ্য পূজিয়াছি দরিদ্রকুটীরে
যাহা ছিল দিয়ে। তাই বলে' স্বর্গসুখ
কোথা পাব, কোথা হেথা অনিন্দিত মুখ
সুরললনার। বড় আশা করি মনে
আতিথ্যের অপরাধ র’বে না স্মরণে
ফিরে গিয়ে সুখলােকে।

কচ


    সুকল্যাণ হাসে
প্রসন্ন বিদায় আজি দিতে হবে দাসে।

দেবযানী


হাসি? হায় সখা, এ ত স্বর্গপুরী নয়!
পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্ম্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহে; হেথায় সুলভ নহে হাসি।
যাও বন্ধু, কি হইবে মিথ্যা কাল নাশি,'
উৎকণ্ঠিত দেবগণ।—

   যেতেছ চলিয়া?
সকলি সমাপ্ত হ’ল দু’কথা বলিয়া!
দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায়?

কচ


দেবযানী, কি আমার অপরাধ?

দেবযানী


     হায়!
সুন্দরী অরণ্যভূমি সহস্র বৎসর
দিয়েছে বল্লভ ছায়া, পল্লবমর্ম্মর,

শুনায়েছে বিহঙ্গকূজন,—তা'রে আজি
এতই সহজে ছেড়ে যাবে? তরুরাজি
ম্লান হ'য়ে আছে যেন, হের আজিকার
বনচ্ছায় গাঢ়তর শােকে অন্ধকার,
কেঁদে ওঠে বায়ু, শুষ্ক পত্র ঝরে' পড়ে,
তুমি শুধু চলে' যাবে সহাস্য অধরে
নিশান্তের সুখস্বপ্নসম?

কচ


    দেবযানী,
এ বনভূমিরে আমি মাতৃভূমি মানি,
হেথা মাের নবজন্মলাভ। এর পরে
নাহি মাের অনাদর,—চির প্রীতিভরে
চিরদিন করিব স্মরণ।

দেবযানী


    এই সেই
বটতল, যেথা তুমি প্রতি দিবসেই
গােধন চরাতে এসে পড়িতে ঘুমায়ে
মধ্যাহ্নের খরতাপে; ক্লান্ত তব কায়ে
অতিথিবৎসল তরু দীর্ঘ ছায়াখানি
দিত বিছাইয়া, সুখসুপ্তি দিত আনি

ঝর্ঝর পল্লবদলে করিয়া বীজন
মৃদুস্বরে;—যেয়াে সখা, তবু কিছুক্ষণ
পরিচিত তরুতলে বস’ শেষবার
নিয়ে যাও সম্ভাষণ এ স্নেহছায়ার-
দুই দণ্ড থেকে যাও, সে বিলম্বে তব
স্বর্গের হবে না কোনাে ক্ষতি।

কচ


     অভিনব
বলে' যেন মনে হয় বিদায়ের ক্ষণে
এই সব চিরপরিচিত বন্ধুগণে;
পলাতক প্রিয়জনে বাঁধিবার তরে
করিছে বিস্তার সবে ব্যগ্র স্নেহভরে
নূতন বন্ধনজাল, অন্তিম মিনতি,
অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যরাশি। ওগাে বনস্পতি,
আশ্রিতজনের বন্ধু, করি নমস্কার।
কত পান্থ বসিবেক ছায়ায় তােমার,
কত ছাত্র কত দিন আমার মতন
প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছায়তলে নীরব নির্জ্জন
তৃণাসনে, পতঙ্গের মৃদুগুঞ্জস্বরে,
করিবেক অধ্যয়ন; প্রাতঃস্নান পরে

ঋষিবালকেরা আসি সজল বল্কল
শুকাবে তােমার শাখে; রাখালের দল
মধ্যাহ্নে করিবে খেলা, ওগাে তারি মাঝে
এ পুরানাে বন্ধু যেন স্মরণে বিরাজে।

দেবযানী


মনে রেখাে আমাদের হােমধেনুটিরে;
স্বর্গসুধা পান করে' সে পুণ্য গাভীরে
ভুলাে না গরবে।

কচ


   সুধা হ’তে সুধাময়
দুগ্ধ তা’র; দেখে তারে পাপক্ষয় হয়,
মাতৃরূপা, শান্তিস্বরূপিণী, শুভ্রকান্তি
পয়স্বিনী। না মানিয়া ক্ষুধাতৃষ্ণা শ্রান্তি
তা'রে করিয়াছি সেবা; গহন কাননে
শ্যামশস্প স্রোতস্বিনী তীরে, তারি সনে
ফিরিয়াছি দীর্ঘ দিন; পরিতৃপ্তিভরে
স্বেচ্ছামতে ভােগ করি’ নিম্নতট পরে
অপর্যাপ্ত তৃণরাশি সুস্নিগ্ধ কোমল-
আলস্য-মন্থর তনু লভি’ তরুতল
রােমন্থ করেছে ধীরে শুয়ে তৃণাসনে
সারাবেলা; মাঝে মাঝে বিশাল নয়নে

সকৃতজ্ঞ শান্তদৃষ্টি মেলি’, গাঢ়স্নেহ
চক্ষু দিয়া লেহন করেছে মাের দেহ।
মনে র’বে সেই দৃষ্টি স্নিগ্ধ অচঞ্চল,
পরিপুষ্ট শুভ্র তনু চিক্কণ পিচ্ছল।

দেবযানী


আর মনে রেখাে, আমাদের কলস্বনা
স্রোতস্বিনী বেণুমতী।

কচ


    তা'রে ভুলিব না।
বেণুমতী, কত কুসুমিত কুঞ্জ দিয়ে
মধুকণ্ঠে অনিন্দিত কলগান নিয়ে
আসিছে শুশ্রূষা বহি গ্রামবধূসম
সদা ক্ষিপ্রগতি, প্রবাসসঙ্গিনী মম
নিত্য শুভব্রতা।

দেবযানী


   হায় বন্ধু, এ প্রবাসে
আরাে কোনাে সহচরী ছিল তব পাশে,
পরগৃহবাসদুঃখ ভুলাবার তরে
যত্ন তা’র ছিল মনে রাত্রি দিন ধরে';—
হায় রে দুরাশা!

কচ


   চিরজীবনের সনে
তা’র নাম গাঁথা হ'য়ে গেছে।

দেবযানী


    আছে মনে
যেদিন প্রথম তুমি আসিলে হেথায়
কিশাের ব্রাহ্মণ, তরুণ অরুণপ্রায়
গৌরবর্ণ তনুখানি স্নিগ্ধ দীপ্তিঢালা,
চন্দনে চর্চ্চিত ভাল, কণ্ঠে পুষ্পমালা,
পরিহিত পট্টবাস, অধরে নয়নে
প্রসন্ন সরল হাসি, হােথা পুষ্পবনে
দাঁড়ালে আসিয়া-

কচ


   তুমি সদ্য স্নান করি
দীর্ঘ আর্দ্র কেশজালে, নব শুক্লাম্বরী
জ্যোতিস্নাত মূর্ত্তিমতী ঊষা, হাতে সাজি
একাকী তুলিতেছিলে নব পুষ্পরাজি
পূজার লাগিয়া। কহিনু করি বিনতি
“তােমারে সাজে না শ্রম, দেহ অনুমতি
ফুল তুলে দিব দেবী।”

দেবযানী


    আমি সবিস্ময়
সেই ক্ষণে শুধানু তােমার পরিচয়।
বিনয়ে কহিলে,—আসিয়াছি তব দ্বারে
তােমার পিতার কাছে শিষ্য হইবারে
আমি বৃহস্পতিসুত।

কচ


    শঙ্কা ছিল মনে
পাছে দানবের গুরু স্বর্গের ব্রাহ্মণে
দেন ফিরাইয়া।

দেবযানী


  আমি গেনু তাঁর কাছে।
হাসিয়া কহিনু-পিতা, ভিক্ষা এক আছে
চরণে তােমার।—স্নেহে বসাইয়া পাশে
শিরে মাের দিয়ে হাত শান্ত মৃদু ভাষে
কহিলেন—কিছু নাহি অদেয় তােমারে।
কহিলাম—বৃহস্পতিপুত্র তব দ্বারে
এসেছেন, শিষ্য করি লহ তুমি তাঁরে
এ মিনতি। সে আজিকে হ’ল কত কাল
তবু মনে হয় যেন সেদিন সকাল।

কচ


ঈর্ষ্যাভরে তিনবার দৈত্যগণ মােরে
করিয়াছে বধ, তুমি দেবী দয়া করে'
ফিরায়ে দিয়েছ মাের প্রাণ, সেই কথা
হৃদয়ে জাগায়ে র'বে চির-কৃতজ্ঞতা।

দেবযানী


কৃতজ্ঞতা! ভুলে যেয়াে, কোনাে দুঃখ নাই।
উপকার যা করেছি হ'য়ে যাক ছাই—
নাহি চাই দান প্রতিদান। সুখস্মৃতি
নাহি কিছু মনে? যদি আনন্দের গীতি
কোনাে দিন বেজে থাকে অন্তরে বাহিরে,
যদি কোনাে সন্ধ্যাবেলা বেণুমতী-তীরে
অধ্যয়ন-অবসরে বসি পুষ্পবনে
অপূর্ব্ব পুলকরাশি জেগে থাকে মনে;
ফুলের সৌরভসম হৃদয়-উচ্ছ্বাস
ব্যাপ্ত করে' দিয়ে থাকে সায়াহ্ন আকাশ,
ফুটন্ত নিকুঞ্জতল, সেই সুখকথা
মনে রেখাে -দূর হ'য়ে যাক্ কৃতজ্ঞতা।
যদি সখা হেথা কেহ গেয়ে থাকে গান
চিত্তে যাহা দিয়েছিল সুখ; পরিধান

১৪৫
5-10

করে' থাকে কোনাে দিন হেন বস্ত্রখানি
যাহা দেখে মনে তব প্রশংসার বাণী
জেগেছিল, ভেবেছিলে প্রসন্ন অন্তর
তৃপ্ত চোখে, আজি এরে দেখায় সুন্দর;
সেই কথা মনে কোনাে অবসরক্ষণে
সুখস্বর্গধামে। কতদিন এই বনে
দিক্‌ দিগন্তরে, আষাঢ়ের নীল জটা,
শ্যামস্নিগ্ধ বরষার নবঘনঘটা
নেবেছিল, অবিরল বৃষ্টিজলধারে
কর্ম্মহীন দিনে সঘন কল্পনাভারে
পীড়িত হৃদয়; এসেছিল কতদিন
অকস্মাৎ বসন্তের বাধাবন্ধহীন
উল্লাস-হিল্লোলাকুল যৌবন-উৎসাহ,
সঙ্গীত-মুখর সেই আবেগ প্রবাহ
লতায় পাতায় পুষ্পে বনে বনান্তরে
ব্যাপ্ত করি’ দিয়াছিল লহরে লহরে
আনন্দপ্লাবন; ভেবে দেখ একবার
কত ঊষা, কত জ্যোৎস্না, কত অন্ধকার
পুষ্পগন্ধঘন অমানিশা, এই বনে
গেছে মিশে সুখে দুঃখে তােমার জীবনে,—
তারি মাঝে হেন প্রাতঃ, হেন সন্ধ্যাবেলা,
হেন মুগ্ধরাত্রি, হেন হৃদয়ের খেলা,

হেন সুখ, হেন মুখ দেয় নাই দেখা
যাহা মনে আঁকা র'বে চির চিত্ররেখা
চিররাত্রি চিরদিন? শুধু উপকার!
শােভা নহে, প্রীতি নহে, কিছু নহে আর?

কচ


আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয়
সখি! বহে যাহা মর্ম্মমাঝে রক্তময়
বাহিরে তা কেমনে দেখাব?


দেবযানী


    জানি সখে,
তােমার হৃদয় মাের হৃদয়-আলােকে
চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন
চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন
স্পর্দ্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে,
যেওনাকো। সুখ নাই যশের গৌরবে।
হেথা বেণুমতী-তীরে মােরা দুই জন
অভিনব স্বর্গলােক করিব সৃজন
এ নির্জ্জন বনচ্ছায়া সাথে মিশাইয়া
নিভৃত বিশ্রব্ধ মুগ্ধ দুইখানি হিয়া
নিখিল-বিস্মৃত। ওগাে বন্ধু, আমি জানি
রহস্য তােমার।

কচ


   নহে, নহে, দেবযানী।

দেবযানী


নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি
মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী?
বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন,
গন্ধ তা’র লুকাবে কোথায়? কতদিন
যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি,
যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি
অমনি সর্ব্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া,—
নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া
আলোেক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই?
ধরা পড়িয়াছ বন্ধু বন্দী তুমি তাই
মাের কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে।
ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে।

কচ


    শুচিস্মিতে,
সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে
এরি লাগি করেছি সাধনা?

দেবযানী


    কেন নহে?
বিদ্যারি লাগিয়া শুধু লােকে দুঃখ সহে
এ জগতে? করেনি কি রমণীর লাগি
কোনাে নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি
করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্য্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়,
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে’
সাধনা করেছ তুমি কি ধনের তরে
আপনি জান না তাহা। বিদ্যা একধারে
আমি একধারে-কভু মােরে কভু তা'রে
চেয়েছ সােৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সঙ্গোপনে। আজ মােরা দোঁহে একদিনে
আসিয়াছি ধরা দিতে। লহ সখা চিনে
যারে চাও! বল যদি সরল সাহসে
“বিদ্যায় নাহিক সুখ, নাহি সুখ যশে,
দেবযানী, তুমি শুধু সিদ্ধি মূর্ত্তিমতী,
তােমারেই করিনু বরণ”, নাহি ক্ষতি

নাহি কোনাে লজ্জা তাহে। রমণীর মন
সহস্রবর্ষেরই সখা সাধনার ধন।

কচ


দেব-সন্নিধানে শুভে করেছিনু পণ
মহাসঞ্জীবনী বিদ্যা করি’ উপাৰ্জ্জন
দেবলােকে ফিরে যাব; এসেছিনু তাই,
সেই পণ মনে মাের জেগেছে সদাই,
পূর্ণ সেই প্রতিজ্ঞা আমার, চরিতার্থ
এতকাল পরে এ জীবন; কোনাে স্বার্থ
করি না কামনা আজি।

দেবযানী


    ধিক্ মিথ্যাভাষী
শুধু বিদ্যা চেয়েছিলে? গুরুগৃহে আসি’
শুধু ছাত্ররূপে তুমি আছিলে নির্জ্জনে
শাস্ত্র গ্রন্থে রাখি আঁখি রত অধ্যয়নে
অহরহ? উদাসীন আর সবা পরে?
ছাড়ি অধ্যয়নশালা বনে বনান্তরে
ফিরিতে পুষ্পের তরে, গাঁথি মাল্যখানি
সহাস্য প্রফুল্ল মুখে কেন দিতে আনি

এ বিদ্যাহীনারে? এই কি কঠোর ব্রত?
এই তব ব্যবহার বিদ্যার্থীর মত?
প্রভাতে রহিতে অধ্যয়নে, আমি আসি
শূন্য সাজি হাতে ল’য়ে দাঁড়াতেম হাসি,
তুমি কেন গ্রন্থ রাখি উঠিয়া আসিতে,
প্রফুল্ল শিশিরসিক্ত কুসুমরাশিতে
করিতে আমার পূজা? অপরাহুকালে
জলসেক করিতাম তরু-আলবালে,
আমারে হেরিয়া শ্রান্ত কেন দয়া করি’
দিতে জল তুলে? কেন পাঠ পরিহরি
পালন করিতে মোর মৃগশিশুটিকে?
স্বর্গ হ'তে যে সঙ্গীত এসেছিলে শিখে
কেন তাহা শুনাইতে, সন্ধ্যাবেলা যবে
নদীতীরে অন্ধকার নামিত নীরবে
প্রেমনত নয়নের স্নিগ্ধচ্ছায়াময়
দীর্ঘ পল্লবের মত? আমার হৃদয়
বিদ্যা নিতে এসে কেন করিলে হরণ
স্বর্গের চাতুরীজালে? বুঝেছি এখন,
আমারে করিয়া বশ পিতার হৃদয়ে
চেয়েছিলে পশিবারে—কৃতকার্য্য হ'য়ে
আজ যাবে মােরে কিছু দিয়ে কৃতজ্ঞতা;
লৰূমনােরথ অর্থ রাজদ্বারে যথা

দ্বারীহস্তে দিয়ে যায় মুদ্রা দুই চারি
মনের সন্তোষে?—

কচ


   হা অভিমানিনী নারী;
সত্য শুনে কি হইবে সুখ? ধর্ম্ম জানে,
প্রতারণা করি নাই; অকপট প্রাণে
আনন্দ অন্তরে তব সাধিয়া সন্তোষ,
সেবিয়া তােমারে যদি করে' থাকি দোষ
তা’র শাস্তি দিতেছেন বিধি। ছিল মনে
কব না সে কথা! বল কি হইবে জেনে
ত্রিভুবনে কারাে যাহে নাই উপকার,
একমাত্র শুধু যাহা নিতান্ত আমার
আপনার কথা। ভালবাসি কি না আজ
সে তর্কে কি ফল? আমার যা আছে কাজ
সে আমি সাধিব। স্বর্গ আর স্বর্গ বলে’
যদি মনে নাহি লাগে, দূর বনতলে
যদি ঘুরে মরে চিত্ত বিদ্ধমৃগসম,
চিরতৃষ্ণা লেগে থাকে দগ্ধ প্রাণে মম
সর্ব্বকার্য্য মাঝে—তবু চলে' যেতে হবে
সুখশূন্য সেই স্বর্গধামে। দেব সবে

এই সঞ্জীবনী বিদ্যা করিয়া প্রদান
নূতন দেবত্ব দিয়া তবে মাের প্রাণ
সার্থক হইবে; তার পূর্ব্বে নাহি মানি
আপনার সুখ। ক্ষম মােরে, দেবযানী,
ক্ষম অপরাধ।

দেবযানী


   ক্ষমা কোথা মনে মাের?
করেছ এ নারীচিত্ত কুলিশ-কঠোর
হে ব্রাহ্মণ! তুমি চলে' যাবে স্বর্গলােকে
সগৌরবে, আপনার কর্ত্তব্য-পুলকে
সর্ব্ব দুঃখশােক করি দূর-পরাহত;
আমার কি আছে কাজ, কি আমার ব্রত?
আমার এ প্রতিহত নিষ্ফল জীবনে
কি রহিল, কিসের গৌরব? এই বনে
বসে' র’ব নতশিরে নিঃসঙ্গ একাকী
লক্ষ্যহীনা। যে দিকেই ফিরাইব আঁখি
সহস্র স্মৃতির কাঁটা বিঁধিবে নিষ্ঠুর;
লুকায়ে বক্ষের তলে লজ্জা অতি ক্রূর
বারম্বার করিবে দংশন। ধিক্ ধিক,
কোথা হ'তে এলে তুমি, নির্ম্মম পথিক,

বসি’ মাের জীবনের বনচ্ছায়াতলে
দণ্ড দুই অবসর কাটাবার ছলে
জীবনের সুখগুলি-ফুলের মতন
ছিন্ন করে' নিয়ে-মালা করেছ গ্রন্থন
একখানি সূত্র দিয়ে; যাবার বেলায়
সে মালা নিলে না গলে, পরম হেলায়
সেই সূক্ষম সূত্রখানি দুই ভাগ করে'
ছিঁড়ে দিয়ে গেলে। লুটাইল ধূলিপরে
এ প্রাণের সমস্ত মহিমা। তােমা পরে
এই মাের অভিশাপ-যে বিদ্যার তরে
মােরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তােমার
সম্পূর্ণ হ'বে না বশ;—তুমি শুধু তা'র
ভারবাহী হ'য়ে র'বে, করিবে না ভােগ,
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়ােগ।

কচ


আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।
ভুলে যাবে সর্ব্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।