মালিনী



মালিনী


প্রথম দৃশ্য

রাজান্তঃপুর

মালিনী ও কাশ্যপ

কাশ্যপ

ত্যাগ কর, বৎসে, ত্যাগ কর, সুখআশা,
দুঃখভয়; দূর কর বিষয়-পিপাসা;
ছিন্ন কর সংসারবন্ধন; পরিহর
প্রমোদপ্রলাপ চঞ্চলতা; চিত্তে ধর
ধ্রুবশান্ত সুনির্ম্মল প্রজ্ঞার আলোক
রাত্রিদিন;–মোহশোক পরাভূত হোক।

মালিনী


ভগবন্ রুদ্ধ আমি, নাহি হেরি চোখে;
সন্ধ্যায় মুদ্রিতদল পদ্মের কোরকে

আবদ্ধ ভ্রমরী,স্বর্ণরেণুরাশিমাঝে
মৃত জড়প্রায়। তবু কানে এসে বাজে
মুক্তির সঙ্গীত, তুমি কৃপা কর যবে।

কাশ্যপ


আশীর্বাদ করিলাম, অবসান হ'বে
বিভাবরী, -জ্ঞানসূর্য-উদয়-উৎসবে
জাগ্রত এ জগতের জয়জয়রবে
শুভলগ্নে সুপ্রভাতে হবে উদঘাটন
পুষ্পকারাগার তব। সেই মহাক্ষণ
এসেছে নিকটে। আমি তবে চলিলাম
তীর্থ পর্য্যটনে।

মালিনী


   লহ দাসীর প্রণাম।

(কাশ্যপের প্রস্থান)


মহাক্ষণ আসিয়াছে! অন্তর চঞ্চল
যেন বারিবিন্দুসম করে টলমল
পদ্মদলে। নেত্র মুদি' শুনিতেছি কানে
আকাশের কোলাহল; কাহারা কে জানে
কি করিছে আয়ােজন আমারে ঘিরিয়া,
আসিতেছে যাইতেছে ফিরিয়া ফিরিয়া
অদৃশ্য মুরতি। কভু বিদ্যুতের মত
চমকিছে আলাে; বায়ুর তরঙ্গ যত

শব্দ করি’ করিছে আঘাত। ব্যথাসম
কি যেন বাজিছে আজি অন্তরেতে মম
বারম্বার—কিছু আমি নারি বুঝিবারে
জগতে কাহারা আজি ডাকিছে আমারে।

রাজমহিষীর প্রবেশ


মহিষী


মা গাে মা, কি করি তােরে ল’য়ে! ওরে বাছা,
এ সব কি সাজে তােরে কভু, এই কাঁচা
নবীন বয়সে? কোথা গেল বেশভূষা
কোথা আভরণ? আমার সােনার ঊষা
স্বর্ণপ্রভাহীনা; এও কি চোখের পরে
সহ্য হয় মার?

মালিনী


   কখনাে রাজার ঘরে
জন্মে না কি ভিখারিণী? দরিদ্রের কুলে
তুই যে মা জন্মেছিস্ সে কি গেলি ভুলে
রাজেশ্বরী? তাের সে বাপের দরিদ্রতা
জগৎবিখ্যাত, বল্ মা সে যাবে কোথা?
তাই আমি ধরিয়াছি অলঙ্কারসম
তমার বাপের দৈন্য সর্ব্বঅঙ্গে মম
মা আমার।

মহিষী


   ও গাে, আপন বাপের গর্ব্বে
আমার বাপেরে দাও খোঁটা? তাই গর্ভে
ধরেছিনু তােরে, ওরে অহঙ্কারী মেয়ে?
জানিস, আমার পিতা তাের পিতাচেয়ে
শতগুণে ধনী, তাই ধনরত্ন পানে
এত তাঁর হেলা!

মালিনী


   সে ত সকলেই জানে।
যেদিন পিতৃব্য তব, পিতৃধনলােভে
বঞ্চিলেন পিতারে তােমার, মনক্ষোভে
ছাড়িলেন গৃহ তিনি। সর্ব্ব ধনজন
সম্পদসহায় করিলেন বিসর্জ্জন
অকাতর মনে; শুধু সযত্নে আনিলা
পৈতৃক দেবতামূর্ত্তি, শালগ্রাম শিলা,
দরিদ্রকুটীরে। সেই তাঁর ধর্ম্মখানি
মাের জন্মকালে মােরে দিয়েছ মা আনি’
আর কিছু নহে। থাক্ না মা সর্ব্বক্ষণ
তব পিতৃভবনের দরিদ্রের ধন
তােমারি কন্যার হৃদে। আমার পিতার
যা কিছু ঐশ্বর্য আছে ধনরত্নভার
থাক্‌ রাজপুত্র তরে।

মহিষী


    কে তােমারে বােঝে
মা আমার। কথা শুনে জানি না কেন যে
চক্ষে আসে জল। যেদিন আসিলি কোলে
বাক্যহীন মূঢ় শিশু, ক্রন্দনকল্লোলে
মায়েরে ব্যাকুল করি, কে জানিত তবে
সেই ক্ষুদ্র মুগ্ধ মুখ এত কথা ক'বে
দুই দিন পরে! থাকি তাের মুখ চেয়ে,
ভয়ে কাঁপে বুক। ও মোর সোনার মেয়ে
এ ধর্ম্ম কোথায় পেলি, কি শাস্ত্রবচন?
আমার পিতার ধর্ম্ম সে ত পুরাতন
অনাদি কালের। কিন্তু মাগাে, এ যে তব
সৃষ্টিছাড়া বেদছাড়া ধর্ম্ম অভিনব
আজিকার গড়া। কোথা হ'তে ঘরে আসে
বিধর্ম্মী সন্ন্যাসী? দেখে' আমি মরি ত্রাসে।
কি মন্ত্র শিখায় তা'রা, সরল হৃদয়
জড়ায় মিথ্যার জালে? লােকে না কি কয়
বৌদ্ধেরা পিশাচপন্থী, যাদুবিদ্যা জানে,
প্রেতসিদ্ধ তা'রা। মাের কথা লহ কানে
বাছারে আমার। -ধর্ম্ম কি খুঁজিতে হয়?
সূর্যের মতন ধর্ম্ম চিরজ্যোতির্ম্ময়

চিরকাল আছে। ধর তুমি সেই ধর্ম্ম,
সরল সে পথ। লহ ব্রতক্রিয়াকর্ম্ম
ভক্তিভরে। শিবপূজা কর দিনযামী,
বর মাগি' লহ বাছা তাঁরি মত স্বামী।
সেই পতি হবে তাের সমস্ত দেবতা,
শাস্ত্র হবে তাঁরি বাক্য, সরল এ কথা।
শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিতেরা মরুক ভাবিয়া
সত্যাসত্য ধর্ম্মাধর্ম্ম কর্ত্তাকর্ম্মক্রিয়া
অনুস্বর চন্দ্রবিন্দু ল'য়ে! পুরুষের
দেশভেদে কালভেদে প্রতিদিবসের
স্বতন্ত্র নূতন ধর্ম্ম; সদা হাহা করে’
ফিরে তা'রা শান্তি লাগি’ সন্দেহ-সাগরে,
শাস্ত্র ল’য়ে করে কাটাকাটি। রমণীর
ধর্ম্ম থাকে বক্ষে কোলে চিরদিন স্থির
পতিপুত্ররূপে!

রাজার প্রবেশ


রাজা


   কন্যা, ক্ষান্ত হও এবে,
কিছুদিনতরে। উপরে আসিছে নেবে
ঝটিকার মেঘ।

মহিষী


  কোথা হ'তে মিথ্যা ভয়
আনিয়াছ মহারাজ?

রাজা


    বড় মিথ্যা নয়।
হায়রে অবােধ মেয়ে, নবধর্ম্ম যদি
ঘরেতে আনিতে চাস্, সে কি বর্ষানদী
একেবারে তট ভেঙে হইবে প্রকাশ
দেশবিদেশের দৃষ্টিপথে? লজ্জাত্রাস
নাহি তা’র? আপনার ধর্ম্ম আপনারি,
থাকে যেন সঙ্গোপনে, সর্ব্বনরনারী
দেখে' যেন নাহি করে দ্বেষ, পরিহাস
না করে কঠোর। ধর্ম্মেরে রাখিতে চাস
রাখ মনেমনে।

মহিষী


   ভর্তসনা করিছ কেন
বাছারে আমার মহারাজ? কত যেন
অপরাধী। কি শিক্ষা শিখাতে এলে আজ
রাজনীতিকুটিলতা? লুকায়ে করিবে কাজ,
ধর্ম্ম দিবে চাপা! সে মেয়ে আমার নয়।
সাধু সন্ন্যাসীর কাছে উপদেশ লয়,

শুনে পুণ্যকথা, করে সজ্জনের সেবা,
আমি ত বুঝি না তাহে দোষ দিবে কেবা,
ভয় বা কাহারে!

রাজা


   মহারাণী, প্রজাগণ
ক্ষুব্ধ অতিশয়। চাহে তা'রা নির্বাসন
মালিনীর?

মহিষী


  কি বলিলে! নির্ব্বাসন কারে!
মালিনীরে? মহারাজ, তােমার কন্যারে?

রাজা


ধর্ম্মনাশ আশঙ্কায় ব্রাহ্মণের দল
এক হ'য়ে—

মহিষী


   ধর্ম্ম জানে ব্রাহ্মণে কেবল?
আর ধর্ম নাই? তাদেরি পুঁথিতে লেখা
সর্ব্ব সত্য, অন্য কোথা নাহি তা’র রেখা
এ বিশ্বসংসারে? ব্রাহ্মণেরা কোথা আছে।
ডেকে নিয়ে এস। আমার মেয়ের কাছে
শিখে নি ধর্ম্ম কারে বলে। ফেলে দিক
কীটে কাটা ধর্ম্ম তা’র ধিক্‌, ধিক্ ধিক্!

ওরে বাছা, আমি লব নবমন্ত্র তাের,
আমি ছিন্ন করে' দেব’ জীর্ণ শাস্ত্রডাের
ব্রাহ্মণের। তােমারে পাঠাবে নির্ব্বাসনে?
নিশ্চিন্ত রয়েছ মহারাজ? ভাব মনে
এ কন্যা তোমার কন্যা, সামান্য বালিকা,
ওগাে তাহা নহে। এ যে দীপ্ত অগ্নিশিখা।
আমি কহিলাম আজি শুনি লহ কথা—
এ কন্যা মানবী নহে, এ কোন্ দেবতা,
এসেছে তােমার ঘরে। করিয়াে না হেলা,
কোন দিন অকস্মাৎ ভেঙে দিয়ে খেলা
চলে যাবে-তখন করিবে হাহাকার-
রাজ্যধন সব দিয়ে পাইবে না আর।

মালিনী


প্রজাদের পূরাও প্রার্থনা। মহাক্ষণ
এসেছে নিকটে। দাও মােরে নির্ব্বাসন
পিতা।

রাজা


  কেন বৎসে, পিতার ভবনে তাের
কি অভাব? বাহিরের সংসার কঠোর
দয়াহীন, সে কি বাছা পিতৃমাতৃক্রোড়?

মালিনী


শােন পিতা,—যারা চাহে নির্ব্বাসন মাের
তা'রা চাহে মােরে। ওগাে মা, শােন্ মা কথা!
বােঝাতে পারিনে মোর চিত্তব্যাকুলতা।
আমারে ছাড়িয়া দে মা বিনা দুঃখশােকে,
শাখা হ’তে চ্যুতপত্রসম। সর্ব্বলােকে
যাব আমি -রাজদ্বারে মােরে যাচিয়াছে
বাহির সংসার। জানি না কি কাজ আছে,
আসিয়াছে মহাক্ষণ।

রাজা


    ওরে শিশুমতি
কি কথা বলিস্!

মালিনী


   পিতা, তুমি নরপতি,
রাজার কর্ত্তব্য কর। জননী আমার,
আছে তাের পুত্রকন্যা, এ ঘরসংসার,
আমারে ছাড়িয়া দে মা। বাঁধিসনে আর
স্নেহপাশে।

মহিষী


  শােন কথা শােন একবার।
বাক্য নাহি সরে মুখে, চেয়ে তাের পানে
রয়েছি বিস্মিত। হাঁ গাে, জন্মিলি যেখানে

সেখানে কি স্থান নাই তাের? মা আমার,
তুই কি জগৎলক্ষী, জগতের ভার
পড়েছে কি তােরি পরে? নিখিল সংসার
তুই বিনা মাতৃহীনা, যাবি তারি কাছে
নূতন আদরে;—আমাদের মা কে আছে
তুই চলে' গেলে?

মালিনী


   আমি স্বপ্ন দেখি জেগে,
শুনি নিদ্রাঘােরে, যেন বায়ু বহে বেগে,
নদীতে উঠিছে ঢেউ, রাত্রি অন্ধকার,
নৌকাখানি তীরে বাঁধা—কে করিবে পার,
কর্ণধার নাই-গৃহহীন যাত্রী সবে
বসে' আছে নিরাশ্বাস—মনে হয় তবে
আমি যেন যেতে পারি—আমি যেন জানি
তীরের সন্ধান-মাের স্পর্শে নৌকাখানি
পাবে যেন প্রাণ—যাবে যেন আপনার
পূর্ণ বলে;—কোথা হ'তে বিশ্বাস আমার
এল মনে? রাজকন্যা আমি,—দেখি নাই
বাহির সংসার—বসে' আছি এক ঠাই
জন্মাবধি, চতুর্দ্দিকে সুখের প্রাচীর,
আমারে কে করে' দেয় ঘরের বাহির

কে জানে গাে। বন্ধ কেটে দাও মহারাজ,
ওগাে ছেড়ে দে মা, কন্যা আমি নহি আজ,
নহি রাজসুতা,—যে মাের অন্তরযামী
অগ্নিময়ী মহাবাণী, সেই শুধু আমি।

মহিষী


শুনিলে ত মহারাজ? এ কথা কাহার?
শুনিয়া বুঝিতে নারি! এ কি বালিকার?
এই কি তােমার কন্যা? আমি কি আপনি
ইহারে ধরেছি গর্ভে?

রাজা


    যেমন রজনী
উষারে জনম দেয়। কন্যা জ্যোতির্ম্ময়ী
রজনীর কেহ নহে, সে যে বিশ্বজয়ী
বিশ্বে দেয় প্রাণ।

মহিষী


   মহারাজ তাই বলি,
খুঁজে দেখ কোথা আছে মায়ার শিকলি
যাহে বাঁধা পড়ে' যায় আলোকপ্রতিমা।

( কন্যার প্রতি)


মুখে খুলে পড়ে কেশ, একি বেশ! ছি মা!
আপনারে এত অনাদর। আয় দেখি
ভালাে করে বেঁধে দিই। লােকে বলিবে কি

দেখে তােরে?—নির্ব্বাসন! এই যদি হয়
ধর্ম্ম ব্রাহ্মণের—তবে হােক মা উদয়
নব ধর্ম্ম-শিখে নিক তােরি কাছ হ'তে
বিপ্রগণ। দেখি মুখ, আয় মা আলােতে।

( মহিষী ও মালিনীর প্রস্থান)


সেনাপতির প্রবেশ


সেনাপতি


মহারাজ, বিদ্রোহী হয়েছে প্রজাগণ
ব্রাহ্মণবচনে! তা'রা চায় নির্ব্বাসন
রাজকুমারীর।

রাজা



যাও তবে সেনাপতি
সামন্তনৃপতি সবে আন দ্রুতগতি।

(রাজা ও সেনাপতির প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য

মন্দিরপ্রাঙ্গণে ব্রাহ্মণগণ

ব্রাহ্মণগণ


নির্ব্বাসন, নির্ব্বাসন, রাজ-দুহিতার
নির্ব্বাসন।

ক্ষেমঙ্কর


  বিপ্রগণ, এই কথা সার।
এ সংকল্প দৃঢ় রেখাে মনে। জেনাে ভাই
অন্য অরি নাহি ডরি নারীরে ডরাই।
তা'র কাছে অস্ত্র যায় টুটে; পরাহত
তর্কযুক্তি, বাহুবল করে শির নত—
নিরাপদে হৃদয়ের মাঝে করে বাস
রাজ্ঞীসম মনােহর মহাসর্ব্বনাশ।

চারুদত্ত


চল সবে রাজদ্বারে, বল, “রক্ষ রক্ষ
মহারাজ, আর্য্যধর্ম্মে করিতেছে লক্ষ্য
তব নীড় হ’তে সর্প।”

সুপ্রিয়


   ধর্ম্ম? মহাশয়,
মূঢ়ে উপদেশ দেহ ধর্ম্ম কারে কয়।
ধর্ম্ম নির্দ্দোষীর নির্ব্বাসন?

চারুদত্ত


    তুমি দেখি
কুলশত্রু বিভীষণ। সকল কাজে কি
বাধা দিতে আছ?

সােমাচার্য্য


   মােরা ব্রাহ্মণ-সমাজে
একত্রে মিলেছি সবে ধর্ম্মরক্ষাকাজে;
তুমি কোথা হ'তে এসে মাঝে দিলে দেখা
অতিশয় সুনিপুণ বিচ্ছেদের রেখা,
সূক্ষম সর্ব্বনাশ।

সুপ্রিয়


   ধর্ম্মাধর্ম সত্যাসত্য
কে করে বিচার! আপন বিশ্বাসে মত্ত
করিয়াছ স্থির, শুধু দল বেঁধে সবে
সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চরবে?
যুক্তি কিছু নহে?

চারুদত্ত


   দস্ত তব অতিশয়
হে সুপ্রিয়।

সুপ্রিয়


  প্রিয়ম্বদ, মাের দম্ভ নয়;—
আমি অজ্ঞ অতি-দম্ভ তারি যে আজিকে
শতার্থক শাস্ত্র হ’তে দুটো কথা শিখে
নিস্পাপ নিরপরাধ রাজকুমারীরে
টানিয়া আনিতে চাহে ঘরের বাহিরে
ভিক্ষুকের পথে,—তাঁর শাস্ত্রে মাের শাস্ত্রে
দু অক্ষর প্রভেদ বলিয়া।

ক্ষেমঙ্কর


     বচনাস্ত্রে
কে পারে তােমারে বন্ধুবর!

সােমাচার্য্য


     দূর করে'
দাও সুপ্রিয়েরে। বিপ্রগণ কর ওরে
সভার বাহির।

চারুদত্ত


   মােরা নির্ব্বাসন চাহি
রাজকুমারীর। যার অভিমত নাহি
যাক সে বাহিরে।

ক্ষেমঙ্কর


    ক্ষান্ত হও বন্ধুগণ।

সুপ্রিয়


ভ্রমক্রমে আমারে করেছে নির্ব্বাচন
ব্রাহ্মণমণ্ডলী। আমি নহি একজন
তােমাদের ছায়া। প্রতিধ্বনি নহি আমি
শাস্ত্রবচনের। যে শাস্ত্রের অনুগামী
এ ব্রাহ্মণ, সে শাস্ত্রে কোথাও লেখে নাই
শক্তি যার ধর্ম্ম তা'র।
 (ক্ষেমঙ্করের প্রতি) চলিলাম ভাই!
আমারে বিদায় দাও।

ক্ষেমঙ্কর


    দিব না বিদায়।
তর্কে শুধু দ্বিধা তব, কাজের বেলায়
দৃঢ় তুমি পর্বতের মত। বন্ধু মাের,
জান না কি আসিয়াছে দুঃসময় ঘাের,
আজ মৌন থাক।

সুপ্রিয়


   বন্ধু, জন্মেছে ধিক্কার।
মূঢ়তার দুর্ব্বিনয় নাহি সহে আর।
যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকর্ম্ম ব্রত উপবাস
এই শুধু ধর্ম্ম বলে’ করিবে বিশ্বাস
নিঃসংশয়ে? বালিকারে দিয়া নির্ব্বাসনে
সেই ধর্ম্ম রক্ষা হবে? ভেবে দেখ মনে
মিথ্যারে সে সত্য বলি করেনি প্রচার,—
সেও বলে সত্য ধর্ম্ম, দয়া ধর্ম্ম তা'র,
সর্ব্বজীবে প্রেম;—সর্ব্বধর্ম্মে সেই সার,—
তা’র বেশি যাহা আছে, প্রমাণ কি তা'র!

ক্ষেমঙ্কর


স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম্ম এক বটে,
বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে
ভিন্ন জলাশয়। আমরা যে সরােবরে
মিটাই পিপাসা পিতৃপিতামহ ধরে’
সেথা যদি অকস্মাৎ নবজলােচ্ছ্বাস
বন্যার মত আসে, ভেঙে করে নাশ
তটভূমি তার,—সে উচ্ছ্বাস হ'লে গত
বাঁধ-ভাঙা সরােবরে জলরাশি যত

বাহির হইয়া যাবে। তোমার অন্তরে
উৎস আছে, প্রয়ােজন নাহি সরােবরে,—
তাই বলে' ভাগ্যহীন সর্ব্বজনতরে
সাধারণ জলাশয় রাখিবে না তুমি,—
পৈতৃককালের বাঁধা দৃঢ় তটভূমি,
বহুদিবসের প্রেমে সতত লালিত
সৌন্দর্য্যের শ্যামলতা, সযত্নপালিত
পুরাতন ছায়াতরুগুলি, পিতৃধর্ম্ম,
প্রাণপ্রিয় প্রথা, চির-আচরিত কর্ম্ম,
চিরপরিচিত নীতি? হারায়ে চেতন
সত্য জননীর কোলে নিদ্রায় মগন
কত মূঢ় শিশু, নাহি জানে জননীরে,—
তাদের চেতনা দিতে মাতার শরীরে
কোরাে না আঘাত। ধৈর্য্য সদা রাখ, সখে,
ক্ষমা কর ক্ষমাযােগ্য জনে, জ্ঞানালােকে
আপন কর্ত্তব্য কর।

সুপ্রিয়


   তব পথগামী
চিরদিন এ অধীন। রেখে দিব আমি
তব বাক্য শিরে করি'। তর্ক-সূচি পরে
সংসারকর্ত্তব্যভার কভু নাহি ধরে।

উগ্রসেনের প্রবেশ


উগ্রসেন


কার্য্য সিদ্ধ ক্ষেমঙ্কর! হয়েছে চঞ্চল
ব্রাহ্মণের বাক্য শুনে রাজসৈন্যদল,
আজি বাঁধ ভাঙে-ভাঙে!

সােমাচার্য্য


    সৈন্যদল!

চারুদত্ত


     সে কি!
একি কাণ্ড, ক্রমে এযে বিপরীত দেখি
বিদ্রোহের মত!

সােমাচার্য্য


   এতদূর ভালাে নয়
ক্ষেমঙ্কর।

চারুদত্ত


  ধর্ম্মবলে ব্রাহ্মণের জয়,
বাহুবলে নহে। যজ্ঞযাগে সিদ্ধি হবে;
দ্বিগুণ উৎসাহভরে এস বন্ধু সবে
করি মন্ত্র পাঠ। শুদ্ধাচারে যােগাসনে
ব্রহ্মতেজ করি উপার্জ্জন। একমনে
পৃজি ইষ্টদেবে।

সােমাচার্য্য


   তুমি কোথা আছ দেবি,
সিদ্ধিদাত্রী জগদ্ধাত্রী! তব পদ সেবি’
ব্যর্থকাম কভু নাহি হবে ভক্তজন।
তুমি কর নাস্তিকের দর্পসংহরণ,
সশরীরে প্রত্যক্ষ দেখায়ে দাও আজি
বিশ্বাসের বল। সংহারের বেশে সাজি’
এখনি দাঁড়াও সর্ব্বসম্মুখেতে আসি
মুক্তকেশে খড়গহস্তে, অট্টহাস হাসি’
পাষণ্ডদলনী। এস সবে একপ্রাণ
ভক্তিভরে সমস্বরে করহ আহবান
প্রলয়শক্তিরে।

ব্রাহ্মণগণ


 (সমস্বরে) সবে করযােড়ে যাচি-
আয় মা প্রলয়ঙ্করী।

মালিনীর প্রবেশ



মালিনী


    আমি আসিয়াছি।
(ক্ষেমঙ্কর ও সুপ্রিয় ব্যতীত সমস্ত ব্রাহ্মণের
ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম)

সােমাচার্য্য


এ কি দেবী, এ কি বেশ? দয়াময়ী এ যে
এসেছেন ম্লানবস্ত্রে নরকন্যা সেজে।
এ কি অপরূপ রূপ। এ কি স্নেহজ্যোতি
নেত্রযুগে? এ ত নহে সংহারমূরতি!
কোথা হ'তে এলে মাতঃ? কি ভাবিয়া মনে,
কি করিতে কাজ?

মালিনী


   আসিয়াছি নির্ব্বাসনে,
তােমরা ডেকেছ বলে’ ওগাে বিপ্রগণ।

সােমাচার্য্য


নির্ব্বাসন! স্বর্গ হ'তে দেব-নির্ব্বাসন
ভক্তের আহ্বানে!

চারুদত্ত


   হায়, কি করিব মাতঃ!
তােমার সহায় বিনা আর রহে না ত
এ ভ্রষ্ট সংসার!

মালিনী


   আমি ফিরিব না আর।
জানিতাম, জানিতাম তােমাদের দ্বার
মুক্ত আছে মাের তরে। আমারি লাগিয়া
আছ বসে’ তাই আমি উঠেছি জাগিয়া

সুখসম্পদের মাঝে, তােমরা যখন
সবে মিলি যাচিলে আমার নির্ব্বাসন
রাজদ্বারে।

ক্ষেমঙ্কর


   রাজকন্যা?

সকলে


    রাজার দুহিতা!

সুপ্রিয়


ধন্য ধন্য!

মালিনী


   আমারে করেছ নির্ব্বাসিতা?
তাই আজি মাের গৃহ তােমাদের ঘরে।
তবু একবার মােরে বল সত্য করে’
সত্যই কি আছে কোনাে প্রয়ােজন মােরে,
চাহ কি আমায়? সত্যই কি নাম ধরে’
বাহিরসংসার হ'তে ডেকেছিলে সবে
আপন নির্জ্জনঘরে বসে ছিনু যবে
সমস্ত জগৎ হ’তে অতিশয় দূরে
শতভিত্তিঅন্তরালে রাজঅন্তঃপুরে
একাকী বালিকা। তবে সে ত স্বপ্ন নয়!
তাই ত কাঁদিয়াছিল আমার হৃদয়
না বুঝিয়া কিছু!

চারুদত্ত


   এস মা জননী,
শত চিত্তশতদলে দাঁড়াও অমনি
করুণামাখানাে মুখে।

মালিনী


    আসিয়াছি আজ-
প্রথমে শিখাও মােরে কি করিব কাজ
তােমাদের। জন্ম লভিয়াছি রাজকুলে,
রাজকন্যা আমি,—কখনাে গবাক্ষ খুলে
চাহিনি বাহিরে; দেখি নাই এ সংসার
বৃহৎ বিপুল,—কোথায় কি ব্যথা তা'র
জানি না ত কিছু। শুনিয়াছি দুঃখময়
বসুন্ধরা, সে দুঃখের লব পরিচয়
তােমাদের সাথে।

দেবদত্ত


   ভাসি নয়নের জলে
মা তােমার কথা শুনে।

সকলে


    আমরা সকলে
পাষণ্ড পামর।

মালিনী


আজি মাের মনে হয়
অমৃতের পাত্র যেন আমার হৃদয়—
যেন সে মিটাতে পারে এ বিশ্বের ক্ষুধা
যত দুঃখ যেথা আছে সকলের পরে
অনন্ত প্রবাহে।–দেখ দেখ নীলাম্বরে
মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ পেয়েছে প্রকাশ।
কি বৃহৎ লােকালয়—কি শান্ত আকাশ-
একজ্যোৎস্না বিস্তারিয়া সমস্ত জগৎ
কে নিল কুড়ায়ে বক্ষে —ওই রাজপথ,
ওই গৃহশ্রেণী, ওই উদার মন্দির-
স্তব্ধচ্ছায়া তরুরাজি—দূরে নদীতীর,
বাজিছে পূজার ঘণ্টা—আশ্চর্য্য পুলকে
পূরিছে আমার অঙ্গ— -জল আসে চোখে,
কোথা হ'তে এমু আমি আজি জ্যোৎস্নালােকে
তােমাদের এ বিস্তীর্ণ সর্বজনলােকে।

চারুদত্ত


তুমি বিশ্বদেবী।

সােমাচার্য্য


   ধিক্ পাপ রসনায়!
শত ভাগে ফাটিয়া গেল না বেদনায়,—
চাহিল তােমার নির্ব্বাসন!

দেবদত্ত


    চল সবে
বিপ্রগণ, জননীরে জয়জয়রবে
রেখে আসি রাজগৃহে।

সমবেত কণ্ঠে


    জয় জননীর।
জয় মা লক্ষীর! জয় করুণাময়ীর!

(মালিনীকে ঘিরিয়া লইয়া সুপ্রিয় ক্ষেমঙ্কর ব্যতীত সকলের প্রস্থান)



ক্ষেমঙ্কর


দূর হােক্ মােহ, দূর হােক! কোথা যাও
হে সুপ্রিয়?

সুপ্রিয়


   ছেড়ে দাও, মােরে ছেড়ে দাও।

ক্ষেমঙ্কর


স্থির হও। তুমি ও কি, বন্ধু, অন্ধভাবে
জনস্রোতে সর্ব্বসাথে ভেসে চলে' যাবে?

সুপ্রিয়


এ কি স্বপ্ন ক্ষেমঙ্কর?

ক্ষেমঙ্কর


    স্বপ্নে মগ্ন ছিলে
এতক্ষণ,—এখন সবলে চক্ষু মিলে
জেগে চেয়ে দেখ।

সুপ্রিয়


   মিথ্যা তব স্বর্গধাম,
মিথ্যা দেবদেবী ক্ষেমঙ্কর-ভ্রমিলাম
বৃথা এ সংসারে এতকাল। পাই নাই
কোনাে তৃপ্তি কোনাে শাস্ত্রে, অন্তর সদাই
কেঁদেছে সংশয়ে। আজ আমি লভিয়াছি
ধর্ম্ম মাের, হৃদয়ের বড় কাছাকাছি।
সবার দেবতা তব, শাস্ত্রের দেবতা,
আমার দেবতা নহে। প্রাণ তা'র কোথা,
আমার অন্তরমাঝে কই কহে কথা,
কি প্রশ্নের দেয় সে উত্তর–কি ব্যথার
দেয় সে সান্ত্বনা! আজি, তুমি কে আমার
জীবন-তরণীপরে রাখিলে চরণ
সমস্ত জড়তা তা'র করিয়া হরণ
এ কি গতি দিলে তা'রে! এতদিনপরে
এ মর্ত্যধরণীমাঝে মানবের ঘরে
পেয়েছি দেবতা মাের।

ক্ষেমঙ্কর


    হায় হায় সখে,
আপন হৃদয় যবে ভুলায় কুহকে
আপনারে, বড় ভয়ঙ্কর সে সময়-
শাস্ত্র হয় ইচ্ছা আপনার, ধর্ম্ম হয়

আপন কল্পনা। এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশি
সে সৌন্দর্য্যে দিকে দিকে রহিয়াছে মিশি
ইহাই কি চিরস্থায়ী? কাল প্রাতঃকালে
শতলক্ষ ক্ষুধাগুলা শত কর্ম্মজালে
ঘিরিবে না ভবসিন্ধু—মহাকোলাহলে
হবে না কঠিন রণ বিশ্বরণস্থলে?
তখন এ জ্যোৎস্নাসুপ্তি স্বপ্নময়া বলে'
মনে হ'বে—অতি ক্ষীণ, অতি ছায়াময়।
যে সৌন্দর্য্যমোহ তব ঘিরেছে হৃদয়,
সেও সেই জ্যোৎস্নাসম-ধর্ম্ম বল তা'রে?
একবার চক্ষু মেলি চাও চারিধারে
কত দুঃখ, কত দৈন্য, বিকট নিরাশা!
ওই ধর্ম্মে মিটাইবে মধ্যাহ্নপিপাসা
তৃষ্ণাতুর জগতের? সংসারের মাঝে
ওই তব ক্ষীণ মােহ লাগিবে কি কাজে?
খররৌদ্রে দাঁড়াইয়া রণরঙ্গভূমে
তখনাে কি মগ্ন হ'য়ে র’বে এই ঘুমে
ভুলে র’বে স্বপ্নধর্ম্মে-আর কিছু নাহি?
নহে সখে।

সুপ্রিয়


  নহে নহে।

ক্ষেমঙ্কর


    তবে দেখ চাহি
সম্মুখে তােমার। বন্ধু, আর রক্ষা নাই।
এবার লাগিল অগ্নি। পুড়ে হবে ছাই
পুরাতন অট্টালিকা, উন্নত উদার,
সমস্ত ভারতখণ্ড কক্ষে কক্ষে যার
হয়েছে মানুষ। এখনাে যে দুনয়নে
স্বপ্ন লেগে আছে তব।

    খাণ্ডবদহনে
সমস্ত বিহঙ্গকুল গগনে গগনে
উড়িয়া ফিরিয়াছিল করুণ ক্রন্দনে
স্বর্গ সমাচ্ছন্ন করি' -বক্ষে রক্ষণীয়
অক্ষম শাবকগণে স্মরি। হে সুপ্রিয়,
সেই মত উদ্বেগ-অধীর পিতৃকুল
নানা স্বর্গ হ'তে আসি’ আশঙ্কা-ব্যাকুল
ফিরিছেন শূন্যে শূন্যে আর্ত্ত কলস্বরে
আসন্ন সঙ্কটাতুর ভারতের পরে।
তবু স্বপ্নে মগ্ন সখে।

    দেখ মনে স্মরি,
আর্য্যধর্ম্ম মহাদুর্গ এ তীর্থনগরী
পুণ্যকাশী। দ্বারে হেথা কে আছে প্রহরী?

৯৭
5--7

সে কি আজ স্বপ্নে র'বে কর্ত্তব্য পাশরি
শত্রু যবে সমাগত, রাত্রি অন্ধকার,
মিত্র যবে গৃহদ্রোহী, পৌর পরিবার
নিশ্চেতন।—হে সুপ্রিয়, তুলে চাও আঁখি।
কথা কও। বল তুমি, আমারে একাকী
ফেলিয়া কি চলে' যাবে মায়ার পশ্চাতে
বিশ্বব্যাপী এ দুর্য্যোগে, প্রলয়ের রাতে?

সুপ্রিয়


কভু নহে, কভু নহে। নিদ্রাহীন চোখে
দাঁড়াইব পার্শ্বে তব।

ক্ষেমঙ্কর


    শুন তবে, সখে,
আমি চলিলাম।

সুপ্রিয়


   কোথা যাবে?

ক্ষেমঙ্কর


     দেশান্তরে,
হেথা কোনাে আশা নাহি আর। ঘরে পরে
ব্যাপ্ত হ'য়ে গেছে বহ্নি। বাহির হইতে
রক্তস্রোত মুক্ত করি হবে নিবাইতে।
যাই, সৈন্য আনি।

সুপ্রিয়


   হেথাকার সৈন্যগণ
রয়েছে প্রস্তুত।

ক্ষেমঙ্কর


   মিথ্যা আশা; এতক্ষণ
মুগ্ধ পঙ্গপালসম তা'রাও সকলে
দগ্ধপক্ষ পড়িয়াছে সব দলেবলে
হুতাশনে। জয়ধ্বনি ওই শুনা যায়।
উন্মত্তা নগরী আজ ধর্ম্মের চিতায়
জ্বালায় উৎসবদীপ।

সুপ্রিয়


   যদি যাবে ভাই,
প্রবাসে কঠিনপণে, আমি সঙ্গে যাই।

ক্ষেমঙ্কর


তুমি কোথা যাবে বন্ধু? তুমি হেথা থেকো
সদা সাবধানে; সকল সংবাদ রেখাে
রাজভবনের। লিখাে পত্র। দেখাে সখে,
তুমিও ভুলাে না শেষে নূতন কুহকে,
ছেড়াে না আমায়। মনে রেখাে সর্ব্বক্ষণ
প্রবাসী বন্ধুরে।

সুপ্রিয়


   সখে, কুহক নূতন,
আমি ত নূতন নহি। তুমি পুরাতন,
আর আমি পুরাতন।

ক্ষেমঙ্কর


    দাও আলিঙ্গন।

সুপ্রিয়


প্রথম বিচ্ছেদ আজি। ছিনু চিরদিন
এক সাথে। বক্ষে বক্ষে বিরহবিহীন
চলেছিনু দোঁহে-আজ তুমি কোথা যাবে,
আমি কোথা র’ব!

ক্ষেমঙ্কর


   আবার ফিরিয়া পাবে
বন্ধুরে তােমার। শুধু মনে ভয় হয়
আজি বিপ্লবের দিন বড় দুঃসময়;—
ছিন্নভিন্ন হ'য়ে যায় ধ্রুববন্ধচয়,
ভ্রাতারে আঘাত করে’ ভ্রাতা, বন্ধু হয়
বন্ধুর বিরােধী। বাহিরিনু অন্ধকারে,
অন্ধকারে ফিরিয়া আসিব গৃহদ্বারে;
দেখিব কি দীপ জ্বালি বসি’ আছ ঘরে
বন্ধু মাের? সেই আশা রহিল অন্তরে।


তৃতীয় দৃশ্য

অন্তঃপুরে মহিষী


মহিষী


এখানেও নাই! মাগাে, কি হবে আমার।
কেবলি এমনি করে' কতদিন আর
চোখে চোখে রাখি তা'রে, ভয়ে ভয়ে থাকি,
রজনীতে ঘুম ভেঙে নাম ধরে' ডাকি,
জেগে জেগে উঠি। চোখের আড়াল হ'লে
মনে শঙ্কা হয় কোথা গেল বুঝি চলে'
আমার সে স্বপ্নস্বরূপিণী। যাই, খুজি,
কোথা সে লুকায়ে আছে।

(প্রস্থান)


যুবরাজের সহিত রাজার প্রবেশ


রাজা


    অবশেষে বুঝি
দিতে হ’ল নির্ব্বাসন।

যুবরাজ


    না দেখি উপায়।
ত্বরা যদি নাহি কর রাজ্য তবে যায়

মহারাজ। সৈন্যগণ নগরপ্রহরী
হয়েছে বিদ্রোহী। স্নেহমােহ পরিহরি
কর্ত্তব্য সাধন কর—দাও মালিনীরে
অবিলম্বে নির্ব্বাসন!

রাজা


   ধীরে, বৎস, ধীরে।
দিব তা'রে নির্ব্বাসন,—পূরাব প্রার্থনা-
সাধিব কর্ত্তব্য মাের।—মনে করিয়াে না
বৃদ্ধ আমি মােহমুগ্ধ, অন্তর দুর্ব্বল,
রাজধর্ম্ম তুচ্ছ করি ফেলি অশ্রুজল।

মহিষীর পুনঃপ্রবেশ


মহিষী


মহারাজ, মহারাজ, বল সত্য করে'
কোথা লুকায়েছ তা'রে কাঁদাইতে মােরে?
কোথায় সে?

রাজা


  কে মহিষী?

মহিষী


    মালিনী আমার।

রাজা


কোথায় সে? চলে' গেছে? নাই ঘরে তা'র?

মহিষী


ওগাে নাই। যাও তুমি সৈন্যদল ল’য়ে
খোঁজ তা'রে পথে পথে আলয়ে আলয়ে,
কর ত্বরা। ওগাে তা'রে করিয়াছে চুরি
তােমার প্রজারা মিলে। নিষ্ঠুর চাতুরী
তাহাদের। দূর করে দাও সর্ব্বজনে।
শূন্য করে' দাও এ নগরী, যতক্ষণে
ফিরে নাহি দেয় মালিনীরে।

রাজা


    গেছে চলে’?
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি ফিরাইব কোলে
কোলের কন্যারে মাের। রাজ্যে ধিক্ থাক!
ধিক ধর্ম্মহীন রাজনীতি! ডাক, ডাক্
সৈন্যদলে।

( যুবরাজের প্রস্থান)


মালিনীকে লইয়া সৈন্যগণ ও প্রজাগণের মশাল ও
সমারােহ সহকারে প্রবেশ


ব্রাহ্মণগণ


  জয় জয় শুভ্র পুণ্যরাশি,
বিগ্রহিণী দয়া।

মহিষী


(ছুটিয়া গিয়া) ওমা, ওমা, সর্ব্বনাশী,
ও রাক্ষসী মেয়ে, আমার হৃদয়বাসী
নির্দ্দয় পাষাণী, এক পল করি না গাে
বুকের বাহির—তবু ফাঁকি দিয়ে মা গাে
কোথা গিয়েছিল?

প্রজাগণ


   কোরাে না গাে তিরস্কার
মহারাণী। আমাদের ঘরে একবার
গিয়েছিল আমাদের মাতা।

চারুদত্ত


     কেহ নই
আমরা কি, ও গাে রাণী? দেবী দয়াময়ী
শুধু তােমাদেরি?

দেবদত্ত


   ফিরে ত এনেছি পুনঃ
পুণ্যবতী প্রাসাদলক্ষীরে।

সােমাচার্য্য


    মা গাে শুন
আমাদের ভুলিয়াে না আর। মাঝে মাঝে
শুনি যেন শ্রীমুখের বাণী, শুভকাজে

পাই আশীর্ব্বাদ; তা হ'লে পরাণ-তরী
পথ পাবে পারাবারে ধ্রুবতারা ধরি
যাবে মুক্তিপারে।

মালিনী


   তােমরা যেয়াে না দূরে
এসেছ যাহারা। প্রতিদিন রাজপুরে
দেখা দিয়ে যেয়াে। সকলেরে এনাে ডাকি,
সবারে দেখিতে চাহি আমি। হেথা থাকি
র’ব আমি তােমাদেরি ঘরে পুরবাসী।

সকলে


মােরা আজি ধন্য সবে-ধন্য আজি কাশী!

(প্রস্থান)


মালিনী


ওগাে পিতা, আজ আমি হয়েছি সবার।
কি আনন্দ উচ্ছ্বসিল, জয়জয়কার
উঠিল ধ্বনিয়া যবে, সহস্র হৃদয়
মুহূর্ত্তে বিদীর্ণ করি।

রাজা


   কি সৌন্দর্য্যময়
আজিকার ছবি। সমুদ্রমন্থনে যবে
লক্ষ্মী উঠিলেন-তাঁরে ঘেরি কলরবে
মাতিল উন্মাদনৃত্যে উর্ম্মিগুলি সবে,

সেই মত উচ্ছ্বসিত জনপারাবার,
মাঝে তুমি লােকলক্ষ্মী মাতা।

মালিনী


     মা আমার
এ প্রাচীরে মােরে আর নারিবে লুকাতে,
তব অন্তঃপুরে আমি আনিয়াছি সাথে
সর্ব্বলােক,—দেহ নাই মাের, বাধা নাই,
আমি যেন এ বিশ্বের প্রাণ।

মহিষা


     থাক তাই,
বিশ্বপ্রাণ হ'য়ে। আপন করিয়া সবে
থাক মা'র কাছে। বাহিরে যেতে না হবে,
হেথা নিয়ে আয় তাের বৃহৎ সংসার,
মাতা কন্যা দোঁহে মিলি সেবা করি তা'র।
অনেক হয়েছে রাত, বােস মা এখানে,
শান্ত কর আপনারে—জ্বলিছে নয়ানে
উদ্দীপ্ত প্রাণের জ্যোতি নিদ্রার আরাম
দগ্ধ করি'। একটুকু কর মা বিশ্রাম।

মালিনী


( মাতাকে আলিঙ্গন করিয়া)


মাগাে, শ্রান্ত এবে আমি। কাঁপিতেছে দেহ।
কোথা গিয়েছিনু চলে’ ছাড়ি মার’ স্নেহ

প্রকাণ্ড পৃথিবীমাঝে। মাগাে, নিদ্রা আন্
চক্ষে মাের। ধীরে ধীরে কর তুই গান
শিশুকালে শুনিতাম যাহা; আজি মাের
চক্ষে আসিতেছে জল, বিষাদের ঘাের
ঘনাইছে প্রাণে।

মহিষী


   বসুগণ, রুদ্রগণ,
বিশ্বদেবগণ, সবে করহ রক্ষণ
কন্যারে আমার। মর্ত্ত্যলােক, স্বর্গলােক
হও অনুকূল—শুভ হােক, শুভ হােক
কন্যার আমার। হে আদিত্য, হে পবন,
করি প্রণিপাত, সর্ব্ব দিকপালগণ
কর দূর মালিনীর সর্ব্ব অকল্যাণ।—
দেখিতে দেখিতে আহা শ্রান্ত দুনয়ান
মুদিয়া এসেছে ঘুমে। আহা, মরে' যাই,
দূর হাে দূর হােক্ সকল বালাই।—
ভয়ে অঙ্গ কাঁপে মাের। কন্যার তােমার
একি খেলা মহারাজ? সমস্ত সংসার
খেলার সামগ্রী তা'র,—তা'রে রেখে দিবে
আপনার গৃহকোণে, ঘুম পাড়াইবে
পদ্মহস্ত পরশিয়া ললাটে তাহার।
অবাক হয়েছি দেখে' কাণ্ড বালিকার।

যেমন খেলেনাখানি, তেমনি এ খেলা।
মহারাজ, সাবধান হও এই বেলা।
নবধর্ম্ম নবধর্ম্ম, কারে বল তুমি
কে আনিল নবধর্ম্ম, কোথা তা’র ভূমি
আকাশকুসুম? কোন্ মত্ততার স্রোতে
ভেসে এল-কন্যারে মায়ের কোল হ'তে
টানিয়া লইয়া যায়-ধর্ম্ম বলে তায়?
তুমিও দিয়াে না যােগ কন্যার খেলায়
মহারাজ। বলে' দাও, গ্রহবিপ্রগণ
করুক সকলে মিলে শান্তিস্বস্ত্যয়ন
দেবার্চ্চনা। স্বয়ম্বরসভা আন ডেকে’
মালিনীর তরে। মনােমত বর দেখে'
খেলা ভেঙে যােগ্যকণ্ঠে দিক বরমালা—
দূর হ'বে নবধর্ম্ম, জুড়াইবে জ্বালা।


চতুর্থ দৃশ্য

রাজ উপবন

মালিনী, পরিচারিকাবর্গ ও সুপ্রিয়

মালিনী


হায়, কি বলিব! তুমিও কি মাের দ্বারে
আসিয়াছ দ্বিজোত্তম? কি দিব তােমারে?
কি তর্ক করিব? কি শাস্ত্র দেখাব আনি?
তুমি যাহা নাহি জান, আমি কি তা জানি?

সুপ্রিয়


শাস্ত্রসাথে তর্ক করি, নহে তােমাসনে।
সভার পণ্ডিত আমি তােমার চরণে
বালকের মত। দেবি, লহ মাের ভার।
যে পথে লইয়া যাবে, জীবন আমার
সাথে যাবে, সর্ব্ব তর্ক করি পরিহার,
নীরব ছায়ার মত দীপবর্ত্তিকার।

মালিনী


হে ব্রাহ্মণ, চলে' যায় সকল ক্ষমতা
তুমি যবে প্রশ্ন কর, নাহি পাই কথা।

বড়ই বিস্ময় লাগে মনে। হে সুপ্রিয়,
মাের কাছে কি জানিতে এসেছ তুমিও?

সুপ্রিয়


জানিবার কিছু নাই, নাহি চাহি জ্ঞান।
সব শাস্ত্র পড়িয়াছি, করিয়াছি ধ্যান
শত তর্ক শত মত। ভুলাও, ভুলাও,
যত জানি সব জানা দূর করে' দাও।
পথ আছে শতলক্ষ, শুধু আলাে নাই
ওগাে দেবী জ্যোতির্ম্ময়ী-তাই আমি চাই
একটি আলাের রেখা উজ্জ্বল সুন্দর
তােমার অন্তর হ'তে।

মালিনী


    হায় বিপ্রবর,
যত তুমি চাহিতেছ আমি যেন তত
আপনারে হেরিতেছি দরিদ্রের মত।
যে দেবতা মর্ম্মে মাের বজ্রালােক হানি
বলেছিল একদিন বিদ্যুন্ময়ী বাণী
সে আজি কোথায় গেল। সেদিন, ব্রাহ্মণ,
কেন তুমি আসিলে না—কেন এতক্ষণ
সন্দেহে রহিলে দূরে? বিশ্বে বাহিরিয়া
আজি মাের জাগে ভয়—কেঁপে ওঠে হিয়া,

কি করিব কি বলিব বুঝিতে না পারি-
মহাধর্ম্ম-তরণীর বালিকা কাণ্ডারী
নাহি জানি কোথা যেতে হবে। মনে হয়
বড় একাকিনী আমি, সহস্র সংশয়,
বৃহৎ সংসার, অসংখ্য জটিল পথ,
নানা প্রাণী, দিব্যজ্ঞান ক্ষণপ্রভাবৎ
ক্ষণিকের তরে আসে। তুমি মহাজ্ঞানী
হবে কি সহায় মাের?

সুপ্রিয়


    বহু ভাগ্য মানি
যদি চাহ মােরে।

মালিনী


   মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ
রুদ্ধ করে' দেয় যেন সমস্ত প্রবাহ
অন্তরের—অকারণ অশ্রুজলে ভাসে
দুনয়ন, কি জানি কি বেদনায়। অকস্মাৎ
আপনার পরে যেন পড়ে দৃষ্টিপাত
সহস্র লােকের মাঝে, সেই দুঃসময়ে
তুমি মাের বন্ধু হবে? মন্ত্রগুরু হ'য়ে
দিবে নবপ্রাণ?

সুপ্রিয়


   প্রস্তুত রাখিব নিত্য
এ ক্ষুদ্র জীবন। আমার সকল চিত্ত
সবল নির্ম্মল করি’, বুদ্ধি করি’ শান্ত
সমৰ্পণ করি দিব নিয়ত একান্ত
তব কাজে।

প্রতিহারীর প্রবেশ


প্রতিহারী


   প্রজাগণ দরশন যাচে।

মালিনী


আজ নহে, আজ নহে। সকলের কাছে
মিনতি আমার; আজি মাের কিছু নাহি
রিক্তচিত্ত মাঝে মাঝে ভরিবারে চাহি-
বিশ্রাম প্রার্থনা করি ঘুচাতে জড়তা।

(প্রতিহারীর প্রস্থান)

যে কথা শুনতেছিলে কহ সেই কথা,
আপন কাহিনী। শুনিয়া বিস্ময় লাগে,
নূতন বারতা পাই, নবদৃশ্য জাগে
চক্ষে মাের। তােমাদের সুখদুঃখ যত,
গৃহের বারতা সব আত্মীয়ের মত
সকলি প্রত্যক্ষ যেন জানিবারে পাই।
ক্ষেমঙ্কর বান্ধব তােমার?

সুপ্রিয়


    বন্ধু, ভাই,
প্রভু। সূর্য্য সে আমার, আমি রাহু,
আমি তা'র মহামােহ; বলিষ্ঠ সে বাহু,
আমি তাহে লৌহপাশ। বাল্যকাল হ'তে
দৃঢ় সে অটলচিত্ত, সংশয়ের স্রোতে
আমি ভাসমান। তবু সে নিয়ত মােরে
বন্ধুমােহে বক্ষেমাঝে রাখিয়াছে ধরে'
প্রবল অটল প্রেমপাশে, নিঃসন্দেহে
বিনা পরিতাপে; চন্দ্রমা যেমন স্নেহে
সহাস্যে বহন করে কলঙ্ক অক্ষয়
অনন্ত ভ্রমণপথে। ব্যর্থ নাহি হয়
বিধির নিয়ম কভু; লৌহময় তরী
হােক না যতই দৃঢ়, যদি রাখে ধরি’
বক্ষতলে ক্ষুদ্র ছিদ্রটিরে, একদিন
সঙ্কটসমুদ্রমাঝে উপায়বিহীন
ডুবিতে হইবে তা’রে। বন্ধুচিরন্তন,
তােমারে ডুবাব আমি, ছিল এ লিখন।

মালিনী


ডুবায়েছ তা'রে?

১১৩
5-8

সুপ্রিয়


   দেবি, ডুবায়েছি তা'রে।
জীবনের সব কথা বলেছি তােমারে,
শুধু সেই কথা আছে বাকি।
    যেই দিন
বিদ্বেষ উঠিল গর্জ্জি দয়াধর্ম্মহীন,
তােমারে ঘেরিয়া চারিদিকে,—একাকিনী
দাঁড়াইয়া পূর্ণ মহিমায়, কি রাগিণী
বাজাইলে বংশীরবে যেন মন্ত্রাহত
বিদ্রোহ করিল তা’র ফণা অবনত
তব পদতলে। শুধু বিপ্র ক্ষেমঙ্কর
রহিল পাষাণচিত্ত, অটল অন্তর।
একদা ধরিয়া কর কহিল সে মােরে
“বন্ধু, আমি চলিলাম দূর দেশান্তরে।
আনিয়া বিদেশী সৈন্য বরুণার কূলে
নবধর্ম্ম উৎপাটন করিব সমূলে
পুণ্য কাশী হ’তে।”—চলি গেল রিক্ত হাতে
অজ্ঞাত ভুবনে। শুধু ল’য়ে গেল সাথে
আমার হৃদয়, আর, প্রতিজ্ঞা কঠোর।
তা’র পরে জান তুমি কি ঘটিল মাের।
লভিলাম যেন আমি নবজন্মভূমি
যেদিন এ শুষ্কচিত্তে বরষিলে তুমি

সুধাবৃষ্টি। “সর্ব্ব জীবে দয়া”—জানে সবে
অতি পুরাতন কথা— তবু এই ভবে
এই কথা বসি’ আছে লক্ষবর্ষ ধরি’
সংসারের পরতীরে। তা'রে পার করি'
তুমি আজি আনিয়াছ সােনার তরীতে
সবার ঘরের দ্বারে। হৃদয়-অমৃতে
স্তন্যদান করিয়াছ সে দেবশিশুরে,
লয়েছে সে নবজন্ম মানবের পুরে
তােমারে মা বলে'।—স্বর্গ আছে কোন্ দূরে
কোথায় দেবতা -কেবা সে সংবাদ জানে।
শুধু জানি বলি দিয়া আত্ম অভিমানে
বাসিতে হইবে ভালো—বিশ্বের বেদনা
আপন করিতে হ'বে,—যে কিছু বাসনা
শুধু আপনার তরে তাই দুঃখময়।
যজ্ঞে যাগে তপস্যায় কভু মুক্তি নয়-
মুক্তি শুধু বিশ্বকাজে। ফিরে গিয়ে ঘরে
সে নিশীথে কাঁদিয়া কহিনু উচ্চস্বরে—
-বন্ধু বন্ধু কোথা গেছ বহু বহু দূরে
অসীম ধরণীতলে মরিতেছ ঘুরে।—
ছিনু তা'র পত্রআশেপত্র-নাহি পাই
না জানি সংবাদ। আমি শুধু আসি যাই
রাজগৃহমাঝে;—চারিদিকে দৃষ্টি রাখি,

শুধাই বিদেশিজনে, ভয়েভয়ে থাকি-
নাবিক যেমন দেখে চকিত নয়নে
সমুদ্রের মাঝে—গগনের কোন্ কোণে
ঘনাইছে ঝড়।—এলাে ঝড় অবশেষে
একখানি ছােট পত্ররূপে। লিখেছে সে-
রত্নবতী নগরীর রাজগৃহ হ'তে
সৈন্য ল’য়ে আসিছে সে শােণিতের স্রোতে
ভাসাইতে নবধর্ম্ম—ভিড়াইতে তীরে
পিতৃধর্ম্ম মগ্নপ্রায়, রাজকুমারীরে
প্রাণদণ্ড দিতে।—প্রচণ্ড আঘাতে সেই
ছিঁড়িল প্রাচীন পাশ এক নিমেষেই।
রাজারে দেখানু পত্র। মৃগয়ার ছলে
গােপনে গেছেন রাজা সৈন্যদলবলে
আক্রমিতে তা’রে। আমি হেথা লুটাতেছি
পৃথ্বীতলে—আপনার মর্ম্মে ফুটাতেছি
দন্ত আপনার।

মালিনী


  হায়, কেন তুমি তা'রে
আসিতে দিলে না হেথা মাের গৃহদ্বারে
সৈন্যসাথে? এ ঘরে সে প্রবেশিত আসি’
পূজ্য অতিথির মত—সুচিরপ্রবাসী
ফিরিত স্বদেশে তা'র।

রাজার প্রবেশ

রাজা


    এস আলিঙ্গনে
হে সুপ্রিয়! গিয়েছিনু অনুকূলক্ষণে
বার্ত্তা পেয়ে। বন্দী করিয়াছি ক্ষেমঙ্করে
বিনাক্লেশে। তিলেক বিলম্ব হ'লে পরে
সুপ্তরাজগৃহশিরে বজ্র ভয়ঙ্কর
পড়িত ঝঞ্ঝনি’, জাগিবার অবসর
পেতেম না কভু। এস আলিঙ্গনে মম
বান্ধব, আত্মীয় তুমি।

সুপ্রিয়


   ক্ষম মােরে ক্ষম
মহারাজ!

রাজা


  শুধু নহে শূন্য আত্মীয়তা
প্রিয়বন্ধু! মনে আনিয়াে না হেন কথা
শুধু রাজ-আলিঙ্গনে পুরস্কার তব।
কি ঐশ্বর্য্য চাহ? কি সম্মান অভিনব
করিব সৃজন তােমা’তরে? কহ মােরে!

সুপ্রিয়


কিছু নহে, কিছু নহে, খাব ভিক্ষা করে'
দ্বারে দ্বারে।

রাজা


  সত্য কহ, রাজ্যখণ্ড লবে?

সুপ্রিয়


রাজ্যে ধিক্ থাক!

রাজা


   অহো! বুঝিলাম তবে
কোন্ পণ চাহ জিনিবারে, কোন্ চাঁদ
পেতে চাও হাতে? ভালাে, পূরাইব সাধ,
দিলাম অভয়। কোন্ অসম্ভব আশা
আছে মনে, খুলে বল! কোথা গেল ভাষা।
বেশি দিন নহে, বিপ্র, সে কি মনে পড়ে
এই কন্যা মালিনীর নির্ব্বাসনতরে
অগ্রবর্ত্তী ছিলে তুমি। আজি আরবার
করিবে কি সে প্রার্থনা? রাজদুহিতার
নির্ব্বাসন পিতৃগৃহ হ'তে? সাধনার
অসাধ্য কিছুই নাই—বাঞ্ছা সিদ্ধ হবে—
ভরসা বাঁধহ বক্ষোমাঝে।—শুন তবে-
জীবন-প্রতিমে বৎসে—যে তােমার প্রাণ
রক্ষা করিয়াছে—সেই বিপ্র গুণবান্
সুপ্রিয় সবার প্রিয়, প্রিয়দরশন,
তা’রে-

সুপ্রিয়


 ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও হে রাজন্!
অয়ি দেবি, আজন্মের ভক্তিউপহারে
পেয়েছে আপন ঘরে ইষ্টদেবতারে
কত অকিঞ্চন-তেমনি পেতেম যদি
আমার দেবীরে—রহিতাম নিরবধি
ধন্য হ'য়ে। রাজহস্ত হ'তে পুরস্কার।
কি করেছি? আশৈশববন্ধুত্ব আমার
করেছি বিক্রয়—আজি তারি বিনিময়ে
ল’য়ে যাব শিরে করি’ আপন আলয়ে
পরিপূর্ণ সার্থকতা? তপস্যা করিয়া
মাগিব পরমসিদ্ধি জন্মান্ত ধরিয়া—
জন্মান্তরে পাই যদি তবে তাই হােক-
বন্ধুর বিশ্বাস ভাঙি সপ্ত স্বর্গলােক
চাহি না লভিতে।—পূর্ণকাম তুমি দেবী,
আপনার অন্তরের মহত্ত্বেরে সেবি’
পেয়েছ অনন্ত শান্তি,—আমি দীনহীন
পথে পথে ফিরে মরি অদৃষ্ট অধীন
শ্রান্ত নিজভারে। আর কিছু চাহিব না-
দিতেছ নিখিলময় যে শুভকামনা
মনে করে’ অভাগারে তারি এক কণা
দিয়ো মনে মনে।

মালিনী


   ওরে রমণীর মন
কোথা বক্ষোমাঝে বসে’ করিস্ ক্রন্দন
মধ্যাহ্নে নির্জ্জননীড়ে প্রিয়বিরহিতা
কপােতীর প্রায়?—কি করেছ বল পিতা
বন্দীর বিচার?

রাজা


   প্রাণদণ্ড হবে তা'র।

মালিনী


ক্ষমা কর। একান্ত এ প্রার্থনা আমার
তব পদে।

রাজা


  রাজদ্রোহী, ক্ষমিব তাহারে
বৎসে?

সুপ্রিয়


  কে কার বিচার করে এ সংসারে
সে কি চেয়েছিল তব সসাগরা মহী
মহারাজ? সে জানিত তুমি ধর্ম্মদ্রোহী
তাই সে আসিতেছিল তােমার বিচার
করিতে আপন বলে। বেশি বল যার

সেই বিচারক। সে যদি জিনিত আজি
দৈবক্রমে—সে বসিত বিচারক সাজি’
তুমি হ’তে অপরাধী।

মালিনী


    রাখ প্রাণ তা'র
মহারাজ! তা'র পরে স্মরি উপকার
হিতৈষী বন্ধুরে তব যাহা ইচ্ছা দিয়াে
লবে সে আদর করি।

রাজা


    কি বল সুপ্রিয়।
বন্ধুরে করিব বন্ধুদান?

সুপ্রিয়


    চিরদিন
স্মরণে রহিবে তব অনুগ্রহঋণ
নরপতি।

রাজা


  কিন্তু তা'র পূর্ব্বে একবার
দেখিব পরীক্ষা করি’ বীরত্ব তাহার।
দেখিব মরণভয়ে টলে কি না টলে
কর্ত্তব্যের বল। মহত্ত্বের শিখা জ্বলে
নক্ষত্রের মত,—দীপ নিবে যায় ঝড়ে,
তারা নাহি নিবে।—সে কথা হইবে পরে।

তােমার বন্ধুরে তুমি পাবে, মাঝখানে
উপলক্ষ্য আমি। সে দানে তৃপ্তি না মানে
মন।—আরাে দিব।—পুরস্কার বলে’ নয়,—
রাজার হৃদয় তুমি করিয়াছ জয়-
সেথা হ’তে লহ তুলি’ রত্ন সর্ব্বোত্তম
হৃদয়ের।–কন্যা, কোথা ছিল এ সরম
এতদিন! বালিকার লজ্জাভয়শােক
দূর করি দীপ্তি পেত অম্লানআলােক
দুঃসহউজ্জ্বল। কোথা হ'তে এল আজ
অশ্রুবাপে ছলছল কম্পমান লাজ-
যেন দীপ্ত হােমহুতাশনশিখা ছাড়ি
সদ্য বাহিরিয়া এল স্নিগ্ধ সুকুমারী
দ্রুপদদুহিতা।

( সুপ্রিয়ের প্রতি)


   উঠ, ছাড়, পদতল।
বৎস, বক্ষে, এস। সুখ করিছে বিহ্বল
দুর্ভর দুঃখেরি মত। দাও অবসর,
হেরি প্রাণপ্রতিমার মুখশশধর,
বিরলে আনন্দভরে শুধু ক্ষণকাল।

( সুপ্রিয়ের প্রস্থান)


(স্বগত) বহুদিন পরে মাের মালিনীর ভাল

লজ্জার আভায় রাঙা। কপােল ঊষার
যখনি রাঙিয়া উঠে বুঝা যায়, তা'র
তপন উদয় হ'তে দেরী নাই আর।
এ রাঙা আভাস দেখে আনন্দে আমার
হৃদয় উঠিছে ভরি—বুঝিলাম মনে
আমাদের কন্যাটুকু বুঝি এতক্ষণে
বিকশি উঠিল—দেবী নারে, দয়া নারে,
ঘরের সে মেয়ে।

প্রতিহারীর প্রবেশ


প্রতিহারী


   জয় মহারাজ, দ্বারে
উপনীত বন্দী ক্ষেমঙ্কর।

রাজা


   আন তা'রে।

শৃঙ্খলবদ্ধ ক্ষেমঙ্করের প্রবেশ



নেত্র স্থির, ঊর্দ্ধশির, ভ্রূকুটির পরে
ঘনায়ে রয়েছে ঝড়, হিমাদ্রিশিখরে
স্তম্ভিত শ্রাবণ সম।

মালিনী


    লােহার শৃঙ্খল
ধিক্কার মানিছে যেন লজ্জায় বিকল

ওই অঙ্গপরে। মহত্ত্বের অপমান
মরে অপমানে। ধন্য মানি এ পরাণ
ইন্দ্রতুল্য হেন মুর্ত্তি হেরি।

রাজা


(বন্দীর প্রতি)   কি বিধান
হয়েছে শুনেছ?

ক্ষেমঙ্কর


   মৃত্যুদণ্ড।

রাজা


    যদি প্রাণ
ফিরে দিই, যদি ক্ষমা করি?

ক্ষেমঙ্কর


    পুনর্ব্বার
তুলিয়া লইতে হ'বে কর্ত্তব্যের ভার,—
যে পথে চলিতেছিনু আবার সে পথে
যেতে হ'বে।

রাজা


  বাঁচিতে চাহ না কোনােমতে!
ব্রাহ্মণ, প্রস্তুত হও মমতা তেয়াগি'
জীবনের। এই বেলা লহ তবে মাগি
প্রার্থনা যা কিছু থাকে।

ক্ষেমঙ্কর


   আর কিছু নাহি
বন্ধু সুপ্রিয়েরে শুধু দেখিবারে চাহি।

রাজা


(প্রতিহারীর প্রতি)


ডেকে আন তা'রে।

মালিনী


   হৃদয় কাঁপিছে বুকে।
কি যেন পরমাশক্তি আছে ওই মুখে
বজ্রসম ভয়ঙ্কর। রক্ষা কর পিতঃ,
আনিয়াে না সুপ্রিয়েরে।

রাজা


    কেন মা শঙ্কিত
অকারণে? কোনাে ভয় নাই।

ক্ষেমঙ্করের নিকট সুপ্রিয়ের আগমন

ক্ষেমঙ্কর


(আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করিয়া) থাক্ থাক,
যাহা বলিবার আছে আগে হ'য়ে যাক-
পরে হবে প্রণয়সম্মান।—এস হেথা।
জান সখে, বাক্যদীন আমি-বেশি কথা
যােগায় না মুখে। সময় অধিক নাই,
আমার বিচার হ’ল শেষ—আমি চাই

তােমার বিচার এবে। বল মাের কাছে
এ কাজ করেছ কেন?

সুপ্রিয়


    বন্ধু এক আছে
শ্রেষ্ঠতম, সে আমার আত্মার নিশ্বাস,
সব ছেড়ে রাখিয়াছি তাহারি বিশ্বাস,
প্রাণসখে, ধর্ম্ম সে আমার।

ক্ষেমঙ্কর


    জানি জানি
ধর্ম্ম কে তােমার। ওই স্তব্ধ মুখখানি
অন্তর্জ্যোতির্ম্ময়, মূর্ত্তিমতী দৈববাণী
রাজকন্যারূপে, চতুর্ব্বেদ হ'তে সখে
কেড়ে ল’য়ে পিতৃধর্ম্ম ওই নেত্রালোকে
দিয়েছ আহুতি তুমি। ধর্ম্ম ওই তব।
ওই প্রিয়মুখে তুমি রচিয়াছ নব
ধর্ম্মশাস্ত্র আজি।—

সুপ্রিয়


   সত্য বুঝিয়াছ সখে।
মাের ধর্ম্ম অবতীর্ণ দীন মর্ত্ত্যলােকে
ওই নারীমূর্ত্তি ধরি'। শাস্ত্র এতদিন
মাের কাছে ছিল অন্ধ জীবন-বিহীন;

ওই দুটি নেত্রে জ্বলে যে উজ্জ্বল শিখা
সে আলােকে পড়িয়াছি বিশ্বশাস্ত্রে লিখা
যেথা দয়া সেথা ধর্ম্ম, যেথা প্রেমস্নেহ,
যেথায় মানব, যেথা মানবের গেহ।
বুঝিলাম, ধর্ম্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,
পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুনঃ;—দাতারূপে
করে দান, দীনরূপে করে তা' গ্রহণ,—
শিষ্যরূপে করে ভক্তি, গুরুরূপে করে
আশীর্ব্বাদ; প্রিয় হ'য়ে পাষাণঅন্তরে
প্রেম-উৎস লয় টানি’, অনুরক্ত হ'য়ে
করে সর্ব্বসমর্পণ। ধর্ম্ম বিশ্বলােকালয়ে
ফেলিয়াছে চিত্তজাল,—নিখিল ভুবন
টানিতেছে প্রেমক্রোড়ে,—সে মহাবন্ধন
ভরেছে অন্তর মাের আনন্দবেদনে
চাহি ওই ঊষারুণ করুণ বদনে।
ওই ধর্ম্ম মোর।

ক্ষেমঙ্কর


   আমি কি দেখিনি ওরে?
আমিও কি ভাবি নাই মুহূর্ত্তের ঘােরে
এসেছে অনাদি ধর্ম্ম নারীমূর্ত্তি ধরে’
কঠিন পুরুষমন কেড়ে নিয়ে যেতে
স্বর্গপানে? ক্ষণতরে মুগ্ধ হৃদয়েতে

জন্মেনি কি স্বপ্নাবেশ? অপূর্ব্ব সঙ্গীতে
বক্ষের পঞ্জর মাের লাগিল কাঁদিতে
সহস্র বংশীর মত,—সর্ব্ব সফলতা,
জীবনের যৌবনের আশাকল্পলতা
জড়ায়ে জড়ায়ে মাের অন্তরে অন্তরে
মুঞ্জরি উঠিল যেন পত্রপুষ্পভরে
এক নিমেষের মাঝে। তবু কি সবলে
ছিঁড়িনি মায়ার বন্ধ, যাইনি কি চলে’
দেশে দেশে দ্বারে দ্বারে, ভিক্ষুকের মত
লইনি কি শিরে ধরি অপমান শত
হীন হস্ত হ'তে-সহিনি কি অহরহ
আজন্মের বন্ধু তুমি তােমার বিরহ।—
সিদ্ধি যবে লব্ধপ্রায়—তুমি হেথা বসে'
কি করেছ—রাজগৃহমাঝে সুখালসে
কি ধর্ম্ম মনের মত করেছ সৃজন
দীর্ঘ অবসরে?—

সুপ্রিয়


   ওগাে বন্ধু, এ ভুবন
নহে কি বৃহৎ? নাই কি অসংখ্য জন,
বিচিত্র স্বভাব? কাহার কি প্রয়ােজন

তুমি কি তা জান? গগনে অগণ্য তারা,
নিশিনিশি বিবাদ কি করিছে তাহারা
ক্ষেমঙ্কর? তেমনি জ্বালায়ে নিজ জ্যোতি
কত ধর্ম্ম জাগিতেছে তাহে কোন্ ক্ষতি।

ক্ষেমঙ্কর


মিছে আর কেন বন্ধু। ফুরাল সময়,
বাক্য ল’য়ে মিথ্যা খেলা, তর্ক আর নয়।
সত্যমিথ্যা পাশাপাশি নির্ব্বিরােধে র’বে
এত স্থান নাহি নাহি অনন্ত এ ভবে।
অন্নরূপে ধান্য যেথা উঠে চিরদিন
রােপিবে তাহারি মাঝে কণ্টক নবীন
হে সুপ্রিয়, প্রেম এত সর্ব্বপ্রেমী নয়।
ছিল চিরদিবসের বিশ্রব্ধ প্রণয়
আনিবে বিশ্বাসঘাত বক্ষোমাঝে তা'র
বন্ধু মাের, উদারতা এত কি উদার।
কেহ বা ধর্ম্মের লাগি সহি নির্য্যাতন
অকালে অস্থানে মরে চোরের মতন,
কেহ বা ধর্ম্মের ব্রত করিয়া নিস্ফল
বাঁচিবে সম্মানে সুখে, এ ধরণীতল
হেন বিপরীত ধর্ম্ম এক বক্ষে বহে—
এত বড় এত দৃঢ় কভু নহে নহে।

১২৯
5-9

সুপ্রিয়


(মালিনীর প্রতি ফিরিয়া)


হে দেবি, তােমারি জয়! নিজ পদ্মকরে
যে পবিত্র শিখা তুমি আমার অন্তরে
জ্বালায়েছ-আজি হ’ল পরীক্ষা তাহার-
তুমি হ'লে জয়ী। সর্ব্ব অপমানভার
সকল নিষ্ঠুরঘাত করিনু গ্রহণ।
রক্ত উচ্ছ্বসিয়া উঠে উৎসের মতন
বিদীর্ণ হৃদয় হতে,—তবু সমুজ্জ্বল
তব শান্তি, তব প্রীতি, তব সুমঙ্গল
অম্লান অচল দীপ্তি করিছে বিরাজ
সর্ব্বোপরি। ভক্তের পরীক্ষা হ’ল আজ,
জয় দেবি।—ক্ষেমঙ্কর, তুমি দিবে প্রাণ,—
আমার ধর্ম্মের লাগি করিয়াছি দান
প্রাণের অধিক প্রিয় তােমার প্রণয়,
তােমার বিশ্বাস। তা'র কাছে প্রাণভয়
তুচ্ছ শতবার।

ক্ষেমঙ্কর


   ছাড় এ প্রলাপ বাণী।
মৃত্যু যিনি তাঁহারেই ধর্ম্মরাজ জানি,—
ধর্ম্মের পরীক্ষা তাঁরি কাছে। বন্ধুবর,
এস তবে কাছে, এস ধর মাের কর,

চল মােরা যাই সেথা দোঁহে এক সনে,—
যেমন সে বাল্যকালে—সে কি পড়ে মনে-
কত দিন সারারাত্রি তর্ক করি', শেষে
প্রভাতে যেতেম দোঁহে গুরুর উদ্দেশে
কে সত্য কে মিথ্যা তাহা করিতে নির্ণয়।
তেমনি প্রভাত হােক! সকল সংশয়
আজিকে লইয়া চলি অসংশয় ধামে,
দাঁড়াই মৃত্যুর পাশে দক্ষিণে ও বামে
দুই সখা, ল’য়ে দুজনের প্রশ্ন যত।
সেথায় প্রত্যক্ষ সত্য উজ্জ্বল উন্নত;—
মূহূর্ত্তে পর্ব্বতপ্রায় বিচার বিরােধ
বাষ্পসম কোথা যা'বে! দুইটি অবােধ
আনন্দে হাসিব চাহি দোঁহে দোঁহাকারে।
সব চেয়ে বড় আজি মনে কর যারে
তাহারে রাখিয়া দেখ মৃত্যুর সম্মুখে।

সুপ্রিয়


বন্ধু, তাই হােক।

ক্ষেমঙ্কর


   এস তবে, এস বুকে।
বহুদূরে গিয়েছিলে এস কাছে তবে
যেথায় অনন্তকাল বিচ্ছেদ না হ'বে।

লই তবে বন্ধুহস্তে করুণ বিচার-
এই লহ।

(শৃঙ্খল দ্বারা সুপ্রিয়ের মস্তকে আঘাত ও তাহার পতন )


সুপ্রিয়


  দেবী, তব জয়।  (মৃত্যু)

ক্ষেমাঙ্কর


(মৃতদেহের উপর পড়িয়া)  এইবার
ডাক, ডাক ঘাতকেরে।

রাজা


(সিংহাসন ছাড়িয়া)  কে আছিস্ ওরে!
আন্ খড়গ।

মালিনী


   মহারাজ ক্ষম ক্ষেমঙ্করে।

( মূর্চ্ছিতা )