কাহাকে?/প্রথম পরিচ্ছেদ

কাহাকে?



প্রথম পরিচ্ছেদ।

Man's love is of man's life a thing apart,
’Tis woman's whole existence.

এ কথা যিনি বলিয়াছেন তিনি একজন পুরুষ। পুরুষ হইয়া রমণীর অন্তর্গত প্রকৃতি এমন হুবহু ঠিকটি কি করিয়া ধরিলেন, ভারী আশ্চর্য্য মনে হয়। আমি ত আমার জীবনের দিকে চাহিয়া অক্ষরে অক্ষরে এ কথার সত্যতা অনুভব করি। যত দূর অতীতে চলিয়া যাই, যখন হইতে জ্ঞানের বিকাশ মনে করিতে পারি তখন হইতে দেখিতে পাই—কেবল ভালবাসিয়াই আসিতেছি, ভালবাসা ও জীবন আমার পক্ষে একই কথা, সে পদার্থটাকে আমা হইতে বিচ্ছিন্ন করিলে জীবনটা একেবারে শূন্য অপদার্থ হইয়া পড়ে- আমার আমিত্বই লোপ পাইয়া যায়।

 তখন আমার বয়স কত? সাল তারিখ ধরিয়া এখনি তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিতেছি না। আমাদের দুইবোনের জন্মকোষ্ঠী বা ঠিকুজী নাই তাই ইচ্ছামাত্র সময়ে অসময়ে এ সন্দেহ ভঞ্জন করিতে পারি না। একবার একখানা গানের খাতার কোণে তারিখটা লিখিয়া রাখিয়াছিলাম কিন্তু খাতাখানা খুঁজিতে গিয়া শৈশবের বড় বড় মক্সওয়ালা ক খ লেখা কাগজপত্রের কাঁড়িগুলা পর্য্যন্ত মিলিল; কেবল সেইখানাই পাওয়া গেল না। পুরুষে সম্ভবতঃ আমার সারল্যে অবিশ্বাস করিয়া ইহার মধ্য হইতে গুঢ় অভিপ্রায় টানিয়া বাহির করিবেন, কিন্তু স্ত্রীলোকে বুঝিবেন, বাস্তবিক পক্ষে সাল তারিখ মনে করিয়া রাখা আমাদের পক্ষে কিরূপ কঠিন ব্যাপার। বরঞ্চ ঘটনার ছবি হইতে তাহার আনুষঙ্গিক বার তিথি আমরা ঠিক ধরিতে পারি কিন্তু তিথি নক্ষত্র আগে মনে করিয়া যদি ঘটনা মনে করিতে হয় তাহা হইলে ঘটনাটির কালাশুদ্ধি হইবার ষোল আনাই সম্ভাবনা। যেমন দিদির বিবাহ যখনি মনে পড়ে—তখনি উৎসব-সমারোহপূর্ণ ফাল্গুন মাসের সেই বিশেষ পূর্ণিমা নিশিটিও চোখের উপর জ্বলজীবন্ত দেখিতে পাই। কিন্তু সালের মূর্ত্তি ত আর ফাল্গুনের সে বসন্তে বা পূর্ণিমার সে জ্যোৎস্নালোকে উপরঞ্জিত নহে। কাজেই ছবিগত সাদৃশ্য বা অসাদৃশ্য ধরিয়া মাস তিথির মত সাকার চিত্রে একসাল হইতে অন্য সালের তফাৎ মনে করিতে পারি না। নিরাকার নিরূপ ধ্যানের ন্যায় ধ্যান সহকারে এখনকার সাল ধরিয়া দশ বৎসর পূর্ব্বের সে সালটা গণিয়া তবে ঠিক করিয়া লইতে হয়। কিন্তু এনিয়মে অর্থাৎ স্মৃতির সাহায্যে ত আর নিজের জন্মসাল নির্ণয় করা যায় না, বিধাতা পুরুষ তাহা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন। স্মৃষ্টির এ কি এক অপূর্ব্ব রহস্য বুঝিতে পারি না-মানব জন্মগ্রহণ করে ধরাতলে, অমনি আকাশের তারা নক্ষত্ররাশি তাহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাতাইয়া লইয়া তাহার ভাগ্য রচনা করিতে বসে, আর মানুষের সর্ব্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ আত্মীয় যে স্মৃতি তাহাকে সে তখন একেবারে হারাইয়া ফেলে, অন্ততঃ সে সময় স্মৃতির সহিত মানুষের কোন সম্পর্কই থাকে না। এখানে তাই কেবল নিতান্তই অঙ্কের সঙ্কেতে অর্থাৎ সালের খাতিরে সালটা মনে রাখিতে গিয়াই যত মুস্কিল বাধিয়াছে; তাহা ১২৮২ বা ৮৩ ক্রমাগতই ভুল হইয়া যায়। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে এ ভুলে ক্ষতি কাহার? আমারো নহে পাঠকেরো নহে। অবশ্য এ রকম একটা ভুলে জীবনে যদি সুদীর্ঘ তিনশত পঁয়ষট্টি দিন ও বারটা মাসওয়ালা একটা বৃহৎ সম্বৎসরের ব্যবধান পড়িত তাহা হইলে ক্ষুদ্রজীব একজন মনুষ্যের পক্ষে তাহাতে বিস্তর তফাৎ করিয়া তুলিত, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমি হাজার ভুলি না কেন, কাল আমাকে কিছুতেই ভুলিবে না, বয়স আমার সর্ব্ব অবস্থাতেই কড়ায় গণ্ডায় ঠিকটি থাকিয়া যাইবে—আর পাঠকের পক্ষে—আমি উনিশ না হইয়া যদি বিশ হই, কিম্বা বিশ না হইয়া যদি একুশই হই—সব সমানই কথা। যতদূর বুঝিতেছি তিনি কেবল বিষয়টার একটা শেষ নিষ্পত্তিতে আসিতে পারিলেই নিশ্চিন্ত হইতে পারেন, নিষ্পত্তিটা ঠিক বা বেঠিক হউক তাহাতে কি এত আসিয়া যায়? এ প্রকৃতি পুরাতত্ববিদেরই একচেটিয়া নহে। তবে ধরিয়া লওয়া যাক, আমার বয়স তখন আঠার উনিশ। আমি এখনো অবিবাহিত।—শুনিয়া কি কেহ আশ্চর্য্য হইতেছেন? কিন্তু আশ্চর্য্য হইবার ইহাতে কি আছে? আজকাল ত এমন অনেকেই ইহার চেয়েও অধিক বয়স পর্য্যন্ত অবিবাহিত থাকেন—আমিও না হয় আছি। ইহাই যদি বিস্ময়জনক হয় তবে অধিকতর বিস্ময়ের কথা পরে আসিতেছে। আমি ভালবাসি, বিবাহের পূর্ব্বেই ভালবাসি; তিনি যে স্বামী হইবেন এমনতর আশা করিয়াও ভালবাসি নাই। কেবল তাহাই নহে, এই ভালবাসাই আমার একমাত্র প্রথম এবং শেষ,ভালবাসা নহে। আমি ইহাকে যখন ভালবাসি নাই, তাহাকে ভালবাসিয়াছিলাম—আর তাহাকে যখন বাসি নাই তখনো আমার হৃদয় শূন্য ছিল না। মাকে মনে পড়ে না, শিশুকালেই আমি মাতৃহারা, কিন্তু শৈশবে বাবাকে যেমন ভালবাসিতাম কোন সন্তান মাকে যে তাহার অধিক ভালবাসিতে পারে এরূপ আমি কল্পনাও করিতে পারি না। অনেকেরই সংস্কার আছে পিতৃমাতৃপ্রেম ও দাম্পত্যপ্রেম পরস্পর নির্লিপ্ত পৃথক দুইবস্তু, একের সহিত অন্যের তুলনাই অসঙ্গত অসম্ভব। তুমি আমার সহিত মিলিবে কি না জানি না—আমার কিন্তু ধারণা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত, আমার অভিজ্ঞতায় শৈশবের মাতৃ গ্রেমে ও যৌবনের দাম্পত্যপ্রেমে অল্পই তফাৎ। যৌবনে প্রণয়ীরই মত, শৈশবে পিতামাতা আমাদের একমাত্র নির্ভরের সামগ্রী, পূজার সামগ্রী, ভালবাসার সামগ্রী, পিতামাত রক্ষক দেবতা প্রণয়ী, একাধারে সর্ব্বস্ব। উভয় প্রেমেই—সেই আসঙ্গলিপ্সা, সারাদিন চোখে চোখে রাখিতে সাধ, প্রাণে প্রাণে আপনার করিবার ইচ্ছা, সম্পূর্ণভাবে দখল করিয়া রাখিবার বাসনা, না পাইলে পরম অতৃপ্তি, তাহার সুখে সুখ, তাহার সুখের জন্য কষ্ট স্বীকারে, আনন্দ, এ সমস্ত একই রকম।

 আমরা দুই বোন, কিন্তু দিদির সঙ্গে আমার তেমন ভাব হইতে পারে নাই তিনি বয়সে আমার চেয়ে ৪।৫ বৎসরের বড়, তাহা ছাড়া তিনি বেশীর ভাগ পিসিমার কাছে কলিকাতাতেই থাকিতেন। তবুও দিদিকে খুব ভাল বাসিতাম: তিনি বাড়ী আসিলে আনন্দ হইত; কিন্তু বাড়ী আসিয়া দিদি যদি বাবাকে দখল করিতেন বা তাঁহার কোন কাজ করিয়া দিতেন আমার ভাল লাগিত না। সন্ধ্যাবেলা আহারান্তে বাবা বিছানায় শুইয়া গুড়গুড়ি টানিতেন; দিদি যখন থাকিতেন তখন আমরা দুই বোনে দুই পাশে গিয়া শুইতাম, কিন্তু বাবার গলা জড়াইয়া থাকা আমারি একচেটিয়া ছিল। দুই হাতে কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া কাণে কাণে কথা হইত-বাবা তুমি কাকে ভালবাস? মনের মধ্যে পূর্ণ বিশ্বাস আমাকেই ভালবাসেন, তিনি কিন্তু তাহা বলিতেন না, বলিতেন দুজনকেই ভালবাসি। উত্তরে সস্তুষ্ট হইতাম না, অসন্তুষ্টও হইতাম না; কেননা তিনি যাহাই বলুন, আমার মনে হইত আমাকেই ভালবাসেন। আমি কাণে কাণে বলিতাম-—“দিদি রাগ করবেন বুঝি?” বাবা হাসিতেন, আমার বিশ্বাস মনে আরো দৃঢ় হইয়া আঁটিয়া বসিত। তথন আমার বয়স কত জানি না—বোধ হয় ৫।৬ বৎসর হইবে। শীতকালে বাবার গায়ে যথেষ্ট গরম কাপড় থাকিলেও আমার গায়ের ছোট রুমাল খানি দিয়া যতক্ষণ তাঁহাকে না ঢাকিতাম, ততক্ষণ মনে হইত তাঁহার শীত ভাঙ্গিতেছে না। গরমী কালে টানাপাখা যতই হউক না কেন, মাঝে মাঝে হাতপাখা না করিলে আমার তৃপ্তি বোধ হইত না। দাসদাসীর অভাব নাই কিন্তু আমি সুবিধা পাইলেই কুটনা কুটিবার আড্ডায় গিয়া বঁটি একখানা টানিয়া আলুটা, পটলটা যাহা সম্মুখে পাইতাম তাহার উপরেই আঁচড় পাড়িবার অভিপ্রায়ে আঙ্গুলে আঁচড় পাড়িয়া বসিতাম, আর রান্নাঘরে গিয়া বামুনদিদির ভাতের কাটি কাড়িয়া লইয়া ডাল, মাছেরঝোল, অম্বল নির্ব্বিচারে সবই ঘুঁটিবার প্রয়াস পাইতাম, কখনো বা ব্রাহ্মণীকে স্তুতি মিনতিতে বশ করিতে পারিলে তাহার হাতের নুন মসলাটা নিজের হাতে করিয়া হাঁড়িতে ফেলিবার মহানন্দলাভও অদৃষ্টে ঘটিত। এই রূপে রান্নাঘরে কতদিন যে হাত পা পুড়াইয়াছি তাহার ঠিক নাই। হইলে কি হয়,—আমার বিশ্বাস ছিল অন্ন ব্যঞ্জনে আমি কাটি দিলেই বাবার পক্ষে তাহ সুখাদ্য হইবে, কেননা রান্নাটা তবেই আমার হইল। পান করিবার সময় বাবার পানে মসলা দিতে আমাকে না ডাকিলে আমি আর সেদিন রক্ষা রাখিতাম না। বাবা ত ভাত খাইয়া তাড়াতাড়ি আফিস চলিয়া যাইতেন, তাহার পর সেদিন আমাকে সাধিয়া ভাত-খাওয়ান অন্য কাহারো দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত।—বাগানের ফুলে আর কাহারো অধিকার ছিল না—ভোর না হইতেই যত ভাল ভাল ফুল তুলিয়া অনিয়া বাবার কাছে হাজির করিতাম। জ্যেঠাইমার পূজার ফুল অল্পই অবশিষ্ট থাকিত, কোনদিন বা মোটেই থাকিত না; সে দিন তিনি বাবার কাছে নালিস করিতে আসিয়া তাঁহার ফুলগুলি সব লইয়া যাইতেন। আমার এমন রাগ ধরিত! এক বার আমার অসুখ করিয়াছিল দিদি তখন বাড়ী ছিলেন, তিনি আমার বদলে বাবাকে ফুল তুলিয়া দিতেন, অসুখের কষ্ট তেমন অনুভব করিতাম না—যেমন সেই কষ্ট! আমি দুঃষ্টামি করিলে আমাকে জব্দ করিবার জন্য তেমন কোন সহজ উপায় ছিল না; যেমন “আজ সন্ধ্যাবেলা তোকে চাবি দিয়ে রাখব বাবার কাছে শুতে দেব না” এই কথা। সহস্র দুষ্টামি এই শাসনে তখনকার মত তামার বন্ধ হইয়া যাইত। এক কথায় আমার সেই ক্ষুদ্র শৈশবজীবন কুলে কুলে তখন তাঁহাতেই পরিপূর্ণ ওতপ্রোত ছিল। তাই বলিয়াছি শৈশব ও যৌবনপ্রেমে তফাৎ অল্পই। বস্তুতঃ আমার মনে হয় কি মাতৃপ্রেম, কি ভাই বোনের ভালবাসা, কি বন্ধুত্ব, কি দাম্পত্যপ্রেম সকলরূপ গভীর ভালবাসারই মূলগত ভাব একই। একের সহিত অন্যের পার্থক্য কেবল সে ভাবের স্থায়ীত্ব ও প্রবলতার তারতম্যে। যাহাকে ভালবাসি তাহার সুখে সুখবোধ ও তাহাকে সম্পূর্ণরূপে আপনার করিবার ইচ্ছা প্রেমের এই যে নিঃস্বার্থ অথচ সর্ব্বেসর্ব্বা ভাব পিতামাতার স্নেহেই ইহার প্রথম স্ফূর্ত্তি এবং ভ্রাতাভগিনী সখাসখীর ভালবাসার মধ্য দিয়া প্রণয়ে ইহার চরম পরিণতি। আসলে প্রেম মাত্রে একই বস্তু কেবল বিকশনে ও ভিন্নধারে ভিন্নাকার।

 আমি যেমন শিশুকালে যে আমি ছিলাম এখনও সেই আমি আছি, তথাপি দেহ জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশে স্বতন্ত্র আকারও হইয়া পড়িয়াছি, সেইরূপ শৈশব প্রেমই যখন যৌবনে মহাকারে বর্দ্ধিত ও পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে তখন আর পূর্ব্বের পরিমিত ক্ষুদ্র ভাব গুলিতে তাহার পরিধি পূর্ণ করিতে পারে না, যে তখনকার শিক্ষা জ্ঞান আকর্ষণ আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ আধারে আপনাকে পরিব্যাপ্ত বিকাশিত করিতে চাহে। তখন যাহা দেখিয়াছি জানিয়াছি পাইয়াছি তাহাতেই মন তৃপ্তি মানে না— কেননা যাহা দেখি নাই, জানি নাই এমন মহাসুন্দর ভাব কল্পনায় আমাদের মনে আবিভূত হইয়াছে; সেই জন্য তখন এই উভয় ভাবের সম্মিলনে সর্ব্বসুন্দর সর্ব্বপরিতৃপ্তিকর মানসদেবের আরাধনায় সাকারে নিরাকার পূজার জন্য মনোপ্রাণ ব্যগ্র আকুল হইয়া উঠে। সে রমণীই ধন্য—যে তাহার মনোদেবতার সন্ধান পাইয়া এই পরিপূর্ণ উথলিত আবেগময় প্রাণের পূজায় জীবন সার্থক করিতে পারে; আর সেই পুরুষই ধন্য যে এই পূজারতা হৃদয়ের দেবতারূপে বরিত হইয় তাহার পূজায় জীবন উৎসর্গ করিয়া জীবনের উদ্দেশ্য সফল করিতে পারে, আর সেই প্রেমই প্রকৃত প্রেম যাহা এই উভয়ের আত্মহারা পূজায় অধিষ্ঠিত হইয়া প্রবলভাবে চিরবিরাজমান।

 আমি পিতাকে এখনও খুব ভালবাসি—তাঁহার সুখের জন্য আমি আত্মবিসর্জ্জনেও কুষ্ঠিত নহি–কিন্তু তিনি এখন আর আমার জীবনের একমাত্র সুখ দুঃখ আশ্রয় অবলম্বন, আকাঙ্ক্ষা কামনা পূজা আবাধনা, দেবতা সর্ব্বস্ব নহেন। অধিক দিন তাঁহাতে উক্ত সর্ব্বে-সর্ব্বা প্রেমভাব স্থায়ী হয় নাই। এই খানেই প্রণয়ের সহিত ইহার মূলগত পার্থক্য। যৌবনের বহুপূর্ব্বে শৈশবেই বাবার এ ভালবাসায় ভাগীদার জুটিয়াছিল।

 এতক্ষণ বলি নাই আমাদের বাড়ী কোথায়। কথাটা না পাড়িয়া চলিলে বলিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এখন দেখিতেছি আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। আমরা ঢাকা জেলার লোক, বাবার জমীদারী সম্পত্তিও কিছু আছে, কিন্তু প্রধান আয় চাকরীতে, তিনি একজন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। যতদিন বাড়ী বসিয়া কাজ পাইয়াছিলেন ততদিন সকল বিষয়ে আমাদের বেশ সুবিধা ছিল। কিন্তু আমার বয়স যখন আট নয় তখন এক সব ডিভিসনে তাঁহার বদলি হইল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি বিদ্যাশিক্ষার জন্য দিদি পিসিমার কাছে কলিকাতায় থাকিতেন। আমি কিন্তু কখনও বাবাকে ছাড়িয়া থাকি নাই, এখনও থাকিতে পারিব না জানিয়া জ্যেঠাইমাকে ও আমাকে সঙ্গে লইয়া বাবা কর্ম্মস্থলে আসিলেন। এখানে সরকারী স্কুল বা বালিকা বিদ্যালয় কিছুই ছিলনা, জমীদার কৃষ্ণমোহন বাবুর বাড়ীর তাঁহার বাড়ীর ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুল বসিত, পাড়ার শিশুগণও অনেকেই এখানে পড়িতে আসিত, আমিও আসিতাম। কলিকাতায় এরূপ প্রথা আছে কি না জানি না; পাড়াগাঁয়ের অনেক স্থলেই এক পাঠশালায় শিশুবালকবালিকাগণ একত্রে পড়ে। সেখানে সকলেরই সঙ্গে আমার খুব ভাব হইল কিন্তু সকলের চেয়ে ছোটুর সহিত। ইহার আসল নাম কি জানি না বাড়ীর মধ্যে ছোট বলিয়াই বোধ হয় সকলে ইহাকে ছোটু ছোটু করিয়া ডাকিত। তখন ভাবিতাম ইহাই তাহার একমাত্র নাম। ছোটু কৃষ্ণমোহন বাবুর ভাগিনেয়; বাপ না থাকায় মামার বাড়ী প্রতিপালিত। ছোটুর সহিত বেশী ভাব হইবার প্রধান কারণ সে স্কুলে সর্ব্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ, বোধ হয় বার তের হইবে। বাল্যকালে বরস্যবয়স্যাদিগের অপেক্ষা বয়োধিকদিগের সহিত মিশিবার কিরূপ আকর্ষণ তাহার অভিজ্ঞতা বোধ হয় অনেকেরই আছে; দ্বিতীয়তঃ ইনি পণ্ডিত মহাশয়ের প্রধান পড়ো, নিম্নক্লাশের ছাত্রছাত্রীগণের পড়া দেখিবার ভার ইহার উপর সমর্পণ করিয়া পণ্ডিত মহাশয় নিজের পরিশ্রম অনেকটা লাঘব করিতেন। স্কুল বসিত কৃষ্ণমোহন বাবুর বাহিরের একখানা আটচালাঘরে প্রাতঃকাল সাড়ে সাতটার সময়, আর ভাঙ্গিত সাড়ে ১০ টায়। কিন্তু আমরা সকলে সাড়ে ছয়টার মধ্যে স্কুলে গিয়া হাজির হইতাম আর এমন একদিনও যায় নাই যে আমরা গিয়া ছোটুকে বেঞ্চের উপর বসিয়া থাকিতে দেখি নাই। পণ্ডিত মহাশয় আসিতেন ৭॥ টায় কোনদিন বা আটটায়, ততক্ষণ ছোটু আমাদিগকে পড়া বলিয়া দিত, কপি বুকে অক্ষর লিখিয়া দিত, পকেট হইতে মুড়ি মুড়কি বিতরণ করিত, বোধ করি ইহা তাহার প্রাতরাশের অবশিষ্ট, আর বাকী সময় বই হাতে করিয়া মনে মনে নিজের পড়া মুখস্থ করিত ও মুখে গুণগুণ করিয়া গান গাহিত; এই তাহার এক বিশেষ অভ্যাস ছিল। আমরা কোন কোন সময় যদি ধরিয়া পড়িতাম, কি গাহিতেছ স্পষ্ট করিয়া গাও, ভাল করিয়া গাও, তা কখনও গাহিত না। একদিন কেবল আমরা তাহার গানের দু এক লাইন স্পষ্ট শুনিয়াছিলাম। আটচালায় প্রবেশ করিতে যাইতেছি, তাহার গুণগুণানি একটু স্পষ্টতর ভাবে কাণে গেল। প্রভা বলিল—তাহার সকলের চেয়ে দুষ্ট বুদ্ধি বেশী যোগাইত—‘ছোটু গান করছে এইখানে দাঁড়িয়ে শুনি, তাপর শিখে গিয়ে বলব কেমন শুনে নিয়েছি’। দু একদিন আগে কৃষ্ণমোহন বাবুর ছেলের পৈতে উপলক্ষে তাঁহার বাড়িতে কলিকাতার নাচ আসিয়াছিল। আমরা থিয়েটারকে নাচ বলিতাম। আমরাও দেখিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু কি যে দেখিয়াছিলাম, কি যে অভিনয় হইয়াছিল তাহা যদিও জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে পারিব না। আমি সমস্ত ক্ষণই প্রায় জ্যেঠাইমার কোলে মাথা দিয়া ঘুমাইয়াছিলাম, একবার কেবল একটা ভয়ঙ্কর চীৎকারে ঘুম ভাঙ্গিয়া গিয়া দেখি জরীর পোষাক পরা একজন রাজার ছেলে ভারী রাগিয়া গেছে, রাগিয়। জোরে জোরে তক্তার উপর লাথি মারিতেছে আর তরবারী উঠাইয়া চীৎকার করিতেছে। দেখিয়া ভারী ভয় হইল, তাহার পর আবার ঘুমাইয়া পড়িলাম। আর একবার জ্যেঠাইমা আমাকে জাগাইয়া দিয়াছিলেন; সেবার দেখিলাম কতকগুলি পরী শূন্যে ঝুলিতেছে। সে দৃশ্যটা বড় ভাল লাগিয়াছিল। সেই থিয়েটারেই বুঝি ছোটু গান শিখিয়া থাকিবে, সে গাহিতেছিল—

হায়! মিলন হোলো,
যখন নিভিল চাঁদ বসন্ত গেলো!
হাতে করে মালা গাছি সারা বেলা বসে আছি
কখন ফুটিবে ফুল, আকাশে আলো—

 এইটুকু শুনিয়াই আমরা হাসিয়া গৃহে প্রবেশ করিলাম। পরে এমন আপশোষ হইয়াছে কেন গানটি শেষ পর্য্যস্ত শুনি নাই। অনেক উপন্যাস প্রহসন গীতিনাট্যে গানটি খুঁজিয়াছি কিন্তু পাই নাই। আমরা ঘরে ঢুকিয়া হাসিয়া বলিলাম ‘কেমন তোমার গান শুনে ফেলেছি।’ ছোটু ভারি লজ্জিত হইল। গানটির সেই ক-লাইন একবার শুনিয়াছিলাম কিন্তু কখনো আর ভুলি নাই, আর পরের ভাল করিয়া মুখস্থ করা গানও কত ভুলিয়াছি তাহার ঠিক নাই।

 আগেই বলিয়াছি ছোটু আমাদিগকে মুড়িমুড়কি দিত। মুড়িমুড়কি বাড়ীতে যে আমাদের কাহারো দুষ্প্রাপ্য ছিল তাহা নহে, কিন্তু হরিরলুটের বাতাসার মত তাহার হাত হইতে মুড়ি মুড়কি পাইতে আমাদের ভারী আমোদ হইত।

 কথা ছিল, দুষ্টামি না করিলে, ভাল করিয়া পড়া বলিতে পারিলে ছোটু মুড়িমুড়কি দিবে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন রূপ হইয়া পড়িয়াছিল। দুষ্টামি করিলে ছোটু যদি বকিত, আমার চোখ ও অমনি জলে ভরিয়া উঠিত, হাসিখুসি খেলাধুলা সমস্তই বন্ধ হইয়া পড়িত, ছোটু তখন আদর করিয়া আমাকে ঢের বেশী করিয়া মুড়িমুড়কি দিত। এই আদরের লোভে অথবা বেশী মুড়িমুড়কির লোভে জানি না, আমার দুষ্টামিটা বড়ই বাড়িয়া উঠিয়াছিল। পড়া জানিলেও অনেক সময় ভুল উত্তর দিতাম—লেখা দেখিতে আসিলে কালীর ফোঁটা হাতে ফেলিয়া দিয়া হাসিয়া কুটি কুটি হইতাম, বোর্ডে আঁক কষিয়া শিখাইতে গেলে খড়িমাটী মুছিয়া তাহার মাথায় ঘসিয়া দিয়া দুরে পলাইতাম, ইহাতে যদি সে রাগ করিত ত কাঁদিতে বসিতাম,— আর রাগ না করিয়া সেও যদি হাসিয়া খেলায় যোগ দিত—ভুল পড়া বলিলে যদি হাসিয়া বলিত—চালাকি করা হচ্ছে,—হাতে কালী দিলে হাসি মুখে যদি কলমটা লইয়া আমাকে ফোঁট পরাইয়া দিত কিম্বা আমার কপিবুকে নাম লিখিতে বসিত, খড়িমাটি-চিত্রিত হইলে ফুল ছিঁড়িয়া যদি আমাদের মাথায় বর্ষণ করিত, তাহা হইলে আমার আনন্দ রাখিবার স্থান থাকিত না। তাহার এরূপ খেলার ভাব দেখিলে সেদিন কেবল এক আমি কেন—আমরা স্কুলের যত ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সকলে মিলিয়া তাহাকে বিব্রত করিয়া তুলিতাম।

 বাবা আর একলাই বাগানের ভাল ভাল ফুল পাইতেন না, ছোটুর মুড়িমুড়কির বদলে তাহাকে আমি রোজ ফুল আনিয়া দিতাম। কাহাকে ফুল দিতে বেশী ভাল লাগিত—বাবাকে বা তাহাকে, আর কাহার সঙ্গই বা বেশী ভাল লাগিত—বাবার বা তাহার, তাহা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না। কোন একটি ভাল ফুল দেখিলে একবার মনে হইত বাবাকে দিই একবার মনে হইত তাহার জন্য লইয়া যাই; যেদিন দেখিতাম বাবা উঠিয়াছেন সেদিন ফুলটি তাঁহাকেই দিতাম, আর যেদিন দেখিতাম তিনি উঠেন নাই সেদিন ছোটুর জন্য লইয়া যাইতাম। সকালে যেমন ছোটুর কাছে যাইতে ব্যগ্র হইতাম সন্ধ্যাবেলা তেমনি আগ্রহে বাবার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিতাম যাহার কাছে যখন থাকিতাম তাহাকেই তখন বেশী ভালবাসি বলিয়া মনে হইত। ছোটুর কাছ হইতে বাবার কাছে আসিয়া প্রায়ই তাঁহাকে বলিতাম—“বাবা তোমাকে খুব ভালবাসি"; বাবা যেন সন্দেহ করিয়াছেন!

 তিনি বলিতেন “সত্যি”?

 আমি বলিতাম—“হ্যাঁ সত্যি বলছি”।

 বাবা হাসিয়া চুম্বন করিতেন; আমিও করিতাম—ভাবিতাম ছোটু ত আমাকে চুম্বন করে না; তবে বাবার মত আমাকে ভালবাসে না, আমি কেন তবে ভালবাসিব? কে বলে ভালবাসা ভালবাসা প্রত্যাশা করে না? ছেলেবেলাও এই ভাব! ইহাত আমাকে কেহ শিখায় নাই!

 দুইবৎসর আমরা একত্র পড়িয়ছিলাম, তাহার পর অনেক চেষ্টা যত্ন করিয়া নিজ ঢাকাতেই বাবা বদলী হইলেন। এই সময় দিদির বিবাহ হইল। সেই দুইবৎসরের প্রতি প্রাতঃকাল কিরূপ আনন্দে কাটিয়াছিল মনে করিতে হৃদয় এখনো আনন্দপূর্ণ হইয়া উঠে। তাহার পর ৮|১০ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, তাহার পর আমি ভালও বাসিয়াছি—শৈশবের স্নিগ্ধ কোমল ভালবাসা নহে, যাহাকে লোকে বলে প্রেম—যৌবনের সেই জ্বলন্ত অনুরাগ—তাহারো অভিজ্ঞতা জন্মিয়াছে; জীবনে কত বড় বড় আশা ভাঙ্গিয়াছে গড়িয়াছে, কত প্রবল আনন্দ নিরানন্দ জীবনের গ্রন্থিগুলি যেন দলিয়া পিষিয়া চলিয়া গিয়াছে কিন্তু শৈশবের সেই অপরিণত ক্ষুদ্র প্রেমে কি ইহা অপেক্ষাও কম সুখ কম নিঃস্বার্থ ভাব ছিল? তখনকার সেই ছোট খাট সুখ দুঃখ আশা নিরাশার প্রতি আমার মমতা আকর্ষণ কি এখনো কিছু কম! তাহা আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি না। তবে কি-কে জানে কি! তোমরা শুনিলে হয়ত বুঝিতে পরিবে, কি। আমার নিজের নিকট ত নিজের জীবন প্রকাণ্ড একটা প্রহেলিকা।