কাহাকে?/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 দিদি বলিয়াছিলেন, তাহার সাপক্ষের বক্তব্য শুনিলে আমার আর রাগ থাকিবে না; ফলে বিপরীত ঘটিল। নিজের দোষক্ষালন অভিপ্রায়ে তিনি যাহা কিছু বলিতে লাগিলেন তাহাতেই উত্তরোত্তর ধাপে ধাপে আমার রাগটা ক্রমিকই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। প্রথমেই রাগ ধরিল, বিলাতের ঘটনাকে নিতান্ত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবে সামান্য flirtation মাত্র বলিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করায়; রাগটা আরো জ্বলিল ডাক্তারকে গালি দিতে শুনিয়া; অবশেষে ক্রোধের যেখানে যতটুকু বাকি ছিল সর্ব্বাংশে বেশ হুহু করিয়া ধরিয়া উঠিল, যখন বলিলেন তিনি আমাকে ছলনা করেন নাই, আমি তাঁহাকে ছলনা করিয়াছি, না ভাল বাসিয়া ও ভালবাসা জানাইয়াছি, নহিলে এত সামান্য কথায় তাঁহাকে এতদূর অপরাধী করিতাম না। যেন ভাল বালিলে লোকে ন্যায়ান্যায় জ্ঞান পর্য্যন্ত হারাইয়া ফেলে, অন্যায়কে দোষকে পূজা করাই যেন ভালবাসা! আমি তাঁহাকে যেরূপ ভাল লোক মনে করিয়া ভাল বাসিয়াছিলাম—তিনি যে তাহ নহেন সে যেন আমারি দোষ। তিনি যে আপনাকে আমার আদর্শরূপে প্রকাশ করিয়াছিলেন সে আমারি ছলনা বটে! কি চমৎকার যুক্তিচাতুরী! আমার এতদূর ক্রোধ হইল যে, তাহার একটা স্ফুলিঙ্গকণাও বাহিরে আসিয়া পড়িলে যেন সমস্ত বিশ্বকে ভষ্মীভূত করিয়া ফেলতে পারিত। অথচ এই প্রজ্বলন্ত মহাক্রোধও তাঁহার বিদায় কালের সেই কাতর করুণ উক্তিতে মুহূর্ত্তে অতি সহজে ভষ্মাকারে নির্ব্বাপিত নিষ্ফল হইয় পড়িল! রমণী সব পারে—যথার্থ প্রেম উপেক্ষা করিতে পারে না, বিধাতা বুঝি এই খানেই স্ত্রীপুরুষের স্বভাবগত বিশেষ পার্থক্য নির্দ্দেশ করিয়াছেন। তাঁহার ব্যথিত স্বরে, তাঁহার মর্ম্মোত্থিত বাক্যে তাঁহার গভীর প্রেম অন্তরে উপলব্ধি করিলাম, হৃদয়ের স্তরে স্তরে তাহাতে করুণ তান বিকম্পিত হইয়া উঠিল; তিনি চলিয়া গেলেন; কিন্তু তাঁহার নৈরাশ্য-ব্যথা আমি নিজের মত করিয়াই অনুভব করিতে লাগিলাম। তাঁহার যে কথায় পূর্ব্বে ক্রোধাভিভূত হইয়াছিলাম, সেই কথা মনে উদয় হইয়া নিজের প্রতি সন্দেহ আনয়ন করিল,—সত্যই কি তবে আমিই ইঁহাকে ছলনা করিয়াছি, না ভালবাসিয়াও ভালবাসা জানাইয়। ইঁহার চিরজীবনের সুখদুঃখ আপনাতে ন্যস্ত করিয়াছি?

 প্রাণভর করুণাপূর্ণ অনুতাপ বেদন লইয়া আমি নীরবে বসিয়া, দিদি আমার দিকে সোৎসুক দৃষ্টিতে চাহিয়া কি যেন জিজ্ঞাসা করিবেন ভাবিতেছেন, এই সময় ভৃত্য আসিয়া খবর দিল “ডাক্তার আসিয়াছেন।” এই সংবাদে সহজেই ভিন্নমনা হইয়া পড়িলাম-চিন্তাবেগ শমিত হইল, ডাক্তার যখন গৃহে প্রবেশ করিলেন স্পষ্ট আনন্দ অনুভব করিলাম।

 ডাক্তার আসিয়া প্রথমে আমাদিগকে অভিবাদন করিয়া, পরে সকালে আসিতে না পারার কারণ জানাইয়া তজ্জন্য ক্ষোভ প্রকাশ পূর্ব্বক আমার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। দিদি বলিলেন “ভালই আছে, রাতে ঘুমও বেশ হয়েছে—আর বোধহয় ওষুধের আবশ্যক নেই?”

 পশ্চিমের জানালা দিয়া আমার কৌচের উপর রৌদ্র পড়িয়াছিল; ইতিমধ্যে তিনি জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া আমার নিকটে একখানি চৌকিতে আসিয়া বসিলেন, বসিয়া আমার হাত দেখিয়া বলিলেন “না! এখনো বেশ সবল বোধ হচ্ছে না—টনিকটা বন্ধ করবেন না।”

 আমি বলিলাম “না অমন বিশ্রী ওষুধ আমি আর খাব না।”

 ভগিনীপতি কোথা হইতে আসিয়া বলিলেন—“কার সঙ্গে অভিমান আবদার হচ্ছে? ডাক্তারের সঙ্গে না ওষুধের সঙ্গে।”

 আমি লজ্জিত হইলাম, তাই ক্রুদ্ধস্বরে বলিলাম—“এ বুঝি আবদার হোল? একবার ওষুধটা খাও দেখি?”

 ভগিনীপতি বলিলেন “তাতে যদি তোমাদের আবদার কিছু কমে তাহলে একশিশি কেন, যত শিশি বল খাচ্ছি। I say Doctor এমন পজিটিভ প্রমাণ থাকতে মেয়ে পুরুষের intellectual superiority সম্বন্ধে এখনো এত বাকবিতণ্ডা চলে কেন তাত বুঝতে পারিনে!”

 দিদি বলিলেন—“পজিটিভ প্রমাণটা কি, আর কোন্ পক্ষে শুনি?

 ভগিনীপতি বলিলেন—“মেয়েরা যদি আর কারো সঙ্গে অভিমান করতে না পায় তখন ভাগ্যের সঙ্গেই অভিমান করতে বসে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস-অটল অচল অদৃষ্টকেও তারা চখের তাপে গলিয়ে একেবারে জল করে ফেলবে।”

 দিদি বললেন “অদৃষ্টযদি এমনই অটল অচল হয় তাহলে তার সঙ্গে যারা লড়াই করতে যায় তারাই বা কি মহাবুদ্ধিমান?

 ডাক্তার বলিলেন—“বেশ বলেছেন, আমি সম্পূর্ণভাবে আপনার সঙ্গে একমত!”

 ভগিনীপতি বলিলেন—“তুমি শুদ্ধ দলে মিশলে—তবে দেখছি আর এখান পোষাল না আমার, আমি চল্লুম-নীচে মক্কেল এসে বসে আছে। যাবার সময় দেখা করে যেও হে।” ভগিনীপতি চলিয়া গেলেন, ডাক্তার বলিলেন—“আচ্ছা ও ওষুধটা যদি আপনি খেতে না পারেন একটা সুস্বাদু টনিক লিখে দিচ্ছি।”

 এই সরল সহানুভূতি আমার বড় ভাল লাগিল, আমি আনন্দ দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিলাম।

 এস্থলে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক না হইলেও একটি কথা বলিতে ইচ্ছা হইতেছে। যাঁহারা স্ত্রীলোকের আবদার সহ্য করিতে না পারিয়া খড়্গহস্তে তাহার দমন করিয়া থাকেন, মুহূর্ত্তের জন্য যদি কেবল তাঁহারা দিব্যহৃদয় লাভ করিয়া অনুভব করিতে পারেন, সামান্য নির্দ্দোষ ছোটখাট অভিমানগুলির সম্মান রক্ষায় অতি সহজে তাঁহারা নিজের এবং পরের কিরূপ অপরিমিত গভীর সুখের কারণ হইতে পারিতেন, কেবল একটুখানি সহাহুভূতির অভাবে এই সুখের স্থলে কত অসুখ বৃদ্ধি করিতেছেন; কত কোমল হৃদয় নিষ্পেষিত কঠোর করিয়া তুলিতেছেন—তাহা হইলে জানিনা তাঁহাদের সুখ বাড়িত কিম্বা দুঃখ বাড়িত, তবে সংসারের রূপ এবং স্ত্রীলোকের ভাগ্য যে অনেকটা পরিবর্ত্তিত হইত তাহাতে সন্দেহ নাই।

 গৃহের এককোণে টেবিলে লিখিবার সরঞ্জাম ছিল—ডাক্তার নূতন একটি প্রেস্‌ক্রিপসন লিখিয়া দিদির হাতে দিয়া বলিলেন, “আর বোধ হয় আমার আসার অবশ্যক নেই।”

 দিদি বলিলেন—“এখন ত ভালই আছে আর অসুখ না করলেই বাঁচা যায়।” ডাক্তারের আসিবার কথার উত্তরে আর কোন কথাই বলিলেন না, আমার সেটা নিতান্ত অভদ্রতা বলিয়া মনে হইল; দিদির উপর মনে মনে একটু রাগ হইল, কেন তিনি কি বলিতে পারিতেন না—‘মাঝে মাঝে খোঁজখবর লইয়া যাইবেন’ অথবা ‘কখনো কোন দিন সুবিধা মত দেখা করিতে আসিলে সুখী হইব’—এমনিতর কোন একটা ভদ্রতার কথা? কিন্তু রাগটা মনেই চাপিয়া লইলাম। দিদির কথার উত্তবে ডাক্তার বলিলেন “আশাকরি এখন ভালই থাকবেন।” বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় গৃহকোণে যে ছোট টিপাইটির উপর একটি ফুলদানিতে কতকগুলি সুগন্ধী ফুল সাজান ছিল, সেই টিপাইটি আমার কাছে আনিয়া রাখিয়া বলিলেন—“ফুলের গন্ধ Nervous system এর পক্ষে খুব উপকারী”—বলিয়া আর একবার good bye বলিয়া চলিয়া গেলেন। আমার সহসা বাল্যকালের সেই আটচালা ঘর মনে পড়িল—ছোটুকে আমি যে ফুলগুলি দিতাম সে সযত্নে একটি ভাঙ্গ গ্লাসে পড়ার টেবিলের উপর কেমন সাজাইয়া রাখিত, আমি মাঝে মাঝে তাহার উপর ঝুঁকিয়া ফুলগুলির গন্ধ লইতাম; সুঁকিয়া বলিতাম “বাঃ কেমন গন্ধ, আমি বাড়ীতে যে ফুল সাজাই তার ত কই এমন গন্ধ হয় না”; ছোটু হাসিয়া সগর্ব্বে মাথা নাড়িত। সে ঘটনার সঙ্গে আজিকার এ ঘটনার বিশেষ যে কিছু সাদৃশ্য ছিল এমন নহে; তথাপি আমার মনে হইল—এ যেন ছোটু আমাকে তাহার সেই ফুলদানী আনিয়া দিল। আমি আত্মবিস্মৃত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতে গেলাম—“আপনি কি ছোটু?” সহসা আত্মস্থ সচেতন হইলাম; যেন নিদ্রাভঙ্গে জাগিয়া উঠিলাম, ততক্ষণ তিনি দ্বার পার হইয়া চলিয়া গিয়াছেন। আমার সহসা মনে হইল আমি কি ইহাকে ভালবাসিতেছি? মিষ্টার ঘোষের গান শুনিয়া যে মোহ জন্মিত ইঁহাকে দেখিয়াও কি সেইরূপ মোহের উদয় হইতেছে না? এ কিরূপ চাপল্য কিরূপ হীনতা! এই দুদিন আগে যাহাকে ভাল বাসিয়াছি তাঁহাকে ভুলিলাম? আমার প্রতি যাঁহার ভালবাসা অটল অচল তাঁহাকে ভুলিলাম? আর কিজন্য? কাহার জন্য? যাহাকে জীবনে পূর্ব্বে কখনো দেখি নাই, একদিনের মাত্র যাহার সহিত সাক্ষাৎ তাহার জন্য? এই জন্যই কি তাঁহাকে দোষী করিয়াছিলাম? নিজের ভালবাসা গিয়াছে বলিয়াই কি তাঁহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা গিয়াছে? তাঁহার কথাই তবে সত্য? আমি তাঁহাকে ছলনা করিতেছি তিনি নহেন; নহিলে যথার্থ ভালবাসিলে এ ঘটনায় আমার দুঃখ হইত অভিমান হইত, কিন্তু এরূপ ক্রোধ হইত না; তাঁহাকে পরিত্যাগ করিবার ভাব আসিত না।

 আমার অন্ধ নয়ন যেন খুলিয়া গেল, আমি সত্যালোক দেখিতে পাইলাম, নিজের দোষ অতি তীব্রভাবে অনুভব করিলাম; অনুতাপে হৃদয় দাহ হইতে লাগিল। দিদি ডাক্তারকে আসিতে না বলায় তখন রাগ হইয়াছিল এখন তাহাতে খুসি হইলাম; ভাবিলাম তাঁহার সহিত আর কখনো দেখা করিব না; যাঁহাকে একবার স্বামী মনে করিয়াছি—তিনিই আমার স্বামী হইবেন। তাঁহকে বিবাহ করিব-কিন্তু প্রতারণা করিব না; আমার মনের ভাব খুলিয়া বলিব, যদি ইহাতেও তিনি আমাকে বিবাহ করিতে চাহেন আমি তাঁহারি। সমস্ত শুনিয়াও অবশ্যই তিনি আমাকে বিবাহ করিবেন; তাঁহার প্রেম অটল অচল, আমি যাহাই হই তিনি দেবতা, তাঁহার প্রেমে তিনি পতিত-আমাকে উদ্ধার করিবেন।

 দিদি যখন সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন—“তাঁর সঙ্গে কি কথা হোল?” তখন বিবাহ করিতে আমি দৃঢ় সঙ্কল্প। আমি বলিলাম “বুঝেছি, তাঁকে বিয়ে না করে কোন দোষ করেন নি।”

 “তোকে যে খুব ভাল বাসে তাও বুঝেছিস?”

 “বুঝেছি।”

 “এখন বিয়েতে আপত্তি আছে কি?”

 বুলিলাম “না”।

 দিদি ভারী খুশী হইয়া বলিলেন, “একহপ্তা পরে সে আসবে—না”?