কাহাকে?/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ।

 অন্য সকলে চলিয়া গেলে ভগিনীপতি ডাক্তারকে ডিনারে থাকিতে বলিলেন। সন্ধ্যার পর আমরা গৃহ কর্ম্ম সারিয়া ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তিনি একাকী টেবিলের নিকট বসিয়া আমার সেই পরিত্যক্ত নভেলখানি লইয়া পড়িতেছেন। আমরা একেবারে নিকটে আসিতে তাঁহার যেন হুঁস হইল, বইখানি বন্ধ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দিদি বলিলেন, “বসুন। এমন অজ্ঞান হয়ে কি পড়ছিলেন? মিডলমার্চ্চ? আমরা এসে ত আপনার সুখস্বপ্ন ভাঙ্গালুম না?”

 আমরা উপবিষ্ট হইলে ডাক্তারও বসিলেন—বসিয়া ঈষৎ উৎগ্রীব হইয়া তাঁহার সুকোমল পাণ্ডুবর্ণ, বালোপম মসৃণ চিবুক ও কপোল প্রান্তন্থ, কর্ণমূল বিলুষ্ঠিত আকুঞ্চিত বিরল শ্মশ্র গুচ্ছে বামহস্তের অঙ্গুলী সঞ্চালিত করিতে করিতে, সূক্ষ্ম স্বর্ণরজ্জু গ্রথিত আইগ্লাসের মধ্য হইতে আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিলেন—“মাপ করবেন, সত্যিই এ একটা আমার ভারী weakness; জর্জ এলিয়টের নভেল একখানি হাতের কাছে পেলে আর লোভ সামলাতে পারি নে। দেখুন না এই বইখানা কতবার পড়েছি—তার ঠিক নেই,—তবুও এখন মনে হচ্ছিল,— যেন নতুন বই পড়ছি, নতুন জ্ঞান নতুন আনন্দের মধ্যে ডুবে আছি। আপনি অবশ্য পড়েছেন বইখানি?”

 দিদি। পড়েছিলুম অনেকদিন আগে; মন্দ লাগেনি। কিন্তু মাঝে মাঝে যে লম্বা লম্বা লেক্‌চার—সেইগুলোতে কেমন যেন প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে।

 ডাক্তার। হ্যাঁ তাতে গল্পের interest তেমন নেই বটে কিন্তু লেখকের ideal তা থেকে বেশ স্পষ্ট মনে বসে। বলতে কি, জর্জ এলিয়টের একটি লাইন ও আমার বাদ দিতে ইচ্ছা করে না, অনাবশ্যক বা অপ্রীতিকর বলে মনে হয় না; যে পাতাই ওলটাই— যেখান থেকেই পড়ি-পড়তে পড়তে একটা জ্বলন্ত সহানুভূতির ভাবে হৃদয় যেন সতেজ হয়ে ওঠে—পৃথিবীর জীবন সমষ্টির মধ্যে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়—এবং সেই মহাসমষ্টিতে আপনার সুখদুঃখ বিসর্জ্জন দিয়ে সুখী হতে ইচ্ছা করে।

 দিদি। আপনি কি বলেন! মিডলমার্চের হিরোইন ত দু দুবার বিয়ে করেছিল? আত্মত্যাগের কি চূড়ান্ত আদৰ্শই তাতে দেখালে!”

 ডাক্তারের ওষ্ঠাধরে একটু যেন হাসির রেখা দেখা দিতে না দিতে মিলাইয়া পড়িল,—তিনি গম্ভীরভাবে বলিলেন “আপনারা হয়ত ভুলে যান নভেলিষ্ট আর নীতিশিক্ষক এক নন। তিনিও নীতিশিক্ষা দেন বটুে-কিন্তু তাঁর প্রণালী স্বতন্ত্র, তিনি চিত্রকর। বিশ্বের অভঙ্গ অব্যর্থ নিয়মের মধ্যে, সমাজের ভঙ্গ প্রবণ ক্ষণিক নিয়মের মধ্যে নিয়তিব এবং স্বভাবচক্রের গতিতে চরিত্র ভেদে অবস্থাভেদে মানুষ কিরূপ বিচিত্র মূর্ত্তিতে ফুটে ওঠে—তাই ছবির মত একে দেখানই নভেলিষ্টের কাজ। জর্জ এলিয়ট মানুষের মানুষত্ব ছুঁতে চান না,তাকে জড় বা দেবতা করতে চান না। সহানুভূতিতে, ভালবাসাতে সেই মানুষত্বের পূর্ণবিকাশ করতে চান মাত্র। ডরথিয়া ideal রাজ্যেই বাস করে, তার আশা আকাঙ্ক্ষা সমস্তই অসাধারণ; সত্য জগতের সংশ্রবে এরূপ স্বভাবের লোক কিরূপ ভুল করে লেখক তার ছবিতে তাই দেখিয়েছেন। তার জীবনের এই failure এর মধ্যে ও কি খুব একটা pathos নেই।

 দিদি। তার উপর মমতা হয় বটে—কিন্তু ভারি রাগ ধরে— আবার শেষে ও অমন একটা অপদার্থকে ভালবাসলে?

 আমি বলিলাম—“কেউ কেউ বলেন, ডরথিয়া, ম্যাগি, নাকি লেখিকারি চরিত্রের ছায়া?”

 ডাক্তার বলিলেন—“এইরূপ শোনা যায় বটে। তাঁর জীবনের উচ্চতম আশা আকাঙ্ক্ষা আদর্শে তিনি যেমন বিফল—”

 ভগিনীপতি আসিয়া পড়ায় কথাটা থামিয়া গেল। দিদি বলিলেন “এত দেরী যে!”

 ভগিনীপতি ললিলেন—“মক্কেলটাকে আর কিছুতে তাড়াতে পারিনে। কি discussion চলছে হে—জর্জ্জ এলিয়ট? Oh! she is a great creator, we must admit that, I am sorry to say.”

 ডাক্তার। What a reluctant admission! Does not your man's nature take delight in glorifying such genius in a woman? What a grand intellect she had—combined with the sympathetic heart and subtle instinct of a true woman! মানুষের সামান্য অসামান্য প্রত্যেক কার্য্যটি, তার অন্তর স্বভাবের কিরূপ নিগুঢ় উদেশ্য কিরূপ সূক্ষ্মতম ভাব থেকে প্রসূত তিনি যেমন তা চুল চিরে দেখিয়েছেন এমন কোন পুরুষ নভেলিষ্টে পেরেছেন কি?”

 ভগিনীপতি। There I quite disagree. Do you mean to say she is as great a genius as Shakespere, or even modern—

 ভগিনীপতির কথা শেষ করিতে না দিয়াই ডাক্তার খুব সতেজে বলিলেন-"Of course, why not? Though at first I spoke of novelists only—yet if you choose to bring in Shakespear's name I have not the slightest hesitation in pronouncing her to be as great in her sphere, as Shakespeare is, in his.”

 এমনতর আস্পদ্ধাপূর্ণ মূর্খামির কথায় ভগিনীপতিকে নিতান্তই বিচলিত করিয়া তুলিল। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন “What a monstrous proposition —Quite blasphemous to my mind. I never heard of such a ridiculous comparison 1 She is no more a Shakespear than you are my dear fellow—however cleverly she might have written her novels.”

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “Of course she isn't—how could she possibly be Shakespeare Did I really say such a foolish thing? What I meant to say, and would go on repeating till the end of my life is this—that the genius shown in the works of George Elliot is in no way inferior to that of any renowned poet or novelist of England, dead or alive.”

 ভগিনীপতি। But it comes to the same thing. Well, prove in what way she is as great a creative genius as Shakespeare?

 ডাক্তার বলিলেন-But the burden of proof lies on you my friend!”

 এই সময় ডিনারের ঘণ্টা পড়িল, আমরা যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। তাঁহাদের বাকযুদ্ধ যে কোথায় গিয়া দাঁড়ায়—এই ভাবিয়া আমরা মহাভীত হইয়া পড়িয়ছিলাম।—দিদি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—“তর্কটা এখন রেখে দিলে হয় না—ডিনারের ঘণ্টা পড়েছে।”

 তাঁহারাও উঠিয়া দাঁড়াইলেন,–কিন্তু ভূতে পাইলে সে যেমন মানুষকে ছাড়িতে চাহে না তর্কে পাইলে মানুষ তেমনি তাহাকে ছাড়িতে চাহে না। উঠিয়া দাঁড়াইয়াও ভগিনীপতি বলিলেন—“You must give me good reasons my dear fellow, or else you must admit that she was not a Shakespeare.”

 ডাক্তার বলিলেন—All right, that I heartily admit. As she was a woman and called George Eliot she could not be a man or Shakespeare either!"

 ভগিনীপতি হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন—“The premises being granted the conclusion must follow as the night the day, that her genius also could not be on a par with Shakespear's. Now let us shake hands in the name of Shakespeare, who was the * principal cause of this never-ending discussion which has however ended happily to the satisfaction of all parties. Vive le Shakespeare the great man!”

 ডাক্তার ভগিনীপতির হাত সজোরে ঝাঁকাইয়া বলিলেন— “Vive la George Eliot the great woman!"

 ভগিনীপতি। All right! I have no grudge against her you will see. Three cheers for Shakespeare— Three cheers for George Eliot!

ডাক্তার। And vice versa. Three cheers for George Eliot-Three cheers for Shakespeare!”

 দুজনে মিলিয়া ইহার পর একসঙ্গে হুরে হুরে করিয়া উঠিলেন। আমি বলিলাম

 “আর আমাদের লেখকেরা বুঝি বাকী থাকিবেন?”

 দিদি। তাত বটেই। বঙ্কিমচন্দ্রের জয় সর্ব্বাগ্রে।

 ভগিনীপতি সুর করিয়া গাহিলেন—

 জয় every lady র জয়, জয় every gentlemanএর জয়,

 জয় জয়, জয় ভারতের জয়।”

 কে জানিত রুদ্ররস এমন হাস্যরসে পরিণত হইবে, তাঁহাদের উক্ত গানের কোরসে আমাদের ক্ষীণ হাসির কোরস তেমন ফুটিল ন। কিন্তু আমরা হাসিতে হাসিতে ভোজন গৃহে সমাগত হইলাম।