কাহাকে?/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
ডিনারে রাত জাগিয়া দিদি তাঁহার ঘরে দিবা নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, আমি ড্রয়িংরুমে জানালার পাশে ইজিচেয়ারে বসিয়া একখানি নভেল পড়িবার চেষ্টা করিতেছিলাম –কিন্তু কিছুতেই তাহাতে মন বসিতেছিল না। কিছুদিন পূর্ব্বে পরীক্ষার রাশি রাশি পাঠের মধ্যেও ফাঁকি দিয়া যখন নভেল শেষ করিতাম—তখন মনে হইত সারা জীবন যদি উপন্যাসের মধ্যে আপনাকে ডুবাইয়া রাখিতে পারি, তাহা হইলেই আমার জীবনের পরম ও চরম সুখ লাভ হয়—আমি আর সংসারে অন্য কিছু চাহি না। কত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের সুখের কল্পনা পরিবর্ত্তিত হয়, একবৎসরও তাহার পর অতীত হয় নাই!
চোখের উপর খোলা কেতাব, যন্ত্রের মত হরফগুলি নিঃশব্দে আওড়াইয়া যাইতেছি—অথচ খানিক পরে আত্মস্থ হইয়া দেখিতেছি এক অক্ষরও তাহার হৃদয়ঙ্গম হয় নাই—আসলে পড়িতেছি না ভাবিতেছি, কিন্তু কি ভাবিতেছি তাহারও একটা ঠিক ঠিকানা নাই, অস্পষ্ট অসংযত বিশৃঙ্খল ভাবনা,—মনের মধ্যে একটা কেমন অশান্ত বিদ্রোহী বাসনা, উপস্থিতের উপর বিতৃষ্ণা, অনুপস্থিতের জন্য আগ্রহ,–কিন্তু সে অনুপস্থিত যে কি, তাহার আকৃতি কিরূপ-স্থিতিই বা কোথায়, তাহা সে ভাবনার মধ্যে নাই। মাঝে মাঝে এক একবার পূর্ব্বাকাশে দৃষ্টি পড়িতেছিল— উদার স্তব্ধ সৌন্দর্য্যদৃশ্যের মধ্যে আমার উদাসচিত্ত স্বপ্নের মত যেন মিলাইয়া পড়িতেছিল, সহসা আবার তাহা হইতে যেন জাগিয়া উঠিয়া পুস্তকে চক্ষু ফিরাইতেছিলাম। ঠুং ঠুং করিয়া চারিটা বাজিল, আকাশে চাহিয়া দেখিলাম সুন্দর লাল মেঘের শোভা, সমুদ্র মনে পড়িল, এই প্রশান্ত সুরঞ্জিত আকাশের দিকে চাহিয়া কটকে যাইবার পথে ঝটিকা তরঙ্গিত যে ভীম সমুদ্র দেখিয়াছিলাম তাহাই মনে পড়িল, কে জানে এ দৃশ্যের সহিত তাহার কি যোগ? অমনি বহুপূর্ব্বে পঠিত একখানি উপন্যাসের কয়েকটি লাইন ও মনে পড়িয়া গেল—“In certain places and certain periods the aspect of the sea is dangerous—fatal; as at times is the glance of a woman.” যখন পড়িয়ছিলাম তুলনাটা বেশ ভাল লাগিয়াছিল তাই বোধ হয় স্মৃতির কোণে ইহা সুপ্ত ছিল—আজ সহসা জাগিয়া উঠিল। যদিও বইখানির নাম কিম্বা তখন যে ইহার কিরূপ অর্থ বুঝিয়াছিলাম তাঁহার কিছুই এখন মনে পড়িল না। ভাবিলাম, সমুদ্রের সহিত যে দৃষ্টির তুলনা হয় তাহ অবশ্য ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হইবে, স্ত্রীলোকের সক্রোধ দৃষ্টি কি পুরুষের নিকট এতই ভয়জনক। আমি ত পুরুষ নই, সে ভাবটা ঠিক আত্মস্থ করিতে পারিলাম না, কেবল পুরুষের কাপুরুষতা ভাবিয়া মনে মনে একটু হাসির উদ্রেক হইল। কই আমি ত পুরুষের এমন ক্রুদ্ধ দৃষ্ট ক্রুদ্ধ ভাব কল্পনা করিতে পারি না যাহাতে আমাকে ভয় কম্পিত অপ্রকৃতিস্থ করিয়া তোলে। আমাকে ত লোকে এত কোমল স্বভাব বলিয়। জানে, বাস্তবিকই আমি অল্পেতেই আৰ্দ্র হই, পরদুঃখ দেখিতে পারি না, বিশেষতঃ ভালবাসা স্থলে সহজেই নিজের প্রবল ইচ্ছাও বিসর্জ্জন করিতে পারি, কিন্তু ক্রোধে কি আমাকে বশ করিতে পারে? সেদিন যদি তিনি আমার কথায় রাগ করিয়া রূঢ়বাকো আমাকে অভিশম্পাৎ দিতেন, প্রতিশোধ লইবেন বলিয়া শাসাইতেন, তাহা হইলে কি তাঁহার বেদনা আমি অনুভব করিতাম-না তাহা নিবারণের জন্যই এত ব্যাকুল হইতাম? সম্ভবতঃ তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা অভক্তিরই উদ্রেক হইত। প্রেমের আশঙ্কাই প্রবল আশঙ্কা। যে ভালবাসে, যাহাকে ভালবাসি—তাহাকে ব্যথা দিতে প্রাণে যেমন বাজে এমন আর কিসে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নহে; প্রেমময় করুণ দৃষ্টিই প্রকৃত পক্ষে fatal—dangerous; তাঁহার বিদায় কালের সেই সকরুণ দৃষ্টি মনে জাগিল। লেখকও যে শেষ অর্থে এ তুলনা ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে আমার আর তখন সন্দেহ রহিল না। সময়ে সময়ে জোয়ার আসিয়া শুষ্ক তীরস্থিত বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে যেমন সহসা ভাসাইয়া লইয়া যায়—এই সকরুণ দৃষ্টিও সেইরূপ নিঃশব্দে হৃদয় অধিকার করে—তখন লোকে বিপদ জানিয়া শুনিয়াও আর ফিরিতে পারে না, অধিকাংশ সময় ফিরিতে চাহেও না, ইচ্ছা করিয়া তাহাতে আপনাকে ভাসাইরা দেয়; সেই জন্যই ইহা অধিক ভয়জনক।
জুতার শব্দে চিন্তাভঙ্গ হইল, চমকিয়া ফিরিয়া চাহিলাম, দেখিলাম তিনি। তাঁহার ভাব তেমন সহাস্য নহে, গম্ভীর বিষণ্ন ভাবে গৃহে প্রবেশ করিয়া নীরবে হাত বাড়াইয়া দিলেন, নীরবে সেক্হ্যাণ্ড করিয়া নিকটের একখানি চৌকিতে বসিলেন। তাঁহাব ভাব দেখিয়া আমিও দমিয়া গেলাম, বুঝিলাম চিঠি না পাইয়া ক্ষুণ্ন হইয়াছেন, অথচ তাঁহাকে প্রফুল্ল দেখিলে আমি যেরূপ সহজভাবে সব খুলিয়া বলিতে পারিতাম এখন তাহা অসম্ভব হইয়া উঠিল। এরূপ অবস্থায় কি শত ইচ্ছাতেও কথা ফোটে!
কিছু পরে তিনি নিজেই জিজ্ঞাসা করিলেন “আমার চিঠি পেয়েছিলেন আশা করি?” সম্বোধনের পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিলাম, তাঁহার এই অনাত্মীয় ভাব, অনুত্তপ্ত শীতল কঠিন ভাষা, আমার হৃদয়কে কেমন তুষার জমাট করিয়া আনিতে লাগিল; আমিও অস্বাভাবিক রুদ্ধ গম্ভীর স্বরে বলিলাম—“পেয়েছি, শীঘ্র আসবেন বলে উত্তর দিই নি।”
“উত্তর কি এখন প্রত্যাশা করতে পারি?”
অবশ্যই পারেন। আমিও ত বলিবার জন্য প্রস্তুত, কিরূপে সমস্ত খুলিয়া বলিব এতদিন ধরিয়া অনবরত মনে মনে তাহার রিহার্সেল দিয়া আসিতেছি অথচ এখন বলিতে গিয়া দেখিলাম বলা কত কঠিন! কি যে বলিব—কি কথা হইতে আরম্ভ করিব, কিছুই মনে করিতে পারিলাম না, মাথার মধ্যে কথার রাশি এলোমেলো ভাবে সবেগে ঘুরপাক খাইতে লাগিল। ঘূর্ণ মস্তিষ্ক, রূদ্ধাবেগ লইয়া আমি বলিলাম—“আমি-আমি কি বলব—আপনার দোষ”
তিনি বলিলেন “এখনো সেইভাব—সেই উত্তর-আমারই দোষ!—”
আমি যদিও তাহা বলিতে যাই নাই—বলিতে গিয়াছিলাম, আপনার দোষ নেই—আমারি দোষ ইত্যাদি; কিন্তু কথাটা এইখানেই তিনি ধরিয়া লইয়া উত্তর করিলেন। উল্লিখিত কথার পর বলিলেন “দোষ অমারি তবে হ’ক, কিন্তু এ দোষ
জেনেও কি আমাকে বিবাহ করতে পারবেন? আমি নিতান্তই স্বার্থপর হ’য়ে একথা বলছি মনে করবেন না। এ বিবাহ ভেঙ্গে গেলে আপনার পক্ষেও কিরূপ ক্ষতি তা বিবেচনা করবেন। আমি ভালবাসি, না বিবাহ হ’লে আমার কষ্ট হবে, এরূপ ভেবে মতামত স্থির করবেন না; নিজের মঙ্গলামঙ্গল ভেবে যা ভাল তাই স্থির করুন।”
কথাটা খুবই নিঃস্বার্থ ভাবের কথা; কিন্তু আমার সমস্ত প্রকৃতি ইহাতে বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। যে কারণে আমি তাঁহার সমস্ত দোষ ভুলিয়াছিলাম—সে কারণ ইহার মধ্যে কোথা? এই আশ পাশআঁটা, বুদ্ধি বিবেচনাযুক্ত কথার মধ্যে প্রেমোচ্ছাস ব্যাকুলতা কই? তবে যে গুজব শুনা গিয়াছে তাহা কি সত্য? কয়েক হাজার সামান্য রৌপ্য মুদ্রা তাঁহার প্রেম জয় করিয়াছে? আমার নিদ্রিত গর্ব্ব জাগিয়া উঠিল; আমি অসঙ্কোচে সুস্পষ্টস্বরে বলিলাম “আমার ক্ষতির জন্যে আমি ভাবি নে—আপনারো ভাববার আবশ্যক নেই,—সুবিধার জন্য আমি বিবাহ করতে চাই নে—আপনার সুখ যখন এর উপর নির্ভর কচ্ছে না—তখন আমি অব্যাহতি প্রার্থনা করি—”
তিনি শুষ্ককণ্ঠে বলিলেন, “তবে তাই হৌক্—”