কাহাকে?/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।


 একই রকমে দিন কাটিতে লাগিল। প্রতিদান পাইবার আশা নাই, ভরসা নাই, ইচ্ছাও নাই; নিরাশীর মধ্যেও তথাপি অন্তঃশীলা অংশ প্রবাহিতা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাসনা বিদ্রোহী, মনের বিরুদ্ধে মন সংগ্রামরত, নিজের সহিত অনবরত যুদ্ধে হৃদয় রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত। এমন অবস্থায় তোমরা কেহ কি কখনো পড়িয়াছ! জানিনা; কিন্তু মনে হয়, এ বিশাল সংসারে এ জ্বালা শুধু আমিই জানি।

 ভাবিতে গেলে মহা বিষ্ময়ের মধ্যে মগ্ন হইয়া পড়ি!—কেবল দুই চারি দিনের দেখা, কেবল দুই চারিট কথা বার্ত্তা; তাহাতেই কিরূপে আমাকে এমনতর পাগল করিয়া তুলিল! সেই ক্ষণিক মিলনের মধ্যে জগতের যত কিছু সৌন্দর্য্য-মধুরতা আনন্দ-উচ্ছাস, যত কিছু হলাহলভরা অভাব বেদনার অভিজ্ঞানে জীবনের অভিজ্ঞতা যেন সম্পূর্ণ।

 তাঁহাকেও ত ভাল বালিয়াছিলাম; কিন্তু এখন বুঝিতেছি, সে এ রকমের অনুভাব নহে।—সেশুধু গানের মোহ, স্মৃতির ব্যথা; এমন মর্ম্মবিজড়িত আকুল আকাঙ্খাময় আত্মদান নছে। সে শুধু বিশ্বাসের উচ্ছাস, প্রীতির অনুভবে মর্ম্মান্তিক সহানুভূতি, তাই যখন বিশ্বাস ফুরাইল, যখন মনে হইল তাঁহার ভালবাসা সত্য নহে, তখন সে ভালবাসাও ফুরাইল। কিন্তু এ সন্দেহে, এ অবিশ্বাসে সে ক্রোধ কোথা? সে বিরক্তি কোথা! সে বিস্মৃতিই বা কোথা? নৈরাশাসিঞ্চনে এ প্রেম আরো কেবল মনে দৃঢ় বদ্ধমূল হইয়া বসিতে লাগিল।

 প্রাণের মধ্যে সারাদিন কি যে আগুণ জ্বলিতেছে, কাজে কর্ম্মে গল্পে কথায় তাহার নিবৃত্তি নাই। যতই ভাবি ‘আর না আর না’ ততই ইঁহাকে ভাবি; ভুলিতে চেষ্টা করিয়া দর্শনতৃষায় আরো ব্যাকুল হইতে থাকি; বায়ুর শব্দে নিরাশ মনে বাতুল আশা জাগাইয়া তোলে—মোহভঙ্গে দগ্ধ হৃদয়ে বেদনাধ্বনি ওঠে—“একবার একবার কি আর দেখা পাইব না! আর কিছু না—যদি শুধু মাঝে মাঝে দেখা পাইতাম! হৃদয় ভাগিনী নহে—যদি সামান্য বন্ধুত্বভাগিনীও হইতে পারিতাম! তাহ হইলেই কি আমার জীবন জন্ম সার্থক হইত না? কোথায় সে গর্ব্বিত অপমান বোধ!

 এইরূপ দাবানল হৃদয়ে বহিয়া দিন কাটে। ভবিষ্যতে কি হইবে, কে জানে, কালে ইহার শান্তি আছে কিনা জানি না, কিন্তু পুড়িতে পুড়িতে জ্বলিতে জ্বলিতে এখন মনে হয়—এমনি নিরাশাময় আশা, বেদনাময় আকুলতায় জীবন জ্বলিয়া পুড়িয়া যখন ভষ্মসাৎ হইবে তখনি মাত্র ইহার শান্তি! সুদীর্ঘ জীবনের দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠি। ইহাই কি প্রেম? যে তৃষ্ণায় তৃপ্তি নাই, যে আকাঙ্খায় নিবৃত্তি নাই, যে আশায় সফলতা নাই, তাহাই কি প্রেম? কে জানে!

 ইহার তিন চারিদিন পরে চঞ্চলের সহিত দেখা। তাহাদের রাড়ীতেই দেখা। আমাদের দুজনে খুব ভাব। বেশী না হউক অন্ততঃ পক্ষে সপ্তাহে একবার করিয়া দিনান্ত ধরিয়া আমরা দুজনে একত্র কাটাই। কোনবার বা সে আমাদের বাড়ী আসে— কোনবার বা আমি তাহাদের বাড়ী যাই। তাহার নজর এড়াইতে পারিলাম না; আমাকে দেখিবা মাত্র আমার শুষ্ক বিষণ্ন ভাব লক্ষ্য করিয়া সমবেদনার স্বরে চঞ্চল বলিয়া উঠিল—“আর তুমি কি না বল সেজন্য তোমার কিছুই আসে যায় না; একি চেহারা হয়েছে? আমার তার উপর এমন রাগ ধরছে! কি করে যে কাকারা দিদির সঙ্গে তার বিয়ে—

 “দিলেই বা!”

 “আচ্ছা ঠিক বলছ তুমি তাকে আর ভালবাস না! বিয়ে ভেঙ্গে গেছে বলে দুঃখিত হওনি?”

 “তুমি কি মনে কর তোমাকে আমি অঠিক কিছু বলব! কোন কথা তোমাকে বলতে না পারি, কিন্তু যা বলব তা বেঠিক বলব না,—এ বেশ জেনো।”

 চঞ্চল খুশী হইয়া আমার গাল টিপিয়া বলিল “সইলো আমার, তোকে কিন্তু ভাই বড় কেমন কেমন দেখাচ্ছে। তা এতটা একজনকে বিশ্বাস করেছিলি,—সে বিশ্বাসটা ভাঙ্গলে, সে জন্যও ত কষ্ট হত?”

 “হয়েছিল অবিশ্যি, তাত জানই। কিন্তু তাই বলে যদি ভাব আমি সেই কষ্টে এখনো মারা যাচ্ছি—তা হলে—

 “আমি হলে ত যেতুম! আমি যদি বিলাত থেকে এক হপ্তা চিঠি না পাই, এমন ভয় হয়, কি বলব।”

 “তোর যে বিয়ে হয়ে গেছে, তোর স্বামী ভুল্লেও যে তোর ভোলার পথ বন্ধ, আর ভোলাটাই আমাদের পক্ষে যুক্তি কেননা তাতেই আমাদের মুক্তি।”

 চঞ্চলও হাসিল, হাসিতে হাসিতে বলিল—“তা ঠিক! দিদিও (কুসুম) ত দেখছি বেশ আছে! আমি নিজের ভাব থেকেই দেখছি উণ্টে বুঝে মরি! শুনেছ অবিশ্যি দিদির বিয়েও ভেঙ্গে গেছে?”

 “না। ভাঙ্গলো কেন?

 “তাত জানিনে। তাঁরা ত আর আমাদের কাছে কিছু প্রকাশ করেন না। বাইরে বাইরে অমনি শুনছি যে হবে না নাকি! বোধ করি রমানাথই ভেঙ্গেছে, কেননা দিদির শুনেছি ইচ্ছা ছিল। লোকটার যাহক গুণপণা আছে—নইলে দিদি পর্য্যন্ত ভোলে?”

 আমি একটু স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম,—একটা অনুতাপ গ্লানি হৃদয়ে বহিয়া গেল! এ বিবাহে তিনি অসম্মত হইলেন কেন? আমি কি তাহাতে লিপ্ত!

 চঞ্চল বলিল—"কি ভাবছ?”

 আমি বলিলাম—“তোমার দিদি কি সত্যি তাঁকে ভালবেসেছিলেন; আমার তাঁর জন্যে বড় মায়া করছে, সাধ্য থাকলে কোন রকমে বিয়েটা ঘটাতুম।”

 “তোমাকে কে মায়া করে ঠিক নেই—তুমি মায়া করছ দিদিকে! আমি ত তার বড় একটা দরকার দেখছিনে। আত্মাদর দিদির যথেষ্ট আছে—নিজের মূল্য সে বেশ বোঝে, কেনই বা না বুঝবে? রূপ গুণের কিছু কসুর নেই, তার উপর টাকা। যে বিয়ে করবে, রাজকন্যা ও অর্দ্ধেক রাজত্ব এক সঙ্গে পাবে। কত লোক তার জন্য হা হুতাশ করে মরছে তার ত ঠিকই নেই। যদি দুঃখ করতে হয় তাদেরই জন্য বরঞ্চ কর। দিদির যদি সামান্য একটুকু আঁচর লেগে থাকে ত এতদিনে তার দাগ বেশ মিলিয়ে পড়েছে।”

 “তা কি করে জানলে? যারা সহজে ভালবাসায় পড়ে না তারা ভালবাসলে বরঞ্চ সহজে না ভোলারই কথা!”

 “হ্যাঁ যদি তেমন ভালবেসে থাকে। কিন্তু সে রকমটা ত মনে হয় না। লোকটা একটু চটুকে রকম, কথাবার্ত্তায় খানিকটা চমক লাগাতে পারে—কিন্তু তার উপর যে কারো গভীর ভালবাসা হবে তাত আমি মনে করতে পারিনে। নিদেন আমার হলেত হোত না, আর দেখা যাচ্ছে তোমারো হয়নি। তাহলে দিদিরই কি হবে?”

 “বস্! খুব ত লজিক দেখছি!”

 “ইংরাজি নভেলে প্রায়ই ত দেখা যায় first love অনেক সময়েই অনভিজ্ঞ হৃদয়ের একটা শুধু উচ্ছাস, তেমন গভীর ভালবাসা নয়। দিদিরও এটা খুব সম্ভব সেই রকম একটা ফেণা উঠে জল বুদ্বুদের মত আবার মিলিয়ে পড়েছে। যথার্থ ভালবাসা হৃদয়ের একটা শিক্ষা,—সেট শুধু আবেগ নয়; তার উপযুক্ত পাত্রও চাই। হ্যা ডাক্তারকে কেউ ভালবাসছে শুনলে সেটা বোঝা যায় বটে। আজ কাল ত আমরা দিদিকে এইকথা নিয়ে ঠাট্ট করি,—তিনি কিনা তাদের ঘরাউ ডাক্তার হয়েছেন। আর মনে হয়—ডাক্তার বেশ একটু ধরা পড়েছে—”

 আমার হৃৎপিণ্ডে শোণিত বেগে বহিল; মনে হইল মুখে চোখে তাহা উছলিয়া উঠিতেছে, বুঝিবা এখনি ধরা পড়ি। কিন্তু চঞ্চল লক্ষ্য করিল না—বলিয়া উঠিল—”এই যে দিদি! অনেক দিন বাঁচবে, নাম করতে করতে হাজির।”

 অনেক দিন পরে কুসুমের সহিত দেখা। মনে হইল, সে যেন পরিবর্ত্তিত। তাহার নয়নে সেই বিদ্দ্যুদ্দাম প্রস্ফারণ চাপ ল্যের যেন অভাব; অধরে আত্মম্ভরীময় সদা প্রস্ফুটিত হাস্যরেখা যেন নিমীলিত। আমার মায়া করিতে লাগিল। পাছে সে ভাবে আমি তাহার প্রতি অপ্রসন্ন—আর সেরূপ মনে করি বার যথেষ্ট কারণও বর্তমান; তাই আমি সহস্য ভাবে আগেই বলিলাম; “এই যে কুসুম! অনেক দিন পরে দেখা!”

 কুসুম একটু চাপা ভাবে উত্তর করিল—

 “হ্যাঁ কত দিন ভেবেছি দেখা করতে যাব-কিছুতেই কেমন ঘটে ওঠেনি। তোমরাই কোন আমাদের বাড়ী আস?”

 ইহার উত্তর যোগাইল না—বলিলাম “আমি দেশে যাচ্ছি—”

 “দেশে! কেন?”

 চঞ্চল বলিয়া উঠিল, “মনের দুঃখে বনবাস আর কি!”

 আমি অপ্রতিভ হইয়া পড়িলাম; ছি কুসুম কি ভাবিবে? চঞ্চলও বলিয়া বোধ হয় বুঝিল কথাটা কুসুমের মনে লাগিতে পারে। তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়িল-বলিল “তা পর দিদি ডাক্তারের খবর কি?”

 কুসুম বলিল—“তাঁর খবর আমি কি জানি। মণি সম্ভবতঃ বলতে পারে; ওদের ওখানে না প্রায়ই যান? কেন মনের দুঃখ কিসের? মণির মত সৌভাগ্য আমাদের হ’লে আমরা ত বেঁচে যেতুম!”

 উদ্দেশ্য অবশ্য ঠাট্ট, কিন্তু ইহার মধ্য হইতে সত্যের আভাষ প্রকাশ পাইল। বলিতে বলিতে কুমুমের চাপা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়িল। সে নিশ্বাসে ঈষৎ যেন ঈর্ষামাখা নৈরাশ্য বেদনা ব্যক্ত হইল। বুঝিলাম কুসুম ভালবাদে, সত্যই ভালবাসে; কিন্তু কাহাকে? তাঁহাকে না ইঁহাকে? মিষ্টার ঘোষকে-না ডাক্তারকে?