কাহাকে?/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।
কাহাকে? তাহাতে কি আর সন্দেহ আছে? চঞ্চল কি জানে? তার সব অনুমান বইত নয়! মিষ্টার ঘোষ যে এমন সুবিধার বিবাহ আপন হইতে ছাড়িবেন তাহা হইতেই পারেনা; কেন ছাড়িবেন, তাহার যখন কোন কারণই নাই। কুসুমই এ বিবাহে অসম্মত হইয়াছে। যতক্ষণ চন্দ্রোদয় না হয় ততক্ষণ নক্ষত্র দীপ্তিশালী, চন্দ্র উঠিলে কি আর তারার আলো চোখে লাগে? ডাক্তারের সহিত পরিচিত হইয়াই কুসুম মন পরিবর্ত্তন করিয়াছে —কুসুমের সহিতই ডাক্তার engaged; নহিলে ইঁহার নাম শুনিবামাত্র কুসুম ওরূপ বিহ্বলতা প্রকাশ করে কেন! বেচার রমানাথ! তাহার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতির দীর্ঘ নিশ্বাস উঠিল।
স্তব্ধ নিশায় শয্যাশায়ী একাকী আমি নির্ব্বাধে চিন্তামগ্ন হইয়া এইরূপ মীমাংসা করিতে করিতে আর একটি কথা সেই সঙ্গে বারম্বার এই ভাবিতেছিলাম—“কুসুম কি ভাগ্যবতী!” ইহার মধ্যে কি ঈর্ষা লুকান ছিল? নিশ্চয়ই। লোকে বলে এমন স্থানে ঈর্ষা না হইয়া যায়না-আমি কি আর সৃষ্টিছাড়া! তবে এ ঈর্ষা নিতান্তই নিরীহ ঈর্ষা, অপূর্ণ আকাঙ্খা উত্থিত নৈরাশ্য বেদনা;—আকুল দীর্ঘ নিশ্বাসে মাত্র তাহার বিকাশ ও তাহাতেই তাহার অবসান, বিকৃত বিরূপ বিদ্বেষপূর্ণ অভিশাপ ইহাতে ছিল না! থাকিবার কথাও নহে।—যেখানে অধিকারে, উপভোগে কেহ অপহারক সেখানে সেই অপহারকের প্রতি ক্রোধ বিদ্বেষ স্বাভাবিক। কিন্তু কুসুম আমার কাছে কি দোষে দোষী? আমা হইতে আমার প্রিয়তমের স্নেহও সে ছিন্ন করে নাই, আমার আত্মীয়তা অধিকারও তাহা হইতে সে হরণ করে নাই —সৌভাগ্য ক্রমে সে না হয় তাঁহার প্রণয়িনী হইয়াছে, যদি তাহা না হইত—যদি কুসুমকে তিনি না ভালবাসিতেন— তাহা হইলেই যে আমি সে ভালবাসা পাইতাম এমন আশাও আমার মনে নাই। তবে তাহার উপর ক্রোধ বিদ্বেষ জন্মিবে কেন? বরঞ্চ বিপরীত। দ্বেষের পরিবর্ত্তে এই ঈর্ষার আঘাতে আমার হৃদয়ের একটি গুপ্ত প্রতিদ্বার সহসা খুলিয়া গেল। সত্য কথা বলিতে হইলে, ইতি পূর্ব্বে আমি কুসুমের প্রতি সখ্যভাব অনুভব করি নাই। কিন্তু যখনি মনে হইল—কুসুম আমার প্রিয়তমের প্রিয়তম—তখনি আমারও সে প্রিয় হইয়া উঠিল,— তাহার যে সকল গুণ রাশি এতদিন আমার অন্ধনয়নে অপ্রকাশিত ছিল—পরম প্রীতি ভাজন বন্ধুর মত সহসা সেই সবে আমি সাতিশয় আকৃষ্ট হইয়া উঠিলাম, এবং এই নবসখ্যতা ভাবে আমাকে এতদূর অধীর এতদূর বিহ্বল করিয়া তুলিল যে তখনি তাহাকে সখিত্বের ডোরে বাঁধিয়া তাহার সৌভাগ্যে আনন্দ প্রকাশ করিয়া পত্র লিখিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলাম। এমন কি মনের আবেগে বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িলাম, কিন্তু ডেক্সের কাছাকাছি আসিয়া সহসা মন পরিবর্ত্তিত হইল, মনে হইল, ছি কুসুম কি ভাবিবে? আর কিই বা লিখিব! আস্তে আস্তে আবার ফিরিয়া গিয়া বিছানায় ঢুকিলাম।
পরদিন সকালে দিদি বলিলেন “সে আসবে জানিস?” আমার হৃৎপিণ্ড বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম—“কবে?”“কাল টেনিসে।—মুখে তুই কিছু বলিসনে, কিন্তু দিন দিন যে রকম শুকিয়ে যাচ্ছিস দেখলে চোখে জল আসে।”
ভারী লজ্জা হইল, ছি ছি—দিদিও ধরিয়া ফেলিয়াছেন! “হ্যাঁ শুকিয়ে যাচ্ছি! তোমার যেমন কথা!”
দিদি বলিলেন—“আর এতটা কষ্ট কেন—না সামান্য একটু ভুল বোঝার জন্যে!”
আমি সহসা আকাশ হইতে পড়িলাম—বুঝিলাম ডাক্তারের কথা বলিতেছেন না।
দিদি বলিলেন—“সে যে তোকে ভালবাসে তাতে আর সন্দেহ নেই। ওনার সঙ্গে দেখা হতে নিজেই সে কথা তুলে বলেছে যে তোর ব্যবহারে তার অত্যন্ত কষ্ট হয়েছে;—যদিও অন্য পার্টিরা তাকে বিয়ের জন্য বিশেষ ধরে পড়েছেন—কিন্তু এখনো সে তাদের কথা দেয়নি। এখনো যদি তোর মত হয়, ত সে সমস্ত Sacrifice করতে প্রস্তুত। কাল আসবে, দেখিস যেন আবার হেঙ্গাম বাধিয়ে বসিস নে। তুই ভাল বাসিস, সেও ভাল বাসে, মাঝে থেকে এক ফ্যাকড়া!”
আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। আমি এখন নিজের হৃদয় বেশ ভাল করিয়া বুঝিয়াছি, তাঁহাকে ভালবাসা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব, তবে বিবাহ করিব কি করিয়া? আমি বলিলাম “আমার জন্য তাঁকে কোন রকম sacrifice করতে হবে না। দিদি, আবার কেন এ হেঙ্গাম বাধান? আমি দেখা করতে পারব না!”
দিদি বলিলেন “তুই এমন কথা ধরতে পারিস? sacrifice বলেছে, অমনি অভিমান!”“অভিমান আবার কোথায় পেলে। ভালবাসাস্থলেই মানাভিমান! ভালবাসাতেই আত্মবিসর্জ্জন ক’রে ও আত্মবিসর্জ্জন নিয়ে সুখ। তেমন ভালবাসা থাকলে তিনিও এটা sacrifice ভাবে দেখতেন না, আর আমারো তা গ্রহণ করতে কুষ্ঠা হোত না।—যাকে ভালবাসিনে তার উপর মানভিমানই বা কি-আর তার sacrificeই বা নিতে যাব কেন?”
দিদি তবুও মনে করিলেন—ইহা আমার অভিমানের কথা। হাসিয়া বলিলেন,—
“তোর সঙ্গে বাবু আমি তর্কে পারব না-সেত কাল আলছেই, এসে তর্কভঞ্জন মানভঞ্জন সবই করবে এখন।”
আমি দৃঢ়স্বরে বলিলাম “দিদি তুমি খুবই ভুল বুঝছ। অভিমান করে আমি এরূপ বলছিনে। তাঁর এ কথায় আমার বরঞ্চ আহ্লাদই হয়েছে-মন থেকে একটা দারুণ ভার নেমে গেছে। আমি যাকে ভালবাসতে পারছিনে—তিনি আমাকে ভালবাসছেন—আমি তাঁর কষ্টের কারণ—এটা মনে করতে কি খুব সুখ নাকি?”
দিদি রাগিয়া বলিলেন “তোর মত আত্মম্ভরী লোক যদি আর দুটি আছে? সেই যে ধরে বসেছিস সে ভাল বাসেনা—এ আর কিছুতে ছাড়বিনে। যা হক কাল ত সে আসছে, দেখা ত হোক, তারপর যা হয় হবে”—
আমি কাতর হইয়া বলিলাম—“আমি দেখা করতে পারব না দিদি,—ব’লো আমার অসুখ করেছে।”
“অসুখ করেছে! উনি এদিকে তাকে আসতে বলে এসেছেন,—ভাবে গতিতে প্রকাশ করেছেন যে তোর আর এ বিয়েতে কোন আপত্তি হবেনা; আর তুই এখন বলছিস দেখা করবিনে!”
“আমি কি করব? দেখা হলেই যে আমাকে আবার সেই কথাই বলতে হবে। আমি যে কিছুতেই এ বিয়েতে রাজি হতে পরিচিনে দিদি”
“আমাদের অপমান, তোর নিজের অপমান, লোক হাসাহাসি এসবই ভাল, তবু এ বিয়েতে রাজি হতে পারবিনে? অথচ তার দোষ কিছুই নেই! এর কোন মানে আছে?”
“আমি তাঁকে ভালবাসতে পারবনা”
“এই দুদিন আগে এত ভালবাসা, আর ভালবাসতে পারবিনে! সে কি কখনও হয়! এখন ও রকম মনে হচ্চে, বিয়ে হলেই ঠিক ভালবাসা হবে।”
আমি নিতান্ত মরিয়া হইয়া বলিলাম “দিদি তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি দেখা করতে পারবনা, আমি তখন বুঝিনি, এখন বুঝছি তাঁর সঙ্গে বিয়ে হলে আমিও সুখী হবনা তিনিও না।”
“তবে তোর যা ইচ্ছা করিস যা ইচ্ছা বলিস! এমন এক গুঁয়ে মেয়েও ত আমি কখনো দেখিনি!” বলিয়া দিদি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ভাবে চলিয়া গেলেন।