কাহাকে?/বিংশ পরিচ্ছেদ

বিংশ পরিচ্ছেদ।

 মহা আনন্দ। বাবা সম্মত। কিন্তু ডাক্তার ত আর সে পর্য্যন্ত আসেন নাই তাঁহাকে এ সুখবরটা কিরূপে জানাই? চন্দ্রময়ী নিশা! আমি উদ্যানে বসিয়া উদ্বিগ্নচিত্তে রাস্তার দিকে চাহিয়া আছি—মনে হইল যেন তিনি যাইতেছেন। উঠিয়া দ্রুতগতিতে রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম। কিন্তু তিনি তখন এতটা দূরে চলিয়া গিয়াছেন যে আমাকে দেখিতে পাইলেন না; আমি আবার অনুসরণ করিলাম। কিন্তু বৃথা, সেই সুদীর্ঘ রাস্তায় মোড়ে তিনি অদৃশ্য হইয়া পড়িলেন। কাতর চিত্তে পথিপার্থের একটি সুপ্রশস্ত ভূমিতে উঠিলাম—সেখান হইতে দেখিব তিনি কোথায় গেলেন; কিন্তু তখনি একজন বালিকা সাজিহাতে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। “একি প্রভা যে”! আমরা ছেলেবেল কৃষ্ণমোহন বাবুর পাঠশালায় একত্র পড়িয়াছি। সে বলিল “তুমি কোথা থেকে? আমি আজ সবে এখানে এসেছি, ফুল তুলে তোমাকে দিতে যাচ্ছিলুম।”

 আমি বলিলাম—“এইরূপ ভাই বিপদ,—তাঁকে খবর দিতে যাব তা পারছিনে”।

 সে বলিল—“এস আমাদের বাড়ী”। এমন সময় তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঘোড়ায় চড়িয়া আসিয়া হাজির। প্রভা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল “জানিস ডাক্তার কোথায়?”

 সে বলিল—“জানি বইকি! মণি তুমি আমার এই ঘোড়ায় চড়; আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই”।

 ঘোড়ায় চড়িলাম—ঘোড়াটা উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া একটা পাহাড়ে উচ্চভূমিতে উঠিল; প্রভা ও তাহার ভাই কোথায় পড়িয়া রহিল তাহার ঠিক নাই। টুট, গেলাপ, ক্যানটার, তাহার পর চারিপায়ে উল্লম্ফন করিয়া পক্ষীরাজের মত উড়িয়া চলিতে লাগিল। আমি প্রাণপণে রাশ ধরিয়া রহিলাম। প্রতিমুহূর্তে মনে হইতে লাগিল বুঝি পড়ি পড়ি। রাস্তা দিয়া একটা উট চলিয়া যাইতেছিল,—বিপদ দেখিয়া উষ্ট্রবাহক তাহার পিঠ হইতে লাফাইয়া পড়িল—ঘোড়াটাও হঠাৎ থামিল-আমি সেই অবকাশে নামিয়া পড়িলাম। কিন্তু এখানেই বিপদের শেষ নহে। রাত্রিকাল, অপরিচিত বিজন ভূমি, এখানে আমি নিতান্ত একাকী, এখন কি করিয়া গৃহে ফিরি? হাঁটিয়া রাস্তায় উঠিলাম,—রাস্তাটা ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল—অবশেষে একটি চোরাগলির মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। চারিদিকে উচ্চভূমি; মধ্যে একটি মাত্র ছোট্টগলি, গলির মোড়ে একখানি ক্ষুদ্র কুটির। কুটিরে ঢুকিলাম,—কোমল মুখশ্রী এক বৃদ্ধা আমাকে দেখিয়া বলিলেন—“এস মা এস; যাবে কোথায়? বস।”

 আমি বলিলাম—“আমি পথহারা"!

 বৃদ্ধা বলিলেন—“বস মা একটু কফি খাও। সামনে বাগান দেখছ, আমি নিজে হাতে কফিগাছ পুঁতেছি”

 ঘরে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল দীপের কাছে মাটীর উপর নানারকম দ্রব্য সামগ্রী ফেলাছড়া। আমি বলিলাম, “এখানে এসব জিনিষ পত্র পড়ে কেন?”

 বৃদ্ধা বলিলেন—"সে আসবে বলে চলে গেছে এখনো আসেনি; এখনি আসবে।”

 আমি বলিলাম “কে গো?”

 বুড়ি বলিলেন—“আমার সোনার চাঁদ বৌগো।”

 বুঝিলাম—তিনি পাগল। তাঁহার বৌ মরিয়াছে; বধূর অলঙ্কার তৈজসাদি লইয়া তাহার প্রত্যাগমন অপেক্ষায় তিনি বসিয়া আছেন। আমার চোখ দিয়া জল পড়িল। বুড়ি বলিলেন—"মা তুমি কে গো? আমার বৌ কি ঘরে ফিরে এলে? ও ছোটু আয়রে! আহা সেই যে বাছা আমার, মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে গেছে—এখনো ঘরে ফেরেনি”। আমার বুক ফাটিয়া কান্না আসিল,—অশ্রুজলে আমি জাগিয়া উঠিলাম —

 উঠিয়া ঘড়ি দেখিলাম,—ডাক্তার যাইবার পর আধ ঘণ্টাও অতিবাহিত হয় নাই।—আর আমি পাঁচমিনিটও ঘুমিয়াছি কিনা সন্দেহ —মনের মধ্যে কেমনতর একটা নিরাশার গুরু ভার লইয়া জানালায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। ছোটুকে ত সব বলিব ভাবিতেছি—বলিলে পরিত্রাণ পাইব এমনে মনে করিতেছি, কিন্তু যদি আমার ভুল হয়? আমি তাহাকে যেমন ভাল লোক মনে করিতেছি সে তেমন নাও হইতে পারে! বাস্তবিক আমি তাহীকে কি চিনি!—আর যদি এমনতরই হয় ছোটু আমাকে এখনো ভালবাসে? সেই জন্যই আমাকে বিবাহ করিতে চাহিতেছে? তাহা হইলে আবার একজনের কিরূপ কষ্টের কারণ হইব! অতিশয় ব্যাকুল অশান্ত হৃদয়ে আকাশের দিকে চাহিলাম,—ঈশ্বরের অনুগ্রহলোলুপ হইয়া কাতরচিত্তে অনন্ত নিরীক্ষণ করিলাম।—আকাশে সান্ধ্য মেঘে নানাবর্ণের তরঙ্গবিন্যাস। শ্বেত কৃষ্ণ নীল লাল পীত হরিৎ নানা আভায় একত্রে স্তরে স্তরে পুঞ্জীকৃত। শাদায় কালোর ছায়া, লালে নীলের বেষ্টন; ধূসরে গোলাপির সংমিশ্রণ। দেখিয়া মনে হইল; এইত সংসারের নিয়ম! দুঃখ ছাড়া কোথায় সুখ; অশ্রুহীন হাসি কোথায়? আমার প্রাণান্ত আকাঙ্ক্ষাতে, সাধনাতেই কি তবে ইহার অন্যথা হইবে? আমি কে? সৃষ্টির একটি অনুকণা; বিধাতা আমার জন্য কি তাঁহার নিয়ম পরিবর্ত্তন করিবেন?

 ভাবিতে ভাবিতে কখন যে পিয়ানোর কাছে আসিয়া বসিলাম জানিতেও পারিলাম না। আনমনে বাজাইতে লাগিলাম

হায় মিলুন হোলো!
যখন নিভিল চাদ বসন্ত গেলো!
হাতে করে মালাগাছি সারা বেল বসে আছি
কখন ফুটীবে স্কুল আকাশে আলো!
আসিবে সে বরবেশে, মালা পরাইব হেসে
বাজিবে সাহানা তানে বাঁশি রসালে!
সেই মিলন হোলে!
আসিল সাধের নিশা তরু পুরিলনা তৃষা—
কেমন কি ঘুমে আঁখি ভরিয়ে এল!

 আর জানিতাম না; এই কটি লাইনই বারবার বাজাইতেছি সহসা পশ্চাৎ হইতে ইহার অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিয়া কে গাহিল

শুভক্ষণে ফুলহার পরান হোলনা আর
হাতের সুগন্ধী মালা হাতে শুখাল;
নিশিশেষে আঁখি মেলে বাসি মাল দিনু গলে
মরমে বেদনা নিয়ে নয়নে জল'।
হায় মিলন হোলো!

 গীত বাদোর সুর কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদয়ে কি এক অপূর্ব্ব কম্পন উঠিল। কে গাজিতেছেন তাঁহার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত না করিয়াই আমি মুগ্ধ আবেশ বিভোর হইয়া গানের সঙ্গে শেষ পর্য্যস্ত বাজাইয়া চলিলাম। তিনি যখন থামিলেন, যথন ফিরিয়া তাঁহাকে দেখিলাম তখন বর্ত্তমান অতীতে, যৌবন বাল্যে বিলুপ্ত। আমি বিস্ময়ে বিভ্রমে বলিতে যাইতেছি,—তুমি ছোটু-তুমি ছোটু? কিন্তু বলা হইল না, প্রাণের কথা ওষ্ঠধরে আসিয়া মিলাইয়া গেল। তখনি বাহিরে পদ শব্দ শুনিলাম, আত্মস্থ হইয়া বুঝিলাম বাবা আসিতেছেন; সভয়ে সঙ্কোচে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। বাবা আসিয়া বলিলেন—"এই যে বিনয় কুমার। মণি তুমি এঁকে চিনেছ কি? ইনিই ছোটু!”

 এখনো কি স্বপ্ন দেখিতেছি? নিশ্চয়ই!!!