কালান্তর (২০১৮)/প্রলয়ের সৃষ্টি

প্রলয়ের সৃষ্টি

এক সময়ে, এই বিশ্বসৃষ্টির প্রথম যুগে সৃষ্টি ও প্রলয়ের দ্বন্দ্বনৃত্য চলেছিল- সৃষ্টি ও প্রলয়ের শক্তির মধ্যে কে যে বড়ো তা বুঝবার জো ছিল না, চারি দিকে নিয়ত সংঘাত চলেছিল। তখন যদি বাইরে থেকে কেউ এই পৃথিবীকে দেখতে পেত তা হলে বলত, এই বিশ্ব প্রলয়েরই লীলাক্ষেত্র, সৃষ্টির নয়। চারি দিকে তখন ক্রমাগত ভয়ংকরের নাট্যলীলা চলেছিল। সেই মহাতাণ্ডবের যুগে আমরা যাকে প্রাকৃত জগৎ বলি তাই ছিল, তখন পৃথিবীতে জীব আসে নি। কিন্তু এই মহাপ্রলয়ের অন্তরে সৃষ্টির সত্যই গোপন হয়ে ছিল। যা বিনাশ করে, যা ভীষণ, বাইরে থেকে তাকেই সত্য বলে মনে হলেও তা সত্য নয়— এই ভীষণ তাণ্ডবলীলাই সৃষ্টির ক্ষেত্রে চরম কথা নয়। ক্রমশ সব আলোড়ন উপদ্রব থেমে গেল, এর অন্তরে যে সৌন্দর্যলীলা গোপন ছিল তাই প্রকাশ পেল সেই প্রলয়ের তাণ্ডব, সেই ঝড়ঝঞ্জা-মহামারী আজও আছে বটে, কিন্তু সে আছে নেপথ্যে— সে একবার দেখা দেয়, আবার চলে যায়— তাকেই আমরা চরম পরিণাম বলি নে। সমস্ত উপদ্রব শান্ত হয়ে আসে, উপনিষদে যাঁকে শান্ত বলেছে তাঁরই রূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আকাশে নক্ষত্রে নক্ষত্রে যে হোমহুতাশন, অগ্নির উচ্ছ্বাস, আমরা দেখি তার শান্তরূপ। নক্ষত্রলোক জুড়ে কী অসহ্য উপদ্রব, কী অগ্নিবাষ্পের উচ্ছ্বাস চলেছে সে কথা আমরা ভাবি নে। আমাদের শয়নগৃহের বাতায়ন দিয়ে যখন আকাশকে দেখি তখন দেখি তার স্নিগ্ধ রূপ, তখন দেখি আকাশ হাসছে— সে আমাদের নিদ্রাকে ব্যাহত করে না। এই শান্তিই চরম সত্য— এ শান্তি দুর্বলের শাস্তি নয়, এ প্রবলের শান্তি।

 পৃথিবীতে প্রচণ্ডের মধ্যে, সংঘাতের মধ্যে, শান্তির যে অভ্যুদয় দেখি আদিযুগে, তাই দেখি আজ মানুষের ইতিহাসেও। উদ্দাম নিষ্ঠুরতা আজ ভীষণাকার মৃত্যুকে জাগিয়ে তুলছে সমুদ্রের তীরে তীরে; দৈত্যেরা জেগে উঠছে মানুষের সমাজে, মানুষের প্রাণ যেন তাদের খেলার জিনিস। মানুষের ইতিহাসে এই দানবিকতাই কি শেষ কথা? মানুষের মধ্যে এই-যে অসুর এই কি সত্য? এই সংঘাতের অন্তরে অন্তরে কাজ করছে শাস্তির প্রয়াস সে কথা বুঝতে পারি যখন দেখি, এই দুঃখের দিনেও কত মহাপুরুষ দাঁড়িয়েছেন শান্তির বাণী নিয়ে— সেজন্য মৃত্যুকে পর্যন্ত স্বীকার করেছেন। এঁদের সংখ্যা বেশি নয়, সাম্রাজ্যলুব্ধরা এঁদের হিংসা করে মারে— তবু এঁদের শক্তিকে নিঃশেষ করতে পারে না। এখনো মানুষ বিপদকে স্বীকার করেও দূর ভবিষ্যতের বাণী বহন করে চলেছে। অকুতোভয়ে। সত্য এখানেই। আজ চীনে কত শিশু নারী, কত নিরপরাধ গ্রামের লোক দুর্গতিগ্রস্ত— যখন তার বর্ণনা পড়ি হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। আজ এই সংগীতমুখর শান্ত প্রভাতে আমরা যখন উৎসবে যোগ দিয়েছি এই মুহূর্তেই চীনে কত লোকের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে—পিতার কাছ থেকে পুত্রকে, মাতার কাছ থেকে সন্তানকে, ভাইয়ের কাছ থেকে ভাইকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যাচ্ছে, যেন মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য নেই— সে। কথা চিন্তা করলেও ভয় হয়। অপর দিকে আছে আপন-সাম্রাজ্য-লোভী ভীরুর দল, তারা এই দানবদের কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ক্ষীণ এরা, ইতিহাসে এদের স্বাক্ষর লুপ্ত। চীনকে যখন জাপান অপমান করেছে সিনেমার ভিতর দিয়ে, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে— যেমন অপমান আমাদের দেশেও হয়ে থাকে— তখন এই প্রতাপশালীর দল কোনো বাধা দেয় নি, বরং চীনকে দাবিয়ে দিয়েছে, বলেছে চীনের চঞ্চল হবার কোনো অধিকার নেই। আমাদের দেশেও দেখি, দুর্বলকে অবমাননার কোনো প্রতিকার নেই। তবুও এ কথা বলব, যারা আজ দুঃখ পাচ্ছে, প্রাণ বিসর্জন করছে, সৃষ্টি করছে তারাই। এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন অপমানিত জাতিরাই নূতন যুগকে রচনা করছে। প্রতাপশালী ভীরুরা তাদের ঐশ্বর্যভারে নত; পাছে কোনো জায়গায় তাদের কোনো ক্ষতি হয় এইজন্য তারা দুর্বলের পক্ষে দাঁড়াল না। তবু হতাশ হব না। যারা পীড়িত হচ্ছে মৃত্যুকে বরণ করেই তারা নূতনকে সৃষ্টি করছে; যারা দুঃখ পেল তারাই ধন্য। যারা দস্যুবৃত্তি করছে, যারা মানুষের পথ আগলে আছে, মানুষের ইতিহাসে তারা সম্মানের যোগ্য নয়। এ আশা দুরাশা নয়— বিনাশের শক্তিই মানুষের ইতিহাসে শেষ কথা হতে পারে না, তা হলে মানুষ বাঁচত না। অনেক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে এসেছে মানুষ, তবু তার বড়ো বড়ো কামনা মরে নি। কেবল ক্ষুধাতৃষ্ণার দাস নয় সে, এখনো মানুষ চলেছে; এখনো তার মহত্ত্বের উৎস শুকোয় নি। মানুষের ইতিহাসের অন্তরে যদি মহতের কোনো স্থান না থাকত তবে মানুষের ইতিহাস এত অত্যাচার সহ্য করেও প্রাণশীল থাকত না। আজকের দিনে এই গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে এইই মানুষের আশ্বাসবাণী। সমস্ত সংঘাতের মধ্যেও কল্যাণের রূপ প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে— সমস্ত দুঃখের মধ্যে সমস্ত পাপের মধ্যে পুণ্যের আবির্ভাব এই আমাদের আশা।

 চীনের প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচারে আজ আমাদের হৃদয় উৎপীড়িত কিন্তু, আমাদের কী করবার আছে? আমরা কী করতে পারি? আমরা অত্যাচারীকে নিন্দা করছি কিন্তু বলা যেতে পারে, নিন্দা করে কী লাভ? এই দুঃখবোধ-দ্বারা, দানবের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে আমরাও সেই সৃষ্টির পক্ষে কাজ করছি— এর শক্তি যতই ক্ষীণ হোক এও সৃষ্টির কাজ। আমাদের অস্ত্র নেই, কিন্তু আমাদের মন আছে। আমরা লড়াই না করতে পারি, কিন্তু এ কথা যদি আমাদের মনে জাগ্রত রাখি যে অধর্মের দ্বারা আপাতত যতই উন্নতি হোক তার মূলে আছে বিনাশ— যদি এ কথা বিস্মৃত না হই যে মানব-ইতিহাসের মূলে কল্যাণের শক্তি কাজ করছে— এ কথা মেনে নিয়ে সেই কল্যাণের পক্ষে আমাদের কর্মকে চেষ্টাকে যেন প্রয়ােগ করি। আমাদের মেশিনগান নেই, কিন্তু আমাদের চিন্তা আছে- তার মূল্য যতটুকুই হােক, তাকে আমরা মহতের দিকে প্রয়ােগ করব।    মাঘ ১৩৪৪  

শান্তিনিকেতন
৭ পৌষ ১৩৪৪













 ২৬