কারাকাহিনী/দ্বিতীয় বার

(দ্বিতীয় বার)

প্রস্তাবনা।

 জানুয়ারী মাসে আমার একবার জেল হইয়াছিল। সেবারকার অভিজ্ঞতা অপেক্ষা আমার মনে হয় এবারের অনুভূতি অনেক সুন্দর। আমি ইহা হইতে অনেক শিক্ষাই লাভ করিয়াছি। আমার মনে হয়, আমার এই অনুভূতি অন্য ভারতবাসীর পক্ষেও উপযোগী।

 সত্যাগ্রহ সংগ্রাম—নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ—অনেক ভাবেই করা যায়। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে রাজ্যশাসন, সম্বন্ধীয় দুঃখ দূর করিবার উপায় শুধু জেল। আমার মনে হয়, আমাদের বার বার জেলে যাইতে হইবে। ইহা শুধু এই আন্দোলনের জন্য নয়, উপরন্তু ভবিষ্যতে অন্যান্য বিপদ আসিতে পারে, তাহার প্রতীকারেরও উত্তম উপায়। অতএব জেলের বিষয় যাহা কিছু জ্ঞাতব্য তাহা হিন্দুস্থানবাসীদের জানা কর্তব্য।

গ্রেপ্তার।

 যখন মিঃ সোরাবজী জেলে গেলেন, তখন মনে হইল যে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আমিও চলিয়া গেলে ভাল হয়; নতুবা যেন তাঁহার কারামুক্তির আগেই এ আন্দোলন সার্থক হইয়া উঠে। আমার আশা ব্যর্থ হইল। কিন্তু যখন নেটালের বীর নেতৃবৃন্দ জেলে গেলেন, তখন আবার এই ইচ্ছা প্রবল হইয়া উঠিল এবং পরে তাহা পূর্ণ হইল। ডারবান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন কালে ৭ই অক্টোবর আমি বোকসরষ্ট ষ্টেশনে ধৃত হইলাম, কারণ আমার কাছে আইন অনুযায়ী সার্টিফিকেট ছিল না এবং আমি আঙ্গুলের টিপসহি দিতে অস্বীকার করিয়াছিলাম। ট্রান্সভালের প্রাচীন হিন্দু অধিবাসীগণের মধ্যে যাঁহারা নোটালে শিক্ষা সমাপ্ত করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া আসিবার উদ্দেশ্যেই আমি ডারবানে গিয়াছিলাম। আশা ছিল যে নোটালের নেতৃবৃন্দের অভাবে অনেক ভারতীয়ই সেখান হইতে আসিতে প্রস্তুত হইবেন। সরকারেরও এই ভয় ছিল। তাই বোকাসরোষ্ট্রর জেলার, একশতের অধিক ভারতীয় কয়েদীর জন্য ব্যবস্থা করিবার আদেশ পাইয়াছিল। তদনুসারে প্রিটোরিয়া হইতে তাঁবু, কম্বল, বাসন ইত্যাদি ও পাঠান হইয়াছিল। যখন আমি অনেকগুলি ভারতবাসীর সহিত বোকাসরষ্টে নামিলাম, তখন আমার সহিত অনেক পুলিস ছিল, কিন্তু তাহাদের সকল দৌড় ধাপ ব্যর্থ হইল। জেলার ও পুলিসকে নিরাশ হইতে হইল, কারণ ডারবান হইতে আমার সঙ্গে অতি অল্প ভারতবাসীই আসিয়াছিলেন। সেই গাড়ীতে মাত্র ৬ জন ছিলেন, এবং সেই দিন অন্য ট্রেণে আরও ৮ জন আসিয়াছিলেন। অর্থাৎ সর্ব্বসমেত ১৪ জন ভারতবাসী আসিয়াছিলেন। সকলকেই গ্রেপ্তার করিয়া জেলে লইয়া যাওয়া হইল। দ্বিতীয় দিন আমাদের সকলকে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে লইয়া যাওয়া হইল। কিন্তু মোকদ্দমা ৭ দিনের জন্য মুলতুবী করিয়া দেওয়া হইল। বলদের উপর বসিয়া যাইতে আমরা অস্বীকার করিয়াছিলাম। দুই দিন পরে মিঃ ভাণ্ডজীী করষণজী কোঠারী আসিলেন। তিনি অৰ্শ রোগে কষ্ট পাইতে ছিলেন। অসুখ বাড়িয়া ওঠাতে এবং বোকাসরষ্টে পিকেটিং এর প্রয়োজন বোধে তিনি জামিন দিয়া খালাস হইলেন।

জেলে আমাদের অবস্থা।

 আমরা যখন জেলে পৌঁছিলাম, তখন মিঃ দাউদ মহম্মদ, মিঃ রুস্তমজী, মিঃ আঙ্গলিয়া (যাঁহার সহায়তায় এই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আরম্ভ), মিঃ সোরাবজী, অড়াচনীয়া প্রভৃতি অন্যান্য ভ্রাতৃবৃ্ন্দ মিলিয়া প্রায় ২৫ জন ছিলাম। তখন রমজানের মাস সুতরাং মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ রোজা পালন করিতেছিলেন। তাঁহাদের জন্য বিশেষ অনুমতি লইয়া সন্ধ্যাবেলায় মিঃ ইসপ সুলেমান কাজীর বাড়ী হইতে খাদ্য আসিত। এইজন্য তাঁহারা শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করিতে পারিয়াছিলেন। বাহিরের জেলে আলোর বন্দোবস্ত ছিল না। তাই রমজানের জন্য আলো ও ঘড়ী রাখিবার অনুমতি পাওয়া গেল। সকলেই মিঃ আঙ্গলিয়ার পরে নমাজ পাঠ করিতেন। প্রথমে রোজারক্ষণকারীদের পরিশ্রমের কাজ দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু পরে তাঁহাদের আর এরূপ কাজ করিতে হয় নাই।

 অবশিষ্ট যে কয়জন ভারতবাসী কয়েদী ছিলেন তাঁহাদের আপনাদের খাদ্য বন্ধন করিবার অনুমতি ছিল। সুতরাং মিঃ উমিয়াশঙ্কর শেলত ও মিঃ সুরেন্দ্র নাথ মেড়ে, এই দুইজনকে এই কাজের ভার দেওয়া হইল। পরে কয়েদীদের সংখ্যা বাড়িয়া গেলে তখন মিঃ জোশীকে সঙ্গে দেওয়া হইল। ইঁহারা যখন দেশ হইতে বহিষ্কৃত হইলেন তখন এই কাজ মিঃ রতণজী সোঢ়া, মিঃ রাঘবজী, এবং মিঃ মাওজী কোঠারীকে করিতে হইল। পরে যখন কয়েদী অনেক বাড়িয়া গেল, তখন মিঃ লাল ভাই এবং মিঃ উমর উসমানও এই কাজে লাগিলেন। রন্ধনকারীদের রাত ২।৩ টার সময় উঠিতে হইত এবং সন্ধ্যা ৫।৬ টা পর্যন্ত এই কাজে লাগিয়া থাকিতে হইত। যখন অধিকাংশ কয়েদীকেই ছাড়িয়া দেওয়া হইল, তখন রন্ধন করিবার ভার মিঃ মুসা ইউসফ, ইমাম সাহেব এবং মিঃ বাওয়াজীর লইলেন। যিনি ভারতীয় আহমদীয়া ইসলামিক সোসাইটীর সভাপতি এবং বড় ব্যবসায়ী ছিলেন, এবং যাঁহার কোন দিনই রুটী তৈয়ারী করিবার প্রয়োজন হয় নাই, তাঁহার হাতের অন্ন এই ভাবে যে পাইয়াছিল তাহাকে আমি ধন্য বলিয়া মনে করি। যখন ইমাম সাহেব এবং তার সঙ্গী মুক্তি পাইলেন তখন সে সৌভাগ্য আমার হইল। আমার একাজে অল্প সল্প অভ্যাস ছিল, সুতরাং কোন বিপদে পড়িতে হয় নাই। চারি দিন পর্যন্ত এ কাজ আমার হাতে ছিল, তাহার পর মিঃ হরিলাল গান্ধী এই ভার গ্রহণ করিলেন।

 যখন প্রথম জেলে যাই তখন সেখানে শয়ন করিবার তিনটী মাত্র কুঠুরী ছিল। তাহারই মধ্যে ভারতবাসীদের একত্র রাখা হইত। এই জেলে ভারতবাসী ও কাফ্রিদের আলাদা রাখা হইত।

জেলের ব্যবস্থা।

 পুরুষদের জেলে দুইটী বিভাগ ছিল। একটা ইউরোপীয়দের জন্য। তাহাতে যাহারা গোরা বা শ্বেতাঙ্গ নহে তাহাদের রাখা হইত। জেলার ভারতীয় কয়েদীগণকে কাফ্রিদের সহিত একত্র রাখিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তাহাদের ব্যবস্থা শ্বেতাঙ্গদের বিভাগেই করিয়াছিলেন। কয়েদীদের জন্য ছোট ছোট কুঠুরী,এবং প্রত্যেক কুঠুরীতে ১০।১৫ বা ততোধিক জনের থাকিবার স্থান। সমস্ত জেলখানা পাথর দিয়া তৈয়ারী, কুঠুরীগুলিও উঁচু। দেওয়ালে পেলেস্তারা দেওয়া ছিল, ফরাস সর্ব্বদা ধোয়া হইত, তাই তাহা খুব পরিষ্কার থাকিত। দেওয়ালে অনেকবার চুণকাম করা হইত বলিয়া সর্ব্বদাই নূতন মনে হইত। উঠান কাল পাথরে তৈয়ারী করা হইয়াছিল, তাহাও সর্ব্বদা ধোয়া হইত। উঠানেই ছিল স্নানের ঘর। তিন জনে এক সঙ্গে বসিয়া স্নান করিতে পারে এমন যায়গা সেখানে ছিল। দুইটা পাইখানা ছিল। বসিবার জন্য দুইটা বেঞ্চ। যাহাতে কয়েদী উপরে উঠিতে না পারে সে জন্য কাঁটাওয়ালা তারের জাল উপরে ছিল। প্রত্যেক কুঠুরীতেই বাতাস ও আলো ভাল ভাবে চলাচল করিতে পারিত। সন্ধ্যা ছয়টার সময় কয়েদীদের বন্ধ করা হইত, এবং সকালে ছয়টার সময় দরজা খুলিয়া দেওয়া হইত। দরজায় তালা দেওয়া হইত, সুতরাং কোন কয়েদীর পায়খানা ইত্যাদি যাইবার প্রয়োজন হইলেও বাহিরে যাইতে পারিত না। কুঠরীর ভিতরেই এই কাজ সারিবার জন্য ফিনাইল দেওয়া পাত্র রাখা হইত।

আহার।

 আমি বোকসরষ্টের জেলে গিয়া দেখিলাম, ভারতীয় কয়েদীরা প্রাতে ‘পূপূ’ ও দ্বিপ্রহরে এবং সন্ধ্যায় ভাত ও তরকারী পাইত। তরকারীর মধ্যে আলুই বেশীর ভাগ। ঘির সহিত মোটই সম্পর্ক ছিল না। যাহারা বিনাশ্রমে দণ্ডিত হইয়া জেলে ছিল তাহার পূর্ব্বোক্ত আহার্য্য ছাড়া প্রাতে ‘পূপূ’র সঙ্গে এক আউন্স চিনি ও দ্বিপ্রহরে কিছু রুটি পাইত। বিনাশ্রমে দণ্ডিত কয়েদীদের অনেকেই সশ্রম কারাবাসে দণ্ডিত কয়েদীদিগকে আপনাদের চিনি ও রুটি হইতে কিছু কিছু ভাগ দিত। কয়েদীদের দুই দিন মাংস খাইবার কথা, কিন্তু তাহাতে হিন্দু বা মুসলমান কাহারও লাভ হইত না, সুতরাং তাহার পরিবর্ত্তে আমাদের অন্য কিছু পাওয়া উচিত ছিল এবং ইহার জন্য আমরা আবেদন করিয়াছিলাম। তাহার পর হইতে মাংসের দিনে আমর এক আউন্স ঘি ও কিছু ‘বীন’ পাইতে লাগিলাম। তা ছাড়া জেলের বাগানে একপ্রকার তরকারি আপনা হইতে হইত, তাহা ব্যবহার করিবার অনুমতি পাওয়া গিয়াছিল। সময় সময় বাগান হইতে পিঁয়াজও আনিবার সুবিধা দেওয়া হইত। সুতরাং ঘি ও ‘বীন’ পাওয়ার পরে আমাদের আহার সম্বন্ধে আর উল্লেখযোগ্য কোন অভিযোগ থাকিল না। জোহান্সবর্গের জেলে ভোজনের অন্য প্রকার ব্যবস্থা; তরকারী দেওয়া হইত না, সন্ধ্যায় দুই দিন সবজী ও ‘পূপূ’ পাওয়া যাইত, তিন দিন বীন্, একদিন আলু ও ‘পূপূ’।

 এই আহার নিজেদের রীতি অনুযায়ী না হইলেও সাধারণ ভাবে ইহাকে মন্দ বলা চলে না। অনেক ভারতবাসীর, ‘পূপূ’ ভাল লাগিত না, এবং তাঁহারা ইচ্ছা করিয়াই থাইতেন না। কিন্তু আমার মনে হয় এটা খুব ভূল। ‘পূপূ’ মিঠা ও পুষ্টিকর খাদ্য। গমের পরিবর্ত্তে উহাকে এদেশে ব্যবহার করা যাইতে পারে, তাহাতে আবার চিনি দিলে চমৎকার স্বাদ হয়। কিন্তু বিনা চিনিতেও ক্ষুধা থাকিলে খুবই মিষ্ট লাগে। ‘পূপূ’ খাওয়ার অভ্যাস থাকিলে, পূর্ব্বোক্ত ভোজনে আর কেহ অতৃপ্ত থাকে না, সকলেরই ক্ষুধা নিবারণ হয়। শুধু তাহাই নহে, তাহাতে শরীরও হৃষ্টপুষ্ট হয়, সামান্য কিছু পরিবর্ত্তন করিয়া নিলে ইহাতেই ভরপেট খাওয়া হয়। দুঃখের বিষয় ত ইহাই যে, আমরা এরূপ বাবু হইয়া উঠিয়াছি এবং আমাদের অভ্যাস এরূপ হইয়া গিয়াছে যে যদি কোথাও নিজেদের অভ্যাসমত খাবার না জুটিল ত মেজাজ গেল বিগড়াইয়া। বোক‍্সরষ্ট জেলে আমার এই অভিজ্ঞতা হইল; ইহাতে মনে বড় ব্যথা পাইলাম। ভোজন লইয়া বিবাদ ত সর্ব্বদা উঠিত, আর “অন্নই জীবন নহে, খাওয়ার জন্য বাঁচিয়া আছি এমনও নহে” —এরূপ কথা প্রায়ই হইত। সত্যাগ্রহীদের এরূপ গণ্ডগোল করা উচিত নহে; আহার পরিবর্ত্তন করা নিজের কাজ। পরিবর্ত্তন না হইলে যাহা পাওয়া যায় তাঁহাতেই সন্তুষ্ট থাকিয়া গবর্ণমেণ্টকে দেখান চাই যে আমরা কোনও ক্ষেত্রেই পরাজয় স্বীকার করিবার পাত্র নহি। ইহাই আমাদের কর্তব্য। অনেক ভারতবাসীই খাদ্যের অসুবিধার জন্যই জেলে যাইতে ভয় পান। তাঁহাদের উচিত, বিচারপূর্ব্বক আপনাদের ভোজনলালসা সংযত করা।

সশ্রয় কারাদণ্ড

 পূর্ব্বে বলিয়াছি আমাদের সকলের মোকদ্দমা সাত দিন পর্যন্ত মুলতুবী রহিল অর্থাৎ ১৪ই অক্টোবর মোকদ্দমা আরম্ভ হইল। তখন কয়েকজনার এক মাস ও কয়েকজনার আট সপ্তাহ সশ্রম কারাদণ্ড, এই হইল বিধান। একটি ১১ এগার বছরের ছেলে ছিল, তাহাকেও “১৪ দিন বিনাশ্রমে কারাবাস” এই দণ্ড দেওয়া হইল। আমার ভয় হইল, পাছে আমার নামে মোকদ্দমা উঠাইয়া লওয়া হয়। এই ভাবিয়া আমি চটিয়া উঠিলাম। আর সকালের বিচার শেষ হইলে, ম্যাজিষ্ট্রেট অল্পক্ষণের জন্য বিচারকর্ম স্থগিত রাখিলেন। তাহাতে আমি আরও চিন্তান্বিত হইলাম। প্রথমে ত মনে হইতেছিল, আমার উপরে লাইসেন্স না দেখানের ও আঙ্গুলের টপসহি না দেওয়ার অভিযোগ আনা হইবে; শুধু তাই নয়, অন্যান্য ভারতবাসীদের ট্রান্সভালে লইয়া যাওয়ার অপরাধও তাহার সহিত যোগ করা হইবে। মনে মনে এই কথা লইয়া তোলপাড় করিতেছিলাম এমন সময় ম্যাজিষ্ট্রেট আবার আদালতে আসিলেন এবং আমার মোকদ্দমা আবার আরম্ভ হইল। আমার ২৫ পাউণ্ড জরিমানা দণ্ড হইল, জরিমানা অনাদায়ে ২ মাস সশ্রম কারাদণ্ড। ইহাতে আমি খুব খুসী হইলাম এবং নিজকে ভাগ্যবান মনে করিলাম কারণ অন্যান্য ভারতীয় ভ্রাতৃবৃন্দের সহিত একত্রে বাস করিবার সৌভাগ্য এইরূপে আমার হইল।

পরিচ্ছদ।

 দণ্ডাদেশ হইবার পর আমাদের জেলের পোষাক পরান হইল। একটা ছোট মুজবুত জাঙ্গিয়া, খদ্দরের একটি শার্ট, তাহা ছাড়া একখানি কাপড়, একট টুপি, তোয়ালে একটি, মোজা আর স্যাণ্ডাল—এইগুলি পাওয়া গেল। আমার মনে হয়, এই পোষাক কাজ করিবার সময়ে খুব উপযোগী; সাদাসিধাও বটে, আর টিকেও বেশী দিন। এরূপ কাপড় সম্বন্ধে আমাদের উল্লেখযোগ্য কোনই অভিযোগ ছিল না। সব সময় এমনধারা পোষাক জুটিলেও কোন ক্ষতি নাই। শ্বেতাঙ্গদের পোষাক অন্যপ্রকার; তাহারা ‘বৈঠকদার’ টুপি পাইত, হাঁটু পর্যন্ত মোজা, ও দুইটি তোয়ালে, তা’ ছাড়া রুমালও তাহাদের দেওয়া হইত। ভারতবাসীদের জন্যও রুমাল দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয়।

কাজ।

 যে সকল কয়েদী সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত, গবর্ণমেণ্ট তাহাদিগকে দিয়া দৈনিক নয় ঘণ্টা কাজ করাইয়া লইতে পারেন। কম্লেদীদের প্রত্যহ ৬টার সময়ে কুঠুরীতে বন্ধ করা হইত। সকালে ৫॥টায় উঠিবার ঘণ্টা বাজিত, আর ৬টায় কুঠুরীয় দরজা খুলিত। কুঠুরীতে বন্ধ করিবার ও বাহির করিবার সময় কয়েদী গোণ হইত। হাতে গোণার কাজ শীঘ্র ও ঠিক ভাবে হইয়া যায়, সেজন্য প্রত্যেক কয়েদীর উপর নিজ নিজ বিছানার পাশে সাবধানে দাঁড়াইয়া থাকিবার আদেশ ছিল। প্রত্যেককেই ৬টা বাজিবার আগে বিছানা গুটাইয়া হাতমুখ ধুইয়া তৈয়ায়ী থাকিতে হইত। সাতটার সময় কাজে হাজির হওয়ার কথা। কাজ ছিল নানারকমের। প্রথমদিন ত আমরা সদর রাস্তার উপর কতকটা খোলা জমি খুঁড়িবার কাজ পাইলাম। এই আমি বাগানের জন্য প্রস্তুত করা হইতেছিল; আমাদের প্রায় ত্রিশ জন ভারতবাসীকে এই কাজে লাগান হইল। কোন ব্যক্তি কাজ করিতে অসমর্থ হইলে তাহাকে আর কাজে যাইতে হইত না। কাফ্রিদের সঙ্গে একত্র আমাদিগকে লইয়া গেল। খুব শক্ত, তা কোদাল দিয়া খুঁড়িতে হইবে। কাজটা ছিল বেশ কঠিন, রৌদ্রও বেশ প্রখর। ছোট জেল হইতে জায়গাটা প্রায় দেড় মাইল দূরে। ভারতবাসীরা সকলে বেশ স্ফুর্ত্তির সঙ্গে চট্ করিয়া কা আর করিয়া দিলেন, কিন্তু অভ্যাস নাই—তাই সকলেই খুব ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। বাবু তালেবন্ত সিংহের পুত্র রবিকৃষ্ণও এই দলে ছিল। তাহাকে কাজ করিতে দেখিয়া আমার মন ব্যথিত হইয়া উঠিতেছিল, কিন্তু তাহার পরিশ্রম দেখিয়া আমি আনন্দও পাইতেছিলাম। দিন, যেমন বাড়িতে লাগিল, কাজের ভাযরও তেমনই শক্ত মনে হইতে লাগিল। ওয়ার্ভার ছিল একটু কড়া মেজাজের; সে সর্ব্বদা “চলাও, চলাও” চীৎকার করিতেছিল, তাহাতে ভারতবাসীরা একটু ভয় পাইয়া গেলেন। অনেককে ত আমি কঁদিতে দেখিলাম। একজনের পা ফুলিয়া উঠিয়াছে দেখিয়া আমায় বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তবু আমি সকলকেই বলিতেছিলাম—সকলেই এমন মন দিন কাজ কর যাহাতে দারোগার কথা বলিবার অবসরই না হয়। আমি নিজেও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। হাতে বড় বড় ফোস্কা পড়িয়া গেল, সেগুলি ফাটিয়া জল পড়তে লাগিল। ঝুঁকিতে কষ্ট হইতেছিল, কোদালও ভারি বোধ হইতে লাগিল। আমি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলাম, আমার মুখ রক্ষা কর; আমাকে এমন ৰল দাও কেন আমি অসমর্থ না হইয়া বারাবর কাজ করিয়া যাইতে পারি। আমি সর্ব্বদাই তাঁহার উপর বিশ্বাস রাখিয়া কাজ করিতাম। দারোগা আমাকে তাগাদা করিতে লাগিল। আমি ক্লান্ত হইলে সে কাজ করিতে বলিত। আমি তাহাকে বলিলাম, কিছু বলিবার দরকার নাই, আমি প্রাণপণে কাজ করিবার লোক ফাঁকিবাজ নহি। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ প্রাণপণ খাটিব। এই সময়ে দেখিলাম, মিঃ জিনাভাই দেশাই মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন। জায়গা হইতে নড়িবার হুকুম ছিল না, সুতরাং একটু দাঁড়াইলাম। দারোগা সেখানে গেল; আমার মনে হইল, আমার সেখানে যাওয়া উচিত। আমি দৌড়াইয়া গেলাম; আজও দুই জন ভারতবাসী আসিলেন। জিনাতাইএর মুখে জল ছিটাই দিতে, তাঁহার জ্ঞান ফিরিয়া আসিল। দারোগা আর সকলকে কাজে পাঠাইয়া দিয়া আমাকে তাঁহার পাশে বসিতে দিল। জিনাতাই সর্বাঙ্গে খুব জল ছিটাইলে পর তিনি সুস্থ বোধ করিলেন। আমি দারোগাকে জানাইলাম যে ইনি হাঁটিয়া জেলে ফিরিয়া যাইতে পারিবেন না; তখন গাড়ী আনান হইল। আমি তাঁহাকে লইয়া যাইতে আদিষ্ট হইলাম। জিনাভাইএর মাথায় জল দিতে দিতে আমার মনে হইল,—আমার কথায় বিশ্বাস রাখিয়া কত তারতবাসীই না জেল খাটতেছেন! যদি আমার পরামর্শ অন্যায় হয়, তবে কত বড় পাপী আমি! আমারই জন্য তাঁহাদিগকে এত দুঃখ সহিতে হইতেছে। এই ভাবিয়া আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। ঈশ্বর সাক্ষী করিয়া আবার চিন্তা করিতে লাগিলাম, এবং তর্কসমুদ্রে ডুব দিয়া হাসিমুখে বাহির হইলাম। আমার মনে হইল, আমি যে পরামর্শ দিয়াছি তাহা ন্যায়সঙ্গতই বটে। দুঃখ ভোগই সুখ, দুঃখের জন্য বিরক্ত হইলে চলিবে না। এখন ত শুধু মূর্চ্ছা হইল, যদি মৃত্যুও আসে তবু আমি যে পরামর্শ দিয়াছি তাহা ছাড়া অন্য পরামর্শ দিতে পারিব না। গর্ভযন্ত্রনার চেয়ে বড় এই দুঃখ ভোগ করিয়াই শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভ করা কর্তব্য। এই মনে করিয়া আমি শান্তি পাইলাম, এবং জিনাভাইকে সাহস ও ভরসা দিতে লাগিলাম।

 গাড়ী আসিলেই জিনাভাইকে তাহাতে শোয়ান হইল; গাড়ি ছাড়িয়া দিল। বড় দারোগার কাছে কথা উঠিল, তখন ছোট দারোগার চেতনা হইল। দ্বিপ্রহরে জিনাভাইকে কাজে আনা হইল না এবং আরও তিনজন ভারতবাসীকে ঐরূপ দুর্ব্বল মনে করিয়া ছুটী দেওয়া হইল। বাকী সকল কাজে আসিলেন। দ্বিপ্রহরে বারোটা হইতে একটা পর্য্যন্ত খাইবার সময়। একটা হইতে পাঁচটা পর্য্যন্ত কাজ করিতে হইত। দ্বিপ্রহরে আমাদের দেখিবার ভার শ্বেতাঙ্গের বদলে কাফ্রি দারোগার উপরে পড়িল। সে শ্বেতাঙ্গ দারোগার চেয়ে ভাল ছিল, বেশী তাগাদা করিত না, মাঝে মাঝে একটু আধটু বলিত। এই বেলা, অর্থাৎ দুপ্রহরে, কাফ্রি ও ভারতবাসীকে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাখা হইল। আমাদিগকে একটু নরম জমি খুঁড়িতে দেওয়া হইল।

 যে লোকটি এই কাজের কণ্ট্রাক‍্ট্ অর্থাৎ ঠিকা লইয়াছিল, তাহার সহিত আমার কথা হয়। সে বলিল, ভারতীয় কয়েদীদের কাজে তাহায় ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। সে স্বীকার করিল যে, একজন কাফ্রি একযোগে যতখানি শারীরিক শ্রম করিতে পারে একজন ভারতবাসী তাহা পারে না।

 আমি বলিলাম, ভারতবাসীরা কোনও দারোগার ভয়ে কাজ করিবার লোক নহে। তাহারা ঈশ্বরের ভয়ে যতখানি পারিবে ততখানি কাজ করিৰে। কিন্তু পরে আমার এই মত পরিবর্ত্তন করিতে হইল; কারণ বলিতেছি।

 দ্বিতীয় দিন আমাদের আবার কাজ করিতে বাহিরে আনা হইল, কিন্তু শেতাঙ্গ দারাগার সঙ্গে নয়, —একজন কাফ্রি দারোগার সঙ্গে। সে আগের দিনের লোকটি নয়। এ লোকটিও বেশ ভাল ছিল, আমাদের কিছুই বলিত না।

 আমরাও ভাল ছিলাম। কারণ শরীরে যতখানি কুলায় ততখানি কাজ কৱিতাম। আমাদের যে কাজ দেওয়া হইয়াছিল তাহাও ছিল সাধারণ রকমের। সদর রাস্তার উপর মিউনিসিপ্যালিটির জমিতে গর্ত্ত করিবার ও পুরাইবার কাজ ছিল; তাহাতে ক্লান্তি আসা সম্ভব। আমি অনুভব করিতাম, ভগবান আমাদের সকল কাজের সাক্ষী। আমরা কাজ চুরী করিতেছিলাম, কারণ লোকদের কাজে ঢিল দেখা যাইতেছিল। আমার মতে, এরূপ ভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়া আমাদের পক্ষে বড়ই কলঙ্কের কথা। আমাদের আন্দোলনে যে ঢিল পড়িতেছিল তাহার কারণ ইহাই। সত্যাগ্রহের পন্থা যেমন সরল তেমনি অরক্ষিত। আমাদিগকে সর্ব্বদা শুদ্ধ থাকিতে হইবে। গবর্নমেণ্টের সহিত ত আমাদের শত্রুতা নাই, তাহাকে আমি শত্রু বলিয়া মনে করি না। সরকারের সহিত বিবাদের কারণ —তাহার ত্রুটি সংশোধন করিয়া অন্যায় দূর করা। আমি তাহার অমঙ্গলে প্রসন্ন হইব না, তাহার বিপক্ষতাচরণ করিবার সময়েও তাহার মঙ্গল চাহিব। এই বিচারবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া যথাশক্তি আমাদের জেলে কাজ করা উচিত। যদি আমি বলি যে আমাকে দিয়া কাজ করানো নীতি আমি মানি না, সুতরাং যখন দারোগা দেখিব তথনই শুধু পূরা কাজ করিব, নতুবা নয়, তবে এ ভাব মনে হওয়া অনুচিত। যদি কাজ উচিত ও ন্যায়ানুমোদিত না হয় তবে দারোগাকে গ্রাহ্য না করাই উচিত। তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়ানই উচিত, এবং ইহার পরিণামে যদি দণ্ড বাড়িয়া যায় তবে তাহাও মাথা পাতিয়া লইব। কিন্তু কোন কোন ভারতবাসী একথা মানেন না। যে কাজ করে না সে শুধু কাজ এড়াইবার জন্যই এবং আলস্যবশতঃ কাজে ফাঁকি দেয়। এরূপ আলস্য ও কাজ চুরী আমাদের শোভা পায় না। সত্যাগ্রহী বলিয়া আমাকে যে কাজ দিবে তাহা আমার কন্যা উচিত। আর যদি দারোগর দিকে না চাহিয়া কাজ করা যায় তবে কোনও কষ্টই হয় না। তাই কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই অনেকের জেলে অনেক কষ্ট পাইতে হয়।

 এইবার আমি আসল কথার অবতারণা করিব। এইরূপে দিনের পর দিন কাজ সহজ হইয়া আসিল। যে দলে আমি ছিলাম, তখন তাহার উপর জেলের বাগান পরিষ্কার রাখিবার ও গাছ লাগাইবার ভাযর পড়িল। ভুট্টা বাগান, আলুর আল পরিষ্কার করা, ও মাটি দেওয়া —এই ছিল বেশীর ভাগ কাজ।

 দুই দিন পরে মিউনিসিপালিটির পুকুর খুঁড়িবার জন্য আমাদিগকে পাঠান হইল। সেখানে মাটি খুঁড়িতে হইত, মাটির ঢিপি করিতে হইত, আর সে মাটি বহিয়া অন্যস্থানে আনিতে হইত। কাজটা শক্তই ছিল। দুই দিন পর্য্যন্ত সে কষ্ট আমরা পাইয়াছিলাম। কাজে লাগার পরে আমাদের শরীর ফুলিয়া উঠিল, কিন্তু মাটিচিকিৎসায় তাহা সারিয়া গেল।

 জায়গাটা জেল হইতে ৪।৫ মাইল দূরে। আমাদের ট্রলিতে করিয়া লইয়া যাওয়া হইত। পুকুরের মধ্যেই খাবার তৈয়ারী করিতে হইবে, তাই আটা, বাসনপত্র ও কাঠ সরে লইয়া যাইতে হইত। এততেও ঠিকাদার খুসী নয়। আমরা কাফ্রিদের সমান কাজ করিতে পারিতাম না। দুই দিন খুব করিয়া পুকুরের কাজ করাইয়া লওয়া হইল, তার পর আমাদের অন্য কাজ দেওয়া হইল। এতদিন ব্যবস্থা ছিল যে, নানারকম কাজ করিতে পারিলেও ভারতবাসীদের একই কাজে লাগান হইবে। এবার হইতে তাহাদের কাজ অনুসারে ভাগ করিয়া দেওয়া হইল। কেহ কেহ সৈনিকদের সমাধির পাশে ঘাস উঠাইয়া সাজাইবার জন্য চলিয়া গেলেন, অন্য সকলকে সমাধিক্ষেত্র পরিষ্কার রাখিবার কাজে নিযুক্ত করা হইল। এইভাবে কাজ চলিল। ইতিমধ্যে বরটন মোকদ্দমার পর প্রায় ৫০ জন ভারতবাসী মুক্তি পাইলেন। তখন প্রায়ই আমাদিগকে বাগানের কাজ দেওয়া হইত। সেখানে মাটি কাটা, ফসল তোলা, জঞ্জাল একত্র করা— ইত্যাদি কাজ ছিল। একাজ শক্ত বোধ হইত না, এবং ইহাতে শরীরও ভাল হইত। একাস্বরে ৯ ঘণ্টা এই কাজ করিতে প্রথম প্রথম প্রাণ শেষ হইত, কিন্তু অভ্যাস হইয়া গেলে বিশেষ কিছু কষ্টবোধ হইত না।  এই কাজ ছাড়াও, প্রত্যেক কুঠুরিতে প্রস্রাবের জন্য যে পাত্র ছিল তাহা উঠাইয়া আনিবার ভার আমাদের উপর পড়িয়াছিল। দেখিলাম, অনেকে একাজ করিতে ঘৃণা বোধ করেন। কিন্তু বাস্তবিক, ইহাতে ঘৃণা করিবার কিছু নাই। কাজ করিতে গিয়া লজ্জা বা ঘুণা বোধ করা ভুল। বিশেষ করিয়া কয়েদীর ত বিরক্তির অবকাশই নাই। প্রায়ই দেখিতাম, কুঠুরীর প্রস্রাবের পাত্র কে উঠাইবে তাহা লইয়া কথা উঠিত। যদি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মূল কথা আমার নিকট পরিষ্কার হইয়া গিয়া থাকে তবে আর এ প্রশ্ন উঠে না, বরং কে একাজ করিবে তাহা লইয়া কাড়াকাড়ি পড়ে। যাহার উপর এই কাজের ভার পড়ে, তাহার নিজকে ধন্য মনে করা উচিত; অর্থাৎ এমন হওয়া উচিত যে, গবর্ণমেণ্ট জেলে আমায় এমন কাজ করিতে দিলে তাহাতে আমাদের মান সম্রমের কিছু হইবে না, বরং গবর্ণমেণ্টের বলার আগেই সে কাজ করিতে প্রস্তুত থাকা সব চেয়ে ভাল। যখন কষ্ট সহ্য করিতে প্রস্তুত আছি, তখন একজনকে অন্যের চেয়ে বেশী কষ্ট পাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকিতে হইবে, এবং যাহার উপর সব চেয়ে বেশী কাজের ভার পড়িবে তাহার তাঁহাতে গৌরবই বোধ করিতে হইবে। মিঃ হাসান মির্জ্জা এই আদর্শ প্রচার করিলেন। তাঁহার ফুসফুসের রোগ ছিল, শরীরও বিশেষ দুর্ব্বল; তবু তাঁহাকে যখনই যে কাজ দেওয়া হইয়াছে সে কাজ তিনি খুসী হইয়া করিতেন। শুধু তাহাই নহে, নিজের রোগও তিনি গ্রাহ্য করিতেন না। একবার একজন কাফ্রি দারোগা তাঁহাকে বড় দারোগার পায়খানা পরিষ্কার করিতে বলিয়াছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ সে কাজ করিতে স্বীকার করিলেন। পূর্ব্বে তিনি কখনও একাজ করেন নাই, তাই একাজ, করিতে করিতে তাঁহার বমি হইল, তবু তিনি পশ্চাৎপদ হইলেন না। যখন তিনি অন্য একটি পায়খানা পরিষ্কার করিতেছিলেন, তখন আমি সেখানে গিয়া পৌঁছিলাম; এ দৃশ্য দেখিয়া আমার মন প্রসন্ন হইয়া উঠিল, আমার হৃদয় তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হইল। প্রশ্ন করিয়া প্রথম পায়খানা পরিষ্কার করার কথা জানিতে পারিলাম। একবার প্রধান দারোগা সেই কাফ্রি দাবোগাকে আদেশ দিয়াছিলেন যে, ভারতবাসীদের জন্য বিশেষ করিয়া যে পায়খানা, তৈয়ার করা হইয়াছে তাহা পরিষ্কার করার জন্য ভারতবাসীদের যেন লাগান্ত হয়। দাবোগা আমার কাছে আসিয়া দুই জন লোক চাহিল। আমি ত নিজে একাজ ভাল বলিয়াই মনে করিতাম, আমার এরূপ কাজ করিতে একটুও লজ্জা হয় না, তাই আমি গেলাম। আমার মতে, আমাদের এরকম কাজ করার অভ্যাস থাকা উচিত। আমরা এসব কাজ খারাপ মনে করি, তাই নিজেদের উঠান ও পায়খানার খারাপ অবস্থা অনেকবার আমাদের চোখে পড়ে; এমন কি, এইভাবেই মৃগী প্রভৃতি অনেক মন্দ রোগের সৃষ্টি বা বিস্তার আমাদের জন্য হয়। আমরা স্থির ধারণা করিয়া বসিয়াছি যে, পায়খানা খারাপ জায়গা, তাই সেখানকার দুর্গন্ধে আমরা দূষিত হই। এই সমস্ত কাজ না করার দণ্ডস্বরূপ একজন ভারতবাসীকে নির্জ্জন কারাকক্ষে রাখিবার আদেশ হইয়াছিল। দণ্ড পাইল, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না, কিন্তু এই দণ্ডভোগের কোনও প্রয়োজনই ছিল না, আর একাজ করিতে দ্বিধা বোধ করাও ঠিক নয়। যখন আমি একাজ করিতে প্রস্তুত হইলাম, তখন দারোগা অন্য সকলকেও একাজে আসিতে বলিল। পূর্ব্বোক্ত আদেশের কথা সকলের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল, এবং কাজ অতি সামান্য হইলেও মিঃ উমর ওস‍্মান ও মিঃ রুস্তম আমার সাহায্যের জন্য ছুটিলেন। এ কথার উল্লেখ করিয়া শুধু ইহাই দেখাইতে চাই যে, গবর্ণমেণ্ট যে কাজ করাইতে চাহিয়াছিলেন ইঁহারা সে কাজ করিতে কোনই সঙ্কোচ বোধ করেন নাই, গৌরবই বোধ করিয়াছিলেন। যে কাজ দেওয়া হয় তাহা করিতে অস্বীকার করিলে আমরা সত্যাগ্রহের অনুপযুক্ত হইয়া পড়ি।

জোহান্সবর্গে বদলী।

 এতক্ষণ বোক‍্সরষ্ট জেলের কথা বলিতেছিলাম, এখন তাহার পরের ঘটনা বলি। আমাকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, সমস্ত সময়টাই বোক‍্সরষ্ট জেলে কাটাইতে হয় নাই। কিছুদিন পরে হঠাৎ আমাকে জোহান্সবার্গ জেলে লইয়া যাওয়া হইল, সেখানে যাহা ঘটিয়াছিল তাহা উল্লেখযোগ্য। ২৫শে অক্টোবর আমাকে সেখানে লইয়া যাওয়া হইল, কারণ একটি মোকদ্দমায় আমার সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়। আমার মনে হইতেছিল, ইহা ছাড়া অন্য কারণও আছে। আমাদের সকলেরই মনে মনে খুব আশা ছিল, সুতরাং ভাবিলাম,—হয়ত বা মিঃ স্মাট‍্স্ এর সহিত কোনও একটা আলোচনা হইবে। কিন্তু পরে দেখিলাম, সে সব কিছুই নয়। আমাকে লইয়া যাইবার জন্যই জোহান্সবর্গ হইতে এক দাবোগাকে বিশেষ করিয়া পাঠান হয়। আমার ও তার জন্য ট্রেণে একটি কামরা দেওয়া হইয়াছিল। সেকেণ্ডক্লাসের টিকিট ছিল, কারণ সে ট্রেণে থার্ড ক্লাসের গাড়ীই ছিল না। আমি জানিতাম, তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতেই কয়েদী লইয়া যাওয়া হয়। ট্রেণেও আমার কয়েদীর পোষাক ছিল। আমার জিনিষপত্র আমাকেই বহিয়া নিতে হইল। জেলখানা হইতে ষ্টেশন পর্য্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইয়াছিল, জোহান্সবার্গে পৌছিলে সেখান হইতে জেল পর্যন্ত বোঝা বহিয়া যাইতে হইল। এই ঘটনায় কাগজে খুব আন্দোলন হয়। পার্লামেণ্টে পর্যন্ত প্রশ্ন উঠে। অনেকেই এ ঘটনায় ব্যথা পাইয়াছিলেন। সকলের মনে হইল, আমার মত রাজনৈতিক কয়েদীকে সাধারণ কয়েদীর পোষাকে লইয়া যাওয়া ও বোঝা বহান অন্যায়।

 যথন মিঃ আঙ্গলিয়া শুনিলেন যে আমাকে এইভাবে যাইতে হইবে, তখন তাঁহার চোখে জল আসিল। এই ঘটনা হইতে তখন বুঝিলাম, লোকের মনে কষ্ট হইয়াছে। মিঃ নায়ডু ও মিঃ পোলক সংবাদ পাইয়াছিলেন, তাঁহারা ষ্টেশনে আসিয়া জুটলেন। আমার এই অবস্থা দেখিয়া তাঁহাদের কান্না পাইল। এই সকল কান্নাকাটির কোনও কারণ ছিল না। এ দেশে রাজনৈতিক ও সাধারণ কয়েদীর-মধ্যে প্রভেদ রাখা গবর্ণমেণ্টের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের যত বেশী কষ্ট দেওয়া হইবে এবং যত কষ্ট আমরা ভোগ করিব, তত শীঘ্রই মুক্তি আসিবে। আর আমার মনে হয়, জেলের পোষাক পরায় ও বোঝা বহায় কোনও কষ্টই নাই। কিন্তু জগৎ এমনই যে এ কথা বোঝে না। এই ঘটনায় ইংলণ্ডে বেশ আন্দোলন হইল।

 পথে দাবোগার জন্য কোনও কষ্টই হয় নাই। ঠিক করিয়াছিলাম, দারোগা নিজে যদি বিশেষ অনুমতি না দেন, তবে জেলে ছাড়া অন্য কোথাও কিছু খাইব না। জেলের খাবারের উপরেই এ পর্যন্ত নির্ভর করিয়া আসিয়াছি। রাস্তার জন্য সঙ্গেও খাবার লওয়া হয় নাই। দাবোগা স্বেচ্ছায় আমাকে খাওয়া দাওয়ার অনুমতি দিলেন। ষ্টেশন মাষ্টার আমাকে কিছু পয়সা দিতে চাহিলেন; তাঁহার সহানুভূতির আতিশয্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলাম, কিন্তু পয়সা লইতে সম্মত হইলাম না। মিঃ কাজীও ষ্টেশনে ছিলেন, তাঁহার নিকট হইতে ১০ শিলিং লইলাম। আমার এবং দারোগার জন্য তাঁহার নিকট হইতে খাবারও লইলাম।

 সন্ধ্যার কাছাকাছি জোহান্সবর্গে পৌঁছিলাম। দারোগা আমাকে ভারতবাসীদের সহিত মিশিতে না দিয়া চুপে চুপে লইয়া গেলেন। জেলের যে কুঠুরীতে রুগ্ন কাফ্রি কয়েদীরা ছিল, সেখানে আমার বিছানা পাতা হইল। সে রাত্রি অত্যন্ত উদ্বেগে ও চিন্তায় কাটিল। আমাকে অন্য ভারতবাসীর কাছে লইয়া যাইবে, এ কথা আমার জানা ছিল না; আমার ধারণা ছিল, এই খানেই আমাকে রাখিবে। এই ভাবনায় আমি ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলাম। তবু প্রাণপণে স্থির করিলাম, যাহা কিছু দুঃখ আসে তাহা সহ্য করিতেই হইবে। আমার কাছে ভগবদ‍্গীতা ছিল; পড়িলাম। সেই সময়ের উপযোগী শ্লোকগুলি পড়িয়া ও চিন্তা করিয়া আমার হৃদয় শান্ত হইল। আমার ভয়ের কারণ,—পাছে লোেকে আমাকে কাফ্রি বা চীনা, জংলী, খুনী, দুর্নীতিপরায়ণ কয়েদী বলিয়া মনে করে। তাহাদের কথা আমি বুঝিতে পারি নাই। কাফ্রিরা আমার সহিত কথা আরম্ভ করিয়া দিল, তাহাদের কথার মধ্যে বিদ্রুপের আভাস দেখিলাম। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না, আমি কথার কোনও উত্তর দিলাম না। তাহারা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে জিজ্ঞাসা করিল, “তোকে এখানে কেন আনা হইয়াছে?” আমি যা’ তা’ একটা উত্তর দিয়া চুপ করিলাম। একজন চীনা তখন প্রশ্ন আরম্ভ করিল, তাহা আরও খারাপ লাগিল। বিছানার সামনে আসিয়া সে আমার পানে কট‍্মট্ করিয়া তাকাইয়া থাকিল। আমি চুপ করিয়া রহিলাম; তখন সে কাফ্রিদের বিছানার দিকে গেল; সেখানে দুইজন লোক অন্য একজনের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, এবং পরস্পরের দোষ দেখাইতেছে। মনে হইতেছিল, ইহারা দুইজন খুনী বা ডাকাত। দেখিয়া শুনিয়া আমার ঘুম উড়িয়া গেল। কাল সকল কথা গবর্ণরকে জানাইব স্থির করিলাম। অনেক রাত্রে তন্দ্রা আসিল।

 ইহাই ত প্রকৃত কষ্ট; ইহার তুলনায় মোট বহা ত কিছুই নয়। আমার যে অভিজ্ঞতা হইল, অন্যান্য ভারতীয়দেরও ঐরূপ অভিজ্ঞতাই হইয়া থাকে; উহারাও এইরূপ ভয় পায়। এই কথা মনে করিয়া, আমিও ঐরূপ কষ্ট ভোগ করিয়াছি ইহা ভাবিয়া আমি খুসী হইলাম। আমি ভাবিলাম, এই অভিজ্ঞতা লইয়া আমি গবর্ণমেণ্টের সহিত আরও জোরে পড়িতে পারিব আর জেলে আসিয়া এই বিষয়ের সংস্কার করাইব। এসকল সত্যাগ্রহ সংগ্রামের গৌণ ফল। পরদিন শয্যাত্যাগ করিতেই আমাকে অন্যান্য ভারতীয় কয়েদীর কাছে লইয়া যাওয়া হইল। সুতরাং গবর্নরকে এ বিষয়ে বলার অবকাশ মিলিল না। তথাপি আমার মনে এই চিন্তা হইল যে, এইরূপে ভারতবাসী ও কাফ্রি কয়েদী যাহাতে একত্র রাখা না হয় সেজন্য আন্দোলন করিতে হইবে। আমার যাওয়ার সময় জন পনের কয়েদী সেখানে ছিল—তার মধ্যে তিন জন ছাড়া আর সকলেই সত্যাগ্রহী। সে তিনজন অন্য অপরাধে অভিযুক্ত, তাহারা কাফ্রিদের সঙ্গেই থাকিত। আমি গেলে পর বড় দারোগা আদেশ দিলেন যে আমাদের সকলের জন্য পৃথক কুঠুরী দেওয়া হউক। আক্ষেপের বিষয়, দেখিলাম অনেক ভারতীয় কয়েদী কাফ্রিদের সহিত শুইতে ভালই বাসিত, কারণ সেখানে প্রহরীর দৃষ্টি এড়াইয়া তামাকটা আসটা আসিতে পারিত। আমাদের পক্ষে এটা লজ্জার কথা, কাফ্রি বা অন্য কাহাকেও ত’ ঘৃণা করি না, কিন্তু এ কথাও ভোলা যায় না যে তাহাদের ও আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন আহারের মধ্যে মিল নাই। আবার, যাহারা তাহাদের সহিত বাস করিতে চাহিত তাহারাও স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এরূপ করিত। এরূপ কোন ভাব আমাকে কোন কাজে উদ্বুদ্ধ করিলে সে ভাব মন হইতে দূর করিয়া দেওয়াই উচিত।

 জোহান্সবর্গের জেলে আর একটি বিষয় আমাকে কষ্ট দিয়াছিল। এখানে জেলের দুইটি পৃথক্ পৃথক্ বিভাগ ছিল। একটিতে থাকিত সশ্রম দণ্ডে দণ্ডিত ভারতীয় ও কাফ্রিরা, অন্যটীতে বিনাশ্রমে দণ্ডিত কয়েদী রাখা হইত। সশ্রম দণ্ডে দণ্ডিত কয়েদীদের সেখানে যাইবার অধিকার ছিল না। আমরা দ্বিতীয় বিভাগে শুইতাম, কিন্তু সেখানকার পায়খানা ইত্যাদি ব্যবহার করিবার অধিকার আমার ছিল না। প্রথম বিভাগে কয়েদীদের সংখ্যা এত বেশী যে, সেখানে পায়খানায় যাওয়া একটু কষ্টকর ব্যাপার। অনেক ভারতবাসীই এইজন্য খুব কষ্ট পাইতেন, তাহার মধ্যে আমিও একজন। দারোগা বলিল, আমি দ্বিতীয় বিভাগের পায়খানায় গেলে কোন ক্ষতি নাই, —সুতরাং আমি তাহাই গেলাম। সেখানেও খুব ভিড়, পায়খানাও খোলা,—দরজা নাই। আমি বসিতেই এক লম্বা চওড়া, রুক্ষ্মদর্শন, বিকটাকার কাফ্রি অসিয়া আমাকে উঠিতে বলিল ও গালি দিতে লাগিল; আমি বলিলাম, এখনই উঠিতেছি। কিন্তু ইহাতেও সে হাত ধরিয়া উঠাইল এবং বাহিরে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। ভাগ্যক্রমে চৌকাট ধরিয়া ফেলায় মাটীতে পড়িয়া গেলাম না। আমি ইহাতে অস্থির হই নাই, হাসিয়া চলিয়া যাইতেছিলাম, কিন্তু কয়েকজন ভারতবাসী আমার অবস্থা দেখিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। জেলে তাহারা ত’ কোন সাহায্যই করিতে পারিত না, তবে নিজেদের নিরুপায় অবস্থা দেখিয়া রাগিয়া উঠিত অবশ্য। পরে বুঝিলাম, অন্য ভারতবাসীরও ত’ এইরূপ দুঃখ ভোগ করিতে হয়। এ বিষয়ে গবর্ণরের সহিত আমার কথাবার্ত্তা হইল, বলিলাম—ভারতবাসীদের জন্য আলাদা পায়খানা করিয়া দেওয়া দরকার; আর, কাফ্রি কয়েদিদের সঙ্গে ভারতবাসীদের যেন কখনও একত্র, রাখা না হয়। গবর্ণর তখনই বড় জেলের ছয়টি পায়খানা ভারতীয় কয়েদীর জন্য আলাদা করিয়া রাখিবার আদেশ দিলেন। তখন হইতে এ কষ্ট দূর হইল। চারদিন পায়খানা যাইতে না পাইয়া আমারও শরীর যথেষ্ট খারাপ হইয়াছিল।

 জোহান্সবর্গে থাকিবার সময় আমাকে তিন চার বার আদালতে যাইতে হয়; সেখানে মিঃ পোলক ও আমার পুত্রের সহিত দেখা করিবার অনুমতি পাইয়াছিলাম; কখনও কখনও অন্য কাহারও সঙ্গে দেখা হইত। আদালত আমাকে বাড়ী হইতে খাবার আনিবার আদেশও দিয়াছিলেন, তাঁহাতে মিঃ কেলেনবেক আমার জন্য রুটী, পনীর প্রভৃতি আনিয়া দিতেন।  আমি এই জেলে থাকিবার সময় সত্যাগ্রহী কয়েদীর সংখ্যা খুব বাড়িয়া গেল। একবার ত’ পঞ্চাশের উপর উঠিল। অনেককেই পাথরে বসিয়া ছোট একটি হাতুড়ি দিয়া পাথর ভাঙ্গিবার কাজ দেওয়া হইয়াছিল। ৮।১০ জনকে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করিবার কাজ দেওয়া হইল। আমাকে কলে টুপি সেলাই করিতে দেওয়া হইয়াছিল। কলের কাজ এইখানেই আমি প্রথম শিখিলাম। কাজটা সহজই ছিল, শিখিতে দেরী হইল না। অধিকাংশ ভারতবাসীকেই পাথর ভাঙ্গার কাজে লাগান হইয়াছিল, সুতরাং আমিও এই কাজ করিতে চাহিলাম। কিন্তু দারোগা বলিল, “আমাকে বড় দারোগা নিযেধ করিয়া দিয়াছে যেন তোমাকে বাহিরে লইয়া না যাই।” সে আমাকে পাথর ভাঙ্গিতে যাইতে দিল না। একদিন আমার মেশিনে বা হাতে সেলাই করার কোনও কাজই ছিল না, তখন আমি পড়িতে লাগিলাম। নিয়ম আছে যে প্রত্যেক কয়েদীকেই জেলে কোন না কোন কাজ করিতে হইবে। দারোগা আমাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“কি, তোমার আজ অসুখ করিয়াছে?” উত্তর দিলাম, “না, মহাশয়”; “তবে কাজ করিতেছ না কেন?” উত্তর দিলাম, “আমার যা’ কাজ ছিল তা শেষ হইয়া গেছে—আমি কাজের ছুতা করিতে চাহি না;—কাজ দাও, করিতে প্রস্তুত আছি, যখন কোনও কাজ নাই, তখন পড়িলে ক্ষতি কি?”

 সে বলিল—“তা ঠিক; তবে যখন বড় দারোগা বা গবর্ণর আসিবেন তখন তুমি ষ্টোরে থাকিলে ভাল হয়।”

 না, আমি তাহাতে রাজী নই। আমি ত’ গবর্ণরকেও বলিয়াছি ষ্টোরেও পুরা কাজ আমার থাকে না—আমাকে কাঁকড় ভাঙ্গিতে পাঠাইয়া দেওয়া হোক না।” “সে খুব ভালই হয়, কিন্তু আমি ত’ আর বিনা হুকুমে তোমাকে কাঁকড় ভাঙ্গিতে পাঠাইতে পারি না।”  ইহার কিছুক্ষণ পরেই গভর্ণর আসিলেন, আমি তাহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। তিনি কাঁকর ভাঙ্গিতে যাইবার আদেশ দিলেন না, বলিলেন, “তোমার সেখানে যাইবার কোনই দরকার নাই, কালই তোমাকে বোকসরষ্ট যাইতে হইবে।”

ডাক্তারী পরীক্ষা

 বোকসরষ্টের জেলটি ছোট, এই জন্য এখানে কতকগুলি সুবিধা মিলিত যাহা জোহান্সবর্গে পাওয়া যাইত না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে, এখানে মিঃ দাউদ মহম্মদ ওভৃতি কয়েকজনকে পায়জামা পরিতেও দেওয়া হইত, মিঃ রস্তমজী, মিঃ সোরাবজী, মিঃ সাপ্রুকে নিজেদের টুপি পরিতে দেওয়া হইত। কিন্তু জোহান্সবর্গ জেলে আরও একটি অসুবিধা ছিল। সেখানে যখন কয়েদী প্রথম ভর্ত্তি হইত, তখন ডাক্তার পরীক্ষা করিতেন। উদ্দেশ্য, যদি কোনও কয়েদীর সংক্রামক রোগ থাকে, তবে তাহাকে ঔষধ দেওয়া ও পৃথক করিয়া রাখা হইবে। সুতরাং মাঝে মাঝে কয়েদীর পরীক্ষা হইত। অনেকেরই চুলকানি ইত্যাদি ছিল। কয়েদীদের দেহ উলঙ্গ করিয়া সর্ব্বাঙ্গ পরীক্ষা করা হইত। ডাক্তারের সময় কম বলিয়া কাফ্রিদের ত’ ১৫ মিনিট পর্যন্ত সকলকেই নগ্ন অবস্থায় দাঁড় করাইয়া রাখা হইত। ডাক্তার কাছে আসিলে ভারতবাসিদিগকে জাঙ্গিয়া খুলিতে হইত। প্রায় সকল ভারতবাসীই জাঙ্গিয়া খুলিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিতেন—অনেকে সত্যাগ্রহের অনুরোধে চুপ চাপ করিয়া থাকিলেও মনে মনে নিশ্চয়ই কষ্ট পাইতেন। ডাক্তারকে এ বিষয়ে বলিলাম, তিনি কয়েকজনকে ষ্টোরের ভিতর লইয়া গিয়া পৃথক্ পৃথক্ পরীক্ষা করিলেন, কিন্তু সর্ব্বদা এরূপ করিতে অস্বীকার করিলেন। এসোশিয়েশন্এ বিষয়ে লেখালেখি করিয়াছিল, এবং ব্যাপারটা আজ পর্যন্ত (১৯০৮) বিচারাধীন রহিয়াছে। এ বিষয়ে একটা প্রতীকার করা উচিত। বহুদিন ধরিয়া যে রীতি চলিয়া আসিয়াছে তাহা হঠাৎ বদলানের দরকার নাই, তবু এ বিষয়ে বিচার করা উচিত। পুরুষদের পক্ষে না হয় খুব বেশী প্রয়োজন নাই হইল, তাই বলিয়া নিজকে এরূপ ভাবে পরীক্ষা করিতে দেওয়ার পক্ষেও খুব যুক্তি নাই। অবশ্য, মিথ্যা লজ্জার কারণ কিছু নাই। যদি মন পবিত্র থাকে, তবে এরূপ নগ্নতার মধ্যে লজ্জার কি আছে? জানি, আমার এই মত প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছেই বিচিত্র বলিয়া মনে হইবে। তথাপি, এ বিষয়ে গভীর চিন্তার প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে আপত্তি করায় আমাদের সত্যাগ্রহধর্ম্মের ক্ষতি হইবে। আগে ত’ ভারতীয় কয়েদীর মোটেই পরীক্ষা হইত না। একধার ২।৩ জন ভারতবাসী রোগ থাকা সত্ত্বেও বলিয়াছিল যে তাহাদের কোন রোগ নাই; ডাক্তারের সন্দেহ হওয়ায় ডাক্তার পরীক্ষা করেন, তখন রোগ ধরা পড়ে। সেই সময় হইতে ডাক্তার, ভারতবাসীদেরও পরীক্ষা করিবেন স্থির করিয়াছেন। ইহাতেই বোঝা যায়, অধিকাংশ স্থলে আমরা নিজেরাই বিপদ ডাকিয়া আনি।

জোহান্সবর্গ হইতে প্রত্যাগমন।

 ৪ঠা নভেম্বর আমি আবার বোকসরষ্ট জেলে ফিরিয়া আসিলাম। এবারও আমার সঙ্গে একজন দারোগা ছিল, পোকও কয়েদীর মত ছিল, এবার আমাকে পায়ে না হাঁটাইয়া, গাড়ীতে করিয়া ষ্টেশনে আনা হইল, কিন্তু টিকিট ছিল তৃতীয় শ্রেণীর, দ্বিতীয় শ্রেণীর নয়। পথে খাইবার জন্য আমাকে আধ পাউণ্ড (প্রায় এক পোয়া) রুটী ও গো-মাংস দেওয়া হইল। আমি গো-মাংস লইতে অস্বীকার করিলাম। তখন দারোগা আমাকে পথে অন্য জিনিষ খাইবার অনুমতি দিল। ষ্টেশনে অনেক ভারতীয় দরজি দেখিলাম। তাহারাও আমাকে দেখিল, কিন্তু কথা বলা মানা ছিল। আমার পোষাক দেখিয়া তাহাদের চোখে জল আসিল। পোষাক সম্বন্ধে ভাল মন্দ বলার অধিকার ত’ আমার ছিল না, আমি তাই চুপ করিয়াছিলাম। আমি ও দারোগা একটি আলাদা কামরায় উঠিলাম। পাশের গাড়ীতে একজন দরজি ছিল, সে নিজের খাবার হইতে আমাকে কিছু দিল। হেডেলবার্গে মিঃ শোভাভাই পেটেল আসিলেন, ষ্টেশন হইতে তিনি কিছু খাবার আনিয়া দিলেন। যাঁহার নিকট হইতে তিনি খাবার আনিলেন তিনি সত্যাগ্রহের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ মূল্য নিতে চাহিলেন না, মিঃ শোেভাভাই বিস্তর পীড়াপীড়ি করাতে মূল্য স্বরূপ নাম মাত্র ছয় পেনী লইলেন। মিঃ শোভাভাই ষ্টাণ্ডারটনে টেলিগ্রাম করিয়াছিলেন, তাই অনেক ভারতবাসীই ষ্টেশনে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা সঙ্গে খাবার আনিয়াছিলেন, সুতরাং পথে দারোগার ও আমার খাওয়াটা বেশ ভালই। হইয়াছিল।

 বোকসরষ্টে পৌঁছাইতেই মিঃ নঙ্গদী ও মিঃ কাজী আসিলেন। তাঁহারা আমাদের সঙ্গে কিছু দূর গেলেন। একটু তফাতে তফাতে চলিবেন, এই অনুমতি তাঁহারা পাইয়াছিলেন। ষ্টেসন হইতে আবার আমাকে জিনিষ পত্র বহিয়া লইয়া যাইতে হইয়াছিল। খবরের কাগজে এ সম্বন্ধে যথেষ্ট আলোচনা হয়। বোকসরষ্টে আমাকে আবার আসিতে দেখিয়া ভারতবাসীরা সকলেই খুব সুখী হইলেন। সেই রাত্রে আমাকে মিঃ দাউফ মহম্মদের কুঠুরীতে বন্ধ করা হয়। আমরা দুজনে নিজেদের কথা বলিয়া অনেক রাত্রি কাটাইলাম।  বোকসরষ্টে কখন ফিরিয়া গেলাম, তখন দেখি, ভারতীয় কয়েদীদের চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। ৩০ জনের স্থানে ৭৫ জন হইয়াছে। এই জেলে এতগুলি কয়েদীর স্থান ছিল না, তাই আটটি বাসা তৈরী করা হইয়াছিল। রাঁধিবার জন্য প্রিটোরিয়া হইতে উনন আসিল। জেলের পাশে নদী ছিল, কয়েদীরা সেখানে স্নান করিতে পারিতেন; তখন তাঁহার কয়েদী বলিয়া মনে হইত না, মনে হইত যেন সিপাহীরাই স্নান করিতেছে, সেটা যেন জেলখানা নয়, সত্যাগ্রহ আশ্রম। দারোগা কষ্ট দিতেছে কি সুখ দিতেছে তাহা ভাবার সময়ই জুটিত না। বাস্তবিক পক্ষে, অধিকাংশ দারোগাই মোটের উপর সজ্জন ছিল। মিঃ দাউদ মহম্মদ সকল দারোগারই একটা না একটা নাম রাখিয়াছিলেন, কাহাকেও ডাকিতেন “উকলী”, কাহাকে বা “মকুটী”। এইরূপ প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক নাম ছিল।

দেখা সাক্ষাৎ

 বোকসরষ্ট জেলে দেখা করিবার জন্য ভারতবাসী অনেকেই আসিতেন। মিঃ কাজী ত প্রায়ই আসিতেন এবং কয়েদীরা কিসে আনন্দে থাকে তাহার ব্যবস্থা তিনি খুবই করিতেন। অন্য যাহারা দেখা করিতে আসিত তাহাদের যাহাতে দেখাশোনার সুযোগ হয় সেজন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। মিঃ পোলক কার্যোপলক্ষে প্রতি সপ্তাহেই দেখা করিতে আসিতেন। নেটাল হইতে মিঃ মহম্মদ ইব্রাহিম ও মিঃ খরসানী কংগ্রেসের প্রধান শাখার চাঁদা আদায়ের জন্য বিশেষ ভাবে আসিয়াছিলেন। ইদের দিন ত’ প্রায় শতাবধি ভারতবাসী তাঁহাদের নেটালের বন্ধুদের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন, সেদিন টেলিগ্রাফের সংখ্যা দেখে কে?

বিবিধ।

 জেলে সাধারণতঃ খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে থাকা যায়; এরূপ ব্যবস্থা না থাকিলে রোগ সহজেই সংক্রামক হইয়া উঠিতে পারিত। তথাপি অনেক বিষয়ে অপরিচ্ছন্ন ভাব দেখা যাইত। গায়ে দিবার কম্বল প্রায়ই অদল বদল হইত, এমন কি, কাফ্রিদের গায়ে দেওয়া খুব ময়লা কম্বলও মাঝে মাঝে ভারতবাসিদের ভাগ্যে জুটিত। সেগুলি প্রায়ই থাকিত উকুণে ভরা, দুর্গন্ধও বাহির হইত খুব। রৌদ্র উঠিলে সেগুলি প্রায়ই আধঘণ্টা ধরিয়া রৌদ্রে রাখিতে হইবে, ইহাই ছিল নিয়ম। কিন্তু এ নিয়ম কখনও পালন করা হইত কি না সন্দেহ। যারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিতে ভালবাসে, তাহাদের পক্ষে এই গোলমাল নিতান্ত সামান্য কথা নয়। পরণের কাপড়েরও অনেক সময়, এইরূপ দশা হইত। কয়েদীদের মুক্তির সময় তাহাদের পরিত্যক্ত কাপড় প্রায়ই ধোওয়া হইত না, সেই ময়লা কাপড়ই নূতন কয়েদীকে দেওয়া হইত। ইহা বড় ঘৃণার কথা।

 জেলে কয়েদীদিগকে যেমন তেমন ভাবে রাখা হইত। জোহান্সবর্গে স্থান ছিল দুই শত কয়েদীর, কিন্তু ঠাসা হইয়াছিল চারিশত। প্রত্যেক কুঠুরীতে যত লোক রাখার নিয়ম, তাহার দ্বিগুণ কয়েদী প্রায়ই রাখা হইত, সময় সময় তাহারা প্রয়োজনমত কম্বলও পাইত না। এ কষ্ট নিতান্ত সামান্য নহে। কিন্তু প্রকৃতির বিধান এমনই যে নির্দ্দোষ ব্যক্তি, যে অবস্থায়ই পড়ুক না, আত্মরক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহার থাকিয়া যায়। ভারতীয় কয়েদীদের অবস্থাও তদ্রুপ হইয়াছিল। এমন বিপদেও তাঁহারা প্রসন্ন থাকিতেন, আর মিঃ দাউদ মহম্মদের মুখে ত চব্বিশ প্রহর হাসি, লাগিয়াই আছে। শুধু তাই নয়, তিনি হাসি ঠাট্টা করিয়া অন্য সকল ভারতবাসীকেও হাসাইতেন।

 দুঃখ করিবার মত একটি ঘটনা জেলে ঘটিয়াছিল। একদিন কয়েকজন ভারতবাসী একস্থানে বসিয়াছিলেন, এমন সময় জনৈক কাফ্রি দারোগা আসিয়া ঘাস কাটিবার জন্য দুই জন লোক, চাহিল। কতকক্ষণ কেহই উত্তর দিল না, তখন মিঃ ইমাম আবদুল কাদির যাইতে প্রস্তুত হইলেন। তখনও তাঁহার সঙ্গে যাইবার জন্য কেহ উঠিল না। সকলেই দারোগাকে বলিতে আরম্ভ করিল, ইনি আমাদের ইমাম সাহেব, ইঁহাকে লইয়া যাইও না। একথা বলায় ব্যাপারটা আরও খারাপ হইল। একে ত সকলেরই ঘাস কাটিতে প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল, সে কথা যাক্। যখন স্বজাতির নাম রাখিবার জন্য ইমাম সাহেব দাঁড়াইলেন, তখন ইহারা তাঁহার পদ প্রতিষ্ঠার পরিচয় দিল। তিনি ঘাস কাটিবার জন্য তৈয়ারী, আর কেহ নয়, ইহা দেখাইয়া তাহারা নিজেদের নির্লজ্জতারই পরিচয় দিল।

ধর্ম্ম সঙ্কট।

 আমার অর্দ্ধেক দণ্ডভোগ শেষ হইয়াছে এমন সময়ে ফিনিক্স হইতে টেলিগ্রাম আসিল যে, মিসেস্ গান্ধীর শরীর অসুস্থ। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত, এজন্য আমার যাওয়া উচিত। সকলেই এ সংবাদে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। আমি দ্বিধার মধ্যে পড়িলাম, ভাবিলাম—এখন আমার কর্তব্য কি? জেলার জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি জরিমানা দিয়া যাইতে চাও?” আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম, “জরিমানা ত আমি কোনও অবস্থায়ই দিতে পারি না, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ সহ্য করাও আমার সত্যাগ্রহ সংগ্রামের একটি অঙ্গ।” এ কথা শুনিয়া জেলর হাসিল, একটু বিরক্তও হইল। সাধারণ ভাবে দেখিলে আমার এ সিদ্ধান্ত নিষ্ঠুর বলিয়া মনে হইবে। কিন্তু আমার ধ্রুব বিশ্বাস,—ইহাই সত্য ও শ্রেয়স্কর। স্বদেশপ্রেমকে আমি আমার ধর্ম্মের একটি অঙ্গ মনে করি। তাহাতে শুধু ইহাই বোঝায় না, যে, স্বদেশপ্রেমেই ধর্ম্মের সকল অংশের সমাবেশ আছে; কিন্তু একথাও বুঝিতে হইবে যে, স্বদেশপ্রেম ব্যতীত ধর্ম্ম পূর্ণ হইতে পারে না। ধর্ম্ম পালনের জন্য যদি স্ত্রীপুত্র বিয়োগ সহ্য করিতে হয়, তবে তাহাও সহা উচিত। তাহাদের সঙ্গ যদি চিরকালের জন্য হারাইতে হয়, তাহা হইলেও এই পথে চলিতে হইবে; ইহাতে লেশমাত্র নিষ্ঠুরতা নাই। ইহা ত’ স্বদেশপ্রেমিকের কর্তব্যই। যখন আমাকে আমরণ সংগ্রাম করিতে হইবে, তখন ইহা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তাকে মনে স্থান দেওয়া উচিত নহে। যেদিন তাঁহার একমাত্র পুত্রের মৃত্যুসংবাদ আসিল, সেদিন তাহার করণীয় শেষ হইয়া আসিলেও লর্ড রবার্ট‍্স্ কাজ করিতেছিলেন, এবং একমাত্র পুত্রের দেহ সমাধিস্থ করিবার সময়ও যোগ দিতে পারেন নাই, কারণ তিনি যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। এরূপ উদাহরণ জগতেব ইতিহাসে বিরল নহে।

কাফ্রিদের ঝগড়া।

 জেলে অনেকগুলি খুনী কাফ্রি ছিল। তাহারা প্রায়ই লড়াই-ঝগড়া করিত, এমন কি, কুঠুরীতে বন্ধ করিয়া দিলেও ক্ষান্ত হইত না। কখনও কখনও ত’ দারোগাকেও অপমান করিত। কয়েদীরা দারোগাকে দুইবার মারিয়াও ছিল। এরূপ কয়েদীর সঙ্গে ভারতবাসীদের একত্র রাখিলে কি কুফল হয় তাহা ত’ স্পষ্টই বুঝা যায়। সৌভাগ্যের বিষয়, ভারতবাসীদের এরূপ নীচতা এপর্যন্ত দেখা যায় নাই। কিন্তু যতদিন গভর্ণমেণ্টের আইনে কাফ্রিদের সহিত ভারতবাসীকে একসঙ্গে গণনা করিবার ব্যবস্থা, ততদিন এই অবস্থায় বিপদের সম্ভাবনা আছে।

জেলে স্বাস্থ্য

 জেলে অধিকাংশ কয়েদীরই বিশেষ কোন রোগ ছিল না। মিঃ মাওজীর কথা প্রথমে বলিয়াছি। মিঃ রাজু নামে একজন তামিল (মান্দ্রাজী) আমাদের মধ্যে ছিলেন। একবার তাঁহার খুব রক্তামাশয় হয় —তিনি অজ্ঞান হইয়া পড়েন। তাহার কারণ তাঁহার মুখে শোনা গেল, প্রত্যহ ৩০ কাপ্ (পেয়ালা) চা পান করা তাঁহার অভ্যাস ছিল। জেলে আর চা কোথায়, তাই তাঁহার অসুখ বাড়িয়া উঠিল। চা পাওয়ার চেষ্টাও তিনি কৰিলেন, কিন্তু পাওয়া গেল না। তাহার বদলে ঔষধ পাওয়া গেল, এবং জেলের ডাক্তার তাঁহাকে ২ পাউণ্ড দুধ ও রুটি দিবার হুকুম দিলেন। ইহাতে, তিনি সুস্থ হইয়া উঠিলেন। মিঃ রাধাকৃষ্ণ তালেবন্ত সিংহের শরীর শেষ পর্যন্ত খারাপই রহিল। মিঃ কাজী ও মিঃ বাওজীব্ শেষ পর্যন্ত রোগে ভুগিলেন। মিঃ রতনথী সোঢ়া চাতুর্ম্মাস্য ব্রত পালন করিতেছিলেন ও একাহারী ছিলেন, ভাল খাবার না পাওয়ায় তিনি ক্ষুধিতই থাকিতেন। কিন্তু তিনিও শেষাশেষি ভাল হইয়া উঠিলেন। তাহা ছাড়া প্রত্যেককেই অল্প বিস্তর রোগে ভুগিতে হইয়াছিল। কিন্তু দেখিলাম, ভারতবাসীরা কেহই রোগে আতুর হন নাই। দেশের জন্য তাঁহারা সর্ব্বদা সকল কষ্টই সহ্য করিতে প্রস্তুত ছিলেন। 

বাধাবিপত্তি

 দেখা গেল যে বাহিরের বিপদ অপেক্ষা ভিতরের বাধাগুলি বেশী কষ্ট দিতেছিল। মাঝে মাঝে সেখানেও হিন্দু মুসলমান, উচ্চ-নীচ জাতি ভেদের ভাব ফুটিয়া উঠিত। সেখানে সকল জাতির ও সকল শ্রেণীর ভারতবাসী ছিলেন। তাঁহাদের ব্যবহারেই বোঝা যাইত, আমরা স্বরাজ লাভের পথে কতখানি পিছনে পড়িয়া আছি; তবে এ কথাও দেখা গেল যে ইহাতে এমন কিছু নাই যাহাতে স্বরাজ সাধন অসম্ভব করিয়া তোলে; যাহা কিছু বাধা ঘটিতেছিল তাহা শেষাশেষি দূর হইয়া গেল।

 অনেক হিন্দু বলিতেন, তাহারা মুসলমানের বা অন্য হিন্দুর হাতে খাইবেন না; এরূপ যাঁহার বলেন, তাহাদের ভারতবর্যের বাহিরে যাওয়াই উচিত নয়। শ্বেতাঙ্গ বা কাফ্রি, যে কেহই খাবার স্পর্শ করুক না, তাহাতে ক্ষতি কি? একবার ত’ একজন বলিয়া বসিলেন, আমি চামারের কাছে শুইব না। এটাও আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয়। খোঁজ করার পরে জানা গেল, তাঁহার জাতিভেদ ভাব বিশেষ ছিল না, দেশে তাঁহার স্বজাতিরা শুনিয়া আপত্তি করিবে, এই ভাবিয়া শুধু তিনি এ কথা বলিয়াছিলেন। আমি জানি, এই ভাবে উচ্চ নীচ ভেদে ও স্বজাতির অত্যাচারে আমরা সত্য ভুলিয়া-অসত্যের আদর করিতেছি। যদি এ বোধ জাগিয়া ওঠে যে, চামারকে তিরস্কার করিবার কিছুই নাই, তখন স্বজাতির বা অন্য কাহারও অন্যায় অত্যাচারের ভয়ে সত্যকে ত্যাগ করিয়া কেমন করিয়া নিজকে সত্যাগ্রহী বলিয়া পরিচয় দিতে পারি? আমার ইচ্ছা হয়, যাঁহারা এই সংগ্রামে যোগদান করিবেন তাঁহার জাতি, পরিবার ও অ..র বিরোধ ঘুচাইয়া তবে যেন সত্যাগ্রহে যোগ দেন। এরূপ করি না বলিয়াই আমাদের আন্দোলন শিথিল হয়। এ কথা আমার সত্য বলিয়া মনে হয়। যখন আমরা সকলেই ভারতবাসী, তখন এক দিকে মিথ্যা ভেদ রাখিয়া, অন্য দিকে বড় বড় কথা বলিয়া অধিকার চাওয়া কেমন করিয়া সম্ভব? কিম্বা ‘দেশে লোকে কি বলিবে,’ এই ভয়ে সত্যকে যদি ত্যাগ করি, তবে কেমন করিয়া এই বিরোধে জয়ী হইব? ভয়ে কোনও পথ ত্যাগ করা ভীরুর কাজ। কোনও ভীরু ভারতবাসীই সরকারের বিরুদ্ধে এই মহাসংগ্রামে শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকিতে পারিবে না

 জেলে কাহারা যাইতে পারে? এতেই বোঝা যাইতেছে, ব্যসনগ্রস্ত, মিখ্যা জাতি-ভেদ আচারী, কলহপ্রিয়, অথবা যাহারা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ‘উচ্চ’ 'নীচ' এই ভেদ দেখে, কিম্বা যাহারা রুগ্ন, এমন কেহ জেলে যাইতেই পারিবেন না, গেলেও বেশী দিন সেখানে টিকিতে পারিবেন না। দেশহিতের নামে সম্মান বোধে যাঁহারা জেলে যাইবেন, তাহাদের দেহ, মন, আত্মা, সুস্থ ও সবল হওয়া দরকার। যে ব্যাক্তি রুগ্ন, সে পরিণামে ক্লান্ত হইয়া পড়ে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে উচ্চ নীচ বোধ যাহাদের আছে, যাহারা ব্যসনগ্রস্ত, কলহপ্রিয়, একটুকু চা, বিড়ি কিম্বা অন্য কোনও দ্রব্যের বিনিময়ে যাহারা, নিজেকে বিকাইয়া দিতে পারে, তাহারা শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকিতে পারে না।

পড়াশুনা।

 সারাদিন কাজ করিলেও, সকালে, সন্ধ্যায় ও রবিবারে পড়িবার কিছু সময় পাওয়া যায়। জেলে অন্য কোনও ঝঞ্চাট না থাকায় পড়াও বেশ ভাল হয়। খুব অল্প সময় পাওয়া স্বত্ত্বেও রাস্কিনের দুইটি বিখ্যাত গ্রন্থ, থোবোর প্রবন্ধাবলী, বাইবেলের কিছু অংশ, গুজরাতী ভাষায় গারিবল‍‍্ডীর জীবন চরিত ও বেকনের প্রবন্ধাবলী, এবং আরও দুই খানি ইংরেজী পুস্তক (ভারতবর্ষের বিষয়ে) আমি পড়িয়া শেষ করিয়াছিলাম। রাস্কিন ও খোরোর প্রবন্ধাবলী স্থানে স্থানে সত্যাগ্রহের কথায় পূর্ণ। মিঃ দেওয়ান্ আমাদের জন্য গুজরাতী পুস্তক পাঠাইয়াছিলেন, তাহা ছাড়া প্রায় সদা সর্ব্বদা ভগবদ‍্গীতা তা পাঠ হইত। ইহার ফলে, সত্যাগ্রহ আমার হৃদয়ে স্পষ্ট হইয়া উঠিল, এবং বলিতে পারি যে জেলে এমন কিছু ছিল না যাহাতে আমার হৃদয়ে কোনও অস্থির ভাব আনিয়া দিতে পারিত।

 উপরে যাহা লিখিয়াছি তাহাতে দুই ভিন্ন ভাব মনে জাগিতে পারে:—

 প্রথমতঃ, মনে হইতে পারে, এই রকম জেলে বদ্ধ হওয়া, মোটা খদ্দর ও খারাপ কাপড় পরা, খারাপ খাদ্য খাওয়া, ক্ষুধায় মরা, দারোগার গালি খাওয়া, কাফ্রিদের সঙ্গে থাকা, পছন্দ হউক আর নাই হউক সকল কাজ করা; দারোগা হয়ত আমার ঢাকর হইতে পারিত, তাহার আদেশ সর্ব্বদা মানা, নিজের প্রিয় আত্মীয় স্বজনের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিতে না পারা, কাহাকেও চিঠি লিখিতে না পারা, প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র না পাওয়া, খুনী এবং ডাকাতের সঙ্গে একত্র বাস করা,—এ সকল দুঃখ ভোগ কেন করিব? এর চেয়ে ত মৃত্যুও ভাল। জরিমানা দিয়া মুক্তি পাওয়া বরং ভাল, তবু জেলে যাওয়া ভাল নয়। ভগবান্ করুন, কাহারও যেন জেলে যাইতে না হয়।

 কিন্তু এই রকম চিন্তা মানুষকে দুর্ব্বল করিয়া ফেলে সে জেলকে ভয় পায়, এবং যে কল্যাণ সাধনের জন্য সে জেলে যায় তাহা অপূর্ণ থাকে।

 আর এক ভাব মনে জাগিতে পারে:—

 দেশহিতের জন্য, মানরক্ষার জন্য, ধর্মের জন্য যদি আমায় জেলে যাইতে হয় ত’ সে আমার সৌভাগ্য। জেলে দুঃখ কিসের? বাহিরে এখানে ত আমাকে অনেকের তাঁবেদারী করিতে হয়, জেলে শুধু দারোগার আদেশই মানিয়া চলিতে হয়। জেলে ত কিছুরই চিন্তা করিতে হয় না,—না উপার্জ্জনের, না খাওয়া দাওয়ার। সেখান অন্যে ঠিক সময়ে বাঁধিয়া দেয়; স্বয়ং সরকার বাহাদুর সেখানে শরীররক্ষী। আর তার জন্য ত আমাকে কিছুই দিতে হয় না। এমন কর্ম্মও জুটিতে পারে যে তাহাতে ব্যায়ামের কাজ বেশ হইয়া যায়। সকল ব্যসন সহজেই দূর হইয়া যায়, মন স্বাধীন থাকে, ঈশ্বরের আরাধনার সুযোগ আপনিই আসে। সেখানে ত’ শুধু শরীর বন্দী হইয়া থাকে, আত্মা পূর্ণতর স্বাধীনতা লাভ করে। প্রত্যহ নিয়মিত সময়ে শয্যা ত্যাগ করিতাম। শরীরকে যে বন্দী করিয়াছে, শরীর রক্ষার ভার তাহারই উপর। নানারূপে,স্বছন্দভাবেই দিন কাটে। যখন বিপদ আসিল বা দুষ্ট দারোগা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিল, তখন ধৈর্য্য ধারণের অভ্যাস আমার হয়। তাহার বিরুদ্ধাচরণ আমার কর্তব্য; তাহাতেই আমার আনন্দ। এই ভাবে দেখিলে জেল পবিত্র ও সুখদায়ক মনে করা ও মত সেই ভাবে গড়িয়া তোলা নিজের হাতে। মনের অবস্থা বিচিত্র; অল্পেই সে ব্যথা পায়, অল্পেই তাহার আনন্দ। আমার আশা, আমার কারাবাসের এই দ্বিতীয় কাহিনী পড়িয়া পাঠক দেশ বা ধর্ম্মের জন্য জেলে যাওয়া, সেখানে দুঃখ ভোগ করা ও অন্যান্য বিপদ মাথা পাতিয়া লওয়া আপনার কর্তব্য মনে করিবেন। এই কথা মনে করিয়াই আমি আনন্দ পাই;