কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/অনুগ্রহ
অনুগ্রহ
এই যে জগৎ হেরি আমি,
মহাশক্তি জগতের স্বামী,
একি হে তোমার অনুগ্রহ?
হে বিধাতা কহ মোরে কহ।
ওই যে সম্মুখে সিন্ধু, এ কি অনুগ্রহ-বিন্দু?
ওই যে আকাশে শোভে চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তব অনুগ্রহ!
ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র এক জন,
আমারে যে করেছ সৃজন,
একি শুধু অনুগ্রহ করে'
ঋণ-পাশে বাঁধিবারে মোরে?
কটাক্ষে করিয়া অবহেলা,
হেসে ক্ষমতার হাসি, অসীম ক্ষমতা হতে
ব্যয় করিয়াছ এক রতি—
অনুগ্রহ করে' মোর প্রতি?
শুভ্র শুভ্র যুঁই দুটি ওই যে রয়েছে ফুটি
ওকি তব অতি শুভ্র ভালবাসা নয়?
বল মোরে, মহাশক্তিময়,
ওই যে জোছনাহাসি, ওই যে তারকারাশি,
আকাশে হাসিয়া ফুটে রয়,
ওকি তব ভালবাসা নয়?
ওকি তব অনুগ্রহ-হাসি
কঠোর পাষাণ-লৌহময়?
তবে হে হৃদয়হীন দেব,
জগতের রাজ-অধিরাজ,
হান তব হাসিময় বাজ,
মহা অনুগ্রহ হ’তে তব
মুছে তুমি ফেলহ আমারে—
চাহিনী থাকিতে এ সংসারে।
কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়,
ভালবাসি আপন ভুলিয়া,
গান গাহি হৃদয় খুলিয়া,
ভক্তি করি পৃথিবীর মত,
স্নেহ করি আকাশের প্রায়।
আপনারে দিয়েছি ফেলিয়া,
আপনারে গিয়েছি ভুলিয়া,
যারে ভালবাসি তার কাছে
প্রাণ শুধু ভালবাসা চায়।
সাক্ষীআছ তুমি অন্তর্যামী
কতখানি ভালবাসি আমি,
দেখি যবে তার মুখ, হৃদয়ে দারুণ সুখ
ভেঙে ফেলে হৃদয়ের দ্বার—
বলে “এ কি ঘোর কারাগার!”—
প্রাণ বলে “পারিনে সহিতে,
এ দুরন্ত সুখেরে বহিতে!”
আকাশে হেরিলে শশী আনন্দে উথলি উঠি
দেয় যথা মহা পারাবার
অসীম আনন্দ উপহার,
তেমনি সমুদ্র-ভরা আনন্দ তাহারে দিই
হৃদয় যাহারে ভালবাসে,
হৃদয়ের প্রতি ঢেউ উথলি গাহিয়া উঠে
আকাশ পূরিয়া গীতোচ্ছ্বাসে।
ভেঙে ফেলি উপকূল পৃথিবী ডুবাতে চাহে
আকাশে উঠিতে চায় প্রাণ,
আপনারে ভুলে গিয়ে হৃদয় হইতে চাহে
একটি জগতব্যাপী গান!
তাহারে কবির আশ্রুহাসি
দিয়েছি কত না রাশি রাশি,
তাহারি কিরণে ফুটিতেছে
হৃদয়ের আশা ও ভরসা,
তাহারি হাসি ও অশ্রুজল
এ প্রাণের বসন্ত বরষা।
ভালবাসি, আর গান গাই
কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়,
রাত্রি এত ভাল নাহি বাসে,
ঊষা এত গান নাহি গায়।
তাই দিয়ে কি নিয়েছি আমি,
গান গেয়ে কি পাইনু, স্বামী?
আগ্নের-পর্বত-ভরা ব্যথা,
আর দুটি অনুগ্রহ-কথা?
ভালবাসা স্বাধীন মহান্,
ভালবাসা পর্বত সমান।
ভিক্ষাবৃত্তি করে না তপন
পৃথিবীরে চাহে সে যখন;
সে চাহে উজ্জ্বল করিবারে,
সে চাহে উর্বর করিবারে;
জীবন করিতে প্রবাহিত,
কুসুম করিতে বিকশিত।
চাহে সে বাসিতে শুধু ভালো,
চাহে সে করিতে শুধু আলো।
অনুগ্রহ বিলাসী গর্বিত,
অনুগ্রহ দয়ালু-কৃপণ—
অনুগ্রহ অশ্রুবিন্দু দেয়
শুষ্ক আঁখি করিয়া মন্থন।
নীচ হীন দীন অনুগ্রহ
কাছে যবে আসিবারে চায়,
প্রণয় বিলাপ করি উঠে—
গীত গান ঘৃণায় পলায়।
হে দেবতা, অনুগ্রহ হতে
রক্ষা কর অভাগা কবিরে,
অপযশ, অপমান দাও
দুঃখ জ্বালা বহিব এ শিরে।
সম্পদের স্বর্ণ-কারাগারে,
গরবের অন্ধকার মাঝ—
অনুগ্রহ রাজার মতন
চিরকাল করুক্ বিরাজ!
সোনার শৃঙ্খল ঝঙ্কারিয়া,—
গরবের স্ফীত দেহ লয়ে—
অনুগ্রহ আসেনাক’ যেন
আমাদের স্বাধীন আলয়ে।
গান আসে বলে’ গান গাই,
ভালবাসি বলে’ ভালবাসি,
কেহ যেন মনে নাহি করে
মোরা কারো কৃপার প্রয়াসী।
না হয় শুনো না মোর গান,
ভালবাসা ঢাকা রবে মনে;
অনুগ্রহ করে এই কোরো
অনুগ্রহ কোরো না এজনে।