কাহিনী (১৯১২)/ভাষা ও ছন্দ
ভাষা ও ছন্দ
যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়,
মহান ব্রহ্মপুত্র অকস্মাৎ দুর্দ্দাম দুর্ব্বার
দুঃসহ অন্তরবেগে তীরতরু করিয়া উন্মূল
মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল
তট-অরণ্যের তলে তরঙ্গের ডম্বরু বাজায়ে
ক্ষিপ্ত ধূর্জ্জটীর প্রায়; সেই মত বনানীর ছায়ে
স্বচ্ছ শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে
অপূর্ব্ব উদ্বেগভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে
মহর্ষি বাক্মীকি কবি,—রক্তবেগ-তরঙ্গিত বুকে
গম্ভীর জলদমন্দ্রে বারম্বার আবর্ত্তিয়া মুখে
নব ছন্দ; বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত
মুহূর্ত্তে নিল যে জন্ম পরিপূর্ণ বাণীর সঙ্গীত,
তারে লয়ে কি করিবে, ভাবে মুনি কি তার উদ্দেশ,―
তরুণ গরুড়সম কি মহৎ ক্ষুধার আবেশ
পীড়ন করিছে তারে, কি তাহার দুরন্ত প্রার্থনা,
অমর বিহঙ্গশিশু কোন্ বিশ্বে করিবে রচনা।
আপন বিরাট্ নীড়।—অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার,
তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্দ্ধশিখা জ্বালি চিত্তে তাহােরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।
অস্তে গেল দিনমণি। দেবর্ষি নারদ সন্ধ্যাকালে
শাখাসুপ্ত পাখীদের সচকিয়া জটারশ্মিজালে,
স্বর্গের নন্দনগন্ধে অসময়ে শান্ত মধুকরে
বিস্মিত ব্যাকুল করি, উত্তরিলা তপােভূমি পরে।
নমস্কার করি কবি, শুধাইলা সঁপিয়া আসন
“কি মহৎ দৈবকার্য্যে, দেব, তব মর্ত্ত্যে আগমন!”
নারদ কহিলা হাসি—“করুণার উৎসমুখে, মুনি,
যে ছন্দ উঠিল ঊর্দ্ধে, ব্রহ্মলােকে ব্রহ্মা তাহা শুনি
আমারে কহিলা ডাকি, যাও তুমি তমসার তীরে,
বাণীর বিদ্যুৎ-দীপ্ত ছন্দোবাণবিদ্ধ বাল্মীকিরে
বারেক শুধায়ে এস,―বোলো তারে, “ওগো ভাগ্যবান্,
এ মহা সঙ্গীতধন কাহারে করিবে তুমি দান।
এই ছন্দে গাঁথি লয়ে কোন্ দেবতার যশঃকথা
স্বর্গের অমর কবি মর্ত্ত্যলােকে দিবে অমরতা।”
কহিলেন শির নাড়ি ভাবােন্মত্ত মহামুনিবর,
“দেবতার সামগীতি গাহিতেছে বিশ্বচরাচর,
ভাষাশূন্য অর্থহারা। বহ্নি ঊর্দ্ধে মেলিয়া অঙ্গুলি
ইঙ্গিতে করিছে স্তব; সমুদ্র তরঙ্গবাহু তুলি
কি কহিছে স্বর্গ জানে; অরণ্য উঠায়ে লক্ষশাখা
মর্ম্মরিছে মহামন্ত্র; ঝটিকা উড়ায়ে রুদ্র পাখা
গাহিছে গর্জ্জন গান; নক্ষত্রের অক্ষৌহিণী হতে
অরণ্যের পতঙ্গ অবধি, মিলাইছে এক স্রোতে
সঙ্গীতের তরঙ্গিণী বৈকুণ্ঠের শান্তিসিন্ধু পারে।
মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বন্ধ চারিধারে,
ঘুরে মানুষের চতুর্দ্দিকে। অবিরত রাত্রিদিন
মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ।
পরিস্ফুট তত্ত্ব তার সীমা নেয় ভাবের চরণে;
ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্দ্ধমুখে অনন্তগগনে
উড়িতে সে নাহি পারে সঙ্গীতের মতন স্বাধীন
মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন।
প্রভাতের শুভ্র ভাষা বাক্যহীন প্রত্যক্ষ কিরণ
জগতের মর্ম্মদ্বার মুহূর্ত্তেকে করি উদ্ঘাটন
নির্ব্বারিত করি দেয় ত্রিলোকের গীতের ভাণ্ডার;
যামিনীর শান্তিবাণী ক্ষণমাত্রে অনন্ত সংসার
আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, বাক্যহীন পরম নিষেধ
বিশ্বকর্ম্ম কোলাহল মন্ত্রবলে করি দিয়া ভেদ
নিমেষে নিবায়ে দেয় সর্ব্ব খেদ সকল প্রয়াস,
জীবলোক মাঝে আনে মরণের বিপুল আভাস;
নক্ষত্রের ধ্রুব ভাষা অনির্ব্বাণ অনলের কণা
জ্যোতিষ্কের সূচিপত্রে আপনার করিছে সূচনা
নিত্যকাল মহাকাশে; দক্ষিণের সমীরের ভাষা
কেবল নিশ্বাসমত্রে নিকুঞ্জে জাগায় নব আশা,
দুর্গম পল্লবদুর্গে অরণ্যের ঘন অন্তঃপুরে
নিমেষে প্রবেশ করে, নিয়ে যায় দূর হতে দূরে
যৌবনের জগয়ান;―সেই মত প্রত্যক্ষ প্রকাশ
কোথা মানবের বাক্যে, কোথা সেই অনন্ত আভাস,
কোথা সেই অর্থভেদী অভ্রভেদী সঙ্গীত উচ্ছ্বাস,
আত্মবিদারণকারী মর্ম্মান্তিক মহান্ নিশ্বাস।
মানবের জীর্ণ বাক্যে মাের ছন্দ দিবে নব সুর,
অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর
ভাবের স্বাধীন লােকে, পক্ষবান্ অশ্বরাজ সম
উদ্দাম সুন্দর গতি,—সে আশ্বাসে ভাসে চিত্ত মম।
সূর্য্যেরে বহিয়া যথা ধায় বেগে দিব্য অগ্নিতরী
মহাব্যোম-নীলসিন্ধু প্রতিদিন পারাপার করি;
ছন্দ সেই অগ্নিসম বাক্যেরে করিব সমর্পণ
যাবে চলি মর্ত্তসীমা অবাধে করিয়া সন্তরণ,
গুরুভার পৃথিবীরে টানিয়া লইবে ঊর্দ্ধপানে,
কথারে ভাবের স্বর্গে, মানবেরে দেবপীঠস্থানে।
মহাম্বুধি যেইমত ধ্বনিহীন স্তব্ধ ধরণীরে
বাঁধিয়াছে চতুর্দ্দিকে অন্তহীন নৃত্য গীতে ঘিরে,―
তেমনি আমার ছন্দ, ভাষারে ঘেরিয়া আলিঙ্গনে
গাবে যুগে যুগান্তরে সরল গম্ভীর কলস্বনে
দিক্ হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান,―
ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্য্যাদা করি দান।
হে দেবর্ষি, দেবদূত, নিবেদিয়ো পিতামহ-পায়ে
স্বর্গ হতে যাহা এল স্বর্গে তাহা নিয়োনা ফিরায়ে।
দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে,
তুলিব দেবতা করি মানুষের মাের ছন্দে গানে।
ভগবন্, ত্রিভুবন তােমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজে
কহ মােরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে।
কহ মােরে বীর্য্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,
কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্ম্মের নিয়ম
ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মত,
মহৈশ্বর্য্যে আছে নম্র, মহা দৈন্য়ে কে হয়নি নত,
সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,
কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,
কে লয়েছে নিজ শিরে রাজভালে মুকুটের সম
সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম,―
কহ মােরে সর্ব্বদর্শী হে দেবর্ষি তাঁর পুণ্য নাম।”
নারদ কহিলা ধীরে―“অযােধ্যার রঘুপতি রাম।”
“জানি আমি জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্ত্তিকথা,”
কহিলা বাল্মীকি, “তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা,
সকল ঘটনা তাঁর―ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মাের মনে।”
নারদ কহিলা হাসি, “সেই সত্য, যা’ রচিবে তুমি,
ঘটে যা’ তা’ সব সত্য নহে। কবি, তব মনােভূমি
রামের জনমস্থান, অযােধ্যার চেয়ে সত্য জেনাে।”
এত বলি দেবদূত মিলাইল দিব্য-স্বপ্ন-হেন
সুদূর সপ্তর্ষি লােকে। বাল্মীকি বসিলা ধ্যানাসনে,
তমসা রহিল মৌন, স্তব্ধতা জাগিল তপোবনে।