কালান্তর (২০১৮)/আরোগ্য
আরোগ্য
আমি আশ্রমে উপস্থিত আছি অথচ ৭ই পৌষের উৎসবের আসন গ্রহণ করতে পারি নি, এরকম ঘটনা আজ এই প্রথম ঘটল। আমার বার্ধক্য এবং আমার রোগের দুর্বলতা আমাকে সমস্ত বহির্বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আজ আমার সেই দূরত্ব থেকে তোমাদের যদি কিছু বলি তো সংক্ষেপে বলব। কেননা বাহিরের কোনো কাজে অধিকক্ষণ মনোযোগ দিতে আমার নিষেধ আছে, কেবল যে ডাক্তারের তা নয়, আমার রোগজীর্ণতারও।
যৌবনের তেজ যখন প্রখর ছিল, ভাবতুম, বার্ধক্যটা একটা অভাবাত্মক দশা, অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে সমস্ত শক্তি হ্রাস হয়ে সেই দশা মৃত্যুর সূচনা করে। কিন্তু আজ আমি এর ভাবাত্মক দিক ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছি। সত্তার যে বহিরঙ্গ, যাকে আমরা অহং নাম দিতে পারি, তার থেকে শ্রদ্ধা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে। ঠিক মনে হচ্ছে, যেমন পরিণত ফল তার বাহিরের খোসাতে আর আসক্ত হয়ে থাকে না, সেই খোসাটা ক্রমশ তার পক্ষে নিরর্থক হয়ে ওঠে। তখন তার প্রধান সম্পদ হয় ভিতরের শস্য। কাঁচা অবস্থায় সেই শস্যের পরিণত রূপ সে অনুভব করতে পারে না, এইজন্যে তাকে বিশ্বাস করে না। তখন সে আপনার বাহিরের পরিচয়েই বাহিরে পরিচিত হতে চেষ্টা করে, সেখানে কোনো আঘাত পেলে সে পরম ক্ষোভের বিষয় বলে মনে করে। বৃদ্ধ বয়সে তার বিপরীত দশা ঘটে। সে অন্তরের পূর্ণতার মধ্যে আপনাকে যত উপলব্ধি করতে পারে ততই একটা পরম আশ্বাস লাভ করে এবং ততই বাহিরের ক্ষতি অথবা অসম্মান তাকে আর ক্ষুব্ধ করতে পারে না। এ কথা কেউ যেন না মনে করে, এটা একমাত্র বৃদ্ধ বয়সেরই অধিকারগত। বস্তুত অল্প বয়সে আমরা সংসারের বহিরঙ্গকেই সম্পূর্ণ মূল্য দিই বলেই সংসারে এত অশান্তি ঘটে এবং মিথ্যার সৃষ্টি হতে থাকে। কেননা এই বাহিরের দিকেই আমরা পরস্পরের সহিত বিচ্ছিন্ন এবং একমাত্র আপনার মধ্যেই আবদ্ধ।
আজ আমি রোগের দশা অতিক্রম করছি বলেই আরোগ্য কাকে বলে সেটা বিশেষভাবে অনুভব করি। কিন্তু যথার্থ আরোগ্য সে জীবনের সকল অবস্থারই সম্পদ। সেই আরোগ্যে আমরা সমস্ত বিশ্বভুবনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগস্থাপন করতে পারি। জগতে আমাদের অস্তিত্ব আনন্দময় হয়ে ওঠে। তখন আমাদের দেহের অনুকূল অবস্থা। এই-যে আরোগ্যতত্ত্ব এটা দেহের অন্তরবিভাগের সম্পদ, অলক্ষ্যে সকল দেহে ব্যাপ্ত হয়ে কাজ করে। অসুস্থ হলেই সেই অন্তরগুঢ় সামঞ্জস্য ভেঙেচুরে গিয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পীড়িত করতে থাকে। তখন তার বিরোধের অবস্থা। সেইরকম আমাদের সত্তার যে অস্তরবিভাগে আধ্যাত্মিক সত্য পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে তার প্রভাব যখন অক্ষুন্ন হয়, তখন সর্বত্র তার শান্তি এবং সকলের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য। এই আন্তরিক সম্পূর্ণতাকে উপলব্ধি করবার সাধনায় কোনো বয়সের ভেদ নেই। তরুণ অবস্থায় নানা-প্রকার আসক্তির আবিলতায় এই উপলব্ধির ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু যাঁরা তাকে অতিক্রম করে আপনার আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারেন তাঁরা সর্বত্র শান্তিলাভ করেন। কারণ, তাঁরা মানবতার সত্যকে অনুভব করতে পারেন, এবং তাঁদের ভয় থাকে না— তাঁরা মৃত্যুকে অতিক্রম করেন।
মানব-ইতিহাসে কোনো কোনো জাতির মধ্যে এই সত্যের উপলব্ধির ইতরবিশেষ দেখা যায়। য়ুরোপীয় সভ্যতা প্রথম থেকেই বাহিরে আপনার সার্থকতা অন্বেষণ করেছে এবং লোভকে কর্ণধার করে দেশে দেশে, বিশেষভাবে এশিয়ায় ও আফ্রিকায়, দস্যুবৃত্তি-দ্বারা ধনসঞ্চয় করেছে। যে বিজ্ঞান যথার্থ আত্মসাধনার সহায় তাকে বিশুদ্ধ জ্ঞানের পথ থেকে ভ্রষ্ট করে জগতে মহামারী বিস্তার করেছে। এই দুর্গতির অন্ত কোথায় জানি নে। অপর পক্ষে কোনো কোনো জাতি অপেক্ষাকৃত সহজে তাদের স্বভাবকে অনুসরণ করে বাহিরের চিত্তবিক্ষেপ থেকে শান্তিলাভ করে এসেছে। তারা বিবাদ ক’রে, লড়াই করে মানুষের গৌরব সপ্রমাণ করতে চায় নি। বরঞ্চ লড়াই করাকে তারা বর্বরতা বলে জ্ঞান করেছে। চীন, তার প্রধান দৃষ্টান্ত। বহু শতাব্দী ধরে আপনার সাহিত্য, অতুলনীয় শিল্প ও অতিগভীর তত্ত্বজ্ঞানের মধ্যে মনকে সম্পদশালী করে রাখতে পেরেছে। মানুষের চরম সত্য যে তার অন্তরে সঞ্চিত এই কথাটা যতই তারা জীবনের ব্যবহারে সপ্রমাণ করেছে ততই তারা মহতী প্রতিষ্ঠা পেয়ে এসেছে। আজ লোভের সঙ্গে, বিজ্ঞানবাহন রিপুর সঙ্গে, তার শশাচনীয় বিরোধ ঘটল।
আমাদের বিশ্বাস, একদিন যখন এই বিরোধের অবসান হবে তখন চীন তার সেই চিরন্তন প্রাচীন শান্তিকে পুনরায় পৃথিবীতে স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু যারা লোভকে কেন্দ্র করেছে তারা জয়লাভ করলেও আত্মপরাভবের বিপত্তি থেকে কোনোদিন রক্ষা পাবে কি না সন্দেহ করি। এই লোভের শেষ পরিণাম মহতী বিনষ্টি। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, পরস্পরের অর্জিত সম্পদের প্রতি লুব্ধ হস্তক্ষেপ— এই অভ্যাস অনার্য অভ্যাস এবং এই অভ্যাস মাদকতার মতো শরীর মনকে অভিভূত করে রাখে। তার থেকে নিজেকে উদ্ধার করা পরম আঘাতেও অসাধ্য। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর শিক্ষা দেশকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককেই মনের ভিতর ধ্যান করতে হবে। কারণ, পাশ্চাত্য সংক্রামকতা আমাদের জাতির মধ্যে প্রবেশ করে ভারতবর্ষের পুরাতন আধ্যাত্মিক বীর্যকে প্রতিদিন পরাস্ত করছে। ঋষিবাক্যে যে পরম মন্ত্র একদিন আমরা পেয়েছিলেম সে হচ্ছে শান্তং শিবং অদ্বৈতম্— এক সত্যের মধ্যে সত্যের এই তিন রূপ বিধৃত। শান্তি এবং কল্যাণ এবং সর্বমানবের মধ্যে ঐক্য— এই বাণীর তাৎপর্য মানুষকে তার সত্য পরিচয়ে উত্তীর্ণ করতে পারে, কারণ মানবের ধর্ম: পরস্পর প্রীতির মিলন, ব্যবহারে কল্যাণ ও শান্তিকে অক্ষুন্নভাবে স্বীকার করা। আমি এই কামনা করি, আমাদের পিতামহের মর্মস্থান থেকে উচ্চারিত এই বাণী আমাদের প্রত্যেকের ধ্যানমন্ত্র হয়ে জগতে শান্তির দৌত্য করতে থাক্।
যে সমাজ আত্মার পরিবর্তে বহির্বিষয়কে একান্ত প্রাধান্য দেয়, সে আপন লোভের সঞ্চয় দিয়ে অন্যকে আঘাত করে এবং সেই লোভের সঞ্চয়ই তার ফিরে আঘাতের বিষয় হয়। এই আঘাত-প্রত্যাঘাতের কোনোদিন কোথাও অন্ত দেখা যায় না। শত্রুর বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে সে এই লোভের দুর্গকে দৃঢ়তর করতে থাকে, পরাস্ত হলে দৃঢ়তর প্রয়াসে তার অনুসরণ করতে থাকে। তখন পৃথিবীর যে-সকল জাতি বাহুবলে তার সমান নয় তাদের স্বাধীন কৃতার্থতার পথ অবরুদ্ধ করে ফেলে। এই লোভরিপুপ্রধান সভ্যতা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে হেয় করে রাখবার পেষণযন্ত্র হয়ে থাকে, কারণ লোভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করতে পারে না। এরকম সভ্যতাকে সভ্যতা নাম দেওয়া যায় না, কেননা সভ্যতা সর্বমানবের সম্পদ। অদ্যকার মহাযুদ্ধের অধিনায়কদের অন্তত এক পক্ষ বলে থাকেন, তারা সমস্ত মানবের জন্য লড়াই করছেন। কিন্তু নিজেদের গণ্ডির বাহিরের মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করে না, উদ্ধত লোভরিপুর এই লক্ষণ। কেননা, আত্মা যাদের মুখ্য লক্ষ্য নয় আত্মীয়তার বোধসীমা তাদের কাছে সংকীর্ণ। মানুষের সম্বন্ধে অদ্বৈতবুদ্ধি অর্থাৎ অখণ্ড মৈত্রী তাদের কাছে শ্রদ্ধা পায় না। মনে রাখতে হবে, একদিন এই মৈত্রী প্রচার করবার জন্য সেদিনকার বুদ্ধভক্ত ভারত প্রাণান্ত স্বীকার করেও দেশে বিদেশে অভিযান করেছিল, পরসম্পদকে আত্মসাৎ করবার জন্য নয়।
পাশ্চাত্য-অলংকার-মতে মহাকাব্য যুদ্ধমূলক। মহাভারতের আখ্যান ভাগেরও অধিকাংশ যুদ্ধবর্ণনার দ্বারা অধিকৃত কিন্তু যুদ্ধেই তার পরিণাম নয়। নষ্ট ঐশ্বর্যকে রক্তসমুদ্র থেকে উদ্ধার করে পাণ্ডবের হিংস্র উল্লাস চরমরূপে এতে বর্ণিত হয় নি। এতে দেখা যায়, জিত সম্পদকে কুরুক্ষেত্রের চিতাভস্মের কাছে পরিত্যাগ করে বিজয়ী পাণ্ডব বিপুল বৈরাগ্যের পথে শান্তিলোকের অভিমুখে প্রয়াণ করলেন— এ কাব্যের এই চরম নির্দেশ। এই নির্দেশ সকল কালে সকল মানবের প্রতি। যে ভোগ একান্ত স্বার্থগত, ত্যাগের দ্বারা তাকে ক্ষালন করতে হবে। যে ভোগে সর্বমানবের ভোজের আহ্বান আছে সভ্যতার স্বরূপ আছে তার মধ্যে। কিন্তু রিপু অতি প্রবল, সাধনা অতি দুরূহ; সেই কারণেই এই সাধনায় যত দূর সিদ্ধি লাভ করা যায় মনুষ্যত্বের গৌরব তত দূর প্রসারিত হতে থাকে, ব্যাপ্ত হতে থাকে তার সভ্যতা।
যুগ প্রতিকূল, বর্বরতা বলিষ্ঠতার মর্যাদা গ্রহণ করে আপন পতাকা আন্দোলন করে বেড়াচ্ছে রক্তপঙ্কিল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিকারগ্রস্ত রোগীর সাংঘাতিক আক্ষেপকে যেন আমরা শক্তির পরিচয় বলে ভুল না করি। লোভ যে সম্পদ আহরণ করে আনে তাকে মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত ঐশ্বর্য বলে জ্ঞান করে এসেছে, এবং অহংকৃত হয়েছে সঞ্চয়ের মরীচিকায়। লোভের ভাণ্ডারকে রক্ষা করবার জন্যে জগৎ জুড়ে অস্ত্রসজ্জা, যুদ্ধের আয়োজন চলল। সেই ঐশ্বর্য আজ ভেঙেচুরে তার ভগ্নাবশেষের তলায় মনুষ্যত্বকে নিষ্পিষ্ট করে দিচ্ছে।
আমার অধিক কিছু বলবার নেই, শক্তিও নেই। মানবসত্যের শেষ বাণী আমাদের দেশে উচ্চারিত হয়েছে, আমি আজ কেবল তারই প্রত্যুচ্চারণ করে বিদায় গ্রহণ করি।—
সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে
সংবাদে ছিল না মুখরিত
নিস্তব্ধ খ্যাতির যুগে—
আজিকার এইমতো প্রাণযাত্রাকল্লোলিত প্রাতে
যাঁরা যাত্রা করেছেন
মরণশঙ্কিল পথে
আত্মার অমৃত-অন্ন করিবারে দান
দূরবাসী অনাত্মীয় জনে,
দলে দলে যাঁরা
মরুবালুতলে অস্থি গিয়েছেন রেখে,
সমুদ্র যাঁদের চিহ্ন দিয়েছে মুছিয়া,
অনারব্ধ কর্মপথে
অকৃতার্থ হন নাই তাঁরা
মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ-মাঝে
শক্তি জোগাইছে যাহা অগােচরে চিরমানবেরে—
তাঁহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি
আজি এই প্রভাত-আলােকে,
তাঁহাদের করি নমস্কার॥
১২ ডিসেম্বর ১৯৪০। প্রাতে