কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/আমি-হারা

আমি-হারা

হায় হায়!
জীবনের তরুণ বেলায়,
কে ছিলরে হৃদয় মাঝারে,
দুলিতরে অরুণ-দোলায়?
হাসি তার ললাটে ফুটিত,
হাসি তার ভাসিত নয়নে,
হাসি তার ঘুমায়ে পড়িত
সুকোমল অধর-শয়নে।

ঘুমাইলে, নন্দন-বালিকা
গেঁথে দিত স্বপন-মালিকা,
জাগরণে, নয়নে তাহার
ছায়াময় স্বপন জাগিত;
আশা তার পাখা প্রসারিয়া
উড়ে যেত উধাও হইয়া,
চাদের পায়ের কাছে গিয়ে
জ্যোৎস্নাময় অমৃত মাগিত।

বনে সে তুলিত শুধু ফুল,
শিশির করিত শুধু পান,
প্রভাতের পাখীটির মত
হরষে করিত শুধু গান।
কে গো সেই, কে গো হায় হায়,
জীবনের তরুণ বেলায়
খেলাইত হৃদয়মাঝারে
দুলিতরে অরুণ-দোলায়?
সচেতন অরুণ-কিরণ
কে সে প্রাণে এসেছিল নামি?
সে আমার শৈশবের কুঁড়ি,
সে আমার সুকুমার আমি।

প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
পথমাঝে উড়িলরে ধূলি,
হৃদয়ের অরণ্য-আঁধারে
দুজনে আইনু পথ ভুলি।
নয়নে পড়িছে তার রেণু,
শাখা বাজে সুকুমার কায়
ঘন ঘন বহিছে নিশ্বাস
কাঁটা বিধে সুকোমল গায়।

ধূলায় মলিন হল দেহ,
সভয়ে মলিন হল মুখ,
কেঁদে সে চাহিল মুখপানে
দেখে মোর ফেটে গেল বুক!

কেঁদে সে কহিল মুখ চাহি,
“ওগো মোরে আনিলে কোথায়?
পায় পায় বাজিতেছে বাধা,
তরু-শাখা লাগিছে মাথায়।
চারিদিকে মলিন আঁধার,
কিছু হেথা নাহি যে সুন্দর,
কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাত-রবি-কর?”
কেঁদে কেঁদে সাথে সে চলিল,
কহিল সে সকরুণ স্বর,
“কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাত-রবি-কর?”

প্রতিদিন বাড়িল আঁধার
পথ হল পঙ্কিল, মলিন,
মুখে তার কথাটিও নাই,
দেহ তার হল বলহীন।

অবশেষে একদিন, কেমনে, কোথায়, কবে
কিছুই যে জানিনে গো হায়,
হারাইয়া গেল সে কোথায়!


রাখ দেব, রাখ মোরে রাখ,
তোমার স্নেহেতে মোরে ঢাক,
আজি চারিদিকে মোর এ কি অন্ধকার ঘোর
একবার নাম ধরে ডাক!
পারি না যে সামালিতে, কাঁদি গো আকুল চিতে
কত র’ব মৃত্তিকা বহিয়া?
ধূলিময় দেহখানি ধূলায় আনিছে টানি
ধূলায় দিতেছে ঢাকি হিয়া!


হারায়েছি আমার আমারে,
আজ আমি ভ্রমি অন্ধকারে।
কখনো বা সন্ধ্যাবেলা, আমার পুরানো সার্থী
মুহূর্ত্তের তরে আসে প্রাণে;
চারিদিক নিরখে নয়ানে।
প্রণয়ীর শ্মশানেতে একেলা বিরলে আসি
প্রণয়ী যেমন কেঁদে যায়,

নিজের সমাধিপরে নিজে বসি উপছায়া
যেমন নিশ্বাস ফেলে হায়,
কুসুম শুকায়ে গেলে যেমন সৌরভ তার
কাছে কাছে কাঁদিয়া বেড়ায়,
সুখ ফুরাইয়া গেলে একটি মলিন হাসি
অধরে বসিয়া কেঁদে চায়,
তেমনি সে আসে প্রাণে  চায় চারিদিক পানে
কাঁদে, আর কেঁদে চলে যায়!
বলে শুধু “কি ছিল, কি হল
সে সব কোথায় চলে গেল।”


* * * *


বহু দিন দেখি নাই তারে,
আসেনি এ হৃদয়-মাঝারে।
মনে করি মনে আনি তার সেই মুখখানি,
ভালো করে মনে পড়িছে না,
হৃদয়ে যে ছবি ছিল, ধূলায় মলিন হল,
আর তাহা নাহি যায় চেনা।
ভুলে গেছি কি খেলা খেলিত,
ভুলে গেছি কি কথা বলিত।



যে গান গাহিত সদা, সুর তার মনে আছে,
কথা তার নাহি পড়ে মনে।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে উড়িত সে মেঘ চেয়ে
আর তাহা পড়ে না স্মরণে।
শুধু যবে হৃদি-মাঝে চাই
মনে পড়ে—কি ছিল, কি নাই।