কাহাকে?/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।


আমাতে আর আমি নাই। মনের মধ্যে প্রলয় ঝটিকা প্রবাহিত। বাবা আহারান্তে বাহিরে গেলেন। আমার আজন্ম-শিক্ষিত ভয় লজ্জা সঙ্কোচ এই বিপ্লব-আবেগে তুণের মত যেন উড়িয়া গেল, আমি উত্তেজিত আলোড়িত মস্তকে গৃহে আসিয়া বাবাকে পত্র লিখিলাম—

 “শ্রীচরণেষু—

 বাবা, আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা নাই; ইছা বালিকার খেয়াল মনে করিবেন না। আমি খুবই ভাল করিয়া হৃদয় পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া বলিতেছি বিবাহে আমার সুখ নাই। ইংলণ্ডে ত এমন অনেকেই অবিবাহিত থাকেন। থাকিয়া দেশের জন্য কাজ করেন, আমিও দেশের কার্য্যে জীবন উৎসর্গ করিতে চাই। আমি বেশ জানি তাহাতেই আমার একমাত্র সুখ। বিবাহ দিয়া আমাকে অসুখী করিবেন না।”

আপনার স্নেহের
মৃণালিনী।

 বাবা অফিসে যাইবার পুর্ব্বেই চাকরের হাতে চিঠিখনি তাঁহাকে পাঠাইয়া উৎকণ্ঠিত কম্পিত চিতে ইহার ফল প্রতীক্ষা করিতে লাগিলায়। কিছু পরে পদশব্দ হইল, বুঝিলাম বাবা নিজেই আসিতেছেন—লুপ্ত লজ্জা সহসা ফিরিয়া আসিল; মনে হইল কি করিয়া তাঁঁহাকে মুখ দেখাইব! তিনি ঘরের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন, আমি নত মুখে মাটির দিকে চাহিয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ বাবা নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “তোমার দেখছি ভারি একটা ভূল সংস্কার জন্মেছে; বিবাহ করলে কি দেশের কাজ করা যায় না! আমাদের দেশের যে রকম অবস্থা অবিবাহিত স্ত্রীলোকের পক্ষেই বরঞ্চ এসব কাজে বাধা বিঘ্ন অধিক। বিবাহে যে তুমি সুখী হবে, তোমার জীবনের সমস্ত কর্ত্তব্য সমস্ত উদ্দ্যেশ্য সাধিত হবে তাতে আমার সন্দেহ মাত্র নেই। স্ত্রীলোকের ঐহিক পরিমার্থিক, সকল প্রকার মঙ্গলের জন্যই বিবাহ শ্রেষ্ঠ, প্রশস্ত পথ। তুমি অনভিজ্ঞ অজ্ঞান বালিকা, তোমার কথায় কাজ ক’রে আমি তোমার অমঙ্গলের কারণ হতে পারিনে। এতদিন যোগ্য পাত্রের অভাবে ইচ্ছা সত্ত্বেও তোমার বিবাহ দিতে পারিনি; এখন ঈশ্বরেচ্ছায় সুপাত্র মিলেছে তোমারও সৌভাগ্য আমারো সৌভাগা। এই সৌভাগ্যে আপনাকে ধন্য মনে করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করে আনন্দ হৃদয়ে তোমার পতিদেবতাকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হও।”

 বাবা এইরূপ বলিয়া উত্তরের অপেক্ষ না করিয়াই চলিয়া গেলেন। আমি বুঝিলাম তাঁহার সঙ্কল্প অটল—আরো বুঝিলাম, তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে আমার ক্ষমতা নাই। আমি মর্ম্মে মর্ম্মে দুর্ব্বল বঙ্গনারী, আজ্ঞাবর্ত্তী দুহিতা। জীবন বিসর্জ্জন দিতে পারি-কিন্তু ইহার পরে বিবাহ সম্বন্ধে দ্বিরুক্তি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আত্মজলাঞ্জলি ভিন্ন আমার উপায়াস্তুর নাই।