কাহাকে?/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।


যেমন হইয়া থাকে, ডাক্তার চলিয়া যাইবার পর তাঁহাকে লইয়া আমাদের মধ্যে সমালোচনা চলিতে লাগিল। দিদি বলিলেন— “লোকটাকে লাগল মন না।”

 ভগিনীপতি বলিলেন—“Yes—he's not a bad fellow— hasn't got much common sense though, too much of a woman worshipper I should say.”

 দিদি। সেত ভালই।

 ভগিনীপতি। মন্দ কে বলছে? Poor fellow I pity him—he's quite lost in admiration of the fair sex. Fancy an intelligent and educated man like him firmly believing in the possibility of a woman's ever coming up to Shakespeare in intellectual power!

 দিদি। সেটা কি এমনি অসম্ভব ব্যাপার?

 ভগিনীপতি। And what is worse still—feeling no hesitation whatever in expressing this outrageous opinion of his before others and making a fool of himself. The man has absolutely no sense of the ludicrous.

 আমি বলিলাম—“তাঁর যে strength of conviction খুব আছে—এতে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।”

 তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন—“you are right, it shows his sincerity and to tell you the truth, I like him all the better for this outspoken foolish enthusiasm of his.”

 দিদি। লোকটা বেশ সহৃদয়।

 ভগিনীপতি। He has the manners of a perfect gentleman—

 তাহার পর সহসা বলিয়া উঠিলেন—"আচ্ছা মণির সঙ্গে তার বিয়ে হলে কেমন হয়?”

 দিদি। সেত engaged!

 ভগিনীপতি। Good gods! কে বল্লে! আমি ত ভাবছিলুম he was rather sw-never mind what, but—কে বল্লে?

 দিদি। চঞ্চলের মা বলছিলেন।

 ভগিনীপতি। এরই মধ্যে পাকড়াও করলে কে? কথাটা ত গুজবও হতে পারে?—

 দিদি। না ডাক্তারের মায়ের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, গুজব হবার নয়। তবে পাত্রীটি যে কে তা আর আমি জিজ্ঞাসা করিনি, অন্য কথা এসে পড়লে, আর জেনেই বা আমার লাভ কি বল?

 ভগিনীপতি। Bad luck everywhere, eh! তবে চল এখন শুতে যাওয়া शाक, স্বপ্নে এই happy pairকে congratulate করা যাবে এখন!

 কি ভাগ্য ইহা রাত্রি কাল; তাই আমার সহসা পরিবর্ত্তিত বিবণ মূর্ত্তি ইঁহারা দেখিতে পাইলেন না।

 শয়নগৃহে আসিয়া জানালার ধারে কৌচে বসিলাম। বিছা নায় যাইতে ইচ্ছা হইল না। নয়নপথে মুক্তাকাশখণ্ডে শ্বেত কৃষ্ণ মেঘের উপর দিয়া স্তরে স্তরে, তরঙ্গে তরঙ্গে, তর তর বেগে পূর্ণ শশধর ভাসিয়া যাইতেছিল; তাহার দিকে চাহিয়া আমার সন্ধ্যার সেই সুখ সেই মুখ মনে জাগিতে লাগিল; আর ব্যথিত অশ্রুধারা হৃদয় ভেদ করিয়া নয়নে উথলিয়া উঠিতে লাগিল।

 সবই কি আমার কল্পনা! ইঁহার নয়নে যে সুমধুর দৃষ্টি দেখিলাম, ইহার সাধারণ কথার মধ্যে যে অসাধারণ হৃদয় কথা পড়িলাম, তাহার মধ্যে কি সত্য কিছুই নাই? সমস্তই কি আমার মনের ছায়া—আমার মনের ভাব মাত্র? সন্দেহ নাই। আমি কে? আমি কি? নিতান্ত ক্ষুদ্র, নিতান্ত অযোগ্য, মূহূর্ত্তের জন্যই বা কিরূপে অতদুর আত্মহারা হইলাম? এ দুরাশা মনে উঠিল? তাহা কখনো নহে; কখনো হইবারো নহে,—সমস্তই আমার ভ্রম! আমার কল্পনা!

 বাহিরে তেমনি পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না; অন্তরে তেমনি মধুর দৃষ্টি, কেবল সন্ধ্যার সেই আনন্দের পরিবর্ত্তে সমস্তই এখন নিরানন্দ বিষাদ স্নান; হৃদয়ের নবজাগ্রত মধুর বসন্ত মুহূর্ত্তে মরুবিলীন —

 তাঁহাকে মনে পড়িল যাঁহার ভালবাসা উপেক্ষা করিয়াছি তাঁহাকে মনে পড়িল। শুনিতে পাই সংসার কর্ম্মফলে চলিতেছে, ইহাও কি কর্ম্মফল? তাহাকে কষ্ট দিয়াছি তাই এ কষ্ট! কিন্তু আমি কি তাঁহাকে ইচ্ছা করিয়া কষ্ট দিয়াছি? অবস্থাচক্রের উপর কি আমার হাত আছে? তাঁহা হইতে আমার হৃদয় যে দূরে পড়িয়াছে সে কি আমার দোষে? সহস্র চেষ্টাতেও কি আর সে প্রেম ফিরাইতে পারি? না আমার ইচ্ছাক্রমেই এই নবপ্রেম আমার হৃদয়ে জাগ্রত হইয়াছে?

সাধ্য থাকিলে এই মুহূর্ত্তে কি ইহা বিলোপ করিতাম না! যে কর্ম্মের উপর আধিপত্য নাই, তাহারো ফল আছে? সে জন্যও মানুষ দায়ী! তাহার নিমিত্ত এই ভয়ানক শাস্তি! তবে মানুষকে এত ক্ষুদ্র এত তুচ্ছ, এত দুর্ব্বল করিয়া গড়িয়াছ কেন প্রভু! দুর্ব্বল অসহায়ের প্রতি তোমার করুণ কোথায় তবে? অবশ্যই আছে! কেবল কর্ম্মফলে সংসার চলিলে এতদিন ইহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইত। আমিই বা আজ কোথায় থাকিতাম! যে করুণায় বল্যে কৈশোরে অসংখ্য রোগশোক দুঃখ তাপের অবসান করিয়া জীবনে সুখ শান্তি বিধান করিয়াছ, হে নাথ-করুণাময় তোমার সেই অনন্ত করুণাবারি বর্ষণে—”

 প্রার্থনা অসম্পূর্ণ রহিয়া গেল; কি ভিক্ষা করিতে যাইতেছি! ঈশ্বরের করুণা আহ্বান করিয়া যাহাকে ভালবাসি তাহাকে পাইতে চাহি! আমার সুখের জন্য অন্যের সুখে অভিশম্পাৎ প্রার্থনা করিতেছি! প্রার্থনার সহজ উচ্ছাস সহসা স্তম্ভিত হইয়। গেল, করপুট শিথিল হইয়া পড়িল, আমি সেইখানেই শুইয়া পড়িয়া অধীর বেদনায় মনে মনে কহিলাম—“তোমার করুণা! প্রভু, তোমার করুণা! আমার মঙ্গলের জন্য যে কষ্ট যে দুঃখ বিধান করিতে চাহ আমি যেন ধীরভাবে তাহ সহ্য করিতে পারি; করুণা করিয়া এই বল দাও নাথ।” কাঁদিয়া কাঁদিয়া প্রার্থনা করিতে করিতে সেই অবস্থাতেই কখন ঘুমাষ্টয়া পড়িলাম জানিনা। যখন জাগিয়া উঠিলাম, তখন পূর্ব্ব রাত্রের সেই বেদনাময় অনুভূতি লইয়াই জাগিয়া উঠিলাম। সেই ছবি সেই দৃষ্ট মনোনেত্রে দেখিতে দেখিতেই জাগিয়া উঠিলাম।—