ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু/আলোছায়া
আলোছায়া
তারা ছিল দুটি বোন, সুজাতা ও সুদর্শনা। আনন্দনাথের পিঠাপিঠি দুটি মেয়ে। বয়সে দুজন অবশ্য যমজ নয়, চেহারাতে এবং স্বভাবেও দুজনকার মধ্যে বিলক্ষণ প্রভেদ, অথচ দুই বোনে বাহিরে প্রভেদ যাই থাক, অন্তরে তারা এক আত্মা, এক প্রাণ। ‘দুই শরীরে একই মন’—একেই বলা হয়। বড় বোন সুজাতা শান্ত স্নিগ্ধ কোমল প্রকৃতি, চেহারাতেও তার সেই অন্তররূপের অভাব সুপরিস্ফুট। এমন মিষ্ট মধুর হাস্যমুখী মেয়ের কদাচিৎ দেখা মেলে। জলধৌত চিক্কণ নব-পত্রিকার মত বর্ণশ্রী, চোখে বুদ্ধিমত্তার ও উজ্জ্বলতার সঙ্গে লজ্জাকুণ্ঠার মৃদুভাব, স্বল্পভাষিণী অথচ বাক্যবিন্যাসে সুনিপুণা, যে কেহ এর সংস্পর্শে আসে একে মায়া না করিয়া পারে না। পড়াশোনা সযত্নেই করে, কত অল্প বয়সে বাংলা, সংস্কৃত কত ভাল রূপেই আয়ত্ত করিয়াছে,—পরীক্ষা লইলে আশ্চর্য্য হইয়া যাইতে হয়, অথচ তাহাকে দেখিলে কার সাধ্য বাহির হইতে তার বিদ্যাবত্তা বুঝিতে পারে। ছোট ছোট খণ্ড খণ্ড কবিতাও সে এই বয়সে লিখিতে পারে; তবে সে-সব কবিতার এখনও একটি মাত্র পাঠিকা ব্যতীত দুটি নাই।
ছোট বোনের নাম সুদর্শনা। নামটি যতই জমকালো, মেয়েটির রূপ অবশ্য ততটা অনিন্দিত নয়, বরং প্রবীণা মহল বড়বোনের সঙ্গে তুলনা করিয়া এর রোগা লম্বা গড়নকে একটু নিন্দার চোখেই দেখিতেন। “দিন দিন মেয়ে হচ্ছেন যেন একটি তালপাতার সিপাই!”—এই রকম সব সমালোচনা মধ্যে মধ্যে উঠিয়াও পড়ে। অবশ্য মেয়ের দিদি বা তার পিতামহ—দাদুর সামনে এ কথাটা বুদ্ধিমতীরা সহজে উচ্চারণ করেন না; যেহেতু বোনের নিন্দা শুনিলে সুজাতা তার শান্তস্বভাবের জন্য মুখে বেশি প্রতিবাদ করিতে না পারিলেও মুখখানা নীচু করিয়া থাকে, দুটি শান্ত চোখে তার জল ভরিয়া উঠে, সুবিধা থাকিলে হঠাৎ উঠিয়া সরিয়াও যায়। বেশি কড়া মনে হইলে সুদর্শনাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাকে পরম স্নেহে দুহাতে জড়াইয়া ধরে, একটা ছল করিয়া বলে, “বেঁটে মানুষ আমার দ্বারা তো হবে না, আলমারির মাথা থেকে ঐ টুলটায় চড়ে দেখতো পাখা আছে কিনা”,—নয়তো বলে,—“সূর্যমুখী ফুলগুলি কত উচুতে ফুটেছে দেখ! পেড়ে আনতো, ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখি।”—অর্থাৎ এইরকম করিয়া সে নিন্দাকারীকে না হোক নিজের মনকে, বুঝাইতে চাহিত ‘যে যা’ বলিতে হয় বলুক, আমি ওদের কথা মানিনে, লম্বা হওয়ার সংসারে কত দরকার, কত যে ওরা কাজে লাগে।”
সুদর্শনার রং তার দিদির চাইতে কিছু ফর্সা, খুঁটিয়া দেখিলে নাকে চোখেও কিছু হয়ত শ্রেষ্ঠ হইতে পারে, কিন্তু তার বড় বড় কাল চোখের মধ্যে মাঝে মাঝে কালো মেঘের ভিতরকার বিদ্যুৎ ঝলক মারে, উন্নত নাসারন্ধ্র সঘনে স্ফুরিত হয়, কাল-বৈশাখীর ঝড়-ঝাপ্টাও কদাচিৎ উঠিয়া পড়িতে বাধে না। আগুনের একটা লকলকে শিখার মতই সে যেন দর্পিতা। এতটুকু অবহেলা বা উপহাস তার প্রাণে সয় না, অতি সহজেই সে ফাটিয়া পড়ে, বিশেষ অন্যায় দেখিলে।
অথচ এই বিপরীত-ধর্ম্মী বোন দুটির মধ্যে এতখানি মনের মিল প্রাণের সংযোগ কদাচিৎ দেখা যায়, অথবা দেখা যায় না।
সুদর্শনার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ। ছোটবেলায় রুগ্ন ছিল বলিয়া বিদ্যাভ্যাসটা তার কিছু বিলম্বিত হইয়াছিল। কিন্তু দিদির কৃপায় নিরক্ষরা ছোট বোন দিদির অধীত বিদ্যার সারভাগ আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিল। রামায়ণ-মহাভারতের, কামিনী রায়ের, মানকুমারীর অনেক কবিতাই সে দিদির পড়া শুনিয়া শুনিয়া কণ্ঠস্থ করিয়া ফেলিয়াছিল। যখন তখন বড় বড় কবিতা সে যত্র-তত্র ‘রিসাইট’ করিয়া বেড়াইত। সে যে পড়িতে পারে না, সহজে সেটা ধরিবার উপায় ছিল না।
দুই
সুদুর পশ্চিমের ট্রেনরাস্তা হইতে অনেকখানি ভিতরে সব্-ডিভিসন অফিসারের সুদৃশ্য বাংলোর তিন দিক বেড়িয়া খোলা মাঠ। একদিকে একটি সুরচিত ফুল-বাগান। এঁদের এখানে আসিবার পূর্ব্বে একজন কম বয়সী ইংরেজ রাজকর্ম্মচারী এ বাড়ীতে ছিলেন। ওদের রুচি প্রবৃত্তি, একটু বেশ সৌখীনত্বের দিকে স্বতঃই থাকে, তার আমলে বাগানটি বেশ ভালরূপেই যে যত্ন সেবা লাভ করিয়াছিল তা দেখা যায়। কেয়ারি-করা ভাল ভাল গোলাপ ফুলের গাছে অসংখ্য জাতের গোলাপ ফুটিয়া নিত্যই,—বাগানকেই শুধু নয়, বাংলো-নিবাসী এবং অদূরবর্ত্তী পথের পথিকদেরও নয়ন-মন-লোভন হইয়া থাকে। যেসব বিষয়ে ত্রুটি ছিল, বোটানির নামজাদা ছাত্র আনন্দনাথ সে সব নিরাকরণ করিয়া দিয়া তাহাকে একটি আদর্শ গোলাপ বাগিচা বানাইয়াছেন। মালির সঙ্গে সঙ্গে এদের পরিচর্য্যা তিনি স্বহস্তে করিতেন, সঙ্গী হইত তাঁর মেয়ে দুটি। এমন করিয়া নিতান্ত ছোট বেলা হইতেই বাহ্য প্রকৃতির পরিবেশে তাদের দুজনকারই অন্তঃ প্রকৃতিতেও বাপের মত সৌন্দর্য্যানুভূতি ও সৌন্দর্য্য উপভোগ-স্পৃহা বর্দ্ধিত হইতেছিল। যাকে বলে ‘অবস্তুতান্ত্রিক’ বা ভাবুকতা, রক্ত দিয়া এবং শিক্ষা সাহচর্য্য দিয়া তাহারই পত্তন এদের মধ্যে আবাল্য হইয়া গিয়াছে, তাছাড়া এটা কতকটা এদের বংশগতই বলা যায়। সোনা-দানার চাইতে এরা ফুল ভালবাসে, ফুলের মালা গাঁথা এদের মস্ত বড় ক্রীড়া-বিলাস! জাপানী মেয়েদের মধ্যে যেমন শোনা যায় নানা সাজে তারা নিয়মিতরূপে ফুল সাজায়— ফুল পরে—এরাও তেমনি পুষ্প চয়ন, পুষ্প বিন্যাস, পুষ্পালঙ্কারে ভূষিত হইতে পারিলে কৃতার্থ হয়। সোনার মাকড়ী বালা হার দিনে দু’বার মায়ের কাছে জমা রাখিতে ছোটে, মা বিরক্ত হইলে বলে, “কি করবো, ও যে রঙ্গন ফুলের মালার সঙ্গে মিল খাচ্ছে না, কানে দেখ না কি রকম তারে গেঁথে চুনির মতন রঙ্গন-কুঁড়ির কুণ্ডল পরেছি।”
মাও তাদের অপূর্ব্ব শিল্পী, ভাবপ্রবণতায় তিনিও কারও চাইতে কম যান না, চাহিয়া দেখিয়া মুখটা একটু প্রফুল্ল করেন, কিছু না বলিলেও মুখের ভাবে স্পষ্ট ফুটিয়া ওঠে, “তা বড় মিথ্যা বলিসনি, যা হোক তোদের রুচিটা তাহলে গড়ে দিতে পেরেছি।”
সুজাতার জন্য নয়, সুদর্শনার জন্যই তাঁর মনে একটা ভয়-ভাবনা ছিল, পুত্র-সন্তান বিলম্বে আসার জন্য কোলের মেয়েটিকে অনেকদিন পর্য্যন্ত ছেলের সাজে সজ্জিত রাখিয়াছিলেন, সে সেই দাবীটা কিছুতেই ছাড়িতে রাজী হয় নাই, আকাশ নীলের রেশমী ফ্রক, গোলাপী, লাল, ধপধপে সাদা আদ্ধির সৌখীন কাটের কত সাধের তৈরী করানো ফ্রক মেয়ে কিছুতে পরিতে রাজী হয় নাই। যেদিন তার ভাই জন্মিল, সে নিজেই উপযাচক হইয়া সেদিন কিন্তু তার দিদিকে আসিয়া বলিল, “খোকা বড় হয়ে পরবে, ওসব— এবার তোলা থাক, আমি মায়ের দেওয়া ঐ ঘাঘরাগুলোই পরি তাহলে, কেমন?”
মহা খুসী হইয়া দিদি তাকে সাজাইতে বসিল, কিন্তু চুল তখনও তো ছোট করিয়াই কাটা, রিবন বাঁধা আর ঘটিল না, এই বিপত্তির সম্ভাবনাতেই দূরদর্শিনী মায়ের পূর্ব্বাহ্ণেই তৈরী-রাখা রং-মিলানো লেশদার কুঁচিদার টুপিগুলা অগত্যা কাজে লাগিল। সাজগোজ সমাধা করিয়া দিয়া হাসি-হাসি মুখে অতৃপ্ত-নেত্রে বোনটিকে নিরীক্ষণ করিয়া যেন আশ মিটিতে ছিল না, পুলকে গদগদ হইয়া সুজাতা তার গাল টিপিয়া দিয়া বলিয়া উঠিল, “কি সুন্দর যে দেখাচ্ছে তোকে”—
“কই দেখি”—বলিয়া সুদর্শনা আর্সির সামনে ছুটিয়া গেল, এক লহমার দৃষ্টি বুলাইয়াই সে উগ্র তীব্রকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, “সুন্দর কই! ছাই, ছাই! দিদি! তুমি মিথ্যে কথা বল্লে কেন?”
সুজাতা কলস্বরে হাসিয়া উঠিল, “তুই একটি হনুমান! পছন্দ বলে কিছু নেই তোর, যাঃ।”
দিদি যখন তাকে বড় কথা বলিয়াছে, অর্থাৎ ‘হনুমান’ তখন সেটাকে নেহাৎ মারাত্মক গালি দেওয়াই হইয়াছে, অতএব এর পর আর এ নিয়ে গণ্ডগোল করা চলেনা। অথচ মা বলিলে সে এক বিরাট ব্যাপার হইতে পারিত।
এখন সুদর্শনার খাটো চুলে চিমটি কাটিয়া রিবন বাঁধা সুজাতার কাজের মত কাজ জুটিয়াছে—প্রত্যহ বিভিন্ন রং-এর বিভিন্ন ছবি। তবে টুপিটাকে বেড়াইতে বাহির হইবার সময় দু’বেলাই হাতে করিতে হয়। অবশ্য বেশীর ভাগ সুজাতাই করে, তারই গরজ, যেহেতু এটুকু চুল খুব বেশী ক্ষণ রিবনের দায়িত্ব বহন করিতে সমর্থ হয় না— পথের মধ্যেই খুলিয়া পড়ে। কত না হারাইত, যদি না পাহারা দিতে সঙ্গে থাকিত দিদি।
এহেন সুদর্শনা দেবীর যদি একটু একটু সুরুচি বোধ জন্মিতে থাকে, কলিকাতার বড়ঘরের মেয়ে মিস নিগট্ এবং পরে শ্বশুরালয়ে মিস রেক্সের ছাত্রী, ঠাকুরবাড়ীর সভ্যতার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিতা নবীনা জননীর মধ্যে কতটা নিরাপত্তা বোধ কি করিয়া না জন্মিবে? দূর পশ্চিমে নাগরিক আবহাওয়ার বাহিরে বর্দ্ধিত হওয়া মেয়েটি কি শেষে একটি ধাঙ্গড় বা সং তৈরি হইবে নাকি?
তিন
কেন্দ্রস্থ-সূর্য্যকে বেষ্টন করিয়া যেমন সৌরজগৎ নিয়ন্ত্রিত হইতেছে, আনন্দনাথের পিতৃদেব দেশবিখ্যাত মহামনীষী পৃথ্বীদেবকেও তাঁহার পরিবারের সৌরপতি বলিলে অত্যুক্তি হয় না। মহাদেবের মত ধবলকান্তি, উন্নত শরীর, অপুর্ব্বদর্শন, হাস্যম্মিত প্রসন্ন মুখ প্রবরকে দর্শন করিলে স্বতই দর্শকের চিত্ত শ্রদ্ধার ভারে নত হইয়া পড়িতে বাধ্য। একদা সংযুক্ত বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলি ইঁহারই হস্তে নিয়ন্ত্রিত হইয়াছিল। তখনকার দিনের সম্রাটতুল্য ছােট লাটদের মধ্যে কেহ কেহ এঁর সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কোন গুরুতর কার্য্যের মীমাংসা করিতেন না, ইংরাজ উচ্চ রাজপুরুষ মাত্রেই এঁকে একটু বিশেষরূপ সম্মান করিয়া চলিতেন। সে-সব দিনে অনেক বড়-ঘরানা ইংরাজ এদেশে আসিতেন, বড় বড় পণ্ডিতও তখন সিবিল সার্ভিস চাকুরীতে নিতান্ত সংখ্যাল্প থাকিতেন না, তাঁরা পৃথ্বীদেবের সহিত পরিচিত হইবার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সুযােগ সন্ধান করিতেন, পরিচিত হইতে পারিলে সম্মানিত বােধ করিতেন। আনন্দনাথের উপরওয়ালা সাহেব যিনি যখনই আসিয়াছেন, নিজে তাঁর বাড়ী আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ভুল করেন নাই। ভিজিট রিটার্ণের সময় সুদর্শনা তার দাদুর সঙ্গে প্রায়ই থাকিত। আলাের পিছনে ছায়ার মতই সে দাদুর অনুগামিনী। বড় কঠিন দীর্ঘকালব্যাপী রােগ ভােগ করিয়া প্রায় মৃত্যুদ্বার-সমাসীন হইয়াও সে বহু চিকিৎসা এবং অসম্ভব যত্ন সেবায় পুনর্জন্ম পাইয়াছে বলিয়াই হয়ত সকলের কাছেই আদরটা একটুখানি তার বেশী হইয়া পড়িয়াছিল। তবে এ পরিবারের সে “আদর” দেওয়া ছিল না—যে আদরে বাড়ীর মেয়েরা “জল ঘটিটি গড়িয়ে খায়নি” বলে আদিখ্যেতা করা যায়! এদিকে যতই আদব করা হোক না, ডিসিপ্লিন না মানিয়া স্বেচ্ছাস্বতন্ত্রতা করা এখানে চলে না, বরং বেশী কাছে থাকার জন্য ফাইফরমাস খাটা, মুখে মুখে কাহিনী, কিংবদন্তী, ইতিহাস, ভূগোল, পুরাণ, উপপুরাণ, কথা কাহিনী দুষ্পাঠ্য শোনা ও শেখা ইত্যাদিতে শরীর ও মনকে বেশী দুষ্পাঠ্য খাটাইতে হয়। সুজাতা এই বয়সেই বাংলা শেষ করিয়া দুষ্পাঠ্য দাদুর কাছে পাঠ দুষ্পাঠ্য কান দুষ্পাঠ্য কিছু মুখস্থও করিয়াছে। সকালে উঠিয়া দুষ্পাঠ্য হইয়া দেবদেবীর প্রণাম এবং ছোট ছোট নীতি-শ্লোক প্রত্যহ দাদুর কাছে বলিবার নিয়ম দাদু করিয়া দিলেন। এ ব্যবস্থা উত্তরকালে এ পরিবারে স্থায়ী হইয়া গিয়াছিল। সমস্ত ছেলেমেয়েরা একত্র হইয়া প্রত্যুষে পিতামহরূপী পিতামহকে বেড়িয়া (মাতামহও বটে), দেবশিশুদের মত অথবা কোন আরণ্যক মহর্ষীব সাক্ষাতে ঋষিবালকবর্গের সামগানের মত সমস্বরে বহু স্তব-স্তোত্র পাঠান্তে স্বদেশী সঙ্গীত করিয়া দেশের মঙ্গল কামনা জানাইয়া দিবসারম্ভ করিত। সে যুগে “বাজ রে শিঙ্গা বাজ এই রবে”, “কতকাল পরে বল ভারত রে”—ইত্যাদি গানই চালু ছিল। এব বহু পরবর্ত্তী কালে প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছিল—
“অবনত ভারত চাহে তোমারে,
এস সুদর্শনধারী মুরারি!
নবীন তন্ত্রে, নবীন মন্ত্রে,
কর দীক্ষিত নিপীড়িত ভারত তোমারি।
মঙ্গল ভৈরব শঙ্খ নিনাদে,
বিচূর্ণ কর সব ভেদ বিবাদে,
নব আশে হিন্দুস্থান ধরুক নূতনতর তান,
এস হৃদি-শোণিতে মেদিনী রঞ্জিতে,
নববেশে ভীষণ অসিধারী,
এস ভারত-পাশ-নাশকারী।”
এই অপূর্ব্ব উন্মাদনাকারী মহান সঙ্গীতের রচয়িতার পরিচয় জানা যায় নাই, তবে এখন অবশ্য এই স্বাধীন ভারতে না জানার আর কোন কারণ নাই।
পিতা-পুত্র উভয়েই বলিতেন: ডাকের মত ডাক যদি সমস্ত ভারতবাসী মিলে ডাকতে পারে, তবে কি না এসে তিনি থাকতে পারবেন! নিশ্চয়ই ভারতের ‘পাপ’ নষ্ট করতে তাঁকে আসতেই হবে। তিনি নিজেই যে বলেছেন:
“যদা যদাহি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারতঃ
অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহং
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।”
তাই তাঁকে আহ্বান-সঙ্গীত জানান এবাড়ীতে অর্দ্ধ শতাব্দীরও পূর্ব্ব হইতেই নিয়ন্ত্রিত করা হইয়াছিল, কল্কীরূপী যুগাবতারের ধ্যান প্রণাম মন্ত্রও প্রত্যহ শিশুচিত্ত হইতে পূজাভাবে উচ্চারিত হইত:
‘সজল জলদ দেহ বাত বেগৈকবাহো,
কবধৃত কব্বাল, সর্ব্বললাকৈকপালঃ
কলিকুল বনহন্তা সত্যধর্ম্ম প্রণেতা,
কলয়তি কুশলং বঃ কল্কীরূপংস্বভুপঃ’।
দুই পুরুষ ধরিয়া পৃথীদেবই যে বাংলাদেশে সর্ব্বপ্রথম স্বদেশী মন্ত্রের বীজ বপন করেন, এ কথা আজ চাপা পড়িতে বসিয়াছে। ‘প্রোপাগাণ্ডার’ অভাবে হিন্দু সমাজ এখন ঘোর তামসিক আলস্যের সমাজ। ব্রাহ্ম সমাজ প্রভৃতিতে তবু কতকটা রজোগুণের আধিক্য আছে, নিজ সমাজের লােককে তাঁরা বিশ্বে সম্মানিত করিতে চান, হিন্দু সমাজের একটি আত্ম-প্রতারণাত্মক শব্দ আছে, “ধৃষ্টতায় উপেক্ষা,” ব্যস্! কিন্তু এ ধৃষ্টতা কাহাদের? সত্যকে ইচ্ছা করিয়া যারা অপ্রকাশ রাখে তাদের নয়?
সাহিত্যে, সমাজে, স্বাদেশিকতার প্রথম পরিকল্পনায় বাংলাদেশ পৃথ্বীদেবের নিকটে অপূরণীয় ঋণে আবদ্ধ, ভবিষ্যতের ইতিহাসকার যদি সত্যানুসন্ধিৎসু হন তবে অকুণ্ঠিত শ্রদ্ধায় একথা স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেনই, যতদিন কোন সত্য-দ্রষ্টা প্রকৃত ঐতিহাসিকের উদ্ভব না হইতেছে ততদিন এ সত্য অবশ্য গােপনই থাকিবে।
সুদর্শনারা যেদিনে সদ্য-চিত্রিতা ভারত মাতার মূর্ত্তির উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করিত, তখন “বন্দে মাতরম” জন্মগ্রহণ করে নাই, তখন তার পূর্ব্বরূপ পৃথ্বীদেবের রচিত সংস্কৃত শ্লোকের মূর্ত্তিতে প্রকট ছিল, সে এই:—
“মাতর্নমামি সততং সতীদেহরূপাং,
মাতর্নমামি বসুধাতল পুণ্যতীর্থাং,
মাতর্নমামি পদযুগ্মধৃতা সমুদ্রাং
মাতর্নমামি হিমগৌর কিরিটিভূষাং।
চার
জীবনের সবচেয়ে মধুর মধুরতর মধুরতম সুখস্বপ্ন অকস্মাৎ ভঙ্গ হইয়া গেল। অসুস্থ হইয়া পৃথ্বীদেব এই সব্-ডিভিসনের পুত্রাবাস ছাড়িয়া তাঁর বেনারসের দুর্গাকুণ্ড রােডের বাগানবাটীতে সহসাই চলিয়া গেলেন। সঙ্গে তাঁর দুজন চিরসেবক মাত্র গেল। আনন্দনাথের ছুটি নাই, পাওয়াও সম্ভব নয়, তাঁর পত্নী ধরিত্রী দেবীর একান্ত আগ্রহ সত্ত্বেও তাঁর পিতৃপ্রতিম শ্বশুর তাঁকে এবার সঙ্গে লইয়া গেলেন না, ছেলেটি এখনও নিতান্তই শিশু। সুদর্শনাদের পিসিমারা ইতিমধ্যেই সেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন।
আলো সরিয়া গিয়াছে,—যদিও দূরে থাকিয়াও রশ্মি সংহত করে নাই; তথাপি তাহা মৃদু ও ক্ষীণ, ছায়া টিঁকিবে কি লইয়া?
সুজাতা ও সুদর্শনার জীবনযাত্রার ধরাবাঁধা পথ এক নিয়মে চলিতে থাকিলে কি হইবে, সূর্য্যাস্তের সমস্ত রশ্মিচ্ছটা হারাইয়া পৃথিবীর যে দশা হয়, তাদের ঠিক তেমনিই ধারা বিষাদ বিষন্ন করিয়া দিল। তথাপি মনের মধ্যে ঔৎসুক্যভরা আগ্রহের সীমা নাই, এবার দুর্গাপূজার ছুটিতে বহুদিন পরে দেশে যাওয়া হইবে। আঃ! কতকালই যে তারা বাড়ী ছাড়িয়া আসিয়াছে, সুজাতা সেখানে কত আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য কাহিনী শোনায়, কত অপরিচিত অপরিচিতা, পরমাত্মীয় ও পরমাত্মীয়াদের গল্প করে, তাদের কথা সুদর্শনা কিছুই মনে করিতে পারে না। একটা আবছা গোছের ভাসা-ভাসা দু’চারটি কথাই স্মরণপথে মধ্যে মধ্যে ভাসিয়া উঠে মাত্র।
দাদু কাশী যাওয়ার আগেই কার্য্যব্যপদেশে কিছুদিনের জন্য অন্যত্র যাওয়া হইয়াছিল। হাঁটাপথে পাল্কী করিয়া যাওয়া হইল, দুইটি ছোট ছোট নদীতে বোটের উপর পাল্কী তুলিয়া পার করা হইল, সেও বেশ একটা বিচিত্র ব্যাপার। কিন্তু তার চাইতে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল যখন বিশালকায় (সেকালের) শোন নদের উপরকার পণ্টুন ব্রীজের উপর দিয়া তাদের পাল্কী চলিতেছিল। সেদিনের বর্ষার শোন নদ—সে এক ভীষণ ভৈরব মূর্ত্তি। তার গর্জ্জন প্রায় সমুদ্র গর্জ্জনেরই একটি পকেট সংস্করণ, তরঙ্গভঙ্গ উত্তাল। সেদিন অপরাহ্নে বাতাসটা একটু জোরেও হয়ত বহিতেছিল, ওরা দুই বোনে পাল্কীতে বসিয়া স্থির করিল, ঝড় উঠিয়াছে। পাল্কীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দুজনে চুপ করিয়া শুইয়া রহিল, মনে মনে একটুখানি হয়ত ভয়-ভয়ও হইয়া থাকিবে। দাদু তাঁর পাল্কী এদের পাশে থামাইয়া ডাকিলেন, “সুজু-সুনা! একি, দোর বন্ধ করে কি করছো? এমন অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখছো না।” সত্য! অদৃষ্টপূর্ব্ব এক অনির্ব্বচনীয় সৌন্দর্য্যে ভরা সেই অপরাহ্ন প্রকৃতির কি আশ্চর্য্য রূপ! এই জন্যই পথ-প্রদর্শক গুরুর প্রয়োজন—মানুষের জীবনপথের পদে-পদেই প্রয়োজন।
বর্ষার রজনীগন্ধা এবং বহুবর্ণের জিনিয়া ফুলের বিচিত্র শোভাসম্ভারে সারাক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টি মেলিয়া থাকিতে ইচ্ছা করে। সুজাতা বড় কর্ত্তব্যপরায়ণা শান্ত মেয়ে, ইচ্ছাকে সে দমন করিয়া রাখে, কিন্তু সুদর্শনাকে বাগানছাড়া করাও কঠিন! একেবারে সে ফুল-পাগলা। খেলার পুতুলের চাইতে ফুলের পুতুল বানাইয়া সে কত বিচিত্র খেলারই না অবতারণা করিতে পারে! অর্জ্জুনের লক্ষ্যভেদ, রামের হরধনুভঙ্গ, এমন কি রাজসূয় যজ্ঞ অবধি ঘটাইয়া বসে। ফুলের তো আর অভাব নাই, নির্দ্দিষ্ট সংখ্যার পুতুলের মতন তো আর নয়। যত খুসী লোক তৈরি করা যায়।
পাঁচ
শরৎকালের প্রখর সূর্য্য করোজ্জল সুপরিচ্ছন্ন প্রভাত। রেলপথের দুধারে খালবিল হ্রদ তড়াগ খানা ডোবা পুষ্করিণী সমস্তই বর্ষাজলে পরিপূর্ণ হইয়া টলমল টলমল করিতেছে। যেখানে সেখানে জলজ পদ্ম শালুক হেলা ফুলের শ্বেত ও আরক্ত বর্ণ শোভায় জলময় উদ্যানগুলি আলোকিত হইয়া ঝলমল ঝলমল করিতেছিল। কোথাও হেলেঞ্চা শুশুনি কলমীদামে, কোথাও পানিফলের লতায় লতায় অথৈ জল দেখা যায় না, কোথাও নির্ম্মল জলে মৎস্যকুল নির্ভীক আনন্দে বিচরণ করিয়া ফিরিতেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ধানক্ষেত উলটিয়া চুনাপুঁটি প্রভৃতি চারা মাছ সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছিল। জেলেরা জাল ঘুরাইয়া জলে ফেলিতেছে অথবা জাল গুটাইয়া ধৃত মৎস্য ডাঙ্গায় আনিতেছে, নদীর চরে চরে শ্বেত চামরের মত কাশফুলের কি বিচিত্র শোভা! বিপদ এই যে এ-দিকে চাহিতে গেলে ও দিকটায় দেখা যায় না। পাহাড় পর্ব্বত, নদ-নদী, ছোট গ্রাম, কত না’ কি! আবার টেলিগ্রামের তারে বসিয়া দোল-খাওয়া নীলকণ্ঠ, বুলবুলি, বাবুই, কাঠঠোকরা পাখীরা! তারাই কি কিছু কম দর্শনীয়? মাছরাঙ্গা, বক জলের উপর একেবারে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, সুদর্শনা এদের এর আগে কখনও দেখে নাই, সুজাতা দেখিয়াছে বিতোগ্রামে—তার বেশ মনে ছিল, সে-ই এসব চিনাইয়া দিয়া তার বোনের গুরুগিরি করিতেছে।
“দিদি! দিদি। দেখ, দেখ, কতবড় একটা শঙ্খচিল! আচ্ছা ওটা অমন দেখতে কেন? কিরকম যেন।” সুজাতা হাসিয়া বোনের গাল টিপিয়া দিল, “যাঃ, ও চিল কেন হতে যাবে, ওতো শকুনী! ঐ দেখ্ কত উড়ছে, ওদিকটায় হয়ত ভাগাড় আছে।”
“সত্যি? আচ্ছা দিদি! নতুন ঝি যে বলতো, ‘গো-ভাগাড়ে গরু পড়ে,—শকুনির মাথায় টনক নড়ে,’ কেন আমায় ওরকম বলতো তাহলে? ভারী দুষ্টতো? আচ্ছা ওকে দেখাবো মজা।”
“তুই যে গল্প শোনবার জন্যে ওর কাজ হওয়া মাত্তর ওর সন্ধানে সন্ধানে থেকে ডাকাডাকি করতিস্, তাই ওকথা বলত।”
“ইস্! তাই জন্যে ওইরকম বিশ্রী একটা জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করবে? দাঁড়াওনা মজা দেখাচ্ছি বাড়ী গিয়ে।”
“ঐ দেখ, ওকে বলে জলপিপি, ঐ যে জলে সাঁতার কাটছে।”
“বাঃ, বাঃ, কি চমৎকার সাঁতার কাটে, হাঁসদের মতন, না?”
নিজেদের বাড়ীতে ঢুকিয়া সুদর্শনা বিস্ময়ে মূর্চ্ছা যাইবার
জোগাড়! কি চমৎকার প্রকাণ্ড প্রাক্ শোন-নদ ধরণের মস্তবড় নদী! আর কত রকমারি ফুল! প্রকাণ্ড বাগানে অসংখ্য জাতীয় গোলাপ ফুটিয়া যেন দিক সমূহ আলোকিত করিয়া আছে। তার সঙ্গে কত নাম-না-জানা, না-দেখা দেশী-বিদেশী ফুলের কেয়ারি লতার অসংখ্য কুঞ্জ বানানো। দেওয়ালের গায়ে গায়ে এবং থামে থামে স্থানে স্থানে বহু জাতীয় আইভি-খচিত। প্রকাণ্ড দৌড়বার লম্বা বারান্দাটায় বড় বড় বাহারে টবে মনসা জাতের বহুল বৈচিত্র্য অর্কিডের ঝুলন্ত খাঁচা। নাই এমন কিছুই নাই! আনন্দনাথই এ-সবের সৃষ্টিকর্ত্তা, তাঁর ‘বোটানি পড়ার’ এগুলি লব্ধফল, লাইব্রেরীতে ঐরকমই অসংখ্য ইতিহাস সংগ্রহ, নানা দেশের বিচিত্র-বিচিত্র শিলাজাত, হাতির দাঁত, হরিণের, গণ্ডারের, বাঘের ষ্টাফ্ করা মুণ্ড; পাখী—মৃত ও জীবিত দুইয়েরই বিচিত্র সংগ্রহ আছে। এছাড়া তরুলতায় ও ঝুমকা লতায় জড়ানো লোহার রেলিং-ঘেরা কৃত্রিম কানন-গৃহে মৃগযূথ ইচ্ছাসুখে বিচরণ করিয়া ফিরিতেছে। ময়ূর দুইটি অপরাহ্নে মেঘময় আকাশের দিকে চাহিয়া-চাহিয়া কি নাচটাই না নাচিল! কি বিচিত্র ইন্দ্রধনুর মত বর্ণোজ্জ্বল, ছটা-বিস্তারিত ওদের পেখম!
অথচ দুচার দিনেই নূতনত্বের এই বিস্ময়-বিজড়িত নেশার ঘোর যখন কাটিয়া গেল, তখনই সে দেখিল, অনুভব করিল, এই তাদের নিজস্ব ঐশ্বর্য্যময় স্বর্ণপুরীতে সে আর সে সুদর্শনা নয়, পাঁচজন বা পঁচিশ জনের মধ্যে একজনমাত্র। সব্-ডিভিসনের হাকিম-দুহিতা নয়, যে-পথে বাহির হইলেই দুধারী সসম্ভ্রম সেলাম পড়ে, বরং বাসনমাজা ঝিটা পর্য্যন্ত সুবিধা পাইলে খ্যাঁক করিয়া উঠে। তাছাড়া যে কেহই যে কোন কারণেই খ্যাঁক করিতে তৈরি থাকে, ও বলিয়া নয়, এখানের এই দস্তুর,—এর জন্য সবাই প্রস্তুত আছে।
সব চেয়ে বড় কথা, যারা তার জীবনের কেন্দ্র দাদু আর দিদি, তাদের সে এই লোকারণ্যের মধ্যে হারাইতে বসিল। ওখানকার মত দাদুকে তেমন করিয়া তো আর একান্ত ভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর কত কাজ, কত অসংখ্য লোকজন আসে যায়, মাঝে মাঝে লাট-বেলাটের দরবার ইত্যাদিতে বাড়ী ছাড়িয়া যান, ওখানকার মত সুদর্শনা আর তাঁর সহযাত্রিনী হইতে পায় না, সে এখন দশের মধ্যে একজন মাত্র। অভিমানে মন ভরিয়া উঠে। তবে নিত্যকর্ম্ম-পদ্ধতিতে দাদুর সঙ্গ এখানেও নিয়ম-নিয়ন্ত্রিতা, এর কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নাই। সম্মিলিত শিশুবাহিনীর শীঘ্রই সে তার প্রায় সমবয়স্ক পিতৃব্য পুত্রের সহিত একত্রে পরিচালক পদস্থ হইয়া উঠিল।
দুঃখ এবং ফলে ক্রোধ উপজাত হইল তার সবচেয়ে বেশী সুজাতার উপরে। সে এখানে আসিয়া অন্য দলে ভিড়িয়া গেল এবং তার সঙ্গে নেহাৎ দিদিগিরি ফলাইতে লাগিল, সে আর তার অন্তরঙ্গ বন্ধু নয়, বন্ধু হইল মেজদি, সেজদি ইত্যাদিরা। খুব হাসাহাসি চলিতেছে, সে আসিলে সব চুপ! সেও ভিখারী নয়, যাচ্ঞা করিয়া লইবে না, থাকুক ওদের সঙ্গে, নাই ওকে দলে লইল, সেও একটা দল গড়িবে, তবে কথা এই, দিদির অভাব কি পূরণ হইবার?
ছয়
বাড়ীতে উপর্য্যুপরি তিনটি বিবাহ হইয়া গেল। পূর্ণ দুইটি বৎসরও নয়, এরই ভিতরে তিনটি নূতন লোক আসিল একান্ত আপনজন হইয়া। নৃপেন্দ্র, সুকুমার ও সুজিত; এদের মধ্যে সুকুমার ও সুজিতকে পাইয়া সকলেই তৃপ্ত, সুদর্শনার তো কথাই নাই। তার ছাই-পাঁশ আগড়ম-বাগড়ম শোনার অদ্ভুত ধৈর্য্য ছিল সুজিতমোহনের। নিজেও সে যথেষ্ট বকিতে পারে। কত ভাল ভাল ডিটেকটিভের গল্প, এমন কি অত বড় যে কাউণ্ট মণ্টিকৃষ্টোর বিরাট কাহিনী—তাও হপ্তায় হপ্তায় আসিয়া সে তাকে ও সুজাতাকে শুনাইয়াছে। উপহার সে প্রায়ই দেয়। লইতে বড় লজ্জা করে, এ লইয়া যথেষ্ট মান-অভিমানও চলিতে থাকে, অবশেষে না লইয়া ছাড়ান থাকে না, অবশ্য লোভনীয় বস্তুতে ছেলেমানুষ তারও যে কিছুমাত্র লোভ ছিল না, সে কথা কেমন করিয়া বলা যায়? তবে কিনা পরদ্রব্যকে লোষ্ট্রবৎ দেখিতে ওরা নিত্যই আদিষ্ট হয় কিনা, মনে বড়ই কুণ্ঠা আসে।
প্রথমে সুজিত এদের বাজে গল্পই বলিত। একদিন দিদির কাছে একটি ইংরেজী ডিটেকটিভের গল্প শুনিয়া, সুজিত আসিলে সে সঘন ঝঙ্কার তুলিল—“যান যান, কে শুনতে চায় আপনার ছাই-পাশ গল্প! দিদির বেলায় যত ভাল ভাল বেছে বেছে রেখে, আমার বেলায় খোকাখুকির মতন—হ্যাঁঃ, শুনছি আমি তাই।”
সুজিত মুখ টিপিয়া ঈষৎ হাসিল, “তুমি কি খুকি নও?”
আর রক্ষা আছে। সুদর্শনা সর্পিনীর মতই ফুঁসিয়া উঠিল, “তাই না! আমি খুকি? চলুন না দাদুর কাছে, চলুন, কি বলেন তিনি শুনবেন চলুন, মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ ধরেছি না? বাল্মীকি রামায়ণের পদ্যানুবাদ করছি না? আমায় খুকি বলা হচ্চে!”
দারুণ ভীতিপূর্ণ শিহরণের অভিনয় করিয়া সুজিত কহিল, “দেবি! ক্ষম দোষ; মূর্খজনে রোষ নাহি কর। আমি কি জানিব বল মহিমা তোমার!”
“কী ভীষণ দুষ্টু আপনি!” সুদর্শনা ঘুঙুর-গাঁথা মল সঘনে বাজাইয়া সরোষে প্রস্থান করিল। অবশেষে দিদির অশ্রুতপূর্ব্ব ঐ বৃহত্তর উপন্যাসের ঘুষ কবলাইয়া মিটমাট হইল।
সাত
নিতান্ত অল্প বয়সেই সুদর্শনার বিবাহ হইয়া গেল। তার দাদুর একান্ত অনিচ্ছায় রোগাটে ও রুগ্ন এবং সংসার-অনভিজ্ঞা এই তাঁর একান্ত প্রিয়পাত্রীটিকে এত শীঘ্র পরের ভাগ্যে সঁপিয়া দিতে তাঁর গভীর স্নেহ-হিতৈষণাভরা চিত্ত ভালমতে সায় না দিলেও বৎসর তিনেক শ্বশুরঘর করিতে না পাঠানোর কড়ারে ছেলেটির রূপ, গুণ ও চরিত্রের বিশেষ রূপ খ্যাতি শুনিয়া তাঁহাকে সম্মত হইতে হইল। সুজাতা এখন প্রায়ই শ্বশুরবাড়ী যাতায়াত করে। আর একটি খোকা কোলে পাইয়াছে। ছেলেটিকে অবশ্য অর্দ্ধেক দখল করিয়াছে সুদর্শনাই। গভীর স্নেহে মাসিমা তাহাকে দিয়া সন্তান-স্নেহের রসাস্বাদন করিতেছিল, তা এ-যে তাদের জন্মগত অধিকার! যতই সংসার-অনাসক্ত কাব্যিক-মনই হোক, তবু তাদের এ সহজাত-ধর্ম্ম, বাহিরে যাই থাক, ভিতরে জাগ্রত আছেন যে অনাদি জননী। সমবয়সী একটি বোনের বিবাহ দেখিয়া তার একবারটির জন্য বিবাহের সাধ মনে জাগিয়াছিল, কিন্তু শ্বশুরবাড়ী যাওয়া দেখিয়া সখ মিটিয়া গিয়াছিল। নিজের বিবাহের কথা শুনিয়া ভয়ে ভাবনায় শুষ্ক মুখে একা পাইয়া দাদুকে গিয়া বলিল, “আমায় কেন বিয়ে দেবেন দাদু? আপনি যে বলেছিলেন, ঋষিকুমারীদের মতন পৈতে দিয়ে বেদ পড়াবেন আমাকে।”
দাদু উত্তর দিলেন হাস্যমুখেই, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত্ত বিলম্বে বলিলেন, “ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি আর কত দিনই বা বাঁচবো,—তখন তোমায় কে দেখবে? আরূঢ়-পতিত হয়ে যাবে যে। নাঃ, এ ভালই হবে। ছেলেটি খুব সৎ ও বিদ্বান, দুঃখ তুমি ওর হাতে পাবে না।”
এই তো তার বেদবাক্য! দাদু যখন ‘ভাল’ বলিতেছেন, নিশ্চয়ই তার ভাল হইবে। সুধীরকে সে যদিও চোখ তুলিয়া দেখে নাই, তবে আবছা দেখায় বুঝিয়াছে চেহারাখানা তার ভাল। তবে তাকে কথা কহাইতে চায়, এই যা’ বড় দোষ! সুদর্শনা মুখচোরা মোটেই নয়, বরঞ্চ মুখরাই,—কিন্তু কে জানে কেন এর কাছে আবোলতাবোল বকিতে একটু যেন বাধবাধ ভাব হয়। তাছাড়া দরজার বাহিরে এ বাড়ীর মেয়েরা ‘আড়ি পাতিতে’ খুব ওস্তাদ! শ্বশুর বাড়ীর দুটিরাত্রে পড়াশোনা, শিবপূজার কথা, ভাইবোনদের পরিচয় সে দিয়াছে, শুধু শেষের রাত্রে সুধীর তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছিল, “আমায় তোমার খারাপ লাগছে না?” সে উত্তর দিয়াছিল, “খারাপও না,—ভালও না?’ এই লইয়া তার ক্ষুদে-ননদটি হাসিয়া হাসিয়া গালে একটা ঠোনা মারিল, চোক পাকাইয়া বলিল, “ইস্ ‘খারাপও না, ভালও না’ কেনগা? আমার অমন সুন্দর দাদা, ‘ভালও না’র মানে?”
তা’ হলে কথা কওয়াত মুস্কিল! সরল-সত্যকথা বলিতেই যে দাদু এ যাবৎ তাকে শিক্ষা দিয়াছেন। ‘মন-রাখা’, ‘অর্দ্ধ সত্য’ অথবা মিথ্যা বলা ত ওর অভ্যাস নাই।
বাড়ী ফিরিবার পর সুজিত যখন আসিয়া প্রশ্ন করিয়া বসিল, “কিগো দর্শনা, বরটিকে কেমন লাগলো?”
সে সগর্ব্বে দ্বিধাশূন্যচিত্তে তৎক্ষণাৎ জবাব করিল, “ছাই”!
“ছাই?—কি ছাই? তোমার মনটা ছাই? না, আমার যে মুখ অমন অসঙ্গত প্রশ্ন করে, তা’তেই ছাই?”
“যান! বড় আপনি ইয়ে হয়েছেন, আপনার সঙ্গে আর একটি কথা আমি কইবো না, এই সোজা বলে দিচ্চি!”
“পুঁজি করে রাখা নেহাৎই দরকার, বাজে খরচ কেনই বা করবে, সে তো জানা কথাই। আমি কিন্তু কইবো, যতই তুমি মুখে ছাই ঢালো না কেন।”
সুদর্শনা রাগে গর গর করিয়া ঝঙ্কার ঝাড়িল, “মাগো! কি বিশ্রী মন আপনার। আমি কখন আপনাকে ওকথা বল্লুম? দিদিকে বলে দেবো,—আজকাল আমায় আপনি বড্ড জ্বালাচ্ছেন। কেন, আর কি কোন কথা নেই?”
সুজিত শান্ত-গাম্ভীর্য্যের সহিত চিন্তার ভাণ করিয়া বলিতে লাগিল, “আর কোন কথা,—হ্যাঁ, আছেই ত, সে ভদ্রলোক আসছেন কবে? তুমি বা সেখানে কবে যাচ্চো—”
আর রক্ষা আছে! সাপের লেজে পা পড়িল! সুদর্শনা গরম তেলে-পড়া বেগুনের মত ছ্যাঁক করিয়া উঠিল, “তা’ আর নয়! আমি আবার যাচ্চি ওদের বাড়ী! দাদু আমায় সেখানে যেতে দেবেন না, কষ্টে দাদুকে ছেড়ে তিনটি দিন ছিলুম, সে আপনি কি করে বুঝবেন।”
সুজিত মুখ টিপিয়া হাসিল,—“আর দাদু যদি দিদিটির মতন ঠেলে পাঠিয়ে দেন?”
সাহঙ্কারে উত্তর দিল, “সব্বাই দিদি নয়গো! ও যেমন ভাল মেয়ে, আমি তো সেরকম নই; আমি যাব না, দাদুর পা’ধরে পড়ে থাকবো,নড়বোই না।”
“দাদু যদি নড়া ধরে তুলে ব্রুহ্যামে পুরে দোর বন্ধ করে দেন? পাহারাওলা সঙ্গেই তো থাকবে, সে তখন ম্যানেজ করে নেবে। কেউ কারু হক ছাড়ে? আমি কি ছেড়েছি?”
সুদর্শনার অভিমান কানায় কানায় ভরিয়া উঠিতেছে, কোনমতে আত্মাহঙ্কার বজায় রাখিতে চাহিয়া প্রবল বেগে মাথা নাড়া দিল,—“আমি যাবো না।” চোখে জল ভরিয়া আসিয়াছে এবার বুঝি পড়ে পড়ে।
সুজিত ঈষৎ অপ্রতিভ হইল, নরম সুরে কহিল, “তুমি একটি পাগল!”
“আপনি? আপনি একটি—”
“কি? থামলে কেন? গর্দ্দভ?”
এবার সজল চোখের মেঘে শরতের রৌদ্র ফুটিয়া উঠিল, “আহা, তাই কি কখনও বলতে পারি? আপনি হচ্চেন বড় ভগ্নিপতি, বয়সে কত বড়।”
সুজিত সজোরে হাসিয়া ফেলিল, “বলছিলে-ত, আবার বিনয় দেখাচ্ছেন।”
সুদর্শনা নিজেকে জয়ী বুঝিয়া সংহত অভিমানে বিনীত বাক্যে জানাইল, “সেই জন্যেই ত বল্লাম না। যাকগে পাঁচ-পরেদের কথা থাক, অনেকদিন আপনি একটা গল্প বলেননি, আজ তো এখানে খেয়ে যাবেন, খাবার পর গল্পের আসর যদি না বসে তাহলে কিন্তু ভীষণ আড়ি দেবো। দাদুর কাছে অনেকক্ষণ যাইনি, আমি চল্লাম।”
বিবাহিত জীবন তাহাকে কোন ফ্যাসাদে ফেলে নাই। সেই পণ্ডিতমশাই, মাষ্টারমশাই ও দাদুর কাছে সংস্কৃত কাব্যপাঠ চলে। সুধীর দৈবাৎ নিমন্ত্রিত হইলে রাত্রিবাসের নিমন্ত্রণ সে পায় না। সাঙ্গোপাঙ্গো সঙ্গে সুদর্শনা সাজসজ্জা করিয়া দ্বিপ্রহরে একবার দর্শন দিয়া আসে। এ একরকম মন্দ নয়। উপরন্তু শ্বশুরবাড়ীর বস্ত্রালঙ্কার, তত্ত্ব-তাবাস তা নেহাৎ মন্দ আসে না। ওদিকে তার খুব বেশী লোভ না থাকুক, তবু সে যতই হোক, ভিতর হইতে মেয়ে বই তো আর ছেলে নয়। অলক্ষ্যে অলক্ষ্যে প্রকৃতি ঠাকুরাণী তার ভাঙ্গাগড়া কাজটুকু নীরবে সমাধা করিতে তো আর ছাড়েন না। এত আস্তে সে মেসিনটি চলে, বাহিরে নিঃসাড় নীরব, কেহ কিছু জানতেও পারে না।
অকস্মাৎ বসন্তের সাজানো বাগান প্রচণ্ড ঘূর্ণি-বাতাসে লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল। সৌরপতি রাহুগ্রস্ত হইলেন। অনারোগ্য আয়ুক্ষয়কর রোগে পৃথ্বীপতি ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি হারাইতে লাগিলেন। দেশ-বিদেশের সমস্ত গণ্যমান্য ডাক্তার কবিরাজ কিছুতেই কিছু করিয়া উঠিতে পারিল না। সেবা যত্ন যতদূর সম্ভব তার কোনই ত্রুটি নাই। বায়ু পরিবর্ত্তন, ঘরের বজরায় গঙ্গাবক্ষে বায়ু সেবন—সবই হইল, শেষে একদিন সেই অমূল্য জীবন-প্রদীপটি নির্ব্বাপিত হইয়া গেল। সজ্ঞানে সানন্দে সর্ব্বকর্ম্মসমাপ্তির প্রশান্ত পরিতৃপ্তির সহিত সে যেন মহাপ্রস্থান, মৃত্যু নয়,—অমরত্বের পথে বিজয়যাত্রা! কিন্তু এখানকার আলো নিবিল।
এই যে ব্যাপারটি ঘটিয়া গেল, যদিও প্রায় বর্ষাবধিই ইহার ভীষণ সম্ভাবনায় বাড়ীশুদ্ধ লোকই ভিতরে বাহিরে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা অনুভব করিয়া আসিতেছিল, তথাপি যে মুহূর্ত্তে সেই সন্দিগ্ধ সম্ভাবনার বিষয়টা বাস্তবমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিল, প্রত্যেকের উপর সে যেন একটা আকস্মিক আঘাতের মতই পতিত হইল। বিশেষ করিয়া সুদর্শনা—অতর্কিত আক্রমণে মানুষ যেমন দিশা হারায়, যেন সেইরকম আকুল হইয়া পড়িল। দাদু, তার চিরদিনের দাদু, যার বাড়া তার আর কিছুই বড় ছিল না, প্রিয় ছিল না, সত্য ছিল না,—সেই দাদু! অত মহৎ, অত মহান, অমন স্নেহময় সেই দাদু যে এমন করিয়া সত্য সত্যই একদিন তাকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে পারেন, এতদিন ধরিয়া এতখানি দেখিয়া শুনিয়াও সে যেন ভাল করিয়া তাহা ধারণা করিয়া লইতেও পারে নাই। রোগ যতই কঠিন হোক, চিকিৎসকের যতবড় হাটই এ বাড়ীতে বসুক, মন যে তার অটুট বিশ্বাসে দেব-দেবীদের পায়ের তলায় মাথা কুটিয়া বরাবর অভয় পাইয়া আসিয়াছে। কিছুতেই সে চিত্ত বলহারা হয় নাই। দাদুর মত এত বড় জীবন কখন কি একেবারে নিঃশেষ হইয়া যাইতে পারে? এত বড় অবিশ্বাস্য ঘটনাকে বিশ্বাস করিবে কে?
কিন্তু যা অসম্ভব তাও সম্ভব হইল। সুদর্শনার মনে হইল এর পর আর তার বাঁচিয়া থাকিবার কোন প্রয়োজনই বাকি রহিল না। যে পৃথিবীতে তার দাদুর স্থান হয় নাই, সেখানে তারই বা স্থান হয় কেন? যে দেবতা দাদুকে তাঁর কাছে তাকে বঞ্চিত করিয়া টানিয়া লইয়াছেন, কিসের অবিচারে তিনি তাকে এখানে ফেলিয়া রাখিয়াছেন? কি অধিকার আছে তাঁর এত বড় পক্ষপাত করিবার? সারাদিন ভূমে লুটাইয়া ক্রমাগতই সে আত্মগত এই প্রশ্ন করিয়া বলিতে লাগিল, এমন করিয়া বাঁচিয়া থাকার সার্থকতা কি?'—এই প্রশ্নের উত্তর কেহই তাহাকে দিতে পারে নাই। কারণ কাছে তার কেহই ছিল না, —সে একাই আপনাকে,—শুধু—একমাত্র আপনাকেই এই প্রশ্নবাণে জর্জ্জরিত করিয়া তুলিতেছিল। উত্তর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হয়ত উহ্যভাবে মনের মধ্যে ছিল, কিন্তু উত্তর পাওয়ার কোন উপায়ই তো ছিল না। আর উপায় থাকিলেই বা কি?
এ প্রশ্ন এই পৃথিবীতে আজই কি নূতন করিয়া উঠিল? অনেকেই এর বহু বহু পূর্ব্বেই, এমন কি, খুব সম্ভব এ প্রশ্ন চিরদিন ধরিয়াই করিয়া আসিয়াছে। উত্তর কেহই এ পর্য্যন্ত পাইয়াছে কি? খুব সম্ভব পায় নাই। এমন করিয়া বাঁচিয়া থাকার সার্থকতা কি? বাস্তবিকই প্রশ্নটা বড়ই কঠিন। দুঃখ, দৈন্য, দুর্ব্বিপাকে ভরা মৃত্যুময় এই সংসারে রোগের অসহ্য যন্ত্রণা, শোকের দুর্ব্বিসহ আঘাত, অভাবের অকথ্য তাড়না, সর্ব্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষেরই অমানুষিক অবিচার ও অত্যাচার,—এত সব সহ্য করিয়াও মানুষ বাঁচিয়া থাকে কেমন করিয়া? বাঁচিয়া থাকে কেন? বুঝিয়া ওঠা কঠিন বই কি! অথচ দেখা যায়—সদা সর্ব্বদাই দেখা যায়, তেমন করিয়া বাঁচিয়া থাকা সার্থক হোক বা অসার্থক হোক, মানুষ বাঁচিয়াই থাকে,—সকল অবস্থা অতিক্রম করিয়াও বাঁচে। মুখে মৃত্যুর কথা বলিলেও এমন কি খুব তীব্রভাবে মনে করিলেও বাঁচিয়া থাকার স্পৃহাই তাদের মধ্যে সমধিক প্রবল, অবচেতন মনের মধ্যে সে স্পৃহা যে কেমন করিয়া কোথায় লুকানো থাকে, সে খবর সে নিজেও তা আর জানিতে পারে না, তাই তো কোন অবস্থাতেই মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে যথার্থভাবে মৃত্যু কামনা করে না। আকস্মিক একটা ক্রোধ বা মোহের বশে,—মধ্যে মধ্যে দেখা যায় সে আত্মহত্যাও করিয়া বসে বটে, কিন্তু সে রকম ক’জনেই বা করে? আর করিলেও যারা করে তারাও প্রকৃতিস্থতার মধ্য দিয়া তাহা করিতে পারে না। সাময়িক উন্মত্ততার মধ্য দিয়াই এমন অমানুষিক কাজটা করিয়া বসে।
হ্যা, বাঁচিয়া থাকাতেই মানুষের সুখ! সে যে মৃত্যুর কথা বলে বা ভাবে সে শুধু জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার বশে নয়,—বিড়ম্বিত জীবনের একান্ত অভিমানেরও ফলে নয়, এতদিন ধরিয়া যে অপ্রতিহত সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে সে সমাসীন ছিল, আজ তাহা হইতে বিচ্যুত হইয়া কোন অনির্দ্দেশ্য জীবনের জটিল জালে বিজড়িত হইবার একটা নিদারুণ আতঙ্ক-মিশ্র দুর্ভাবনা তার চিত্তকে আচ্ছন্ন করিয়া দেয়। সুদর্শনার ঠিক এই অবস্থাটাই ঘটিয়াছিল। দাদুহীন পৃথিবী যে তার পক্ষে একান্ত নূতন, এই নূতন অবস্থাটাকে সে ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখিতেছিল, নতুবা মরণের জন্য তার মনে সত্যকার আগ্রহ জাগিয়া ওঠা সম্ভবপর মনে হয় না। এই ত তার সবেমাত্র কিশোর বয়স মাত্র, এ বয়সে অন্তর হইতে কখনও মৃত্যুর আহ্বান শোনা যায়?
সুদর্শনা তার দাদুকে যেমন করিয়া তার সর্বান্তঃকরণ দিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল, তেমন হয়ত আর কেহ পারে নাই। তার দিদি সুজাতাও তাঁকে দেবতার মতই ভক্তি করিত, তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা অন্তরের মধ্য হইতে ঢালিয়াও দিয়াছিল, কিন্তু ধৈর্য্যশীলা ও শান্ত প্রকৃতির মেয়ে সে, অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত অন্তর্প্রবাহিনী, বাহিরে সকল অবস্থাকেই সে ধীরস্থির ও নীরব সংযমের সহিত গ্রহণ করিতে পারে। তার উপর স্বামীর প্রেমে, সন্তান-স্নেহে সে পত্নী ও জননীর কর্ত্তব্য লইয়াও কতকটা আত্মবিস্মৃত। নিজের দুঃখ লইয়া তাহাকে একান্তভাবে লালন করিয়া বেড়াইবার অবসরই বা তার কোথায়? বরং সে এই মহাপ্রলয়ের মধ্যে বাবার জন্য, পিসিমাদের জন্য, বিশেষতঃ গভীর শোকে সমাচ্ছন্ন বোনটির জন্যই আপনাকে সঁপিয়া দিয়াছে। বিরাট শ্রাদ্ধ-ব্যাপারের সুবিপুলতর আয়োজনের মধ্যেও শ্রদ্ধান্বিতা পূজারিণীরূপে নীরব অশ্রুজলে অভিসিঞ্চিতা হইয়া যথাকর্ত্তব্য করিতে করিতে আত্মপ্রতিষ্ঠ হইতে সচেষ্ট আছে।
সুদর্শনার শোক কিন্তু সহজবোধ্য নয়। সে এ পর্য্যন্ত দাদু ভিন্ন আর কোন সম্পর্কের মধ্যে খুব নিবিড়ভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া দিতে পারে নাই। এমন কি, দিদি ব্যতীত আর কোনখানেই নিজের কোনরূপ দাবীও সে এ পর্য্যন্ত ভাল করিয়া প্রতিষ্ঠা করে নাই। একমাত্র দাদুকেই সে তার সমুদয় চিত্ত-প্রাণ সমর্পণ করিয়া দিয়াছিল। সেই দাদুকে ছাড়িয়াও যে সে বাঁচিয়া থাকিতে পারে, এই অভিজ্ঞতা তাহাকে সুগভীর বিস্ময়ে এবং সুকঠোর ধিক্কারে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। এও কি হয়? এও কি সম্ভব? নিজেকে সে কঠিন কণ্ঠে পুনঃপুনঃই এই প্রশ্ন করিয়া নিজের প্রতি অশ্রদ্ধায় যেন বিতৃষ্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল। মনে মনে বার বার করিয়াই বলিল, “ধিক! এই তোমার অত ভালবাসা? তুমি মরিয়া গেলে দাদু কিন্তু কখনই এমন করিয়া সহ্য করিতে পারিতেন না!”
আশৈশবের শত সহস্র অবিস্মৃত স্মৃতি যেন সহস্রফণা ফণীর মতই তাহার সমস্ত মনটাকে বিষ দন্ত দিয়া সবলে দংশন করিতে লাগিল। সে কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না, ইহার পর সে বাঁচিয়া থাকিবে কেমন করিয়া, কাহাকে লইয়া এবং কাহারই বা জন্য?
অন্যান্য অনেকেরই মত এ ব্যাপারে নিমন্ত্রিত হইয়া সুধীরও এ বাটীতে আসিয়াছিল। কয়েকদিন ধরিয়াই সে দানসাগর শ্রাদ্ধের সমারোহের মধ্যে সকলের সঙ্গে মিশিয়া রহিয়া গেল। কাজকর্ম্ম সব শেষ হইবার পর একদিন সুযোগ মিলিলে সে সুদর্শনার শোকসংবিঘ্ন মুখের দিকে চাহিয়া স্নেহ পরিপূর্ণ সহানুভূতির সহিত কহিল, —“শুনলুম, তুমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছো না, খাওয়া-দাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছ; কিন্তু সকলের কথাও তো তোমার ভাবা উচিত। দাদুকে কি তুমি একলাই হারিয়েছো? আমাদের কি কিছুই খোয়া যায়নি?”
একান্ত দুঃখের সহিত উচ্চারিত এই কথাগুলি সুদর্শনা স্তব্ধ থাকিয়াই শুনিল। শুনিতে শুনিতে অকথ্য বেদনার সহিত তার মনে হইল, যে লোক তাকে এই সামান্য কয়টামাত্র দিনই দেখিতে পাইয়াছে, সে যখন এমন বিষাদিত কণ্ঠে তাঁর সম্পর্কে কথা বলিতেছে, তখন তার দুঃখ যে কত বড় তার কি কোন হিসাব করা চলে? উঃ, এ যেন কিছুতেই সহ্য করা যায় না।
তবু যেদিন দুজনকার চোখের জল একসঙ্গে মিলিত হইয়া সেই যে একই খাতের মধ্যে দুই চিত্তধারাকে একত্রে বহিয়া আসিতে সহায়তা করিল, ইহা তুচ্ছ নয়। জীবনে এই সর্ব্বপ্রথম তার মনে হইল, বিবাহের পর হইতে এই বাৎসরিক কাল ধরিয়া এ লোকটিকে সে যতটা দূরবর্ত্তী বলিয়া জানিত, হয়ত এ তা নয়। এই দেড় বৎসরের মধ্যে ধীরে ধীরে কখন যে কেমন করিয়া এই চির অপরিচিত পরের চেয়েও পর তার নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহা জানিতেও ত কই পারা যায় নাই? আজ সবার চাইতে এই সত্যটাই তার চিত্তকে যেন ঈষৎ ভারমুক্ত করিল যে, হয়ত অল্পকালের মধ্যে এই লোকটি তার দাদুকে সত্য করিয়াই ভালবাসিয়াছিল। হ্যাঁ, ভাল না বাসিলে তার গলার স্বরে হৃদয়ের ওই আবেগ স্পন্দন কখনই এমন সত্যের সুরে ধ্বনিত হইতে পারিত না! আলো নিবিয়া গেলে মানুষ ছায়ার পিছনে ছুটিয়া বেড়ায়। নিঃসঙ্গ সে যে থাকিতে পারে না।