উপসংহার।

 তেমনি উজ্জল মধুর সন্ধ্যায় তেমনি মেঘের স্তর, তেমনি বর্ণ বিন্যাস, ছায়া আলোর তেমনি লীলাখেলা; কেবল মনের ভাব আজি অন্য রকম।

 আজ আমি দিশহারা একাকী নৈরাশাপূর্ণ বাথিতচিত্তে অকুল আকাশ সমুদ্রের দিকে চাহিয়া ভাসিতেছি না-—‘সুখ কোথায়—সুখ কোথায়? সুখ কেবল দুঃখের অন্ধকারে, হাসি কেবল অশ্রুর তাপে, ফুটিতে না ফুটিতে টুটিয়া ঝরিয়া যায়।’ আজ কানন তলে দুজনের প্রেমে মগ্ন দুজনে; আকাশের বর্ণমিলন সৌন্দর্যে হৃদয়ে অন্য ভাবের সুর বিকম্পিত। আজ মেঘে মেঘে লাল কালের মিলন দেখিয়া আমি ভাবিতেছি “অশ্রু আছে বলিয়া হাসির এত মাহাত্মা, দুঃখ আছে বলিয়াই সুখ এত মধুর। তিনিও কি ঠিক এইরূপই ভাবিতেছিলেন। আমার নীরব চিন্তা ভঙ্গ করিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন—” Happiness is not happy enough but must be drugged by the relish of pain and fear.”

 অতি সুখে দীর্ঘ নিশ্বাস উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে একটি অনুতাপ ব্যথা জাগিয়া উঠিল, আমি এত সুখী, আর মিষ্টার ঘোষ? যদি সত্যই তিনি আমাকে ভাল বাসিয়া থাকেন—তাঁহার প্রতি কত দূর অন্যায় করিয়াছি? আমার ভাবনা কি ইহারে মস্তিষ্ক স্পর্শ করিল! হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন—“ও: একটা মস্ত খবর আছে!-কুসুমের সাতগে রামনাথের বিবাহ? What a humbug—beg your pardon, I mean what an examplary lover —

 আর বেশী কিছু না বলিতে দিয়াই আমি বলিলাম—‘সত্যি নাকি? কবে?”

 “আমাদের বিবাহের এক সপ্তাহ আগে।” গাছের আড়াল হইতে নবেদিত চন্দ্রের জ্যোতি ইহার মুখে প্রস্ফুরিত হইয়া উঠিল। আমি মুগ্ধ নেত্রে সেই রূপের জ্যোতি পান করিতে লাগিলাম।

 দুই কলায় মাত্র অসম্পূর্ণ ত্রয়োদশীর নির্ম্মল চন্দ্র নীলাম্বর তলে ভাসিয়া উঠিয়াছে, শেফালিকা রাশি আমাদের সর্ব্বাঙ্গ স্পর্শ করিয়া সুগন্ধে জ্যোস্নালোক বিকম্পিত করিতে করিতে কাননতলে তারার মত ঝরিয়া পড়িতেছে। শরতের জ্যোৎস্না ঈষৎ স্নানাভ, তাহার ছায়া ছায়া আলোক আমাদের অতি সুখে ম্রিয়মান হৃদয়ের মত বিষাদ স্নিগ্ধ অতি কোমল মধুর।

 থাকিয়া থাকিয়া আমি বলিলাম—“আচ্ছ আপনি-কি ক’রে——”

 “আবার আপনি? তবে আমি শুনবনা।”

 “আচ্ছা আচ্ছা তুমি,—কি করে তুমি আমাকে এতটা দুঃখ দিলে? যখনি আমার কথা থেকে বুঝলে তোমার সঙ্গেই বাবা সম্বন্ধ করেছেন—তখন সেটা— “বুঝলুম বটে কিন্তু কি করে জানব যা বুঝছি তাই ঠিক, ভুলও ত হতে পারে?

 “তাই আমাকে অমন কষ্টের মধ্যে ফেলে রেখে গেলে— বেশ যাহক!

 “বুঝছ ন-আমি ভাবলুম কেবল তোমার বাবার সঙ্গে একটিবার কথা কয়ে তখনি আসব, তাপর বিনয় কুমার তোমার ছোটু হয়ে দাড়াবে—”

 “ভারী একটা কৌতুক নাটক অভিনয় হবে। সে লোভটা কি আর সামলান যায়! তা আমার কেন ইতি মধ্যে যতই কষ্ট হ’ক ন! এমনি তোমার ভালবাসা!

 “তা বই কি! আর তোমার এমনি ভালবাসা, আমাকে দেখে চিনতেই পারনি। আমি তোমাকে প্রথম দিন দেখেই চিনেছিলুম!”

 “সেটা কিনা খুবই আশ্চর্য্যের কথা! যখনি বাড়ী এসেছ তখনি ত পরিচয় জেনেছ। জেনে গুনে আর চিনতে পারবে না! বরঞ্চ এ অবস্থাতে তুমি যে বরাবর আপনাকে ঢেকে রেখেছিলে—একবার পুরাণ গল্প করতে ইচ্ছাও হয়নি—এইটেই পরমাশ্চর্য্য! তোমার ভালবাসা এখানেই বোঝা যাচ্ছে।”

 “ঠাকরুণ যে engaged ছিলেন সেটা ভোলেন কেন? তাপর যখন দেখলুম মহাশয় বাল্য বন্ধুকে চিনতেই পারলেন না তখন ভাবলুম মানে মানে চুপ করে যাওয়াই ভাল; কি জানি যদি পুরাণ পরিচয়ে বন্ধুত্বের দাবীটাই অসহ্য হ’য়ে ওঠে! তুমি ত আর পুরাণ আমাকে ভালবাসনি, তুমি ভালবেসেছ একজন নুতন লোককে!”  “তুমিও ত আর আমাকে ভালবাসনি। তোমার প্রেম পুরাতনের উপর; তুমি ভালবেসেছ তোমার বাল্যসখীকে।”

 আগে মনে করিতাম প্রেমে বুঝি মতামত, স্বতন্ত্র ভাল একাকার হইয়া যায়। এখন দেখিতেছি ছায়ালোকের মত, আকর্ষণ বিকর্ষণের মত প্রেমে দ্বন্দ্ব কলহ মানাভিমান অবিচ্ছেদ্য। তাহাতেই ইহা চিরনবীন চিরজীবন্ত।

 অন্ততঃ আমাদের জীবনে, প্রেমালাপ অনবরত এইরূপ দ্বন্দ্বময়। আমি বলি 'তুমি আমাকে ভালবাস নাই, ভালবাসিয়াছ তোমার বাল্যসখীকে।’

 তিনি বলেন ‘তুমি আমাকে ভালবাস নাই ভালবাসিয়াছ নূতন লোক ডাক্তারকে।'

 এখন পাঠক মীমাংসা করুন—ঠিক কি? পুরাতনের ছায়া দেখিয়াই হৃদয় নূতনে আকৃষ্ট হইয়াছে, অথবা নূতনে মুগ্ধ হইয়। সহসা পুরাতন লাভ করিয়াছি? কাহাকে ভালবাসিতে এ কাহাকে ভালবাসিয়াছি?

সমাপ্ত।