কাহাকে?/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
জীবনে কত মহাবিপদে পড়িয়াছি কিন্তু কখনও আমাকে এই সামান্য বিপদের মত এত কাতর এত অভিভূত করে নাই। যেন ভীষণ অন্ধকারে একাকী দাঁড়াইয়া, দেহে তীক্ষ শাণিতাস্ত্র বর্ষণ চলিতেছে, আত্মরক্ষার কিছুমাত্র উপায় নাই, হস্ত উঠাইতে মস্তক তুলিতে শতধার কৃপাণ তাহার তীক্ষতা আরো ভীষণরূপে অনুভব করাইয়া দিতেছে। আমি যন্ত্রণাজর্জ্জর কাতরপ্রাণে সর্ব্বাস্তঃকরণে কেবল ডাকিতেছি, মাত: পৃথিবী বিদীর্ণ হও আমি তোমার মধ্যে প্রবেশ করি। সে কাতর প্রার্থন ব্যর্থ হইল না, জগৎমাতার সিংহাসন বিকম্পিত করিয়া তাহ করুণা অনয়ন করিল। তখনো আমি সেই চৌকিতে সেইরূপ মুহ্যমান ভাবে বসিয়া আছি, চাকর আসিয়া খবর দিল বাবা আসিয়াছেন। বাবার আসিবার কথা ছিল বটে, তিনি লিখিয়াছিলেন আমাকে আসিয়া লইয়া যাইবেন, তবে এত শীঘ্র আসিবেন তাহা আমরা মনে করি নাই।
দিদির ঘরে প্রবেশ করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইলাম, অগ্রসর হইয়া প্রণাম করিতেও সাহস হইল না, দেখিলাম বাবা অগ্নি মূর্ত্তি হইয়া ক্রোধবিকম্পিত উগ্রস্বরে দিদির সহিত কথা কহিতেছেন, বুঝিলাম অবশ্য আমাকে লইয়াই তাঁহাদের বাকবিতণ্ডা, কম্পিত কলেবরে সেখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম, তাঁহারা আমার আগমন লক্ষ্য না করিয়াই পুর্ব্বের ভাবে কথা কহিতে লাগিলেন। বাবা বলিলেন “সে শোনবার মত কথা কি যে বলব? আমি যে গুনে পাগল হয়ে যাইনি তা আমার আশ্চর্য্য মনে হচ্চে। তুমি বলছ মণির ইচ্ছা ছিলনা তাই বিবাহ ভাঙ্গতে হয়েছে। বাজার রাষ্ট্র সে নাকি বলেছে কন্যার শোভন শীলতা, নম্রতার অভাব দেখেই তাকে সরে পড়তে হয়েছে। বেশী আর কি বলব।”
দিদি। মিথ্যা কথা!
বাবা। মিথ্যা কথা তা কি আমাকে বলতে হবে? মণির মত স্বাভাবিক বিনয়, নম্রতা, লজ্জা কটা মেয়ের আছে?
দিদি। না তা বলছিনে। পাত্র কখনই এরূপ বলেনি, মিথ্যা গুজব; এখনো সে বিয়ে করতে রাজি, যদি ওরূপ তার মনের ভাব হবে তাহলে কি—
বাবা। বিয়ে করতে রাজি! আমন পাত্রে আমি মেয়ে দেব!
দিদি। কিন্তু আপনি স্থির হয়ে একটু ভেবে দেখুন তাতেই লোকলজ্জা কলঙ্ক সমস্ত দূর হবে।
বাবা। লজ্জা কলঙ্ক যা হবার হয়েছে, তার চেয়ে বেশী আর কি হবে? হলেও সবই সহ্য করব তবু অমন চণ্ডালের হাতে মেয়ে সমর্পণ করব না।
দিদি। কিন্তু আপনি পরের কথা শুনে অন্যায় করছেন। সে কখনই অমন দুর্জ্জন নয়, অমন করে সে বলেনি।
বাবার রাগ তাঁহাতে উপশমিত হইল না। তিনি তেমনি ক্রুদ্ধ ভারে বলিলেন—“Scoundrel! নিশ্চয়ই বলেছে! মণি যে তাকে বিবাহ করতে নারাজ সেটা বলতে যে তার নিজের মান হানি হয়! কিছুতেই আমি তাকে কন্যাদান করব না। মণিকে আজই রাত্রে সঙ্গে নিয়ে যাব। নিজে দেখে শুনে যে পাত্র পছন্দ করব তাকেই মেয়ে দেব। তোমাদের মত ইংরাজী কোর্টসিপ আর না।”
দিদি অনেক করিয়া তাহাকে দু এক দিন থাকিতে অযুরোধ করিলেন, বাবা কিছুতেই রাজি হইলেন না, সেই রাত্রেই আমরা ঢাকা যাত্রা করিলাম। গাড়ীতে উঠিয়া আমি যেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলাম, পিতার স্নেহের মধ্যে আপনাকে পুর্ণভাবে ছাড়িয়া দিয়া অনেক দিনের পর অতি অপূর্ব্ব শান্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। কিন্তু অধিকক্ষণ সে সুখভোগ অদৃষ্টি ঘটিল না। কে জানে সংসারের একি দানব নিয়ম! কাহারও অতিমুখ তাহাকে এ পর্য্যন্ত সহ্য করিতে দেখিলাম না! ষ্টিমারে বাবা বলিলেন “ছোটুকে তোমার মনে পড়ে কি?”
“পড়ে বই কি!”
“তাঁর মায়ের ভারী ইচ্ছা তোমাকে পুত্রবধূ করেন। আমারে অত্যন্ত ইচ্ছা ইহাকে জামাতা করি; এমন স্বপাত্র সচরাচর পাওয়া যায় না; ভগবান যদি বিমুখ না হন, তোমার যদি ভাগ্যবল পুণ্যবল থাকে তাহ’লে ঢাকায় গিয়ে যত শীঘ্র হয় এই শুভ বিবাহ সম্পন্ন করার ইচ্ছা আছে।”
যে আশা যে কল্পনা অনেক দিন ধরিয়া হৃদয়ে নিরবচ্ছিন্ন সুখকর স্বপ্ন রাজ্য নির্ম্মাণ করিত আজ তাহাই সত্যে পরিণত হইবার সম্ভাবনায় সহসা বজ্রাঘাতে যেন স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম।