কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/সন্ধ্যা

সন্ধ্যা

ব্যথা বড় বাজিয়াছে প্রাণে,
সন্ধ্যা তুই ধীরে ধীরে আয়।
কাছে আয়——আরো কাছে আয়——
সঙ্গীহারা হৃদয় আমার
তোর বুকে লুকাইতে চায়।

তোর কাছে ফেলিরে নিশ্বাস,
তোর কাছে কহি মন-কথা,
তোর কাছে করি প্রসারিত
প্রাণের নিভৃত নীরবতা।
তোর গান শুনিতে শুনিতে
তোর তারা গুনিতে গুনিতে,
নয়ন মুদিয়া আসে মোর,
হৃদয় হইয়া আসে ভোর——
স্বপন গোধূলিময় প্রাণ
হারায় প্রাণের মাঝে তোর।
একটি কথাও নাই মুখে,
চেয়ে শুধু রোস্ মুখপানে
অনিমেষ আনত নয়ানে।

ধীরে শুধু ফেলিস্ নিশ্বাস,
ধীরে শুধু কানে কানে গাস্
ঘুম-পাড়াবার মৃদু গান,
কোমল কমল-কর দিয়ে
ঢেকে শুধু দিস্ দুনয়ান,
ভুলে যাই সকল যাতনা
জুড়াইয়া আসে মোর প্রাণ।

তাই তোরে ডাকি একবার,
আমার দুখেরে ঢেকে রাখ্,
বল্ তারে ঘুমাইতে বল্
কপালেতে হাতখানি রাখ্।
কোলাহল করিয়া দে দূর-
দুখেরে কোলেতে করে নিয়ে
রচে’ দে নিভৃত অন্তঃপুর।

আয় সন্ধ্যা, ধীরে ধীরে আয়,
হাতে লয়ে স্বপনের ডালা,
গুন্ গুন্ মন্ত্র পড়ি পড়ি
গাঁথিয়া দে স্বপনের মালা
জড়ায়ে দে আমার মাথায়,
স্নেহ-হস্ত বুলায়ে দে গায়।

স্রোতস্বিনী ঘুমঘোরে, গাবে কুলু কুলু করে
ঘুমেতে জড়িত আধ’ গান,
ঝিল্লিরা ধরিবে একতান।
দিন-শ্রমে শ্রান্ত বায়ু গৃহমুখে যেতে যেতে
গান গাবে অতি মৃদু স্বরে,
পদশব্দ শুনি তার তন্দ্রা ভাঙি লতা পাতা
ভর্ৎসনা করিবে মরমরে।
গুঞ্জরিত গানগুলি মিলিয়া হৃদয়-মাঝে
মিশে যাবে স্বপনের সাথে,
নানা নব রূপ ধরি ভ্রমিয়া বেড়াবে তারা
হৃদয়ের গুহাতে হাতে।
আয় সন্ধ্যা, ধীরে ধীরে আয়
জগতের নয়ন ঢেকে দে—
আঁধার আঁচল পেতে দিয়ে
কোলেতে মাথাটি রেখে দে!