কাহাকে?/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
চারিদিকেই অশান্তি অসুখ, নিরানন্দ ভাব। দিদি স্তব্ধ গম্ভীর, ভগিনীপতি অকারণক্রুদ্ধ, ভৃত্যদিগের প্রতি অযথা ভর্ৎসনাপরায়ণ, দাসদাসীগণ শশব্যস্ত ত্রস্ত ভীত, এমন কি বাড়ীর গাছপালা ঘরদরজা প্রভৃতি অচেতন জড়পদার্থগুলা পর্য্যন্ত যেন তাহাদের স্বাভাবিক প্রিয়দর্শনতা শূন্য, সমস্ত বায়ুমণ্ডলে কেমন যেন একটা স্তব্ধ অস্বস্তি বিষাদ বিকম্পিত। আমিই ইহার কারণ, আমার মনে কি অন্ধকার গুরুভার। এমন দিনে আবার পিসিমা তাঁহার কন্যা প্রমোদাকে লইয়া এখানে মধ্যাহ্নভোজনে আসিলেন। মনের ভার মনে চাপিয়া আমরা যথাসাধ্য তাঁহাদের মনোরঞ্জনে তৎপর হইলাম। প্রমোদা প্রশ্নের উপর প্রশ্নে আমাকে বিব্রত করিয়া তুলিল “কি হইয়াছে? এত রোগা কেন? এমন বিমর্ষ শুকনো কেন? তিনি মফঃস্বলে গিয়াছেন বলিয়া বুঝি? শীঘ্রই আসিবেন সে জন্য এতটা কেন? বিবাহ ত হইবেই—একটু কি সবুর সয় সয়না,”-ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন আর সেকাল নাই, অন্যান্য অনেক আচার অনুষ্ঠানের ন্যায় সখীদিগের নিকট মন খুলিয়া মনের জ্বালা নিবারণ করিবার প্রথাও নিতান্ত পুরাতন হইয়া পড়িয়াছে, একালের মেয়েদের মনের দুঃখ সহজে মুখে ফুটিতে চাহে না; বিশেষতঃ এমনতর দুঃখ, ইহাত কিছুতেই প্রকাশের নহে,—আমি মনের কথা মনে রাখিয়া কাষ্ঠ হাসি এবং বাকচাতুরীতে তাহাকে ক্রমশঃ নিরুত্তর করিলাম।
বেলা কাটিল, টেনিসের দল সমাগত হইলেন, বাহিরের ও বাড়ীর লোকে মিলিয়া আমরা সবশুদ্ধ দশজনে বাগানে সমবেত হইলাম। যদিও একটিমাত্র কোর্ট কিন্তু লোক অধিক না হওয়ায় তাহাতে খেলার তেমন অসুবিধা হইল না। পিশিমা খেলেন না—আমিও শারীরিক অবসন্নতার দোহাই দিয়া প্রথম হইতেই দর্শকশ্রেণীভুক্ত, অন্যেরা একদলের বিশ্রামে অপরদল খেলিতে লাগিলেন।
ডাক্তারও আসিয়াছিলেন, খেলার অবসরে নিকটে আসিয়া বসিলেন,–স্বাভাবিক মৃদুস্বরে বলিলেন—“আপনাকে ভারী দুর্ব্বল মনে হচ্ছে! আপনার দিদি বলছিলেন, আপনি ভারী careless, স্বাস্থোর দিকে আপনার মোটেই নজর নেই, নভেল পেলে খাওয়া দাওয়া পর্য্যন্ত ভুলে যান!”
আমি বলিলাম “কই। আজকাল ত পড়াশুনা একরকম ছেড়ে দিয়েছি বল্লেই হয়।”
প্রমোদা আমার কাছে বসিয়াছিল—সে বলিল—“পড়াশুনা ছেড়েছে কি না জানি না, তবে খাওয়া দাওয়া যে ছেড়েছে তার সাক্ষী আমি দিতে পারি। ডাক্তার মশায় ওকে একটা ওষুধ দিন না।”
ডাক্তার বলিলেন “gladly! আজই একটা প্রেসক্রিপসন লিখে দেব এখন, কিন্তু খাবেনত?”
আমি গল্প করিতেছিলাম—কিন্তু আমার দৃষ্টি ছিল টেনিস খেলার দিকে, ডাক্তারের প্রশ্নে আমি একটু হাসিয়া তাঁহার দিকে চাহিলাম,—দেখিলাম তাঁহার দৃষ্টি স্নেহপূর্ণ অতি মধুর, তাহাতে আমার মর্ম্মস্থল পর্য্যন্ত যেন ভরিয়া গেল, ব্যথিত অন্তর দেশ হইতে ধীরে ধীরে, সুখের দীর্ঘ নিঃশ্বাস উঠিল, হৃদয়ের পাষণভার দ্রব হইয়া অশ্রুতে উথলিয়া উঠিতে চাহিল, কণ্ঠাগ্রে এই কথাগুলি আসিয়া আবার মিলাইয়া পড়িল—“আপনার ওষুধে কি আমার মনের অসুখ তাড়াতে পারবেন?”
মনের কথা মনে, চোখের জল চোখে চাপিয়া নতমুখী হইলাম। এই সময় তাঁহার ডাক পড়িল “I say Doctor,—come on, you are wanted here to make up a new set.”
তিনি ইহাতে কোন উত্তর না করিয়া আমাকে বলিলেন “আরবারে আপনাকে যে টনিক দিয়েছিলুম—তাতে কি উপকার হয়েছিল? কত দিন”—
ভগিনীপতি আবার ডাকিলেন–“I say come on”– চঞ্চল নিকটে আসিয়া বলিল “আপনি আসবেন না? আপনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি—” তিনি একটু যেন থতমত থাইয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন “Am I really making you all wait? Oh it is too bad of me—”
বলিতে বলিতে তিনি চলিয়া গেলেন—প্রমোদা বলিল “ডাক্তার খুব ভাল লোক-না?” আমি কোন উত্তর করিলাম না।
তীব্র রোগাবসানে দুর্ব্বল দেহমনে নবস্বাস্থ্যের সঞ্চারে আবার জগতের দিকে চাহিয়া, আত্মীয় স্বজনের স্নেহাদর অনুভব করিয়া যে অবসাদময় স্বপ্নময় সুখ তাহার আস্বাদ যিনি লাভ করিয়াছেন, তিনিই আমার তখনকার মনের অবস্থা অনুভব করিতে পরিবেন।