কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/ছবি ও গান/নিশীথ-চেতনা



নিশীথ-চেতনা


স্তব্ধ বাদুড়ের মত জড়ায়ে অযুত শাখা
দলে দলে অন্ধকার ঘুমায় মুদিয়া পাখা।
মাঝে মাঝে পা টিপিয়া বহিছে নিশীথ-বায়
গাছে নড়ে ওঠে পাতা, শব্দটুকু শোনা যায়।

আকাশের পানে চেয়ে জাগিয়া রয়েছি বসি,
মাঝে মাঝে দুয়েকটি তারা পড়িতেছে খসি;
ঘুমাইছে পশুপাখী বসুন্ধর অচেতনা,
শুধু এবে দলে দলে আঁধারের তলে তলে
আকাশ করিয়া পূর্ণ স্বপ্ন করে আনাগোনা।

স্বপ্ন করে আনাগোনা! কোথা দিয়ে আসে যায়!
আঁধার আকাশ মাঝে আঁখি চারিদিকে চায়।
মনে হয় আসিতেছে ছায়াময়ী নিশাচরী
আকাশের পার হতে, আঁধার ফেলিছে ভরি।
চারিদিকে ভাসিতেছে চারিদিকে হাসিতেছে
এ উহারে ডাকিতেছে আকাশের পানে চেয়ে,
বলিতেছে, “আয় বোন, আয় তোরা আয় ধেয়ে।”
হাতে হাতে ধরি ধরি, নাচে যত সহচরী,
চমকি ছুটিয়া যায় চপলা মায়ার মেয়ে।



যেন মোর কাছ দিয়ে এই তা’রা গেল চলে,
কেহবা মাথায় মোর, কেহবা আমার কোলে।
কেহবা মারিছে উকি হৃদয় মাঝারে পশি,
আঁখির পাতার 'পরে কেহবা দুলিছে বসি।
মাথার উপর দিয়া কেহবা উড়িয়া যায়,
নয়নের পানে মোর কেহবা ফিরিয়া চায়।
এখনি শুনিব যেন অতি মৃত্যু পদধ্বনি,
ছোট ছোট নূপুরের অতি মৃদু রণরণি।
রয়েছি চকিত হয়ে আঁখির নিমেষ ভুলি—
এখনি দেখিব যেন স্বপ্নমুখী ছায়াগুলি।

অয়ি স্বপ্ন মোহময়ী, দেখা দাও একবার।
কোথা দিয়ে আসিতেছ, কোথা দিয়ে চলিতেছ,
কোথা গিয়ে পশিতেছ বড় সাধ দেখিবার।
আঁধার পরাণে পশি সারারাত করি খেলা
কোন্ খানে কোন্ দেশে পালাও সকাল বেলা।
অরুণের মুখ দেখে কেন এত হয় লাজ—
সারাদিন কোথা বসে না জানি কি কর কাজ।
ঘুমঘুম্ আঁখি মেলি তোমরা স্বপন-বালা,
নন্দনের ছায়ে বসি শুধু বুঝি গাথঁ মালা।
শুধু বুঝি গুন্ গুন্ গুন্ গুন্ গান কর,—
আপনার গান শুনে আপনি ঘুমায়ে পড়।




আজি এই রজনীতে অচেতন চারিধার।
এই আবরণ ঘোর ভেদ করি মন মোর
স্বপনের রাজ্যমাঝে দাঁড়া দেখি একবার।
নিদ্রার সাগর-জলে মহা আঁধারের তলে,
চারিদিকে প্রসারিত এ কি এ নূতন দেশ,
একত্রে স্বরগ মর্ত্য নাহিক দিকের শেষ।
কি যে যায় কি যে আসে, চারিদিকে আশেপাশে;
কেহ কাঁদে কেহ হাসে, কেহ থাকে কেহ যায়,
মিশিতেছে, ফুটিতেছে, গড়িতেছে, টুটিতেছে,
অবিশ্রাম লুকোচুরি—আঁখি না সন্ধান পায়।
কত আলো কত ছায়া, কত আশা কত মায়া,
কত ভয়, কত শোক, কত কি যে কোলাহল,
কত পশু কত পার্থী কত মানুষের দল।

উপরেতে চেয়ে দেখ কি প্রশান্ত বিভাবরী,
নিশ্বাস পড়ে না যেন জগৎ রয়েছে মরি!
একবার কর মনে আঁধারের সঙ্গোপনে
কি গভীর কলরব—চেতনার ছেলেখেলা—
সমস্ত জগৎ ব্যেপে স্বপনের মহা-মেলা।
মনে মনে ভাবি তাই এও কি নহেরে ভাই
চৌদিকে যা' কিছু দেখি জাগিয়া সকালবেলা
এও কি নহেরে শুধু চেতনার ছেলেখেলা।




আমি যদি হইতাম স্বপন বাসনা-ময়।
কত বেশ ধরিতাম কত দেশ ভ্রমিতাম,
বেড়াতেম সাতারিয়া ঘুমের সাগরময়।
নীরব চন্দ্রমা তারা, নীরব আকাশ ধরা,
আমি শুধু চুপি চুপি ভ্রমিতাম বিশ্বময়।
প্রাণে প্রাণে রচিতাম কত আশা কত ভয়।
এমন করুণ কথা প্রাণে আসিতাম কয়ে
প্রভাতে পূরবে চাহি ভাবিত তাহাই লয়ে।
ওরে স্বপ্ন, আমি যদি স্বপন হতেম হায়,
যাইতাম তার প্রাণে, যে মোরে ফিরে না চায়।
প্রাণে তার ভ্রমিতাম, প্রাণে তার গাহিতাম,
প্রাণে তার খেলাতেম আবিরাম নিশিনিশি।
যেমনি প্রভাত হত আলোকে যেতাম মিশি।
দিবসে আমার কাছে কভু সে খোলে না প্রাণ,
শোনে না আমার কথা, বোঝে না আমার গান,
মায়ামন্ত্রে প্রাণ তার গোপনে দিতাম খুলি,
বুঝায়ে দিতাম তারে এই মোর গানগুলি।
পরদিন দিবসেতে যাইতাম কাছে তার,
তাহলে কি মুখপানে চাহিত না একবার?