কাহাকে?/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
দিদি যাহা বলিয়ছিলেন তাহাই হইল, তিনি আমাকে দেখিতে আসিয়া নিজেই সে কথা পাড়িলেন। বলিলেন—“ডাক্তার আমাকে যা বলছিল—তুমি তা শুনেছিলে—না?” এই প্রথম আমাকে তিনি ‘তুমি’ বলিয়া সম্বোধন করিলেন; কালিকার বিবাহ প্রস্তাবের পর আর আপনি বলিয়া সম্ভাষণ বোধ করি তাঁহার সঙ্গত মনে হইল না। অথবা এইরূপ সম্বোধনে এখন অধিকার জন্মিয়াছে বিবেচনা করিলেন। আমি নীরবে ঘাড় নাড়িয়া স্বীকার করিলাম—শুনিয়াছি। তিনি তখন বলিলেন “তুমি বোধ হয় ভেবে নিয়েছ ভারী একটা মহামারী কাণ্ড করে বসেছি, I am so sorry,—কিন্তু আসলে তেমন কিছুই নয়-সামান্য flirtation মাত্র, বিলাতে ত এমন আখসারই হয়ে থাকে—”
আমি ক্রোধ চাপিয়া সহজ গম্ভীরভাবে বলিলাম—“কিন্তু ডাক্তারের কথায় ত উল্টোই মনে হ’ল।”
“Oh the meddling fellow——He is a puritanić hypocrite of the first water! অন্যের সম্বন্ধে একটা কথা পেলে হয়—তিলকে তাল করে তোলে।”
আমি আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলাম না, বলিলাম একজন পরিত্যক্ত অসহায় রমণীর পক্ষ গ্রহণ করে যে সে হিপক্রিট, তবে যে বিশ্বস্তহৃদয় রমণীকে ফাঁকি দেয় তাহাকে অভিধানে কি নামে সম্বোধন করে—বোধ করি Honorable man! কথাটা বোধ করি অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ হইয়াছিল, বলিয়াই আমি অনুতপ্ত হইলাম। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন—তাহার পর বলিলেন—“আমি ফাঁকি দিই নি, যদি বিবাহ করতুম তাহলেই বরঞ্চ ফাঁকি দেওয়া হ’ত। কেননা আমি তাকে কোন জন্মেই ভালবাসতে পারতুম না।”
“তবে engaged হলেন কেন?”
“ঠিক engaged হই নি তবে তবে-একটা ভুল বোঝা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে আমার দোষ নয়। বলতে ইচ্ছা ছিল না কিন্তু তুমি যখন এতদূর শুনেছ, না বলেও উপায় নেই।”
বলা বাহুল্য তিনি যাহা বলিলেন তাহাতে সেই ইংরাজ ললনারই উপর বর্ত্তমান সমাজ প্রথায় দোষ অধিক পৌঁছায়। সেই তাঁহাকে প্রথমে অনুরাগ দেখাষ্টয়াছিল—তাঁহাকে তাহাদের বাড়ীতে ক্রমাগত যাইতে বলিত, না গেলে দুঃখ করিত, কোথাও যাইবার আবশ্যক হইলে তাঁহার সঙ্গ প্রার্থনা করিত ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন পুরুষের পক্ষে এরূপ আহ্বান উপেক্ষা করা নিতান্ত অসৌজন্য কাজ, তিনি তাই এইরূপে তাহার ফাঁদে পড়িয়া গেলেন, অবশেষে যখন বুঝিলেন তাহার প্রত্যাশা বড় অধিক, সে বিবাহ আশা করে, তখন ক্রমশঃ সরিয়া পড়িলেন। তাঁহার কথার এই সারমর্ম্ম। জানিনা এই বিবরণে অন্য সকলে সেই মুগ্ধা অভিযুক্ত রমণীকে কিরূপ দৃষ্টিতে দেখিতেছেন, আমার কিন্তু এ কথায় তাহার উপর বরঞ্চ মমতা হইল এবং অভিযোগীর উপর যে বড় শ্রদ্ধা বাড়িল—তাহাও নহে।
আমি বলিলাম “কিন্তু আপনি তাকে ভুল বুঝতে দিলেন কেন? আপনার পক্ষে যা flirtation তার পক্ষে তা জীবন্ত অনুরাগ, আপনার খেলা তার মৃত্যু, এরূপস্থলে বিবাহই আপনার উচিত কার্য্য।”
“তুমি কি মনে কর—দৈবাৎ একটা অন্যায় করেছি বলেই সেই অন্যায়কে চিরস্থায়ী করা কর্ত্তব্য?—আমি যদি তাকে বিবাহ করি, কেবল আমার কষ্ট নয়—আমার ভাই, বোন, পিতামাতা, আত্মীয় স্বজনের চিরকষ্ট, দেশের সহিত অজন্ম বিচ্ছেদ; এবং এই সমস্ত দুঃখ কষ্ট বহন করব যার জন্য তারো চিরকষ্ট, কেননা তার প্রতি আমার এমন ভালবাসা নেই যাতে তাকে সুখী করতে পারি। এ অবস্থায় তুমি কি আমাকে বিবাহের পরামর্শ দিতে?”
কথাটা ঠিক বলিরা মনে হইল, বলিলাম—“কিন্তু তবে সে কেন এখনো বিবাহের প্রত্যাশা করে?—অন্ততঃ তাকে পরিষ্কার করে মনের ভাব জানিয়ে মুক্তি লওয়া উচিত ছিল।”
“আমি ত মনে করেছিলুম যথেষ্ট স্পষ্ট করে মনের ভাব জানতে দেওয়া হয়েছে, তবে এখনো যদি ভুলভ্রান্তি থাকে আমাদের বিবাহের খবর পেলেই তা ভেঙ্গে যাবে।”
কথাটা বড় খারাপ লাগিল, বাস্তবিক সে যদি ইঁহাকে ভালবালে—আর বিবাহের আশা করে তাহা হইলে এই খবরে তাহার কিরূপ হৃদয়দাহ হইবে। তাহার ভালবাসা আমার আগে, তাহার অধিকার আমার আগে, আমি কোন্ প্রাণে তাহার এরূপ যন্ত্রণার কারণ হইব—! আমি উত্তেজিত স্বরে বলিলাম “আপনি ন্যায় অন্যায় কি করেছেন জানি নে, তার বিচারক ভগবান আমরা নই, তবে যে রমণী আপনাকে এতদূর ভালবাসে তাহার সুখের পথে আমি কাঁটা হব না, এ নিশ্চয় জানবেন।”
তিনি যেন বজ্রাহত হইয়া খানিক ক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। আমার কাছ হইতে এরূপ কথা শুনিবেন—ইহা তাঁহার কল্পনার অতীত। কিছু পরে বলিলেন, “তুমি আমাকে ছলনার অভিযোগ দিচ্ছ, আমি আর যাকেই ছলনা করে থাকি— তোমাকে করি নি। কিন্তু তুমি আমাকে ছলনা করেছ, তুমি আমাকে না ভালবেসে ও ভালবাস এইরূপ বুঝতে দিয়েছ! যদি সত্য সত্য আমাকে ভালবাসতে, তা হলে কখনই এই সামান্য অপরাধে বিবাহ ভাঙ্গতে চাইতে না, আমার অবস্থা বুঝে বরঞ্চ মমতা করতে। Oh my God— have I lived to hear this!"
অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করিয়া রহিলাম,—যখন দিদি আসিলেন তখন তাঁহার সহিত দু একটা কথা কহিবার পর তিনি বলিলেন “আজ রাত্রেই একটা মোকদ্দমায় মফস্বলে যেতে হচ্ছে, হয়ত হপ্তাথানেক সেখানে থাকতে হবে। আশা করি চিঠিপত্র পাব।”
এই বলিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিদায় গ্রহণ উপলক্ষে আমার হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, অতি ব্যথিত করুণ কণ্ঠে বলিলেন “কি আর বলব, my life and death are in your hands—এই বুঝে বিবাহ ভাঙ্গবার কথা মনে করো।”
ইহার পর তিনি চলিয়া গেলেন।