কাহাকে?/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
দিদি সব শুনিয়া আমার উপরই অসন্তুষ্ট হইলেন,—আমাকেই দোষ দিতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন,—“এখন বোঝা যাচ্ছে কুসুমের সঙ্গে তার বিয়ের গুজব উঠেছে কেন, তোরই দোষে দেখছি তা ঘটেছে। আমি কি করে জানব—ভিতরে ভিতরে এত কাণ্ড হয়েছে; আমি ভাবছি-ভালয় ভালয় সব গোলযোগ মিটে গেল-বাঁচা গেল। মিটমাট যে শুধু তোর মনে মনে তাত আর বুঝিনি তখন; সে বেচারাই বা কি ক’রে তা বুঝবে বল? প্রথমে ত তাকে স্পষ্ট করে বলে দিলি বিয়ে করবিনে; তার পরে সে তার জীবন মরণ মিনতি জানালে যখন, তখনও একটি কথা কইলিনে, মফঃস্বলে গিয়েও সাধ্যসাধনা করে চিঠি লিখলে, চিঠির এক লাইন উত্তর পর্য্যন্ত দিলিনে, এতে মানুষ কি ভাবে বল দেখি? তার ত মানুষের প্রাণ-না সে পাথর? এত উপেক্ষার পর তবুও যে সে আবার এ বাড়ীতে এসে তোর সঙ্গে দেখা করে, বিয়ে সম্বন্ধে মতামত জিজ্ঞাসা করেছে,—এতে আমি ত তাকে খুবই ভাল বলি, তার ভদ্রতা সৌজন্যের পরিচয় এতে খুবই পাওয়া যাচ্ছে।”
আমি বলিলাম, “তা হতে পারে—কিন্তু যে রক্ম করে সে মত জিজ্ঞাসা করেছেন তাতে ভালবাসার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে কি?”
“ভালবাসার অভাব আমি ত এতে কিছুই দেখছিনে। হাজার ভালবাসলেও যদি জানা যায় সে আমাকে চায় না—তাহলে যার একটু আত্মসম্মান জ্ঞান আছে—সে কি আর প্রেমের দোহাই দিয়ে কথা কইতে পারে?”
“কিন্তু তিনি যখন বল্লেন—এ বিয়ে না হলে আপনার কিরূপ ক্ষতি তাই বিবেচনা ক’রেই বিয়ে করা না করা স্থির করুন,—আমি ভালবাসি—বা না বিয়ে হলে আমার কষ্ট হবে—এরূপ ভাববেন না;—তখন কি আমি বলব নাকি—হ্যাঁ আপনি ভাল বাসুন বা না বাসুন তাতে কিছু আসে যায় না, আমার মঙ্গলের জন্যই আমি বিয়ে করতে প্রস্তুত। তাঁরই আত্মসম্মান জ্ঞান আছে—আর আমার কিছুমাত্র নেই!"
“তুইই তার প্রতি অন্যায় করেছিস, তার মনে আঘাত দিয়েছিস; সে জন্য তুই যদি নিজের ভুল, নিজের দোষ স্বীকার ক’রে তার কষ্ট দূর করতে যেতিস—তাহলে তাতে কি ক’রে যে তোর আত্মসম্মানের হানি হোত তাত আমি বুঝতে পারিনে। তবে সত্যি যদি এড়াবার অভিপ্রায়েই সে তোকে অমন ক’রে বলে থাকে, তাহলেও তাকে সে কথা স্পষ্ট করে বলবার অবসর দেওয়া উচিত ছিল। এখন দাঁড়াচ্ছে এই,—তোর ইচ্ছা নেই ব’লেই বিয়েটা ভাঙ্গতে সে বাধ্য হোল; দোযটা সমস্ত এক তরফেরই।”
আমার দিকটি দিদির কিছুতে চোখে পড়িল না। তিনি কেবল দেখিতে লাগিলেন,—আমিই তাঁহাকে অন্যায়রূপে উপেক্ষা করিয়া, অকারণে আমার নিজেরই সুখসৌভাগ্য বিসর্জ্জন দিতে বসিয়াছি! সুপাত্রে ন্যস্ত হওয়াই কন্যাজীবনের চরম সৌভাগ্য,—
পরম সার্থকতা। গুণবান স্বামীর সোহাগে যে সোহাগিনী— তাহার নিকট অন্য আকাঙ্ক্ষনীয় প্রার্থনীয় বিষয় আর কি আছে? স্বামীর সোহাগের ঘরে শত দুঃখও দুঃখের নহে—আর ইহার অভাবে তাহার জীবন জন্ম নিতান্তই দুঃখময় নিরর্থক বলিয়া অনুভূত। দিদি তাঁহার এই স্ত্রীস্বভাবসুলভ দৃষ্টি দিয়া এখন কেবল এক পক্ষই দেখিতেছেন,—তিনি আমার কিরূপ উপযুক্ত পাত্র, তিনি আমাকে কিরূপ ভাল বাসেন, তাঁহাকে বিবাহ করিলে আমি কিরূপ রূপবান গুণবান স্বামীর প্রেমে সুখী হইতে পারিতাম আর আমার মিথ্যা ছেলেমানষি সেণ্টিমেণ্টের চাপল্যে তাঁহাকে এবং তাঁহার সেই অমূল্য প্রেমকে উপেক্ষা করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের কিরূপ ঈর্ষণীয় অবসর হারাইতেছি! এ অবস্থায় আমার মনোভাবের গাম্ভীর্য্য কি করিয়। তাঁহার দৃষ্টিতে প্রকাশ করি,—কি করিয়া দিদিকে বোঝাই— তাঁহার ও রূপ করিয়া বলার পর আমার আর ভুলস্বীকারের পথ ছিল না, তখন দোষ স্বীকার করিলে আমার হীনতাই প্রকাশ পাইত। দিদির স্নেহ হইতেই যদিও এই কঠোরতার এই নির্ম্মমতার জন্ম,–কিন্তু আমি কি তখন সেই স্নেহ সেই মমতা উপলব্ধি করিয়াছিলাম,—না তাহা করিলেও তাহাতে আমার ব্যথা লাগিত না? দিদির এই সহানুভূতিহীন দোষারোপে আমার প্রকাশের শক্তি পর্য্যন্ত কমিয়া আসিতে লাগিল, অশ্রুজলে অবরুদ্ধ হইয়া ক্রমশঃই ভাষার শক্তি ভাষার স্বর ক্ষীণতর হইয়া পড়িতে লাগিল।
আমাদের দুজনের বাক্বিতণ্ডা শেষ না হইতে হইতে ভগিনীপতি আসিয়া বিষ্ময়ক্রুদ্ধ স্বরে বলিলেন-“কুমু! What is this?” বলিয়া একথান খোলা চিঠি দিদির কোলের উপর ফেলিয়া দিলেন। দিদি নীরবে চিঠিখানা পড়িয়া আমাকে দিলেন। অক্ষর দেখিয়াই বুঝিলাম—তাঁহার চিঠি —পড়িয়া দেখিলাম-যাহা মনে করিয়াছিলাম তাহাই; তাহাতে আমাদের বিবাহ ভঙ্গের কথা এবং আমার ইচ্ছা ক্রমেই এরূপ হইয়াছে তাঁহাকে যেন দোষী না করা হয়,—এইরূপ সৌজন্য প্রকাশ।
চিঠি পড়া আমার তখনো শেষ হয় নাই-ভগিনীপতি বলিয়া উঠিলেন—“Blackguard Rascal! Scoundrels! মিশ করকে বিয়ে কর্ত্তে চায়—তাই এই সব excuse! I will bring a suit against him, I will—upon my honour!”
দিদি বললেন—“ত পার কই, যা বলেছে তাত আর মিথ্যা বলেনি; মণির কথাতেই ত বিয়ে ভেঙ্গেছে?”
“মণির কথাতেই বিয়ে ভেঙ্গেছে? you mean মণির ইচ্ছাতে? বিলাতের সেই engagement ব্যাপার নিয়ে? তুমিত বলেছিলে সে সব মিটমাট হয়ে গেছে! is she mad, Or what new freak of hers is this now”
“আমি তাই ভেবেছিলুম—যে মিটমাট হয়ে গেছে, কিন্তু এখন দেখছি ঠিক মেটেনি”
“Oh Frailty, thy name is woman! কথাটা দেখছি খুবই ঠিক! সামান্য অপরাধে এত কেন? এই ত তোমাদের শিক্ষার উদারতা! স্বাধীনতার ফল! I don't know what todo! I think I shall go mad!"
এইরূপ তিরস্কার এইরূপ অপবাদ নীরবে আত্মসাৎ করিতে আমার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল,—আমার দোষেই এরূপ ঘটিয়াছে সত্য, কিন্তু সমস্ত অবস্থা জানিলে ভগিনীপতিও কি এ দোষ অমার্জ্জনীয় ভাবিতেন; তাঁহার পুরুষের দৃষ্টিতেও কি ইহার মার্জ্জনীয় দিক প্রকাশিত হইত না? কিন্তু কি করিয়। তাঁহাকে সমস্ত বিবরণ খুলিয়া বলি? দিদিকে বলা আর তাঁহাকে বলা ত আর এক কথা নহে —তথাপি আমি প্রাণপণে বল সংগ্রহ করিয়া ক্ষীণস্বরে বলিলাম—“আমি কি করব! তিনি যখন বল্লেন-“বিবাহ না করলে আপনার ক্ষতি হবে কি না কেবল তাই বিবেচনা করেই স্থির করুন বিবাহ করবেন কি না——তখন আমি আর কি বলব? তিনি যদি এর চেয়ে একটুখানি কোমল ভাবে—একটু খানি হৃদয়ের সঙ্গে তাঁর ইচ্ছা আমাকে জানাতেন—তাহলে আমি কি অগ্রাহ্য করতে পারতুম?”
ভগিনীপতি বদ্ধভ্রূকুটি হইয়া বলিয়া উঠিলেন—“কি? আপনার ক্ষতি হবে কি না ভেবে বিবাহ স্থির করুন? Is this a proposal! I see there is a trick in it!”
দিদি বলিয়া উঠিলেন—“কিন্তু আসল ব্যাপার আগে শোন! মফঃস্বলে যাবার আগে সে নিতান্তই অনুনয় বিনয় করে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল, তাতে একটা আশার কথা শোনেনি। মফঃস্বল থেকেও সাধ্যসাধনা করে চিঠি লিখেছিল; কিন্তু তারও এক লাইন উত্তর পর্য্যন্ত পায় নি। এর পরে মানুষ আবার কি ক’রে তবুও feeling দেখায় বল? তারও ত সহ্যের একটা সীমানা আছে। আমি বলি তুমি তাকে স্পষ্ট করে তার মনের ভাব জিজ্ঞাসা কর—যদি বাস্তবিক তার এড়াবার ইচ্ছা হয়—তাও বুঝবে-আর যদি উভয়তঃ ভুল বোঝার জন্য এরূপ ঘটে থাকে তাও সহজে মিটে যাবে”
আমি আস্তে আস্তে সজলনেত্রে দিদিকে বলিলাম—“দিদি তোমার দুটি পায়ে পড়ি তাঁর কাছে আর একথা পাড়তে বলো না; একি কেনা বেচা যে আপনার সুবিধা বুঝে ক্রমশঃ দর কমাতে হবে? যদি তিনি সত্যি ভালবাসেন-ত তিনিই আবার বলবেন। বারণ করো—তাঁকে কোন কথা বলতে।”
ভগিনীপতি চিন্তিতচিত্তে গৃহে পদশ্চারণ করিতেছিলেন; আমার কথায় দিদি কোন কথা কহিবার আগেই তিনি বলিয়া উঠিলেন—“Well! আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারচিনে। I am disgusted with the whole thing I must say. দেখা যাক যে আপনা হতে আর কিছু বলে কি না, এদিকে আমিও তার সম্বন্ধে যতটা পারি সব information নেব এখন। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল—কাল টেনিসে আসতে বলেছি। বিলাতের ব্যাপারটাও তাকে জিজ্ঞাসা করা যাবে—তাহলে লোকটার ভাব অনেকটা ঠিক ধরতে পারব। কিন্তু কথা হচ্ছে আর একটা,—কাল বার লাইব্রেরিতে ঢুকব কি করে?”
দিদি বলিলেন—“আমি ভাবছি বাবার জন্যে। তাঁর কাণে কথাটা উঠলে তাঁর নাজানি কিরূপ কষ্ট হবে!”
আমিও তাহাই ভাবিতেছিলাম, এত ভাবনার মধ্যে সেই ভাবনাতেই আমাকে অধিকতর কাতর করিয়া তুলিয়াছিল।