কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/আহ্বান সঙ্গীত

আহ্বান-সঙ্গীত



ওরে তুই জগৎ-ফুলের কীট,
জগৎ যে তোর শুকায়ে আসিল,
মাটিতে পড়িল খসে,
সারা দিন রাত গুমরি গুমরি
কেবলি আছিস্‌ বসে।
মড়কের কণা, নিজ হাতে তুই
রচিলি নিজের কারা,
আপনার জালে জড়ায়ে পড়িয়া
আপনি হইলি হারা।
অবশেষে কারে অভিশাপ দিস্‌
হা-হুতাশ করে সারা,
কোণে বসে শুধু ফেলিস্‌ নিশাস,
ঢালিস্‌ বিষের ধারা।

জগৎ যে তোর মুদিয়া আসিল,
ফুটিতে নারিল আর,
প্রভাত হইলে প্রাণের মাঝারে
ঝরে না শিশিরধার।
জড়িত কুঞ্চিত বলিত হৃদয়ে
পশে না রবির কর,
নয়নে তাহার আলোক সহে না
জোছনা দেখিলে ডর।
কালো কীট ওরে শুধু তোরে নিয়ে
মরণ পুষিছে প্রাণে,
অশ্রুকণা তোর জ্বলিছে তাহার
মরমের মাঝখানে।
ফেলিস্‌ নিশাস, মরুর বাতাস,
জ্বলিস্‌ জ্বালাস্‌ কত,
আপন জগতে আপনি আছিস
একটি রোগের মত।
হৃদয়ের ভার বহিতে পারে না,
আছে মাথা নত করে,
ফুটিবে না ফুল, ফলিবে না ফল,
শুকায়ে পড়িবে মরে।
তুই শুধু সদা কাঁদিতে থাকিবি
মৃত জগতের মাঝে,

আঁধারের কোণে ঘুরিয়া বেড়াবি
কি জানি কিসের কাজে!
আঁধার লইয়া হুতাশ লইয়া
আপনে আপনি মিশে,
জরজর হয়ে মরিয়া রহিবি
নিজের নিশাস-বিষে।
বাহিরে গাহিবে মরণের গান
শুকানো পল্লবগুলি,
জগতের সাথে ভূতলে পড়িয়া
ধূলিতে হইবি ধূলি।


রোদন, রোদন, কেবলি রোদন,
কেবলি বিষাদ-শ্বাস,
লুকায়ে, শুকায়ে, শরীর গুটায়ে
কেবলি কোটরে বাস!
মাথা অবনত, আঁখি জ্যোতিহীন,
শরীর পড়েছে নুয়ে,
জীর্ণ শীর্ণ তনু ধূলিতে মাখানো
অলস পড়িয়া ভূঁয়ে।
নাই কোনো কাজ—মাঝে মাঝে চাস্
মলিন আপনা পানে,

আপনার স্নেহে কাতর বচন
কহিস্ আপন কানে।
দিবসরজনী মরীচিকা-সুরা
কেবলি করিস্ পান;
বাড়িতেছে তৃষা—বিকারের তৃষা
ছটফট করে প্রাণ।
দাও দাও বলে সকলি যে চাস্,
জঠর জ্বলিছে ভুখে,
মুঠি মুঠি ধূলা তুলিয়া লইয়া
কেবলি পূরিস্ মুখে।
নিজের নিশাসে কুয়াশা ঘনায়ে
ঢেকেছে নিজের কায়া,
পথ আঁধারিয়া পড়েছে সমুখে
নিজের দেহের ছায়া।
ছায়ার মাঝারে দেখিতে না পাও,
শব্দ শুনিলে ডরো—
বাহু পসারিয়া চলিতে চলিতে
নিজেরে আঁকড়ি ধরো।
মুখেতে রেখেছ আঁধার গুঁজিয়া,
নয়নে জ্বলিছে রিষ,
সাপের মতন কুটিল হাসিটি,
দশনে তাহার বিষ।

চারিদিকে শুধু ক্ষুধা ছড়াইছে
যে দিকে পড়িছে দিঠ,
বিষেতে ভরিলি জগৎ, রে তুই
কীটের অধম কীট।
আজিকে বারেক ভ্রমরের মত
বাহির হইয়া আয়,
এমন প্রভাতে এমন কুসুম
কেনরে শুকায়ে যায়।
বাহিরে আসিয়া উপরে বসিয়া
কেবলি গাহিবি গান,
তবে সে কুসুম কহিবে কথা,
তবে সে খুলিবে প্রাণ।

অতি ধীরে ধীরে ফুটিবে দল,
বিকশিত হয়ে উঠিবে হাস,
অতি ধীরে ধীরে উঠিবে আকাশে
লঘু পাখা মেলি খেলিবে বাতাসে
হৃদয়-খুলানো, আপনা-ভুলানো,
পরাণ-মাতানো বাস।
পাগল হইয়া মাতাল হইয়া
কেবলি ধরিবি রহিয়া রহিয়া
গুন্ গুন্ গুন্ তান।

প্রভাতে গাহিবি, প্রদোষে গাহিবি,
নিশীথে গাহিবি গান।

দেখিয়া ফুলের নগন মাধুরী,
কাছে কাছে শুধু বেড়াইবি ঘুরি,
দিবানিশি শুধু গাহিবি গান।
থরথর করি কাঁপিবে পাখা
কোমল কুসুম-রেণুতে মাখা,
আবেগের ভরে দুলিয়া দুলিয়া
থরথর করি কাঁপিবে প্রাণ।
কেবলি উড়িবি, কেবলি বসিবি
কভু বা মরম-মাঝারে পশিবি,
আকুল নয়নে কেবলি চাহিবি
কেবলি গাহিবি গান।
অমৃত-স্বপন দেখিবি কেবল
করিবিরে মধুপান।
আকাশে হাসিবে তরুণ তপন,
কাননে ছুটিবে বায়,
চারিদিকে তোর প্রাণের লহরী
উথলি উথলি যায়।
বায়ুর হিল্লোলে ধরিবে পল্লব
মরমর মৃদু তান,

চারিদিক হতে কিসের উল্লাসে
পাখীতে গাহিবে গান।
নদীতে উঠিবে শত শত ঢেউ,
গাবে তারা কলকল,
আকাশে আকাশে উথলিবে শুধু
হরষের কোলাহল।
কোথাও বা হাসি, কোথাও বা খেলা,
কোথাও বা সুখগান,
মাঝে বসে তুই বিভোর হইয়া,
আকুল পরাণে নয়ান মুদিয়।
অচেতন সুখে চেতনা হারায়ে
করিবিরে মধুপান।
ভুলে যাবি ওরে আপনারে তুই
ভুলে যাবি তোর গান।
মোহ লাগিবেরে নয়নেতে তোর,
যে দিকে চাহিবি হয়ে যাবি ভোর,
যাহারে হেরিবি, তাহারে হেরিয়া
মজিয়া রহিবে প্রাণ।
ঘুমের ঘোরেতে গাহিবে পাখী
এখনো যে পাখী জাগেনি,
মহান্ আকাশ ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া
উঠিবে বিভাস রাগিণী।

জগত-অতীত আকাশ হইতে
বাজিয়া উঠিবে বাঁশি,
প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া
কোথায় যাইবে ভাসি।
উদাসিনী আশা গৃহ তেয়াগিয়া
অসীম পথের পথিক হইয়।
সুদূর হইতে সুদূরে উঠিয়।
আকুল হইয়া চায়,
যেমন, বিভোর চকোরের গান
ভেদিয়া ভেদিয়া সুদূর বিমান
চাঁদের চরণে মরিতে গিয়া
মেঘেতে হারায়ে যায়।
মুদিত নয়ান, পরাণ বিভল,
স্তবধ হইয়া শুনিবি কেবল
জগতেরে সদা ডুবায়ে দিতেছে
জগত-অতীত গান;
তাই শুনি যেন জাগিতে চাহিছে
ঘুমেতে মগন প্রাণ।
জগৎ-বাহিরে যমুনা-পুলিনে
কে যেন বাজায় বাঁশি,
স্বপন-সমান পশিতেছে কানে
ভেদিয়া নিশীথরাশি;


উদাস জগৎ যেতে চায় সেথা
দেখিতে পেয়েছে পথ,
দিবসরজনী চলেছেরে তাই
পূরাইতে মনোরথ।
এ গান শুনিনি এ আলো দেখিনি,
এ মধু করিনি পান,
এমন বাতাস পরাণ পূরিয়া
করেনিরে সুধা দান,
এমন প্রভাত-কিরণ-মাঝারে
কখনো করিনি স্নান,
বিফলে জগতে লভিনু জনম,
বিফলে কাটিল প্রাণ।
দেখ্‌রে সবাই চলেছে বাহিরে
সবাই চলিয়া যায়,
পথিকেরা সবে হাতে হাতে ধরি
শোন্‌রে কি গান গায়।
জগৎ ব্যাপিয়া, শোন্‌রে, সবাই
ডাকিতেছে, আয় আয়,
কেহবা আগেতে কেহবা পিছায়ে,
কেহ ডাক শুনে ধায়।
অসীম আকাশে, স্বাধীন পরাণে
প্রাণের আবেগে ছোটে,

এ শোভা দেখিলে জড়ের শরীরে
পরাণ নাচিয়া ওঠে।
তুই শুধু ওরে ভিতরে বসিয়া
গুমরি মরিতে চাস্‌।
তুই শুধু ওরে করিস রোদন
ফেলিস্ দুখের শ্বাস!
ভূমিতে পড়িয়া, আঁধারে বসিয়া
আপনা লইয়া রত,
আপনারে সদা কোলেতে তুলিয়া
সোহাগ করিস্‌ কত!
আর কত দিন কাটিবে এমন
সময় যে চলে যায়।
ওই শোন্‌ ওই ডাকিছে সবাই
বাহির হইয়া আয়!