কাহাকে?/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।


 বাড়ী পা দিব্যমাত্র জ্যেঠাইমার আমার প্রতি স্বাগত সন্তাষণ—“ওমা কি হবে গো। মেয়ে যে পেল্লায় বড় হয়ে উঠেছে! আর এখনো আয়বড়! লোকে দেখলে বলবে কি! ছিছি ঠাকুর পো তোমার মুখে অন্নজল রোচে কি করে গা!”

 বাবা ব্যস্তসমস্ত পলায়নপর হইয়। বলিলেন—“শীগগিরই হবে—শীগগিরই হবে; সবই এক রকম ঠিক—সেজন্য তোমার কোন ভাবনা নেই।”—

 সব ভাল করিয়া শোনা গেল কি না গেল, তিনি কোন রকমে কথা গুলো মুখের বাহির করিয়া চলিয়া গেলেন।—

 জ্যেঠাইমা ইহাতে আরো অসন্তুষ্ট হইয়া আপন মনে গণগণ করিতে লাগিলেন—“না আমার কোন ভাবনা নেই—তোমারি যত ভাবনা? এই যে পাঁচজন মেয়ে ছেলে এখনি এখানে আসবে, মণিকে দেখে নানা কথা বলবে তুমিত আর শুনতে আসবে না; আমারি লজ্জায় বাকরোধ হবে।”

 জ্যেঠাইমার ভয় দেখিলাম নিতান্ত অকারণ নহে। সত্য সত্যই আমি আসিয়াছি শুনিয়া আমাদের যত কেহ আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবাসী মহিলাগণ পালায় পালায় প্রতিদিন দল বাঁধিয়া আমাকে দেখিতে আসেন; আসিয়া,আশ্চর্য! প্রতি জনে ঠিক একই রকম ভাষায়, পাখীর শেখা বুলির মত আমার অকাল কৌমার্য্যে বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করিয়া অবশেষে বাবার মুঢ়তার নিন্দাবাদে প্রচুর পরিতৃপ্তি সঙ্গে লইয়া গৃহে ফেরেন। এমন কি এইরূপ সমবেত জল্পনায় জ্যেঠাইমার যথার্থ দুঃখের তীব্রতা ও ক্রমশঃ হ্রাস হইতে লাগিল; সারগ্রাহিণী সুন্দরীবর্গের শিক্ষাগুণে, মরালের অনুকরণে তিনিও এই অনিবার্য্য দুঃখকর ঘটনার মধ্য হইতে নিন্দাবাদের মুখ টুকু ছাঁকিয়া উপভোগ করিতে লাগিলেন। আমারি জীবন কেবল ইহাতে অসহ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। তথাপি ভাবিয়া দেখিলাম বিবাহের অপেক্ষ,—যাহাকে ভালবাসিনা তাহার পত্নী হওয়া অপেক্ষ, এই অশাস্তি অসুখও চির সহনীয় চির বরণীয়। বিবাহের কথা মনে করিতেই সমস্ত স্বায়ুপ্রণালী এমনি বিপর্য্যস্ত হইয়া উঠে।

 দিন যায়। বাহিরের লোকের তীব্র সমালোচনা, জ্যেঠাইমার বাবাকে ভর্ৎসনা, বাবার তাঁহাকে প্রশান্ত আশ্বাস প্রদান, এই রকমে প্রতিদিন একই ভাবে কাটে। বিবাহের নূতন কোন কথা বা ছোটুর কোন উল্লেখ আর শুনিতে পাই না। সেইজন্য এই অশান্তি অসুখ সত্ত্বেও দিনে দিনে আমি আশ্বস্ত হইতে লাগিলাম, আমার মন হইতে অল্পে অল্পে আশঙ্কার ভাব তিরোহিত হইতে লাগিল; ক্রমশঃ এতদূর স্বচ্ছন্দভাব অনুভব করিতে লাগিলাম যে আমার মনের নিভৃত চিন্তাগুলি মনোমধ্যে আবার বেশ জমাইয়া গুছাইয়া লইয়া তাহার উপভোগে রত হইলাম। লোকে নিজের দুঃখ ভুলিতে পারিলে পরের দুঃখে সহানুভূতি করিতে অবসর পায়। আমি আত্মস্থ হইয়া জোঠাইমার ও পাড়াপ্রতিবাসীর কঠোর মন্তব্য গুলিকে ও অন্য ভাবে দেখিতে শিখিতেছি; তাঁহাদের তীব্রোক্তিতে তাঁহাদের আজন্ম কালের মতবিশ্বাসজাত আকুলতা বুঝিয়া ক্রোধ ও বিরক্তির পরিবর্তে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির ভাবে তাহ সহিয়া লইয়া একটা প্রশান্ত নিরাশার ক্রোড়ে যখন আপনার আশ্রয় প্রস্তুত করিয়া লইয়াছি তখন বাবা একদিন আহারকালে বলিলেন—“ছোটু দু একদিনের মধ্যেই এখানে আসছেন। তিনি এলেই বিবাহের দিন স্থির হবে।”

 জ্যেঠাইমা আহিলাদে বলিয়া উঠিলেন “বর নিজেই আগে আসছে? তুমি যে বলেছিলে বরের মা আসবে? তা বুঝি এলনা! আজি কাল এই রকমই হয়েছে, ছেলে নিজে না মেয়ে দেখলে হয় না! তা দেখুক কিন্তু আর দেরী না—এই মাসের মধ্যেই বিয়ে দেওয়া চাই।”

 বাবা বলিলেন “আমারো তাই ইচ্ছা।”