যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণকে কহিতে লাগিলেন—

 আমাদিগকে যখন দ্বাদশ বৎসর এইভাবে যাপন করিতে হইবে তখন মৃগপক্ষিসমাকীর্ণ ফুলফল-সম্পন্ন কোন কল্যাণকর স্থান অন্বেষণ করা কর্ত্তব্য।

 অর্জ্জুন কহিলেন—তুমি যদি কোন বিশেষ স্থান মনস্থ করিয়া না থাক, তবে আমি নিকটবর্ত্তী স্বচ্ছ সরােবরবিশিষ্ট দ্বৈতবন নামক এক অতি রমণীয় স্থান অবগত আছি, তথায় অক্লেশে দ্বাদশ বৎসর কালক্ষেপ করিতে পারি।

 ক্রমে বনবাসের নিরূপিত দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত হইল। সত্যপ্রতিজ্ঞ পাণ্ডবগণ ত্রয়ােদশবর্ষীয় অজ্ঞাতবাসের আয়ােজন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে ভ্রাতৃগণ! প্রথমত একটি গূঢ় অথচ রমণীয় স্থান স্থির করা আবশ্যক ষেখানে অরাতিগণের অজ্ঞাতসারে অথচ স্বচ্ছন্দে আমরা একবৎসর যাপন করিতে পারি।

 অর্জ্জুন কহিলেন—মহারাজ! কুরুমণ্ডলের চতুর্দ্দিকে পাঞ্চাল চেদি মৎস্য প্রভৃতি যে সকল বন্ধুগণের রাজ্য আছে, ইহার মধ্যে যে কোন একটায় আমরা নিশ্চয়ই প্রচ্ছন্ন থাকিতে সক্ষম হইব।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে মহাবাহো! ইহার মধ্যে মৎস্য রাজ্যই আমার মনোনীত হইতেছে। বিরাটরাজা পিতার বন্ধু ছিলেন ও সর্ব্বদাই আমাদের হিতকামনা করিতেন। তিনি বৃদ্ধ ধর্ম্মশীল এবং বদান্য। তাঁহার নিকট গমন করিয়া আমরা যদি ছদ্মবেশে প্রত্যেকে এক একটি উপযুক্ত কর্ম্মে নিযুক্ত হই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সম্বৎসরকাল তথায় অকুতোভয়ে বাস করিতে পারিব।

 অর্জ্জুন কহিলেন—হায়! তুমি চিরকালই সুখে পালিত ও রাজপদে প্রতিষ্ঠিত, তুমি এক্ষণে অন্যের অধীনে কি কর্ম্ম করিবে?

 যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে ভ্রাতৃগণ! তোমরা চঞ্চল হইও না। আমি যে কর্ম্ম করিতে পারি তাহা স্থির করিয়াছি, শ্রবণ কর। আমি কঙ্ক নাম ধারণপূর্ব্বক অক্ষনিপুণ ব্রাহ্মণবেশে হস্তে শারিফলক গজদন্ত-নির্ম্মিত চতুর্ব্বর্ণ শারি ও সুবর্ণময় অক্ষ লইয়া বিরাটরাজের সভাপদের প্রার্থী হইব। বিশেষ পরিচয় জিজ্ঞাসিত হইলে বলিব আমি পূর্ব্বে রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রিয়সখা ছিলাম। এই কর্ম্মে আমি বিনা ক্লেশে রাজার মনোরঞ্জন করিতে পারিব। এক্ষণে, হে বৃকোদর! বল তুমি কি কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া কালাতিপাত করিবে?

 ভীমসেন কহিলেন―হে ধর্ম্মরাজ! আমি মনে করিতেছি বল্লব নাম ধারণ করিয়া সূপকার বলিয়া পরিচয় দিব। পাককার্য্যে আমার বিশেষ নৈপুণ্য আছে। বিরাটরাজের উপস্থিত কিঙ্করগণ অপেক্ষা আমি নিশ্চয়ই উৎকৃষ্টতর ব্যঞ্জন প্রস্তুত করিয়া রাজাকে তৃপ্ত করিতে পারিব। এতদ্ব্যতীত মল্ল ক্রীড়াস্থলে আমি বাহুবলের পরিচয় প্রদান করিয়া সকলের সম্মানভাজন হইতে পারিব সন্দেহ নাই। পরিচয় চাহিলে আমিও কহিব যে, আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের সূপকার ও মল্লযোদ্ধা ছিলাম। হে রাজন! এই ভাবে আমি নির্ব্বিঘ্নে কালক্ষেপ করিতে পারিব।

 তখন যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেন—

 যে মহাবীর তেজস্বীর মধ্যে অগ্নিতুল্য, যাঁহার বাহুদ্বয় সমভাবে জ্যা-ঘাতদ্বারা কিণাঙ্কিত, সেই সব্যসাচী কোন্ ছদ্মবেশ অবলম্বন করিবেন?

 তদুত্তরে অর্জ্জুন কহিলেন―

 হে ধর্ম্মরাজ! তুমি যথার্থই বলিতেছ যে, আমার জ্যা-ঘাতচিহ্নিত ভুজদ্বয় ও যুদ্ধগর্ব্বিত সুদৃঢ় শরীর গোপন করা সহজ নহে, সেইজন্য আমি সঙ্কল্প করিয়াছি যে, মস্তকে বেণী ও কর্ণে কুণ্ডল ধারণপূর্ব্বক বলয়শ্রেণীদ্বারা কিণাঙ্কিত হস্ত আচ্ছাদিত করিয়া বৃহন্নলা নামে নর্ত্তক সাজিব। আমি ইন্দ্রালয়ে বাসকালে গান্ধর্ব্ব-বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলাম, সুতরাং আমি মহিলাদিগকে নৃত্যগীতাদি শিক্ষা দিলে অন্তঃপুরে নিশ্চয়ই সমাদৃত হইব। আমিও জিজ্ঞাসিত হইলে বলিব যে, দ্রৌপদীর পরিচর্য্যায় নিযুক্ত ছিলাম। হে ধর্ম্মরাজ! আমি এইরূপে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় সুখে বিরাটভবনে বিহার করিতে পারিব।

 অনন্তর যুধিষ্ঠির কহিলেন―

 হে নকুল! তুমি সুখসম্ভোগসমুচিত এবং সুকুমার, তুমি কি কর্ম্ম করিতে পারিবে?

 নকুল কহিলেন—মহারাজ! আমার চিরকালই অশ্বের প্রতি প্রীতি আছে, আমি তাহাদের শিক্ষা ও চিকিৎসাসম্বন্ধে অনেক তথ্য অবগত আছি; অতএব আমি গ্রন্থিক নাম ধারণ করিয়া অশ্বপরিদর্শকের পদ প্রার্থনা করিব। এ কার্য্য আমারও প্রীতিকর হইবে, রাজাকেও ইহা দ্বারা সন্তুষ্ট করিতে পারিব। আমিও পরিচয়স্থলে বলিব যে, রাজা যুধিষ্ঠিরের অশ্বাধিকারে নিযুক্ত ছিলাম।

 সহদেব জিজ্ঞাসিত হইলে বলিলেন—

 হে রাজন! তুমি যৎকালে আমাকে গো-তত্ত্বাবধারণে প্রেরণ করিতে, আমি সে সময়ে গােগণের দোহন পালন ও শুভাশুভ লক্ষণসম্বন্ধে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলাম; অতএব আমার জন্য চিন্তিত হইও না, আমি তন্ত্রিপাল নামে গোচর্য্যায় নিযুক্ত থাকিয়া নিশ্চয়ই রাজার তুষ্টিসাধন করিতে পারিব।

 পরিশেষে কাতরস্বরে ধর্ম্মরাজ বলিতে লাগিলেন—

 হে ভ্রাতৃগণ! আমাদের প্রাণপ্রিয়া ভার্য্যা, যিনি আমাদের পালনীয়া ও মাননীয়া, তাঁহাকে কি প্রকারে আমরা পরের সেবায় নিযুক্ত দেখিব, তিনি আজন্মকাল কেবল পরের সেবা গ্রহণই করিয়াছেন, সাজসজ্জা ব্যতীত কোন বিষয়েই স্বয়ং অনুষ্ঠান করেন নাই, অতএব তিনি কোন্ কর্ম্মই বা করিতে পারিবেন?

 দ্রৌপদী কহিলেন—মহারাজ! লোকে সাজ সজ্জাসম্বন্ধীয় সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের নিমিত্ত কিঙ্করী নিযুক্ত করিয়া থাকে; অতএব আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা কেশ সংস্কারকুশল সৈরিন্ধ্রী বলিয়া পরিচয় দিয়া রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচর্য্যা করব। এই কার্য্যে সহায়হীনা সাধ্বী স্ত্রীরাই নিযুক্ত থাকেন, সুতরাং ইহা আমার পক্ষে অনুপযুক্ত হইবে না, আমি নিশ্চয়ই রাজমহিষীর সম্মানিতা হইব; অতএব আমার নিমিত্ত আর মনস্তাপ প্রাপ্ত হইও না।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন —হে কৃষ্ণে! তুমি উত্তম কর্ম্মই স্থির করিয়াছ। কিন্তু রাজভবন বড় বিপৎসঙ্কুল স্থান, সাবধানে থাকিও, যেন কেহ তােমাকে অপমানিত না করিতে পারে।

 পরে সকলকে সম্বোধনপূর্ব্বক তিনি কহিতে লাগিলেন—

 আমরা কি ভাবে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া কোন্ কোন্ কর্ম্ম করিব তাহা ত স্থির হইল। এক্ষণে পুরোহিত ধৌম্য, আমাদের ভৃত্য ও দ্রৌপদীর পরিচারিকাগণ দ্রুপদরাজভবনে গমনপূর্ব্বক আমাদের অজ্ঞাতবাসাবসানের প্রতীক্ষা করুন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি সারথিগণ শূন্যরথ লইয়া সত্বর দ্বারকায় গমন করিয়া তথায় সেগুলি রক্ষা করুক। কেহ জিজ্ঞাসা করিলে সকলে কহিবেন যে, পাণ্ডবগণ আমাদিগকে দ্বৈতবনে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গিয়াছেন, আমরা তাহার কিছুই জানি না।

 পাণ্ডবগণ কেবলমাত্র অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করিয়া পাদচারে মৎস্য-রাজ্যাভিমুখে চলিতে লাগিলেন। কালিন্দী নদীর দক্ষিণ তীর অবলম্বনপূর্ব্বক কখনও গিরিদুর্গ কখনও বনদুর্গ আশ্রয় করিয়া পাঞ্চালদেশের উত্তর দিয়া ক্রমশ মৎস্যদেশে প্রবিষ্ট হইলেন। পথের অবস্থা ও চতুর্দ্দিক্‌স্থিত ক্ষেত্র দেখিয়া দ্রৌপদী বলিতে লাগিলেন—

 হে ধর্ম্মরাজ! স্পষ্টই বােধ হইতেছে যে এখনও বিরাটনগরী বহুদূরে; আমিও সাতিশয় পরিশ্রান্তা; অতএব আজ রাত্রি এখানেই অবস্থান করা যাক।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—হে অর্জ্জুন! তুমি যত্নসহকারে কৃষ্ণাকে বহন কর। যখন অরণ্যের আশ্রয় অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি, তখন একেবারে রাজধানীতে গিয়া অবস্থিতি করাই ভাল।

 তখন গজরাজবিক্রম অর্জ্জুন পাঞ্চালীকে গ্রহণ করিয়া দ্রুতপদসঞ্চারে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে বিরাট-রাজধানীর সমীপে অবতারিত করিলেন। অনন্তর নগরপ্রবেশের প্রণালীসম্বন্ধে সকলে পরামর্শ করিতে লাগিলেন।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে ভ্রাতৃগণ! আমরা যে সকল ছদ্মবেশ ধারণ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি, তাহাতে আমাদের সঙ্গে এই সকল অস্ত্রশস্ত্র লইলে চলিবে না, বিশেষতঃ অর্জ্জুনের গাণ্ডীব কাহারও অবিদিত নাই; অতএব এই এক বৎসর অজ্ঞাতবাসকালে আয়ুধগুলিকে কোন নিরাপদ স্থানে রক্ষা করিতে হইবে।

 অর্জ্জুন কহিলেন—মহারাজ! ঐ পর্ব্বতশৃঙ্গস্থ শ্মশানের সমীপবর্ত্তী এক দুরারােহ শমীবৃক্ষ দৃষ্ট হইতেছে। উহার শাখায় যদি উত্তমরূপে বস্ত্রাচ্ছাদিত করিয়া আমাদের শস্ত্রসকল রক্ষা করি, তবে তৎকালে কেহ আমাদের দেখিতে পাইবে এমন সম্ভাবনা নাই এবং ভবিষ্যতে যে কেহ ঐ স্থানে গমনাগমন করিবে তাহাও বোধ হয় না। অর্জ্জুনের কথায় সকলে তথায় আয়ুধসংস্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইয়া স্ব স্ব শরাসনের জ্যামোচনপূর্ব্বক তাহার সহিত তূণ খড়্গ এবং অন্যান্য অস্ত্রসমুদায় একত্র সঙ্কলিত করিয়া বস্ত্রের দ্বারা তাহা আচ্ছাদন করিলেন। অনন্তর নকুল সেই সমীবৃক্ষে আরােহণ করিয়া উপযুক্ত দৃঢ় এবং পল্লবাচ্ছাদিত শাখা নির্ব্বাচনপূর্ব্বক তাহাতে পাশদ্বারা সেই বস্ত্রমণ্ডিত অস্ত্রগুচ্ছ বন্ধন করিলেন। পরে স্থানীয় কৃষকাদির মধ্যে ‘ঐ বৃক্ষে মৃতদেহ বাঁধা আছে’ প্রচার করিয়া দেওয়ায় কেহই আর তাহার নিকট গমন করিত না।

 অনন্তর কৃষ্ণার সহিত পঞ্চভ্রাতা নগরে প্রবিষ্ট হইয়া প্রত্যেকে স্বীয় নির্ব্বাচিত ছদ্মবেশের উপযােগী বস্ত্র ও উপকরণ সংগ্রহ করিয়া রাজসভায় কর্ম্ম প্রার্থনায় একে একে উপস্থিত হইতে লাগিলেন।

 সর্ব্ব প্রথমে রাজা যুধিষ্ঠির শারিফলকবেষ্টিত কাঞ্চনময় অক্ষগুটিকাসকল কক্ষে ধারণপূর্ব্বক ব্রাহ্মণবেশে বিরাটভবনে উপস্থিত হইলেন। অচিরকাল মধ্যেই ভস্মাচ্ছন্ন বহ্নির ন্যায় দীপ্তিমান্ ধর্ম্মরাজের প্রতি বিরাটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। তিনি বিস্মিত হইয়া অন্যান্য সভাসদ্‌দিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন―

 হে সভ্যগণ! যিনি ব্রাহ্মণবেশে রাজার ন্যায় শােভা পাইতেছেন, ইনি কে? ইঁহার সহিত অনুচরবর্গ বা বাহনাদি কিছুই নাই, অথচ ইনি নৃপতির ন্যায় নির্ভীকচিত্তে আমাদের নিকট আগমন করিতেছেন।

 বিরাটরাজ এরূপ আলােচনা করিতেছেন, ইত্যবসরে যুধিষ্ঠির সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিলেন―

 মহারাজ! আমি ব্রাহ্মণ, দৈবদুর্ব্বিপাকে সর্ব্বস্বান্ত হইয়া আপনার নিকট জীবিকালাভার্থে আসিয়াছি, আপনি অনুমতি করিলে এই স্থানে অবস্থান করিয়া আপনার অভিলাষানুরূপ কার্য্য সম্পাদন করিব।

 বিরাটরাজ সাতিশয় প্রহৃষ্ট মনে কহিলেন―

 হে তাত! তোমাকে নমস্কার! তুমি কোন্ রাজ্য হইতে আগমন করিতেছ, তােমার নাম ও গােত্র কি এবং কোন্ শিল্প কার্য্যই বা অনুষ্ঠান করিয়া থাক?

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—মহারাজ! আমি ব্যাঘ্রপদী গােত্রসম্ভূত ব্রাহ্মণ, আমার নাম কঙ্ক। আমি পূর্ব্বে রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রিয়সখা ছিলাম, দ্যূতে আমার বিশেষ নিপুণতা আছে।

 বিরাট কহিলেন—দ্যূতদক্ষ ব্যক্তি আমার অতিশয় প্রিয়পাত্র; অতএব অদ্য হইতে তুমি আমারও সখা হইলে। তুমি কখনই হীন কর্ম্মের উপযুক্ত নহ; অতএব তুমি আমার সহিত সমানভাবে এ রাজ্য শাসন কর।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—আমার কেবল একটি প্রার্থনা এই আছে যে, আমাকে কোনো নীচ বা কপটাচারী ব্যক্তির সহিত ক্রীড়া না করিতে হয়।

 বিরাট ইহাতে সম্মত হইয়া কহিলেন―

 তোমার সহিত যে কেহ অন্যায় ব্যবহার করিবে, তাহাকে আমি অবশ্যই উপযুক্ত দণ্ড দিব। পুরবাসিগণ শ্রবণ করুক, অদ্য হইতে এ রাজ্যে আমারই ন্যায় তােমার প্রভুতা রহিল।

 যুধিষ্ঠির এইরূপ সমাদরসহকারে কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া পরম সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর ভমিবল ভীমসেন কৃষ্ণবস্ত্র পরিধান করিয়া কৃষ্ণ ছুরিকা ও পাককার্য্যোপযােগী সামগ্রী হস্তে ধারণপূর্ব্বক আগমন করিলেন। মৎস্যরা তাঁহাকে সমাগত দেখিয়া কহিতে লাগিলেন—

 এই উন্নতস্কন্ধ রূপবান্ অদৃষ্টপূর্ব্ব যুবাপুরুষ কে? উহার অভিলাষ কি, কেহ শীঘ্র গিয়া জানিয়া আইস।

 এই রূপ আদিষ্ট হইয়া সভাসদ্‌গণ সত্বর ভীমসেন-সমীপে উপস্থিত হইয়া রাজার আদেশানুরূপ জিজ্ঞাসা করিল। তখন ভীমসেন তাঁহার সজ্জার উপযােগী দীনভাবে রাজার সম্মুখে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন―

 আমি উত্তম ব্যঞ্জনকার সুদ, আমার নাম বল্লভ। আমাকে সূপকারের কর্ম্ম নির্ব্বাহার্থে আপনি গ্রহণ করুন।

 বিরাট বলিলেন―হে সৌম্য। তোমাকে সামান্য সূপকার বলিয়া কিছুতেই বিশ্বাস হইতেছে না। তোমার যেরূপ ও বিক্রম দৃষ্ট হইতেছে, তাহাতে তোমাকে নরেন্দ্র হইবার উপযুক্ত বলিয়া বোধ হয়।

 ভীম বলিলেন―হে বিরাটেশ্বর। পূর্ব্বে আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের কর্ম্মে নিযুক্ত থাকিয়া আমার প্রস্তুত ব্যঞ্জনদ্বারা তাঁহার বিশেষ তৃপ্তিসাধন করিতাম। তাহা ছাড়া আমি বাহুযুদ্ধে সুশিক্ষিত; অতএব আমি নিশ্চয়ই আপনার প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিতে পারিব।

 বিরাট কহিলেন―বল্লভ! তোমাকে এ কর্ম্মের অনুপযুক্ত বোধ করিলেও আমি তোমার অভিলাষ পূর্ণ করিব। তোমাকে আমার মহানসের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য দিলাম।

 ভীমও এইরূপে নৃপতির সাতিশয় প্রীতিভাজন হইয়া অভিলষিত কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন। কেহই তাঁহার প্রকৃত পরিচয়ের সন্দেহমাত্র করে নাই।

 অনন্তর অসিতলোচনা দ্রৌপদী সুদীর্ঘ ও সুকোমল কেশপাশ বেণীরূপে বন্ধন ও একমাত্র মলিন বসন পরিধান করিয়া সৈরিন্ধ্রীর ন্যায় দীনভাবে রাজভবনে গমন করিতে লাগিলেন। নাগরিক পুরুষ ও স্ত্রীলোকগণ তাঁহার অসাধারণ সৌন্দর্য্য দেখিয়া কৌতূহলীচিত্তে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল―

 তুমি কে, কোথায় যাইবে, তোমার অভিলাষ কি? দ্রোপদী সকলকে কহিলেন—

 আমি সৈরিন্ধ্রী, আমাকে কেহ কার্য্যে নিযুক্ত করিলে আমি তাহা সুচারুরূপে সম্পন্ন করিব।

 বিরাটমহিষী সুদেষ্ণা প্রাসাদের উপর হইতে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন, ইত্যবসরে অনাথার ন্যায় দীনবসনা অথচ অমানুষরূপধারিণী দ্রৌপদী তাঁহার নয়নগোচর হইলেন।

 সুদেষ্ণা তাঁহাকে নিকটে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন—

 ভদ্রে! তুমি কে এবং অভিলাষই বা কি?

 দ্রৌপদী পূর্ব্ববৎ সৈরিন্ধ্রীর কর্ম্মপ্রার্থনা জ্ঞাপন করিলেন। তখন রাণী কহিলেন—

 হে ভাবিনি! আমি তোমাকে সখীরূপে লাভ করিয়া পরম প্রীত হইতাম, কিন্তু তোমার যেরূপ সৌন্দর্য্য তাহাতে ভয় হয়, পাছে রাজপুরুষগণ তোমার নিমিত্ত চঞ্চল হইয়া কোন অনিষ্ট ঘটায়।

 দ্রৌপদী কহিলেন—হে মহিষি! আমি প্রবল প্রতাপান্বিত গন্ধর্ব্বের পত্নী; অতএব আমাকে কেহ অপমান করিতে সক্ষম হইবে না; কারণ ইহা জ্ঞাত হইলে কোন্ রাজপুরুষ আমার সম্বন্ধে অযথা ভাব মনে পোষণ করিতে সাহসী হইবেন? অতএব আপনি নির্ভয়ে আমাকে আশ্রয় প্রদান করিতে পারেন, আমি পূর্ব্বে যদুকুলশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের মহিষী সত্যভামা এবং কুরুকুলসুন্দরী দ্রুপদনন্দিনীর নিকট নিযুক্ত ছিলাম। আমি কেশসংস্কার, বিলেপন পেষণ এবং নানাজাতীয় পুষ্পের মালা গ্রন্থন কার্য্যে নিপুণ। তবে আমার এই প্রার্থনা যে, উচ্ছিষ্টস্পর্শ বা পাদপ্রক্ষালন কার্য্য যেন আমাকে না করিতে হয়।

 রাণী―তথাস্তু!—বলিয়া তাঁহাকে উপযুক্ত বসনভূষণ প্রদানপূর্ব্বক স্বীয় ভবনে আশ্রয় প্রদান করিলেন।

 অনন্তর সহদেব অনুত্তম গোপবেশ ধারণ ও গোপভাষা অভ্যাস করিয়া বিরাটের নিকট উপস্থিত হইয়া রাভবনসমীপবর্ত্তী গোষ্ঠের নিকট দণ্ডায়মান রহিলেন। রাজা তাঁহার বেশ ও মুখশ্রীর সম্পূর্ণ বৈষম্য লক্ষ্য করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া তাঁহাকে আহ্বানপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন―

 হে তাত! আমি পূর্ব্বে কখনও তােমাকে দেখি নাই, তুমি কাহার পুত্র, কোথা হইতেই বা আসিলে, আমায় সবিশেষ জ্ঞাপন কর।

 সহদেব বলিলেন―আমি বৈশ্য, লোকে আমাকে তন্ত্রিপাল বলিয়া সম্বোধন করে। আমি পূর্ব্বে রাজা যুধিষ্ঠিরের গােসকলের তত্ত্বাবধারণ করিতাম, এক্ষণে আপনার নিকট সেই কর্ম্মের প্রার্থী আছি।

 বিরাট সহদেবের সৌম্যমূর্তি দর্শনে অতিশয় প্রীত হইয়া বলিলেন―

 তুমি অদ্যাবধি আমার সমুদয় পশুশালার কর্ত্তৃত্ব প্রাপ্ত হইলে।

 এবং তাঁহাকে অভিলষিত বেতন প্রদানের আজ্ঞা করিয়া দিলেন। সহদেব এইরূপে সমাদরে গৃহীত হইয়া সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর বলিষ্ঠ দেহ উন্নতকায় অর্জ্জুন নর্ত্তকের ন্যায় স্ত্রীবেশ পরিধান করিয়া কর্ণে কুণ্ডল, মস্তকে সুদীর্ঘ কেশকলাপ ও হস্তে শঙ্খ ও বলয় ধারণপূর্ব্বক বিরাট রাজের সভামণ্ডপে উপস্থিত হইলেন। রাজা সেই তেজঃপুঞ্জ মূর্ত্তির অতীব অসঙ্গত নারীবেশ দেখিয়া সভ্যগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—

 এই ব্যক্তি কে, ইনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আমি ত পূর্ব্বে এরূপ মূর্ত্তি কখনও দেখি নাই।

 সভ্যগণ বলিল―

 ইনি কে আমরা তো কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।

 ক্রমে অর্জ্জুন নিকটে উপস্থিত হইলে বিরাট জিজ্ঞাসা করিলেন—

 তোমার পুরুষসদৃশ বিক্রম ও স্ত্রীসদৃশ বেশভূষা দেখিয়া আমরা বিস্মিত হইতেছি। তুমি আত্মপরিচয় প্রদান কর।

 অর্জ্জুন কহিলেন—মহারাজ! আমার নাম বৃহন্নলা, রাজা যুধিষ্ঠিরের অন্তঃপুরে নৃত্যগীতাদিদ্বারা মহিলাগণের চিত্তরঞ্জন ও তদ্বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করিতাম। এবিষয়ে আমি অতিশয় দক্ষ; অতএব পিতৃমাতৃহীন আমাকে আপনার পুত্র বা কন্যা জ্ঞান করিয়া রাজকুমারী উত্তরার শিক্ষার নিমিত্ত নিযুক্ত করুন।

 বিরাট কহিলেন―হে বৃহন্নলে! তুমি আমার কন্যা উত্তরা ও অন্যান্য পুরমহিলাগণকে নৃত্য গীতাদি বিষয়ে সুনিপুণ কর, তাহাতে আমার বিলক্ষণ প্রীতিসাধন হইবে। তবে তােমার যেরূপ তেজ ও দীপ্তি প্রকাশ পাইতেছে,তাহাতে এ কার্য্য তােমার নিতান্ত অনুপযুক্ত বিবেচনা হইতেছে।

 রাজার অনুমতি অনুসারে অর্জ্জুন অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্ব্বক রাজমহিলাগণের শিক্ষাকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। রাজকুমারী তাঁহাকে পিতার ন্যায় মান্য করিতেন, ক্রমশ তিনি সকলেরই অতিশয় প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন। পুরুষদের সহিত অর্জ্জুনের সাক্ষাৎ হইত না; সুতরাং উঁহার পরিচিত হইবারও কোন আশঙ্কা রহিল না।

 পরিশেষে নকুল একদিন অশ্বশালার বাজিসকল নিরীক্ষণ করিতেছেন, এমন সময় তাঁহার অসাধারণ কান্তি রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তিনি তাঁহাকে সুবিচক্ষণ হয়-তত্ত্ববেত্তা অনুমান করিয়া অনুচরগণকে আদেশ করিলেন—

 ঐ দীপ্তিমান্ পুরুষকে আমার সমক্ষে আনয়ন কর।

 রাজাদেশ জ্ঞাত হইবামাত্র নকুল নিকটে আসিয়া কহিলেন—

 মহারাজের জয় হৌক্! আমি একজন প্রসিদ্ধ অশ্বতত্ত্ববিৎ আমাকে সকলে গ্রন্থিক বলিয়া ডাকে, পুর্ব্বে রাজা যুধিষ্ঠিরের অশ্বশালায় নিযুক্ত ছিলাম, এক্ষণে আপনার নিকট অশ্বপালের কর্ম্ম প্রার্থনা করি। আমি অশ্বগণের প্রকৃতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা বিশেষরূপে অবগত আছি।

 বিরাট কহিলেন—তুমি আমার অশ্বপাল হইবার অতিশয় উপযুক্ত পাত্র; অতএব সমগ্র যানবাহনাদি অদ্য হইতে তোমার অধীনে রহিল।

 এইরূপে একে একে পাণ্ডবগণ সকলেই অভিলষিত কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া সম্পূর্ণ অজ্ঞাতভাবে বিরাটভবনে বাস করিতে লাগিলেন।

 মহর্ষি বৃহদশ্বের শিক্ষাপ্রভাবে যুধিষ্ঠিরের বিলক্ষণ অক্ষনৈপুণ্য হওয়ায় তিনি রাজপুরুষগণের নিকট হইতে ক্রীড়াদ্বারা স্বেচ্ছানুসারে বিপুল ধন জয় করিয়া ভ্রাতাদের প্রদান করিতেন। ভীমসেন রাজ-মহানসে প্রাপ্ত বিবিধ উত্তম ব্যঞ্জনদ্বারা সকলের তৃপ্তিসাধন করিতেন। অর্জ্জুন অন্তঃপুরলব্ধ পারিতোষিকদ্বারাও যথেষ্ট উপার্জ্জন করিতেন। সহদেব দধি দুগ্ধ ঘৃতাদি এবং নকুল রাজপ্রসাদাৎ প্রাপ্ত অর্থদ্বারা সকলেরই ভােগসুখের উপকরণ যােগাইতেন।

 পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের চতুর্থ মাসে মৎস্যনগরে সুসমৃদ্ধ মহোৎসব আরম্ভ হইল। তৎকালে মহাকায় অসুরসন্নিভ মল্লগণ চতুর্দ্দিক্ হইতে স্ব স্ব বলদর্শন ও পরীক্ষার্ধে উপস্থিত হইল। তন্মধ্যে একজন সর্ব্বপ্রধান ব্যক্তি সকলকে পরাজয় করিয়া রঙ্গমধ্যে আস্ফালনপূর্ব্বক সকলকে বারম্বার আহ্বান করিতে লাগিল, কিন্তু কেহই তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে আর সাহস করিল না।

 তখন মৎস্যরাজ ভীমের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে আদেশ করিলেন। পাছে বাহুবলে তিনি আত্মপরিচয় প্রদান করিয়া ফেলেন, এই ভয়ে ভীমসেন অতিশয় অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজাজ্ঞা অমান্য করা অবিধেয় বিবেচনা করিয়া অগত্যা বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।

 প্রথমত বিরাটকে বন্দনা করিয়া তিনি ধীরে ধীরে রঙ্গে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার বলিষ্ঠ দেহ দেখিয়া সকলেই হৃষ্ট হইল। পরে তিনি বিখ্যাতরিক্রম সেই জীমূতনামা মল্লকে আহ্বান করিলেন। তখন উভয় বীরের ঘোরতর সংগ্রাম বাধিয়া গেল।

 তাঁহারা পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণ-তৎপর হইয়া কখনও সাংঘাতিক বাহু প্রহার, কখনও মুষ্ট্যাঘাত, কখনও নিদারুণ পদাঘাত, কখনও বা মস্তকে মস্তকে সংঘটনপূর্ব্বক ভীষণ শব্দ উৎপাদন করিতে লাগিলেন। অনন্তর বলিশ্রেষ্ঠ ভীমসেন সেই তর্জ্জন গর্জ্জনকারী মল্লকে সহসা আয়ত্তের মধ্যে প্রাপ্ত হইয়া তাহাকে বলপূর্ব্বক উৎক্ষিপ্ত করিয়া ভূতলে নিক্ষেপ পূর্ব্বক নিষ্পিষ্ট করিলেন।

 লোকবিশ্রুত জীমূতকে পরাজিত করায় ভীমসেনের সমাদরের আর সীমা রহিল না। তদবধি রাজা সর্ব্বদাই সিংহব্যাঘ্রাদি হিংস্রজন্তুর সহিত ভীমসেনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করাইয়া তাহা পরম কৌতুকে অবলোকন করিতেন।