কারাকাহিনী/তৃতীয় বার
তৃতীয় বার
বোকসরষ্ট
২৫ শে ফেব্রূয়ারী আমার প্রতি তিনমাস সশ্রম কারাবাসের আদেশ হইলে আমি যখন বোক্সরষ্টের জেলে বন্দী ভ্রাতৃবৃন্দ ও পুত্রের সহিত মিলিত হইলাম, তখন মনে করিয়াছিলাম, এই তৃতীয় বারের জেল সম্বন্ধে কিছু বলার বা লেখার আর প্রশ্লোজন হইবে না। কিন্তু মানুষের অন্য অনেক ধারণার মতই আমার এ ধারণাও মিথ্যা হইল। এইবার আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করিলাম তাহা অন্য দুইবারের অভিজ্ঞতা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এবারকার শিক্ষা আমি বৎসরব্যাপী পরিশ্রমে ও অভ্যাসেও পাইতে পারিতাম না। জীবনের এই কয়টা মাসকে আমি অমূল্য মনে করি। এই অল্প দিনেই সত্যাগ্রহের কত ছবি আমার মনের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছিল, ২৫শে ফেব্রূয়ারীর আগের তুলনায় কতখানি বেশী শক্তি আমি লাভ করিয়াছি। এই জন্য ট্রান্সভাল গবর্ণমেণ্টের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। গভর্ণমেণ্টের পক্ষীয়' অনেকে মনে স্থির করিয়াছিলেন, এবার আমার ছয়মাস জেল নিশ্চয়ই হইবে। আমার সঙ্গী, প্রবীণ, প্রসিদ্ধ ভারতবাসীগণ, আমার পুত্র— সকলেই ছয় মাসের জন্য দণ্ড ভোগ করিতেছিলেন। মনে মনে প্রার্থনা করিতেছিলাম, ভগবান্ করুন, লোকের আশা যেন পূর্ণ হয়।
কিন্তু আমার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযোগ ছিল না, সুতরাং ভয় হইতেছিল, বুঝি বা তিন মাস মাত্র দণ্ড হয়। হইলও তাহাই।
দণ্ডাদেশ হইবার পর, মিঃ দাউদ মহম্মদ, মিঃ রুস্তমজী, মিঃ সোরাবজী, মিঃ পিল্পে, মিঃ হজুরা সিংহ, মিঃ লালবাহাদুর সিংহ প্রভৃতি সত্যাগ্রহীদের সাইত আনন্দে মিলিত হইলাম। জন দশেক ছাড়া আর সকল কয়েদীর শুইবার ব্যবস্থা জেলের মাঠের মধ্যে ঘরে হইয়াছিল। সুতরাং সে স্থান দেখিতে জেলের চেয়ে বরং লড়াই এর ছাউনীর মত লাগিত। সকলেই সেখানে শুইতে পাইয়া খুসী;—খাওয়ারও খুব সুবিধা। এবারও আগের মত আমাদের উপরেই রাঁধিবার ভার, সুতরাং নিজের রুচি অনুযায়ী খাবার পাওয়া যাইত। সর্ব্বশুদ্ধ ৭৭ জন সত্যাগ্রহী কয়েদী ছিলাম। যাহাকেই যে কাজ দেওয়া হইত, প্রায়ই তাহা সহজ হইত। ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছারীর সম্মুখে পাকা রাস্তা তৈরী করিতে হইবে, তাহার জন্য পাথর, কাঁকর ইত্যাদি খুঁড়িতে ও গাদা করিতে হইত; মাদ্রাসার সামনের ময়দানে ঘাস কাটিতে হইত। সকলেই কিন্তু খুব মনের আনন্দে কাজ করিতেন।
তিন দিন পর্যন্ত আমি স্পেনটোলীর জমাদারের সঙ্গে কাজ করিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু ইহারই মধ্যে টেলিগ্রাম আসিল, আমাকে যেন বাহিরের কাজ করিতে না দেওয়া হয়। মনটা দমিয়া গেল, কারণ বাহিরে যাইতে বেশ আনন্দ লাগিত, শরীর ও স্বাস্থ্য দুইই ভাল বোধ হইত। সাধারণত আমি দুইবার খাই, কিন্তু বোক্সরষ্ট জেলে কাজ করার জন্য দুইবারের বদলে তিনবার খাওয়ার দরকার হইত। এখন ঝাঁট দেওয়ার কাজ পাওয়া গেল; এই কাজে দিন কষ্টে কাটিত। কিন্তু এ কাজও শেষ হওয়ার সময় আসিল।
বোক্সরষ্ট হইতে নিষ্কৃতি।
২রা মার্চ্চ খবর আসিল, আমায় প্রিটোরিয়ায় পাঠাইবার হুকুম আসিয়াছে। সেই দিনই আমায় প্রস্তুত হইতে হইল। বৃষ্টি পড়িতেছিল— রাস্তাঘাট খারাপ ছিল;—এই অবস্থাতেও আমাকে গাঁঠরী উঠাইয়া চলিতে হইল। সঙ্গে ছিল দারোগা সন্ধ্যার ট্রেণে তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে তাহার সঙ্গে চলিলাম।
অনেকেই এই ঘটনায় মনে করিল, ব্যাপার বুঝি মিটিবার উপক্রম হইতেছে; কেহ কেহ আবার মনে করিল, আমায় অন্যত্র লইয়া বেশী কষ্ট দেওয়ার ব্যবস্থাই হইবে; অনেকে ভাবিল,—সত্য মিথ্যা যাহাই হউক, এ বিষয়ে জন সাধারণের মধ্যে যাহাতে বিশেষ কোনও সভা সমিতি বা আন্দোলন না হয়, এই জন্যই আমাকে প্রিটোরিয়ায় রাখিয়া বেশী কষ্ট দেওয়ার জন্য লইয়া যাওয়া হইতেছে।
বোক্সরষ্ট ছাড়িতে ইচ্ছা হইতেছিল না; সেখানে সারাদিন যেমন আনন্দে কাটাইতাম, রাত্রিতেও কথাবার্ত্তা বলিয়া, গল্প করিয়া, তেমনি আনন্দ পাইতাম। মিঃ হজুরা সিংহ ও মিঃ জোশী, এরা দুজনেই বেশ আসর জমাইতেন। তাঁহাদের কথাবার্ত্তাও নিরর্থক ছিল না, জ্ঞানধ্যানের কথায় তাঁহাদের মন সর্ব্বদা ভরপুর। যেখানে দিন রাত্রি এমন আনন্দে কাটিত, যেখানে এতগুলি ভারতবাসী একত্রে থাকিতেন, সে জায়গা ছাড়িতে কোন্ সত্যাগ্রহীর হৃদয়ই না ব্যথা পায়? কিন্তু মানুষের ইচ্ছামত কাজ হইলে ত কথাই ছিল না।
চলিলাম; পথে মিঃ কাজীর সঙ্গে সাদরসম্ভাষণ শেষ করিয়া দারোগা ও আমি গাড়ীতে উঠিলাম। শীত পড়িতেছিল; সারারাত্রি বৃষ্টি হইল। আমি গায়ে চাদর জড়াইবার অনুমতি পাইলাম। তাহাতে কিছু আরাম বোধ হইল, শীত একটু কমিল। সঙ্গে ছিল রুটী ও পনির; আমিত’ খাওয়া সারিয়া বাহির হইয়াছিলাম, সুতরাং সেগুলি দারোগার কাজে লাগিল।প্রিটোরিয়ায়।
৩রা প্রিটোরিয়ায় পৌঁছিলাম। সেখানে সকলই নূতন মনে হইল। জেল ও নূতন তৈরী, লোক ও সব নূতন। আমাকে খাইতে বলা হইল, কিন্তু ইচ্ছাই ছিল না। “মীলি মিলের” পরিজ্, দেওয়া হইল, এক চামচ খাইয়া রাখিয়া দিলাম। দারোগা অবাক্; বলিলাম, ক্ষুধা নাই; সে হাসিল। তাহার পর আমাকে অন্য এক দারোগার জিম্মায় রাখা হইল। সে বলিল, গান্ধী, টুপি নামাও। আমি টুপি নামাইলাম। তখন জিজ্ঞাসা করিল, তুই কি গান্ধীর ছেলে? উত্তর দিলাম, না—আমার ছেলে বোক্সরষ্টে ছয় মাসের জেল খাটিতেছে। এখন আমাকে একটি কুঠুরীতে বন্ধ করা হইল, সেখানে পাইচারী করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে দারোগা দরজার ছিদ্র দিয়া আমায় পাইচারী করিতে দেখিয়া বলিল, “গান্ধী, বেড়াস্ না—এক জায়গায় বোস্, মেঝে খারাপ হইতেছে।” পাইচারী বন্ধ করিয়া দিলাম; এক পাশে দাঁড়াইলাম। সঙ্গে পড়িবার কিছু ছিল না। আমার পুস্তক গুলি আমাকে দেওয়া হয় নাই। আন্দাজ ৮ টার সময় আমাকে বন্ধ করা হয়—১০টার সময় ডাক্তারের কাছে লইয়া যাওয়া হইল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কোন ও সংক্রামক রোগ আছে? ‘না’ বলায় ফিরিয়া আসিলাম। আবার কুঠুরীতে বন্ধ করা হইল। ১১ টার সময় আমাকে অন্য একটি ছোট কুঠুরীতে লইয়া যাওয়া হইল। সেখানে অনেক ক্ষণ থাকিলাম। এই কুঠুরী গুলি এক এক জনের জন্য তৈয়ারী,—১০ ফিট লম্বা ৭ ফিট চওড়া, মেঝেয় আলকাতরা দেওয়া। মেঝে চক্চকে রাখার জন্য দারোগার অনুক্ষণ চেষ্টা। লো বাতাসের জন্য কাচ ও লোহার গরাদ দেওয়া অনেকগুলি ছোট ছোট জানালা আছে। রাত্রে, কয়েদীকে দেখিবার জন্য ইলেকট্রিক আলো ছিল,—কয়েদীর সুবিধার জন্য নয়, কারণ তাহাতে পড়িবার মত আলো হয় না, আলোর সামনে গিয়া ঐ দাঁড়াইয়া বড় অক্ষরের বই পড়া চলিত। ঠিক আটটার সময়ে আলো নিভাইয়া দেওয়া হইত, কিন্তু রাত্রে ৫।৬ বার জালা হইত, দারোগা দরজার ফাঁক দিয়া চট্ করিয়া কয়েদীকে দেখিয়া নিবে বলিয়া।
১১টা বাজিলে ডিপুটী গবর্ণর আসিলেন, তাঁহাকে আমি তিনটী কথা জানাইলাম। প্রথমতঃ, পুস্তক গুলি চাহিলাম; দ্বিতীয়তঃ, আমার স্ত্রীর অসুখের জন্য তাঁহাকে পত্র লিখিবার অনুমতি, ও তৃতীয়তঃ, বসিবার জন্য, একটী বেঞ্চ। প্রথমটীর উত্তর—‘বিচার করিয়া দেখা যাইবে। দ্বিতীয়টীর উত্তর—‘চিঠি লিখিতে পার’; তৃতীয়টীর উত্তর ‘না’ পাওয়া গেল। গুজরাতীতে চিঠি লিখিলাম, তাহার উপর মন্তব্য হইল,—আইনতঃ ইংরেজীতে চিঠি লিখিতে হইবে। বলিলাম, আমার স্ত্রী ইংরেজী জানেন না, আর আমার চিঠি তাঁহার অসুখে ঔষধের কাজ করিবে। বিশেষ কিছু নূতন কথা লিখিবার ছিল না, তথাপি অনুমতি পাইলাম না। ইংরেজীতে লিখিবার আজ্ঞা আমি প্রত্যাখান করিলাম। সেইদিন সন্ধ্যায় আমার পুস্তকগুলি পাইলাম।
দ্বিপ্রহরে খাবার আসিল। কুঠুরীর মধ্যে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই খাইতে হইল। তিনটার সময় আমি স্নান করিবার অনুমতি চাহিলাম। স্নানের জায়গা আমার কুঠুরী হইতে প্রায় ৪০ গজ দূরে। দারোগা বলিল,“বেশ, কিন্তু কাপড় খুলিয়া উলঙ্গ হইয়া যাইতে হইবে।” জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহার কি প্রয়োজন? আমি কাপড় পরদার উপর রাখিয়া দিব। তখন সে অনুমতি দিয়া বলিল, যেন বেশী দেরী না করি। শরীর মোছাঁ শেষ হয় নাই, এমন সময়ে প্রভু হাঁক দিলেন,—‘হয়েছে’? উত্তর দিলাম, হইতেছে। কোন ভারতবাসীর মুখদর্শন ত সেখানে ভাগ্যের কথা। সন্ধ্যার সময় কম্বল, চাদর ও পাতিবার অন্য মাদুর পাওয়া গেল—চৌকি টৌকি ছিল না। পায়খানায় পর্যন্ত দারোগা সঙ্গে যাইত। সে ত’ আমায় জানিত না, তাই বলিত, ‘হয়েছে, এইবার বাহিরে এস’ কিন্তু আমার যে বেশীক্ষণ বসিবার অভ্যাস, সেটা সে বুঝিত না। এখন উঠি কেমন করিয়া? উঠিলে কাজ শেষ হয় না। মাঝে মাঝে আবার দারোগা বা একজন কাফ্রি দাঁড়াইয়া ‘ওঠ্’ ‘ওঠ্’ বলিয়া চীৎকার করিতে থাকিত।
দ্বিতীয় দিন কাজ পাওয়া গেল, তাহাও আবার মেঝে ও দরজা পরিষ্কার করিবার। দরজার উপর রং দেওয়া ছিল,—দরজা কিন্তু লোহার। তাহাকে আবার পালিশ করার কি প্রয়োজন, বুঝিলাম না। এক একটী দরজার পিছনে তিন তিন ঘণ্টা খাটিলাম কিন্তু কিছুই প্রভেদ দেখিলাম না। তবে মেঝেটার চেহারা কিছু ফিরিয়া গেল বটে। আমার সঙ্গে কাফ্রিরাও কাজ করিতেছিল, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে নিজেদের দণ্ডবৃত্তান্ত বলিতেছিল,—এ দণ্ডভোগ আমার কেন, তাহাও জিজ্ঞাসা করিতেছিল। কেহ কেহ প্রশ্ন করিল, চুরী করিয়াছি কি না; কেহ আবার জিজ্ঞাসা করিতেছিল,—কি হে, মদ বিক্রয় করিতে আসিয়াছিলে না কি? তাহাদের কথাটা এক আধটু বুঝবার পর যখন তাহাদিগকে নিজেব কথা বললাম, তখন সকলেই পরামর্শ দিল,—“কোয়াইট রাইট্ (বেশ করিয়াছ), অমলু গুডে (গোরারা খারাপ লোক), ডোণ্ট্, পে ফাইন্ (জরিমানা দিও না)।” ইত্যাদি। আমার কুঠুরীর গায়ে লেখা ছিল—“আয়স্তে লেটেতু” বা সলিটারী সেল্। আমার পাশেই এমন ধারা আরও পাঁচটী কুঠুরী দেখিলাম। আমার প্রতিবেশী ছিল একজন কাফ্রি, সে খুন করিবার চেষ্টা করার অপরাধে অপরাধী। তাহার পিছনে আরও তিনজন কাফ্রি ছিল, তাহারা পাশবিক ব্যভিচার অপরাধে কারারুদ্ধ। এমনই সঙ্গীদের মধ্যে, এই ..বেস্থার ভিতরে, প্রিটোরিয়া জেলে আমার অভিজ্ঞতার আরম্ভ।
ভোজন।
খাবার ব্যবস্থাও তেমনি। সকালে “পূপূ”, দ্বিপ্রহরে তিনদিন “পূপূ” ও আলু অথবা গাজর, তিনদিন “বীন্”; সন্ধ্যার সময়ে—ভাত (ঘি না দেওয়া)। বুধবার দ্বিপ্রহরে “বীন্স্”, ভাত, ঘি; ও রবিবারে “পূপূ” ভাত ও ঘি পাওয়া যাইত। বিনা ঘিয়ে ভাত খাওয়া কষ্টকর; তাই যতদিন ঘি পাই ততদিন ভাত খাইব না স্থির করিলাম। সকালে ও দ্বিপ্রহরে “পূপূ” মিলিত—কখনও কাঁচা, কখনও বা আখের রসের মত পাতলা। “বীন্স্” কখনও কখনও কাঁচা থাকিত, তবে প্রায়ই ঠিক পাইতাম। তরকারির বেলায় ছোট ছোট চারিটি আলু (সেগুলি আট আউন্স বলিয়া ধরা হইত।) ও গাজরের দিন তেমনই ছোট ছোট তিনটি গাজর।
সকালে কোনও কোনও দিন ২।৪ চামচ “পূপূ” পাইতাম বটে, কিন্তু সাধারণতঃ দ্বিপ্রহরের খাওয়ার উপরই দুই মাস কাটাইরা দিলাম। এই উদাহরণ হইতে আমার বোকসরষ্ট জেলের ভ্রাতৃবৃন্দের বোঝা উচিত, নিজেরা রাঁধিবার সময়ে যদি কোনও জিনিষ কিছু কাঁচা থাকিত তখন ইহা লইয়া ব্রাগ করা উচিত হয় নাই। বলুন, এ অবস্থায় কাহার উপরে রাগ করিতে পারা যায়? এখানে একটা ব্যবস্থা করা যাইত বটে, তবে আমার মতে এবিষয়ে অভিযোগ করা আমাদের সাজে না। যেখানে সকলেই ধৈর্য্য ধারণ করিয়া থাকিতে পারে, সেখানে কেমন করিয়া অভিযোগ করা যায়? অভিযোগে সকলেই একমত হওয়া দরকার। কখন কখন দারোগাকে জানাইতাম, আলু কম হইয়াছে; তখন সে আরও আলু আনিয়া দিত। কি এমন করিয়া আর কতদিন চলে? একদিন দেখিলাম, দারোগা আমার জন্য অন্য একজনের বাটি হইতে আনিয়া দিতেছে। সেই দিন হইতে বলাই ছাড়িয়া দিলাম।
সন্ধ্যার সময় ভাতে ঘি পাওয়া যাইত না ইহা আমি লক্ষ্য করিয়াছিলাম, এবং যাহাতে এ বিষয়ে কোনও একটা ব্যবস্থা হয়, তাহা করিব স্থির করিয়াছিলাম। বড় দারোগাকে বলিলে সে উত্তর দিল,—ঘি কেবল বুধ ও রবিবার দিন দ্বিপ্রহরে মাংসের বদলে পাওয়া যাইতে পারে, যদি বেশী দরকার হয় তবে ডাক্তারের কাছে যাইতে হইবে। পরদিন ডাক্তারের সহিত দেখা করিতে চাহিলাম—দেখা হইল।
ডাক্তারকে বলিলাম,—চর্ব্বির বদলে ভারতীয় কয়েদীদের জন্য যেন ঘি দেওয়া হয়।
সেখানে বড় দারোগা ও ছিল, সে বলিল,—গান্ধীর প্রার্থনা অন্যায়। এতদিন ত’ কত ভারতীয় কয়েদী চর্ব্বিও খাইয়াছে, মাংসও খাইয়াছে। চর্ব্বি নিলে শুকনা চাল দেওয়া হয়, তাহাও লোকে বেশ খায়। সত্যাগ্রহ কয়েদীরাও ত সকলেই খায়। জেলে আসার সময় তাহাদের ওজন নেওয়া হইয়াছিল, যাওয়ার সময় আবার ওজন করিয়া দেখা গেল, ওজন বাড়িয়াই গেছে।
ডাক্তার বলিলেন,—এর উপর আর কি বলিতে পার? উত্তর দিলাম —এ ঘটনা জানি না, তবে নিজের বিষয় বলতে পারি যে যদি একেবারেই ঘি না পাই, তবে নিশ্চয়ই আমার শরীর খারাপ হইবে। ডাক্তার বলিলেন,—তোমার জন্য তবে রুটির হুকুম দিতেছি; উত্তর দিলাম, এর জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু আমি শুধু আমারই জন্য বলিতে আসি নাই,—যতক্ষণ না সকলেরই ঘিয়ের ব্যবস্থা হয়, ততক্ষণ আমি রুটি খাইতে পারি না। ডাক্তার বললেন, তা হ’লে আর আমাকে দোষ দিও না।
এবারে কি করি? বড় দারোগা যদি মধ্যে কথা না বলিত, তবে হুকুম পাওয়া যাইত। সেই দিনই আমাকে রুটি ও ভাত দেওয়া হইল ক্ষুধিত ছিলাম, কিন্তু সত্যাগ্রহী হইয়া এ অবস্থায় কি করিয়া খাই? কিছুই খাইলাম না। পরদিন ডিরেক্টারের কাছে আবেদন করিবার অনুমতি চাহিলাম। অনুমতি ত’ পাওয়া গেল, তাঁহার কাছে আবেদনও করা হইল। তাহাতে জোহনসবর্গে ও বোক্সরষ্টের উদাহরণ দিয়া ঘি পাইবার জন্য প্রার্থনা করিলাম। পনের দিন পরে উত্তর আসিল। যতদিন না ভারতবাসীদের অন্য কোনও রকম খাবারের বন্দোবস্ত হয়, ততদিন আমাকে প্রত্যহ ভাতের সহিত ঘি দেওয়া হইবে। খবরটা প্রথমে আমাকে দেওয়া হয় নাই, তাই প্রথম দিন ত’ ভাত, রুটি, ঘি খুব খাইয়া লইলাম। বলিলাম, রুটির দরকার নাই, কিন্তু উত্তর হইল—ডাক্তারের হুকুম, রুটি দেওয়া হইবেই। পনের দিন ত রুটি খাওয়া গেল। প্রথম দিন মজা করিয়া খাইলাম বটে, কিন্তু পরদিন জানিতে পারিলাম, এই রকম আদেশ দেওয়া হইয়াছে। আমি তখন ভাতের সঙ্গে ঘি ও রুটি লইতে অস্বীকার করিলাম। বড় দারোগাকে বলিলাম, যতক্ষণ না সকলেই ঘি পাইতেছে, ততক্ষণ আমি খাইতে পারি না। কাছে ডেপুটি গবর্ণরও ছিলেন, তিনি বলিলেন,—“তোমার ইচ্ছা।” আবার ডিরেক্টরকে লিখিলাম। আমাকে বলা হইয়াছিল, নেটালে যেমন খাবার দেওয়া হয় আমাদেরও তেমনই দেওয়া হইবে। আমি সে বিষয়ে লিখিলাম, এবং শুধু নিজের জন্য হইলে যে ঘি ইত্যাদি লইতে পারি না, তাহাও বলিলাম। শেষে প্রায় দেড় মাস পরে আদেশ আসিল, যেখানে যেখানে ভারতবাসী কয়েদী বেশী আছে, সেখানে ঘি দেওয়া হইবে। এই রূপে দেড় মাস পরে জয় লাভ করার পর, আমার “রোজা” বা উপবাস শেষ হইল। শেষাশেষি আমি ঘি, রুটি ও ভাত খাইলাম। আমি সকালে খাওয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলাম, ভাত রুটী পাওয়ার পরেও কখনও কখনও দ্বিপ্রহরে “পূপূ” দিলে ৮।১০ চামচ মাত্র খাইতাম। “পূপূ” তা, নিত্য নূতন রকমের তৈয়ারী হইত। রুটি আর ঘিতে আমার যথেষ্ট হইত, তাই শরীরও ভাল হইয়া উঠিল।
যখন একাহারী ছিলাম, তখন শরীর খারাপ হইয়াছিল, দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম, আর প্রায় দশ দিন আধকপালী, মাথাধরা রোগে ভুগিতে ছিলাম। বুক খারাপ হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা গিয়াছিল।
কার্য্য পরিবর্ত্তন।
বুক খারাপ হইবার কারণ, —আমাকে দরজা ও মেঝে পরিষ্কার করার কাজ দেওয়া হইয়াছিল। প্রায় দশ দিন এই কাজ করার পর ছেঁড়া কম্বল সেলাই করিয়া জুড়িবার ভার দেওয়া হইল। কাজটা ছিল একটু মিহি ধরণের। সমস্ত দিন কোমর নীচু করিয়া মেঝেতে বসিয়া কাজ করিতে হইত, তাহাও আবার কুঠুরীতে বসিয়া। ইহাতে সন্ধ্যার সময়ে কোমরে ব্যথা হইত, চোখও ব্যথা করিত। আমার মনে হয়, বদ্ধ কুঠুরীর বাতাস খারাপ, তাই দারোগাকে একবার বলিলামও—আমাকে না হয় বাহিরে মাটী খুঁড়িবার কি অন্য কোনও কাজ দিন্, কিম্বা বাহিরে বসিয়া কম্বল সেলাই করিবার অনুমতি দেওয়া হউক্। কিন্তু তিনি দুইটি অনুরোধই প্রত্যাখ্যান করিলেন। এবারও ডিরেক্টারকে লিখিলাম। শেষে ডাক্তারের হুকুম আসিল। যদি খোলা হাওয়ায় কাজ করিবার অনুমতি না পাইতাম, তবে বোধ হয় শরীর আরও খারাপ হইত। এই অনুমতি পাওয়ার জন্য আমায় যে কত কষ্ট পাইত হইয়াছিল, তাহা আর এখানে বলার প্ররোজন নাই। শেষে হইল এই, আমার খাবার পরিবর্ত্তন হইল, আর খোলা বাতাসে কাল করার অনুমতি পাইলাম। লাভটা দুরকমেই হইল। যখন কম্বল সেলাই করার কাজ পাইয়াছিলাম তখন মনে হইয়াছিল, এই এক কাজ শেষ করিতে আমার সাত দিন লাগিবে আর ততক্ষণ আমারও শেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু হইল ঠিক্ উল্টা। প্রথম কম্বল বোনা শেষ হইবার পরে আমি এক এক জোড়া কম্বল দুই দিনেই শেষ করিতে লাগিলাম। তখন অন্য কাজও পাওয়া গেল—যেমন, বানীয়ানে শশম ভরা, জেলের টীকিটের জন্য পকেট তৈরী করা, ইত্যাদি।
আমি অনেক সত্যাগ্রহীকেই বলিয়াছিলাম, যদি স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া, রোগ লইয়া জেলের বাহিরে যাইতে হয়, তবে আমাদের সত্যাগ্রহ দুর্ব্বল বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। ধৈর্য্য ধরিয়া আমরা সত্যপন্থা অবলম্বন করিতে পারি। চিন্তা করিলেও স্বাস্থ্য খারাপ হয়। সত্যাগ্রহীদের ত’ জেলকে বাড়ী মনে করাই উচিত।
আমি এই ভাবিয়াই কষ্ট পাইতাম যে আমাকেই শেষে যেন কোনও রকমে রোগ নিয়া বাহির হইতে না হয়। পাঠকের স্মরণ রাখা উচিত, আমার জন্য যে ঘিএর অনুমতি হইয়াছিল তাহার জন্য সে চেষ্টা না করিলে সত্যাগ্রহে আমার শরীর খারাপ হইত। কিন্তু অন্যের বেলায় এ নিয়ম থাটে না। প্রত্যেক কয়েদী যখন একলা থাকে তখন নিজের অসুবিধা দূর করিবার চেষ্টা করিতে পারে। প্রিটোরিয়ায় আমার এরূপ না করার বিশেষ কারণ ছিল। এই কারণেই আমি শুধু নিজের জন্য ঘি লওয়ার অনুমতি মানিয়া লইতে পারি নাই।অন্যান্য পরিবর্ত্তন
উপরে বলিয়াছি, দারোগার আমার উপরে বিশেষ খোসনজর ছিল না, সেই একটু কড়া ব্যবহার করিত। কিন্তু এ ভাব বেশী দিন রহিল না। সে যখন জানিতে পারিল যে আমি খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে স্বয়ং সরকার বাহাদুরের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া বসি, কিন্তু তখুনি আবার তাহার সকল আজ্ঞাই পালন করি, তখন সে তাহার আচরণ পরিবর্তন করিল। সে আমাকে যাহা খুসী করিতে দিত। এমন কি, পায়খানায় যাওয়ার এবং স্নান করিবার কষ্ট ও দূর হইয়া গেল। সে জানাইতও না যে তাহার হুকুম আমার উপরও চলিবে। সে বদ্লী হইবার পর তাহার স্থানে যে দারোগা আসিল, সে ছিল খুব উদার। সে আমায় ন্যায্য ও যোগ্য সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করিত। সে বলিত, ‘যে লোক নিজের জাতির জন্য লড়াই করে তাহাকে আমি খুব ভালবাসি। আমি নিজেই লড়াই করি, তোমাকে আমি কয়েদী বলিয়া মনে করি না। এই রকম নানা কথা সে বলিত।
কিছু দিন পরে আমাকে সকালে ও সন্ধ্যায় আধঘণ্টার জন্য জেলের ভিতর পথে বেড়াইবার অনুমতি দেওয়া হইল। যখন বাহিরে বসিয়া কাজ করিতাম তখনও এই ব্যবস্থা বলবৎ রহিল। মনে হয়, যে সকল কয়েদীর বসিয়া কাজ করিতে হয় তাহাদের জন্য এইরূপ নিয়ম করা উচিত।
আমি বেঞ্চের জন্য আবেদন করিয়াছিলাম, পাওয়া যায় নাই। কিছু দিন পরে বড় দারোগা তাহাও পাঠাইয়া দিল। জেনারাল স্মাট্স্ দুইখানি ধর্ম্ম পুস্তক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, সুতরাং মনে হইল, আমাকে যে কষ্ট দেওয়া হইতেছে তাহা তাঁহার আজ্ঞা অনুযায়ী নহে, বরং তাঁহার ও অন্য সকলের অজ্ঞাতসারে, আমাকে কাফ্রিদের মধ্যে গণ্য করাতেই এত কষ্ট।
..থা ত পরে স্পষ্ট জানিতে পারিয়াছিলাম, —আমাকে যে একলা রাখা হইয়াছিল তাহার কারণ আমি যাহাতে অন্য কাহারও সঙ্গে কথাবার্ত্তা কহিতে না পারি। কিছু চেষ্টার পরে নোর্টবুক ও পেন্সিল রাখার অনুমতিও পাইলাম।
ডিরেক্টারের সহিত সাক্ষাৎ।
আমি প্রিটোরিয়া পৌঁছিলেই মিঃ লীচিন ষ্টাইন বিশেষ অনুমতি লইয়া আমার সহিত দেখা করিলেন। তিনি শুধু আফিসের কাজের সম্বন্ধে দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা, প্রকার প্রশ্ন করিলেন। তাহার উত্তর দিতে চাহিতেছিলাম না, কিন্তু তিনি যখন বিশেষ আগ্রহ দেখাইলেন, তখন বলিলাম—“আমি ত বেশী কথা বলি না, শুধু এই টুকুই বলিতে পারি, আমার সঙ্গে খুব নির্দ্দয় ব্যবহার করা হইতেছে। জেনারেল স্মাট্স্ এইভাবে আশার সত্যাগ্রহ ভাঙ্গিতে চাহিতেছেন, কিন্তু তাহা কখনও সম্ভব হইবে না। যে কোনও কষ্ট আমাকে দেওয়া হউক,—আমি সকলই সহ্য করিতে প্রস্তুত। আমার মন শান্ত হইয়া গেছে। কিন্তু আপনি এ কথা প্রকাশ করিবেন না। যখন মুক্তি পাইব তখন সকল কথা জগৎকে জানাইব।” তবুও মিঃ ষ্টাইন মিঃ পোলককে একথা বলেন। মিঃ পোলকও সে কথা পেটে রাখিতে পারিলেন না, তিনি আর সকলকে বলিয়া বেড়াইলেন। যখন মিঃ ডেভিড পোলক, লর্ড সেলবোর্ণকে লিখিলেন ও খোঁজ খবর আরম্ভ হইল, তখন ডিরেক্টর আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। তাঁহাকেও আমি এই কথা বললাম। তাহা ছাড়া, যে অভিযোগগুলির কথা উপরে বলিয়াছি, সেগুলির কথাও তাঁহাকে বলিলাম। এ ঘটনার প্রায় দশ দিন পরেই আমি শুইবার জন্য চৌকী, বালিশ, রাত্রে পরিবার জন্য কামিজ্, ও মুখ মোছার জন্য রুমাল পাইলাম। প্রত্যেক ভারতবাসীরই যে এ গুলির প্রয়োজন, আমি সে কথাও বলিয়াছিলাম। সত্য কথা বলতে গেলে স্বীকার করিতেই হইবে যে গোরাদের চেয়ে ভারতবাসী শোওয়া বসা বিষয়ে বিলাসী। বিনা বালিশে শোওয়া ভারতবাসীর পক্ষে বড় কঠিন।
এই ভাবে খাওয়ার ও খোলা হওয়ায় কাজ করার সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে শুইবার সুবিধাও হইয়া গেল। কিন্তু কপাল যায় সঙ্গে; চৌকী জুটিল, কিন্তু তাহা আবার ছারপোকায় ভরা। প্রায় ১০ দিন চৌকী ব্যবহার করিলাম না, তাহার পর বড় দারোগা যখন ঠিক করিয়া দিল, তখন তাহাতে শুইতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু এতদিনে আমার মেঝেতে কম্বল পাতিয়া শোওয়ার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং চৌকী পাইয়া বিশেষ কিছু সুবিধা অসুবিধা আর হইল না। আমি বালিশের কাজ বইগুলি দিয়া চালাইতেছিলাম, সুতরাং বালিশ পাইলেও বিশেষত্ব কিছু বোধ করিলাম না।
হাতকড়ী পরিতে হইল।
প্রথম হইতেই আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হইয়াছিল তাহার সম্বন্ধে আমার মনে যে ধারণা হইয়াছিল, তাহা নিম্নলিখিত ঘটনায় আরও বদ্ধমূল হইল। চার পাঁচ দিন পরে মিসেস্ পিলের, মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিবার জন্য আমার উপর সমন দেওয়া হইল। আমাকে আদালতে লইয়া যাওয়া হইল। সেই সময়ে আমার হাতে হাতকড়ী দেওয়া হয়। দারোগা কৃপা করিয়া একটু জোরেই দিয়াছিলেন, হয়ত বা অজ্ঞাতসারে এরূপ ঘটিয়া থাকিবে। বড় দারোগা দেখিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহার কাছে অনুমতি চাহিলাম, একখানা বই সঙ্গে লইয়া যাইব; সে ভাবিল, হাতকড়ী পরিতে লজ্জা, তাই এই প্রার্থনা। সে বলিল,—“বইখানা এমন ভাবে দুই হাতে লও যাহাতে হাতকড়ী, ঢাকা পড়ে।” হাসি অসিল; হাতকড়ী পরাটা ত আমি সৌভাগ্য বলিয়া মনে করি। এমন পুস্তক হাতে পড়িল, যাহার অর্থ— ঈশ্বরের রাজ্য তোমার হৃদয়েই রহিয়াছে—“The Kingdom of God is within you” Tolstoi. মনে মনে বললাম, ভাল সুযোগ পাওয়া গেল। বাহির হইতে যত বিপদই আসুক, ঈশ্বরের স্থান যদি আমার হৃদয়ে থাকে, তবে আর ভয় কি?
এইভাবে আমায় আদালতে পায়ে হাঁটিয়া যাইতে হইল। ফিরিবার সময়ে জেলের ঠেলাগাড়ীতে আসিয়াছিলাম। ভারতবাসীরা বোধ হয় এ কথা জানিতে পারিয়াছিল যে, আমি ঐ পথ দিয়া যাইব। তাই আদালতের সম্মুখে অনেক ভারতবাসী আসিয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে মিঃ এ্যম্বকলাল ব্যাস, মিসেস পিলের টকিলের সাহায্যে আমার সহিত দেখা করিলেন। আমাকে আর একবার আদালতে যাইত হইয়াছিন সেবারও হাতকড়ী দেওয়া হয়, তবে যাওয়া আসা ঠেলাগাড়ীতে করিয়াছিলাম।
সত্যাগ্রহের মহিমা
উপরে এমন অনেক কথা লিখিয়াছি যাহা হয়ত খুবই নগণ্য, উল্লেখযোগ্য নহে, কিন্তু সেগুলি বিস্তারিত ভাবে বলিয়াছি শুধু ইহাই দেখাইবার জন্য সত্যাগ্রহ ছোট বড় সকল ঘটনাতেই প্রয়োগ করা যাইতে পারে। ছোট দারোগা আমাকে যে শারীরিক কষ্ট দিল তাহা আমি স্বীকার করিয়া নিয়াছিলাম, ফলে আমার মন শান্ত হইল। শুধু তাহাই নহে, শেষে তাহাদেরি আপনা হইতে এ অন্যায় দুর করিতে হইল। আমি যদি সেগুলির প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা করিতাম তবে শুধু আমার মন দুৰ্বল হইয়া পড়িত, এবং যে বড় কাজ আমি করিতেছিলাম তাহা অসম্পূর্ণ ই থাকিয়া যাইত। তাহা ছাড়া, দারোগাকেও শত্রু করিতাম। আহারের দুঃখও প্রথমে সহ্য করিয়াছিলাম, নিজের মত চলিয়াছিলাম বলিয়াই পরে আপনা হইতে সব দূর হইল। এমনই ভাব সামান্য সামান্য বিষয়েও এই সত্যাগ্রহ প্রয়োগ করা যাইতে পারে।
ইহার মধ্যে আমার সব চেয়ে প্রধান লাভ—শারীরিক কষ্ট সহিতে সহিতে মনের বা অনেকখানি বাড়িয়া গেল। এই তিনমাসে অনেক শিক্ষা পাইয়াছি, তাহার বলেই আজ অধিকতর দুঃখ সহ্য করিতে প্রস্তুত হইয়াছি। দেখিতেছি যে ঈশ্বর অনুক্ষণ সত্যাগ্রহীর সহায়, তাই তিনি প্রাণপণ কষ্ট দিয়া সত্যাগ্রহের পরীক্ষা করেন।
কি কি বই পড়িয়াছিলাম।
আমার সুখ দুঃখের কথা শেষ হইয়াছে। এই তিন মাসে আমার যথেষ্ট লাভ হইয়াছে! সব চেয়ে বড় লাভ,–এই সময়ে পড়াশোনা করিবার খুব সুবিধা মিলিয়াছিল। প্রথম প্রথম অবশ্য নানা কারণে হৃদয় মন অশান্ত হইয়া উঠিত। মন থাকিলেই সর্ব্বদা বানরের মত ছট্ফট্ করে। এরূপ অবস্থায় অনেকেই দমিয়া যান। ঠিক এমন সময়ে বইগুলি আমায় বাঁচাইল। ভারতীয় বন্ধুদের অভাব অনেকটা পূরণ করিয়া দিল এই বইগুলি। সর্ব্বদাই প্রায় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত পড়িবার সুযোগ পাইতাম। সকালে খাবার খাইতাম না, সুতরাং এক ঘণ্টা অবসর পাইতাম—সে সমস্ত টুকু পড়িতাম। সন্ধ্যাবেলায়ও তাহাই হইত। দ্বিপ্রহরে খাইতে খাইতেই পড়িতাম। সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ ক্লান্ত না হইলে বাতী জ্বালিবার পরেও পড়িতাম। শনি রবিবারে ত যথেষ্ট সময় পাইতাম। এই সময়ে প্রায় ত্রিশখানি বই পড়িয়া ফেলি। ইংরেজী, হিন্দী, গুজরাতী, সংস্কৃত ও তামিল ভাষার বই ছিল; ইংরেজী পুস্তকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য টলষ্টয়, এমার্সন ও কার্লাইলের গ্রন্থাবলী। প্রথম দুইখানি ধর্ম্মবিষয়ক, তাই এই সঙ্গে আমি জেলে বাইবেলও অনিয়াছিলাম। টলষ্টয়ের পুস্তকগুল এরূপ সরস ও সরল যে, যে কোনও ধর্ম্মাবলম্বী লোক সে গুলি পড়িয়া আনন্দ লাভ করিতে পারেন। তাহার বইগুলি পড়িয়া মনে হইত, তিনি যাহা লিখিয়া গিয়াছেন জীবনে তাহা নিশ্চয় পালন করিয়াছেন।
কার্লাইলের, “ফ্রেঞ্চ রিভলিউশন”—ফরাসী বিপ্লব সম্বন্ধীয় পুস্তক পড়িতেছিলাম; বইখানি খুব জোরে লেখা। বইখানি পড়িয়াই মন হইয়াছিল, ভারতবর্ষের সমস্যা সমাধানের পন্থার ইউরোপীয় পন্থার সহিত খাপ খাইতে পারে না। আমার বিশ্বাস, বিপ্লবে ফরাসীদের বিশেষ কিছু লাভ হয় নাই। ম্যাট্সিনির মতও তাহাই। এ বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে, এখানে সে বিচারের স্থান নাই। কিন্তু ইহাতেও কয়েকজন সত্যাগ্রহীর দৃষ্টান্ত পইেলাম। গুজরাতী, হিন্দী ও সংস্কৃত পুস্তকগুলির মধ্যে স্বামিজী, বেদশব্দসংজ্ঞা ও ভট্ট কেশবরামের উপনিষদ্ পাঠাইয়াছিলেন; মিঃ মোতিলাল দীবান মনুস্মৃতি পাঠাইয়াছিলেন; ফিনিক্সে ছাপা রামায়ণসার, পতঞ্জলিকৃত যোগসূত্র, নাথুরামকৃত আহ্নিক প্রকাশ, প্রোফেসর পরমানন্দ কর্তৃক দত্ত সান্ধ্যগীতা এবং স্বর্গীয় কবি রামচন্দ্রের কবিতাও পাইয়াছিলাম। এগুলির মধ্যে ভাবিবার অনেক কিছু পাইয়াছিলাম। উপনিষদ্ পাঠে শান্তিলাভ করিয়াছিলাম, তাহার একটি বাক্য—আমার হৃদয়ে চিরকাল অঙ্কিত থাকিবে,—তাহার মর্ম্ম “যাহা কিছুকর, সকলই আত্মার কল্যাণের জন্য করিও”। উপনিষদে আরও কত চিন্তার সামগ্রী পড়িয়াছিলাম। কিন্তু সব চেয়ে বড় আনন্দ পাইয়াছিলাম, কবি রামচন্দ্রের স্তবকপাঠে। আমার মতে তাঁহার রচনা সকলেরই আদরণীয়। টলষ্টয়ের মত তাঁহার আদর্শ ও মহান্। ইহা হইতে এবং সন্ধ্যার পুস্তক হইতে অনেক অংশ আমি কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম। রাত্রে যতক্ষণ না ঘুম শাসিত ততক্ষণ সেগুলি আবৃত্তি করিতাম, ও প্রত্যহ সকালে আধঘণ্টা সেই বিষয়ে চিন্তা করিতাম। তাহাতে মন সর্ব্বদাই প্রফুল্ল থাকিত। যখন কোনও নিরাশার ভাব মনে মনে জাগিত, তখন সেগুলি মনে করা মাত্র হৃদয় শান্ত হইত, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন পূর্ণ হইয়া উঠিত। এ বিষয়ে নানা কথাই পাঠককে বলিবার মত, তবু তাহার উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হইবে বলিয়া ক্ষান্ত হইলাম। শুধু ইহাই বলিতে চাহি, যে, সৎগ্রন্থ অনেক সময় সৎসঙ্গের অভাব কিয়দংশে পূর্ণ করতে পারে; সুতরাং যে সকল ভারতীয় কয়েদী জেলেও আনন্দ লাভ করিতে চাহেন তাঁহাদের সৎগ্রন্থ পাঠের অভ্যাস রাখা উচিত।
তামিল শিক্ষা।
এই'সত্যাগ্রহসংগ্রামে তামিল ভ্রাতৃবৃন্দ যত কাজ করিতেছিলেন, অন্য ভারতবাসী তত করিতে পারেন নাই। তাই মনে হইল, অন্য কোনও কারণ না থাকলেও শুধু মুক্ত হৃদয়ে তাহাদের উপকার স্বীকার করিবার জন্যই আমার ভাল করিয়া তামিল পড়া উচিত। সুতরাং শেষের একমাস বিশেষ করিয়া তামিল পড়িবার জন্য কাটাইলাম। তামিল যতই পড়িতে লাগিলাম, ততই ভাষাটি খুব ভাল লাগিতে লাগিল। ভাষাটি যেমন সরস, তেমনি মধুর। তামিল রচনাবলী পড়িয়া মনে হইল, অতীতে এবং, বর্তমানেও এই ভাষাভাষী লোক খুব বিচারবান্, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন।
ভারতকে যদি এক করিতে হয়, তবে মান্দ্রাজের বাহিরে, অনেক ভারতবাসীরই তামিল শেখা উচিত।শেষ কথা
আমার আশা যাঁহারা এই কাহিনী পাঠ করিবেন তাঁহদের মধ্যে যাহাদের হৃদয়ে এখনও দেশগ্রীতি জাগে নাই তাহা জাগরিত হইবে, তাঁহারা সত্যাগ্রহ অবলম্বন করিবেন, আর যাঁহাদের হৃদয়ে দেশপ্রীতি পূর্ব্ব হইতেই জাগরূক তাঁহাদের সে প্রীতি দৃঢ়তর হইবে। যিনি আপনার ধর্ম্ম জানেন না, তাঁহারা দেশপ্রীতি সত্য হইতে পারে না। এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হইতেছে।