কাহাকে?/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
তাহাকে প্রথম দেখি দিদির বাড়ী—টেনিস পার্টিতে। ভগিনীপতি বিলাতফেরত ব্যারিষ্টার, ইংরাজিয়ান চালে চলেন; টেনিস খেলা উপলক্ষে হপ্তায় হপ্তায় তাঁহার বাড়ীতে ছোট খাট একটী স্ত্রীপুরুষ সম্মিলনী হইয়া থাকে। তিনিও বিলাতফেরত; ভগিনীপতির সহিত একটু কি রকম সম্পর্কও আছে, ভগিনীপতির ভগিনীপতির দূর সম্পর্কীয় ভাই কি এই রকম একটা কিছু।
প্রথম দর্শনেই কি আমি প্রাণ সমর্পণ করিয়াছিলাম? মোটেই নহে; আমি উপন্যাস লিখিতেছি না। বরঞ্চ বিপরীত। আলাপ হইবামাত্র একটু পরে তিনি একটু টেপা হাসি হাসিয়া দিদির দিকে চাহিয়া বলিলেন,—যদিও জনাস্তিকে—“এমন মণিকে আপনি এতদিন খনির মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন?” আমার নাম মৃণালিনী আমাকে সকলে মণি বলিয়া ডাকে। কথাটা আমি শুনিতে পাইলাম এবং এই প্রশংসার মধ্য হইতে কেমন একটা বেতর বেসুরো স্বর খট করিয়া কাণে বাজিল! ভগিনীপতি আবার ইহার পর ঠাটা করিয়া প্রকাশ্যেই বলিলেন—
Full many a gem of purest ray serene
The dark unfathomed caves of ocean bear,
Full many a flower is born to blush unseen
And waste its sweetness on the desert air.
দিদির নন্দাই সংস্কৃতে এম্ এ দিয়াছেন, তিনিই বা বিদ্যা ফলাইবার এমন সুযোগ ছাড়িবেন কেন; তিনিও গোঁপে তা দিতেদিতেবলিলেন—“ন রত্ন মন্বিষ্যতে মৃগ্যহে হিতৎ—রত্ন কাহাকেও অন্বেষণ করে না—তাহাকে অন্বেষণ করিয়া লইতে হয়।
সকলের মুখেই বেশ একটু হাসি ফুটিল; এইরূপে হাস্যাম্পদ হইয়া ইহার কারণকে যে আমি বিশেষ প্রীতির নজরে দেখিয়াছিলাম এমনটা ঠিক বলিতে পারিড়েছি না—কিন্তু এ ঘটনা হয় টেনিস খেলার আগে,—খেলার পরে একটু অবস্থান্তর ঘটিল। উদ্যান চইতে সকলে গৃহে সম্মিলিত হইলে তিনি গান গাহিতে অনুরুদ্ধ হইয়া প্রথমে গাহিলেন ইংরাজিগান; দিদির তাহাতে মন উঠিল না, দিদি ধরিয়া পড়িলেন—“বাঙ্গালা গান গাহুন;”—অনেক আপত্তি প্রকাশ করিয়া অনেক ইতস্ততঃ করিয়া অবশেষে নাচারে পড়িয়া তিনি বাঙ্গাল গানই আরম্ভ করিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য্য ব্যাপার। এ যে ছেলে বেলার ছোটুর সেই গান!
হায়, মিলন হোলো—যখন নিভিল চাঁঁদ বসন্ত গেলো। কেবল ছোটুর অস্পষ্ট গুণগুনাণি নহে। দিদি তাঁহার গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাইতেছিলেন, পিয়ানোর তানে লয়ে তাঁহার পূর্ণ কণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া গৃহে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল; আমি ত মুগ্ধ অভিভূত হইয়া শুনিতে লাগিলাম। পিশাসিত ব্যক্তির জলপানের ন্যায় গানের প্রতি শব্দ প্রতি ছত্র সোৎসুক্যে গ্রাস করিতে করিতে রুদ্ধ নিশ্বাসে তাহার শেষ পর্য্যন্ত শুনিবার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু আশা আকাঙ্ক্ষা যতই সামান্য হউক যদি মর্ম্মান্তিক হয় তবে বুঝি তাহা সহজে পূর্ণ হয় না,ইহাই বুঝি সংসারের অব্যর্থ নিয়ম! দুই লাইন শেষ হইতে না হইতে মিষ্টার কর সস্ত্রীক সপুত্রিক গৃহে প্রবেশ করিলেন। অভ্যর্থনা সমাদরের সাধারণ একটা হিল্লোল-প্রবাহের মধ্যে গান বাজনা থামিয়া গেল; গায়ক বাদক উভয়েই উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগকে অভিবাদন সম্ভাষণ করিলেন। স্বাগতগণ তাঁহাদের পালায় আবার সকলের সহিত যথাবিহিত ভদ্রতাঙ্গুষ্ঠান শেষ করিবার পর যদিও সেই অসমাপ্ত গীত বাদ্যের পুনরারম্ভ প্রার্থনা করিলেন; কিন্তু গায়ক আর তাঁহাতে সম্মত হইলেন না। মিশ কর একজন - গায়িকা, তিনি তাঁহাকেই গাহিতে অনুরোধ করিলেন। কেবল আমার ছাড়া গৃহ শুদ্ধ অন্য সকলেরি সেইরূপ ইচ্ছা,—অতএব কুসুম তাঁঁহার সুশোভন শীলতাপূর্ণ আপত্তি প্রকাশের সুখভোগে পর্য্যস্ত কালব্যয় করিতে অবসর না পাইয়া তখনি পিয়ানোর কাছে আসিয়া বসিতে বাধ্য হইলেন। আবার গান বাজনায় গৃহ গম গম করিষা উঠিল; কুসুমের স্বকণ্ঠ সুতানে মুগ্ধ হইয়া শ্রোতাগণ অবিরাম একটি গানের পর আর একটির ফরমাশ করিতে লাগিলেন; কিন্তু আমার কর্ণে তাহার কোনটিই প্রবেশ করে নাই আমার মাথায় সেই একই গান একই স্বরে কেবল ঘুরিতেছিল।
হায়! মিলন-হোলো! যখন নিভিল চাঁদ বসন্ত গেলো!
গান বাদ্য গল্পস্বল্পের পর নিয়মিত সময়ে নিমন্ত্রিতগণ যখন বাড়ী চলিয়া গেলেন, গৃহ নিস্তব্ধ নির্জন হইয়া পড়িল—তখনো আমার কাণে সেই গান বাজিতে লাগিল। রাতে ঘুমাইয়াও তাহা স্বপ্নে দেখিলাম। ছেলেবেলার সেই আটচালা ঘর, তাহাতে দিদির এই ড্রয়িংক্রম সমারোহ,—ছোটু গাহিতেছে— তাহার গুনগুনানি সুরে নহে-সুস্বরে সুতানে পূর্ণ কণ্ঠে গাছিতেছে—আমার দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া গাহিতেছে-
সেই মিলন হোলো—যখন নিভিল চাদ বসন্ত গেলে।
সেই মধুময় গীতধারায় সেই প্রেমময় দৃষ্টিপ্রবাহে আমার সর্ব্বাঙ্গ বিদ্যুৎ কম্পিত হইয়া উঠিল, আর ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল দেখিলাম ভোর হইয়াছে।
বড় আশা ছিল, দ্বিতীয় হপ্তায় টেনিস পার্টির দিনে গানটি শুনিব কিন্তু তিনি আর সেদিন আসিলেন না। রাত্রিকালৈ ডিনার টেবিলে আমি বলিলাম—“মিষ্টার ঘোষ যে আজ এলেন না?”
“দিদি বলিলেন “হ্য আমিও ঐ ভাবছিলুম-তিনি যে আজ এলেন না?”
ভগিনীপতি ঠাট্টার স্বরে বলিলেন “তাইত রমানাথ কি জানে এদিকে এমন প্রলয় উপস্থিত, তাহলে অবশ্যই আসত—ত ডাকব নাকি?
ঠাট্টাটা আমাকে স্পর্শ করিল না, আমি সত্যই গায়কের প্রতি আকৃষ্ট হই নাই আমার অনুরাগ গানের প্রতি অতএব আমি তাঁহার ঠাট্টায় না দমিয়া বেশ সহজভাবেই বলিলাম ‘ডাক না,তিনি বেশ গাইতে পারেন—আরএকদিন শুনতে ইচ্ছা আছে।”
আমার মনে কোন লুকান অভিপ্রায় ছিল না—কিন্তু তাহাদের মনে ছিল। তখন যদিও তাহ বুঝি নাই পরে বুঝিয়াছি।— সুতরাং আমার কথাটা তাঁহারা লুফিয়া লইলেন। দিদি বলিলেন “রমানাথ অনেকদিন ‘কল' করেছেন কিন্তু এখনো পর্য্যন্ত তাঁকে ডিনারে বলা হোল না একদিন খেতে নিমন্ত্রণ করা যাক।” ভগিনীপতি বহিলেন “তথাস্তু। তোমার ইচ্ছাতেই আমার ইচ্ছা। যেদিন ইচ্ছা বলিয়া পাঠাও।”
ডিনারের দিন তাহাকে দেখিয়া প্রথমটা যেন একটু নিরাশ হইয়া পড়িলাম;—পূর্ব্বে একদিন মাত্র তাহাকে দেখিয়াছি— একদিনেই যে তাঁহার মূর্ত্তি মানসপটে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল এমন নহে, বরঞ্চ ১০|১২ দিনে চেহারাটা এতদূর ভুলিয়া গিয়াছিলাম, যে তাঁহাকে মনে করিতে সেই স্বপ্নের চেহারাই মনে পড়িতেছিল—তাই চাক্ষুষ প্রভেদ প্রত্যক্ষ করিবামাত্র একটু ক্ষুণ্ণ হইলাম। আমার স্বপ্ন দৃষ্ট পুরুষ যে দেবতার ন্যায় সুপুরুষ এমন বলিতেছি না—সত্য কথা বলিতে, সে মুখও আমার তেমন সুস্পষ্ট মনে ছিল না, মনে ছিল কেবল স্বপ্নের সেই দৃষ্টি —আর এখন যাহাকে দেখিলাম তিনি কিছু মন্দ দেখিতে না, দিব্যি নাক মুখ, বেশ পরিপাটি করিয়া বড় কপালে চুল ফেরান, ঘন গোঁপের বেশ বঙ্কিম বাহার-সব শুদ্ধ বেশ ভালই দেখিতে। যদিও গোঁপের এ বাহার প্রথমে চোখে লাগে নাই—ক্রমশঃ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলাম—প্রথমে বরঞ্চ একটু বেশী ঘন রলিয়াই মনে হইয়াছিল। কিন্তু আমার স্বপ্নদৃষ্টপুরুষের মত তাঁহার নয়নে সেই প্রাণস্পর্শী পরিপূর্ণ সরল—অথচ প্রেমময় দৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখিলাম না; তাহার সন্ধান করিতে গিয়াই নিরাশ হইয়া পড়িলাম। “কথাবার্ত্ততে মাঝে মাঝে কেমন একটু খটকা লাগিতে লাগিল। তাঁহার টানাবোন রসিকতা এক একবার যেন ভদ্রতার সীমানা ছাড়াইয়া উঠিতেছে, মনে হইতেছিল—অথচ স্পষ্ট করিয়া এরূপ মনে কারিতেও ভরসা হইতেছিল না। ইংলণ্ডের best manners যিনি শিখিয়া আসিয়াছেন তাঁহাতে সুরুচি বা ভদ্রতর অভাব কিরূপে সম্ভবে?—আমারি অমার্জ্জিত অশিক্ষিত রুচি বশতঃ তাহা ঠিক উপলব্ধি করিতেছি না।
তিনি আসিতেই দিদি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন— “আপনি যে বৃহস্পতিবারে এলেন না? আমরা শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত ভাবছিলুম আপনি আসবেন।”
তিনি বলিলেন মিষ্টার করের বাড়ী নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। I refused them so many times before, that I had not the heart to do so again. So sorry—but did you really expect me! If I had only known it, I would have sacrificed a thousand—”
ভগিনীপতি বলিয়া উঠিলেন-"I say R don't be so very eloquent, it might make me jealous you know—”
দিদি বলিলেন “সে দিন ডিনারের পর আপনাদের কি গান হ’ল? মিশ কর কি সুন্দর গাইতে পারেন?”
“মিষ্টার ঘোষ একটু হাসিয়া বলিলেন হ্যাঁ এইরূপ শোনা যায় বটে-অন্তঃত তাঁদের ত এইরূপ বিশ্বাস। I What a lovely colour! It suits the complexion beautifully"
আমার সাড়ির প্রতি লক্ষ্য করিয়া এ কথাটা বলা হইল। ডিলার টেবিলে অবশ্য আমি তাঁঁহআর পাশে বসিয়াছিলাম কিন্তু মনে রাখিবার মত এমন কিছু বিশেষ কথা হয় নাই। ভগিনীপতিতে তাঁহাতে বেশী সময় পলিটিক্স্ লইয়াই তর্ক বিতর্ক চলিয়াছিল, মাঝে মাঝে আমার সহিত যা কথাবার্ত্তা, অধিকাংশই তাহা প্রশ্নোত্তর। আমি গাহিতে পারি কি না, কবিতা পড়ি কি না-কাহার কবিতা আমি বেশী ভালবাসি,—কত দিন এখানে থাকিব ইত্যাদি। আমি নিজে হইতে কথা কহিবার মধ্যে তাঁহার গানের প্রশংসা করিয়াছিলাম আন্তরিক প্রশংসা, ইংরাজি কমপ্লিমেণ্ট নহে। বোধ করি তাহাতে তিনি সন্তুষ্ট হইয়া থাকিবেন, প্রশংসা শুনিয়া বলিলেন “বাঙ্গলা গান আমি বেশী জানি না, এবার দেখছি শিখতে হবে।”
তাঁহার সমস্ত কথার মধ্যে এই কথাটি আমার ভাল লাগিয়াছিল; মনে হইল তিনি হৃদয়ের সহিত বলিতেছেন। খাবার পর আবার তিনি সেই গানটি গাহিলেন,—
হায়! মিলন হোলো!
যখন নিভিল চাঁদ বসন্ত গেলো!
হাতে করে মালাগাছি সারাবেলা বসে আছি
কখন ফুটিবে ফুল, আকাশে আলো,—
আসিবে সে বর বেশে মালা পরাইব হেসে
বাজিবে সাহানা তানে বাঁশি রসালে —
আসিল সাঁধের নিশা তবু পুরিল না তৃষা
কেমন কি ঘুমে আঁখি ভরিয়ে এল—
হায় মিলন হোলো!