কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/ছবি ও গান/নিশীথ জগৎ
নিশীথ জগৎ
জন্মেছি নিশীথে আমি, তারার আলোকে
রয়েছি বসিয়া,
চারিদিকে নিশীথিনী মাঝে মাঝে হুহু করি
উঠিছে শ্বসিয়া।
পশ্চিমে করেছে মেঘ, নিবিড় মেঘের প্রান্তে
স্ফুরিছে দামিনী,
দুঃস্বপ্ন ভাঙিয়া যেন শিহরি মেলিছে আঁখি
চকিত যামিনী।
আঁধারে অরণ্যভূমি নয়ন মুদিয়া
করিতেছে ধ্যান,
অসীম আঁধার নিশা আপনার পানে চেয়ে
হারায়েছে জ্ঞান।
মাথার উপর দিয়া উড়িছে বাদুড়
কাঁদিছে পেচক,
একেলা রয়েছি বসি, চেয়ে শূন্যপানে,
না পড়ে পলক।
আঁধারের প্রাণী যত ভূমিতলে হাত দিয়া
ঘুরিয়া বেড়ায়,
চোখে উড়ে পড়ে ধূলা কোনখানে কি যে আছে
দেখিতে না পায়।
চরণে বাধিছে বাধা, পাষাণে বাজিছে মাথা,
কাঁদিছে বসিয়া,
অগ্নি-হাসি উপহাসি উল্কা-অভিশাপ-শিখা
পড়িছে খসিয়া।
তাদের মাথার'পরে সীমাহীন অন্ধকার
স্তব্ধ গগনেতে,
আঁধারের ভারে যেন নুইয়া পড়িছে মাথা
মাটির পানেতে।
নড়িলে গাছের পাতা চকিতে চমকি উঠে,
চায় চারিধারে,
ঘোর আঁধারের মাঝে কোথা কি লুকায়ে আছে
কে বলিতে পারে।
গহন বনের মাঝে চলিয়াছে শিশু
মা’র হাত ধরে,
মুহূর্ত্ত ছেড়েছে হাত,পড়েছে পিছায়ে
খেলাবার তরে,
অমনি হারায়ে পথ কেঁদে ওঠে শিশু
ডাকে মা-মা-বলে,
“আয় মা, আয় মা, ওরে কোথা চলে গেলি,
মোরে নে মা কোলে।”
মা আমনি চমকিয়া “বাছা বাছা” বলে ছোটে,
দেখিতে না পায়,
শুধু সেই অন্ধকারে মা মা ধ্বনি পশে কানে
চারিদিকে চায়।
সহসা সমুখ দিয়া কে গেল ছায়ার মত,
লাগিল তরাস,
কে জানে সহসা যেন কোথা কোন দিক হতে
শুনি দীর্ঘশ্বাস!
কে বসে রয়েছে পাশে? কে ছুঁইল দেহ মোর
হিম-হস্তে তার?
ওকি ও? একিরে শুনি! কোথা হতে উঠিলরে
ঘোর হাহাকার?
ওকি হোথা দেখা যায়— ওই দূরে—অতি দূরে
ও কিসের আলো?
ওকি ও উড়িছে শূন্যে? দীর্ঘ নিশাচর পাখী?
মেঘ কালো কালো?
এই আঁধারের মাঝে কত না অদৃশ্য প্রাণী
কাঁদিছে বসিয়া
নীরবে টুটিছে প্রাণ, চাহিছে তারার পানে
অরণ্যে পশিয়া।
কেহ বা রয়েছে শুয়ে দগ্ধ হৃদয়ের 'পরে
স্মৃতিরে জড়ায়ে।
কেহ না দেখিছে তারে, অন্ধকারে অশ্রুধারা,
পড়িছে গড়ায়ে।
কেহ বা শুনিছে সাড়া, উৰ্দ্ধকণ্ঠে নাম ধরে
ডাকিছে মরণে,
পশিয়া হৃদয়মাঝে আশার অঙ্কুরগুলি
দলিছে চরণে।
ওদিকে আকাশ পরে মাঝে মাঝে থেকে থেকে
উঠে অট্টহাস,
ঘন ঘন করতালি, উনমাদ কণ্ঠস্বরে
কাঁপিছে আকাশ।
জালিয়া মশাল-আলো নাচিছে গাইছে তারা—
ক্ষণিক উল্লাস,
নিশীথ মুহূর্ত্ত তরে হাসে যথা প্রাণপণে
আলেয়ার হাস।
অরণ্যের প্রান্তভাগে নদী এক চলিয়াছে
বাঁকিয়া বাঁকিয়া,
স্তব্ধ জল, শব্দ নাই, ফণী সম ফুঁসি উঠে
থাকিয়া থাকিয়া।
আঁধারে চলিতে পান্থ দেখিতে না পায় কিছু
জলে গিয়া পড়ে,
মুহূর্ত্তের হাহাকার, মুহূর্ত্তে ভাসিয়া যায়
খর-স্রোত-ভরে।
সখা তার তীরে বসি একেলা কাঁদিতে থাকে,
ডাকে উর্দ্ধশ্বাসে,
কাহারো না পেয়ে সাড়া শূন্যপ্রাণ প্রতিধ্বনি
কেঁদে ফিরে আসে।
নিশীথের কারাগারে কে বেঁধে রেখেছে মোরে
রয়েছি পড়িয়া,
কেবল রয়েছি বেঁচে স্বপন কুড়ায়ে লয়ে
ভাঙিয়া গড়িয়া।
আঁধারে নিজের পানে চেয়ে দেখি, ভাল করে
দেখিতে না পাই
হৃদয়ে অজানা দেশে পাখী গায় ফুল ফোটে
পথ জানি নাই।
অন্ধকারে আপনারে দেখিতে না পাই যত
তত ভালবাসি,
তত তারে বুকে করে বাহুতে বাঁধিয়া লয়ে
হরষেতে ভাসি।
তত যেন মনে হয় পাছেরে চলিতে পথে
তৃণ ফুটে পায়,
যতনের ধন পাছে চমকি কাঁদিয়া ওঠে
কুহুমের ঘায়।
সদা হয় অবিশ্বাস কারেও চিনি না হেথা,
সবি অনুমান,
ভালবেসে কাছে গেলে দূরে চলে যায় সবে,
ভয়ে কাপে প্রাণ।
গোপনেতে অশ্রু ফেলে, মুছে ফেলে, পাছে কেহ
দেখিবারে পায়,
মরমের দীর্ঘশ্বাস মরমে রুধিয়া রাখে
পাছে শোনা যায়।
সখারে কাঁদিয়া বলে “বড় সাধ যায় সখা,
দেখি ভাল করে,
তুই শৈশবের বঁধু চিরজন্ম কেটে গেল
দেখিলু না তোরে।
বুঝি তুমি দূরে আছ, একবার কাছে এসে
দেখাও তোমায়।”
সে অমনি কেঁদে বলে “আপনারে দেখি নাই
কি দেখাব হায়।”
অন্ধকার ভাগ করি আঁধারের রাজ্য লয়ে
চলিছে বিবাদ,
সখারে বধিছে সখা সন্তানে হানিছে পিতা,
ঘোর পরমাদ।
মৃত দেহ পড়ে থাকে, শকুনী বিবাদ করে
কাছে ঘুরে ঘুরে,
মাংস লয়ে টানাটানি করিতেছে হানাহানি
শৃগালে কুকুরে।
অন্ধকার ভেদ করি অহরহ শুনা যায়
আকুল বিলাপ,
আহতের আর্তস্বর, হিংসার উল্লাস ধ্বনি,
ঘোর অভিশাপ।
মাঝে মাঝে থেকে থেকে কোথা হতে ভেসে আসে
ফুলের সুবাস,
প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে, অশ্রুজলে ভাসে আঁখি
উঠেরে নিশ্বাস।
চারিদিক ভুলে যাই, প্রাণে যেন জেগে ওঠে
স্বপন আবেশ,—
কোথারে ফুটেছে ফুল, আঁধারের কোন্ তীরে
কোথা কোন্ দেশ।