কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/দুঃখ আবাহন
দুঃখ আবাহন
আয় দুঃখ, আয় তুই,
তোর তরে পেতেছি আসন,
হৃদয়ের প্রতি শিরা টানি টানি উপাড়িয়া
বিচ্ছিন্ন শিরার মুখে তৃষিত অধর দিয়া
বিন্দু বিন্দু রক্ত তুই করিস্ শোষণ;
জননীর স্নেহে তোরে করিব পোষণ!
হৃদয়ে আয়রে তুই হৃদয়ের ধন।
যখন হইবি শ্রান্ত বুকেতে রাখিস্ মাথা,
সে বিছানা সুকোমল শিরায় শিরায় গাঁথা!
সুখেতে ঘুমাস্ তুই হৃদয়ের নীড়ে।
অতি গুরু তোর ভার—
দুয়েকটি শিরা তাহে যাবে বুঝি ছিঁড়ে,
যাক্ ছিঁড়ে।
জননীর স্নেহে তোরে করিব বহন,
দুর্ব্বল বুকের 'পরে করিব ধারণ,
একেলা বসিয়া ঘরে অবিরল এক স্বরে
গাব তোর কানে কানে ঘুম-পাড়াবার গান,
মুদিয়া আসিবে তোর শ্রান্ত দুনয়ান।
প্রাণের ভিতর হতে উঠিয়া নিশ্বাস
শ্রান্ত কপালেতে তোর করিবে বাতাস,
তুই সুখেতে ঘুমাস্!
আয় দুঃখ আয় তুই, ব্যাকুল এ হিয়া;
দুই হাতে মুখ চাপি হৃদয়ের ভূমি 'পরে
পড়্ আছাড়িয়া।
সমস্ত হৃদয় ব্যাপি একবার উচ্চস্বরে
অনাথ শিশুর মত ওঠরে কাঁদিয়া।
প্রাণের মর্ম্মের কাছে
একটি যে ভাঙা বাদ্য আছে,
দুই হাতে তুলে নেরে সবলে বাজায়ে দেরে,
নিতান্ত উন্মাদ সম ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্!
ভাঙে ত ভাঙিবে বাদ্য ছেঁড়ে ত ছিঁড়িবে তন্ত্রী,
নেরে তবে তুলে নেরে, সবলে বাজায়ে দেরে,
নিতান্ত উন্মাদ সম ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্!
দারুণ আহত হয়ে দারুণ শব্দের ঘায়
যত আছে প্রতিধ্বনি বিষম প্রমাদ গণি
একেবারে সমস্বরে
কাঁদিয়া উঠিবে যন্ত্রণায়,
দুঃখ, তুই, আয় তুই আয়।
নিতান্ত একেলা এ হৃদয়;
আর কিছু নয়,
কাছে আয় একবার, তুলে ধর্ মুখ তার,
মুখে তার আঁখি দুটি রাখ্,
একদৃষ্টে চেয়ে শুধু থাক্।
আর কিছু নয়—
নিরালয় এ হৃদয়
শুধু এক সহচর চায়,
তুই দুঃখ, তুই কাছে আয়!
কথা না কহিস্ যদি বসে' থাক্ নিরবধি
হৃদয়ের পাশে দিন-রাতি।
যখনি খেলাতে চাস্, হৃদয়ের কাছে যাস্
হৃদয় আমার চায় খেলাবার সাথী।—
আয় দুঃখ, হৃদয়ের ধন,
এই হেথা পেতেছি আসন।
প্রাণের মর্ম্মের কাছে
এখনো যা' রক্ত আছে
তাই তুই করিস শোষণ।