কাহিনী (১৯১২)/সতী
সতী[১]
রণক্ষেত্র
অমাবাই ও বিনায়ক রাও
অমাবাই
পিতা!
বিনায়ক রাও
পিতা! আমি তাের পিতা! পাপীয়সি
স্বাতন্ত্র্যচারিণী! যবনের গৃহে পশি
ম্লেচ্ছগলে দিলি মালা কুলকলঙ্কিনী!
আমি তাের পিতা!
অমাবাই।
অন্যায় সমরে জিনি
স্বহস্তে বধিলে তুমি পতিরে আমার,
হায় পিতা, তবু তুমি পিতা! বিধবার
অশ্রুপাতে পাছে লাগে মহা অভিশাপ
তব শিরে, তাই আমি দুঃসহ সন্তাপ
রুদ্ধ করি রাখিয়াছি এ বক্ষ পঞ্জরে।
তুমি পিতা, আমি কন্যা, বহুদিন পরে
হয়েছে সাক্ষাৎ দোঁহে সমর অঙ্গনে
দারুণ নিশিথে। পিতঃ প্রণমি’ চরণে
পদধূলি তুলি শিরে লইব বিদায়।
আজ যদি নাহি পার ক্ষমিতে কন্যায়
আমি তবে ভিক্ষা মাগি বিধাতার ক্ষমা
তােমা লাগি পিতৃদেব!
বিনায়ক রাও
কোথা যাবি অমা!
ধিক্ অশ্রুজল! ওরে দুর্ভাগিনী নারী
যে বৃক্ষে বাঁধিলি নীড় ধর্ম্ম না বিচারি’
সে ত বজ্রাহত দগ্ধ, যাবি কার কাছে
ইহকাল-পরকাল হারা!
অমাবাই
পুত্র আছে—
বিনায়ক রাও
থাক্ পুত্র! ফিরে আর চাস্নে পশ্চাতে
পাতকের ভগ্নশেষ পানে। আজ রাতে
শােণিত-তর্পণে তাের প্রায়শ্চিত্ত শেষ,—
যবনের গৃহে তাের নাহিক প্রবেশ
আর কভু। বল্ তবে কোথা যাবি আজ!
অমাবাই
হে নির্দ্দয়! আছে মৃত্যু, আছে যমরাজ,
পিতা হতে স্নেহময়, মুক্তদ্বারে যাঁর
আশ্রয় মাগিয়া কেহ ফিরে নাই আর।
বিনায়ক রাও
মৃত্যু? বৎসে! হা দুর্বৃত্তে! পরম পাবক
নির্ম্মল উদার মৃত্যু—সকল পাতক
করে গ্রাস—সিন্ধু যথা সকল নদীর
সব পঙ্করাশি। সেই মৃত্যু সুগভীর
তোর মুক্তি গতি। কিন্তু মৃত্যু আজ না সে,
নহে হেথা। চল্ তবে দূর তীর্থবাসে
সলজ্জ স্বজন আর সক্রোধ সমাজ
পরিহরি; বিসর্জ্জি কলঙ্ক ভয় লাজ
জন্মভূমি ধূলিতলে। সেথা গঙ্গাতীরে
নবীন নির্ম্মল বায়ু;—স্বচ্ছ পুণ্যনীরে
তিন সন্ধ্যা স্নান করি’, নির্জ্জন কুটীরে
শিব শিব শিব নাম জপি শান্ত মনে,
সুদূর মন্দির হতে সায়াহ্ন পবনে
শুনিয়া আরতিধ্বনি,―একদিন কবে
আয়ুঃশেষে মৃত্যু তোরে লইবে নীরবে,―
পতিত কুসুমে লয়ে পঙ্ক ধুয়ে তার
গঙ্গা যথা দেয় তারে পূজা উপহার
সাগরের পদে।
অমাবাই।
পুত্র মোর!
বিনায়ক রাও
তার কথা
দূব কর। অতীত-নির্ম্মুক্ত পবিত্রতা
ধৌত করে দিক্ তোরে। সদ্য শিশুসম
আরবার আয় বৎসে পিতৃকোলে মম
বিস্মৃতি মাতার গর্ভ হতে। নব দেশে,
নব তরঙ্গিনীতীরে, শুভ্র হাসি হেসে
নবীন কুটীরে মোর জ্বালাবি আলোক
কন্যার কল্যাণ করে।
অমাবাই
জ্বলে পতিশোক,
বিশ্ব হেরি ছায়াসম; তোমাদের কথা
দূব হতে আনে কানে ক্ষীণ অস্ফুটতা,
পশে না হৃদয়মাঝে। ছেড়ে দাও মোরে,
ছেড়ে দাও! পতিরক্তসিক্ত স্নেহডোরে
বেঁধো না আমায়।
বিনায়ক রাও
কন্যা নহেক পিতার।
শাখাচ্যুত পুষ্প শাখে ফিরেনাক আর।
কিন্তু রে শুধাই তোরে কারে ক’স্ পতি
লজ্জাহীনা! কাড়ি নিল যে ম্লেচ্ছ দুর্ম্মতি
জীবাজির প্রসারিত বরহস্ত হতে
বিবাহের রাত্রে তোরে-বঞ্চিয়া কপােতে
শ্যেন যথা লয়ে যায় কপোত-বধূরে
আপনার ম্লেচ্ছ নীড়ে,—সে দুষ্ট দস্যুরে
পতি ক’স তুই!—সে রাত্রি কি মনে পড়ে?
বিবাহ সভায় সবে উৎসুক অন্তরে
বসে আছি,―শুভলগ্ন হল গত প্রায়,―
জীবাজি আসে না কেন সবাই শুধায়,
চায় পথপানে। দেখা দিল হেনকালে
মশালের রক্তরশ্মি নিশীথের ভালে,
শুনা গেল বাদ্যরব। হর্ষে উচ্ছ্বসিল
অন্তঃপুরে হুলুধ্বনি। দুয়ারে পশিল
শতেক শিবিকা; কোথা জীবাজি কোথায়
শুধাতে না শুধাতেই, ঝটিকার প্রায়
অকস্মাৎ কোলাহলে হতবুদ্ধি করি’
মুহূর্ত্তের মাঝে তােরে বলে অপহরি
কে কোথা মিলাল। ক্ষণপরে নতশিরে
জীবাজি বন্ধনমুক্ত এল ধীরে ধীরে―
শুনিনু কেমনে তারে বন্দী করি পথে,
লয়ে তার দ্বীপমালা, চড়ি তার রথে,
কাড়ি লয়ে পরি তার বর-পরিচ্ছদ
বিজাপুর যবনের রাজসভাসদ্
দস্যুবৃত্তি করি গেল। সে দারুণরাতে
হােমাগ্নি করিয়া স্পর্শ জীবাজির সাথে
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি—দস্যুরক্তপাতে
লব এর প্রতিশোধ। বহুদিন পরে
হয়েছি সে পণমুক্ত। নিশীথ সমরে
জীবাজি ত্যজিয়া প্রাণ বীরের সদ্গতি
লভিয়াছে। রে বিধবা, সেই তাের পতি,―
দস্যু সে ত ধর্ম্মনাশী!
অমাবাই
ধিক্ পিতা, ধিক্!
বধেছ পতিরে মাের—আরো মর্ম্মান্তিক
এই মিথ্যা বাক্যশেল। তব ধর্ম্ম কাছে
পতিত হয়েছি, তবু মম ধর্ম্ম আছে।
সমুজ্জ্বল। পত্নী আমি, নহি সেবাদাসী।
বরমাল্যে বরেছিনু তাঁরে ভালবাসি
শ্রদ্ধাভরে; ধরেছিনু পতির সন্তান
গর্ভে মাের,―বলে করি নাই আত্মদান।
মনে আছে দুই পত্র একদিন রাতে
পেয়েছিনু অন্তঃপুরে গুপ্তদূতী হাতে।
তুমি লিখেছিলে শুধু,—“হান তারে ছুরি,”
মাতা লিখেছিল, “পত্রে বিষ দিনু পূরি
কর তাহা পান।” যদি বলে পরাজিত
অসহায় সতীধর্ম্ম কেহ কেড়ে নিত
তা হলে কি এতদিন হত না পালন
তোমাদের সে আদেশ? হৃদয় অর্পণ
করেছিনু বীরপদে। যবন ব্রাহ্মণ
সে ভেদ কাহার ভেদ? ধর্ম্মের সে নয়।
অন্তরের আন্তর্যামী যেথা জেগে রয়
সেথায় সমান দোঁহে। মাঝে মাঝে তবু
সংস্কার উঠিত জাগি;―কোন দিন কভু
নিগূঢ় ঘৃণার বেগ শিরায় অধীর
হানিত বিদ্যুৎকম্প,—অবাধ্য শরীর
সঙ্কোচে কুঞ্চিত হত;―কিন্তু তারো পরে
সতীত্ব হয়েছে জয়ী। পূর্ণ ভক্তিভরে
করেছি পতির পূজা; হয়েছি যবনী
পবিত্র অন্তরে; নহি পতিতা রমণী,―
পরিতাপে অপমানে অবনতশিরে
মোর পতিধর্ম্ম হতে নাহি যাব ফিরে
ধর্ম্মান্তরে অপরাধীসম।—এ কি, এ কি!
নিশীথের উল্কাসম এ কাহারে দেখি
ছুটে আসে মুক্তকেশে!
(রমাবাইয়ের প্রবেশ)
জননী আমার!
কখনো যে দেখা হবে এ জনমে আর
হেন ভাবি নাই মনে। মাগো, মা জননি
দেহ তব পদধূলি।
রমাবাই
ছুঁস্নে যবনী
পাতকিনী!
অমাবাই
কোন পাপ নাই মাের দেহে,―
নির্ম্মল তােমারি মত।
রমাবাই
যবনের গেহে
কার কাছে সমর্পিলি ধর্ম্ম আপনার?
অমাবাই
পতি কাছে।
রমাবাই
পতি! ম্লেচ্ছ, পতি সে তােমার!
জানিস্ কাহারে বলে পতি! নষ্টমতি,
ভ্রষ্টাচার! রমণীর সে যে এক গতি,
একমাত্র ইষ্টদেব। ম্লেচ্ছ মুসলমান,
ব্রাহ্মণ কন্যার পতি! দেবতা সমান!
অমাবাই।
উচ্চ বিপ্রকুলে জন্মি’ তবুও যবনে
ঘৃণা করি নাই আমি, কায়বাক্যেমনে
পূজিয়াছি পতি বলি’; মােরে করে ঘৃণা
এমন কে সতী আছে? নহি আমি হীনা
জননী তােমার চেয়ে,―হবে মাের গতি
সতীস্বর্গলোকে।
রমাবাই
সতী তুমি!
অমাবাই
আমি সতী।
রমাবাই
জানিস্ মরিতে অসঙ্কোচে!
অমাবাই
জানি আমি।
রমাবাই
তবে জ্বাল চিতানল! ওই তাের স্বামী
পড়িয়া সমরভূমে।
অমাবাই
জীবাজি?
রমাবাই
জীবাজি।
বাক্দত্ত পতি তাের। তারি ভস্মে আজি
ভস্ম মিলাইতে হবে। বিবাহ রাত্রির
বিফল হােমাগ্নিশিখা শ্মশানভূমির
ক্ষুধিত চিতাগ্নিরূপে উঠেছে জাগিয়া;
আজি রাত্রে সে রাত্রির অসমাপ্ত ক্রিয়া
হবে সমাপন।
বিনায়ক রাও
যাও বৎসে, যাও ফিরে
তব পুত্র কাছে, তব শোকতপ্ত নীড়ে।
দারুণ কর্ত্তব্য মাের নিঃশেষ করিয়া
করেছি পালন,―যাও তুমি।―অয়ি প্রিয়া
বৃথা করিতেছ ক্ষোভ। যে নব শাখারে
আমাদের বৃক্ষ হতে কঠিন কুঠারে
ছিন্ন করি নিয়ে গেল বনান্তর ছায়ে,
সেথা যদি বিশীর্ণা সে মরিত শুকায়ে
অগ্নিতে দিতাম তারে; সে যে ফলেফুলে
নব প্রাণে বিকশিত, নব নব মূলে
নূতন মৃত্তিকা ছেয়ে। সেথা তার প্রীতি,
সেথাকার ধর্ম্ম তার, সেথাকার রীতি।
অন্তরের যােগসূত্র ছিঁড়েছে যখন
তােমার নিয়মপাশ নির্জ্জীব বন্ধন
ধর্ম্মে বাঁধিছে না তারে, বাঁধিতেছে বলে।
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!—যাও বৎসে চলে,
যাও তব গৃহকর্ম্মে ফিরে,―যাও তব
স্নেহপ্রীতিজড়িত সংসারে,—অভিনব
ধর্ম্মক্ষেত্র মাঝে। এস প্রিয়ে, মােরা দোঁহে
চলে যাই তীর্থধামে কাটি মায়ামোহে
সংসারের দুঃখ সুখ চক্র আবর্ত্তন
ত্যাগ করি,’—
রমাবাই
তার আগে করিব ছেদন
আমার সংসার হতে পাপের অঙ্কুর
যতগুলি জন্মিয়াছে। করি যাব দূব
আমার গর্ভের লজ্জা। কন্যার কুযশে
মাতার সতীত্বে যেন কলঙ্ক পরশে।
অনলে অঙ্গারসম সে কলঙ্ক কালী
তুলিব উজ্জ্বল করি চিতানল জ্বালি’।
সতীখ্যাতি রটাইর দুহিতার নামে
সতী মঠ উঠাইব এ শ্মশানধামে
কন্যার ভস্মের পরে।
অমাবাই
ছাড় লােকলাজ
লােকখ্যাতি,—হে জননী এ নহে সমাজ,
এ মহাশ্মশানভূমি। হেথা পুণ্যপাপ
লােকের মুখের বাক্যে করিয়ােনা মাপ,—
সত্যেরে প্রত্যক্ষ কর মৃত্যুর আলোকে,
সতী আমি। ঘৃণা যদি করে মোরে লোকে
তবু সতী আমি। পরপুরুষের সনে
মাতা হয়ে বাঁধ যদি মৃত্যুর মিলনে
নির্দ্দোষ কন্যারে―লােকে তােরে ধন্য কবে―
কিন্তু মাতঃ নিত্যকাল অপরাধী র’বে
শ্মশানের অধীশ্বর পদে।
রমাবাই
জ্বাল চিতা,
সৈন্যগণ! ঘের আসি বন্দিনীরে।
অমাবাই
পিতা!
বিনায়ক রাও
ভয় নাই, ভয় নাই! হায় বৎসে হায়
মাতৃহস্ত হতে আজি রক্ষিতে তােমায়
পিতারে ডাকিতে হল।—যেই হস্তে তােরে
বক্ষে বেঁধে রেখেছিনু, কে জানিত ওরে
ধর্ম্মেরে করিতে রক্ষা, দোষীরে দণ্ডিতে
সেই হস্তে একদিন হইবে খণ্ডিতে
তােমারি সৌভাগ্যসূত্র হে বৎসে আমার!
অমাবাই
পিতা!
বিনায়ক রাও
আয় বৎসে! বৃথা আচার বিচার
পুত্রে লয়ে মাের সাথে আয় মোর মেয়ে
আমার আপন ধন। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্যধর্ম্ম সত্য চিরদিন।
পিতৃস্নেহ নির্ব্বিচার বিকারবিহীন
দেবতার বৃষ্টিসম,―আমার কন্যারে
সেই শুভ স্নেহ হতে কে বঞ্চিতে পারে
কোন্ শাস্ত্র, কোন্ লােক, কোন্ সমাজের
মিথ্যা বিধি, তুচ্ছ ভয়।
রমাবাই
কোথা যাস! ফের!
রে পাপিষ্ঠে, ওই দেখ্, তাের লাগি প্রাণ
যে দিয়েছে রণভূমে,―তার প্রাণদান
নিস্ফল হবে না,―তােরে লইবে সে সাথে
বরবেশে, ধরি তাের মৃত্যুপূত হাতে
শূরস্বর্গ মাঝে। শুন, যত আছ বীর,
তােমরা সকলে ভক্ত ভৃত্য জীবাজির,―
এই তাঁর বাক্দত্তা বধূ,―চিতানলে
মিলন ঘটায়ে দাও মিলিয়া সকলে
প্রভুকৃত্য শেষ কর।
সৈন্যগণ
ধন্য পুণ্যবতী।
অমাবাই
পিতা!
বিনায়ক রাও
ছাড় তােরা!
সৈন্যগণ
যিনি এ নারীর পতি
তাঁর অভিলাষ মােরা করিব পূরণ।
বিনায়ক রাও
পতি এঁর স্বধর্মী যবন।
সেনাপতি
সৈন্যগণ,
বাঁধ বৃদ্ধ বিনায়কে।
অমাবাই
মাতঃ! পাপীয়সি!
পিশাচিনি!
রমাবাই
মুঢ় তােরা কি করিস্ বসি!
বাজা বাদ্য, কর জয়ধ্বনি।
সৈন্যগণ
জয় জয়।
অমাবাই
নারকিনী!
সৈন্যগণ
জয় জয়।
রমাবাই
রটা বিশ্বময়
সতী অমা।
অমাবাই
জাগ, জাগ, জাগ ধর্ম্মরাজ!
শ্মশানের অধীশ্বর, জাগ তুমি আজ।
হের তব মহারাজ্যে করিছে উৎপাত
ক্ষুদ্র শত্রু,― জাগ,’ তারে কর বজ্রাঘাত
দেবদেব! তব নিত্যধর্ম্মে কর জয়ী।
ক্ষুদ্র ধর্ম্ম হতে।
রমাবাই
বল্ জয় পুণ্যময়ী,
বল্ জয় সতী।
সৈন্যগণ
জয় জয় পুণ্যবতী।
অমাবাই
পিতা, পিতা, পিতা মাের!
সৈন্যগণ
ধন্য ধন্য সতী!
- ↑ মিস্ম্যানিং সম্পাদিত ন্যাশনাল ইণ্ডিয়ান্ অ্যাসোসিয়েশনের পত্রিকায় মারাঠি গাথা সম্বন্ধে অ্যাকওয়র্থ্ সাহেব-রচিত প্রবন্ধ বিশেষ হইতে বর্ণিত ঘটনা সংগৃহীত।