কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/গান আরম্ভ

গান আরম্ভ

ডাকি তোরে, আয়রে হেথায়,
সাধের কবিতা তুই আয়!
চারিদিকে খেলিতেছে মেঘ,
বায়ু আসি করিছে চুম্বন,
সীমা-হারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া
হৃদয় করিছে আলিঙ্গন।

অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার,
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে, কবিতা আমার।
যবে আমি আসিব হেথায়
মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায়।
মেঘেতে মেঘেতে মিলে মিলে
হেলে দুলে বাতাসে বাতাসে,
হাসিহাসি মুখখানি করি’
নামিয়া আসিবি মোর পাশে।

বাতাসে উড়িবে তোর বাস,
ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ,
ঈষৎ মেলিয়া আঁখি-পাতা
মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া,
হৃদয়ের মৃদুল কিরণ
তাধরেতে পড়িবে লুটিয়া।

গলাটি জড়ায়ে ধরি মোর
বসে’ র’বি কোলের উপর।
এলোথেলো কেশপাশ লয়ে
বসে বসে খেলিব হেথায়,
ঊষার অলক দুলাইয়া
সমীরণ যেমন খেলায়।
চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব
আধফুটো হাসির কুসুম,
মুখ লয়ে বুকের মাঝারে
গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম।

কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি
আসিবে মেঘের শিশুগুলি,
ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে
অবাক্ হইয়া চেয়ে রবে।

তাই তোরে ডাকিতেছি আমি
কবিতা রে, আয় একবার,
নিরিবিলি দুটিতে মিলিয়া
র’ব হেথা, বধূটি আমার।

মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে
আয় লো কবিতা মোর বামে।
চম্পক-অঙ্গুলি দিয়ে
অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে,
যেমন করিয়া উষা নামে।
বায়ু হতে আয় লো কবিতা,
আসিয়া বসিবি মোর পাশে,
কে জানে বনের কোথা হতে
ভেসে ভেসে সমীরণ-স্রোতে
সৌরভ যেমন করে আসে।

হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে
বধূ মোর, ধীরে ধীরে আয়।
ভীরু প্রেম যেমন করিয়া
ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া
বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে
অমনি মূরছি পড়ে যায়।

অথবা শিথিল দেহ-লতা
এস তুমি, বস' মোর পাশে;
শোয়াইয়া হিমানী-শয়নে,
চুমি ক্লান্ত মুদিত নয়নে,
মরণ যেমন করে আসে,
শিশির যেমন করে ঝরে;
পশ্চিমের আঁধার সাগরে
তারাটি যেমন করে যায়;
অতি ধীর মৃদু হেসে, সিঁদুর সীমন্ত-দেশে
দিবা সে যেমন করে আসে
মরিবারে স্বামীর চিতায়,
পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায়।
পরবাসী ক্ষীণ আয়ু একটি মুমূর্ষ বায়ু
স্বদেশ-কাননপানে ধায়
শ্রান্ত পাখা চলিতে না চায়;
যেমনি কাননে পশে, ফুলবধূটির পাশে
শেষ কথা বলিতে বলিতে
তখনি অমনি মরে যায়।
তেমনি, তেমনি করে এস,
কবিতা রে বধূটি আমার,
ম্লান মুখে করুণা বসিয়া,
চোখে ধীরে ঝরে অশ্রুধার।

দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস,
দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী,
বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে
মরমে রাখিবি মুখখানি।