কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/ছবি ও গান/মধ্যাহ্নে

মধ্যাহ্নে

হের ওই বাড়িতেছে বেলা,
বসে আমি রয়েছি একেলা।

ওই হোথা যায় দেখা, সুদূর বনের রেখা
মিশেছে আকাশ নীলিমায়।
দিক্ হতে দিগন্তরে মাঠ শুধু ধূধূ করে,
বায়ু কোথা বহে চলে যায়।
সুদূর মাঠের পারে গ্রামখানি একধারে
গাছ দিয়ে ছায়া দিয়ে ঘেরা,
কাননের গায়ে যেন ছায়াখানি বুলাইয়া
ভেসে চলে কোথায় মেঘেরা!
মধুর উদাস প্রাণে চাই চারিদিক্‌ পানে,
স্তব্ধ সব ছবির মতন,
সব যেন চারিধারে অবশ আলস ভারে
স্বর্ণময় মায়ায় মগন।
গ্রামখানি, মাঠখানি, উঁচুনীচু পথখানি,
দুয়েকটি গাছ মাঝে মাঝে,




আকাশ-সমুদ্রে-ঘেরা সুবর্ণ দ্বীপের পারা
কোথা যেন সুদূরে বিরাজে।
কনক-লাবণ্য লয়ে যেন অভিভূত হয়ে
আপনাতে আপনি ঘুমায়,
নিঝুম পাদপ লতা, শ্রান্তকায় নীরবতা
শুয়ে আছে গাছের ছায়ায়।
শুধু অতি মৃদুস্বরে গুন্‌ গুন্‌ গান করে
যেন সব ঘুমন্ত ভ্রমর,
যেন মধু খেতে খেতে ঘুমিয়েছে কুসুমেতে
মরিয়া এসেছে কণ্ঠস্বর।
নীল শূন্যে ছবি আঁকা  রবির কিরণ মাখা,
সেথা যেন বাস করিতেছি,
জীবনের আধখানি যেন ভুলে গেছি আমি
কোথা যেন ফেলিয়ে এসেছি।
আনমনে ধীরি ধীরি বেড়াতেছি ফিরি ফিরি
ঘুমঘোর ছায়ায় ছায়ায়,
কোথা যাব কোথা যাই সে কথা যে মনে নাই,
ভুলে আছি মধুর মায়ায়।
মধুর বাতাসে আজি যেনরে উঠিছে বাজি
পরাণের ঘুমন্ত বীণাটি,
ভালবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখী যেন
বসিয়া গাহিছে একেলাটি,।




কে জানে কাহারে চায়, প্রাণ যেন উভরায়
ডাকে কারে “এস এস” বলে,
কাছে কারে পেতে চায়, সব তারে দিতে চায়,
মাথাটি রাখিতে চায় কোলে।
স্তব্ধ তরুতলে গিয়া, পা-দুখানি ছড়াইয়া
নিমগন মধুময় মোহে,
আনমনে গান গেয়ে দূর শূন্যপানে চেয়ে
ঘুমায়ে পড়িতে চায় দোঁহে।
দূর মরীচিকাসম ওই বন উপবন,
ওরি মাঝে পরাণ উদাসী,
বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে,
নাম ধরে বাজাইছে বাঁশি।
সে যেন কোথায় আছে, সুদূর বনের পাছে,
কত নদী সমুদ্রের পারে,
নিভৃত নির্ঝরতীরে লতায় পাতায় ঘিরে
বসে আছে নিকুঞ্জ-আঁধারে।
সাধ যায় বাঁশি করে বন হতে বনান্তরে
চলে যাই আপনার মনে,
কুসুমিত নদীতীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে
কে জানে কাহার অন্বেষণে।
সহসা দেখিব তারে, নিমেষেই একেবারে
প্রাণেপ্রাণে হইবে মিলন,


এই মরীচিকা দেশে দুজনে বাসর-বেশে
ছায়ারাজ্যে করিব ভ্রমণ।
বাঁধিবে সে বাহুপাশে চোখে তার স্বপ্ন ভাসে
মুখে তার হাসির মুকুল,
কে জানে বুকের কাছে আঁচল আছে না আছে
পিঠেতে পড়েছে এলোচুল।
মুখে আধখানি কথা চোখে আধখানি কথা
আধখানি হাসিতে জড়ানো,
দুজনেতে চলে যাই কে জানে কোথায় চাই
পদতলে কুসুম ছড়ানো।

বুঝিরে এমনি বেলা ছায়ায় করিত খেলা
তপোবনে ঋষি-বালিকারা,
পরিয়া বাকল-বাস, মুখেতে বিমল হাস
বনে বনে বেড়াইত তারা।
হরিণ-শিশুরা এসে কাছেতে বসিত ঘেঁসে
মালিনী বহিত পদতলে,
দু-চারি সখীতে মেলি কথা কয় হাসি খেলি
তরুতলে বসি কুতুহলে।

ওই দূর বনছায়া ও যে কি জানেরে মায়া,
ও যেনরে রেখেছে লুকায়ে,




সেই স্নিগ্ধ তপোবন চিরফুল্ল তরুগণ,
হরিণশাবক তরু-ছায়ে।
হোথায় মালিনী নদী বহে যেন নিরবধি,
ঋষিকন্যা কুটীরের মাঝে,
কতু বসি তরুতলে স্নেহে তারে ভাই বলে,
ফুলটি ঝরিলে ব্যথা বাজে।
কত ছবি মনে আসে, পরাণের আশেপাশে
কল্পনা কত যে করে খেলা,
বাতাস লাগায়ে গায়ে  বসিয়া তরুর ছায়ে
কেমনে কাটিয়া যায় বেলা।